কৃষ্ণপক্ষ
 

গাজী তানজিয়া  

 

jene_sum@yahoo.com

 

রোকেয়া হলের ফোন বুথে কানে রিসিভার চেপে ধরে ক্লান্তিহীন ভাবে ডায়াল করে যাচ্ছে তূর্ণা। লাইনটা পাওয়াই যাচ্ছে না। দীর্ঘক্ষণ ধরে চলছে এই কসরত। ফার্ষ্ট ইয়ারের কয়েকটা মেয়ে পাশ থেকে যাবার সময় ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো তূর্ণাকে। লংস্কার্টের ওপর কালো শার্ট পরা দীর্ঘাঙ্গী এই মেয়েটাকে বিদেশী ষ্টুডেণ্ট ভেবেছে হয়তো তারা। প্রথম প্রথম সবাই এমন ভাবে। এই চাহনীতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে - সেই ছেলেবেলা থেকেই। যে কেউ তার দিকে একবার তাকালে দ্বিতীয়বার আবার তাকাবে এটাই যেন নিয়ম। তূর্ণা দেখতে সত্যিই সাধারণ বাঙালীর তুলনায় ভিন্ন। লম্বা পাঁচ ফুট সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি, মসৃণ ত্বকে গোলাপী আভা, তীক্ষ্ম নাক, বাদামী চোখ, গাঢ় বাদামী চুলের তূর্ণাকে দেখলে কে বলবে এদেশী! অথচ ওর মায়ের গায়ের রঙটা শ্যামলাই বলা যায়, বাবার রঙটা ফর্সা বটে তবে বাঙালী ফর্সা যাকে বলে হলুদাভ। এই দুয়ের সমন্বয়ে তূর্ণার এত ফর্সা হওয়াটা বাড়াবাড়ি মনে হয় সবার কাছে। মেয়েগুলোর এমন চোরা চোখে তার দিকে তাকানোটা অন্য সময় হলে বেশ উপভোগ করত সে। কিন্তু এখন তার যা মনের অবস্থা তাতে মনের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। এতক্ষণে লাইনটা বোধ হয় পেল সে; ওপাশে রিং হচ্ছে...,
- হ্যালো,
- স্লামালেকুম, ক্যান আই স্পিক টু শিশির?
- কে বলছেন?
- আমি তূর্ণা বলছি।
মহূর্তের নিরবতা, তারপর ওপাশের শীতল কন্ঠটা আরো শীতলতা ঢেলে দিয়ে বলল, শিশির বাড়ীতে নেই।
ভেতর থেকে উঠে আসা উৎকণ্ঠা চেপে রেখে তূর্ণা বলল, কে বলছেন, আণ্টি? আণ্টি শিশির কোথায় গেছে?
শীতল কন্ঠটা কেটে কেটে বলল ঢাকার বাইরে। বলে লাইনটা কেটে দিলেন ভদ্র মহিলা।
ঢাকার বাইরে কোথায় গেছে, কবে গেছে কিছুই জানা হলো না তূর্ণার। শিশির এর মা এর এই অদ্ভুত ব্যবহারের কোন কারণ ও খুঁজে পাচ্ছে না। সে এর আগে দুবার শিশিরদের বাড়ীতে গিয়েছে। শিশির এর মা এর মিষ্টি আর আন্তরিক ব্যবহার তাকে মুগ্ধ করেছে কিন্তু আজ এমন আচরণ করলেন কেন হঠাৎ? শিশিরই বা গেল কোথায়, না বলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর সেই যে প্রথম দিনই শিশির এসে তার সাথে পরিচিত হলো, তারপর কেটে গেল ছয় বছর, কই শিশিরতো তাকে না বলে কোথাও যায় নি! কি এমন জরুরী কাজ পড়লো যে সে তাকে না জানিয়েই চলে গেল! ওর মাও কেমন অদ্ভুত আচরণ করলেন। অথচ ওর মা ভাল করেই জানেন ওদের সম্পর্কের কথা। মাষ্টার্স পরীক্ষা শেষ হলে যে ওরা বিয়ে করবে সে ব্যাপারটাও তো দু পরিবারেরই জানা। অভিমানে মনটা ভারী হয়ে গেল তূর্ণার এখনই হয়তো দুচোখ ভরে গড়িয়ে পড়বে জল। কিন্তু না এটা পাবলিক প্লেস, সে নিজেযকে সংযত করল। সে কি ভুল করছে? অন্যকেউ ফোনটা ধরে থাকতে পারে। আর একবার ফোন ঘোরাবে কি না ভাবছে তূর্ণা। নাহ্ তিনি তো স্বেচ্ছায়ই ফোনটা কেটে দিয়েছেন। আবার করলে যদি বিরক্ত হন, অপমান করেন! নাহ্ সেই অপমান সহ্য করা কষ্টকর হবে তার জন্য। শিশির এমন করতে পারে না, সে নিশ্চই কোনো মেসেজ রেখে গেছে তার জন্য। হল গেটে দাদুর কাছে বা তাদের কোনো বন্ধু বা রুমমেটের কাছে। তূর্ণা এবার ফোন করে নাঈমকে। নাঈমটা কে বাড়ীতে পাওয়া গেলে হয়। ফোনটা নাঈমই তুলল,
