একটি বস্তুসংকেতের কল্পনামূলক কাহিনী
গাজী তানজিয়া
Jene_sum@yahoo.com
 


নদীর পাড়টা মানুষে মানুষে গিজ গিজ করছে। সবাই কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে লাশটার দিকে। কেউ কেউ কিশোর বয়সী বা কৈশোরোত্তীর্ণ যারা আমাকে নামে চিনতো, কিন্তু চেহারায় চেনে না। তারা দু এক জন জানতে চায় লোকটা কে? অন্যরা বলে চেনো না? আদিত্য, আদিত্য! ছেলেটা যেন চমকে ওঠে। মনে মনে বলে এত যার প্রতাপ সে এই ভাবে শেষ! তবে এই নামটা আমার আসল নাম না। আমার প্রকৃত নাম আসলাম, আসলাম খান। এই লাইনে আসার পর আমি আমার এমন একটা নাম দিতে চাইলাম যেটা শুনলেই সবাই চমকে যাবে। রক্ত শীতল করা একটা অনুভূতি হবে শুধু নামটা নয় নামের অধিকারী মানুষটার কথা ভেবে। অনেক ভাবলাম, নামটা কি হতে পারে? যার চমক থাকবে তেজ থাকবে এবং দীর্ঘস্থায়ী হবে। একবার ভাবলাম বিদ্যুৎ, বিদ্যুৎ নামটা কেমন হয়? নাহ্ এর তেজ আছে চমক আছে কিন্তু স্থায়ীত্ব নেই। মেঘের গর্জনে আর চমকে যার আবির্ভাব, কিন্তু সে বড় ক্ষণিকের জন্য; তাই বিদ্যুৎ নামটা না হয় আপাতত ওয়েটিং লিষ্টে থাক, পরে কখনো ছদ্মনাম নিতে হলে দেখা যাবে। নামটা হতে পারে সূর্য্য, হ্যা সূর্য্য।  তবে সরাসরি সূর্য্য নয় এর সমার্থক শব্দ বা সিনোনেম। তপন, নারায়ণ, অরুণ, আদিত্য, নাকি অ্যামেন! অ্যামেন হতে পারে তিনি প্রাচীন মিশরের জনপ্রিয় দেবতা ছিলেন ‘ অ্যামেন’ অর্থাৎ সূর্য দেবতা। কেউ কেউ আবার বলতেন ‘আমন রা’। অ্যাটন ও হতে পারে এর মানেও সূর্য্য । কিন্তু অ্যামেন মানে যদি হয় সূর্যের চাকতি, অ্যাটন  সূর্যের রশ্মি। নাহ্ এসব বিদেশী নাম চলবে না। তার কারণ, এর অর্থই কেউ বুঝবে না। বাংলাগুলো থেকে একটা বেছে নিতে হবে। এর মধ্যে ‘আদিত্য’ নামটা ভাল। ‘ত’ এর ওপর একটা ‘জ্-ফলা’ থাকাতে উচ্চারণের সময় একটা ধাক্কা লাগে, এই ধাক্কাটাই জরুরী। নিজেকে সূর্যের মত প্রতাপশালী দেখার শখ জেগেছে সেই ‘জিনিসটা’ হাতে আসার পর থেকেই। শুভাকাঙখীরা বলেছিল ভুল পথ বেছে নিয়েছ। আমার পথটা যে ভুল না সেটা ওদের আমি কি করে বোঝাই! কিন্তু এখন এ কি হলো? আমার মৃত্যুটা খুব যুতসই হলো না। এই নদীর ধারে কাদা মাটির ওপর কেমন পড়ে আছে দেহটা। মুখটা বিশ্রী রকমের হা হয়ে আছে। সুবিধা বা অসুবিধার মধ্যে একটাই, সবকিছু দেখতে এবং শুনতে পাচ্ছি। মৃতরা কি এটা পারে? জানা ছিল না।

