মৃত্যুফাঁদ

মূল Roald Dahl - Lamb to the Slaughter

অনুবাদ- তিমুর

timursblog@yahoo.com

        

© সংরক্ষিত 

প্রথম পর্ব

 

 

পর্দা টানা ঘরটা আরামদায়কভাবে উষ্ণ, দুটো টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে, একটা মহিলার দিকে, অন্যটা বিপরীত দিকের চেয়ারের পাশে । পাশের সাইডবোর্ডে দুটো লম্বা গ্লাস, সোডা ওয়াটার, হুইস্কি রাখা আর থার্মোস বাকেটে তাজা বরফের টুকরো রাখা ।
মেরি ম্যালোনি তার স্বামী প্যাট্রিকের ফিরে আসার অপেক্ষায় আছে ।
বার বার মেরি ঘড়ির দিকে চাইছে, তবে দুশ্চিন্তায় পড়ে নয় । যত মিনিট যাচ্ছে ততই ওর আসার সময় হচ্ছে । একটা মৃদু হাসির উদ্ভাস মেরিকে জড়িয়ে রেখেছে । মাথাটা যেভাবে কাঁথা সেলাইয়ের উপর ঝুঁকে আছে সেটাও আশ্চর্য প্রশান্তির । মেরির ত্বক-এখন সে ছয়মাসের অন্তস্বত্বা, আশ্চর্য উজ্বল এক আভা বিকিরণ করছে । মুখ তার কোমল, শান্ত চোখজোড়া যেন আগের থেকে বড় আর গাঢ় রং নিয়েছে । ঘড়িতে যখন পাচ্টা বাজতে দশ মিনিট বাকি, তখন ঠিক নিয়মমাফিক ড্রাইভওয়েতে গাড়ির টায়ারের শব্দ পেল মেরি । দড়াম করে গাড়ির দরজা বন্ধ হলো, পায়ের আওয়াজ এগিয়ে জানালার পাশ দিয়ে, দরজায় চাবি ঘোরানোর শব্দ হল, আর মেরিও রোজকার মত সেলাই ফেলে উঠল, চুমু দিয়ে অভ্যর্থনা করবার জন্য ।
'হ্যালো, ডার্লিং,' মেরি বলল ।
'হ্যালো ডার্লিং,' জবাব দিল প্যাট্রিক ।
ওর কোটটা নিয়ে আলমারিতে ঝুলিয়ে রাখল মেরি তারপর ড্রিংক বানাতে শুরু করলো । ওর জন্য বেশ জোরদার মিক্স, নিজের জন্য অপেক্ষাকৃত হালকা । আবার সেলাই নিয়ে নিজের চেয়ারে বসে পড়ল মেরি, ওর স্বামী ওপাশের চেয়ারে বসে লম্বাটে গ্লাসটা নাড়াচ্ছে এমন করে যে গ্লাসের পাশে বরফের কিউব বাড়ি লেগে টুং টাং আওয়াজ হচ্ছে ।
মেরির জন্য দিনের এই সময়টা সবচেয়ে চমৎকার । সে জানে তার স্বামী প্রথম ড্রিংকটা শেষ না হওয়ার আগে মুখ খোলে না সচরাচর । এতক্ষ বাড়িতে একা থাকার পর চুপচাপ বসে সে স্বামী সঙ্গ উপভোগ করে । অনেকটা সুর্যস্নানের মতন অনুভুতি, যে উত্তাপের ছোঁয়া সে এই পুরুষের মধ্যে থেকে পায় । যেভাবে ঢিলেঢালা ভাবে প্যাট্রিক চেয়ারে বসে, যেভাবে দরজা দিয়ে ঘরে ঢোকে, যেভাবে লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘরের মধ্যে চলাফেরা করে সবই তার মুগ্ধতার বিষয় । মেরির দিকে তাকালে তার চোখে যেরকম দূরাগত দৃষ্টি দেখা দেয়, মুখটা ওর যেরকম আজব কিসিমের, যেভাবে প্যাট্রিক হুইস্কি হাতে ক্লান্তি কিছুটা না কাটা পর্যন্ত চুপচাপ বসে থাকে