- হ্যালো নাঈম আমি তূর্ণা, আচ্ছা শিশির কোথায় গেছে বলতে পারিস? কদিন ধরে ওর কোনো খোঁজ নাই।
- বলিস কি, তোকে বলে যায় নাই? তোকে আমি আগেই বলেছি না তূর্ণা, শিশির হ্যাজ গান্।
- -কখন বললি?
-
gone, গান মানে আউট, মানে আউট হয়ে গেছে। জানিস বিজ্ঞানীদের গবেষণায় এসেছে যে সুন্দরীদের সান্নিধ্যে থাকলে পুরুষের মেধা কমে যায়। তারা সব আই কিউ টেষ্টে খারাপ ফল করে।
- বাদ দে তো তোর ঠাট্টা, আই  অ্যাম সিরিয়াস।
- আরে শোন না, শোন না ওরা কি বলেছে শোন, মেয়েদের কিন্তু এমনটা হয় না। কারণ নারী পুরুষের সৌন্দর্যে ভোলে না। নারীর কাছে পুরুষের সৌন্দর্যের কোনো দাম নেই। কারণ নারী প্রকৃতিগত ভাবেই ভীষণ প্রাকটিক্যাল হয়। ওরা বাহ্যিক সৌন্দর্যের চাইতে পুরুষের চারিত্রিক দৃঢ়তা, স্বভাব, শারিরীক, মানসিক ও সামাজিক শক্তি, ক্যারিয়ার, ইত্যাদি দেখে মুগ্ধ হয় বুঝলি? গেল- বুঝলি, তোর পাল্লায় পড়ে শিশিরটা গেল! জানিস ইভেন বিজ্ঞানীরা কি বলেছে? সুন্দরী নারীদের সান্নিধ্যে পুরুষের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা এতটা কমে যায় যে, কোনো সুন্দরী মেয়ে কোনো ছেলেকে তার নিজের বাড়ীর ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে এক চান্সে মনে করতে পারার সংখ্যা খুবই কম।
- নাঈম আমার এখন এসব শুনতে ভাল লাগছে না, তুই সত্যি জানিস না শিশির কোথায়?
- বলিস কি, তুই না জানলে আমি জানব কি করে?
ফোনটা কেটে দিল তূর্ণা। সত্যিই তো সে না জানলে অন্যরা জানবে কি করে? সেই মানুষের কি এমন হলো! যে তাকে না বলে উধাও।
শিশির কি তাহলে...!
এমনতো আজকাল হর-হামেশাই হচ্ছে। গত বছর বাংলার রোমানা আপা বাথরুমের পাইপে ওড়না পেচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করলো-না, তার প্রেমিকের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে! ছেলেগুলোর সাথে এতটা গভীর মানসিক ও শারিরীক সম্পর্কে এরা জড়িয়ে পড়ে কেন, যে জন্য আত্মহত্যা করতে হয়! জীবনে বেঁচে থাকার জন্য এতটুকু মানসিক শক্তি তারা অর্জন করতে পারেনি!
একদিন ঠাট্টাচ্ছলে বা নিতান্ত কৌতুহল বসে শিশির তূর্ণার কাছে জানতে চেয়েছিল, আচ্ছা এমন যদি হয় আমি মরে গেলাম বা কোনো কারণে আমাদের ব্রেকআপ হলো, তখন তুই কি করবি?
- কেন তুই যা করবি, আমিও তাই করব। ভাবছিস কাঁদতে বসব? অত সোজা না। তবে মরে গেলে কথা আলাদা..., আমার মনটাই ভেঙ্গে যাবে। ধর আমার কান্নাগুলোই তখন শিশির হয়ে ঝরবে পৃথিবীতে। তূর্ণার গলাটা কেমন ভার হয়ে এসেছিল, পরিবেশ হালকা করতে শিশির বলল, এখন আমি বলি? আমাকে একটু  স্কোপ দে- ।
- হ্যা বল,
- তূর্ণার হাতটা আলতো করে ছুঁয়ে বলল, কি বলব বলত, তোকে ছাড়া জীবন... ভাবাই যায় না !