আরে, আরে! মাছি এসে গেছে দেখি, মুখের মধ্যে ঢুকে যাবে না কি! যাক, গেলে যাবে, মাছি তাড়ানো এখন আমার কাজ না। এই লোকগুলো কি দেখে? একটা মৃতদেহ ঘিরে শত শত মানুষ দাড়িয়ে আছে, কোনো মানে হয়? তারা নিজেদের মধ্যে কি সব বলাবলিও করছে চাপা স্বরে। কারো মুখে খুব বিষাদ নাই আবার হাসিও নাই। আমার মৃত্যুতে এদের তো খুশি হবার কথা, কিন্তু হলো না কেন? আচ্ছা, মৃতদেহ দেখলে কেউ খুশি হয় না কেন? তাদের কি এ কথা মনে পড়ে যায় যে আমাকেও একদিন যেতে হবে। অথচ যখন বেঁচেছিলাম তখন তো আমার একবারও মনে হয় নাই যে আমাকেও একদিন মরতে হবে! মানুষের সাথে কত রকম উল্টা পাল্টা ব্যবহারটাই না করেছি। তবে গরীবের সাথে করি নাই। আমার রাজনৈতিক আদর্শ গরীব মারার আদর্শ ছিল না। আমাদের আদর্শ ছিল সম্পদের সুসম বণ্টন। এই ব্যাখ্যাকে আমি অপব্যাখ্যায় রূপ দিলাম। ধনীর ধন থেকে আমাকে ভাগ দিতে হবে কারণ আমি ধনী হতে পারি নাই। একটা আদর্শ ও নীতিবোধের অপব্যাখ্যা।

আরে,আরে! শরীরের ওপর দিয়ে দেখি একটা বিচ্ছু হাটাহাটি করছে, অবার কামড়ে দেবে নাতো!
শিট! দিল একটা হুল ঢুকিয়ে। কিন্তু না ব্যথাতো লাগে নাই! এই নশ্বর দেহটার জন্য এখনো এতো চিন্তা আর সেবার যখন পূরবীকে কলেজ যাওয়ার পথে...। জীবনে এত খারাপ কাজ করলাম কোনোটাই মনে দাগ ফেলে নাই। কিন্তু পূরবীর ব্যাপারটা এখনো কোথায় যেন আঁচড় কাটে। মেয়েটা প্রতিদিন প্রায় তিন মাইল হেটে কলেজে যাওয়া আসা করতো। গরীব বাবা মা এর একমাত্র মেয়ে। লেখাপড়া শিখে সংসারের হাল ধরাই একমাত্র লক্ষ্য। ওদের গ্রামের দিক থেকে যে রাস্তাটা এসেছিল কলেজের দিকে, সেই রাস্তা ঘেঁষেই কলেজের একটু আগে ছিল কলেজ হোষ্টেল। আমি তখন ঐ হোষ্টেলের অধিপতি। আমার ঘরটা ছিল রাস্তার ধারে একেবারে কোনার ঘরটা। রাস্তা থেকে এক লাফে ঢুকে যাওয়া যেত সেখানে। গ্রাম থেকে যত ছেলে মেয়ে আসতো তাদের কারো পক্ষে আমাকে সালাম না দিয়ে কলেজে ঢুকবার জো ছিল না। ওহ্‌, হোয়াট এ পিরিয়ড! ভেবে এখনো পুলকিত হচ্ছি। তো ভাবছিলাম পূরবীর কথা। পূরবী, পূরবী মেয়েটা তখন বিএ শেষ বর্ষের ছাত্রী। আর কিছুদিন পরেই ওরা পরীক্ষা দিয়ে কলেজ ছেড়ে চলে যাবে। এর আগেই, এর আগেই ব্যবস্থা একটা করতে হবে। তার সাথে আমার প্রেম ভালোবাসা কিছু হয় নাই। ওসবের আমার কাছে কোনো গুরুত্ব ও নাই। আমি কোন নৈতিকতার ধার ধারি না তখন। ওর সাথে প্রেমের চেষ্টাও করি নাই, চেষ্টা করলেও হতো না।। ধর্ম একটা বাধা ছাড়াও ভালো তো দূরের কথা সাধারণ মানের ছেলে হিসেবেও আমার কোন ইমেজ ছিল না কলেজে। কলেজে যে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলাম তাও কেউ স্বেচ্ছায় ভোট দেয় নাই। ভোট দিয়েছিল ভয়ে। আমার কাছে যে ধাতব বস্তুটা ছিল। ক্ষমতার উৎস তো তার নলে। ধাতব বস্তুটা আমার জীবন, আমার দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টে দিয়েছিল। ঐ বয়সে তো মানুষ চরিত্রহীন হয় না, আচ্ছা, আমি কেন হলাম? তার প্রধান কারণ একটা ১৮ বোরের পিস্তল! ক্ষমতা, অসীম ক্ষমতা! ‘বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস’ মাও সে তুং এর এই উক্তিটার যে কত অপব্যাখ্যা হয়েছে যুগে যুগে!
এত ক্ষমতাধরেরা অনুনয় বিনয় করে প্রেম নিবেদন করে না। জোর করে, জোর! রাতের বেলা ভিসিআর এ পর্নো ছবি দেখা, তাস পেটানো আর চোলাই মদ। এ সবই চলে। হোষ্টেল সুপার তো ভুলেও আমাদের রুমের সামনে দিয়ে যেত না। তবে পূরবী, সে আমাকে খুব একটা ভয় পায় বলেও মনে হতো না। তার চাহনীতে আছে কিসের যেন দৃঢ়তা, কি এক সংকল্পের প্রকাশ। পূরবী আমাকে ভয় করে না, এটা কোনো দোষের ছিল না। দোষের ছিল ওর ফিগারটা। ওরকম বিপাশা বসুর মতন শরীরের বাঁক নিয়ে সে যখন হেটে যেত তখন আমার সমস্ত শিরা উপশিরায় ঝংকার উঠতো। উর্বশী যেন প্রাচ্যের তাম্রবর্ণ ধারণ করে ধরায় পা রেখেছে। চাহনীতে কি এক মাদকতা!
কেনা নারীতে মন উঠে গেছে ততদিনে। দু একটা শিকারও ধরা হয় মাঝে মধ্যে। কিন্তু কারো মাঝে ওকে খুঁজে পাই না। নাহ! আর সামলানো গেল না নিজেকে। হ্যা পূরবী, পূরবীই সেই নারী। আমি গিয়ে দাড়ালাম ক্ষুধার্ত বাঘের মত হোষ্টেলে আমার ঘরের পাশে অসহায় দাড়িয়ে থাকা নারকেল গাছটার পাশে।

