সাগর-শুক্তি
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
পায়ের পাতা ডোবা জলের মধ্যে হেঁটে যাওয়া মেয়েটি সোজাসুজি তার দৃষ্টির সামনে আসতেই মেয়েটিকে চিনতে পারলো বিভাস। গত কয়েকদিন ধরেই এখানে ওখানে মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে। এই প্রথম ওর সঙ্গীকে ওর সঙ্গে দেখা যাচ্ছে না। মাণ্ডবী নদীতে পূর্ণিমার ক্রুইজে চাপাগলায় ওদের সংলাপ শুনে বিভাস নিশ্চিন্ত হয়েছে যে, ওরাও বাঙালী। আজ সকালেই এই মেয়েটিকেই নিজের রিসর্টে আবিষ্কার করে বিভাস বেশ অবাক হয়েছিল। সঙ্গে এক বিপুলাকৃতি চল্লিশের কাছাকাছি সঙ্গীও ছিল ওর সঙ্গে। ওরা একসঙ্গেই এসেছে। স্বামী-স্ত্রী হতে পারে। যদিও মেয়েটির চেহারায় এবং আচরণে বধূ সুলভ ব্যাপার-স্যাপার ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। শাঁখা-সিঁদুরের ব্যাপারটা আজকাল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়। হিন্দুও না হতে পারে। তবে বিবাহিতা মেয়েদের সিঁদুরে শাঁথায় খুব একটা খারাপ লাগে না বিভাসের। অন্তত: প্রসাধন হিসেবে। সংস্কার বশত: নয়।
চার পাঁচদিন ধরে যথাসম্ভব একটার পর একটা বিচ ঘুরে বেড়িয়েছে বিভাস। পর্তুগীজ আমল থেকে হাল আমলের ইতিহাস সংগ্রহ করেছে। গোয়ার বিখ্যাত গীর্জা, মন্দির, ওয়াইল্ড-লাইফ স্যাংচুয়ারী, রিজার্ভ ফরেস্ট সহ দ্রষ্টব্য প্রায় সবকিছুরই ছবিও তুলেছে অসংখ্য।
প্রতিটি বিচই মনোরম। পায়ের নীচে নরম সোনালি বালি। পাড়ে নারকেল আর পাম গাছের ঘন সবুজ জঙগল। সীগাল মাঝে মাঝেই নেমে আসছে ঘন নীল সমুদ্রের বুকে। পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ছে সফেন সমুদ্রের ঢেউ। প্রকৃতির এই বিশাল প্রেক্ষাপটে নিজেকে বারবার বড় ক্ষুদ্র, বড় অকিঞ্চিত্কর মনে হল বিভাসের।
শহর লাগোয়া এই ডোনাপাওলা বিচে বিকেলের দিকটায় বিভাসের বেশ ভাল লাগছিল। নীল সমুদ্রের বুকে বিকেলের অস্তরাগের ছোঁয়ায় অপরূপ রঙবদলের খেলা তন্ময় হয়ে দেখছিল সে। মনে মনে ভাবছিল, পর্তুগীজ ভাইসরয়-কন্যা ডোনা আর তার সাধারণ এক গোয়ানিজ প্রেমিক পাওলা'র কথা। তাদের দুরন্ত প্রেম সমাজ মেনে নেয়নি। লৌকিক জীবনে যে প্রেম ব্যর্থ হল সেই প্রেম পরপারে সফল হবে--এই গভীর বিশ্বাসে তারা একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে ঝাঁপ দিয়েছিল গভীর সমুদ্রে। আজও ডোনাপাওলা বিচ তাদের প্রেমের ইতিহাস বুকে নিয়ে বেঁচে রয়েছে।
