রাজাকার থেকে মুক্তিযোদ্ধা: মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে মৌলবির বিবর্তন

 

ফাহমিদুল হক

 

জাতিরাষ্ট্র যদি, বেনেডিক্ট এন্ডারসনের ভাষায় একটি কল্পিত সমাজ (ইমাজিনড কমিউনিটি) অথবা গায়ত্রী স্পিভাকের ভাষায় কৃত্রিম নির্মাণ (আর্টিফিশিয়াল কনস্ট্রাক্ট) হয়ে থাকে, তবে তার কল্পিত ঐক্য ও সংহতির জন্য লাগাতারভাবে একটি আদর্শ জাতীয়তার অবয়ব বা বৈশিষ্ট্য গড়ে তুলতে হয় এবং কিছু রেপ্রিজেন্টশন-পদ্ধতির (স্টুয়ার্ট হলের মতে) মাধ্যমে এ-নির্মাণের কাজটি করতে হয় সেই অবয়ব বা বৈশিষ্ট্যকে ধরে রাখার জন্যও। সংবাদপত্র, সাহিত্য বা শিক্ষা সেই রেপ্রিজেন্টশনের দায়িত্বটি বরাবর পালন করে এসেছে। অপেক্ষাকৃত অধুনা মাধ্যম চলচ্চিত্রও বিশ্বব্যাপী জাতীয়তা, আত্মপরিচয় নির্মাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। বাংলাদেশের স্বাধীন ও শিল্প-সম্মত চলচ্চিত্রের যে-ধারা, সে-ধারার পরিচালকেরাও উৎসাহের সঙ্গে বাঙালি জাতিসত্তা গঠন, সংরক্ষণ ও প্রচারণার কাজটি করে চলেছেন। যেমন এদেশের শিল্প-সম্মত চলচ্চিত্রের বিরাট অংশই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত।

এ-নিবন্ধ এ-রকম একটি বিশ্লেষণে নিযুক্ত হতে চায় যে, মুক্তিযুদ্ধ-ভিত্তিক চলচ্চিত্রসমূহের একটি অপরিহার্য চরিত্র রাজাকার, যাকে নির্দ্বিধায় একজন গোঁড়া মুসলিম বা মৌলবি চরিত্রে দেখানো হতো, সাম্প্রতিক সময়ের কিছু চলচ্চিত্রে সে-মৌলবির ভূমিকা পাল্টে গেছে, ভালোভাবে বললে বলতে হয় উল্টে গেছে এবং তাকে ইদানীং এমনকি মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রেও দেখা যাচ্ছে।

এ-মূল আলোচনায় যাবার পূর্বে আমাদের একটু আলোকপাত করার প্রয়োজন, বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রের আত্মপরিচয়ের যে-ধারা, তার দিকে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে বসবাসকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয় অনুসন্ধান করতে গেলে পাওয়া যাবে তিনটি ধারা: বাঙালিত্ব, মুসলমানিত্ব ও লোকধর্ম। বাঙালিত্ব হলো এ-মানুষগুলোর ভাষিক ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, মুসলমানিত্ব হলো এ-জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় পরিচয় এবং লোকধর্ম হলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চর্চিত গৌন ধর্মসমূহ। আমাদের আত্মপরিচয়ের ডিসকোর্সকে ঘিরে বাঙালিত্ব ও মুসলমানিত্বের বিতর্ককে নিয়ে বহু দিস্তা কাগজ ব্যয় হয়েছে, কিন্তু লোকধর্মের বিষয়টিকে এ-আলোচনায় অনুপ্রবেশের অনুমোদন দেয়া হয়নি। হাজার বছর ধরে বাঙালিত্বের বিকাশ ঘটেছে ধীরে-ধীরে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফরায়েজি-সহ অন্যান্য ইসলামি সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে বঙ্গে মুসলমানিত্বের উত্থান ঘটেছে। পাকিস্তান গঠিত হয়েছিলো মুসলমানিত্বের ভিত্তিতে, আর বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিলো বাঙালিত্বের ভিত্তিতে। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আত্মপরিচয়ের এ-দুই ধারাই চালু আছে। মোটা দাগে বড়ো দুটি দলের মাধ্যমে। তবে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সময়ে এ-দুই ধারা বিবাদমান ও প্রায়শঃ দলীয় সহিংসতা পর্যন্ত গড়ায়। বলা বাহুল্য, বাঙালিত্বের ভিত্তিতে দেশ স্বাধীন হলেও স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মুসলমানিত্বের অনুসারীরাই বেশিরভাগ সময় দেশ শাসন করেছে এবং বিগত জোট সরকারের আমলে তারা প্রভূত আস্কারা পেয়েছে ও শক্তি অর্জন করেছে।