উর্বশীর পা ফেলে এগিয়ে আসছে সে! কিছু বুঝে ওঠার আগেই হ্যাচকা টানে তাকে নিয়ে এলাম ঘরে। অস্ফুটে কি যেন বলছিল তবে চিৎকার কি করেছিল? কি জানি। সেদিন আটকে রেখেছিলাম সারাদিন। ছোবলের পর ছোবল..। হিংস্র থাবার কবল থেকে আত্মরক্ষার দুর্বার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে পূরবী সেদিন শুধু বলেছিল, তোর এমন মরণ হবে যে মানুষ থুতু দেবে তোর লাশে, পেচ্ছাব করবে। তোর মৃত দেহ শেয়ালে শকুনে ছিঁড়ে খাবে।
হায় একি হলো! ওপরের দিকে তাকাই আমি, শকুন এখনো আসে নাই। আর রাত পর্যন্ত লাশ এইভাবে পড়ে থাকলে শেয়াল আসতেও দেরী নাই। পুলিশ, পুলিশ আসে না কেন এখনো! মরে গেলেও আমি পূরবীর অভিশাপ সত্যি হতে দিতে পারি না। আরে পুলিশ খুঁজছি কি জন্যে। জীবদ্দশায় এরাইতো ছিল আমার প্রধান শত্রু। এখন ওরা এলে তো আমার লাশ নিয়ে যাবে লাশকাটা ঘরে। ওখানে নিয়ে কাটাকুটি.., ওরে বাবা কী ভয়ংকর!

ধ্যাৎ এতে ভয় কিসের, কত নিরীহ মানুষ মেরে লাশ ফালায়ে দিছি। তারাও তো লাশকাটা ঘরে গেছে তারা যদি ভয় না পায় , আমার ভয় কিসের! কোনো কিছুতে এখন আর ভয় পাবার কি আছে, আমি কি আর এখন জীবিত মানুষ আছি! আমিতো এখন আত্মা। ধুৎ শালা, একটা মাত্র ভুলের জন্য আত্মা হয়ে গেলাম। না আমি যে সব পাপ করেছি তার জন্য আমার কোনো অনুশোচনা নাই। শুধুমাত্র পূরবী , সেই যে গেল আর কোনোদিন কলেজে আসে নাই। কী জানি কোথায় সে! ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি পূরবী’ কথাটা বলতে গিয়েও সেদিন বলতে পারি নাই। কারণ বন্দুকের নল আমাকে নষ্ট করে দিলেও বিবেকহীন হই নাই তখনো। পৈশাচিকতা যে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ না এটা জানতাম। তারপরও বদনাম এড়াতে পারি নাই। আমার লিডারকে গিয়ে পার্টির কেউ কেউ খবর দিল যে, আমার চরিত্র বলতে আর কিছু নাই। মেয়ে দেখলেই ছোক ছোক করি, আস্ত মাগিবাজ. চাঁদাবাজ!

