নজরুলের কবিতায় চিত্রকল্প
সাইফুজ্জামান
কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবির অভিধায় ভূষিত। বাংলা কবিতার পরিমন্ডলে তাঁর আর্বিভার ধূমকেতুর মতো। মুসলিম চেতনা জাগৃতিতে, স্বদেশ বন্দনায় তাঁর কণ্ঠ উচ্চকিত। রবীন্দ্রপ্রভাব প্রলয় ভেঙে তিনি উদিত হয়েছিলন সর্য তেজ প্রখরতায়। তাঁর কবিতায় নানা নিরীক্ষা, রূপকল্প ও সৌন্দর্য অন্বেষণ বিস্তৃত।
নজরুল ইসলামে প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত। এই কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতায় তাঁর স্বতন্ত্রতা চিহ্নিত। কোমল পেলবতা দ্রোহ ও প্রেমে। ছন্দ ও ভাষার নিখুঁত ব্যবহার তাঁকে সুধীমহলে বিশেষভাবে আদৃত করে। বিদ্রোহী কণ্ঠকে আমরা আবিষ্কার করি। অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, ভাঙার গান-এ নজরুল সংগ্রামের আহবান জানিয়েছেন। নবযুগ নির্মাণ করলেন নজরুল বক্তব্য ও চিত্রকল্পে। ‘বল বীর চির উন্নত মমশীর’ তাঁর কবিতার ভিত্তিভূমি। বিদ্রোহী উচ্চারণ শুধুমাত্র আবেগতাড়িত নয়, জীবনের সমগ্রতা তাঁর কাছে উপস্থিত হয়েছে। কবি নজরুল ‘চপল মেয়ের ভালোবাসা’ ‘ কাঁকন চুড়ি কনকন’ ‘কুমারীর প্রথম পরশকে’ তাঁর কবিতায় তুলে আনেন।
মধ্যযুগের বাংলা কবিতায় উপমা ও চিত্রকল্পের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। মধ্যযুগের কবিরা গতানুগতিক ধারায় কবিতা নির্মাণ করেছেন। তাঁদের রচনায় সাধারণ প্রথাগত রীতি অনুসরিত হয়েছে। চিত্রকল্প সম্পর্কে টি এস এলিয়েট উল্লেখ করেছেন : “চিত্রকল্প সৃষ্টির ব্যাপারে কিংবা রূপকল্পনায় কবি অধ্যয়নের অভিজ্ঞতা থেকে আংশিকভাবেই উপকৃত হন মাত্র; কারণ সংবেদশীল কবি চিত্ররচনা ও রূপকল্পনায় তার সমগ্র জীবনের অভিজ্ঞতাকেই কাজে লাগান। জীবনব্যাপী কবি যা শোনেন, দেখেন অনুভব করেন তাই তাঁর চেতনা ও সৃষ্টি নানারূপে ও রেখায় প্রতিভাত হয় আর সেসবই তাঁকে চিত্ররচনা ও রূপকল্পনায় সহায়তা করে।”
চিত্রকল্প শুধুমাত্র শব্দ চিত্র কিংবা ধ্বনিচিহ্ন নয়। আমাদের দেখা চারপাশের অসংখ্য ঘটনা ‘চিত্রকল্পে’র অন্তর্গত উপাদান। বাস্তব ক্ষেত্রে, বিশেষ করে কবিতা নির্মাণে চিত্রকল্পের ব্যবহার যে তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে তা আমরা কবি নজরুলের কবিতায় পাই। নজরুল সচেতন ছিলেন উপমা, চিত্রকল্প ব্যবহারে। তাঁকে কয়েকটি মাত্র কবিতা থেকে ব্যবচ্ছেদ করা কঠিন। স্বল্প পরিসরে নজরুলের কবিতার খণ্ডিত ব্যবচ্ছেদ করা যেতে পারে।
