সুদূর মরুপল্লীতে আফ্রিকান শিশুদিবস পালিত
মানবাধিকার সংস্থার শান্তি প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া
অমল হালদার
দিনটি ছিল ১৬ জুন ২০০৯। দুর্দান্ত নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে ৫৪ কিলোমিটার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সত্যিকার শিউরে ওঠার মত। রাস্তা বলতে প্রকৃতির সৃষ্ট মরুময় পথ। শুধু বালু আর বালু। মাঝে মধ্যে কোথাও দুএকজন লোক চোখে পরলেও তাদের চোখেমুখে মারাত্মক রকমের স্বাভাবিকতার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছিল। তার উপরে প্রায়শই গাড়ীবহরের রাস্তা হারিয়ে যাওয়া সত্যিই ছিল বিরক্তিকর । তবে গন্তব্যে পৌঁছানোর পর ভাল লাগছিল কারণ অনুষ্ঠানটি ছিল আমার জীবনে একটা ব্যতিক্রমধর্মী মনোজ্ঞ পরিবেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত সমাবেশ। মূলকেন্দ্রটি যদিও কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে ঘেরা ছিল তবুও উপস্থিত শিশুকিশোর এবং মহিলাদের পরিতৃপ্ত হাসি সত্যিই মুগ্ধ করেছিল সবাইকে।
দিড়ি একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। দক্ষিণ ডারফুরের (সুদানের একটা ষ্টেট) রাজধানী শহর নেয়ালা থেকে অনেক অনেক দুরে একদম প্রত্যন্ত মরু এলাকায় এ অবস্থান । সর্বসাকুল্যে দূরত্ব নেয়ালা থেকে ১৪০ কিলোমিটার বা তারও বেশী।
প্রায় ১৫ দিন ধরে সরকারকে অনেক জবাবদিহিতার পর্ব শেষ করে সরকারিভাবে দিবস পালন এবং ভ্রমণ অনুমতিপত্র সংগ্রহ সহ স্থানীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরার পর আমরা নেয়ালা থেকে দুটা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ৪০ জন মানবাধিকার কর্মী (৪ জন বিদেশী) এক দিন আগে দিড়ি এর নিকটবর্তী নিম্নমানের একটা জেলাশহর ঈদ ঊল ফুরসান এ পৌঁছি। এটি নেয়ালা থেকে ৮৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানে একদিন অতিবাহিত করার পর দ্বিতীয় দিনে ৫৪ কিলোমিটার দূরে দিড়ি গ্রামটিতে যেতে সক্ষম হই। প্রায় আরো ৫৪ কিমি পথ অতিক্রমন কম নয়। বর্ষা এলে স্থানটি কমপক্ষে বছরের ৪ মাস জেলাশহর থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন থাকে। মানবাধিকার কর্মীদের জন্য জাতিসঙ্ঘের হেলিকপ্টারই তখনক একমাত্র দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে। এলাকাটিতে ঈদ ঊল ফুরসান থেকে সড়কপথে পৌছাতে কমপক্ষে ৪/৫টি ওয়াদী পার হতে হয়। ওয়াদী হলো ঋতু ভিত্তিক নদী যা কিনা বছরে ৮ মাস পুরোপুরি শুকনো এবং বালুময় থাকে।
