কেনিয়ার প্রত্যন্ত এলাকা পোকট পল্লীতে কুসংস্কারাচ্ছন্ন তরুণীদের জীবন কাহিনী
অমল হালদার
ইস্ট আফ্রিকার রাজধানী কেনিয়া দেশটাকে আমরা যেভাবেই জানি না কেন বাস্তবতা হচ্ছে - দেশটির সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা, আর্থিক প্রবৃদ্ধির হার, জীবন যাত্রার মান এবং সবকিছু মিলিয়ে বিশ্বের পিছিয়ে পড়া দেশগুলার তালিকায় শীর্ষস্থানের কাছাকাছি কেনিয়ার অবস্থান।
ইতিপূর্বে কয়েকবার নাইরবী ভ্রমণ করলেও দেশটির এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছিল এটাই প্রথম। তারিখটি ছিল ৬ সেপ্টেম্বর ২০০৯। আমি আমার এক সুদানী সহকর্মীসহ রাজধানী শহর নাইরবি থেকে প্লেনে চড়ে ৩০০ কিলোমিটার দূরবর্তী কেনিয়ার বিখ্যাত রিফ্ট ভ্যালী প্রদেশের রাজধানী এলডোরেট পৌঁছাই। সময় লেগেছে এক ঘন্টা। এলডোরেট থেকে প্রাইভেট জীপে করে আরও প্রায় ২৫০ কিলোমিটারেরও অধিক দূরে অবস্থিত পোকট এর সদরপল্লী ‘সোক’ -এ যেতে ৬-৭ ঘন্টা সময় লেগে যায়।
ছবিঃ কেনিয়ার পোকট যাবার প্রাক্কালে
পোকট এলাকাটি কেনিয়ার উত্তর পশ্চিমান্তে উগান্ডা সীমান্ত সংলগ্ন সম্পূর্ণ পাহাড়-পর্বত বেষ্টিত একটি এলাকা । স্বাভাবিক জীবিকা নির্বাহের প্রধান অন্তরায় হলো ওখানে পানির স্বল্পতা। কারন এলাকাটি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১৫০০-২০০০ মিটার উচ্চে অবস্থিত। পোকটে পানির একমাত্র উৎস বৃষ্টি। পাহাড়-পর্বতে ঘেরা উচুভূমির কারনে ভুগর্ভস্থ পানির সুবিধা বঞ্চিত এই জনগোষ্ঠীকে বছরের ১২ মাসই বৃষ্টির পানির উপর সম্পূর্ন নির্ভরশীল থাকতে হয়।
ছবিঃ প্রত্যন্ত পাহাড়ী পোকট এলাকা ও পোকটবাসীর বাসস্থান
পোকট অঞ্চলে বৃষ্টি মৌসুম সাধারনত ৬ মাস (মার্চ -আগষ্ট)। বাকী ৬ মাস চলে সংরক্ষিত পানির নির্ভরতায়। প্রাকৃতির বৈষম্যতার কারনে কখনো কখনো বৃষ্টি মৌসুম স্বাভাবিক নিয়মের পরিবর্তে ৪-৫ মাসের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় আর সে বছরেই আসে খরা এবং প্রচন্ড খাদ্য সংকট। প্রাকৃতিক বৈরীতার কারনে মাঠের ফসল শষ্যকণা উতপাদনে হয় অসমর্থ।সময়ের প্রবাহে একসময়েজনের সংরক্ষিত পানি ফুরিয়ে যায়। তখনই গাবাদি পশুর জন্য অত্যাধিক পানি এবং খাদ্য সংকট দেখা দেয়। আর একারনেই শুরু হয় এলাকা পরিত্যাগ যাকে ইংরেজিতে বলে মাইগ্রেশন আউট । লোকজন এলাকা ত্যাগ করে সুদুর উগান্ডার সমতল ভূমিতে সাময়িক বসতি স্থাপন করে কিন্তু কোন একসময়ে আবার ফেরত চলে আসে জন্মস্থানে নারীর টানে। গতবছর ২০০৯ ছিল এমনই একটা প্রাকৃতিক বৈরীতার বছর।
ছবিঃ পোকটের শুষ্ক জলাশয়, জলাশয় হতে পানি সংগ্রহরত পোকটবাসী
পশুপালন, সরগম, মেজ, মিলেট, বিন/চিনাবাদাম চাষ হচ্ছে জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন এবং এগুলোই তাদের স্বাভাবিক খাদ্য-সামগ্রী। প্রত্যন্ত অ্ঞ্চল থেকে সদর এলাকায় যাতায়াত খুবই কষ্টসাধ্য এবং সময় সাপেক্ষ । শিক্ষার মূল্যায়ন অধিকাংশ পোকটবাসী এখনো জানে না। সম্পদ বলতে একাধিক স্ত্রী, অনেক সন্তান এগুলো হচ্ছে সামাজিক মর্জাদার একমাত্র মাপকাঠী। পোকট এলাকায় বহুবিবাহ বা বহুগামীতা খুবই স্বাভাবিক। পুরূষকে সমাজে মর্যাদাশীল করার অন্যতম নির্দেশক হচ্ছে একাধিক স্ত্রী। যার যত বেশী স্ত্রী থাকবে সেই তত বেশী মর্যাদার অধীকরি হবে, লোকজন তাকে বেশী গণ্যমান্য করবে।