'টায়ার্ড ডার্লিং?'
'হ্যাঁ,' বলল ও । 'আমি খুব টায়ার্ড,' বলেই একটা অবাক করা কাজ করল প্যাট্রিক। এক চুমুকে গ্লাসের বাকি অর্ধেক হুইস্কি ও শেষ করে ফেলল । মেরি ঠিক তাকিয়ে ছিল না ওর দিকে, কিন্তু গ্লাসের তলে আইসকিউব ঠোক্কর খাওয়ার খটখট শব্দ শুনে বুঝল ও । চেয়ার থেকে উঠল লোকটা আরেকটা ড্রিংক বানানোর জন্য ।
'আমি বানিয়ে দিচ্ছি!' এক লাফে উঠল মেরি ।
'বসো,' বলল প্যাট্রিক ।
যখন ও ফিরে এল । ড্রিংকের গাঢ় রং দেখেই মেরি বুঝলো যথেষ্ট হুইস্কি পড়েছে ওতে ।
'ডার্লিং, তোমার স্লিপার জোড়া এনে দেই ?'
'না ।'
গাঢ় হলদেটে ড্রিংকে চুমুক দিতে দেখল মেরি ওকে । এত কড়া ওটা যে তেলালো ফেনা ভাসছে গ্লাসে ।
'আমি মনে করি এটা ভীষণ অন্যায় যে তোমার মতন সিনিয়র ডিটেকটিভকে সারাদিন পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ।'
কোন উত্তর দিল না লোকটা । আবার সেলাইয়ে মন দিল মেরি । কিন্তু গ্লাসের কাঁচে বরফের টুংটাং ও শুনতে পাচ্ছে পরিস্কার ।
'ডার্লিং, কিছু পনির এনে দেবো ? আজ বিষ্যুদবার বলে আমি সাপার বানাইনি ।'
'না,' আবার বলল সে ।
'যদি তুমি এত টায়ার্ড থাকো যে বাইরে গিয়ে খেতে পারবে না,' বলে চলল মেরি । 'ফ্রিজারে মাংস আর যা যা দরকার সব আছে । এক পা না নড়ে, চেয়ারে বসেই খেতে পারো তুমি ।'
মেরির চোখজোড়া উত্তরের অপেক্ষায় রইল । কিন্তু নট নড়নচড়ন হয়ে চুপ করে বসে রইল মেরির স্বামী ।
'সে যাই হোক,' বলল মেরি । 'আমি কিছু পনির আর ক্র্যাকার আনি ।'
'আমার খাবার ইচ্ছা নেই ।'
অস্বস্তির সাথে চেয়ারে নড়ে চড়ে বসল মেরি । বড় বড় চোখে এখনো সে দেখছে ওকে । 'কিন্তু তোমার খাওয়া দরকার! আমি বানাচ্ছি, খাওয়া না খাওয়া তোমার ব্যাপার ।'
উঠে দাড়িয়ে সেলাইটা ল্যাম্পের ধারে রাখল ও ।
'বসো,' বলল প্যাট্রিক। 'এক মিনিটের জন্য চেয়ারে বসো ।'
এই প্রথম ভয় পেতে শুরু করল মেরি ।
'বসো,' বলল প্যাট্রিক । 'চেয়ারে বসো ।'
ধীরে ধীরে আবার চেয়ারে পিঠ ঠেকাল মেরি । বড়বড় বিভ্রান্ত চোখে ও দেখছে, দ্বিতীয় ড্রিংকটা শেষ করে, শুন্য গ্লাসটার দিকে ভুঁরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে প্যাট্রিক।
'শোন,' বলল প্যাট্রিক । 'আমার কিছু কথা বলার আছে ।'
'কী ব্যাপার ডার্লিং? কী হয়েছে ?'
একদম নিশ্চল হয়ে বসে আছে প্যাট্রিক, মাথাটা এমনভাবে নামিয়ে রেখেছে যে ল্যাম্প থেকে পড়া আলো মুখের উপরের অংশে পড়ে, মুখ আর চিবুক ছায়ার মধ্যে । মেরি খেয়াল করলো প্যাট্রিকের চোখের পাশের একটা পেশী লাফাচ্ছে ।
