প্রণয় এবং বিচ্ছেদের অবশ্যম্ভাবিতাঃ একটি ময়নাতদন্ত
অনীক আন্দালিব
সম্পর্কের রসায়ন বেশ কুটিল। আমরা মানুষরা একটা নির্দিষ্ট মুখের ভাষায় যে মিথস্ক্রিয়া চালাই, একে অপরের সাথে- তার বাইরেও আরেকটা মানবীয় অস্ফূট ভাষায় ভাব-চলাচল ঘটে। খানিক চাহনি, একটু নীরবতা, শরীরের একটা বাঙ্ময় আলাপ ঘটে চলে অহরহই আমাদের মাঝে। বিশেষ করে নারী-পুরুষের প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে। এই ময়দানে রোজ কত ক্রন্দন-হাস্য আর আনন্দ-বিষাদ মিশে থাকে তা চিন্তা করে বড়ই অবাক হতে হয়! যেন একটা রোলার-কোস্টার রাইডের মতো আমরা দিগ্বিদিক ছুটে শা শা করে চলে যাচ্ছি, গতির তীব্রতায় চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসছে, পাশের জনের দিকে তাকানোর অবসার নাই, একদণ্ড সুস্থির হয়ে বসে কারো সাথে আলাপন নেই। আমরা কেবলই ছুটছি। এই উন্মাতাল দৌড়ের মাঝে যারা যারা হাতে হাত ধরছি, সেই বন্ধনও টিকছে না। নিজের গতিতেই আবার বাঁধন ছুটে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি।
সম্পর্কগুলোও কেমন অদ্ভুত ভাবে মিলে-মিশে যায়! পথ চলতে কাউকে হয়তো খুব ভালো লেগে যায়। পরিচয়, দেখা-সাক্ষাৎ গাঢ় হয়। হয়তো দুজনেরই ভালো লাগে একে অপরের সাথে সময় কাটাতে। দেখা হলেই মুখটা হাসিতে ভরে ওঠে। কারণে অকারণে খিলখিল হেসে দেয়া হয়। এ যেন একটা মধুর সময় কাটানো। একটা সময় মনে হয় আরো একটু বেশি চাই তাকে। আরো একটু বেশি দেখতে চাই, আরো একটু বেশি তার কথা শুনতে চাই। এই কামনার জন্ম কোথায়? এই আকর্ষণের জন্ম কোথায়? কে বলতে পারে? আমরা খালি যা ঘটে চলে তার স্বরূপ-নির্ধারণেই নাজেহাল, কার্যকারণ কে খুঁজতে যাবে! দুইজনের মধ্যে কেউ একজন একটা সময় বুঝে ফেলে, অন্য মানুষটাকে ছাড়া চলছে না। কোন ভালো ঘটনা ঘটলে প্রথমে তার কথাই মনে পড়ে, ইচ্ছা করে তার সাথে সেটা ভাগাভাগি করি। কখনও খুব বিষন্ন বিকেলে মনে হয় সে পাশে থাকলে অকারণ কথা বলে মনের ভারটুকু হালকা করা যেতো। এই আকুতিই হয়তো টান! এই চাহিদাটাই হয়তো ভালোবাসা!