লিডার আমাকে ডাকলেন। অনেক বক্তৃতার এক পর্যায়ে বললেন, শোন, মার্ক্সবাদ লেলিনবাদই সর্বহারার মতবাদ। আর তোমরা , তোমরা এসব কি নোংরামি কর!
বললাম, বেয়াদবি নিয়েন না দাদা, যে সর্বহারা, যার কিছু নাই, তার আবার মতবাদ কিসের? জীবনের সব যুদ্ধে যারা গো হারা হারে তাদের কোনো মতবাদ থাকতে পারে না। আমি এই সব সর্বহারার মতবাদে বিশ্বাস করি না।
এ কথাতে তিনি ভীষণ রেগে গেলেন, সিংহের মত গর্জে উঠলেন, শাট্ আপ! মাইন্ড ইওর ল্যংগুয়েজ! এই ভোগবাদী নোংরা সমাজটাকে বদলে একটি মানবিক সমাজ নির্মাণের জন্য যারা সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনৈতিক পথ বেছে নিয়েছেন। নিজের জীবন বিপন্ন করে, যারা নিজেদের সব বৈষয়িক স্বার্থ উপেক্ষা করে মানুষের জন্য এক বিরাট স্বপ্ন বুকে নিয়ে নিজের কৈশোর যৌবন সমর্পণ করেছেন এই রাজনৈতিক কাজে । তাদের কাজে ভুলভ্রান্তি আছে, কিন্তু তাদের মহত্বকে খর্ব করার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে? যারা বিপ্লব করে তাদের স্বপ্ন থাকে। সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের স্বপ্ন। ওরা শ্রেণী শত্রু নিধন করে । ভারতবর্ষ স্বাধীন করার জন্য যেমন বিপ্লবীরা শত্রুনিধন করেছিল বা বাংলাদেশ স্বাধীন করার সময় মুক্তিযোদ্ধারা, যাকে কোনো ভাবেই খুন বলা যায় না, অথচ তোমরা যেটা কর ওটা শ্রেণীশত্রু নিধন নয় বরং ঐ শ্রেণীতেই নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা, হিংস্র অনৈতিক উপায়ে।

মাথা চুলকে বললাম দাদা, বিশ্বের সবখানে এখন পুঁজিবাদ। অর্থ কড়ির ঝনঝনানি, টাকা যার ক্ষমতা তার ! আর এখন দেশে যে জিনিস আসছে ভয়াবহ সব বাহিনী তাতে তো যে এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা অস্বীকার করবে তাকে সেই অপরাধে যে কোন সময় ধরে নিয়ে...। সেখানে আমাদের মত সমাজ পতিত বা সমাজ বিধ্বংসীরাও যা, ঐ বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শও তা। একথা ভাবতে খারাপ লাগে যে ধরা পড়লে আমাদেরও যা পরিণতি আর ঐ সব সমাজ পরিবর্তনের জন্য জীবন উৎসর্গকারী মহানদেরও একই পরিণতি । আমাদের জন্য স্বাভাবিক আইন আর নাই। তাই ঝুমঝামের অস্বাভাবিক জীবনই ভালো! তবে এই যুক্তিতে কাজ হলো না, তিনি আরো রেগে গেলেন। আমাকে সেদিনই দল থেকে বের করে দিলেন।

আমার মনে একটু কষ্ট লাগলেও পোয়া বারো। নিজেই দল গঠন করলাম। এখন আমিই নেতা। তবে আমার ওপরে ছায়া আছে, এখন আমি সেই ছায়ার সঙ্গী। তার ইঙ্গিতে চলা তার ছত্র ছায়ায় থাকা আর কি। তার ছিল অসীম ক্ষমতা। মনে হলো এবারো ভুল করিনি ।তান্ডব শুরু করলাম। তবে আগের নেতা আবার তার দলভুক্ত সরাসরি অস্বীকারও করতেন না। কারণ কর্মী বাঁচাতে হবে তো। রাজনীতির অনেক প্যাঁচ।