'আমি দুঃখিত কথাটা শুনলে তুমি আঘাত পাবে,' বলে চলল ও । 'কিন্তু অনেক চিন্তা করে দেখলাম সবকথা তোমাকে বলে ফেলাই ভাল । আশা করি আমাকে খুব দুষবে না তুমি ।'
এবং মেরিকে সব খুলে বলল ও । খুব বেশী সময় লাগল না, খুব বেশি হলে চার কী পাঁচ মিনিট । প্রতিটা শব্দে জেগে ওঠা নতুন আতংক নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল মেরি ।
'তো এই হচ্ছে ব্যাপার,' বলে শেষ করল ও । 'আমি জানি এ কথা বলার জন্য এসময়টা খুবই খারাপ । কিন্তু আর কোন উপায় ছিল না । অবশ্যই ভরনপোষনের টাকাপয়সা পাবে । আশা করি এটা নিয়ে বড় হুজ্জোত পাকাবে না তুমি । আমার ক্যারিয়ারের জন্য সেটা খুবই খারাপ হবে ।'
মেরির প্রথম চিন্তা ছিল গোটা ব্যাপারটা অবিশ্বাস করার । হতে পারে ও মুখই খোলেনি ! গোটা কথপোকথনটাই মেরির কল্পনা ? সে যদি নিজের কাজ করে যায়, তবে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে ওঠার মতই বুঝবে আসলে কিছুই ঘটেনি ।
'আমি সাপার বানাবো,' ফিসফিস করে বলল মেরি । এবার আর ওকে বাধা দিল না লোকটা ।
পায়ের নীচে মেঝের অস্তিত্ব টের পাচ্ছে না মেরি । সামান্য অসুস্থতা আর বমি করার ইচ্ছা ছাড়া আর কিছুই টের পাচ্ছে না ও । সবকিছুই স্বয়ংক্রিয় ভাবে চলছে । যন্ত্রচালিতের মত সেলারে নেমে, আলোর সুইচ জ্বালিয়ে, ডিপফ্রিজের ডালা খুলে প্রথম যে জিনিসটা হাতে ঠেকল সেটাই টেনে বের করল ও । কাগজে জড়ানো ওটা তাই মোড়ক খুলে জিনিসটা আবার দেখল ও ।
একটা বরফজমা ভেড়ার রান ।
ঠিক আছে । এটা দিয়েই রাতের খাবার বানানো যাবে । হাড়ের দিকটা দুহাতে ধরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে এল ও । ভেড়ার রানটা দুহাতে ধরে লিভিংরুমে ঢুকল মেরি । ঘরের দিকে পিঠ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে প্যাট্রিক।
'ফর গডস সেক,' ওর পায়ের আওয়াজ না ঘুরেই বলল প্যাট্রিক । 'আমার জন্য সাপার বানিও না, আমি বাইরে যাচ্ছি ।'
সোজা হেঁটে ওর পিছনে চলে এল মেরি । তারপর জমাটবাঁধা ভেড়ার রানটা শুন্যে তুলে প্যাট্রিকের মাথার পিছনে আঘাত হানল মেরি ।
একটা স্টিলের ডান্ডা দিয়ে বাড়ি মারলেও ফলাফল একই হত ।
এক পা পিছনে হটলো মেরি । আজব ব্যাপার হচ্ছে, বাড়ি খাবার পরেও চার-পাঁচ সেকেন্ড নিশ্চল অবস্থায় থেকে ধীরে ধীরে দুলতে দুলতে কার্পেটের উপর আছড়ে পড়ল প্যাট্রিক।
ওর মাটিতে পড়ার আর ছোট টেবিলটা উল্টে পড়ার শব্দে শক থেকে বেরিয়ে এল মেরি । ধীরে ধীরে চেতন জগতে প্রবেশ করল ও । শীত লাগছে আর এখনো মাংসের টুকরোটা দুহাতে শক্ত করে ধরে আছে ও ।
 