প্রচলিত আছে, কেউ যদি কোন মেয়েকে বিয়ের পূর্বে গর্ভবতী করার দায়ে সমাজে দোষী সব্যস্ত হয় অথবা কোন ব্যক্তিকে পরস্ত্রীর সাথে রাত যাপনরত অবস্থায় পাওয়া যায় তার শাস্তি হচ্ছে নির্ধারিত সংখ্যক গরু-মহিষ-ছাগল সামাজিক ব্যক্তিবর্গকে প্রদান করা, যা সমাজ নির্ধারণ করে দেবে। পরে মেয়ের কি হল বা ছেলে কি করল সে ব্যাপারে সমাজের কোন দায়িত্ব থাকে না।
পোকট পরিবারে বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের যোনিকর্তন (ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন্) সামাজিক স্বীকৃতিদানের একমাত্র মাপকাঠী হিসেবে গণ্য করা হয়। যদিও অনেক আগেই কেনিয়া সরকার আইন করে এই প্রথার বিলুপ্তি ঘোষণা করেছেন কিন্ত পোকটবাসী সে আইনকে তোয়াক্কা না করে কখনো গোপনে আবার কখনো প্রকাশ্যে প্রথার যত্রতত্র প্রচলন চালিয়ে যাচ্ছে। যে কারনেই অগাস্ট ২০০৯ এর পরিসংখ্যান আনুযায়ী কমপক্ষে ৮০% অবিবাহিত মেয়েদের যোনিকর্তন প্রথায় পূর্নাঙ্গ মহিলার সামাজিক স্বীকৃতি নিতে হয়। আর একারনেই বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগলো এই সামাজিক প্রথা রধকরনের লক্ষ্যে এলাকার কর্তব্যরত মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে অর্থের যোগান দিয়ে যাচ্ছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিভিন্ন রকম সমাবেশ, সাপ্তাহিক সেশন, স্কুল কারিকুলাম পরিবর্তন, উঠান বৈঠক করে এই প্রথার ক্ষতিকারক দিকগুলো সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করার চেষ্ট চালিয়ে যাচ্ছে। সংস্থাগুলো এই অন্ধকারচ্ছন্ন কুসংস্কার থেকে প্রত্যন্ত এলাকার মুক্তিকামী মেয়েদের জন্য উদ্ধার কেন্দ্রে স্থাপনসহ শিক্ষা এবং বিয়ের যাবতীয় যোগানও দিয়ে থাকে।
ছবিঃ বাঁয়ে-আশ্রয়কেন্দ্রে উদ্ধারকৃত মেয়েশিশু, ডানে-আশ্রকেন্দ্রের একটি কক্ষ
বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের যোনিকর্তন একটা প্রচলিত উৎসব প্রথা যা নিমন্ত্রিত স্বজন এবং অতিথিবর্গকে রাতভর মদ্যপান, আহার, নাচগানসহ বিভিন্নকরমের আমোদ-প্রমোদের যোগান দেয়। এলাকার খুব আনন্দঘন অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে বেশী আকর্ষনীয় এবং জনপ্রিয়। কারন এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটা শিশুমেয়েকে বিবাহযোগ্য সম্পূর্নমেয়ে হিসেবে সামাজিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। আর একারনেই পুরুষতান্ত্রিক এই প্রচলিত সমাজব্যবস্থা এইপ্রথা নিষিদ্ধকরনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে যাচ্ছে। এইপ্রথার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মেয়েদেরকে খুব ছোট থেকে পারিবারিকভাবে মস্তিষ্ক ধোলাই করা হয়। যেমন - যতক্ষণ পর্যন্ত একটা মেয়ের যোনিকর্তন অনুষ্ঠান না হবে ততদিন পর্যন্ত মেয়েদের বয়স যাই হোক না কেন বিবাহযোগ্য বলে সামাজিক স্বীকৃত পাবে না এবং কেউ বিয়ে করতে আগ্রহও প্রকাশ করবে না। আর তথাকথিত এই সামাজিক স্বীকৃতি লাভ কারার জন্য মেয়েরা একটা প্রচন্ডরকমের জীবনমৃত্যু সহ দৈহিক এবং মানসিক চাপের মাঝে থাকে এবং পরবর্তীতে এই ঝুঁকিপূর্ণ প্রথায় নিজেকে বিসর্জন দিতে রাজী হয়।