আত্মপরিচয়ের এ-দুই ধারার উন্মেষের বহু আগে থেকেই বঙ্গে লোক-ধর্মের অস্তিত্ব ছিলো এবং বস্তুতঃ লোক-ধর্মই মূল আত্মপরিচয় ছিলো। প্রাচীন কালে বৌদ্ধ তান্ত্রিকতা, মধ্যযুগে সুফি ইসলাম ও ব্রিটিশ আমলে হিন্দু বৈষ্ণবধর্ম বঙ্গে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী ছিলো। ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে যদি মূল রক্ষণশীল ধর্ম প্রাধান্যশীল থাকে, তবে বঙ্গে বরাবরই মূল ধর্মের এ-সব উদারনৈতিক ধারা বিকশিত হয়েছে। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দিতে এ-তিন ধারার সম্মিলন ঘটে বাউল মতবাদের মধ্য দিয়ে। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দির ইসলামি সংস্কারের কারণে বাউল ও অন্যান্য লোক-ধর্ম প্রবল বাধার সম্মুখীন হয় এবং তারা সমাজের মূলস্রোত থেকে সরে গিয়ে উপধর্ম বা সাব-কালচার হিসেবে আত্মগোপন ও আত্মরক্ষা করে। তবে সাধারণ মানুষের মনস্তত্ত্বে লোক-ধর্মসমূহের প্রভাব ঠিকই রয়ে গেছে, তা তারা বাঙালিত্ব বা মুসলমানিত্ব যারই অনুসারী হোক না কেনো। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদের তুলনায় বাঙালি মুসলমানের অপেক্ষাকৃত উদার হবার কারণ আসলে এটিই।

যাহোক, অন্যান্য মাধ্যমের মতো চলচ্চিত্রে লোক-ধর্মকে উপেক্ষা করা হলেও বাঙালিত্ব ও মুসলমানিত্বের দ্বন্দ্বের বিষয়টি ভালোভাবেই এসেছে। বিশেষত মুক্তিযুদ্ধ-ভিত্তিক চলচ্চিত্রে এটা প্রকটিত হয়ে ওঠে। তানভীর মোকাম্মেলের ইতোমধ্যে নির্মিত ১৫টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ৫টি, মোরশেদুল ইসলামের ১১টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ৪টি এবং তারেক মাসুদের ১০টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ৩টি মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক। স্বাধীনধারার শীর্ষস্থানীয় এ-নির্মাতারা ছাড়াও মূলধারার চাষী নজরুল ইসলামের মুক্তিযুদ্ধ-ভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের খ্যাতি রয়েছে। এ-সব চলচ্চিত্রে সাধারণত এরকম একটি রাজাকার চরিত্র থাকে, যেটি সাধারণত শান্তি-কমিটির সদস্য হয়ে থাকে এবং যার কাজ হলো আক্রমণকারী পাকিস্তানী মিলিটারিকে সহায়তা করা -- যা কি-না মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীকে নারীসরবরাহ পর্যন্ত হয়ে থাকে। এরা একটু বয়ষ্ক ও সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী-টুপি পরিহিত, এদের মুখে দাড়ি থাকে -- অর্থাৎ রাজাকার ও মোল্লা এভাবে সমার্থক হয়ে ওঠে। এ-চরিত্রগুলোর চিত্রায়ণ এরকম ধারণা দেয় যে, কট্টর ইসলামপন্থী হবার পরেও এরা একেকজন সাক্ষাৎ শয়তান, এরা কেবল সেনাদের নারীসরবরাহই করে না, নিজেরাও যথেষ্ট নারী-লোলুপ। এরা সংখ্যালঘু হিন্দুদের বাড়ি দখল করে মুক্তিযুদ্ধের ডামাডোলে এবং স্ত্রী থাকার পরও হিন্দু নারীর দখল নেয়। এ-ধরনের মৌলবি-রাজাকার চরিত্র পাওয়া যাবে মোরশেদুল ইসলামের আগামী (১৯৮৪) ও তানভীর মোকাম্মেলের নদীর নাম মধুমতী (১৯৯৫) ছবিতে।