দ্বিতীয় পর্ব

 

 

'তাহলে,' ভাবল মেরি । 'আমি ওকে খুন করে ফেলেছি ।'
কীভাবে এত দ্রুত ওর মন পরিষ্কার হয়ে গেল তা এক আশ্চর্য ব্যাপার । দ্রুত চিন্তা করতে লাগলো ও । একজন ডিকেটটিভের বউ হিসেবে শাস্তি কী হবে জানা আছে তার । তাতে কিছু আসে যায় না, বরং সেটাকে একধরনের মুক্তি হিসেবেই দেখবে ও । কিন্তু পেটের বাচ্চাটার কী হবে ? খুনী মায়েদের না জন্মানো বাচ্চাদের সম্বন্ধে আইন কী বলেছে ? মা আর বাচ্চা দুটোই কী ঝুলবে ? না কি ওরা দশমাস অপেক্ষা করবে ? কী শাস্তি দেবে ওরা ?
মেরি ম্যালোনি জানে না । তবে কোন ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে না ও ।
ভেড়ার রানটা কিচেনে নিয়ে একটা প্যানে রেখে আভেনে রেখে তন্দুরের আঁচটা বাড়িয়ে দিল মেরি । তারপর হাত ধুয়ে উপরতলার বেডরুমে ছুটল ও । আয়নার সামনে বসে চুল ঠিক করলো, সামান্য মেক
- আপ ছোঁয়াল । একবার হাসার চেষ্টা করে দেখল, অদ্ভুত দেখাচ্ছে । আবার হাসল ও ।
'হ্যালো স্যাম,' হাসিখুশি গলায় জোরে জোরে বলল ও ।
গলাটাও অদ্ভুত শোনাচ্ছে ।
'কিছু আলু দরকার আমার । হ্যাঁ, একক্যান মটরশুঁটিও চাই ।'
এবার হাসি আর গলার আওয়াজ দুটো ই ভাল আসছে । দুয়েকবার রিহার্সাল দিয়ে এক দৌড়ে নীচে নেমে কোটটা গায়ে দিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাগান পার হয়ে হয়ে রাস্তায় নামল মেরি ।
এখন প্রায় ছয়টা বাজে । গ্রোসারি শপে এখনো আলো জ্বলছে ।
'হ্যালো স্যাম,' হেসে কাউন্টারের পিছনের লোকটাকে ডাকলো মেরি ।
'গুড ইভনিং মিসেস ম্যালোনি, কী করতে পারি আপনার জন্য?'
'কিছু আলু দরকার আমার । হ্যাঁ, একক্যান মটরশুঁটিও চাই ।'
তাক থেকে মটরশুঁটি পাড়ার জন্য মেরির দিকে পিছনে ফিরল স্যাম ।
'প্যাট্রিক আজ বাইরে খাবে না ঠিক করেছে, আমরা সাধারনত বিষ্যুদবার দিন বাইরে কোথাও খেয়ে আসি,' জানাল মেরি । 'আর বাসায়ও কোন সব্জি নেই ।'
'তাহলে মাংস নিলে কেমন হয় মিসেস ম্যালোনি ?'
'নাহ, আমার ফ্রিজারে একটা আস্ত ভেড়ার রান আছে ।'
'আমি ফ্রোজেন মাংস রান্না করে দেখিনি কখনো স্যাম । আপনার মনে হয় সব ঠিক মত হবে ?'
'আমি মনে করি না,' বলল দোকানদার । 'এতে কিছু ফারাক বোঝা যাবে । আপনাকে আইডাহো আলু দেবো ?'
'চমৎকার । দুটো দিন ।'
'আর কিছু ?' মাথা একদিকে কাত করল স্যাম । 'খাবার পরে খাওয়ার জন্য কিছু লাগবে ?'
'আপনার সাজেশন কী স্যাম?'
'চিজকেকের একটা বড় স্লাইস নিলে কেমন হয়? আমি জানি ও এটা পছন্দ করে ।'
'পার্ফেক্ট,' বলল মেরি । 'ওর ভারী পছন্দ চিজকেক ।'
সবকিছু প্যাকেটে মোড়ানো হয়ে গেলে জিনিসের দাম দিয়ে সবচেয়ে মধুর হাসিটা উপহার দিল মেরি । 'থ্যাংকইউ স্যাম, গুডনাইট ।'
