পৃথিবীলোক

 

গাজী তানজিয়া

 

jene_sum@yahoo.com

 

 

হিমান্তিকার আজকাল প্রায় সব সময় মনে হয়, গভীর একটা অন্ধকার কুয়ার অতলে তলিয়ে যাচ্ছে সে। চারিদিকে অন্ধকার একটা ঘর। জানালা আছে, খোলাই থাকে, কিন্তু আলো প্রবেশ করে না। সারাক্ষণ মনে হয় যেন বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বাইরেটাও অন্ধকারাচ্ছন্ন । ঘরে এবং ঘর থেকে তাকিয়ে বাইরে সব জায়গায় একটা দম বন্ধ করা অবস্থা তার এখন। ভীষণ অন্ধকার  চারিদিকে, কত কাল হলো আকাশ দেখেনি সে। নীল আকাশ কেমন হয়? ভুলে গেছে হিমান্তিকা। ঝকঝকে রোদ্দুর? তাও ভুলে গেছে। রাস্তা, লোকালয়, মানুষ ধীরে ধীরে সব ভুলতে বসেছে সে।

হাসপাতালের এই বদ্ধ ঘরটাতে তার বাস। সারাদিন ধরে একটা এনার্জি সেভার সাদা রঙের বালব জ্বালিয়ে রাখা হয়। চোদ্দ ইঞ্চি একটা টিভি ও আছে, মাঝে মাঝে সেটাকেও চালানো হয়। টিভিতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল দেখতে ভালো লাগে তার। ঠিক যেন ঐ সময় টুকুর জন্য প্রকৃতির কৃত্রিম সান্নিধ্য পায় সে। সবুজ গাছপালা, স্বচ্ছ নীল পানি, কখনো সমুদ্রের বিশাল জলরাশি বা ঘন জঙ্গল, ধাবমান প্রানীকুল ক্ষণকালের জন্য তার জগতে এক স্নিগ্ধ সবুজ প্রাণের স্পন্দন এনে দেয়। আসলে মানুষ প্রকৃতিকে কাছে চায়। আর না চেয়েই কী করবে! প্রকৃতিই উৎস। প্রকৃতিই মা। মাকে না পেলে সন্তান যেমন পাগল হয়। তেমন প্রকৃতিকে না পেলে মানুষের মধ্যে অস্বাভাবিকতা আসে। মানুষ স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রীক হয়। কদিন ধরে ঘুরে ফিরে একথাটাই ভাবছে সোহানা। বদ্ধ ঘরে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। অথচ বাড়ী যেতে পারছে না। মানে অনুমতি মিলছে না। ডাক্তার তার রোগের ধরণটা কে বলছে ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডার । তবে হিমান্তিকার ধারণা সে সিজোফ্রেনিয়াক নইলে তাকে এই ক্লিনিকে ভর্তি করা হলো কেন?

জনে জনে মিলে, চলছে মিছিলে

আমারই দাড়িয়ে থাকা

আমি মিছিলে মিছিলেও একা।

সেই যে কবে দু:সহ একটা অবস্থা , একটা হত্যাকান্ড বা এ্যাকসিডেন্ট ! কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে না পেরে মরবার খুব ইচ্ছা হয়েছিলো তার। অথচ মরবার জন্য যে সব সাধারণ উপকরণ গুলো ছিল হাতের নাগালে , সে গুলোকে বড় দুর্বল অথচ ভয়কর মনে হচ্ছিল তার কাছে।

গলায় দড়ি বা ছাঁদ থেকে লাফিয়ে পড়ার মধ্যে এক ধরণের ভয়াবহতা কাজ করে। মরতে হবে ভালো কথা , তবে এত নিষ্ঠুর পন্থায় নয়। বিষ খাওয়া বা স্লিপিং পিল চলতে পারে তবে সেক্ষেত্রে বেঁচে যাবার রিস্ক থাকে অনেক! কেউ টের পেয়ে গেলে হসপিটালে নিয়ে গিয়ে ওয়াশ করার সমুহ সম্ভবনা থাকতে পারে তাই এই পদ্ধতিটাও নিরাপদ নয়। সবচেয়ে ভালো হতো একটা রিভলবার পেলে; মাথায় একটা গুলি, ব্যাস!  কারণ হিমান্তিকার জানা মতে , মানে তার জানাতো থ্রিলার উপন্যাস বা পলিটিক্যাল হিস্টরিক বই গুলোতে পড়া, যত মানুষ গুলি বিদ্ধ হয় তারা গুলি ঢোকার সাথে সাথে আধাঘণ্টার মধ্যে বুঝতেই পারেনা যে কিছু একটা ঘটেছে। তবে সেই জায়গাটা নড়াচড়া করবার মত সেন্স থাকে না। তাই গুলি যদি মাথায় করা হয় কিছু বুঝে ওঠার আগেই মৃত্যু।  কি মজা! তাই সে তখন প্রায় সব সময়ই একটা রিভলবার এর খোঁজে ব্যস্ত। তাদের নিজেদের বাড়ীতে নেই, তবে আত্মীয়দের মধ্যে কার কার বাড়ীতে এই জিনিসটা আছে তার একটা লিষ্ট তৈরি করে ফেলেছিলো সে মনে মনে। তারা কেউ জিনিসটা নিয়ে তাদের বাড়ীতে আসে না সুতরাং ঐ সব বাড়ীতে গিয়ে কাজটা সারতে হবে। তার আগে জিনিসটা চালাতে শেখা ও জরুরী। এখন যদি সে বাড়ীতে বলে যে শ্যুটিং ক্লাবে ভর্তি হয়ে গোলাগুলি শিখতে চায় তাহলে কেউ রাজী হবে না। আর সামান্য আত্মহত্যা করবার জন্য সে এতটা ঝক্কি ঝামেলাও পোহাতে চায় না। অল্টারনেটিভ হিসেবে সে বিভিন্ন ওয়েবসাইট গুলো সার্ফিং করে এবং এ্যাকশান মুভি দেখে কি ভাবে গুলি চালাতে হয় সে সম্পর্কে একটা সাম্যক ধারণা নিয়ে নিল। এর পর তদের বাড়ীতে পড়ে থাকা ছোটবেলার একটা খেলনা রিভলবার নিয়ে কি ভাবে বুলেট চেম্বার খুলে বুলেট বসিয়ে লক করে ফের ট্রিগার টিপে গুলি করতে হয় তার একটা শর্টকাট ট্রেইনিং নিয়ে নিল। যদিও সে জানে যে এভাবে প্রাকটিস ও প্র্যাকটিক্যালি করার মধ্যে অনেক ফারাক আছে। তারপরও একেবারে আনাড়ী হাতে করার চাইতে কিছুটা ওরাল ট্রেইনিং ই বা কম কিসে!

কিন্তু এই ট্রেইনিং নিতে গিয়ে তার সুবিধা বা অসুবিধা যেটা হলো তা হলো তার সুইসাইডাল টেন্ডেন্সিটা কিছুটা কমে গেল। তার ঐ মুহূর্তে কেন জানি না আর মরতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু এ অবস্থা বেশীদিন স্থায়ী হলো না । ফের মরে যেতে ভীষণ ইচ্ছে করতে লাগলো। আস্তে  স্তে এমন হলো যে কোন পরিস্থিতিই তাকে মৃত্যু চিন্তা থেকে বিরত রাখতে পারে না। শেষে একদিন রিভলবারের গুলি খেতে না পেরে ঘুমের ওষুধ-ই খেতে হলো তাকে। খেলো তো খেলো কিন্তু সে যে আশকা করেছিল তাই হলো, কী ভাবে যেন ধরা পড়ে গেল । হতে পারে টেনশানে দরজা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল বা ইচ্ছে করেই আটকায়নি। নাহ্ সে তো  ভুলেই গিয়েছিল যে তার ঘরের চাবি মা-এর ঘরে থাকে। কারণ ভুল করে সে অনেকবারই চাবি ঘরের ভেতরে রেখেই বাইরে থেকে লক করে চলে গেছে। শেষে কি আর করা চাবি ওয়ালা ডেকে এনে নতুন চাবি বানাও, তালা খোল। সে জনাই চাবি তারপর থেকে মার ঘরে থাকে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়াল নেই, সকাল নয়টায়ও যখন ঘরের দরজা বন্ধ দেখল তখনই মা-এর সন্দেহ হলো। তিনি জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলেন, আর তখনো খুলছে না দেখেই তিনি ছুটে চাবি আনতে গেলেন। হে খোদা ! ও যেন কিছুতেই গলায় ফাঁস না লাগায়। সম্ভাব্য বিভীষিকাময় দৃশ্যটা ভেসে ওঠে চোখে। হিমিকার ঘরের সিলিংফ্যানটা থেকে ঝুলছে একটা স্যালোয়ার কামিজ পরা মেয়ে, চোখ দুটি বিস্ফারিত, গোলাপি নেইলপলিশ লাগানো দুটো ফর্সা পা, পা দুটো শুন্যে দুলছে ...। ভাবতেই শিউরে ওঠেন মা। । ও যেন অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে তাও ভালো। কোনো ভাবেই যেন বাথটাবটা টকটকে তাজা রক্তে গঙ্গা হয়ে আছে সেই দৃশ্য দেখতে না হয়। সমানে তিনি তখন দোয় দরুদ পড়ে যাচ্ছেন । আর চেনা ড্রয়ারে পরিচিত চাবি পাগলের মতো হাতড়ে চলেছেন। তার শুয়ে থাকার ভঙ্গী দেখেই তার মা বুঝতে পেরে গেলেন...। তবে মা এর ধারণা পুরোটা ঠিক না। দীর্ঘদিন ধরে হিমান্তিকার কিছুতেই ঘুম হচ্ছিল না। দু চোখ এক করলেই এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন তাকে তাড়া করছিল। তাই সে নিশ্চিন্তে একদিন অন্তত একদিন ঘুমাবার জন্য এক সাথে ৪টা স্লিপিং পিল খেয়ে ফেলেছিল। আর তাই অনেকদিনের ক্লান্ত দুর্বল শরীর এটাকে ব্লটিং পেপারের মতো চুষে নিয়েছিল।

 

 


 

নিজেকে হসপিটালে আবিষ্কারের পর হিমান্তিকার যার কথা সবার আগে মনে পড়েছে সে হলো তার বড় বোন মৃত্তিকা। মৃত্তিকা থাকে তার স্বামীর সাথে টরেন্টোতে। হিমান্তিকার বেডের মাথার কাছে চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছেন তার মা। পত্রিকার নাম 'মনোজগৎ'। তার মুখটা অসম্ভব থমথমে হয়ে আছে।
উল্টোদিকে কেউ বসে থাকলে তার সাথে কথাবার্তা চালিয়ে নেয়া কষ্টকর তারপরও হিমান্তিকা তার মাকে বলল, মা আপার সাথে কথা হয়েছে?
না।
তোমার সেল ফোনটা খোলা নেই?
খোলাই তো, হসপিটালে বোধহয় নেটওয়ার্ক কাজ করছে না।
তোমার কিন্তু উচিৎ আপার সাথে একবার কথা বলে নেয়া।
উচিৎ অনুচিৎ জ্ঞান তোমাকে দিতে হবে না। এই কঠিন কথাটা বলতে গিয়েও বললেন না তিনি।
আপা নিশ্চয়ই এর ভেতরে দু-একবার ফোন করেছে। কী জানি হালিমা ফোন ধরছে কি না। তুমিতো জানো মা আপার সমস্যাটা।
তোমাদের দু বোনের সমস্যা জানতে জানতে আমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেছে! এ কথাটাও বলতে গিয়ে চেপে গেলেন। মেয়ে যে কান্ড ঘটাচ্ছে আজকাল!
মৃত্তিকার এক অদ্ভুত ধরণের সমস্যা আছে। হিমান্তিকা যার নাম দিয়েছে অহেতুক দুশ্চিন্তা রোগ। তার ধৈর্য সহ্য অন্য সব স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় কম। সে কাউকে ফোন করলে আর সেই ফোন যদি ঐ ব্যক্তি রিসিভ না করে তাহলে পৃথিবীর তাবত দুঃশ্চিন্তা এসে তার ওপরে ভর করে। এবং মানুষ ও সম্পর্ক ভেদে এই দুঃশ্চিন্তা ভিন্ন ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়। ফোনের অপর প্রান্তের মানুষটা যদি তার বন্ধু স্থানীয় হয় তাহলে ভাবতে বসবে , তাদের বন্ধুত্ব শেষ হয়ে গেল না তো? সে কোনোভাবে তার বন্ধুকে হার্ট করে বসল না তো! এবং অবশেষে এই অশংকা এ্যাকসিডেন্ট বা আসন্ন মৃত্যু সম্ভবনা পর্যন্ত গড়ায়। সেই মৃত্তিকা যখন দুদিন ধরে বাড়িতে ফোন করে কাউকে ধরতে পারবেনা তখন তার মনের অবস্থা বলাই বাহুল্য।
যথারীতি গত দুদিন ধরে মায়ের বাড়িতে ফোন করে চলেছে মৃত্তিকা। কিন্তু কেউ ফোন রিসিভ করছে না। আজও কেউ ফোন না ধরলে সে একটা কিছু কান্ড ঘটিয়ে বসবে বলে মনে মনে ঠিক করেছে। আর তা হলো সে সোজা প্লেনের টিকেট কেটে বাংলাদেশে পৌঁছে যাবে। সোজা কথা না! দুদিন ধরে ফোন কানে চেপে ধরে একটার পর একটা রিং শুনে যেতে হচ্ছে তাকে। আর কারো সেল ফোনে কল করলে একই কথা,... কিছুক্ষণ পর আবার ডায়াল করুন..’। আর ভাল্লাগেনা! মনে মনে কিছু দোয়া দরূদ পড়ে নিয়ে আবারো ফোন ঘোরায় মৃত্তিকা। টু-উ-উ, টু-উ-উ , একবার, দুবার, তিনবার, চারবার। অনেকক্ষণ ধরে টেলিফোনে রিং হচ্ছে, প্রথমবার রিং বাজতে বাজতে কেটে গেল, এই দ্বিতীয়বার! কেউ ফোন ধরেই না। এপাশে ফোন কানে চেপে ধরে ভীষণ বিরক্ত হয় মৃত্তিকা, কি ব্যাপার ! কেউ ফোন ধরছে না কেন? বাড়িতে কেউ নেই নাকি! না থাকাটাই স্বাভাবিক। বাবা থাকেন সারাদিন ব্যবসা-অফিস এসব নিয়ে ব্যস্ত। আর মা ইদানিং কি নিয়ে ব্যস্ত গড নোজ! যখন পুরনো বাড়িটা ভেঙ্গে নতুন বাড়িটা করছিলেন তখন তো সারাদিন শপিং নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন, অত বড় একটা বাড়ির কনষ্ট্রাকশন থেকে অল ডেকরেশন, যেন তেন কথা না। ইদানিং তিনি বোধহয় আবার হিমান্তিকাকে নিয়ে পড়েছেন, তার আদরের ছোট কন্যা। সারাজীবন বেশি বেশি আদর দিয়ে এসেছেন। মৃত্তিকাকে তো যেন দেখতেই পারত না। সারাক্ষণ হিমান্তিকার প্রশংসা। হিমান্তিকা আঁকতে পারে, গাইতে পারে ভালো ছাত্রী ইত্যাদি ইত্যাদি। একটা কথা যে প্রচলিত আছে যে, মা তার সব সন্তানকেই সমান ভালবাসে এই কথাটা মৃত্তিকা এখনো বিশ্বাস করতে পারেনা। কারণ তার বদ্ধমূল ধারণা মা হিমান্তিকাকে বেশি ভালোবাসে। সে হুট করে প্রেমে পড়ে না, ছেলেদের পাত্তা দেয় না। এখন কী হলো সেই গুণধর মেয়ের! মা এর ওপর অভিমান হলেও হিমান্তিকার জন্য মনটা খারাপ হয়ে যায় তার। কী হলো ওর? ইদানিং কেমন মন মরা ভাব, এতো দূরে থেকেও বোঝা যায়। এতক্ষণে ফোনটা তুলল কেউ।
হ্যা- এ্যালো,
ছুটন্ত ট্রেনের মতো গতিতে প্রশ্ন করে মৃত্তিকা, কে? হালিমা?
জ্বি আফা!
আচ্ছা মা কোথায় গেছে রে? বাবা মা কাউকে মোবাইলে পাচ্ছি না!
ছোট আপারে নিয়া হাসপাতালে গেছে।
হসপিটালে কেন? মার কিছু হয়েছে? না-কি ..?
ছোট আপার,
কি হয়েছে ছোট আপার?
আমি তো ঠিক জানিনা, তয় কিছু বোধহয় খাইছিল, কেমন বেহুশ মতো হইয়া গেছিল..।
বুকের ভেতরটা ধ্বক করে ওঠে মৃত্তিকার, মনে হলো যেন পৃথিবীটা দুলে উঠল তার।

আত্মহত্যা!