কবির চারপাশের ঘটনাপ্রবাহ থেকে তিনি সংগ্রহ করেন কবিতার বিষয়বস্তু। জীবনের চাওয়া-পাওয়া মনোজগতের পরিবর্তন, চলমান ঘটনাপ্রবাহ, প্রতিক্রিয়া জাগরণ, উন্মোচন নজরুল নিপুণতায় বাণীবদ্ধ করেছেন। জীবনের ক্লেদাক্ততা থেকে স্বপ্নপুরুষ যাত্রা শুরু করেন। কল্পনায় দরোজা, জাগতিক পৃথিবীর কপটতা তাঁর দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে তবু নজরুল ভেঙে পড়েন না, পৃথিবীর অপার সৌন্দর্য তাঁরা চোখের সামনে দুলে ওঠে। কবিতার অন্তর্গত জগৎ থেকে ভাবপ্রকাশকে গ্রথিত করেন নজরুল। উপমা-উৎপ্রেক্ষা ব্যবহারে নজরুল যত্নশীল, সফল। মানুষ বহু ব্যবহারে যেসব শব্দকে আপন করে নিয়েছে সে-শব্দসমূহ নজরুলের কবিতায় নতুন অর্থের ব্যঞ্জনা নিয়ে ধরা দেয়। চিত্রকল্পের সঠিক ব্যবহার কবিতার বক্তব্যকে যে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে, নজরুল সার্থকভাবে প্রয়োগকুশলতায় তা গ্রহণযোগ্য করে উপস্থাপন করেন। কবিতাকে বক্তব্যের নান্দনিকতায় পাঠকপ্রিয়তা করার পাশাপাশি চিত্রকল্প ব্যবহারে ঐতিহ্য, ইতিহাস, সমাজ ও পরিপার্শ্বের অন্তরঙ্গতায় স্পর্শ করেছেন নজরুল। উপমা-উৎপ্রেক্ষা ব্যবহৃত হয় সাদৃশ্যের সাথে সাদৃশ্যের। চিত্রকল্প বিপরীতের সাথে বিপরীতের মিশ্রণ হয়েও উঠতে পারে।
কবির অনুভূতি আনন্দ-বেদনা-বিষন্নতাকে ছুঁয়ে স্পর্শ করে চিত্রকল্প। নিজস্বতা, বোধ ও একান্ত বিষয়কে গভীর মমতায় বিবৃত করা সার্থক কবির কাজ। নজরুল খুব অনায়াসে ব্যঞ্জনামণ্ডিত করেছেন কবিতায় বর্হিজগৎ, অন্তর্চেতনা। কবিকল্পনা রূপাকল্প আশ্রয়ী। প্রকৃতির দৃশ্যপট ও বন্দনা রূপক আশ্রয়ী। আবেগের অকারণ উল্লাস থেকে বেরিয়ে এসেছেন কবি।
কবিতার বিষয় থেকে উঠে এসেছে নির্মাণকুশলতা। তাঁর কিশোর বয়সের এই রচনাতে তাঁর মনোজগতের পরিবর্তন ধরা দিয়েছে। শব্দের সাথে শব্দের সমিল যাত্রা ও অধিকার নজরুল সার্থকভাবেই করেছেন।
শব্দচিত্র নির্মাণ ও উপমা ব্যবহারে নজরুল দক্ষ কারিগর। হাওয়াকে পথিকের গতির সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন নজরুল। নজরুল উচ্চারণ করেন : সুদূর হাওয়া পথিক হাওয়া/ ঐ যে পথে যেতে চুপে চুপে/ চমকে কেন থমকে যেত/ শ্বাস ফেরতে তাকে দেখে দেখে। যাবার বেলায় বনের বুকে তার কামনার কাঁপন যেত রেখে (অভিমানী)। এ উচ্চারণ পাঠককে কল্পকজগতের দিগন্ত খুলে দেয়।
সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক টানাপড়েন নজরুলকে শুদ্ধ কবিতায় নির্মাণে ব্রতী করেছে। বিষয়বৈচিত্র্য উপস্থাপন লক্ষণীয় :