চিট্! এই শিশির চিট করবে তাকে? উইথআউট এনি রিজন! ধ্যাৎ! কি ভাবছে এসব সে, শিশিরের তো কোনো বিপদও হতে পারে! বুকের ভেতরে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল তার। তবে কি মা ওদেরকে বলেছেন সব? যাক, বলতে যখন হবেই..। ওদের প্রতিক্রিয়াটাও জেনে নেয়া ভালো আগে থেকে। এতবড় একটা ঘটনা চেপে রেখে নতুন একটা জীবন কিছুতেই শুরু করা যায় না। অথচ যখনই কথাটা সে শিশিরকে বলবে বলে ঠিক করেছে, ঠিক তখনই শিশিরটা কোথায় উধাও হয়ে গেল। মাকে ফোন করবে সে? তার সব রকম মানসিক অস্থিরতায় একমাত্র আশ্রয়স্থল মা। সকল ঝড় ঝঞ্জায় বটবৃক্ষের ছায়া। মাকে ফোন করতে নিচে নামছে এমন সময় কল এলো তার। দৌড়ে ছুটে গেল সে ভিজিটরস রুমের দিকে।
দূর থেকেই দেখলো ভিজিটরস রুমের সামনে উশকো শুস্কো চুল আর খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে উদভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে আছে শিশির। কত কিছু তাকে জিজ্ঞেস করবে ভেবেছিল কিন্তু কিছুই মনে আসছে না তখন। নিঃশ্বাসের দ্রুত ওঠানামা শুধু অনুভব করছে সে.., ভেবেছিল শুরুতেই এক ঘা বসিয়ে দেবে শিশিরকে। কেন এভাবে তাকে টেনশানে ফেলা! কত কিই না ভেবেছিল সে, কত উল্টা পাল্টা চিন্তা। এক সময় মনে হয়েছিল তবে কি ও কোনো বিপদে পড়ল? অ্যাকসিডেণ্ট.. এমনকি মৃত্যু...। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল তার, তাই সব সংকোচ বিসর্জন দিয়ে ফোন করেছিল ওদের বাড়ীতে... কিন্তু, কিছুই বলতে পারল না সে। কিছুই বলা হলো না।ভেতরের ভাঙ্গনে বাঁধ দিয়ে ফ্যাকাশে হাসলো শিশির, কেমন আছিস তূর্ণা?
অভিমানে গাল ফোলাল সে, তোকে বলব কেন? তোর কি এসে যায় তাতে।
কেমন দ্বিধা গ্রস্তের মতো তূর্ণার হাতটা ধরলো সে। সম্পূর্ণ ভিন্ন আচরণ। শিশির কখনোই এমন ছিল না। হাত ধরতে হলে তো বিনা দ্বিধায় নিসংকোচে সে হাত ধরে তূর্ণার। কোনোদিনই এমন সংকোচ করেনি। তাদের দুজনের আচরণে দ্বিধা ছিল না কোনো। তারা একে অপরকে নারী পুরুষের মতো চাইলেও সম্পর্কটা বন্ধুর স্বাভাবিকতা অতিক্রম করেনি কখনো।
- একটু বাইরে যাবি তূর্ণা?
- কি ব্যাপার বলতো শিশির, আজ এতো ফরমাল বিহেভ করছিস? তুইতো এমন ছিলি না কখনো! আমি কখনো কখনো বাইরে যেতে না চাইলেও তো তুই জোর করতিস। আজ হঠাৎ কি হলো তোর!
আবার সেই ম্লান হাসি হেসে বলল, নাহ্ এমনি, ভয়ে ছিলাম তুই আবার রেগে আছিস কি না আমার ওপরে..।
এতদিন ওরা যখন একসাথে ঘুরত তখন তূর্ণার একটা মজার খেলা ছিল শিশিরকে গাছ চেনানো। কোন একটা ফুল বা বনজ বৃক্ষ দেখলেই বলত, বলতো এটা কি গাছ ? স্বভাবতই ও বলতে পারতো না। তবে শিশির ফলের গাছ খুব ভালো চিনত। তূর্ণা বলত এতে কি প্রমান হয় বলতো?
- কি?
তুই খুব প্র্যাকটিকাল। আর - ছেলেরা প্র্যাকটিকাল হওয়াই ভালো।
আজ আর কেউ কাউকে কোনো গাছ দেখাচ্ছে না। হয়তো এতদিনে সব গাছই চেনা হয়ে গেছে। কিছু আর অজানা নেই!
কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীন হাটাহাটির পর সন্ধ্যা নেমে এলে ফুলার রোডের আইল্যান্ডে দাড়িয়ে শিশির তূর্ণাকে যা বলল, এর জন্য এতদিন ধরে মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিল তূর্ণা।
ম্পিত হাতে তূর্ণার হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে শিশির বলল, তুই আমাকে আগে বলিস নি কেন তূর্ণা?
বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো তারপরও। আমি.. , আমি তোকে বলতে চেয়েছি শিশির, অনেকবার বলতে চেয়েছি। কিন্তু যখনই বলতে গেছি এত গ্লানি এসে ভর করেছে...!
- তোকে আমি বিয়ে করি এটা বাবা মা কিছুতেই মেনে নিতে চাইছেন না।
- জানি এমন হবে, কিন্তু শিশির যতদূর আমি দেখেছি ওনাদেরকে আমার এমন কনজারভেটিভ মনে হয়নি যে, ছেলে ভালোবেসে কাউকে চাইলে তারা মেনে নিতে পারবেন না।
- আসলে তূর্ণা আমরা মানুষকে কতটা চিনি! সম্পূর্ণ সংষ্কার বর্জিত মানুষ কোথাও খুঁজে পাবি না। সব মানুষ কিছু না কিছু কোনো না কোনো সংষ্কার লালন করেন ভেতরে ভেতরে। এর থেকে বাইরে বের হবার পথ খোঁজেন না বা বাইরে বেরতেও চান না।
- আর তুই?
- আমিও এমন সংষ্কার ও ধ্যান ধারণা লালন করেই বড় হয়েছি। একথা তোর কাছে বলতে দ্বিধা নেই। কারণ মা এর কাছ থেকে কথাটা শোনার পর থেকে আমিও কম সংশয়ে ভুগিনি এত দিন। তাইতো দূরে চলে গেলাম। নিজের সাথে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে নির›তর লড়াই করেছি...। কিন্তু পারিনি- না তোকে ভুলতে পেরেছি, না সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকে অতিক্রম করতে পেরেছি। দূরে গেলে আরো বেশি করে তোর কথা মনে পড়ছে। আমি তোকে কিছুতেই ভুলতে পারছি না তূর্ণা, কিছুতেই না। তুই কেন আমাকে কথাটা আগে জানালি না ? কেন আণ্টি মাকে জানালেন আগে, কেন তুই নোস?
- আমি, আমি তোকে ভীষণভাবে বলতে চেয়েছি শিশির কিন্তু পারিনি, একজন ঘৃন্য পাক আর্মির ঔরসজাত সন্তান আমি, যে আমার মাকে ধর্ষণ করেছে দিনের পর দিন, এ কথা কি এত সহজে বলা যায়!
- আমিও ভীষণ দ্বিধায় পড়েছিলাম সত্যি। কিন্তু তুই ছাড়া জীবন! আমি তোকে চাই , ভীষণভাবে চাই কিন্তু...
- কিন্তু.., আমি এখন চাই না শিশির! কারণ তুই যে এতটা রিঅ্যাক্ট করবি আমি কিন্তু ভাবিনি। বরং ভেবেছিলাম তুই হবি আমার আশ্রয়স্থল। এখনতো মনে হচ্ছে তুই আমাকে ভালোইবাসিস নি বা ভালবাসা যেটা আছে সেখানে শ্রদ্ধা নামের বোধটা আর নেই। এতে করে তোকে দোষ দেয়া যায় না, আমার যে প্রকৃত পিতৃ পরিচয় তাতে শ্রদ্ধা থাকার প্রশ্নও নেই।
- আমি সরি তূর্ণা, আমি আসলে ভুল করেছি, তোকে হার্ট করার ইচ্ছা আমার ছিল না।
- না তুই ভুল করিসনি, তুই ঠিকই করেছিস। তুই ভেবেছিস। আর যারা এতটা ভাবে তারা আসলে ভালোবাসে না।
- ভাবি আর যাই করি, তোর চেয়ে বেশি ভালো আমি আর কাউকে বাসতেও পারব না।