ধরা যাক দুজনেরই একসময় এই বোধের উদয় হয় আর তারা বুঝে ফেলে যে একজন ছাড়া আরেকজন ঠিক স্বস্তি পাচ্ছে না। তখন একটা ট্যাগের দরকার পড়ে। শুধু বন্ধুত্বে হয়তো চলে না আর, আরো একটু বেশিই হেলে যায় নির্ভরতার ভারকেন্দ্র। একজন আরেকজনকে যেভাবে পড়ে, যেভাবে বুঝে, মনে হয়, এই সেই- যাকে খুঁজেছি, বা যাকে দরকার। মনের ভাব প্রকাশিত হতেও দেরি হয় না। সেই প্রকাশে হয়তো একটা ক্ষণিক টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়। একজন হয়তো একটু দ্বিধায় পড়ে যায়। তবে মনের টান অনেকসময়ই সেই বাধা পেরিয়ে যায়। একটা বোঝাপড়াও হয়তো হয়ে যায় তাহাদের মাঝে। লেখক সেই বিষয়ে পুরোটা না বুঝলেও এটুকু বুঝে নেয়, এরা হয়তো বাকি জীবনের সময়টুকু ভাগাভাগি করে নিতেই পছন্দ করবে।
এই গল্পটা রূপকথা হলে এখানেই আমার প্রচেষ্টা শেষ হয়ে যেতো। "অ্যান্ড দে লিভ্ড হ্যাপিলি এভার আফটার..." বলে আমিও শেষ করে দিতাম। কিন্তু আমরা খুব অভিশপ্ত জীবনযাপনে মানিয়ে নিচ্ছি নিজেদের। একেকটা মানুষ কতো কোণে খণ্ডিত, তার কতো ভাঁজ, নিজেও বুঝে না কখন বুকে পলি জমে, অভিমান জমে, ছোট ছোট কতো স্বর নিরুত্তর থেকে যায়। আবার হয়তো আমার আশঙ্কা অমূলক, মানুষ আসলেই পারে একে অপরকে ভালোবাসতে অবিমিশ্রভাবে, পারে মানিয়ে নিতে। অনেকেই তো একজীবন কাটিয়ে দেয় পাশাপাশি- সুখে, দুখে, সংগ্রামে, শান্তিতে। আবার কেউ কেউ পারে না। পথ আলাদা হয়ে যায়, মত আলাদা হয়ে যায়।
সেই জোড়ভাঙার সুর প্রথম কবে দেখা যায়? কিভাবে দুজনে মিলে দেখা স্বপ্নেরা ঝরে যায়? প্রকৃতির বৈচিত্র্যের মতো এই ভাঙনের সুরও বিচিত্র! অনেক সময় ছোট ছোট কথায়, ঝগড়ায় মনে কালোমেঘ জড়ো হয়, মনে হয় আগের সেই ভালোবাসা আর নেই, "ও" বোধহয় আমাকে আর আগের মতো ভালোবাসে না! এই অনিশ্চয়তা নিমেষেই উড়ে যায় যদি নির্ভরতা মিলে। এতটুকু স্পর্শ, সহানুভূতি বা ধৈর্যশীল আচরণে হয়তো সাময়িক ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটে। আবার অনেক সময় পাশের মানুষটা হয়তো সেটা বুঝতেও পারে না। তখন শুরু হয় অভিমানের ঢেউ। একটার পর একটা ঢেউ এসে মানুষটাকে বিপর্যস্ত, বিস্রস্ত করে দেয়। একবার মনে হয় কেঁদে কেটে রাগ দেখিয়ে বলে দিই, "তুমি এমন কেন? আমাকে কেন বুঝো না? আমাকে কেন কষ্ট দাও?" তারপরেই আরো বড়ো ঢেউ এসে ঝাপ্টে ভিজিয়ে দেয়, "আমি কেন বলবো? ও কেনো বুঝে নেয় না? আমাকে এতো কম বুঝে কেন ও?"