মেয়েটিকে এখন সেলুলয়েটে ধরা রহস্যময় জীবন্ত ছবির মতো দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে নীচু হয়ে ঝিনুক খুঁজছে কি? ধীরে ধীরে বেশ দূরে চলে যাওয়া পর্যন্ত বিভাস মেয়েটিকে লক্ষ্য করছিল। আগ বাড়িয়ে আলাপ জমানোর ব্যাপারটা ওর ঠিক আসে না বলেই মেয়েটির সঙ্গে আলাপ হয়নি। হয়তো আরো অনেক বাঙালী এই মুহূর্তে গোয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকেই হয়তো পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। কিন্তু বিভাস একলা এসে গত পাঁচদিনে এখনো একলাই রয়ে গেল। বিভাসের এই ব্যাপারটার জন্যেই সঞ্জয় বলেছিল যাকে হোক একজনকে সঙ্গে নিতে। বিভাস অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই সঞ্জয়কে ওর সঙ্গী হিসেবে চেয়েছিল। বলেছিল, আমার সঙ্গে চল্। সব খরচ আমার। কিন্তু নামী কাগজের অতিব্যস্ত সাংবাদিক সঞ্জয় আসতে পারেনি। প্রথমত: সময়ের অভাব। দ্বিতীয়ত: স্ত্রী-কন্যাকে ফেলে গোয়া ভ্রমণের ইচ্ছা ওর ছিল না। বিভাসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলতে সঞ্জয়। অজস্র বন্ধু-বান্ধব ওর ছিল না। অগত্যা একলাই দিন সাতেকের জন্যে বেরিয়ে পড়লো।
এয়ারপোর্ট পর্যন্ত লিফট্ দিতে এসে সঞ্জয় গোটা পাঁচেক খাম ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল--বেস্ট অফ লাক্। আপাতত: এই পাঁচটা খাম এসেছে। আমি অবশ্য উঁকি মারিনি একদম।
মৃদু হেসে অক্ষত খামগুলো পকেটে রেখে দিয়েছিল বিভাস।
--তাহলে সত্যি সত্যি একলাই চললি! এত করে বললাম একজনকে সঙ্গে নিয়ে যা। গোয়ার মতো রোমান্টিক সেক্সি জায়গায় একা একা ঘুরে বেড়াবি, ভাবতেও কেমন অশ্লীল ব্যাপার মনে হচ্ছে কিন্তু!
--আমি কলেজে পড়াই। আমাকে ওসব মানায় না। ঠিক হজমও হবে না। চব্বিশ ঘন্টা টেনশ্ ক্লান্তি এসব দূর করতে দু'চারদিনের বেপরোয়া রিলিফ সাংবাদিক শিল্পপতি পলিটিসিয়ানদেরই মানায়। এসব তোদের স্ট্যাটাস সিম্বল। আমার মতো পেতি মিডলক্লাসের পক্ষে--
--কিস্যু হবে না তোর। চল্লিশে পা দিলি--এখনো ব্যাচেলর। ভাবা যায়!