অবশ্য এ-স্টেরিওটাইপ কেবল চলচ্চিত্রে নয়, সাহিত্য, থিয়েটার সব শিল্প-মাধ্যমেই দেখা যায়। একথা ঠিক, ১৯৭১ সালের রাজাকাররা কোনো না কোনো ইসলামপন্থী দলের সদস্য ছিলো। কিন্তু তারা সবাই বয়ষ্ক টুপি-পরিহিত ছিলো না। তাদের অনেকেই বয়সে তরুণ ও আমাদের মতোই শার্ট-প্যান্ট পরিধান করতো। রাজাকারের মতো দেশ-বিরোধী ও দানবীয় চরিত্রের সঙ্গে মুসলমানিত্বের বেশবাস ও ম্যানারিজম যুক্ত করিয়ে দেয়াটাই সমস্যা-জনক।

প্রশ্ন হলো এ-সমস্যা কেনো দেখা দেয়?

এ-সব নির্মাতা-স্রষ্টারা মূলত চিন্তাভাবনায় আধুনিক ও বাম-ঘেঁষা হলেও ষাটের দশকের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্য দিয়েই পশ্চিমা আধুনিকতা ও বাম-ভাবনার স্থানীকীকরণ ঘটে। ফলে বাঙালি মুসলমানের বাঙালিত্বের অংশটুকুই তারা একমাত্র আত্মপরিচয় বলে ভাবতে চান। এজন্য মুসলমানিত্বের অংশটুকুকে তারা বাতিল করতে চান। ইসলামের অনুসারীরা তাদের কাছে 'অপর'। কেবল রাজাকার-মৌলবি নয়, 'লালসালু'র (তানভীর মোকাম্মেল, ২০০১) মজিদ বা 'বৃষ্টি'র (মোরশেদুল ইসলাম, ২০০০) হাজী সাহেব চরিত্রের নির্মাণেও সেই প্রবণতা স্পষ্ট। নির্মাতা যে-ধর্মনিরপেক্ষ ও আধুনিক প্রেক্ষাপট থেকে উঠে এসেছেন এবং তার চলচ্চিত্রের সম্ভাব্য দর্শক-যে মধ্যবিত্ত, এ-শ্রেণী-বলয়ের কাছে একজন মৌলবি পশ্চাৎপদ, প্রাচীন ও প্রগতি-বিরোধী। আর তাকে যদি রাজাকার চরিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা যায়, তবে তো অপরায়নের ষোলকলা পূর্ণ হয়।

বাংলাদেশে বাঙালিত্ব ও মুসলমানিত্বের আত্মপরিচয়-জনিত যে-বিবাদ ও বিতর্ক, এ-চলচ্চিত্রগুলো তা কমিয়ে আনার পরিবর্তে বাড়িয়ে তোলে। মুসলমানিত্বের অনুসারী যে-নিরীহ নাগরিক, তিনি এ-সব ছবির সঙ্গে দূরত্ব অনুভব করেন। মন্দের সঙ্গে মৌলবির মিশেল তার জন্য অস্বিস্তিকর হয়ে ওঠে। কারণ তিনি নিজে মৌলবী হলেও হয়তো ওরকম মন্দ নন। বা একাত্তরে তিনি বা তার পিতা-চাচা মৌলবি ছিলেন বা এখনও মৌলবিই আছেন, কিন্তু রাজাকারী করেননি। এ-সব চলচ্চিত্র তার কাছে তাই বৈদেশিক-কিছু মনে হয়।