'গুডনাইট মিসেস ম্যালোনি, থ্যাংকইউ ।'
দ্রুত পায়ে ফিরে চলল মেরি, এখন পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই চলছে । সে বাড়ি যাচ্ছে আর তার স্বামী রাতের কাবারের অপেক্ষায় আছে । সে রাতের খাবার খুব যত্ন নিয়ে রাঁধতে যাচ্ছে । এখন যদি সে বাড়ি ফিরে কোন অদ্ভুত বা ট্র্যাজিক কিছু দেখেতো সে শকে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হতেই পারে । আসলে এরকম কিছু যে ঘটবে সে জানেই না !
এইভাবেই করতে হবে গোটা ব্যাপারটা, মনে মনে বলল ও । সবকিছূ যেন স্বাভাবিক আর প্রাণবন্ত হয় । কোন অভিনয়ের দরকারই আর হবে না ।
তাই হাসতে হাসতে একটা গানের কলি যখন কিচেনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলো মেরি ।
'প্যাট্রিক!' জোরে ডাকলো ও । 'প্যাট্রিক ডার্লিং! কোথায় তুমি ?'
ঠোঙ্গাটা টেবিলে রেখে লিভিং রুমের দিকে এগিয়ে গেল ও । ওখানেই পড়ে আছে প্যাট্রিক, পা গুলো বাঁকা হয়ে আছে, আর একটা হাত চাপা পড়েছে শরীরের নীচে । দৃশ্যটা দেখে সত্যিই শক পেল মেরি । সমস্ত পুরনো প্রেম আর স্মৃতি উথলে উঠছে তার । দৌড়ে এসে হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদতে শুরু করলো ও । কোন অভিনয়ের দরকার হল না ।
কয়েক মিনিট পরে উঠে পুলিশ স্টেশনে ফোন করল ও । নাম্বার জানাই আছেই ওর, আরেক প্রান্তের লোকটা ধরতেই বলল মেরি, 'প্যাট্রিক মারা গেছে !'
'কে বলছেন?'
'ম্যালোনি, মিসেস প্যাট্রিক ম্যালোনি ।'
'আপনি বলতে চাইছেন প্যাট্রিক ম্যালোনি মারা গেছেন ।'
'আমার তাই মনে হয়,' ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল ও । 'মেঝের উপর পড়ে আছে ও ।' আমার ধারনা ও মারা গেছে ।'
'এক্ষুনি আসছি আমরা,' বলে ফোন কেটে দিল পুলিশ লোকটা ।
খুব দ্রুত চলে এল পুলিশের গাড়ি, যখন মেরি দরজা খুলল দুজন পুলিশ ঢুকল বাড়ির ভিতর । ওদেরকে চেনে মেরি, আসলে থানার প্রাব সবাইকেই চেনে সে । ধপাস করে একট আচেয়ারে বসে পড়ল ও । তারপর প্যাট্রিকের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা লোকটা, যার নাম ও'ম্যালি, পাশে গিয়ে দাঁড়াল ।
'ও কী মারা গেছে?' চিৎকার করে জানতে চাইল মেরি ।
'আমি দুঃখিত, ব্যাপার তাই । কী করে ঘটল এটা?'
অল্প কথায় মেরি জানালো কী ভাবে গ্রোসারের দোকান থেকে ফিরে এসে প্যাট্রিককে এইভাবে পড়ে থাকতে দেখেছে সে । ও যখন কাঁদছে, কথা বলছে কাঁদছে, নুনান নামে অন্য লোকটা মৃত লোকটার মাথার পিছনে জমাট বাঁধা রক্তের ছোপ দেখতে পেল । ও'ম্যালিকে দেখাতেই সে ফোনের দিকে এগিয়ে গেল ।