ঠাট্টা করলেও সঞ্জয় জানে ওর পরিচিত জগতে বিভাস একেবারে অন্য মানুষ। যৌবনের সোনার দিনগুলোতে চুটিয়ে টিউশনি করতে হয়েছে। ভাই-বোনকে মানুষ করেছে। বিয়ে দিয়েছে। একটা ছোট হলেও সুন্দর বাড়িও করেছে। এসবের ফাঁকে ফাঁকে ডিগ্রী বাড়িয়েছে। ডক্টরেট করেছে। ওর লেখার হাতও চমত্কার। সঞ্জয়ের কাগজে মাঝে মাঝে ফীচার লেখে। সংসারে এমন মানুষ দু'একটা থাকে যাদের চতুর মানুষরা নির্বোধ বলে।
বিয়ের প্রয়োজনীয়তা এবং সবিশেষ উপকারিতা সম্পর্কে সস্ত্রীক সঞ্জয়ের পক্ষ থেকে বিভাসকে সচেতন করার ঠেলায় শেষ পর্যন্ত বিয়েতে রাজি হয়েছে বিভাস। সাজিয়ে গুছিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল সঞ্জয়ই ওর কাগজে। বিভাসের শর্ত অনুযায়ী সঠিক বয়সেরে উল্লেখ করতে হয়েছে। বিভাসের দৃঢ় বিশ্বাস চল্লিশের ঘরে পা দেওয়া পাত্রের জন্যে দু'একজন ডিভোর্সি কিংবা বিধবা ছাড়া আর কেউ যোগাযোগ করবে না। তাই কাগজের পোস্ট বক্সে আসা গোটা পাঁচেক চিঠির ব্যাপারে বিশেষ কোনো আগ্রহ ওর দেখা গেল না।
গোয়ায় এসে প্রথমেই বিভাসের মনে হয়েছিল এখানে না এলে সত্যি বড় আক্ষেপ থেকে যেত। মুম্বাই থেকে বিমানে মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিটেই পানাজি পৌঁছুনো যেত। কিন্তু সঞ্জয় বলেছিল রাত দশটার কোঙ্কন রেলে চেপে মরাগাঁও স্টেশন পর্যন্ত যেতে। রাতের অন্ধকারে প্রচুর সুড়ঙ্গ পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই আরব সাগরের নীল জল ভোরের আলো মেখে ট্রেনের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা শুরু করে দিতেই বিভাস মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। জঙগল ঘেরা নীল সমুদ্র আর ১০৫ কিলোমিটার মনোরম বেলাভূমি দেশ বিদেশের এত পর্যটক কেন টানে বুঝতে দেরি হয়নি।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে চারপাশ বেশ অন্ধকার হয়ে উঠতেই বিভাস উঠে পড়লো। মেয়েটিকে আর দেখা যাচ্ছে না। রিসর্টেই ফিরে গেছে হয়তো।
পরদিন সকালে মাজোরডা বিচে বেড়াতে বেড়াতে ও মেয়েটির কথা ভাবছিল বিভাস। ভেতরে ভেতরে একটু অবাক হচ্ছিল। আজ পর্যন্ত অচেনা অজানা কোনো মেয়েকে নিয়ে ও মাথা ঘামায়নি। অসাধারণ সুন্দরী না হলেও মেয়েটি বেশ লাবণ্যময়ী এবং সাধারণভাবে সুশ্রীই বলা যায়। সাজপোষাকেও উগ্রতা নেই। সাধারণ বাঙালী মেয়েদেরই একজন বলে মনে করায় কোনো অসুবিধে নেই। বার কয়েক দেখা এই মেয়েটি মাঝে মাঝেই ওর ভাবনায় উঠে আসছে বলে বিভাস অবাকই হচ্ছে। বিয়ের ব্যাপারে শেষপর্যন্ত রাজি হওয়ার কারণেই এমনটা হচ্ছে কিনা কে জানে! মেয়েদের ব্যাপারে অবদমিত কৌতুহল হয়তো মাথা তুলতে চাইছে।
মাজোরডা বিচে নানারকমের ঝিনুক কুড়িয়ে জমা করছিল বিভাস। শেষরাতের জোয়াড়ে সমুদ্র এখানে অনেকটা এগিয়ে আসে। ভাটার টানে যখন সমুদ্র আবার অনেক দূরে সরে যায় তখন সৈকতে ছড়িয়ে যায় নানারকমের ঝিনুক।
সমৃদ্র এখানে অনেক শান্ত। জমাতে জমাতে ঝিনুকের একটা ছোটখাট পাহাড় হয়ে গেছে। বিভাস চাইছিল সবগুলোই সঙ্গে নিতে। কিন্তু কাঁধের ঝোলা ব্যাগটা ছাড়া সঙ্গে আর কিছুই নেই। তাও ব্যাগের মধ্যে রয়েছে গোটাকয়েক বই একটা হালকা চাদর। শেষপর্যন্ত ওগুলো কোনোরকমে বগলদাবা করে ব্যাগের মধ্যে যতটা পারলো ঝিনুক ভরে নিল। সংগৃহীত ঝিনুকের এক তৃতীয়াংশও নেওয়া গেল না। কত ঝিনুক বহু যত্নে বালি মুছে সংগ্রহ করেও বেলাভূমিতেই ফেলে যেতে হয়। কুড়োবার সময় মনে হয় না একটাও ফেলে যেতে হবে!