ঐ যে মহাকাল-সারথী
রক্ত -ত্বরিত চাবুক স্থানে
রনিয়ে ওঠে হ্রেষার কাঁদন
বজ্র গানে ঝড় –তুফানে
খুরের দাপট তারায় লেগে
উল্কা ছুটায় নীল খিলানে
গগন তলের নীল খিলানে
(প্রলয়োল্লাস)
বৃহত্তর মানবগোষ্ঠী যাপিত জীবন ও সমকাল নজরুল তাঁর কবিতার অর্ন্তগত উপাদান করেছেন। বর্ণনায় মাধুর্য , উপমার ব্যবহার এমন সার্থক করে তোলা নজরুলের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেছে।
নজরুলের কবিতার সারল্য, ইন্দ্রিয় সংবেদনশীলতা লক্ষণীয়। নজরুল আধুনিক কবি। রোমান্টিক কবি ও যে দার্শনিক তত্ত্ব ধারণ করেনর তাঁর কবিতায় এ ম্যাসেজটি পুরোপুরি উপস্থিত । নজরুলের ‘ আমি ’ তে দশজনের উপস্থিতি স্পষ্ট। অভিমান, ক্রোধ ও ভালোবাসা একসাথে ধারণ করা একজন সার্থক কবির পক্ষে সম্ভব তা নজরুল প্রমাণ করেছেন। তাঁর প্রেমিক কবিসত্তা সংমিশ্রিত। শিল্পীর দ্রোহ কণ্ঠ নাটকীয়, পরিশীলিত। নজরুলের সামনে ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ। নজরুল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছেন । সাম্রাজ্যবাদের পাশে সামন্তবাদ, গ্রামীণ জীবন ও নগরের কোলাহল তাঁকে উচ্চ কণ্ঠ করে । ভূতের আখড়া ভেঙে দেবার জন্য তাঁর প্রস্তুতি ছিল:
কৈ রে কৈ স্বেরাচারী বৈরী এ বাঙলার ?
দৈন্য দেখেছ ক্ষুদ্রের, দেখনি ক’ প্রবলের মার।
(আগ্নেয়গিরি বাঙলার যৌবন)
আবার
আনন্দধাম বাঙলায় কেন ভূতপ্রেত এসে নাচে
দেশী পরদেশী ভূতেরা ভেবেছে বাঙালী মরিয়া আছে
এ ভূত তাড়াব, পাষাণ নাড়াব , চেতনা জাগাব সেথা,
ভয়ের বক্ষে কাঁদিবে আবার এক জননীর ব্যথা
চিন্তা জগতের প্রতিনিয়ত পরিবর্তন নজরুল তাঁর কবিতায় তুলে আনেন। নির্সগ-বন্দনা ও প্রকৃতি -প্রেমে চিত্রকল্প যথাযথ ব্যবহৃত হয়েছে। ব্যক্তিগতজীবনের অব্যক্ত ভাবনাকেও নজরুল বাণীবদ্ধ করেছেন। দেশ, মহাকাল আর ভূগোল নিয়ে আবর্তিত নজরুলের কবিতায় ভূভাগ। জন্মভূমির পরিচয় দিতে গিয়ে নজরুল “ উচ্চারণ করেনঃ জননী মোর জন্মভূমি, তোমার পায় ঠেকায় মাথা/ স্বর্গাদপি গরিয়সী স্বদেশ ..”
নজরুল ইসলাম বাংলা কবিতায় নতুন ধারার প্রবর্তন করেছেন। তাঁর কবিতায়র প্রতীকী ব্যঞ্জনা, চিত্রকল্প ও বক্তব্যের নতুনত্ব পাঠককে আলোড়িত করে। নজরুলের কবিতায় জীবন অন্বেষা, আশাবাদ আর বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম প্রোথিত । তিনি সময়কে সামনে এগিয়ে যেতে দেখেছেন । সময় তাঁর কাছে চলিষ্ণু ।