শেষ পর্ব

 

খুব শিগগিরই আরো অনেক মানুষের আনাগোনা শুরু হয়ে গেল বাসায় । প্রথমে একজন ডাক্তার এল, তারপর দুই ডিটেকটিভ, একজনকে মেরি নাম ধরে চেনে । তারপর এল একজন পুলিশের ফটোগ্রাফার আর ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশেষজ্ঞ । অনেক ফিসফাস আলাপ হলো লাশের পাশে । গোয়েন্দারা সব প্রশ্ন করে চলল, যদিও মেরির প্রতি খুবই ভদ্র ব্যাবহার করছিল ওরা । পুরনো গল্পটা আবার বলল, প্যাট্রিক আসার সময় সেলাই করছিল ও, প্যাট্রিক ক্লান্ত ছিল, এত ক্লান্ত ছিল যে বাইরে যাবার শক্তিই ছিল না তার । মেরি তাই আভেনে মাংস চাপিয়ে দোকানে গেছিল সব্জি কিনতে । ফিরে এসে দেখে এই অবস্থা ।
কোন দোকানে? দুই ডিটেকটিভের একজনের প্রশ্ন ।
বলল মেরি । শুনে সে আরেক গোয়েন্দার কানে কানে কী যেন বলতেই সে ঘর ছেড়ে বাইরে গেল । পনেরো মিনিট পরে সে ফিরে এল এক তাড়া নোট নিয়ে । ফোঁপানির মধ্যেই মেরি ডিটেকটিভদের ফিসফাস শুনতে পেল '....একেবার স্বাভাবিক আচরণ করেছে....ভারী হাসি খুশি ছিল....ভাল একটা কিছু রান্নার চেষ্টায় ছিল...চিজকেক, মটরশুঁটি...না, এ অসম্ভব যে ও.... ।'
একটু পরে ফটোগ্রাফার আর ডাক্তার লোকটা চলে গেল । আরো দু'জন লোক এসে স্ট্রেচারে করে লাশটা নিয়ে গেল । তারপরে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ওয়ালা চলে গেল । দুজন ডিটেকটিভ রয়ে গেল, আরো দুজন পুলিশ । জ্যাক নুনান খুব মোলায়েমভাবে জানতে চাইল রাতটা ও অন্য কোথাও থাকতে চায় কি না? ওর বোনের বাসায় বা দরকার হলে নুনানদের বাসাতেও সে থাকতে পারে ।
না, জানাল মেরি । এখন এক গজ নড়বারও ক্ষমতা নেই ওর । পরে যখন ভাল বোধ করবে, এখন সে একেবারেই ভাল বোধ করছে না ।
অতএব ওকে রেখে ওরা ওদের বাড়ি তল্লাশির কাজ চালিয়ে গেল । অনেকক্ষণ পরপর ডিটেকটিভরা ওকে এক আধটা প্রশ্ন করছে । জ্যাক নুনান এসে জানাল, ওদের ধারনা তার স্বামী মাথার পিছনে কোন ভারী ধাতব জিনিসের আঘাতে মারা গেছে । ওরা অস্ত্রটা খুঁজছে । হতে পারে খুনী লোকটা তার সঙ্গে করেই জিনিসটা নিয়ে কেটে পড়েছে । কিংবা হতে পারে সে জিনিসটা বাড়ির আশপাশেই ফেলে গেছ এবা লুকিয়ে রেখে গেছে ।
'এটা অনেক পুরনো গল্প,' বলল জ্যাক । 'অস্ত্র পেলেই অপরাধীর হদিস পাওয়া অনেক সহজ ।'
বেশ খানিকক্ষন পরে একজন ডিটেকটিভ এসে ওর পাশে এসে বসল । এমন কিছু আছ এবাড়িতে যেটা অস্ত্র হিসেবে ব্যাবহার করা যায় ? মেটালের তৈরি ভেস? বড় কোন স্প্যানার?
না, জানাল মেরি । কোন মেটাল ভেস নেই ।
'কোন বড় স্প্যানার?'
তার মনে হয় না কোন বড় স্প্যানার আছে । কিন্তু ওদের গ্যারেজে থাকতে পারে ।
তল্লাশি চলল । বাড়ির চারপাশে বাগানেও খুঁজছে ওরা । পর্দার ফাঁক দিয়ে টর্চের আলো এসে পড়ছে । ন'টার দিকে মেরি ম্যান্টলপিসের উপর রাখা ঘড়িটার দিকে তাকাল । তল্লাশীদলও ক্লান্ত হয়ে পড়ছে ।
'জ্যাক,' সার্জেন্ট নুনানকে বলল ও । 'আমাকে একটা ড্রিংক দেবে ?'