মাটির ময়নার (তারেক মাসুদ, ২০০২) কাজী চরিত্রটি এদিক থেকে ব্যতিক্রম। সে-মৌলবি কিন্তু রাজাকার নয়। সব মৌলবিই কিন্তু একাত্তরে রাজাকার হয়নি, বরং তাদের বেশিরভাগই হয়তো কাজীর মতোই ছিলো, যারা এক-সময় পাকিস্তান-আন্দোলন করেছে, কিন্তু পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়া মেনে নিতে পারছে না। ঘটনার দ্রুতবেগ তাদের দ্বিধান্বিত করে তোলে এবং সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে সে ব্যর্থ হয়। পাকিস্তান-ভঙ্গ তার কাছে হৃদয়-ভঙ্গের মতোই ব্যাপার। তার মানে এ-নয় যে, সে রাজাকারীতে নেমে পড়ে। জাতীয়তাবাদী-আন্দোলনে যুক্ত মার্ক্সিস্ট মিলনেরও সীমাবদ্ধতা ধরা পড়ে যায় লোক-ধর্মের অনুসারী করিম মাঝির কাছে, যাকে মিলন মৌলবাদী গালি দেয়ায় মাঝি বলে, "প্রকৃত কোনো ধর্মই মানুষকে অন্ধ করে না, বরং চোখ খুলে দেয়।" হয়তো সেই প্রকৃত ধর্ম বড়ো হুজুরের রাজনৈতিক ইসলাম বা কাজীর শাস্ত্রীয় ইসলাম নয়, ইব্রাহিম হুজুরের সুফি ইসলামই মানবমুক্তির প্রকৃত পন্থা; অন্তত পরিচালক সে-রকমই মনে করেছেন।

'মাটির ময়না' ২০০২ সালে নির্মিত হলেও তার চিত্রনাট্য ও নির্মাণ-পর্ব শুরু হয়েছিলো ২০০১ সালের নাইন-ইলেভেনের আগেই। নাইন-ইলেভেনের আগে মুক্তিযুদ্ধ-ভিত্তিক চলচ্চিত্রে রাজাকার ও মৌলবি সমার্থক। নাইন-ইলেভেন পর্বে আমরা পাচ্ছি ব্যতিক্রমী এক মৌলবি কাজীকে, যার প্রতি পরিচালক মনোযোগী ও সংবেদনশীল ছিলেন। কিন্তু নাইন-ইলেভেনের পরবর্তী সময়ের মুক্তিযুদ্ধ-ভিত্তিক চলচ্চিত্রে আমরা দেখছি মৌলবির ভূমিকা বদলে গেছে। যে আগে ছিলো রাজাকার, সে এখন মুক্তিযুদ্ধের শহীদ বা খোদ মুক্তিযোদ্ধা।

এ-পর্বের চলচ্চিত্র হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের 'শ্যামল ছায়া' (২০০৪) ও তৌকীর আহমেদের 'জয়যাত্রা'র (২০০৪) কথা বলা যায়। দু-টি ছবিই একই বছরে নির্মিত এবং ছবি দু-টির কাহিনীও প্রায় একই। শ্যামল ছায়া বাংলাদেশের ছবি হিসেবে অস্কারে যায় এবং জয়যাত্রা বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার ও ২০০৪ সালের শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে জাতীয় পুরস্কারও পায়। দু-টি ছবিতেই গ্রামের কিছু লোক ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে একটি নৌকায় সমবেত হয়েছে হানাদার বাহিনীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য। প্রথমেই বলে নেয়া ভালো, দু-টি ছবিতেই রাজাকার হিসেবে দু-টি চরিত্র ছিলো, কিন্তু চরিত্রগুলো ছোট। এবং 'জয়যাত্রা'র রাজাকারকে দেখা গেছে একটি মাত্র দৃশ্যে। সে-বয়সে তরুণ ছিলো ও তার মাথায় টুপি থাকলেও দাড়ি ছিল না। অর্থাৎ মৌলবিপনা খানিকটা কমে এসেছে। 'শ্যামল ছায়া'র রাজাকার তো রীতিমতো খাকির শার্ট-প্যান্ট পরা বখাটে চেহারার, যাকে এক-পর্যায়ে নৌকার অভিযাত্রীরা আটকে ফেলে এবং বস্তায় বেঁধে পানিতে ফেলে দেয়। তবে নৌকার যুবা মৌলবি তাকে শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বাঁচিয়ে দেয়। সে-একই রাজাকারের মানবিক গুণাবলীও পরে দৃষ্ট হয়, নদী-পথে রাজাকার বাহিনীর টহলের হাত থেকে নৌকাবাসীদের বাঁচিয়ে দেয় সে।