স্থানীয় বিভিন্ন বয়সী পুরূষ-মহিলাদের সাথে আলোচনা এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা শুনে যে ঝুঁকিপূর্ণ দিকগুলোর কথা জানতে পারা গিয়েছে তার সারমর্ম হল - এই প্রথার বাস্তবায়নের কারনে মেয়েদের ঘটনাস্থলে মৃত্যু, আজীবন বিকলাঙ্গ, আজীবন ভগ্নযৌন জীবন, স্বাভাবিক হাটাঁ চলায় বাধাগ্রস্ত হওয়া ও স্বাভাবিক কাজকর্মে বাধাগ্রস্ত হওয়া, সহবাসে কোন যৌনসুখ অনুভব না করা, প্রচন্ড ব্যথা এবং রক্তক্ষরণ হ্ওয়া, প্রসবকালে প্রশ্রাবনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাওয়া, প্রসবকালে প্রচন্ড রক্তক্ষরনের কারনে মায়ের মৃত্যু।
ছবিঃ কেনিয়ার নারীদের জীবিকার সন্ধানে অভিযাত্রা
এই প্রথা সামাজিক ব্যক্তি বর্গকে রাতভর মদপান, খানাপিনা এবং নাচগান আসরযোগান ব্যতিরেকে আর কোনই সফলতা নিয়ে আসতে সক্ষম হয় না। তারপরেও অশিক্ষিত কুসংস্কারচ্ছন্ন এই পোকটবাসী এই প্রচলিত প্রথার পক্ষেই লড়াই করে যাচেছ কারন এটা তাদের ঐতিহ্য এবং এই ঐতিহ্য ধরে রাখার দায়িত্ব তাদের হাতে ন্যস্ত বলে তারা মনে করে।
বাল্যবিয়ে এবং মেয়ের অসম্মতি এবং অজান্তে বয়স্ক বা বৃদ্ধ পুরূষকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য করার মত ঘটনা খুবই অহরহ ঘটতে দেখা যায়। এমনও ঘটনা জানা গিয়েছে যে - মেয়ের বাবা এক বৃদ্ধের কাছ থেকে চুক্তিতে অনেক গরু-মহিষ-ছাগল এনে মেয়ের যোনিকর্তন অনুষ্ঠানসহ সংসারের অন্যান্য খরচ চালিয়ে যচ্ছিল। এই বৃদ্ধটি হল মেয়েটির হবু স্বামী যার একাধিক স্ত্রী আচ্ছে এবং তার হবু স্ত্রীর থেকেও বেশী বয়সী ছেলে-মেয়ে তার আছে। হঠাৎ একদিন (মেয়ের যোনিকর্তন অনুষ্ঠানের দুমাস পর) বৃদ্ধ পুরূষটি তার দলবলসহ এসে মেয়েকে তার বাবা-মার সম্মতিক্রমে উঠিয়ে নিয়ে স্ত্রী হিসেবে ভোগ করা শুরু করে। এমনও ঘটনার সাক্ষ্য পাওয়া গিয়েছে যে - মেয়ের বাবা কোন বৃদ্ধ পুরূষের কাছ থেকে গরু-মহিষ এনেছে, চুক্তি ছিল তার ছোট মেয়েটিকে যোনিকর্তন অনুষ্ঠানের পর তার হাত সপে দিবে। মেয়ে পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে বাড়ী ছেড়ে আত্বীয়ের বাসায় আশ্রয় নেয়ার ২-দিন পর তার মা এসে আত্মীয়ের সহযোগীতার মেয়ের হাত-পা বেঁধে গাধার পিঠে করে বাড়ীতে ফিরিয়ে নেয়ার পথে স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থার সহায়তায় তাকে রাস্তা থেকে উদ্ধার করে উদ্ধার কেন্দ্রে আশ্রয় করে দিয়েছে। কথিত আছে - মেয়ে যত কম বয়সের হবে এবং হবু স্বামী যত বয়স্ক এবং বহুসংখ্যক স্ত্রী অধিকার করবে, মেয়ের বাবা ততই চড়া দামের (গরু-মহিষ-ছাগল) বিনিময়ে মেয়েকে বিয়ে দিতে পারবে। এমনও অনেক বাবা আছে যে তার কম্বয়সী মেয়ের জন্য বৃদ্ধ স্বামী খুঁজতে লোক বা দালাল লাগিয়ে দেয়। উদ্দেশ্য একটাই অনেক গরু-মহিষ লাভ করা।
--------