'শিওর, তুমি এই হুইস্কি খাবে ?'
'প্লিজ, ছোট একটা দাও । খেলে ভাল লাগবে আশা করি ।'
গ্লাস বাড়িয়ে ধরল নুনান ।
'তুমি নিজেও একটা নাও না কেন?' বলল মেরি । 'তুমি নিশ্চয়ই ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছ । তোমরা সবাই আমার সাথে খুব ভাল ব্যাবহার করেছো আজ ।'
'এটা নিয়মে নেই,' বলল জ্যাক । 'তবে একটু নিতে পারি ক্লান্তি দূর করার জন্য ।'
একেক করে সবাই এল । তাদেরকে এক চুমুক করে হুইস্কি পান করতে রাজী করানো গেল । গ্লাসহাতে সবাই আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িবে রইল । ওকে কী বলে স্বান্তনা দেবে বুঝতে পারছে না কেউ । কী ভেবে সার্জেন্ট নুনান কিচেনে ঢুকল । 'মিসেস ম্যালোনি, আভেনটা এখনো চালু আছে । ভিতরে মাংস সহ ।'
'কী সাংঘাতিক!' বলে উঠল মেরি ।
'আমি এটা বন্ধ করে দেই ?'
'তাই করো জ্যাক, ধন্যবাদ ।'
দ্বিতীয়বার সার্জেন্ট আসতেই বড় বড় পানিভরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে মেরি বলল । 'তোমরা আমার একটা উপকার করতে পারবে ।'
'আমরা নিশ্চয়ই চেষ্টা করে দেখব ।'
'তোমরা সবাই প্যাট্রিকের বন্ধু, প্যাট্রিকের খুনীকে বের করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছো । তোমাদের নিশ্চয়ই ভীষণ খিদে পেয়েছে এত দেরী হওয়াতে । প্যাট্রিকের আত্মা, তার উপর ঈশ্বরের আশীর্বাদ বর্ষিত হোক, আমাকে ক্ষমা করবে না যদি তোমাদের আমি না খেয়ে যেতে দেই । তোমরা আভেনে রান্না মাংসটা খেয়ে ফেল ।'
'তা হতেই পারে না !' বলল সার্জেন্ট নুনান ।
'প্লিজ, ' অনুরোধ করল মেরি ম্যালোন । 'প্লিজ ওটা খেয়ে ফেল । আমি একন কিছুই মুখে তুলতে পারবো না । খেয়ে তারপর তোমরা তোমাদের কাজে যাও ।'
বেশ কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করল চার পুলিশ । কিন্তু ওদের পেটে খিদের আগুন জ্বলছিল নিঃসন্দেহে । শেষ পর্যন্ত ওদের কিচেনে পাঠাতে রাজি করাতে পারল মেরি । চেয়ারে বসে থেকেই ওদের কথা শুনতে পাচ্ছে ও । মুখভর্তি খাবার থাকায় কথা জড়িয়ে যাচ্ছে ওদের ।
'আরো নাও চার্লি?'
'না, আর নেয়া ঠিক হবে না ।'
'আরে ও আমাদের এটা শেষ করতে বলেছে । আমরা একটা উপকার করছি মেয়েটার ।'
'ঠিক আছে । আরেকটু দাও তাইলে ।'
'বেচারা প্যাট্রিকে রমাথায় নিশ্চয়ই একটা বিরাট সাইজের লাঠি পড়েছিল । ডাক্তার বলেছে, ওর খুলি এমনভাবে গুঁড়িয়ে গেছে যেন কামারের পেল্লাই মুগুর পড়েছে মাথায় ।'
'সেজন্যই এটা খুঁজে পাওয়া সহজ হবে ।'
'আমিও তাই বলি ।'
'যেই এটা করে থাকুক, নিশ্চয়ই সে অস্ত্রটা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে না ।'
ওদের একজন ঢেঁকুর তুলল ।
'আমার মনে হয় এটা এই বাড়িতেই আছে ।'
'হতে পারে আমাদের নাকের ডগাতেই আছে । কী বল জ্যাক ?'
পাশের ঘর থেকে মেরি ম্যালোনি খিলখিল করে হাসতে শুরু করল।
 

--- শেষ ---