আত্মহত্যা করতে চাইছিল হিমান্তিকা! ওহ্ মাই গড! আত্মহত্যা মানুষের জীবনকে কি দেয়? কতগুলো প্রশ্ন রেখে যাওয়া ছাড়া। কেন? কি জন্য? কী এমন কষ্ট ছিল? কি প্রয়োজন ছিল, অন্য কোনোভাবে কি সমাধান হতো না! জীবনকে কি কোনোভাবে বয়ে নিয়ে যাওয়া যেত না? বেশিরভাগ মানুষ কত কষ্ট করেই না এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকে। জীবনের প্রতি কতটা অনীহা এলে মানুষ আত্মহত্যা করে? কেন করে?
ওহ্ মাই পুওর সিস্টার! কি হয়েছিল ওর? ভেতরে ভেতরে ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ে মৃত্তিকা। হিমান্তিকাটা ভীষণ ইন্ট্রোভার্ট কিছুতেই হয়তো বলবে না ওর প্রবলেমটা। নিজের অজান্তে দুচোখ বেয়ে নেমে আসে জলের ধারা। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার এখন। কাকে বলবে এখন এ কথা! শফিক তার স্বামী এখন অফিসে, এ সময়ে ওকে ফোন করা যাবে না। শফিককে কি বলবে কথাটা! কেন বলবে না? ওকে যে বলতেই হবে। সফিক এ কথাটা প্রায়ই বলে, হিমান্তিকা না থাকলে তাদের বিয়েটাই হতো না। শফিকের সাথে যখন মৃত্তিকার সম্পর্কটা তৈরি হয় তখন মা তো ওকে সহ্যই করতে পারত না। সে ছিল মূলত হিমান্তিকার হাউজ টিউটর। ইউনিভার্সিটির ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট তবে সেই অর্থে খুব রাফ এন্ড টাফ না। খুব সাধারণ একটা ছেলে। হিমান্তিকা-ই একদিন বলেছিল, আপু তুই শফিক ভাইর সঙ্গে কথা বলিস না কেন? তোদের তো পাশাপাশি ডিপার্টমেন্ট! উনি কিন্তু দারুণ একটা ছেলে!
তুই কি করে বুঝলি?
বা-রে, আমার টিচার আর আমি বুঝতে পারব না!
কেমন খ্যাত মার্কা।
মোটেই না। তোরা শুধু বাইরের গেটআপটাই দেখিস,। কিছু মানুষ আছে বাইরে থেকে খুব স্মার্ট দেখালেও তাদের সাথে দু মিনিটও কথা চালিয়ে নেয়া যায় না। কিন্তু শফিক ভাইর জ্ঞানের গভীরতা এমন যে, তার সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলা যায়। কখনোই বোর লাগে না।
যারা অত জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলে তাদের আমার ভালো লাগে না। মাস্টার মাস্টার ভাব।
আরে সেরকম না, অন্যরকম; তুই একদিন কথা বলে দেখিস।
সেদিন মৃত্তিকা একটা পার্টিতে যাবার জন্য বাইরে বেরুচ্ছিল এমন সময় সিঁড়িতে তার সঙ্গে দেখা। অন্যমনষ্ক ভাবে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছিল সে। জিনসের ওপরে গাঢ় নীল টি শার্ট। মাথার চুলগুলো সিল্কি তবে যত্নের কোন ছাপ নেই। সিড়ি দিয়ে উঠবার সময় চুলগুলোও যেন লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছিল। প্রথম কথাটা মৃত্তিকাই বলল, আরে আপনি! আপনার ছাত্রী তো বাড়িতে নেই, মা এর সাথে কোথায় যেন গেছে। আপনাকে আগে ইনফরম করেনি?
সে বলল, আসলে আমারতো সেল ফোন নেই, তাই হয়তো বলতে পারেনি, ওকে এজন্য দোষ দেয়া যায় না। কিন্তু দেখেন আপনি আজ আসবেন সেটাতো ও নিশ্চয়ই জানতো। এখন তো আমারই ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে।
আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন?
হ্যা আমার বান্ধবীর বাড়িতে আজ পাজামা পার্টি।
পাজামা পার্টি মানে এই তো, যেখানে মেয়েরা সারা রাত ধরে পার্টি করবে আর পুরুষ নট এ্যালাউড?
এক্স্যক্টলি! আপনি দেখি সব জানেন!
শফিক ঈষত লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নোয়ায়।
তবে এ কথাটা পুরোপুরি ঠিক না। ভিজিব্যালি পুরুষ নট এ্যালাউড তবে ইনভিজিব্যালি অ্যালাউড।
মানে?
মানে মেয়েদের আলোচনায় তারা আসতে পারে। আর এসেও থাকে। হা-হা।
আপনি তো অনেক মজার মানুষ!
কি ভাবে?
এই যে মজা করে কথা বলেন!
তাই নাকি!
হ্যা, ঠিক এভাবে শুধুমাত্র পুরুষের পার্টিতেও মেয়েরা ইনভিজিব্যালি ঢুকে পড়ে।
তারপর কল্পনায় আপনারা তাদেরকে রক্ত মাংসের মানুষ করে তোলেন।
সে তো আপনারাও করেন, করেন না?
করি হয়তো...! বাই দ্য ওয়ে। আপনি কিন্তু আমার সাথে যেতে পারেন।
কোথায় পাজামা পার্টিতে?
অন্য সময় হলে মৃত্তিকা হয়তো রেগে যেত, কিন্তু এবার সে হেসে ফেলে। নাহ্ , রাস্তায় আপনি যেখানে নামবেন আমি আপনাকে সেখানে ড্রপ করব।
নো থ্যাংকস! শফিক সিঁড়িতে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে মৃত্তিকার যাবার জন্য পথ করে দেয়। মৃত্তিকা নেমে যাবার জন্য এক পা বাড়াতেই হঠাৎ মনে পড়েছে এভাবে শফিক বলল, একটা কথা বলব?
কি বলুন! সৌজন্য হাসি দেয় মৃত্তিকা ।
শফিক সেদিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলে, আপনাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে।
মৃত্তিকা চকিতে থমকে দাড়ায়। সে রেগে যাবে কিনা বুঝতে পারছে না। সে দেখতে খুব একটা সুন্দর না, তাব গায়ের রঙটা শ্যামলা তাই তার মিষ্টি সৌন্দর্যটা সবার চোখ এড়িয়ে যায়। সে কারণে তাকে কেউ সুন্দর বললে সে মনে মনে খুশিই হয়। তারপরও চোখ মুখ গম্ভীর করে বলল, কেমন সুন্দর?
শফিক বলল, প্যারাগন অব বিউটি।
অর্থাৎ! কম্পেয়ার করুন বুঝতে সুবিধা হবে। মৃত্তিকার চোখে মুখে কৌতুক।
অড্রে হেপবার্ন-এর মতো। কথাটা বলে যেন নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে যায় সে। মনে মনে নিজেকে গালি দেয় ‘গর্ধব’ বলে।
মৃত্তিকা কিন্তু রাগে না বরং বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে, আপনি অড্রে হেপবার্নকে শাড়ি পরা দেখেছেন কখনো?
না ঠিক তা নয় শাড়ি পরলেও হয়তো এরকমই লাগত, অথবা ওয়েষ্টার্ন পোশাকে আপনি তার মতো।
তার চেয়ে বরং আপনি বাঙালি কারো কথা বলেন আমার মেলাতে সুবিধা হবে। আমার চেহারায় বাঙালিয়ানাটাই তো বেশি!
তাহলে বলি সুচিত্রা সেন!
ধ্যাৎ! ঐ ভদ্রমহিলার তো ভীষণ অহংকারী ধরণের চেহারা ; আমি কি দেখতে অতটা অহংকারী? সাধারণ কোনো সুন্দরের কথা বলেন।
কি বলব তাহলে! হ্যা পেয়েছি।
কে?
নাহ্ আজ বলব না, ফের কখনো দেখা হলে বলব। আসি তাহলে..।
শফিক চলে যেতে থাকে আর মৃত্তিকা ওভাবেই দাড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, শফিকের চোখের সেই মুগ্ধতা তার মস্তিষ্ক ভেদ করে ছাড়িয়ে যায় মনে। একটা মাত্র কথা.., অথচ কী সুন্দর!
সত্যি বলতে কি সেই ভীষণ অপছন্দের শফিকের সঙ্গেই মৃত্তিকার একদিন প্রেম হয়ে গেল। যেটা মা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। বলতেন, ওদের কোনো বলার মতো স্যোসাল স্ট্যাটাস নেই, লেখা পড়ায় একটু ভালো এই যা। এমন একটা ছেলেকে তার বড় মেয়ে বিয়ে করবে এটা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি। কিন্তু হিমান্তিকা শফিককে সব সময়ই পছন্দ করেছে। ওর পরিবারের সামাজিক অবস্থান হিমান্তিকাকে পীড়িত করেনি কখনো। ও বলত আপু, মা বুঝতে পারছে না শফিক ভাই কত ব্রিলিয়ান্ট আর কত ভালো একটা ছেলে। এক সময়ে দেখবে তিনি তার এই জামাইকে নিয়ে গর্ব করবেন। মা এর শুধু শুধু...। কথা শেষ করে না হিমান্তিকা; আচ্ছা ঠিক আছে, আমি মাকে বুঝিয়ে বলব। কিন্তু আপু তুই একটা কথা আমাকে বুঝিয়ে বলতো, তুই কি করে শফিক ভাই এর মতো একটা ছেলের প্রেমে পড়ে গেলি? আমার মাঝে মাঝে ভীষণ অবাক লাগে ইউনিভার্সিটিতে তো সো কলড স্মার্ট ছেলের অভাব ছিল না। তুই নিশ্চয়ই আমার কথায় ইনফ্লুয়েন্সড হয়েছিস? স্বীকার কর, স্বীকার কর আপু! হিমান্তিকা প্রায় চেপে ধরে তাকে।
যাহ্ তোর কথায় ইনফ্লুয়েন্সড হবো কেন? আমার নিজের বুঝি কোনো সেন্স নেই! হ্যা একথা সত্যি ইউনিভার্সিটিতে স্মার্ট ছেলের অভাব ছিল না কিন্তু মৃত্তিকা ঠিকই বুঝতে শফিক অন্যদের চেয়ে আলাদা। এই যে এ্যাপ্লাইড ফিজিক্সে পিএইচডি করতে স্কলারশিপ নিয়ে টরেন্টো এলো, এসব যোগ্যতা তো সে নিজেই অর্জন করেছে। এমন একটা ছেলেকে ভালবাসবে না! তাছাড়া ও ভীষণ রোমান্টিকও । মৃত্তিকা অত ভালো স্টুডেন্ট না হতে পারে তবে বোকা তো নয়!
হিমান্তিকার কী হতে পারে ভাবতে লাগল মৃত্তিকা। মেয়েটা এতো চাপা স্বভাবের ! তারপরও সেদিন ফোনে কথা বলার সময় জিজ্ঞেস করছিল , আপু কিভাবে রিভলবার চালাতে হয় জানিস?
আমি কি করে জানব! তোর দুলাভাইর বা বাবার কারো কি রিভলবার আছে নাকি? কেন জানতে চাইলি, তুই কি আবার শ্যুটিং ক্লাবে ভর্তি হয়ে গেলি নাকি? আমাদের দেশের মেয়েরা তো আবার শ্যুটিংএ খুব ভালো।
নাহ্ সেজন্য নয়, এই একজন জানতে চেয়েছিল তাই তোকে জিজ্ঞেস করলাম।
কে জানতে চাইবে তোর কাছে? জয় ছাড়াতো এই পৃথিবীতে কোন বন্ধু টন্ধু নেই আর সে যে তোর কাছে জানতে চাইবে তা তো মনে হয় না। আর থাকিসতো সারাদিন একা একা, হতাশাগ্রস্ত মানুষের মতো ইন্টারনেট ঘাটিস।
আপু তোর কথা শেষ হয়েছে!
না, কেন?
আমার আর তোর সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে না।
তার মানে! প্রায় কেঁদে ফেলেছিল মৃত্তিকা । তুই তো আমার সাথে এভাবে কথা বলতিস না। হঠাৎ তোর কি হলো হিমি!
কিছু না, রখি আপা বাই। ফোনটা কেটে দিয়েছিল হিমান্তিকা। তারপরই মা একদিন বলছিলেন ওর অস্বাভাবিকতা নাকি দিন দিন বাড়ছিল।
ও আবার ড্রাগ-ট্রাগ নিচ্ছে না তো!
নাহ সে রকম তো মনে হয় না। ভাবছি একজন সাইকিয়াট্রিষ্ট এর সাথে কথা বলব।
একটা অবিবাহিতা মেয়ে হুট করে সাইকিয়াট্রিষ্ট এর কাছে নিয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হবে মা! একটু ভাবো।
মা হতাশ গলায় বললেন, অন্য কোনো উপায় তো দেখছি না।

 

 

 

হিমান্তিকার ডাক্তার সিদ্ধার্থ বড়ুয়া  একজন নামকরা সাইকিয়াট্রিষ্ট। তবে তিনি খুব একটা খটকার মধ্যে পড়েছেন এই রোগীকে নিয়ে। এই রোগ ভালো করতে হলে একজন সাইকিয়াট্রিষ্ট এর রোগের প্রকৃত কারণ জানা জরুরী, অথচ এই রোগী বা তার ফ্যামিলির কেউই এখন পর্যন্ত ক্লিয়ার করে প্রকৃত কারণ বলছেন না। ফ্যামিলি বলতে বাবা মা আর হিমান্তিকা, বড় বোন বিয়ে করে বিদেশে। তার ওপরে রোগীর বাবার ধারণা যে তার মেয়ে সুস্থ!

 

কতটা সুস্থ এটা বোঝাতে তিনি কিছু উদাহরও দিলেন যার একটা হলো, একদিন তিনি আর হিমান্তিকা অফিসে যাচ্ছিলেন তখন বেলা ১১টার মতো বাজে। মাঝে মাঝে তিনি একটু দেরি করেই অফিস যান, সেদিনও তাই। হিমান্তিকা তার কাছে লিফট চাইল টিএসসি পর্যন্ত। কিন্তু গাড়ী শাহবাগ পেরিয়ে একটু সামনে যেতেই চারুকলার সামনের রাস্তা ধরে একটা মিছিল এসে পড়ল সামনে। একটা বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের মিছিল। ওদের কোন এক কর্মী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুন হয়েছে তার প্রতিবাদে। মিছিলের সামনে বা আশেপাশে গাড়ি পড়লেই গাড়ি ভেঙ্গে দেয়াটা অনেকদিন ধরে নিয়ম হয়ে গেছে। হাফিজ সাহেব টেনশানে গাড়ির মধ্যে বসেও ঘামতে লাগলেন। টাইয়ের নট ঢিলা করতে করতে বললেন, মিছিলের মধ্যে পড়ে গেলাম দেখি মা; গাড়িটা আবার ভেঙ্গে দেবে না তো!