- কিন্তু শিশির, সবচেয়ে বড় কথা হলো যেখানে আমার মা এর সম্মান নেই সেখানে তো আমি যেতে পারি না। বিজ্ঞান বলিস আর সমাজ বলিস মা ই তো সন্তানের আসল পরিচয়। আমি একজন ঘৃণ্য নরপশু, যুদ্ধাপরাধী, পাকিস্তানী আর্মির ঔরসজাত ভেবে যতবার কষ্ট পেয়েছি ততবার আমার বীরাঙ্গণা মা ও তার স্বামী আমার বর্তমান বাবাকে দেখে সব কষ্ট ভুলে গেছি। আমি যার ঔরসজাত সে একজন ঘৃন্য পশু হলেও যার গর্ভে তিলে তিলে আমার বেড়ে ওঠা তিনি এই দেশের জন্য তার সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অমানুষিক শারিরীক ও মানসিক নির্যতন সয়েছেন। কেন জানিস? দেশ! দেশের জন্য। অথচ এদেশের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী তাদের সেই আত্মত্যাগের মর্যাদা দিতে পারেনি। ধর্মীয়, সামাজিক সংষ্কার, রাজাকারদের ষড়যন্ত্র, ইত্যাদি ইত্যাদির ফাঁদে তারা এখনো, এই ২৫ বছর ধরে বন্দি।
- হ্যা তূর্ণা তুই ঠিকই বলেছিস, ঐ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমি একটু দ্বিধায় পড়েছিলাম একথা ঠিক কিন্তু আমি এখনো তোকে ভালবাসি ।
- ভালোবাসা! ভালোবাসা কি তুই জানিসই না। তুই যাকে ভালোবাসা ভাবছিস সেটা একটা অভ্যাস মাত্র । আসলে দীর্ঘদিন আমরা একসাথে ঘুরেছি ফিরেছি তাই এক ধরণের অভ্যাসে পরিণত সয়েছে সম্পর্কটা। কিছুদিন মেশা ছেড়ে দে দেখবি অভ্যাস পাল্টে যাবে। এই দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে তোর সাথে আমার বন্ধুত্ব বলিস, ভালোবাসা বলিস সব অথচ দেখ, তারপরও তোর দ্বিধা..। আর আমার মায়ের সাথে ফারুক রহমানের মানে বাবার ভালোবাসা ছিল ক্ষণিকের ভালোলাগা থেকে। একই রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে এক ঘরোয়া মিটিংয়ে আমার নানা বাড়ীর ড্রয়িংরুমে যাদের পরিচয়। এরপর মিছিলে  মিটিং-এ দেখা হয়েছিল দু'একদিন। অথচ ফারুক রহমান যখন যুদ্ধের পর প্রায় ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে মাকে ঐ অবস্থায় উদ্ধার করলেন তখনো কিন্তু একবারও দ্বিধায় পড়েননি। একবারও ভাবেননি সমাজ সংসার নিয়ে। তুই কোনটাকে ভালোবাসা বলবি শিশির!
এরপর তূর্ণা শিশিরের কাঁধটা আলতো ছুয়ে দৃঢ় স্বরে বলল, তুই আর কিছু না ভেবে ফিরে যা। সত্যি বলতে কি আমার হয়তো কষ্ট হবে বাট আমি তোকে এ জীবনে জড়াতে পারব না। কারণ এখনকার এই সামান্য দ্বিধা ভবিষ্যতে আরো প্রকট হয়ে দেখা দেবে। আর আমি দ্বিধাগ্রস্ত কাউকে আমার জীবনে চাই না।

কি বলবে এখন সে! তূর্ণার ভাষায় প্র্যাকটিক্যাল শিশিরের মাথায় কেন আসেনি ওর মা এর অবদানের কথা, দেশের জন্য তার ত্যাগের কথা। কপালের ওপরের চুলগুলো দুহাতে চেপে ধরে আকাশে তাকায় সে, যেন ঐ বিশাল শুন্যতা পথ বাতলে দেবে তাকে অথচ কিছুই দেখতে পাচ্ছে না কেন? সেখানেও আজ ভর করেছে কৃষ্ণপক্ষ !
 

******

 


গাজী তানজিয়া
গল্পকারপ্রাবন্ধিক
১১১ মণিপুরী পাড়া
ফার্মগেট তেজগাঁও ঢাকা