উত্তুরের বাতাস - ২

গৌতম রায়

 

 

৮.

শেভ করা গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি ওঠে; আগের রাতে মাটিতে বীজ ফেলে রাখার মতো - ভোরবেলা চারাগাছগুলো উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করলে পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কৌতুহলে যেমন দেখে- গাড়ির আয়না দিয়ে গৌতম তেমনই নিজের গাল দেখছে। এই শেভ করা নিয়ে বিধাতার প্রতি গৌতমের প্রবল রাগ ছিলো- কী দরকার ছিলো পুরুষদের শুধু শুধু হয়রানি করার! একদিন-দুদিন পরপর এই ঝামেলা কে করবে! কী আরামেই না আছে মেয়েরা! কিন্তু যেদিন ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ সম্পর্কে জানলো একটু ভালোভাবে, বিধাতার ওপর সমস্ত রাগ শুধু তুলেই নিলো না, পাল্টারাগে ভস্মীভূত করে দিলো। আহারে! তার আপনজনকে যে যদি প্রতিমাসে প্রবলতার মুখোমুখি হতে হয়! শেভ করা তো তুচ্ছ!

এক একটি বাজার যায়, এক এক ধরনের মানুষের আচরণ বদলাতে থাকে। বদলাতে থাকে চারপাশের চরিত্র। এমনকি গাড়ির ড্রাইভারেরও। এই দেখুন, গৌতম কিন্তু একবারও তার সহযাত্রীর নামটি আপনাদের বলে নি! কেন? তাকে কি ভুলে ছিলো? নাকি মানমর্যাদার প্রশ্ন নিয়ে ভ্রমণসঙ্গীকে আলাদা করার অবচেতন প্রচেষ্টা তার বুকেও জমে আছে?

সহযাত্রী এবং চালক হুমায়ূন কবীর। উদ্দাম যুবক, চা-পিয়াসী, গৌতমের মতোই। ফলে যেখানে সেখানে চায়ের আড্ডা জমে যায় দুজনে। বগুড়া বাসস্ট্যান্ডে গরুর দুধের চা পাওয়া যায়, সেখানে সকালবেলার চা খাওয়ার পর একটানে রংপুরে। আজকের রাতটা এখানেই! কিন্তু তার আগে যেতে হবে কুড়িগ্রাম।

৯.

এই জীবনে গৌতম কয়টা জীবনকে সঙ্গী করেছে জানি না, কয়টা জীবনে সঙ্গী হয়েছে- তাও জানি না। কিন্তু জীবনের প্রবহমানতার ভেতরে চলতে চলতে সে অসংখ্যবার টের পেয়েছে- বাইরের পরিচিত রূপ থেকে কোনো এক প্রভাবকের ক্রিয়ায় বের হতে নতুনতর অন্য কোনো সত্ত্বা। হালকা বৃষ্টির পর কালো পিচ ঢালা পথে যে সাদা ফেনাভ ঢেউ উঠে, বাতাসের এবং রাস্তার গলে যাওয়া বিটুমিনে অ্যাসিড গলে গলে সাদা হতে থাকে। শিশুতোষ চোখে চালকের ব্যাখ্যা শুনে- 'এইরহম বিরিস্টি বালা না। গাড়ি চালাইতে বহুত পরবলেম। খালি পিসলা খায়।' সামনে আস্তে ধীরে চলতে থাকা ট্রাক সাইড দিতে চায় না, কথার ফাঁকেই ঝড়ো হাওয়া বইতে থাকে- শিলাবৃষ্টি হবে কি?

১০.

মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে। কোন মা? না, জন্মদাত্রী নয়; তিস্তা ব্রিজ পার হওয়ার সময় খুব করুণ চোখে দেখে নদীর বুকে পানির হাহাকার। আসার সময় যমুনার যে প্রবল জলভার দেখে এসেছিলো গৌতম, এখানে তো তার শিশুটিও নেই। এই তিস্তাই কি একদিন যমুনাকে পানি দেয় নি? তিস্তার স্তন্যামৃত পান করেই কি যুমনা আজকের যুবক হয়ে উঠে নি? তিস্তা তবুও অভিশাপ দেয় না, খালি দেখে, কী অবহেলায় মানুষ তার ওপর আরেকটা সেতু তৈরি করছে। হাহাকার করে ওঠে- বুকের ওপর এতো খুঁটি গেড়ে বসলে পাশ ফিরে শোয়া যাবে কি?