 

হিমান্তিকা স্বাভাবিক গলায় বলল, ওরা কিছু করবে না বাবা! ওদের ভেতরে এখনো একটা আদর্শ আছে। ওরা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের মতো টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি করতে যায় না। দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করে ক্ষমতায় যাবার জন্য অযথা ভাঙচুর করে না। এখনো ওরা মানুষকে সম্মান করতে জানে।

- কথাটা পুরোপুরি ঠিক না মা, যে সব দেশে ওরা ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে সে সব জায়গায় কিছু শোষণ অত্যাচার ওরাও করে। দেখ না গিয়ে এই কাছেই ভারতের পশ্চিম বঙ্গে।

মেয়ে এরপর কোনো তর্কেই গেল না, আর এটাই তার স্বাভাবিকতার চূড়ান্ত প্রমান। বলেন একে কি মেন্টালি অসুস্থ বলা যায়?

মেণ্টালি অসুস্থ বলতে এখানে পাগল মিন করা হচ্ছে না মি. হাফিজ! আমরা ধারণা করছি ও কোনো মানসিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

কে শুনবে কার কথা? হিমান্তিকার বাবা সেটা মানতেও নারাজ।

 

হিমান্তিকার মা প্রথম যেদিন এলেন সেদিন একাই এসেছিলেন ডাক্তার সিদ্ধার্থ বড়ুয়ার চেম্বারে। রেফারেন্স ছিল, তার পরও ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনি তো পেশেন্টকে নিয়ে আসেন নি।

- আসলে ও ভীষণ সেনসিটিভ এখানে আসার ব্যপারটা হিমি হয়তো সহজে নিতে পারবে না।

- আসলে এ বয়সে এটুকু পরিবর্তনেই সে যে সিভিয়ার ধরণের মানসিক সমস্যায় ভুগছে সেটা বলা যায় না।

- কিন্তু ডক্টর, ও ভীষণ প্রাণবন্ত ছিল । কখনোই ওকে আমরা মন খারাপ করে ঘরে গুম হয়ে বসে থাকতে দেখিনি। ওর হয়তো কখনো মন খারাপ হতো, মানুষ মাত্রেই হয় ; কিন্তু আমি বুঝতে পারি, এমন অচরণ ও কখনোই করেনি। অথচ ইদানিং কালে ওর স্বভাবটাই কেমন বদলে গেছে। অকারণে রেগে যায়, কখনো কখনো চিৎকার চেচামেচিও করে। আবার কখনো দেখা যায় দুতিন দিনেও কারো সাথে কথা বলছে না। যেটা ওর স্বভাবের সাথে একেবারেই যায় না। ওতো বাড়িতে থাকলে কথা না বলে কখনো থাকে না। আর একটা ব্যাপার হলো ও ভীষণ আতংকিত হয়ে পড়েছে। কেউ কলিংবেল বাজালেই চমকে ওঠে। ছুটে গিয়ে স্পাই-হোলে চোখ লাগিয়ে দেখবে কে এসেছে। টেলফোন এলেও চমকে ওঠে। আমি যখন ফোনে কথা বলি ও তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। কে কথা বলছে? কি বলছে? এসব বোঝার চেষ্টা করে। বাড়িতে কেউ এলে ভীষণ বিরক্ত হয়।

- ও কি কোনো ধরণের এ্যাকসিডেন্ট বা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল?

- আমি তো ঠিক জানি না, সেটাই তো বুঝতে পারছি না, কিছুই বলে না মেয়ে। আর তার ওপরে সেদিন হুট করে এমন একটা কাজ করে বসল...!

- ম্যাডাম অপনি বরং আরো কিছুদিন দেখেন, এর ভেতরে ওর কোনো পরিবর্তন হয় কি না। আর

 

যদি কোনো চেঞ্জ না হয় সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় না আর দেরি করা ঠিক হবে। কারণ ডিপ্রেশান কে কখনো এ্যভয়েড করা ঠিক না। এতে করে অনেকসময় ডিসঅর্ডার হয়ে যায়।

 

হিমান্তিকার অসুস্থতার সিম্পটমগুলো অনেকটা এরকম, চাকরীটা ছাড়ার পর থেকেই মূলত হিমান্তিকার লোনলিনেসটা বাড়তে থাকে। সব সময় কেমন যেন এক ধরণের অপরাধবোধ কাজ করত ওর ভেতরে ভেতরে। হতাশ হতে হতে মেজাজটা ভীষণ খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল। সব ব্যাপারেই সন্দেহ হত তার । শেষ পর্যন্ত যে মানুষ দেখতো কিছুক্ষণ যেতেই তাকে ভীষণ অসহ্য লাগতো। ওর মনে হতো সবাই ওকে করুণা করছে। শেষ দিকে ঘুম কমে এলো, ক্ষুধা বোধ কোথায় হারিয়ে গেল । সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি গ্রো করতে থাকে, তার পরই ওদের ফ্যামিলি ডক্টর এর পরামর্শে এখানে আসা।

 

তবে তার মাও একজ্যাক্ট কোনো কারণ বলতে পারলেন না। শুধু বললেন, ছেলেবেলা থেকেই আমার মেয়ে ভীষণ ইন্ট্রোভার্ট। কিছু জানতে চাইলেও বলবে না।

 

ইনিসিয়ালি ডাক্তার যে কারণগুলো স্পেসিফাই করছেন সেগুলো হলো, মেয়েটার বয়স সাতাশ-আটাশ এর কাছাকাছি । কিন্তু আজকালকার এই নারী প্রগতির যুগে এটা বেসিক কারণ হতে পারে না । বম্বের নায়িকাদের তো ক্যারিয়ারই শুরু হয় এখন এই বয়সে। তার বয়সটা মোটেই পাগলামির নয়, যেহেতু সে টিন এজার নয়। তবে বড় ধরণের কোন শক্ পেলে এ বয়সে এ অবস্থা হতে পারে। তার ভেতরে এক ধরণের অপরাধ বোধ কাজ করে । সেক্ষেত্রে হৃদয় ঘটিত ব্যাপার থাকতে পারে আবার না ও থাকতে পারে। যদি তেমন কিছু থেকে থাকে সেটাই আসল কারণ হতে পারে না, ভেতরে অন্য কিছু আছে কিন্তু ডা. সিদ্ধার্থ কে কিছু একটা  সূত্র ধরে তো এগোতে হবে।

 

প্রথম সিটিং এ ডাক্তার বেশ আন্তরিকতার সাথে হাসি হাসি মুখে বললেন,আপনার ফরমাল নেম হিমান্তিকার চেয়ে নিক নেম  হিমিকা আমার কাছে বেশ মিষ্টি মনে হয়েছে. ক্যান আই আস্ক ইউ  হিমিকা ?

হিমান্তিকা কোনো জবাব দিল না। হ্যা না কিছুই না। বাইরের লোক তার নিক নেমে ডাকুক এটা তার পছন্দ নয়। তাছাড়া এই ডাক্তারকে তার বেশিরভাগ সময়ই ডাক্তার না এফবিআইর এজেণ্ট বলে মনে হয়।

হিমান্তিকার নীরবতা দেখে ডাক্তার বললেন, ওকে নো প্রবলেম! এটা তার রোগীর সাইকোলোজি সম্বন্ধে আঁচ করার একটা প্রক্রিয়া ।

- আচ্ছা হিমান্তিকা, লেখাপড়া শেষে আপনি কি করতেন?

হিমান্তিকা এবার বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলল, ছাত্রাবস্থায় আমি একটা পলিটিক্যাল পার্টিতে নাম লিখিয়েছিলাম বন্ধুদের সাথে মিলে, তবে সক্রিয় ছিলাম না। তবে  রিগার্ডিং দ্যাট ফিলসফি কিছু একটা করতে চেয়েছিলাম, হলো না ।

- এক সময় চাকরী নিয়েছিলেন একটা কিন্তু চাকরী ছেড়ে ছিলেন কেন?

- তেমন কোন কারণ নেই আবার আছেও। ওটা একটা ঘোড়ার ঘানি টানা টাইপ চাকরী ছিল যা আমার পছন্দ নয়। কোনো ক্রিয়েটিভিটি এ্যাপলাই করতে হয় না। ছকে বাঁধা কাজ। এ জন্য এত শিক্ষিত এ্যমপ্লয়ী কি জন্য নিয়েছিল কে জানে? তাই মন টেকাতে পারিনি, তা ছাড়া চাকরী করতে গিয়ে নিজেকে ভীষণ বন্দি মনে হতে লাগল। আমার স্বাধীন মন অন্যের অধীনতা মানতে পারেনি।

- এ জন্যই কি পরে আপনি আর চাকরি করেন নি?

- হুম্

- তাহলে আপনি কি হতে বা কি করতে চেয়েছিলেন জীবনে?

 

বড় কঠি প্রশ্ন, অথচ এই একই প্রশ্ন সে জীবনে আরো অনেকবার শুনেছে। আসলে সে যে জীবনে কি করতে চেয়েছিল জানে না। তার জীবনে কোনো এইম ছিল না। একবার স্কুলে ইংরেজির টিচার এইম ইন লাইফ রচনা শেখাবার আগে সবাইকে এক এক করে বড় হলে কি হতে চাও জিজ্ঞেস করলে সে কিছুই বলতে পারেনি। মাথা চুলকে বলল, ম্যাডাম, পরে ভেবে বলি? স্বাভাবিক ভাবে এই পরিস্থিতিতে ম্যাডামের রেগে যাওয়া উচিৎ , অথচ ম্যাডাম উল্টো তখন ভেবেছিলেন তার এই ষ্টুডেন্ট কত না জানি ট্যালেন্ট; এই বয়সেই এত ভাবনার ইচ্ছা!

দেখলে হিমান্তিকা হুট করে বলে দিল না যে, ও এটা হতে চায় সেটা হতে চায়! ভেবে বলবে তার মানে ও মন থেকেই কিছু একটা করতে চাইবে যাতে সে সফল হবে।

- আমি সত্যিই জানি না কি হতে চেয়েছিলাম; ক্লান্ত ভঙ্গীতে বলল হিমান্তিকা, রিয়েলি আই ডোন্ট নো ডক্।

 

ডক্টর বুঝলেন ঘাটালে কাজ হবে না সে আর কিছুই বলবে না। তাই তিনি সেদিন আর কোনো প্রশ্ন করলেন না । রিলেটিভ মেডিসিন সম্পর্কে নার্স কে ইন্সট্রাকশন দিয়ে চলে গেলেন। হিমান্তিকার এত ঔষধ খেতে ভালো লাগে না। তার পর ও খায় কারণ সে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চায়। কারণ সে এতদিনে বুঝে গেছে মানুষ বড় স্বার্থপর জীব। মৃত্যু পথযাত্রী সন্তানের বাবা মা ও সন্তানের কথা যতটা না ভাবে তার চেয়ে বেশী ভাবে নিজের কথা যে, ন্তানের মৃত্যুর পর এই শূন্যতা এই মানসিক কষ্ট সে কি করে সহ্য করবে! শারিরীক কষ্ট বা অত্যাচার মানুষ মনে রাখে না তবে মানসিক কষ্ট তাদের সারা-জীবন ভোগায়।

 

হিমান্তিকার সঙ্গে ডক্টর এর যে কথোপকথন হয় সেখানে সে নির্দ্বিধায় যাতে তার মনের কথাগুলো খুলে বলতে পারে তাই অনেকটা ঘোরের মধ্যে একটা ঘোর লাগা অবস্থায় এর পরের হিপনোটিক সিটিংগুলো হতে লাগলো। যেখানে সে ডক্টর এর অস্তিত্ব খুব একটা অনুভব করত না।

 

ডাক্তার সুব্রত না সিদ্ধার্থ কি যেন নাম? ভদ্রলোক প্রায় সব সময় একই ধরণের কথা বলেন। শুনতে শুনতে হিমান্তিকার কেমন ক্লান্তি লাগে ।

 

তার চিকিৎসার প্রাথমিক পর্ব বোধ হয় শেষ, এখন মেডিটেশান পর্ব চলছে। মেডিটেশান খারাপ লাগছে না হিমান্তিকার - ধ্যানের সময় কেমন একটা শান্তি শান্তি ভাব চলে আসে। ধ্যান শেষ তো আর কিছু ভালো লাগে না। ইদানিং তার মনে হচ্ছে ঘরের দেয়ালগুলো তার দিকে তাকিয়ে উপহাসের হাসি হাসছে।

 

কখনো কখনো কথাও বলে, বেশীর ভাগ সময় বলে তারা নাকি জেল-খানার দেয়াল। জবাবে হিমান্তিকা বলে হোক না তাই, আমাদের দেশের দুই নেত্রী ও তো ছিলেন, আমি ও না হয় থাকলাম, সুবিধা কোথায়? প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পর হিমান্তিকার কেমন একটু খটকা লাগে, সেকি একটা দেয়ালের সাথে কথা বলছে? এটা কি ভাবে সম্ভব! হিমান্তিকার মাথার ভেতরটা কেমন ভো ভো করে ওঠে। কেমন যেন একটা গভীর অন্ধকার কুয়ায় ধীরে ধীরে ডুবে যাওয়ার মতো অনুভূতি। তার ভেতরের চেতনা লুপ্ত হয়নি পুরোপুরি, সে ভাবছিল এরা তার সাথে কী-ভাবে কথা বলছে! এরাতো জড়বস্তু । আচ্ছা, জড়বস্তুর সাথে মানুষের সম্পর্ক-ই বা কি? সে যখন সুস্থ স্বাভাবিক ছিল তখনো খেয়াল করেছে, অনেক দিনের জন্য সে বাড়ির বাইরে গেলে বা কোথাও বেড়াতে গেলে ফিরে এসে দেখতো তার ঘরের দেয়াল ঘড়িটা বন্ধ হয়ে আছে। হিমান্তিকা এসে ঘরের ভেতরে কিছুক্ষণ অবস্থান করলে তার পায়ের শব্দে, শরীরের উত্তাপ ও সৌরভে কেমন করে যেন জেগে উঠতো ঘড়িটা। টিক টিক করে জানান দিত তার অস্তিত্ব। এমন কি করে হয়? বা এখন-ই বা এই সব জড় বস্তুরা তার সাথে কথা বলছে কি ভাবে! জড় বস্তুর এই অনুভূতি প্রবতা তার কাছে বিরট রহস্য হয়েই রইল।

 

দেয়ালগুলো আবার তাকে গভীর আগ্রহে জিজ্ঞাসা করে, হিমান্তিকা এখন কি আর তোমার মরে যেতে ইচ্ছে করে না?

- করলেই বা কি? তোমরাতো আর আমাকে সহজে মরবার জন্য পটাশিয়াম সায়ানাইট এনে দিতে পারবে না! 

একথা শুনে সামনের দেয়াল বেশ অবাক স্বরে প্রশ্ন করে পটাশিয়াম সায়ানাইট! সেটা আবার কি?