ডোনাপাওলা বিচে কাল শেষ বিকেলের পর রিসর্টেও আর মেয়েটিকে দেখা যায়নি। সকালে অবশ্য খুব ভোরেই বিভাস বেরিয়ে এসেছে। মেয়েটি হয়তো রিসর্ট ছেড়ে চলে গেছে। কথাটা মনে হতেই নিজের ঘড়ির দিকে তাকালো বিভাস। বারোটা বাজে। বিচও প্রায় ফাঁকা। রিসর্টের দিকে পা বাড়ালো বিভাস।
রিসর্টে পা দিয়েই থমকে দাঁড়াতে হল। রিসেপশনের সামনে একটা জমাট জটলা। একপাশে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেয়েটি। শরীরের কম্পন দেখে বোঝা যাচ্ছে মেয়েটি কাঁদছে। সমস্যাটা বোঝার চেষ্টায় বিভাস রিসেপশনিস্ট যুবকটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। চারপাশের লোকজনের মধ্যে কেউ বাঙালী আছে কিনা বোঝা গেল না। সকলেরই গলায় মাতৃভাষার উত্তেজনা। কিন্তু অ আ ক খ নেই! বিভাস অগত্যা রিসেপশনিস্ট যুবকটিকে আন্তর্জাতিক ভাষায় জিজ্ঞেস করলো--
--কি ব্যাপার, এত হৈ চৈ কেন?
--টেরিবল্ ব্যাপার স্যার। এই মহিলার সঙ্গী মি: বাসু গোয়া ছেড়ে চলে গেছেন।
--তার মানে?
--মানে বাসু ওঁকে কিছু বলে যান নি। রিসর্টের বিলও পেমেন্ট করে যাননি। এখন পুলিশের হাতে ওঁকে তুলে দেওয়া ছাড়া তো কোনো উপায় দেখছি না!
--মি: বাসুর বাড়িতে মানে কলকাতায় আপনারা যোগাযোগ করছেন না কেন?
--হাউ ফানি! উনি সম্ভবত: এখনো রাস্তায়। তাছাড়া একটা নাম ঠিকানা এখানে থাকলেও সেটা যে ওরিজিনাল নয় সেটা আমরা বুঝতে পারছি। কোন ফোন নাম্বারও দেননি উনি। আমাদের ধারণা ওঁর নামটাও সঠিক নয়।
--সে কী! তাহলে তো--
--রিসর্টের বিল বাবদ প্রায় চার হাজার টাকা ইনি পেমেন্ট করে দিলে আমরা পুলিশে যাব না। কিন্তু ওঁর কাছে তো শ'খানেক টাকাও নেই। ইনফ্যাক্ট--সেরকম এক আধটা অর্নামেন্ট পর্যন্ত নেই --
স্তম্ভিত হয়ে গেল বিভাস। মাত্র হাজার চারেক টাকার জন্যে এই বাঙালী মেয়েটি যে নিজেই ভয়ানকভাবে বিপদাপন্ন তাই নয় গোটা বাঙালী সমাজের মান সম্মানের পক্ষেও যথেষ্ট বিব্রতকর। ভেতরের নির্ভেজাল আদর্শবান শিক্ষক-চেতনা বিভাসকে রীতিমতো বিচলিত করে তুললো। বিভাস এই প্রথম পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে সরাসরি মেয়েটির দিকে তাকালো। দৃশ্যত: মনে হচ্ছে লজ্জায় অপমানে মেয়েটি কুঁকড়ে আছে। কথা বলার শক্তিও সম্ভবত: হারিয়েছে। একটু ইতস্তত: করে বিভাস যুবকটিকে বললো--
--আমি ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলে দেখি। আমার দেশেরই মহিলা মনে হচ্ছে।
--ওকে স্যার! আমি আপনার ওপর নির্ভর করছি।
বিভাসের আহ্বানে সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটি রিসর্টের লনে চলে এল। আসলে ঐ জটলা থেকে যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে আসতে চাইছিল। গোলাকৃতি খড়ের ছাতার নীচে মুখোমুখি বসে বিভাস জানতে চাইল--
--আপনার নাম কি?