আস্তে আস্তে কুড়িগ্রাম পার হয়ে গৌতমের গাড়ি চলে যায় নাগেশ্বরীতে। কী সুন্দর নাম! নাগেশ্বরী! নাগ+ঈশ্বরী? মানে মা মনসার কোনো পুত্রজ হয়তো এখানে প্রথম বসতি স্থাপন করেছিলো। আরও সুন্দর সুন্দর নাম আছে কুড়িগ্রামের উপজেলাগুলোর। রৌমারী, ফুলবাড়ি, ভুরুঙ্গামারী...। ভুরুঙ্গামারী থেকে ঘুরে আসা যায় না?

খুব যায়! গাড়ি আস্তে আস্তে এগুতো থাকে। ওই তো ও পাশেই সীমান্ত। একটু ছুঁয়ে যাওয়া যাবে কি? চায়ের দোকানদার সাবধান করে দেয় গুড়ের চা বানাতে বানাতে। একটু পরে কার সাথে যেনো প্রবল ঝগড়া লাগে। মুখের বাণী উড়িয়ে নিয়ে যায় সব অখণ্ডতা। বাংলাতে গালি দিয়ে শহুরে ভদ্রলোকরা শান্তি পান না; এ ভাষায় নাকি গালির অভাব। গৌতম কান খাড়া করে শুনে দুর্বোধ্য, সাবলীল এবং আহ্লাদিত সব গালিগুলো। মুখস্থও করে রাখে কয়েকটা, কিন্তু ফিরতি পথে আসতে আসতে এক এক করে সব ভুলে যায়। যেখানকার সম্পদ, নিজেকে সেখানেই রেখে দেয় প্রকৃতি।

১১.

গৌতম পুরো পথটাই ঘুমোতে ঘুমোতে আসে। কী এক শ্রান্তিময় ঘুম! গৌতম প্রতিবারই ভাবে, ঢাকার বাইরে গিয়ে বুকভরে বাতাস নিবে, পুরো শরীরের সব দূষিত বাতাস ফুসফুস থেকে একটানে বের করে দেবে, কিন্তু কোনোবারই তা মনে থাকে না। মনে পড়ে ফেরার সময় আমিনবাজারের ইটের ভাটাগুলো দেখে। তখন মনে হয়, তাই তো এবারও বুক ভরা বাতাস নেওয়ার কথা তো মনে পড়লো না?

প্রকৃতি নামক বিধাতা হাসে। প্রকৃতিতে গেলে কি মানুষের কৃত্রিমভাবে মনে করে বুক ভারা বাতাস নিতে হয়, বোকা ছেলে? ঢাকার দূষিত বাতাস পেলে তবেই না মনে পড়বে বিশুদ্ধ বাতাসের কথা। দূষিত ছাড়া বিশুদ্ধের কোনো অস্তিত্ব নেই রে!

১২.

রাত দশটায় গৌতম ব্র্যাকের টার্ক থেকে বের হয় হাইওয়েতে। হাঁটতে হাঁটতে রাতের হাঁটে পৌছে। চা খেতে খেতে শুনে দোকানদারে রাতের চিন্তাগুলো। না, বউয়ের কথা কেউ বলে না, কেউ বলে না একটা শান্তির ঘুমের কথা কিংবা সম্ভোগজীবনের উপাখ্যানগুলো কেউ একটু নাড়াচাড়া করেও দেখে না, সবারই চিন্তা আগামীকাল নিয়ে।

এই পৃথিবীর বড় উৎকণ্ঠা এবং চিন্তাভাবনা আগামীকালকে ঘিরেই। কারো আগামীকাল আগামীকালেই, কারোরটা বা আরো দুদিন পর, কিংবা বছরকয়েক পর।

বগুড়া থেকে রংপুর হয়ে কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী, সেখান থেকে পুনরায় রংপুর- এই দীর্ঘ যাত্রায় গৌতম কোনো মানুষ দেখে নি। জনতা দেখেছে। রাতে শুয়ে শুয়ে অবাক হয়ে ভাবে সে- মানুষ দেখা বড়, না জনতা দেখা? ‘মানুষ জাগবে ফের, জাগবে মানুষ’ কথাটা কি সত্য? মানুষ কি আলাদাভাবে জাগতে পারে? জনতা জাগলে কি মানুষ জাগে না?

আজ রাতে জনতা গৌতম মানুষ গৌতমকে দহন করবে।
 

পরের পাতা...