- ও তোমরা বুঝবে না ভয়ঙ্কর ধরনের বিষ! খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ। তোমরা বুঝবে না; তোমাদের তো আর এ সব খেয়ে মরতে হবে না, তোমাদেরকে অপঘাতে মরতে হলে বড়জোড় ভূমিকম্প বা র‌্যাংস ভবনের মত সিচুয়েশান ক্রিয়েট করতে হবে।

পেছনের দেয়ালটা এতক্ষণে প্রায় খেকিয়ে উঠলো, বালাই শাট! এতসব অলুক্ষণে কথা তুমি বলতে পারো! এ জন্যেই তোমার অসুখটাও ভালো হচ্ছে না।

 

এই কর্কশ দেয়ালটার কথা শুনে হিমান্তিকার মন খারাপ হয়ে গেল আর তাই বললো, আমার অসুখ ভালো হোক আর না হোক ভূমিকম্পেসম্ভবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। উন্নত বিশ্বের শিল্পজাত পরিবেশ দূষণ  এর কারণে গ্রীন হাউজ এফেক্ট, গ্লোবাল ওয়ার্মিং ও এ দেশের অপরিকল্পিত বাড়ীঘর নির্মাণ ও নগরায়নের কারণে এমনটা হতেই পারে । তোমাদের মত নিরেট মূর্খদের সেটা জানার কথা নয়, তবে এই বিল্ডিংটা বানানোর সময় যে ভ্যাজাল রড সিমেন্ট দেওয়া হয়নি, বা পরিমানে কম দেয়া হয়নি সেটা কে বলতে পারে! বিল্ডিং কোড মানা হয়েছে কি না কে জানে? যাই হোক আর আমি তোমাদের সাথে এ নিয়ে কথা বলতে চাই না।

- কথা কি আর সাধে বল? তোমার কথা বলার কেউ নেই তাই আমাদের সাথে কথা বলছো।

- এ জন্য তোমরা আমাকে বিশেষ করুণা করছো বলে মনে হয়?

- যাহ: তাই হয় নাকি? তুমি হলে আশরাফুল মাখলুকাত, সৃষ্টির সেরা জীব! তোমার সাথে কথা বলতে পারলে তো আমরা বর্তে যাই। তবে তুমি বড় বেশী মানুষের মত আচরণ কর আমাদের সাথে। অযথা ভয় দিচ্ছ, টেনশানে ফেলছো।

 

হিমান্তিকা মাঝে মাঝে ভাবে সে আদৌ বেঁচে আছে তো! এভাবে জড় বস্তুগুলো তার সাথে কথা বলে কী ভাবে? কী জানি এর বাইরে, এর চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারেনা সে, মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করে আসে..।

এমন সময় ঘড়িটা বলে উঠলো দেয়াল বাদে আমরা ঘরের বাকী জিনিসগুলোর সাথে তুমিতো  কথাই বলতে চাও না।

- ঠিক আছে এখন থেকে তোমাদের সাথেও কথা বলব। তবে কি জানো? তোমাদের প্রতি আমার বিরক্তিরও একটা কারণ আছে। জানি তারপরও..

 এ সব কথা বাদ দাও তো এখন! একটু ধমকের স্বরে ঘড়িকে থামিয়ে দেয় ফ্যানটা। ঠিক যেযন রিমান্ডে এসেছে এমন ভাবে ফ্যানটা তার লম্বা ব্লেডগুলো নিয়ে চার পাশে পাক খেতে খেতে ঘ্যর ঘারে স্বরে প্রশ্ন করে, তোমার কোনো রোম্যান্টিক গল্প নেই? প্রেমে টেমে পড়নি কখনো? সে সব কথা বল না! হাসপাতালে থেকে থেকে বড় বোর হয়ে গেছি, আমাদের খুব ও সব কথা শুনতে ইচ্ছে করছে!

ফ্যানের সাথে সুর মিলিয়ে এসিটাও রিন রিনে মিষ্টি কন্ঠে বললো, হ্যা আপু তুমি আমাদেরকে তোমার আনন্দ দিনের গল্পগুলো থেকে একটু শোনাও না! প্লিজ!

আমি কি সেলিব্রিটি নাকি, আমার কাছে এসব কেন জানতে চাইছ?

বলো না অপু প্লিজ! প্লিজ!

মানুষ হলে হিমান্তিকা হয়ত কিছুই বলত না, কিন্তু নিতান্তই জড় পদার্থ, তাছাড়া সে তো সারাজীবন একা একা নিজের সাথে নিজেই কথা বলে এসেছে, তাই...।

 

 

 

কিছুদূর যেতেই ঘড় ঘড় ঘররর শব্দ করে একেবারে রাস্তার মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেল মোটরসাইকেলটা। আবার হলো কি এর! কোথাও এটাকে নিয়ে বের হলেই বিপত্তি রাস্তার মধ্যে দুই তিনবার বিকল হওয়া চাই। জয় প্লাকটা খুলে ময়লা জমেছে কি না দেখতে লাগল। এক্সএল মোটরসাইকেলে উঠলে কেমন একটা ঘোড়ায় চড়ার মতো অনুভূতি হয়। অন্যরা এটা শুনলে হেসে বলবে তাহলে অন্যসব মোটরসাইকেলে কি গাধায় চড়ার ফিলিং হয়? জয় নির্দ্বিধায় বলে না,খচ্চরের। মোটরসাইকেলটা ছিল জয়ের ভাইয়ার। জয় মাঝে মাঝে ক্ষেপে গিয়ে বলে,ব্যাটা আমার ভাইকে তো জ্বালিয়ে জর্জরিত করেছে এখন আমার পেছনে লেগেছে। আসলে মোটরসাইকেলটা তার পেছনে লাগেনি বরং সে-ই ওর পেছনে লেগেছে। ওর কি সাধ্য আছে বা ছিল! ভাইয়া এটাকে এতো পছন্দ করতো যে,জয়ের ধারণা হয়েছিল এটা কি না কি! ভাইয়া কতদিন এ্যাকসিডেন্ট করে বাড়িতে ফিরেছে- একটু উহু আহা করেনি,শেষে যদি বাবা মা মোটরসাইকেল চড়া বন্ধ করে দেয়। সেই বাহনটাই এখন জয়ের দখলে,ভাবা যায়! ভাইয়ার যখন নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ডক্টরাল প্রোগ্রামের জন্য অফার লেটার এলো, বাড়িতে তো মহা ধুমধাম পড়ে গেল। ওটা ছিল তাদের জীবনে সব চেয়ে আনন্দের দিন। যেন তেন ভাবে না ভাইয়া স্কলারশিপ নিয়ে যাচ্ছে। স্কলারশিপ আর টিচিং এ্যাসিসটেন্টশিপ মিলিয়ে ওকে বছরে ৩৬ হাজার ডলার দেবে। ভাইয়া তখন দীর্ঘদিনের জন্য বিদেশ চলে যাচ্ছিল, সবাইকে সব কিছু দিয়ে দিচ্ছিল। আর জয় তার কাছ থেকে চেয়ে নিল এই এক্সএল-১২৫ মোটরসাইকেলটা। জয় যখন মোটরসাইকেলটা চাইল তখন ভাইয়া বেশ অবাক হয়েছিল। বলল, তুই এটা নিবি! কি করবি এটা দিয়ে? এমনিতে তো অনেক পুরনো,আমিই কিনেছিলাম সেকেন্ড হ্যান্ড। মানে সেকেন্ড হ্যান্ড বলে বিক্রি করেছিল। থার্ড হ্যান্ড ফোর্থ হ্যান্ড কি না কে জানে! এদেশের কাগজ পত্রকে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কোনো কারণ নাই। তা তুই এটা চাইছিস কেন? আগে তো কখনো চালাতে দেখিনি।
কেন ভাইয়া তুমি কি মনে মনে কাউকে দেবে বলে ঠিক করেছ?
না তেমন কিছু ঠিক করিনি। আর এর যা কন্ডিশান কেউ আমার কাছে জেনে বুঝে চাইবেও না। একমাত্র তুইই চাইলি।
এতে তোমার এতো অবাক হবার কিছু নেই। এতদিন তুমি চালাতে, তাই চালাই নি। আর আমিতো জানি এটা তোমার কতো প্রিয় ছিল।
আমি ভেবেছিলাম আমার একাডেমিক বই এর বাইরের বইগুলো তোকে দিয়ে যাব।
ওগুলো আর দিয়ে যেতে হবে কেন? ওগুলো তো সব আমারই।
নাহ্ আমার অনেক বন্ধু চাচ্ছিল আমি তোর কথা বলে ঠেকাচ্ছি।
শুধু বই না,তোমার রেয়ার সব অডিও-ভিডিও সিডিগুলোও কাউকে দেবে না বলছি!
ঠিক আছে দেব না। তাহলে তো আমার আর কাউকে কিছু দেয়ারও থাকল না।
ভাইয়া কি একটু দুঃখ পেয়েছিল এটা ভেবে? আর তাই তার মোটরসাইকেলটা এমন ব্যবহার করে জয়ের সাথে!
হিমান্তিকা ভাইয়ার খবরটা শুনে বেশ অবাক হয়ে বলেছিল, মোটরসাইকেলে ঘোরাঘুরি করা ছেলেরা সাধারণত এতটা ব্রিলিয়ান্ট হয় না। তোর ভাইয়াতো দেখছি এক্সেপশন!
শুধু ভাইয়া না,মা বলে আমিও নাকি ভাইয়ার মতোই জিনিয়াস। কিন্তু আমি আমার প্রতিভা নাকি সব ফালতু কাজে ব্যয় করে ফেলছি।
হিমান্তিকা ঠোট বাঁকিয়ে বলল, আন্টি ঠিকই বলেন। তবে প্রতিভা অনেকটা জেনেটিক হলেও তুমি ততটা নও চান্দু। মা তো.., তাই বুঝতে পারছেন না।
হিমান্তিকাটা যে কি! মাঝে মাঝে ওর ওপরে এতো রাগ হয়, মেজাজটাই বিগড়ে দেয় মেয়েটা !
সিট্! আজ বিকেলে কত জরুরী একটা কাজ। নাটকের ফাইনাল রিহার্সল শুরু হবে জাষ্ট পাঁচটায়। আর এভাবে মোটরসাইকেলটা বিকল হতে হতে এখানেই সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল।


একের পর এক ফোন বেজে যাচ্ছে যাচ্ছে। ভাগ্য ভালো ফোনটা সাইলেন্স মুডে ছিল। আজকের রিহার্সলের পর আগামীকাল স্টেজ রিহার্সল হবে। ১২টা রিহার্সল না দিয়ে ওদের দল মঞ্চে ওঠে না। এবার সবার সিডিউল নিয়ে টানাটানি তাই সর্ব সাকুল্যে দশটা রিহার্সলেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো ডিরেক্টর ফারুখ ভাইকে। আরো দুইটা রিহার্সল তিনি হয়তো করিয়েও ছাড়তেন কিন্তু শিল্পকলায় হল বুকিং যে ডেইটে পড়েছে তাতে আর সম্ভব না। এই নিয়ে হেভি টেনশান চলছে। আর এখন যদি এভাবে রাস্তায় ফেঁসে যায় জয়,তাহলে নির্ঘাত ঝাড়ি খেতে হবে। নাটকে জয়ের পার্ট ছোট হলেও বেশি রেগে গিয়ে ফারুখ ভাই ওকে যে বাদ দিয়ে দেবেন সেই উপায় নেই,কারণ সেট ডিজাইনিং এবং লাইটিং এর সাথেও সে জড়িত। লাবড়ার মতো সব কিছুর সাথেই জড়িয়ে গড়িয়ে মিশে গেছে সে। তাই চাইলেই বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। বা ফারুখ ভাইয়ের তার প্রতি যে একটা সফট কর্নার আছে সেই সুযোগটাও নিয়ে নেয় সে। তবে আজ মিথ্যে বলতে হবে। যদি বলে মোটরসাইকেল ট্রাবল দিচ্ছিল, তাহলে বলবে ঐ ঘোড়াটাকে নিয়ে বের হস কেন? আজ থেকে তুই আর তোর ঘোড়া দুজনেই এক্সপেলড!
তা বলা যাবে না। বলতে হবে জ্যামে আটকা পড়েছিলাম গুরু। তখনো ঝাড়ি একটা খেতে হবে- বলবে, কি এমন দেশোদ্ধার করে বেড়াও যে একটু আগে বেরুতে পার না। ঢাকা তে তো আজ নতুন আস নাই; জানো না রাস্তার কি হালচাল! কোথাও যেতে হলে মিনিমাম সিডিউল টাইমের দুই ঘন্টা আগে বের হতে হয়।
ঢাকায় এই ট্রাফিক জ্যামের জন্য সবচেয়ে সুবিধা হয়েছে রেডিও স্টেশানগুলোর। ওদের ব্যবসা রাতারাতি হিট হয়ে গেছে। জ্যামে পড়ে থেকে মানুষ রেডিওর আর-জে’দের বকবকানি শুনে যায়।


সেদিন হিমান্তিকার সাথে বের হলে মহাখালির জ্যামে পড়ে হিমান্তিকা তো মহা বিরক্ত! বলল,আচ্ছা বলতো আমাদের দেশের প্ল্যানার কারা?
-মানে?
-মানে পলিটিশিয়ান নাকি প্ল্যানিং কমিশনে কারা কাজ করেন যারা তারা?
-বোথ।
-মানে পলিটিশিয়ানদেরকে তো আমরা সবাই চিনি। আর বাকীরা..
-কেন? খুঁজছিস কেন?
-কেন? তোর মাথায় এই ছোট্ট ব্যাপারটা ঢুকছে না। এই যে, ভর দুপুরে গরমের মধ্যে রাস্তায় ঘন্টাখানিক ধরে বসে আছি তার পর জিজ্ঞেস করছিস,কেন?
-না মানে সঙ্গে তুই আছিস তো তাই টের পাইনি।
-কি টের পাসনি?
-ঐ ঘন্টাখানিক-কে মিনিট খানিকের মতো মনে হচ্ছে।
-ঠাট্টা রাখ। আসল কথা শোন,
-ঠাট্টা না সত্যি।
-কি?
-যা বললাম।
-আরে শোন না- সিরিয়াস কথা।
-এর চেয়েও সিরিয়াস!
-হ্যা। বলতো,সত্যিই কি ওরা ভাবেনা এই যানজট কি ভাবে কন্ট্রোল করা যায়!
-ভাববে না কেন? প্রতিদিন প্রতিনিয়তই তো ভাবছে। কিন্তু কি করবে বল! যে ভাবে বানের জলের মতো প্রতিদিন গ্রাম থেকে মানুষ এই ঢাকা শহরে এসে উঠছে তাতে করে..।
-হ্যা ঠিক আছে,যেখানে কর্ম সংস্থানের সুযোগ আছে সেখানেইতো মানুষ আসবে। কিন্তু এই কর্ম সংস্থানের সুযোগটা কি সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া যায় না? দেশের সব জায়গাতেই তো রাস্তাঘাট আছে। গার্মেন্টস সহ অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠান কি সরিয়ে নেয়া যায় না?
-যায় হয়তো। ঠিক আছে এগুলো বাদ দে,আমার কাছে আরো সহজ সমাধান আছে ঢাকা থেকে লোক কমাবার।
-তা কি পরামর্শ শুনি দেবী!
-ঠাট্টা না শোন,ঢাকা থেকে যদি সব ভালো স্কুলগুলো টিচার সহ বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় জেলায় শিফট করা যায় তাহলে এখানে মানুষ আসা অর্ধেকে নেমে যাবে। দেখ,যারা সরকারি চাকরি করে তাদের মফস্বলে পোষ্টিং হলেও ফ্যামিলি থাকে ঢাকায় কারণ ছেলে মেয়েকে ভালো স্কুলে বা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াবে বলে। এতে হয় কি? একদিকে দুর্নীতি বাড়ে অন্যদিকে ঢাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব বাড়ে। আমি এই কথাটাই ভেবে পাই না,আমাদের দেশের প্ল্যানারদের মাথায় এই বুদ্ধি কেন আসে না।
-এই তো দেখলি তোর মাথায় এলো।
-আমি কি প্ল্যানার নাকিরে গাধা!
সত্যিই গাধা। হিমান্তিকার সামনে গেলে তার গাধার মতো আচরণ আরো বেড়ে যায় কেন কে জানে! তখন মনে হয় যেন হিমান্তিকা পৃথিবীর সব জানে,সে কিছুই জানে না। আচ্ছা,এমন হয় কেন? ও তার বন্ধুই তো। অথচ ওর সামনে এমন বোকা বনে যাওয়া কেন?
একথা শুনে পিন্টু একদিন বলল, হয় তুই ওর প্রেমে পড়েছিস নয়তো তুই চাস না তর্কে হিমান্তিকা তোর সাথে হেরে যাক। তবে প্রথম যুক্তি আর দ্বিতীয় যুক্তি যেটাই সত্য হোক না কেন এর ফলাফল হলো একই..।
কি? তোর উর্বর মাথা কি রেজাল্ট দিচ্ছে ?
ঐ তুই হিমান্তিকার প্রেমে পড়েছিস।
ঝট করে ঠাট্টার ছলে পিন্টুর মাথাটা ক্যান্টিনের টেবিলে চেপে ধরে জয় বলে,কি যা তা বলিস! উই আর জাস্ট গুড ফ্রেন্ড।
পিন্টু মাথা তুলে হাসতে হাসতে বলে,এই রিএ্যাকশানটাও সন্দেহজনক মামা! হা-হা-হা।
তুই যা ভাবিস ভাব,আই ডোন্ট কেয়ার।
প্রেমে পড়লে কে-ই বা কেয়ার করে বল...!
বেইলি রোডে পৌঁছতে পৌছতে সন্ধ্যা ৬টা। যথারীতি অনেক আগেই মহড়া শুরু হয়ে গেছে।ফারুখ ভাইয়ের তীব্র ভ্রুকুটি হজম করে মায়ার পাশে বসে পড়ল সে। দিপা ও সবুজ তখন সংলাপ বলছে। মন দিয়ে শুনছে জয়। যাক বাবা! তার পালা আরো পরে আসার কথা। তবে এভাবেই স্থির হয়ে শুনে যেতে হবে তাকে। ইটস এ টিম ওয়ার্ক। এক নাগাড়ে সবারটা শুনে যাওয়াটা পার্ট অফ রিহার্সল। তর ওপরে আজ ফাইনাল রিহার্সল বলে কথা।
তবে ফারুখ ভাইয়ের আজ মুডটা ভাল। দেরি করে আসার জন্য খুব একটা ঝাড়ি দিলেন না ; বললেন, ঘোড়াটা ফেলতে পারলি না জয়!
রিহার্সল শেষ হতে আজ রাত ১০টা বেজে যাবে। তারপর আছে স্টেজ, লাইট আরো অনেক খুটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা। সন্ধ্যা ৭টার দিকে আধা ঘণ্টার জন্য ব্রেক দেয়া হলো। মায়া, জুই, মারুফ ও জয় একসাথে বাইরে এসে দাঁড়াল কফি খাবে বলে। এমন সময় পেছন থেকে কেউ একজন ডাকল,জয়!
স্বরটা পরিচিত কিন্তু অনেকদিন পরে শুনল বলে মনে হয়। পেছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে রাস্তার উল্টো দিক থেকে ভেসে আসা শব্দটা অনুসরণ করতেই দেখে রাস্তাতার ওপারে বিবিয়ানার নীচে দাঁড়িয়ে আছে অর্ণব!