তাই কোনো পদক্ষেপেই ভুল ছিল না আমার । তবে ভুল যেটা হয়ে গেল সেটাই ফাইনাল। শালা আর একবার যদি ফিরে যেতে পারতাম! তাহলে ঐ ব্যাটা শমশের আলী...!
বেশ কিছুদিন ধরে আন্ডাগ্রাউন্ডে থাকতে হচ্ছিল। ভীষণ অর্থকষ্ট যাচ্ছিল। ছায়ার নির্দেশিত টেলিফোন গাইড ধরে ধরে বড়লোকগুলারে ফোন করতে লাগলাম। শালা! বড়লোক কি আর এমনি এমনি হইছো, কথায়ই তো আছে, দেয়ার ইজ এ ক্রাইম বিহাইন্ড এভরি ফরচুন। তাহলে তোদের দুই একটু চান্দা ফান্দা দিতে দোষ কি। লটারীতে তিনটা নাম্বার উঠলো একে একে ফোন করতে লাগলাম। প্রথম কলটা করতে ওপাশ থেকে একজন নারী ফোন রিসিভ করলেন। বললাম মি. শমশের বাড়ীতে আছেন? ওপাশ থেকে প্রশ্ন, আপনি কে বলছেন? বললাম পরিচয়টা তাকেই দেব। মহিলা পরিষ্কার গলায় বললেন তিনি বাড়ীতে নেই, বলে ফোনটা রেখে দিলেন। আমি ল্যান্ড ফোন ছেড়ে এবার আবার ফোন করলাম শমশের এর মোবাইলে। মোবাইলে রিস্ক হয়ে যায় তারপরও অন্য নাম্বারে কনভার্ট করা একটা নাম্বার থেকে রিং করলাম।

ওপাশ থেকে ভারী গলায় হ্যালো বলতেই নিজের পরিচয় দিলাম। ওপাশ থেকে কোনো জবাব নেই। বললাম অপনি বোধহয় আমাকে চিনতে পারেন নাই। সঙ্গে সঙ্গে ত্রস্ত গলায় বললেন, হ্য চিনেছি, চিনেছি, বলেন।
আপনার তো একটা ছেলে একটা মেয়ে তাই না?
উৎকন্ঠিত গলায় বললেন হ্যা, কিন্তু কেন?
আপনি যদি আপনার সন্তানদের বড় ধরণের কোনো ক্ষতি না চান তাহলে আগামী কালকের মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে আমার নির্দেশিত জায়গায় পৌঁছাবেন।
কিন্তু এত টাকা! আমার কাছে এই মুহূর্তে এত টাকা নেই। আমাকে এ্যারেঞ্জ করতে হবে।
আপনি কবে এ্যারেঞ্জ করতে পারবেন?
আগামী পরশু এবং সেটা ৫০,০০০ এর বেশী নয়। এর চেয়ে বেশী দেবার সামর্থ্য আমার নেই। আর আপনিই বা এত টাকা দিয়ে কি করবেন?
লোকটার সাহস আছে, তখনই বোঝা উচিৎ ছিল। বললাম দেখুন, আমাদের দুজন - কি বলব, ভাবলাম মনে মনে,  কমরেডই বলি! আমাদের দুজন কমরেড হসপিটালে, তাদের চিকিৎসার জন্য টাকা চাই। তারা দুজন, আর আপনার ছেলে মেয়েও দুজন! তাদের বাঁচা মরার ওপর আপনার ছেলে মেয়ের জীবনমরণ নির্ভর করছে।