এখানে অতীতের সাথে তুলনাও শুরু হয়ে যায়। আমরা অবুঝ হয়তো, তাই বুঝি না যে নদীর পাড়ের মতো আমরা বদলে যাচ্ছি প্রতিমুহূর্তে, আমাদেরও মন বদলায়, আমরা বড়ো হয়ে যাই, পরিবর্তিত হই। সেখানে পাশেরজনকেও একই তালে বদলাতে হয় কিংবা বুঝে নিতে হয় এই বদলে যাওয়াটায় কারো হাত নেই- এটাই স্বাভাবিক। হয়তো একটা সময়ে সম্পর্কের টানেই একজন বুঝে যায় অপরজনের অভিমান। পুরোনো সুর ফিরে আসতে চায়, সেই ভালোবাসার টানেই আবার দুজনে হেসে ওঠে, বুঝে নেয়ঃ সকালের রোদ আর দুপুরের রোদে অনেক ফারাক। তবু বেঁচে থাকা যায় পাশাপাশি, একে অপরকে এখনও কামনা করা যায়! হাতের পাতা আবারও নতুন করে মিলিয়ে নেয়া যায়।
যদি সেটা না হয় তাহলে আরো জড়িয়ে যায় তন্তুগুলো। শুরু হয় টানাপোড়েন- একটা চাপা ক্ষোভ! একটু একটু মনে হয় পাশে থাকা মানুষটা অচেনা, তাকে আর পড়া যাচ্ছে না ঠিকমতো। কেমন যেন বিরক্ত লাগে সবকিছুই। ছোটখাটো বিষয় যা আগে গায়েই লাগতো না, হালকা খুনসুটিতে উড়ে যেত পলকা পাতার মতো, সেগুলোই পড়ে পড়ে দানা বাঁধতে থাকে। ক্ষোভেরা দলে দলে, দিনে দিনে জমা হয়ে একটা দ্রোহে রূপ নেয়! যে মানুষটাকে আগে এতো ভালো লাগতো, তাকে আর ভালো লাগে না। আজকাল কথায় কথায় ঝগড়া হয়। কোথা থেকে কোথায় চলে যায় কথা-সব। দুজন দুজনকে এতো ভালো করে চিনে, তাই কথায় পুরোনো অভিমান, রাগ, ঝগড়াগুলো উঠে আসতে থাকে। দুজনেরই "ইগো" দাঁড়িয়ে যায়। যে টুকরো কথায় আগে মিটমাট হয়ে যেত এখন সেই কথায় কিছুই হয় না। আরো অনেক কথা ব্যয় করে, ক্লান্ত হয়েও মনোমালিন্য কাটে না। কালি জমতে থাকে দুজনের মাঝে। যে ভালোবাসায় একদিন দুজনে একসাথে ঘন হয়েছিলো আজ সেই ভালোবাসাই হারিয়ে যেতে থাকে।
এইসময় নিজেদের অজান্তেই একটা দূরত্ব তৈরি হয়। দূরত্বটা মনের, চিন্তার, পাশাপাশি থাকার, সর্বোপরি ভালোবাসার। অনেক সময় কথা হয় না অনেকদিন। হলেও ছাড়া-ছাড়া, আগের মতো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে না মনের সাথে মন! অনেকসময় এখান থেকেও সম্পর্কেরা বেঁচে থাকে। অনেকে মানিয়ে নেয়। একটা সম্পর্ক সবসময়ই একটা বড় লগ্নি। মানুষ সহজে সেই লগ্নি করা বিশ্বাস, সেই পুঁজিটা হারাতে চায় না। ভারি হয়ে ওঠা কথামালাকে কাঁধে নিয়েও অনেকে পাশাপাশি থাকে।
তখন হয়তো আরো গভীর যন্ত্রণার সূত্রপাত ঘটে। অচলায়তন ভাঙতে যে এগিয়ে আসে, স্বভাবতই সে একটু সুবিধা পায়। টেনে নেয়া সম্পর্ককে সে টিকিয়ে রেখেছে এরকম একটা ধারণা তাকে একটা সুযোগ দেয় অপরজনকে করুণা করার। সেখানে তীব্র না হলেও একটা প্রচ্ছন্ন আধিপত্য তৈরি হয়। অপরজন তখন হয়তো অজান্তেই একটা অপরাধবোধে ভুগতে থাকে। "আমি হয়তো ওর মতো অতটা ম্যাচিওর না!" -এরকম সন্দেহের দোলাচলে সে একটু ম্রিয়মান হয়ে পড়ে। এখানে আরো অনেক সম্ভাবনার সত্যি হওয়ার সুযোগ আছে, কিন্তু সবক্ষেত্রেই আগের সেই ভারসাম্যটি আর টিঁকে থাকে না। যদিও আমরা সর্বদা বলি যে পুরোনো কথা ভুলে গিয়ে নতুন করে শুরু করা- কিন্তু বাস্তব বলে মানুষকে এহেন গভীর সম্পর্কের খুঁটিনাটিগুলোও অনেক বেশি তাড়িত করে।