অর্ণব দা,ভাইয়ার বন্ধু। এরই মধ্যে সামনে থেকে বড় বড় দু চারটা গাড়ি চলে গেল। অর্ণবদাই তো! দেশে কবে ফিরল? এনভারনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট পড়তে জেনেভায় না কোথায় যেন গিয়েছিল?
অর্ণব হাত তুলে আবারও ডাকলো,জয়!
জয়ও হাত তুলল এবং একই সাথে বেত কাঁটার মতো একটার চাকার সাথে আর একটার চাকায় জড়িয়ে যাওয়া রিক্সা গুলোকে লম্ফ ঝম্ফ দিয়ে টপকে রাস্তা পার হতে লাগল সে।
- কি রে কেমন আছিস?
- তুমি! কবে ফিরলা ?
- সে তো অনেকদিন। প্রায় দশ দিন হয়ে গেল। তোদেরকে খুঁজছিলাম মনে মনে কিন্তু কাউকে ধরতে পারছিলাম না। টেলিফোন ডাইরেক্টরিটাও হারিয়ে ফেলেছি। তাছাড়া তোরা সবাই এখন সেল ফোনে কথা বলিস।
- হ্যা বলি,তবে বাড়ির ল্যান্ড ফোনতো বহাল-তবিয়তে আছে এখনো।
- যাই হোক,এখন তো তোকে পেলাম! এতদিন কেমন এতিম এতিম লাগছিল।
- তুমি কি ওখান থেকে একেবারে তল্পি-তল্পা সহ চলে এলে,নাকি আবারও যাবে?
- আপাতত চলে এসেছি। ব্রেইনড্রেন ঘটাতে আবারও যাওয়া লাগবে কিনা পরে ভাবব। আগে এখনকার সিচুয়েশানটা কিছুদিন অবজার্ভ করি! নিজের দেশে কে না থাকতে চায় বল?
এই হলো অর্ণবদা! সে যে ভাল স্টুডেন্ট বা অন্যদের থেকে একটু আলাদা এমন একটা এক্সপোজার তার মধ্যে কাজ করে। তার কথায় আচরণে বা যে কোনো ব্যাপারে লিড দেবার প্রবনতায়। যেগুলো আবার ভাইয়ার ভেতরে নেই। তারপরও জয় অর্ণবের ভীষণ ভক্ত। ভাইয়াটা কেমন লুকিয়ে থাকা টাইপ, ভাল লাগেনা!
- তারপর.., তোর কি খবর বল। এখনো রাজনীতি করিস?
- তেমন সিরিয়াসলি না, তবে ঐ যোগাযোগ আছে একটা।
- যোগাযোগ যে আছে সেটাতো এখানে দেখেই বুঝতে পারছি।
- নাহ্ তুমি যেভাবে ভাবছ সেভাবে নেই,তবে এই থিয়েটারের সাথে আছে আর কি। এটা ছাড়তে পারব না।
- তোর ব্যস্ততা কেমন?
- ঐ বেকারদের যেমন থাকে তেমন।
- তুই এতো ভাল স্টুডেন্ট আর বেকার! এই দুটো মেলানো যায় না।
- ইচ্ছে করেই বেকার বলতে পার। যেমন কাজ করতে চাই ব্যাটে বলে তেমন মিলছে না তাই...।
এবার জয়ের কাঁধে আলতো করে হাত রেখে অর্ণব বলল, তোকে আমার খুব দরকার জয়। ইনফ্যাক্ট তোদের গ্রুপটাকে দরকার। ইউনিভার্সিটিতে থাকতে তো দেখেছি তোরা কতো ডেডিকেটিং ছিলি!
- কি ব্যাপারে বলত?
- চল কফি খেতে খেতে বলি। কথাটা একটু সময় নিয়ে বলতে হবে।
স্প্রিং রোল শেষ করে ক্রিম কফিতে ঠোঁট ডুবিয়ে কিছু একটা ভেবে নিয়ে অর্ণব বলল,আসলে আমি একটা সেমিনার মতো করতে চাই।
- কোথায় ? কি উদ্দেশ্যে?
- আমি টিএসসিতে করতে চাই। রিগার্ডিং এনভায়রনমেন্ট। সে বিষয়ে তোকে পরে বলব। অনেকেই প্রেসক্লাবে করে থাকে তাদের সংগঠন কাজের ধরণ সম্পর্কে জানান দেয়ার জন্য। কিন্তু আমি ওভাবে না,আগে তোদের মতো কিছু তরুণ কে নিয়ে সংগঠনটা তৈরি করব তারপর না হয় একটা প্রেস কনফারেন্স করা যাবে। আমার সেই প্রাথমিক পর্বে আই নিড ইওর হেল্প। এণ্ড নট ওনলি দ্য ইনিশিয়াল স্টেজ,শেষ পর্যন্তই তোকে আমার দরকার।
- কিন্তু আমার কাজটা কি?
- কো-অর্ডিনেশন। এই ধর ক্লাইমেট চেঞ্জের কারণে আমরা বা আমাদের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী যে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে এই সম্পর্কিত কিছু কাজ আর কি। এর প্রতিকার এর উপায়, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ক্ষতিপূরণ আদায়.... ইত্যাদি। তোকে পরে ডিটেইলসে বলব।
জয় প্রায় লাফিয়ে ওঠে,আমি বুঝতে পারছি। আমি রাজি। অর্ণবদা তুমি কোনো চিন্তা করো না। আই উইল ম্যানেজ এভরিথিং।
জয়ের হাতটা ধরে একটা ঝাকি দিয়ে অর্ণব বলল,আমি জানতাম তুই পারবি।
-তার আগে চল আমরা দেশের দক্ষিণ অঞ্চলটা একবার দেখে আসি।
-চল,কবে যাবে বল।
-যাব,খুব শিগগিরই। তার আগে তোকে আমি জানাব।
-যুবায়ের এখন কোথায় আছে? স্টেটসেই?
-হ্যা ওখানেই আছে। তোমার সাথে যোগাযোগ নেই?
-নাহ্! অনেকদিন হলো নেই। ওর ফোন নাম্বারটা দিস তো!
-তোমরা এতো ভাল বন্ধু ছিলে আর আমার কাছে ফোন নাম্বার চাচ্ছ!
-ছিলাম কি বলছিস,এখনো আছি। তবে বুঝিসনা ব্যস্ততা। দেশের বাইরে গিয়ে পড়া একই সাথে অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের চিন্তায় ফুরসত কই?
এরই মধ্যে জয়ের ডাক পড়ল। পকেটের ভেতরে সেলফোনটা গুমরে উঠেছে।
-হ্যালো।
-কিরে কই তুই ? কখন থেকে তোর জন্য অপেক্ষা করছি!
-আসছি, এখনই আসছি।
অর্ণবদা এখন আমাকে যেতে হবে। আমাদের রিহার্সল শুরু হয়ে গেছে।
-ওহ্ শিওর!
-ওহ্ তুমি শো দেখতে এসো কিন্তু। সময়টা আমি তোমাকে মনে করিয়ে দেব, দৌড়ে লাফিয়ে রাস্তা পার হতে হতে বলল জয়।
-শিওর,ডেফিনিটলি। আই উইল কল ইউ ওকে..!
-ঠিক আছে...।

 

 

 

হিমান্তিকার ভেতর থেকে প্রায় বানের জলের মতো কথা বের হয়ে আসছে। এতো কথা জমে ছিল তার ভেতরে অথচ কারো সাথেই শেয়ার করেনি! ইনফ্যাক্ট প্রয়োজন বোধ করেনি বা স্ট্রেনজার এমন কারো সাথে ওর সেভাবে সম্পর্কও গড়ে ওঠেনি যে ওর এসব কথা জানে না। এমন কারো সাথে হয়তো ওর দেখাই হয়নি যাকে ও বলতে পারে...বা এমন সেনসিবল কেউ যে ওকে বলাতে পারে। সে যাই হোক এটলিষ্ট হিমান্তিকা বলতে শুরু করেছে...,

 
- আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়বার সময়ে মার্ক্সিসিস্ট থিওরিতে প্রভাবিত হয়ে একটা বামপন্থী রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়েছিলাম। আমার ক্লাসের বন্ধুরা ছাড়া সেখানেও দু একজন বন্ধু বান্ধব জুটে গিয়েছিল। তাদের কারো কারো সাথে আমার খুব ভাব ছিল। তবে আমি ভীষণ খুঁতখুঁতে ধরনের মেয়ে ছিলাম কাউকে পছন্দ হলেও তাদের ভেতরের খুঁতগুলো দু এক দিনেই আমর কাছে ধরা পড়ে যেত, যা আমাকে কোনো রকম রোম্যাণ্টিক রিলেশানে নিরুতসাহিত করলেও বন্ধুত্ব হতো খুব। কেউ তেমন ঢুলু ঢুলু চোখে তাকাতে চাইলে বা ভাব জমানো কথা বলতে চাইলে আমার গা জ্বলে যেত, আমি তার পাশ দিয়েও যেতাম না। পরে ওরা ও বুঝে যেত। আর অতি স্বাভাবিক আচরনের ভেতরে দীর্ঘশ্বাস চাপা দিত কেউ কেউ। কিন্তু আপা ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সে ভাব জমানো কথাকে খুব একটা পাত্তা না দিলেও রেগে যায় না। শোনে, হাসে এবং হেসে হেসেই একসময় সবাইকে উড়িয়ে দেয়। কেউ শেষ পর্যন্ত তার নাগাল পায় না। আমি সম্পূর্ণ এর বিপরীত বলেই মা-এর যতো চিন্তা! এই বছর খানিক আগেও আমার এক দীর্ঘদিনের বন্ধুর মতো মানে এক্স পার্টি সতীর্থ একদিন লম্বা প্রশস্তি গেয়ে এক প্রেম পত্র পাঠালো মেইলে। মা তো এক সময় তার অতি আগ্রহ দেখে মনে মনে তাকে মেয়ের জামাই হিসেবে কল্পনাও করে ফেলেছিল। এই মেইলে যে আমি আবার খুঁত খুঁজে বের করবো এটা ছিল মায়ের কল্পনার ও বাইরে। তবে আমি ইচ্ছে করে কখনো খুঁত খুঁজতে চাইনি কেন জানি না আমার সাথেই এমন হয় সব সময়, যত অপদার্থ এসে দেখা দেয়। যা বলছিলাম, মেইলের একপর্যায়ে এসে যেখানে এমাঙ্গ বসবে সেখানে লিখেছে বিটুইন। এত বড় ভুল তো মেনে নেয়া যায় না! বানান ভুল করলেও না হয় মানা যেত কিন্তু এত বড় ভুল ! এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। সেদিন এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর ভীষণ রাগ হয়েছিল। কি ভাবে যে এত কম জানা লোককে এম এ পাশের সার্টিফিকেট দেয়া হয় গড নোজ! এটা শুধু এদেশেই সম্ভব, মুখস্থ করে পাশ করে যাওয়া..।
 