--অঞ্জনা। অঞ্জনা মুখার্জ্জী।
--কলকাতায় বাড়ি?
--না। হুগলীতে।
--ব্যাণ্ডেলের কাছে?
--হ্যাঁ।
--যার সঙ্গে এসেছিলেন তিনি কে হন আপনার?
--কেউ হন না।
এই স্পষ্ট উত্তরের জন্যে বিভাস তৈরি ছিল না। অবাক হয়ে জানতে চাইল--
--কোনো সম্পর্ক নেই অথচ এতদূর ওর সঙ্গে এখানে চলে এলেন কেন? ব্যাপারটা কি অস্বাভাবিক নয়?
--এতদূরে আসতে হবে জানতাম না। সাধারণত: কাছাকাছি--
--এর সঙ্গেই?
--না। একেকবার এক একজনের সঙ্গে--
--কিন্তু কেন?
--টাকার জন্যে।
--টাকার জন্যে! ও--তাই বলুন!
--আমার ভীষণ টাকার প্রয়োজন। মাসে কম করেও তিন-চার হাজার টাকা। এমনিতে কে দেবে?
বিভাস কিছু বললো না। সঞ্জয়ের কথা মনে হল। সঞ্জয় বলেছিল, একজনকে সঙ্গে নিয়ে যা। এ সেই 'একজন' অন্য একজনের সঙ্গে যে এসেছিল।
--এই লোকটা কথা রাখেনি। আমার ওপর জবরদস্তি করতে চেয়েছিল। খুব মার-ধোর করেও আমাকে কাবু করতে পারেনি। তাই জব্দ করতেই এভাবে--
--কথা রাখেনি মানে? ঠিক বুঝলাম না--
--শুধু কম্প্যানি দেওয়ার শর্ত ছিল। এই শর্তেই আমি যাই। সাধারনণত: বয়স্ক লোকজনের দু'একদিনের সঙ্গী হিসেবেই--
বলতে বলতে এতক্ষণে হু হু করে কেঁদে ফেললো অঞ্জনা।
বিভাস অঞ্জনার চোখের দিকে তাকিয়ে আসল সত্যটা বুঝতে চাইছিল। ওর কাছে সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যে বলার কি বিশেষ কোনো প্রয়োজন আছে? অঞ্জনার শর্তেই অঞ্জনাকে সঙ্গিনী হিসেবে চাইলে তো পেশার স্বার্থে তার রাজি হওয়ার কথা!