অনেকে এখানে আরো একটু সুখের আশায় ভারি সম্পর্কের জোয়াল কাঁধ থেকে নামিয়ে ফেলে। "হেথা নয় হোথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে" -এরকম আকূতিতে হয়তো কষ্টের বিষে নীল হয়েও তীব্র বিচ্ছেদের মাঝ দিয়ে যায় মানুষ। একটা বিচ্ছেদ- তা যতই দ্রুত বা ধীরেই ঘটুক না কেন, খুবই বেদনা আর হতাশার। অনেকে নিজেকে দোষারোপ করে, অনেকে অপরজনকে দোষারোপ করে। কিন্তু প্রকৃত দোষ কার? একটা মধুর সম্পর্ক কী করে এরকম বিষিয়ে যায়! ভালোবাসায় উন্মাতাল প্রবাহ থেমে কেন বুকে এই ক্ষোভ জন্মায়? কেনই বা কারো সাথে থাকতে কুণ্ঠায় কুঁকড়ে যেতে হয়, যেখানে একটা সময়ে তাকে নিয়ে গর্ব হতো! এই প্রশ্নগুলো স্বাভাবিকভাবেই খেলা করে মনে।
আমরা অসহায় মানুষ হাতড়ে বেড়াই, উত্তর খুঁজি। কিন্তু হায়! উত্তর মেলে না। ভেবে নিই আরেক মানুষের মাঝে হয়তো সুখী হবো, আগের ভুলগুলো শুধরে ভালবাসবো আবার। আবার হয়তো স্বপ্ন দেখা, আবেগে ভেসে যাওয়া। ভবিষ্যতকে সুন্দর করতে, কারো সাথে জীবন উদযাপন করতে চায় মন। মানুষ তো সততই একাকী, এই একাকীত্ব কাটাতেই জীবনকে নানান উপাচারে ভরে দেয়া, সামাজিকতায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখা। চারপাশে প্রিয় মানুষগুলোকে নিবিড় করে ধরে রাখা যাতে তাদের হৃদয়ের ওমে শীতল-স্ব একটু উষ্ণতা পায়!
এখানে শুধুই বিচ্ছেদের সুরের বিশ্লেষণ। তবে আমি ভাবতে চাই না এভাবে। আমাদের সামর্থ্যের মাত্রা আমরাই জানি না। এক ছাদের নিচে সবসময় হাসি-আনন্দে থাকার জিন নিয়ে আমরা জন্মাইনি। এত বেশি সংঘর্ষ আমাদের নিজেদের মধ্যেই সবসময় ঘটে চলে, আরেকজন মানুষের সাথে তো আরো বেশি ঘটবে সেটা! তারপরও মানুষ ভালোবাসে, আপ্লুত হয় অদ্ভুত আবেশে। অযথাই হেসে ওঠে উদ্দাম! কাউকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে ভাবে বাকিজীবনের আলোছায়ায় তার সাথেই পেরোনো হোক পথ। এই অপার আশাবাদী মানুষকে আমার বড়ো ভালো লাগে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়, আমাদের অতি জটিল পারস্পরিক লড়াইয়ে এক সুপ্রভাতে আমরা সবাই-ই জিতে যাবো!
সেপ্টেম্বর ১১, ২০০৮
***
[লেখাটির জন্মের পিছনে সিংহভাগ কৃতিত্ব একরামুল হক শামীমের। একটা বেশ উপভোগ্য আলোচনায় বিষয়গুলোর বীজ উপ্ত হলে শেষমেশ তার উতসাহে তা পুরো অবয়বটি পেলো!]