ঘড়িটা এবার টিক টিকিয়ে বলে উঠলো তুমি এসব কি গল্প বলছ আপু? আমরা কখন থেকে ইন্টারেস্টিং কিছু, সুখ স্মৃতি কিছু শোনার অপেক্ষায়.. !
- এ গুলো বুঝি ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে না?
- ইন্টারেস্টিং!  তবে তুমি যে বলতে গিয়ে হতাশ হচ্ছো, বিরক্তিতে তোমার মন ভরে উঠছে!
- ঠিক বলেছ অনেকটা। ঠিকইতো!
একটা স্নিগ্ধ আলোর ঝলকানি চোখে মুখে ছড়িয়ে দিয়ে হিমান্তিকা আবার বলতে শুরু করলো,
- তবে শোন, ইউনিভার্সিটিতে দশ-বারো জনের একটা বড় গ্রুপ ছিল আমাদের। আলাদা আলাদা ডিপার্টমেন্ট ও ফ্যাকাল্টি হওয়ার কারণে এমনিতে সব সময় আমাদের খুব একটা যোগাযোগ না ঘটলেও বিশেষ বিশেষ দিনে আমরা একসঙ্গে হতাম। এই যেমন ধরো পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, ভ্যালেন্টাই-ডে, কারো বার্থ ডে, প্রেম ডে বা ব্রেক আপ ডে, ফিলম ফেস্টিভাল ও বই মেলার সময় তো প্রায় প্রতিদিনই। আমাদের গ্রুপে একটা ছেলে ছিল খুব ইন্টারেস্টিং। ওর নাম আশিক। চোখে চশমা পরত এবং সব সময়ই পরে থাকতো। কারণ চশমা খুললে সে কিছুই চোখে দেখত না। চশমা ছাড়া প্রায় কিছুই দেখতো না তাই সবাই আড়ালে বলতো কানা আশিক! কানাকে কানা বলতে নেই সেজন্যেই আড়ালে ডাকা, আর আড়ালটাও এমন, যেন সে শুনতে পায়। এই আশিক যে শুধু চোখে দেখতো না তা নয়; সে অনেক উদ্ভট উদ্ভট কান্ড করত। বা তার ধরণটাই অমন ছিল আমরা ভাবতাম উদ্ভট। সে খাবার টেবিলে খেতে বসে খেতে খেতে গল্প করতে করতে এতটাই মশগুল হয়ে পড়তো যে, ঝুটা কাটা দিব্বি বোন প্লেটে না ফেলে পাশের যে বসে খাচ্ছে তার প্লেটে তুলে দিত। ভুল করেই তুলে দিত অথচ অন্যরা তখন হেসে খুন, আর যার প্লেটে তুলে দেয়া তার খাওয়া বন্ধ। আর সে নিজেও বিব্রত হতো। ফলে কি হতো, ওর পাশে খাবার সময় কেউ সহজে বসতে চাইত না। তবে কখনো কখনো সে এতটা উদাসীন আর কখনো কখনো সে এতটা সতর্ক যে, সামান্য রাস্তাও পাড়ি দিতে পারত না। রোকেয়া হলের সামনের রাস্তা, যেটা হলো ঢাকা শহরের সব চেয়ে নিরাপদ রাস্তা সেটাও সে একা পার হতে পারতো না। কাউকে না কাউকে তার হাত ধরে পার করতে হতো। তবে এই কানা আশিক এর একটা ব্যাপার ছিল। সে তার নামের সদ্বব্যবহার করে মেয়েদের সঙ্গ খুব পছন্দ করতো। অথচ ওর কোনো ধারণাই ছিল না যে মেয়েরা বোকা ছেলেদের পাত্তা দেয় না। তার এই ফানি ক্যারেক্টার এর কারণে কিছু মেয়ে তার বন্ধু ছিল বটে কিন্তু কোনো প্রেমিকা সে জোটাতে পারেনি। অথচ এটাই ছিল যেন ওর একমাত্র ইচ্ছা। কোনো বিশেষ নারীর সান্নিধ্য- আলিঙ্গন..। আগেই বলেছি ফ্যষ্টিভ্যালগুলোতে আমরা বন্ধুরা মিলে খুব ঘোরাঘুরি করতাম। সেবার ফিলম ফেস্টিভ্যালে পাবলিক লাইব্রেরী অডিটোরিয়ামে শর্ট ফিল্ম দেখাচ্ছিল। কানা আশিক খবর নিয়ে এসে বলল চল, সবাই মিলে ফিল্ম দেখে আসি। আমরাও দল বেঁধে প্রস্তুত। ছবিটার নাম ছিল ৭১ এর যীশু। তো দেরি করে যাওয়ায় আমরা টিকেট পেয়েছিলাম সবার শেষে। আর অডিটোরিয়মে ঢুকতে ঢুকতে সিনেমা শুরু হয়ে গিয়েছিল, ওদিকে হল এর লাইট ছিল অফ । এ অবস্থায় কানা আশিকতো কেঁদে ফেলেছিল প্রায় ! আধো আলো , আধো অন্ধকারে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না, সে কি অনুনয় তোমরা কেউ আমার হাত ধরে নিয়ে চল না প্লিজ!
- কোন মেয়ে বুঝি হাত ধরে নিয়ে গেল তাকে?
- আরে না, মেয়ে নয় ছেলেদের মধ্যে থেকে জয় হাত ধরে নিয়েছিল। তবে রাকার মতে সে মনে মনে কোন মেয়েকেই এক্সপেক্ট করেছিল ! তবে ঐ ছেলের হাত কোন মেয়ে ধরবে বল ? যে ছেলে রোকেয়া হলের সামনে থেকে ও রাস্তা পার হতে পারে না। তবে দুঃখের ব্যাপার হলো , সবার শেষে টিকেট কাটায় আমাদের সিট পড়েছিল সামনের সারিতে । সামনের সারিতে বসে মঞ্চ নাটক দেখা যতটা সুখকর সিনেমা দেখা ততটাই কষ্টের। সিনেমা কি দেখেছিলাম জানি না তবে আমরা সবাই চোখ ফুলিয়ে নিয়ে বাড়ী ফিরেছিলাম সেদিন। আর কানা আশিক এর কথা কি বলব! মিনিট দশেক দেখে চোখের ওপর অত্যাচার সইতে না পেরে চোখ বন্ধ করেই পড়ে রইল সারক্ষণ। বেচারার বিশুদ্ধ শিল্প চর্চায় এই ব্যঘাত মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল।

- আবার আমি যখন ছায়ানটে গান শিখতাম তখনও রণিত নামের একটা ছেলের সাথে খুব ভাব হয়েছিল। আমরা প্রোগ্রামগুলোতে অনেকদিন এক সাথে গান করেছি। সব চেয়ে বেশী মজা হতো রিহার্সল এর সময়টাতে। সে কিন্তু আমার প্রেমে পড়েছিল!
- তার পর? তার সাথেও কিছু হল না?
- নাহ! হবে কি ভাবে? ওর যে একটা দোষ প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল আমার কাছে, রণিত এর স্বভাবে কেমন যেন একটা হ্যাংলামো ছিল। যদিও ওর চোখ গুলো ছিল গভীর আর সুন্দর! কিন্তু আমার পছন্দ, এ ম্যান উইথ ষ্ট্রং পারসোনালিটি ।
- তুমিতো দেখছি বড় কাঠ কাঠ টাইপ মেয়ে!
- মেয়েরা কাঠ কাঠই হয় ডিয়ার! আর তাইতো সেন্স অব হিউমার আছে এমন ছেলেদের তারা বেশি পছন্দ করে। তবে এমন একজনের সাথে দেখাও হয়ে গিয়েছিল একদিন। হু ওয়াজ মাই কাইন্ড অফ ম্যান।
- কে সে ?
- অর্ণব!
অনেকদিন ধরে আমি পার্টি অফিস যাচ্ছিলাম না কারণ আমার ভালো লাগতো না। কিছুদিন যেতেই আমি বুঝে গেলাম যে, আমাদের দেশের বামপন্থীরা গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পতিত পুঁজিবাদ ও পচনশীল বস্তুবাদের সেবায় রত তাদের অধিকাংশ। এরই মধ্যে একদিন আমার বন্ধু জয় এসে বলল , তুই তো পার্টির কোনো মিটিং এ আসিস না; পার্টি করা কি ছেড়ে দিলি একেবারে?
- অনেকটা তাই ধরে নে। সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সাথে সাথেই শেষ বুঝলি! এদেশে সমাজতন্ত্রীরা বড় জোর দক্ষ এনজিও সংগঠক হতে পারে আর কিছু না । বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের ওপর পুঁজিবাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কোথায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার এ অর্থে সমাজতন্ত্র আছে বল? চীনে সমাজতন্ত্রীরা শাসন করছে অথচ চীন একটি পুঁজিবাদী রাষ্টের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। সেখানে হত দরিদ্র শ্রেনী আছে আবার বিএমডাব্লিউ চড়ে এমন শ্রেনীর অভাব নেই। ভারতের পশ্চিম বঙ্গে ও কমিউনিষ্ট সরকার, কোথায় সেখানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার বলতে পারিস? শোন জয়! ওসব চেতনা টেতনা বাদ দে কাজের কথা কিছু থাকলে বল।
- তাইতো বলতে এলাম, তুই শুরু করলি লম্বা লেকচার। কাল বিকেলে একবার টি এস সি তে আসতে পারবি? ওয়ার্কশপ আছে একটা - নন পলিটিক্যাল ওয়ার্কশপ ওখানে যে বিষয়ে কথা হবে, আই হোপ তোর ভাল লাগবে।
জয় আমার ছোট বেলার বন্ধু, মাই বেষ্ট ফ্রেন্ড। ও আমার ব্যক্তিত্বকে একটু ভয় ভয় করলেও আমি কোন বিষয়গুলোতে ইন্টারেষ্টেড সেটা সে ভালো করে জানে। আর আমিও তাই আর না করলাম না। বললাম, ওকে আই উইল ট্রাই
- নট ট্রাই ; আসবি কিন্তু!
ওয়ার্কশপে পৌঁছতে একটু দেরী হয়ে গেল, ততক্ষণে একজন পরিবেশ বিদ গ্রিন হাউজ এফেক্ট কি সে বিষয়ে লেকচার দিচ্ছিলেন, পরে এ নিয়ে অনেক ঘাটাঘাটি করেছি তাই এখনো পরিষ্কার মনে আছে। তিনি বলছিলেন, মানুষ তাদের আরাম অয়েশ ও ভোগ বিলাসের জন্য প্রযুক্তির অনেক উন্নয়ন ঘটিয়েছে। সেই উন্নয়নের পথ ধরে এসেছে পলিউশান, কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনো অক্সাইড, মিথেন, ক্লোরো, ফ্লোরো, কার্বন, নাইট্রোজেন অক্সাইড প্রভৃতি যা ব্যাপক নির্গমণ ঘটিয়ে গ্রিন হাউজ গ্যাসের স্তর বাড়িয়ে চলেছে। যার ফলে পৃথিবী হচ্ছে উষ্ণ থেকে উষ্ণতর। যাকে বলা হয় গ্লোবাল ওয়ার্মিং। প্রকৃতির যথেচ্ছ ব্যাবহারের কারণে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেবেই.. .. ..এই সব আরো কত কি! একটু দম নেয় হিমান্তিকা, লম্বা লম্বা শ্বাস নেয় কিছুক্ষণ!
- তারপর কি হলো ? অর্ণব এর সাথে তোমার দেখা হলো কি ভাবে?
- এর আগে জয় এর কাছে দু একবার শুনেছি অর্ণবের কথা। কিন্তু জয় ছিল তার গুনমুগ্ধ তাই স্বভাবতই আমরা ব্যাপারটা তেমন পাত্তা দিতাম না। ভাবতাম কতটা আর হবে ? হয়তো ওর থেকে একটু অন্য রকম! তেমন তো হাজারো আছে! তা বলে গল্প শুনে আমাদের মধ্যে কেউ তাকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম। পরিবেশবিদ এর লেকচার শেষ হলে এলো অর্ণব। আমাদের চেয়ে বছর দুএকের সিনিয়র । শুরুতে নিজের বর্ণনা দিল , আমি অর্ণব ! আজ আপনাদের এখানে এসেছি যে উদ্দেশ্যে তার আগে বলে নেই, আমরা যেহেতু এখানে সবাই সমসাময়িক বয়সের তাই আমাদের সম্বোধনটা তুমিতে হলেই ভালো হয়, এবং তাছাড়া আমাকে আমার নাম ধরে ডাকলে আই ফিল কমফোর্টেবল, নো ভাই টাই!

 
রাকা আমাকে কনুই দিয়ে গুতো দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, দেখ দেখ, যেমন হ্যান্ডসাম তেমন স্মার্ট এন্ড ইন্টেলিজেণ্ট; জয় তো ঠিকই বলেছিল। লিডারশিপ ট্রেইট এর সব ক্রাইটেরিয়াই তার আছে দেখ, ফিজিক্যাল ফ্যাক্টরস এর মধ্যে ফিগার,পারসোনাল এ্যার্ট্টাক্টিভনেস, হাইট। অরগানাইজেশনাল ফ্যাক্টরস এর মধ্যে সেলফ কনফিডেন্স,ডিজায়ার টু লিড, নলেজ, ক্রিয়েটিভিটি এন্ড অরিজিনালিটি,পজিটিভ এফেক্টিভিটি, ফ্লেক্সিবিলিটি, ক্যারিজমা।
- সব কিছু বাদ দিয়ে এগুলো তো ভালই মুখস্থ করে রেখেছিস; তোর কপালে দুঃখ আছে দেখছি রাকা!
- আরে বাদ দে ! দুঃখ কার না আছে তুই বলতে পারবি ওকে তোর ভালো লাগছে না?
- কথা বলিস না শুনতে দে, কিন্তু রাকা থামে না ।
- ধ্যাৎ কেন যে এমন ম্যাড়মেড়ে একটা স্যালোয়ার কামিজ পরে এলাম আজ!
- দুঃখ করিস না উনি তোকে দেখতে এখানে আসেননি। তাছাড়া তুই দুটো ক্রাইটেরিয়া বলতে ভুলে গেছিস অনেষ্টি এণ্ড ইন্টিগ্রিটি সব কিছুর আগে এ দুটো আছে কি না দেখতে হবে না? আর তাকে যতটা  স্মার্ট ভাবছিস তার চেয়ে বেশী ক্লেভার বলেই মনে হচ্ছে এখন পর্যন্ত। বাট ইট ইজ ট্রু , হি হ্যাজ নাইস ভয়েজ উইথ ওয়ে অফ স্পিকিং।


রাকা যত সহজেই কারো প্রেমে পড়ে যেতে পারে আমি তার উল্টো হলেও একথা সত্য, অর্ণব ওয়াজ মাই র্ফাষ্ট ক্র্যাস ।

- সেটা কি করে হলো? এই বললে ক্লেভার আবার বলছো ক্র্যাস! ব্যাপারটা কেমন কন্ট্রাডিক্টরি না?
- মানুষের জীবনটাই তো কন্ট্রাডিক্টরি, তবে সেদিন ওর বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা, ব্যক্তিত্ব ও মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ আবেগ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। রবি ঠাকুরের ভাষায় বলতে হয় তার উপস্থিতি ছিল যেন, আগমন নয়, আবির্ভাব!
সেদিন সবার সাথে এক এক করে পরিচয় শেষে সে আবার বলতে শুরু করেছিলো, বিশ্বের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জলবায়ু। জিওগ্রাফি তে মাষ্টার্স শেষে বিদেশে এনভায়রনমেণ্টাল ম্যানেজমেন্ট-এ কাজ করতে করতেই ভেতর থেকে একটা তাগিদ অনুভব করেছি যে, এখনই যদি সাধারণ মানুষকে জলবায়ুর ভবিষ্যত ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত না করাই তাহলে হয়তো অনেক দেরী হয়ে যাবে। তখন হয়তো এ দেশের উপকূলে বসবাসরত লক্ষ লক্ষ মানুষের শেষ আশ্রয়স্থলটুকু রক্ষাও সম্ভব হবে না। তারই সূত্র ধরে আজ এখানে আসা।
ব্যাপক হারে পরিবেশ দূষণ এর কারণে সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ সব জলবায়ু বোমার। ক্যাটরিনা, সিডর, ইসাবেলা, সুনামি, নার্গিস নামের জলবায়ু বোমা গুলো যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত মানবসৃষ্ট অ্যাটম ফ্যাটম্যান ও লিটল বয়ের সমন্বিত যোগফলের চেয়েও শক্তিশালী।

 
গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর প্রতিক্রিয়ায় আমাদের ওপর ঘনিয়ে আসতে থাকা সর্বনাশের ঘন্টা বাজছে। তিব্বত,ভুটান,ভারত ও নেপাল থেকে নেমে আসা বরফ গলা পানির কারণে প্রতি বছরই সাগরের পানি বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফীত হচ্ছে। আর এর খেসারত দিতে হবে বাংলাদেশ সহ সংলগ্ন অঞ্চলের হত দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে। কারণ বঙ্গপোসাগরের পানি ক্রমে ক্রমে স্ফীত হয়ে গ্রাস করছে সুন্দরবন সংলগ্ন বিস্তীর্ণ গাঙ্গেয় এলাকা এবং এর জনগোষ্ঠীর শেষ ঠাঁই টুকুও। শরণার্থী হয়ে পড়তে পারে এই বিস্তীর্ণ এলাকার জনগোষ্ঠী । লোনা পানি অবাধে প্রবেশ করে নষ্ট করে দিচ্ছে জমির উর্বরতা শক্তি। ভবিষ্যত পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে সহনশীলতার লেশ মাত্র নেই মানুষের। সীমানার প্রান্তে তাদের এই উন্নত জীবন যাপনের কারণে এরই মধ্যে সমুদ্র গর্ভে চিরতরে বিলীন হয়ে গেছে আমাদের দক্ষিণ তালপট্টি। অতলে হারিয়ে গেছে আন্দামান নিকোবর দ্বীপ। ভারতের লোহাগড়া দ্বীপটি কদিন আগেও ঘোড়ামারা থেকে দেখা যেত এখন তা ইতিহাসের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম বাংলাদেশ কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে আছে তবে দক্ষিণ তালপট্টি সেই ধারণা মিথ্যো করে দিল। সত্য হলো বিজ্ঞানী ও বিশ্ববাসীর আশংকা। সাগরের উচ্চতা আর মাত্র এক মিটার বাড়লে বাংলাদেশের তিন কোটি মানুষ জলবায়ু- উদ্বাস্তু হয়ে পড়বে।