এই দু-ছবিতে রাজাকারের মৌলবিপনার এক-রকম মুক্তি ঘটেছে। কিন্তু দু-ছবিতেই অন্য মৌলবি চরিত্র আছে। 'জয়যাত্রা'য় দেখা যায়, যখন পাক-সেনারা গ্রামে ঢুকে, তখন তাদের জেরার মুখে পড়েন মসজিদের ইমাম। তিনি পাক-সেনার নৃশংসতার প্রতিবাদ করেন এবং পাক-সেনার হাতে শহিদ হন। এভাবে একজন মৌলবি হন চলচ্চিত্রের প্রথম প্রতিবাদকারী ও শহিদ। আর শ্যামল ছায়ায় যুবা মৌলভী বলতে গেলে মূল-চরিত্র। তিনি নৌকা আরোহীদের মধ্যে প্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন। তিনি রাজাকারকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচান। তার গুণাবলির চরম নিদর্শন দেখি অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি তার উদারতায়। নৌকায় আরোহীদের মধ্যে কয়েকজন ছিলো হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাদের অন্য আরোহীরা প্রথমে নৌকায় নিতেই চায়নি, কারণ হিন্দু সংখ্যালঘুরা ছিলো পাক-সেনাদের প্রথম টার্গেট। নৌকায় হিন্দু আছে এটা পাক-বাহিনী বা রাজাকার-বাহিনী জানতে পারলে সবারই ঘোর বিপদ। কিন্তু যুবা মৌলভীর উদ্যোগেই মূলত তারা নৌকায় ঠাঁই পায়। আবার এ-চরম প্রতিকূল পরিবেশেও হিন্দু চরিত্রগুলো অস্বাভাবিকভাবে অর্চনা-প্রিয়। বিপজ্জনক অভিযাত্রায়ও তারা পূজায় পরম আগ্রহী। বিপদ ডেকে আনার বন্দোবস্ত করায় মুসলমানরা হিন্দুদের ধমক দেয় ও বকাঝকা করে, কিন্তু যুবা মৌলবি বলে ওঠেন, আল্লাহ পাক বলেছেন, লাকুম দ্বিনীকুম ওয়ালিয়া দ্বীন ... ইত্যাদি। একাত্তরের বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে যুবা মৌলবির এ-অতি-উদার ভূমিকা বাস্তবতার নিরিখে অস্বাভাবিক। এক মৌলবির মধ্যেই যাবতীয় গুণাবলীর সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। এটা আশ্চর্যের।

চলচ্চিত্রে মৌলবির ভূমিকার এ-বিবর্তনের ব্যাখ্যা আমাদের করতে হবে নাইন-ইলেভেন পরবর্তী সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। নির্মাতা ও তার চলচ্চিত্রের দর্শকের জন্য যে-মৌলবি একসময় 'অপর' ছিলো, সেই মৌলবির প্রতিই এখন তিনি একাত্মতা বোধ করছেন। কারণ আধুনিক ও পশ্চিমা মতাদর্শী হবার পরও পশ্চিম আর তাকে নিজের ভাবছে না। মুসলমান নামধারী সবাই এখন পশ্চিমের কাছে অপর, শত্রু ও টেররিস্ট। পশ্চিমের অপরায়নের পাল্লায় পড়ে ধর্ম-নিরপেক্ষ মুসলিম আর শাস্ত্রীয় বা রাজনৈতিক মুসলিম একাকার হয়ে যাচ্ছে। মৌলবিকে আর তাই রাজাকারের মতো ভয়ঙ্কর চরিত্রে বসানো চলে না। বরং তার প্রতি আরও যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। এ-পরিস্থিতি এমনকি তাকে মুক্তিযোদ্ধা বা পাক-সেনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী দেখানোও চলে। কারণ সম্ভাব্য দর্শকও মৌলবিকে আগের মতো দানবীয় চরিত্রের চাইতে মানবিক চরিত্রে দেখতে চাইবে।

[সমাপ্ত]

কৃতজ্ঞতা: এ-নিবন্ধটির মূল থিম চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের সঙ্গে আলাপ-কালে প্রাপ্ত।