দিড়ি এলাকাটি বিভিন্ন উপজাতীয় মুসলমানদের স্থায়ী নিবাস। লোকজন আরবী ছাড়াও স্থানীয় উপজাতীয় ভাষায় কথা বলে। খাবার দাবারের মধ্যে মূলত উট, গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগলের গোশত প্রধান। সরগম, মিলেট মূল দানাদার খাদ্য। শাকসব্জী তেমন একটা নেই। গরীব লোকজনের একটাই সাধারন খাবার, সরগমের সাথে বাদামের মিশ্রণ। বাংলাদেশে যেমন ডাল,ভাত। মূল কৃষিসম্পদ সরগম,মিলেট এবং কাঠবাদাম। গাধা কৃষিকাজ এবং যোগাযোগর মূল বাহন। শিক্ষার হার মারাত্মক ভাবে কম। সুপেয় পানি মানে সাংঘাতিক সংগ্রামের ব্যপার। ৪/৫ কিলোমিটারের মধ্যে ১টা সুপেয় পানির উৎস পাওয়া যেতে পারে, যা মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে প্রায়ই নষ্ট থাকে। বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, তালাক, ছাড়াছাড়ি, মহিলাদের অগনিত সন্তান ধারণ এখানে সাধারণ ব্যপার।
জনগোষ্ঠীর দিক থেকে 'বেনীহাল্বা' (৮০%) উপজাতি সংখ্যা গরিষ্ঠ হলেও 'ফুর' এবং 'সালামাত' উপজাতির আধিক্যও কম নয়। এলাকার চলমান গৃহযুদ্ধ মূলত এই তিন উপজাতির মধ্যে হলেও পার্শ্ববর্তী অন্য উপজাতিও মাঝে মাঝেই বিভিন্নভাবে এতে সম্পৃক্ত থাকে। এই এলাকাটির ভিতরে স্থানীয় এবং খুবই পরিচিত লোকজন ছাড়া অপরিচিত লোকজনের যাতায়াত একদমই বন্ধ। এমনকি সরকারী লোকজনও কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া কখনই যাতায়াত করে না। চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে এলাকার উন্নয়ন একদমই থমকে আছে। প্রায় ৩ বছর পূর্বে আন্তর্জাতিক মানবধিকার সংস্থা, এলাকার মধ্যে অবস্থিত বহুদিনের জীর্নশীর্ণ একটা পুরাতন নামমাত্র স্কুলের উন্নয়নের সূত্র ধরে এলাকাটিতে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিল। মানবাধিকার সংস্থাটি ইতমধ্যে স্কুলটির অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ এলাকার কৃষি, কখনো সখনো স্বল্প পরিসরে স্বাস্থ্যসেবা সহ নানাবিধ উন্নয়ন কাজে জোরালো ভূমিকা রাখছে বলেই সর্বসাধারনণের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে।
এলাকাটিতে গৃহযদ্ধের অবসান ও শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে মাঝে মধ্যেই আলোচনা এবং বিভিন্ন সামাজিক আনষ্ঠানে মানবাধিকার সংস্থাটি সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় এই সুদূর মরুপল্লীতে আফ্রিকান শিশুদিবস পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। এটি সম্ভব হয়েছিল সকল উপজাতীয় সম্প্রদায়ের উপস্থিতির মাধ্যমে। দিনভর শিশুদিবসটি পালনের মূল এজেন্ডা ছিল, উদ্বোধন, শিশুপ্যারেড, শিশুদের চিত্রাংকন, উপজাতি শিশু কিশোরদের গান এবং নাচ, খাওয়া, সেবা প্রদর্শনী, উটশোভা প্রদর্শনীসহ রকমারী সাজসজ্জা। বাজনা ও নাচে ভরপুর এক আনন্দঘন পরিবেশ হঠাত করেই সেদিন বদলে দিয়েছিল প্রত্যন্ত এই অঞ্চলটির নিত্যদিনকার পরিবেশ।
কয়েকজন শিশু কিশোরকে তাদের অনুভূতির কথা জিজ্ঞেস করতে উচ্ছ্বাস ভরে আরবীতে বলেছিল, আউয়াল র্মারা আনা আসুফ আজমাল হায়্জাত মাআন। অর্থ, সকল শিশু,কিশোর এবং মহিলা,পুরুষদের সমন্বয়ে এমন সুন্দর এবং মনোজ্ঞ একটা মহাসমাবেশ জীবনে প্রথমবারের মত দেখার সুযোগ হল। তাদের চোখে মুখে ছিল উচ্ছ্বাস আর আনন্দের হাসি।
তারপর?
দক্ষিণ ডারফুর, সুদান
আগষ্ট ২৪, ২০০৯