ওপাশ থেকে মরিয়া হয়ে শমশের বললেন, এমন কেন হবে?
এমনই হবে, জনগণের আই মিন ধনীর টাকাতেই তাদের চিকিৎসা হবে।
কিন্তু আমি এত টাকা কোথায় পাব?
নির্বিকার ভাবে বললাম টাকা না হয় সন্তান কোনটা আপনিই ভেবে দেখেন। আর টাকা রেডি রাখেন সন্ধ্যা সাতটায় আমি আবার ফোন করবো। এভাবে একে একে তিন জনকেই ফোন করলাম, দুজনকে পাওয়া গেল। এরপর দুজনকে দুটো সময় দিলাম। প্রথম জনকে বললাম পরদিন সন্ধ্যায় শ্মশান ঘাটে আসতে। শেষ পর্যন্ত ওর সাথে দফারফা হয় দুই লাখে। তাই সই, কিন্তু ব্যাটা যে এত্ত সেয়ানা হবে। কাউকে ওর কথা বলেও যেতে পারলাম না! তার আগেই...।
যে টাইম বলেছিলাম তার প্রায় ১৫ মিনিট পর হাজির হই শশ্মান ঘাটে, গোবেচারা চেহারার এক লোক একটা কাগজের শপিং ব্যাগ হাতে দাড়িয়ে ছিল। তার কাছে যেতেই ঝোপের আড়াল থেকে মাথায় মারলো এক গাট্টা, এরপর দুনিয়া অন্ধকার। টাকা দিতে যে পুলিশ আসবে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারি নাই। একেই বলে লোভে পাপ আর পাপে ...। যখন জ্ঞান ফিরল নিজেকে আবিষ্কার করলাম হাতে ও পায়ে লোহার বেড়ী পরানো। পায়ের বেড়ীর সাথে হাতের বেড়ী জড়ানো। এ অবস্থায় হাঁটু মোড়া যায় না। উরু থেকে পরানো লোহার বেড়ের সাথে দুই পায়ে ফ্রেমের মত করে বেড়ী পরানো। হ্যান্ডকাফ তার সাথেই আটকানো। জ্ঞান ফিরে আসার পর থেকেই একের পর এক জিজ্ঞাসাবাদ। কিছু বলতে না চাইলে অকথ্য গালিগালাজ চড় থাপ্পড়। কিন্তু বড়  ধরণের কোনো টর্চার করছে না। সেবার যেমন সন্তুকে ওর গুহ্যদারে রুলার ঢুকিয়ে স্পাইনাল কর্ড ভেঙ্গে দিয়েছিল। আবার রতনকে যখন ধরল তখন কিছুদিন জিজ্ঞাসাবাদের পর একদিন গাড়ি করে নিয়ে গিয়েছিল দূরে, এরপর বলল যাও। রতন তো কিছুতেই যাবে না, সে ওদের পা ধরে কাঁদতে লাগলো।
না স্যার, আমারে যাইতে বলবেন না।
ওরা তো মহা ফ্যাসাদে পড়লো ; পুলিশ এর কাছ থেকে ছাড়া পেতে চায় না এমন আসামী কে কবে দেখেছে!
কিন্তু রতন ভেবেছিল ও যেতে শুরু করলেই ওকে...।
ওরা বলল যা ব্যাটা তোকে ছেড়ে দিয়েছি।
রতন বলে না। কিছুতেই যাইতে বলবেন না স্যার, আমারে এর চাইতে জেলে দেন।
আরে, কি করে বোঝাই যে তোকে ছেড়ে দিয়েছি!
রতন নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত রতনকে সেখানে রেখে ওরাই চলে গিয়েছিল।
রতনকে জীবিতই ছেড়েছিল। যদিও এর পরে রতনের সাথে আমার আর সরাসরি দেখা হয় নাই। ছায়ার সাথে হয়েছিল, তিনিই হেসে হেসে শুনিয়েছেন ঘটনাটা। ছায়াদের কখনো কিছু হয় না হয়তো এদেশে। এরা যুগে যুগে ভিন্ন ভিন্ন রূপে আসে। তো আমাকে ধরার পর থেকে জিজ্ঞাসা আর জিজ্ঞাসা। তেমন কিছুই বলি না তারপরও জিজ্ঞাসা। মনে হলো অনন্ত কাল ধরে চলছে, এর যেন আর শেষ নাই। এভাবে দুদিন পর একদিন হঠাৎই মধ্যরাত পেরিয়ে যাবার পর জেল খানায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আমাকে একটা জীপে তোলা হলো। ঐ মুহূর্তে সব কিছুই আমার কাছে অনিশ্চিত। আদৌ আমাকে কোনো জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, নাকি আরো কয়েক রাত এভাবে। তার পর হয়তো এক যায়গায় গাড়ি দাঁড়াবে আর আমাকে নামিয়ে দেয়া হবে , আর তার পরেই....।
আমি রতন না, তাই আমার জন্য তাইই হলো যা আমি সন্দেহ করেছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে নদীর পাড়টা যেখানে আমি পড়েছিলাম লাশ হয়ে সেখানে পুলিশ আর সাংবাদিকে ছেয়ে গেল। অবশেষে সব সাঙ্গ হলো ! এখন লাশকাটা ঘর, তার পর... কেউ জানে না। আর ভিড়ের মধ্য থেকে ঠিক তখনই গুঞ্জন উঠলো ক্রসফায়ার, ক্রসফায়ার!