মালিনী
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
শ্রীধর দাস তার লম্বা এবং ওজনদার ঝোলাটা মাটিতে নামিয়ে মালিনী'র হাত ধরে শেষবারের মতো ঠিক পেছনে সদ্য ছেড়ে আসা ঘুমন্ত গাঁয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
--এট্টু জিরিয়ে নাও মালিনী। তুমি তো বেশ হাঁপিয়ে উঠেছো গো!
সত্যি সত্যি মালিনী শ্রীধরের লম্বা লম্বা পায়ের হাঁটার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে। তাই জিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাবে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে মাটিতে বসে পড়ে। শ্রীধরও ওর পাশে গুছিয়ে বসে। ডান হাতে ধরা একতারাটার তারে খুব মৃদু টুং-টাং আওয়াজ তুলতেই নিস্তব্ধ রাতে বেশ অনেকটা ছড়িয়ে পড়ে তারের তীব্র অনুরণন। মালিনী জোড়া তালগাছের ফাঁকে প্রায় মরা চাঁদের দিকে নির্নীমেষে চেয়ে কিছু একটা ভাবছিল।
শ্রীধর দাস পাঁচ পুরুষের বাউল-বৈরাগী মানুষ। বড় ভাল গান গায়। দেহতত্ত্বের গানে কতজনের যে মন মজিয়েছে তার লেখাযোখা নেই। দু'দুবার ঘর বেঁধেছিল, কিন্তু বৈরাগী স্বভাবের জন্যে সে ঘর টেকেনি। কিছুক্ষণ পরে শ্রীধর দাস বলে ওঠে,
--আর দেরি করলি আলো ফুটে যাবে মালিনী। ইস্টিশন এখনও এককোশ দূরে।
--ঘর ছাড়তে মন চাইছে না বাউল।' যেন চাঁদকে সাক্ষী রেখেই কথাগুলো বললো মালিনী।
--সে কী! ফিরি যেতি চাও নাকি!
--সতের বছর বয়সে লোকটার হাত ধরে এই গাঁয়ে ঢুকেছি। কুনোদিন অযত্ন অছেদ্দা করেনি। শুধু আমার কোল ভরাতে পারবেনি বলে দশ বচ্ছরের সম্পক্ক চুকিয়ে চলে যাবো তোমার সঙ্গে বাউল!
--আমাকে তুমি ভালোবাসো না মালিনী?
--ঠিক বুঝতে পারছি না গো বাউল! বাঁজা মেয়েমানুষ হয়ে বাঁচতে চাইনি বলেই হয়তো--
--আমি ভেবেছিনু আমার পীরিতে মজে তুমি মরেছো!
--সংসার তো অনেক হলো, মা বলে কেউ না ডাকলে জীবনটা বড় খাঁ খাঁ করে যে!
শ্রীধর দাস আয়েস করে বিড়ি ধরায়। মালিনীর সঙ্গে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবার স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি নতুন ঘর টিকিয়ে রাখার শপথ নিয়েছিল মনে মনে।
মালিনী ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। শ্রীধরের চোখের সামনে এক এক করে শাড়ি অন্তর্বাস খুলে মাটিতে রাখে। মরা চাঁদের আলোয় মালিনীর নির্বসন শরীরের দিকে তাকিয়ে পাথর হয়ে যায় শ্রীধর। মালিনী ফিস ফিস করে বলে ওঠে,
--আমাকে তুমি মা করে দাও বাউল। তোমার সঙ্গে ঘর বাঁধা যাবে না। তুমি তো ঘরের মানুষ নও।
--কী বুলছো গো তুমি! শুধু এই জন্যি--
--তোমাকেও আমি ভালোবাসি গো বাউল। সে তুমি বুঝবে না। না বাসলে কোন অধিকারেতোমার কাছে সন্তান চাইবো বলো! বলতে বলতে এক অসহ্য আবেগ ও উন্মাদনার সঙ্গে শ্রীধরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে মালিনী।
শ্রীধর দাসকে আর কখনো কেউ গাঁয়ে দেখেনি। কিন্তু তার মন মজানো প্রাণ জুড়ানো গানগুলো কচি গলায় গেয়ে গেয়ে সকলকে তাজ্জব করে দেয় মালিনীর কিশোরী কন্যা শ্রীময়ী!