এক্ষেত্রে আমাদের মত শিক্ষিত সচেতন মানুষের কি উচিৎ নয় ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও সংগঠিত হয়ে এ সব উপকূলীয় মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসা? তাই সবার আগে আমি এসেছি আপনাদের কাছে, কারণ আপনারা যতটা সহজে উপলব্ধি করবেন তত ভালোবাসা নিয়ে উইদাউট এনি ক্যালকুলেশান অন্যদের এগোতে সময় লাগবে। জানি, আমাদের অনেক ব্যস্ততা আছে তারপরও কি আমরা সপ্তাহে অন্তত একটা দিনের জন্য একটু সময় দিতে পারি না?
- মূলত আমাদের কজটা কি হবে? এ্যাওয়ারনেস সৃষ্টি করা? জানতে চাইল হলুদ টিশার্ট পরা ছেলেটা। এই ছেলেটা তার উশকু খুশকো চুল আর ছেড়া জিন্সএর জন্য প্রথম থেকেই সবার নজর কাড়ছিল, কিন্তু আমি এক্সপেক্ট করছিলাম প্রথম প্রশ্নটা জয় করবে..। কিন্তু গেল কোথায় সে?
- একজ্যাক্টলি! তবে শুরুতে আমাদের কাজ হবে কিছু আন্তর্জাতিক ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য কাজ করা। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার জন্য আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করা উন্নত দেশগুলোর দায়িত্ব। কারণ বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর জনগোষ্ঠীই এই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত অথচ তারা গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমনের জন্য দায়ী নয় এবং সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় অন্যের সৃষ্ট এই বিরূপ প্রভাব মোকাবেলার কোন সামর্থই নেই তাদের। জলবায়ু পরিবর্তনে যাদের কোন ভূমিকাই নেই সেসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের প্রতি ন্যায় বিচারের স্বার্থে উন্নত দেশগুলোরই উচিৎ প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহন করা।
- আমাদের দ্বিতীয় কাজ হলো সমুদ্রউপকূলীয় এলাকাগুলোতে পৌঁছে পানির ক্রমস্ফীতির ফলে ভূমির লবণাক্ততা দূর করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাতে করে মানুষ তার কৃষি জমি ও অশ্রয়স্থলকে কিছুটা নিরাপদ করতে পারে এবং সবরকম প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঠেকাতে উপকূলে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে বনায়ন বাড়াতে সক্ষম হয়। সবুজ বৃক্ষে ঢেকে দিতে হবে পুরো উপকূল।
ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে যদি আমরা রুখে দাঁড়াতে চাই তাহলে আমাদের বৃক্ষ রোপণ অভিযানে জোর দিতে হবে। পুরো উপকূলীয় এলাকাকে বনভূমিতে পরিণত করতে হবে। অপরিকল্পিত ভাবে বাঁধ দিয়ে চিংড়ি চাষের ফলে মাটি যে অতিরিক্ত লবণাক্ততায় তার উর্বরতা হারায় তার প্রতিকারে কিছু নীতিমালা প্রণয়নে সরকারকে ইনসিষ্ট করতে হবে...।

 

অর্ণব বলছিল আর বলেই যাচ্ছিল। ওর কথা বলার ভঙ্গীটা আমার এতো ভাল লেগে গেল! ওর কথার ভেতর থেকে যেন ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিমত্তা একই সাথে ঝরে পড়ছিল।
ওয়ার্কশপ শেষে হলের বাইরে দাঁড়িয়ে জয় কে বলছিলাম, সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ তার নিজ প্রয়োজন মেটাতে সব রকম প্রতিবন্ধকতাকেই তো মোকাবেলা করেছে তেমনি করে উপকূলীয় মানুষেরাও তাদের ভূমি ও সম্পদ রক্ষার্থে সমুদ্রপুকুলে এ্যাডাপ করে নিতে সক্ষম হবে সেক্ষেত্রে আমাদের সেখানে যাবার যৌক্তিকতা কোথায়?
হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলল, হ্যা ইউ আর রাইট!  বাট যেটা এখনই করা যায় সেটা পাঁচ বছর পরে করতে গেলে তো ক্ষতি বই লাভ হবে না। চমকে ফিরে তাকাতেই দেখি অর্ণব । কখন আমদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে! কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও মুখে স্বভাব সুলভ হাসি ধরে রাখলাম। সেও একই ভঙ্গীতে হাসি ধরে রেখেই বলতে থাকে; তাই ভুক্তভোগীদের অবগত ও সাহায্য সহযোগিতা করানোই আমাদের সংগঠনের লক্ষ্য। হাউ টু সেভ দেয়ার ল্যান্ড এ্যান্ড দ্যা ইকোলজি । কি ভাবে এই আসন্ন বিপর্যয় থেকে তারা নিজেদেরকে রক্ষা করবে।
অন্যদের কথা জানি না ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা ছিল, তার ওপরে এমন একটা সুযোগ একেবারে হাতের নাগালে চলে আসায় আমি তৎক্ষনাৎ অর্ণবের সেভ দ্যা ইকোলজি নামক সংগঠনে নাম লিখিয়ে ফেলি।
যাবার সময় সরাসরি ওর চোখে চোখ রেখে বলি , আসি..।
- দেখা হবে নিশ্চই আবার!
- আই হোপ সো! বলার সময় আমার গলাটা কি একটু কেঁপে গিয়েছিল? সেটা কি সে বুঝতে পেরেছে? অর্ণব কি তাহলে টের পেয়ে গেছে যে বাইরের এই ব্যক্তিত্বময়ী মেয়েটি তাকে ভালবাসতে শুরু করেছে? অনুভূতির হয়তো তরঙ্গ আছে। অর্ণব আমার গোপন ভালোবাসা যেন বুঝতে পারল। অনুভব করলো শরীরে বা মনে। হাত বাড়িয়ে দিল হ্যন্ডশেকের উদ্দেশ্যে। আমি হাত রাখলাম সেই হাতে। জীবনে যেন সেই প্রথম কিছু ছুঁয়ে যাওয়ার অনুভূতি। আর কোন স্পর্শের সাথে এর তুলনাই হয় না।
ভেতরে ভেতরে এক ধরণের চাপা উত্তেজনা তখন, এই সুবাদে কতবার অরণ্যের কাছাকাছি পৌঁছানো যাবে। আমাদের সাথে আরো দু চারজনও নাম লিখিয়ে ফেলেছিল।
 



ঘুমের মধ্যে একটা স্বপ্ন দেখছিল জয়। বড় একটা জাহাজে করে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে সে। সমুদ্রের বিশাল নীল জলরাশি ফুলে ফুলে উঠছে আর সেই সাথে ভীষণ দুলছে জাহাজটা। একই সাথে জাহাজের ক্যাপ্টেন তীব্র ভাবে ভেপু বাজাচ্ছেন। সেই ভেঁপুর শব্দেই ঘুম ভেঙ্গে গেল জয়ের। ভেপু না বাজছে তার মোবাইলফোন তবে অপরিচিত স্বরে। জয়ের অর্ধচেতন মন বলছে , ঘুমাও জয় ইটস নট ইওর কল। কার না কার ফোন বাজছে.. ওদিকে কান দিও না। আর একই সাথে ব্রেইনের অন্য দিকটা বলছে ওঠো জয়, ভুলে গেছ? আজ ২৪ মার্চ কাল রাতে যে মোবাইলে এ্যলার্ম দিয়ে রেখেছিলে। জয় ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে। চকিতে ঘড়ি দেখে নেয় ৭টা বাজে। ৮টায় বাস। কাল রাতে সে আর অর্ণব গিয়ে টিকেট কেটে এনেছে। আপাত গন্তব্য খুলনা তারপর ওখান থেকে বাস চেঞ্জ করে মিঠেখালি। হাতে আর মাত্র একঘন্টা সময় এর মধ্যে রেডি হয়ে বাসস্টপে পৌছতে হবে। জয় প্রায় ছুটে ওয়াশ রুমে ঢোকে দাঁত ব্রাশ করতে করতে গালে হাত বুলায়। শিট্ শেভটাও করতে হবে। অন্য সময় হলে সে শেভ টেভ এর ধার ধারত না। কিন্তু সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা জায়গায় যাচ্ছে তাও খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজে সো..। দ্রুত হাতে শেভ করে নেয় জয় এবং বের হয়ে নিমেষে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র একটা জিন্স, একটা পাজামা ও একটা টি শার্ট ওর ল্যাপটপের ব্যাগটাতে ভরে ফেলে জয়। এরপর এক লাফে ডাইনিং রুমে গিয়ে ফ্রিজটা খুলে উকি মারে ঠিক এমন সময় চায়ের মগ হাতে পেছনে এসে দাঁড়ায় বাবা। আজ তুমি এতো সকাসে ঘুম থেকে উঠেছ কি ব্যাপার? কোথাও যাচ্ছ নাকি?
জয় ভেবেছিল চা-টা তার জন্য, এতক্ষণে ভুল ভাঙল।
হ্যা বাবা, মা তোমাকে বলেনি?
বলেছিল হয়তো, সেটা যে আজই সেটাতো আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু আজ যে খুব জরুরী একটা কাজ পড়ে গেছে তোমার।
জয় মনে মনে বলল, আমি জানতাম বাবা! যে আজই একটা কাজ এসে পড়বে এবং সেটা খুবই জরুরী। বেকার হবার সুবিধা বা অসুবিধা হলো এটাই, যে কোনো সময় যে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব তার ওপরে এসে পড়বে। আর সেটা খুবই জরুরী কাজ যেহেতু সেটা বেকারের ওপর বর্তায়।
একলাফে ডাইনিং টেবিলের কোনায় চলে যায় জয়। যে কাজই পড়ুক বাবা আজ আমি কিছুতেই করতে পারব না, সরি। অর্ণবদার সঙ্গে আমার প্রোগ্রাম সেট হয়ে গেছে। গাড়ীর টিকেট কাটা হয়ে গেছে আর আধা ঘণ্টার মধ্যেই গাড়ীটা ছেড়ে যাবে । এন্ড নাউ আই এ্যাম লিভিং।
বাবা কঠিন একটা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু বললেন না শেষ পর্যন্ত সামলালেন নিজেকে। কারণ তার এই বেকার উড়নচণ্ডী ছেলেটাকে তিনি একটু বেশিই ভালোবাসেন। তিনি জীবনে যা করতে চেয়েছেন কিন্তু প্রয়োজন ও সংসার নামক যন্ত্রের কবলে পড়ে করে উঠতে পারেননি, সেই সব ছেলেমানুষি অথচ করনীয় কাজ গুলোই যেন জয় তার হয়ে করছে। কিন্তু জয় তুমি কথাটা শুনবে তো আগে। এই যে তুমি রাজ্য উদ্ধার করতে ছুটে বেড়াও, আমি কি কখনো তোমার কোনো কাজে বাধা দেই?
কি কথা বল বাবা! বলার ভঙ্গিতে প্রায় অনুনয়ে ভেঙ্গে পড়ে জয়, যার মানে হলো এখনকার মতো আমাকে যেতে দাও প্লিজ!
জয় আমি বুঝতে পারছি তোমার বিষয়টা ভীষণ ইমপর্ট্যান্ট কিন্তু আমি তোমাকে এখন যে কথাটা বলব সেটাও লেস ইমপর্ট্যান্ট নয়। শোন গতকাল যুব ফোন করেছিল।
ভাইয়া ? কি বলেছে?
ওর কিছু জরুরী পেপারস পাঠাতে বলেছিল কিছুদিন আগে। আমি কাগজপত্র সব রেডি করে রেখেছিলাম কিন্তু পাঠানো কোনো মাধ্যম পাচ্ছিলাম না। এখন কাল রাতে ও ফোন করে বলল, ওর এক পরিচিত লোক আমেরিকা যাচ্ছে, আজই দুপুর বারোটায় তার ফ্লাইট। আর ভদ্রলোক থাকেন সাভারে..। বুঝতেই পারছো , কোমরের এই অবস্থা নিয়ে অতদূরে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।
মুখে বিরক্তির শব্দ তোলে জয়। ভাইয়া টা যে কি! দু একদিন আগে বলতে পারল না? দাও কোথায়? এড্রেসটা বল..।
বাবার ঠোটে প্রচ্ছন্ন প্রশান্তির হাসি। বললেন ওর অ্যাড্রেসটা হলো....।
মোটরসাইকেল নিয়ে বেরতে বেরতে অর্ণবকে ফোন করল জয়। অর্ণবদা নিশ্চিত তাকে দায়িত্বজ্ঞানহীন ভেবে বসবে। কিন্তু জয় হেল্প লেস। এখন কিছু করার নেই তার।
জয় কই তুই ? আমিতো বাসস্ট্যান্ডে এসে গেছি আর দশ মিনিটের মধ্যেই বাস ছেড়ে দেবে। এদিকে তোর পাত্তা নেই।
অর্ণবদা তোমাকে ঠিক কি ভাবে বলব বুঝতে পারছি না। আই এ্যাম সরি ফর দ্য ইনকনভিনিয়েন্স। আমি একটা খুব জরুরী কাজে আটকে পড়েছি। তাই এখন এই মুহূর্তে তোমার সাথে যেতে পারছি না। তবে তুমি চিন্তা করো না, আজই আমি তোমার ওখানে পৌছবো।
জয়ের বলার ভঙ্গিতে অর্ণব ওর না আসতে পারার গুরুত্বটা বুঝতে পারল তাই বলল, ইটস ওকে জয়! কিন্তু তুই আজই আসবি কিভাবে?
কেন মোটরসাইকেল নিয়ে! ওসব নিয়ে তুমি ভেব না। দুঃখটা এই দুজনে একসাথে যেতে পারলাম না।
কিন্তু তুই জায়গাটা চিনবি কি করে?
তোমাকে ফোন করে নেব।
অর্ণব মনে মনে বলল, ফ্রিকোয়েন্সি থাকলে হয়!