অঞ্জনা নিজে থেকেই হঠাত্ তার বাবার মৃত্যু , বাড়ি তৈরির জন্যে ব্যাঙ্কের দেনা রেখে যাওয়া, ভাইকে মানুষ করা, বিধবা মাকে নিয়ে তিনজনের সংসার চালানো-- এইসব বৃত্তান্ত অকপটে জানালো। বিভাস কিছু শুনল--কিছু শুনলো না। তার মনে হল একান্তভাবেই উপায়ন্তহীন না হলে এমন একটা মেয়ে এই ধরণের বিপজ্জনক পথে রোজগারের কথা ভাবে না।
বিভাস ঠিক করলো রিসর্টের টাকা ও পেমেন্টে করে দেবে। হাওড়া পর্যন্ত টিকিট কেটে অঞ্জনাকে ট্রেনে তুলে দেবে।
রিসর্টের টাকা মিটিয়ে দিয়ে মারগাঁও স্টেশনে মুম্বাইগামী ট্রেনে অঞ্জনাকে তুলে দিল বিভাস। অঞ্জনা বিভাসের ঠিকানা চেয়েছিল। সুযোগ মতো টাকাটা ও ফেরত দিতে চায়। বিভাস ওর টেলিফোন নাম্বার দিয়ে বলেছিল, দেখা করার আগে যেন ফোন করে নেয়। অঞ্জনা নিজের বাড়ির ঠিকানা লেখা একটা চিরকুট ওর হাতে দিয়ে বললো,
--এটা আমার বাড়ির ঠিকানা। এতগুলো টাকা কবে ফেরত দিতে পারবো জানি না। কিন্তু আমি যে আমার সম্পর্কে মিথ্যে কিছু বলিনি সেটা যদি কখনো যাচাই করতে চান তাহলে এই ঠিকানায়--
--বা:! আপনার হাতের লেখাটা তো বেশ সুন্দর! কতদূর পড়াশোনা করেছেন?
--হায়ার সেকেণ্ডারীর পর আর হয়নি।
মারগাঁও স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তে অঞ্জনার মুখের দিকে তাকিয়ে বিভাসের মনে হল অঞ্জনা একটি কথাও বানিয়ে বলেনি। স্পষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই এটা বিশ্বাস করতে তার ভাল লাগছিল। নিতান্তই পরিস্থিতির চাপে পড়েই যে এই পথে নেমেছে সেটা হাতেনাতে প্রমাণের তাগিদেই যেন বিভাস আচমকা বলে উঠলো,
--আপনি একটা চাকরি পেলে করবেন?
--আমি! আমাকে কে চাকরি দেবে? আমি কি চাকরি করতে পারি?
অঞ্জনা স্পষ্টত:ই হকচকিয়ে গেল।
--কপিরাইটারের চাকরি। আপনি পারবেন। তবে চার হাজার নয়--তিন হাজার টাকা বেতন পাবেন। চলবে কি আপনার?
--আপনি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন না তো?
--না। রাজি থাকলে ফোন নাম্বার তো দিলাম। যোগাযোগ করতে পারেন। অবশ্য আমার বাড়িতেই কাজ করতে হবে। আমি ব্যাচেলর এবং বাড়িতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই--
বলতে বলতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। অঞ্জনার কথা শোনা হল না। তবু বিভাসের মনে হল অঞ্জনা তাকে ফিরেই ফোন করবে।
সেদিনই সন্ধ্যায় ডাবোলিম এয়ারপোর্ট থেকে বিমানে মুম্বাই এসে এক রাত কাটিয়ে পরদিন আবার বিমানেই কলকাতায় পৌঁছুল বিভাস। দমদমে সঞ্জয়ের সঙ্গে ওর স্ত্রী কৃষ্ণাও এসেছিল। কৃষ্ণা প্রথমেই জানতে চাইল পাঁচটা খাম বিভাস খুলেছে কি না। একটাও পছন্দ হয়েছে কি না।
--সরি সঞ্জয়--খামগুলো খোলই হয়নি। আপাতত: এগুলো তোর কাছেই রেখে দে।
পকেট থেকে খামগুলো বের করে বিস্মিত সঞ্জয়ের হাতে গুঁজে দিল বিভাস।
--তার মানে?
--মানে মনস্থির করতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে মনে হচ্ছে।
--গোয়ায় কোনো সাগর-সুন্দরী?
সঞ্জয় কৃষ্ণার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো।
--না রে! সাগর-সুন্দরী টুন্দরী নয়
--তবে?
--স্রেফ একটা ঝিনুক হয়তো!