চার লেন প্রশস্ত মহাসড়ক। খুলনা-মঙলা মহাসড়ক ধরে ৮০ মাইল স্পিডে ছুটছে তার মোটরসাইকেল। রাস্তার দুপাশ থেকে ছুটে আসছে বড় বড় বাস ট্রাক তার পরও জয়ের তেমন একটা ভ্রুক্ষেপ নেই। সে যেন অনেকদিন পর স্বাধীনতা পেয়েছে নিজের ইচ্ছা মতোন হাত পা ছড়িয়ে মোটরসাইকেল চালানোর। ঢাকার রাস্তায় চার গজের মধ্যে বন্দি চালক নয়। আহা স্বাধীনতার কি দারুণ সুখ! এই রাস্তা ধরেই ৩৮ কিলোমিটার গিয়ে বাম দিকে যে বাই লেনটা চলে গেছে সেই দিকে ঢুকবে সে। অর্ণবদা এমনই ইন্ডিকেশান দিয়েছেন। প্রতিটি মাইল ফলকে গিয়ে জয় স্পিড কমিয়ে দেখে নিচ্ছে। দেখতে দেখতেই চলে এলো সেই নির্দিষ্ট পথ। রাস্তার বাঁ দিকে ঢুকতেই সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। রাস্তার দু পাশে সারি সারি কৃষ্ণচূড়ার গাছ ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। শেষ বিকেলের আলোয় অপরাজিতা নীল আকাশের গায়ে আগুন ধরানো এক অপার্থিব সৌন্দর্য ছড়িয়ে বসে আছে চরাচর। জয়ের চোখ যেন জুড়িয়ে গেল। সে কিছুতেই ঐ ফুলরাশির ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারছিল না। দুপাশে ধান ক্ষেত। সেখানে সবুজ লম্বা লম্বা ঘাস। একে বোধ হয় বলে শন। পথের দুপাশের প্রশত জায়গাটুকু দুর্বাঘাসে ছাওয়া। সেখাবে দড়িতে বাঁধা গরু। কোনো কোনো গরু ঘাস খাওয়া ছেড়ে দড়ি সমেত রাস্তার ওপরে গিয়ে দাড়িয়ে আছে। তাদের আড়াআড়ি দড়ি বিপদজনক অবস্থা সৃষ্টি করেছে। সন্ধ্যা নেমে এসেছে । দূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে মাগরিবের আজান। রাস্তাটা শুনশান নীরব। লোকজন তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। কাকে জিজ্ঞেস করবে জয়, ইউনিয়ন কাউন্সিলটা কোথায়? এতো না ভেবে অর্ণবদাকে আবার ফোন করে নেয়াই বেটার! রিং হচ্ছে .. ওপাশ থেকে হ্যালো বলার আগেই হঠাৎ কিছু একটার সঙ্গে মোটরসাইকেলের চাকা জড়িয়ে মোটরসাইকেল রাস্তায় শুয়ে আর জয় গিয়ে গড়িয়ে পড়ল খাদে। উচু রাস্তার ওপর থেকে প্রায় দশ ফুট নিচে পানি কাদায় গড়িয়ে পড়ল সে । কতটা গড়াল বুঝে ওঠার আগেই তার পা গিয়ে ঠেকল ধান ক্ষেতের মধ্যে পাশা পাশি জোড়া মঠের কংক্রিটে। কোনো বিত্তবান হিন্দুর মৃত্যুর পর তার পরিবারের সদস্যরা হয়তো এই ব্যয়বহুল জোড়া মঠ তাদের স্মৃতি উদ্দেশ্যে তৈরি করেছিলেন। মঠের প্রায় এক তৃতীয়াংশ এখন পানির নীচে ডুবে আছে বকী টুকু এখনো শরীরসহ চূড়া উচু করে দাঁড়িয়ে তার অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। পথে আসতে আসতে জয় এমন আরো কয়েকটা মঠ দেখেছে। জয় ঐ প্রায় অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে ওপরে উঠার চেষ্টা করতে লাগল। এমন সময় দেখল একটা হাত তার দিকে বাড়িয়ে ধরেছে কেউ এবং ওকে স্পষ্টতই চমকে দিয়ে একটা নারী কণ্ঠ বলে উঠল, হাতটা ধরেন নইলে উঠতি পারবেন না। জয়ও যতটা সম্ভব শরীরটা ওপরের দিকে তুলে ধরে তার হাতটা সেদিকে বাড়িয়ে দিল। তার শরীরের বেশ কয়েক জায়গায় ছিড়ে থেতলে গেছে। ওপরে উঠতেই মেয়েটি বলল, আপনার কোথাও কেটে ছিঁড়ে যায়নি তো?
একটা বিশ একুশ বছর বয়সী মেয়ে আর তার সাথে দশ বারো বছর বয়সী একটা ছেলে।
জয় গলার স্বরে যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা ছড়িয়ে দিয়ে বলল, ধন্যবাদ! না, তেমন কিছু হয়নি।
আপনি তো পুরো ভিজে গেছেন, ছেলেটি বলল।
আপনি কে? কোত্থেকে এসেছেন? যাচ্ছেনই বা কোথায়?
একেবারেই দার্শনিক প্রশ্ন। যার উত্তর সৃষ্টির শুরু থেকে এখনো মানুষ খুঁজছে। জয়ের হাসি পেয়ে গেল কথাটা ভেবে। কিন্তু এখন কিছুতেই হেসে ফেলা ঠিক হবে না। সে যথা সম্ভব স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বলল, ঢাকা থেকে আসছি, আর যাবো এখানকার ইউনিয়ন-কাউন্সিলে। আপনি যদি আমাকে পথটা বলে দেন তাহলে বেশ উপকৃত হই। এমন শুদ্ধ ব্যাকরণের ভাষায় শেষ শব্দগুলো উচ্চারণ করে জয়ের নিজেকে বেশ বোকা বোকা লাগছিল। এ্যাকসিডেন্ট করে সে কি তাহলে বোকা হয়ে গেল? স্ক্রু দু একটা খুলে পড়ে গেল না তো! এরপর জয় খুব স্মার্টলি উঠে দাড়াতে যায় কিন্তু উহ্ শব্দ করেই বসে পড়ে সে। তার হাটুর কাছটা একেবারে থেতলে গেছে দাঁড়াতে পারছে না।
আহা, আপনার পা টা তো একেবারে কেটে গেছে। ছিঁড়ে হা হয়ে যাওয়া জিনসের ভেতর থেকে জলজল করছে তার কেটে থেতলে রক্ত বের হয়ে যাওয়া হাটু। হাতের কনুই এরও একই অবস্থা।
যদি আপনি কিছু মনে না করেন তবে এই পাশেই আমাদের বাড়ি সেখানে যেতে পারেন। পাশে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে দেখিয়ে বলল, অপু আপনাকে পরে ইউনিয়ন-কাউন্সিলে পৌঁছে দিয়ে আসবেনে।
জয় যা ভেবেছিল ঠিক তাই, তার মোটরসাইকেলটা একটা বেঁধে রাখা গরুর দড়ির সাথে ধাক্কা লেগেই উল্টে গেছে।
পেছনে জয় খুড়িয়ে চলছে এবং মেয়েটা ও ছেলেটা মিলে তার মোটরসাইকেলটা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে আগে আগে।
মেয়েটার নাম মম। তার বাবা মা দুজনেই মারা গেছেন। বাড়ীতে সে থাকে তার ভাই ভাবীর সাথে। ছেলেটি হলো তার ভাইএর ছেলে অপু। মম ও অপু তখন প্রাইভেট পড়ে ফিরছিল। তাদের দুজনের হাতেই বই খাতা।
মমর ভাই তখন বাড়ীতে ছিল না। ওদের পুরোনো দোতলা বাড়ির সামনের খোলা বারান্দায় একটা চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসেছে জয়। মম তার ভাবীকে ডাকতে ভেতরে চলে গেল।
এমন একটা বিশ্রী কান্ড ঘটিয়ে ফেলার জন্য জয় মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মম ও তার ভাবী স্যাভলন তুলা সহ এসে হাজির হলো। জয় যারপরনাই সংকুচিত বোধ করতে লাগল এই দুই অসম বয়সী নারীর সামনে।
মম যতটা স্বচ্ছন্দ তার আচরণে তার ভাবী সম্পূর্ণ তার বিপরীত হলেও অপরিচিত এই আহত যুবকের প্রতি তিনিও সহানুভূতি প্রকাশে কার্পণ্য করলেন না।
মম যেন এক অদ্ভুত মেয়ে! সম্পূর্ণ অচেনা এক যুবকের সাথে একজন তরুণীর এমন নিঃসংকোচ আচরণ! জয় যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। নাকি পরিস্থিতি তাকে এমন স্বাভাবিক করে দিয়েছে। এখানে কোনো তরুণ-তরুণী নয় একজন আহত মানুষই হয়তো প্রধান হয়ে উঠেছে।
এদের দুজনের শুশ্রূষার মাঝেই মমর ভাই এসে হাজির হলেন। তাকে হয়তো খবর দিয়ে আনা হয়েছে। গেট থেকে বাড়ীর ভেতরে ঢুকতে ঢুকতেই তিনি হাঁক দিলেন,
কি, কি হইছে? কে অ্যাকসিডেন্ট করিছে?
সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষের জন্য মানুষের এমন আন্তরিকতা জয় এর আগে কখনো দেখেনি। জয় ভদ্রলোককে দেখেই বুঝতে পারল যে ইনি মম মেয়েটার ভাই। তাদের দু ভাই-বোনের চেহারায় অদ্ভুত মিল। দুজনেরই বড় বড় টানা টানা মায়াময় চোখ, যা মুহূর্তে হরিণের চোখের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই চোখে রাজ্যের মমতা।
মমর ভাইয়ের নাম মজনু। তিনি বেশ পরিচিত ভঙ্গিতে বলতে লাগলেন, এই রাস্তায় প্রায়ই অ্যাকসিডেন্ট হয় বুঝলেন ভাই! কেন যে গরুগুলোকে এভাবে রাস্তার পাশে বেঁধে রাখে? আহা...! আপনার হাঁটু দেখি অনেকখানি কেটে গেছে। যেন তার বাড়ীর সামনের রাস্তায় অ্যাকসিডেন্টের জন্য তিনিও খানিকটা দায়ী এমন এমন ভঙ্গিতে তিনি কথা বলতে লাগলেন। আসলে হয়েছে কি মাঠে ঘাটে যে গরু বাঁধবে সেই উপায় তো নেই । সব জায়গায় পানি উইঠে গেছে তাই অগত্যা রাস্তার পাশের ঐ উচু জায়গাটাতেই বাঁধে সবাই। কদিন পর হয়তো আর পালতিই পারবে না গরু। মোষ পুষতি হবে মোষ! আহ্হা! দেখেন তো কি ভোগান্তি হলো আপনার। তা ভাই আপনাকে মনে হয় এই অঞ্চলে এই প্রথম দেখলাম।
তা আপনি কোথায় আসিছেন, না-কি যাচ্ছিলেন?
জয় সংক্ষেপে তার এখানে আসবার কারণ খুলে বলল। এবং তার সেল ফোনটা ভিজে যাবার জন্য সে যে তার সঙ্গি অর্ণবের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না সেটাও বলল।
ওহ্ আপনি ঐ ভদ্রলোকের সাথে আসিছেন? আমরা তো এইমাত্র তার সাথেই কথা বলে আসলাম। দাঁড়ান আমি এক্ষুনি ওনাকে খোঁজ করে আনার ব্যবস্থা করতিছি।
অবশেষে সেদিন সন্ধ্যায় মমদের বাড়ীতে এমন নাটকীয় ভাবেই জয়ের সাথে অর্ণবের দেখা হলো।
মমর বাবা বেঁচে থাকতে এই এলাকায় বেশ প্রভাবাশালী ছিলেন। এখন তিনি বেঁচে নেই তার পুরনো জৌলুস, অর্থ বিত্ত প্রায় কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই তারপরও তার ছেলে মজনু এলাকায় এখনো বেশ প্রভাবশালী। যদিও প্রভাব খাটানোর জন্য সে বাড়তি কোনো ক্ষমতা বা এফোর্ট কোনোটাই প্রয়োগ করে না। তারপরও শুধুমাত্র তার সরলতা ও ভালমানুষী দিয়ে একধরণের সম্মোহনের মতো এখনো প্রভাবকে টিকিয়ে রেখেছে। বাবার রেখে যাওয়া একশ বিঘা জমির বেশিরভাগই এখন শন জঙ্গলের দখলে। লোনা পানির কারণে না হয় ধান চাষ না মাছ। একসময় ধানের চাষ পর্যপ্ত না হলেও মাছ চাষ হতো, আর তাতে যে হারির টাকা পাওয়া যেত (লিজ বাবদ নেয়া টাকা) তা-ই কে খায়। তাছাড়া তাদের ছিল দুশো বিঘা জমির ওপর মাছের ঘের। এতো জমি তো আর কারো এক দাগে একার থাকে না, অন্যদের জমিও একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হারির টাকার বিনিময়ে জমির মালিকেরা মাছ চাষের জন্য লিজ দেয় তাদের জমি। আর সেখানেই হয় মাছের চাষ। টাকার ঝমঝমানিতে লেখাপড়াটাও একটা সম্মান জনক পর্যায়ে নিয়ে শেষ করেনি মজনু। কলেজে গিয়েছিল কিন্তু বিএ পাশটা আর করেনি। দুবার পরীক্ষা দিয়েছিল। কিন্তু হয়ে উঠল না। বিকেল হলেই বাজারে এমন এক উৎসবের আমেজ বসে যেত। দিনকে দিন তখন কাঁচা টাকার হাতছানিতে বাজারের চেহারাটাই বদলে যেতে লাগল। টিন আর খড়ের চালের দোকানগুলো রাতারাতি সব দালান সয়ে যেতে লাগল। সব দোকানে সাজানো গোছানো শহুরে কায়দায়। হ্যানো জিনিস নেই যা পাওয়া যেত না। এছাড়া মোংলায় জাহাজ থেকে নামতো সব বিদেশী মাল। সেখানে কাঁচের বাসন পত্র, অলিভ অয়েল বিদেশি সাবান, শ্যাম্পু, লেপ, কম্বল, ইলেক্ট্রনিক্স গুডস থেকে শুরু করে পর্নোগ্রাফি পর্যন্ত কি ছিল না। তখন বিদ্যুৎ না থাকলেও জেনারেটরের আলোয় ঝলমল করতো দোকানগুনো। ব্যস্ততাও ছিল সব দোকানে। পূর্ণিমা ও আমাবস্যার সময়টাকে বলে ‘গোন’। ‘গোনের সময়।’ এ সময়ে ঘের থেকে মাছ ধরা ও মাছ চালানের ব্যস্ততা বাড়ত। চারদিকে রমরমা অবস্থা। সারা অঞ্চলে ঈদ ঈদ ভাব জমে উঠত। কেউ ব্যস্ত গলদা নিয়ে কেউ বাগদা কেউ হরিণা। এই  'গোন' এলে চিংড়ির সাথে কাঁকড়ার ব্যবসাও জমত। কাঁকড়ার ব্যবসা করে কত মানুষ লাখপতি হয়ে গেল। ছাদে ডিশ অ্যান্টেনা শোভা পেত ঘরে ঘর। সবার হাতে পয়সা, কেনাকাটার ধুম। গাড়ি মোটরসাইকেল কেনার ধুম। পানিতে অতিরিক্ত লোনা এসে ধান তো ফুরল। কিন্তু জলাবদ্ধতায় এক সময় মাছ ও যে ভাইরাস ধরে ধরে সঙ্গীন অবস্থায় পড়বে কে ভেবেছিল আগে। এখনো অল্প পরিসরে মাছ চাষ হয় গোন আসে কিন্তু সেই জৌলুস সেই উৎসব উৎসব ভাবটা আর নেই। প্রায় সবার অবস্থা পড়ে গেছে। একসময় তাদের বাড়ির বৈঠকখানায় রাত ১২টা পর্যন্ত মানুষ বসে থাকতো। চাকর বাকরে আত্মীয় স্বজনে ভেতর বাড়ি সরগরম। গভীর রাত পর্যন্ত খাওয়া দাওয়া, রান্নঘরে গমগমে ভাব চলতো প্রায় প্রতিদিনই। এসব বাবা বেঁচে থাকবার সময়। ভদ্রলোকের ভাগ্য ভালো এই মন্বন্তর দেখে যেতে হয়নি..। এখন এসব কিছুই নেই, তারপরও মজনুর সেই ভালমানুষি প্রভাবটা টিকে আছে।

 
জয়রা যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে এই বিষয়টা মজনুকেও বিশেষ প্রভাবিত করেছে এবং তাদের কাজের প্রতি সে ইতোমধ্যেই একাত্মতা ঘোষণা করে বসে আছে। আর সেই কারণেই এই দুই তরুণকে সে মনে মনে সুহৃদ ভাবতে শুরু করেছে।
অর্ণব রাতের বেলা থাকার জন্য এখান থেকে দশ কিলোমিটার দূরে হোটেলে বুকিং দিয়ে রেখেছে। তাই জয়কে নিয়ে এবার সেখানে যাবার কথা বলতেই মজনু প্রায় হা হা করে উঠল।
না সেটা কিছুতেই সম্ভব না। আপনারা এখন আমাদের অতিথি; ডাল ভাত যা কিছু হোক রাতের বেলা না খেয়ে আপনাদের যেতে দেব না।
জয়দের ওজর আপত্তি খুব একটা কাজে লাগল না এক্ষেত্রে। মজনু সাহেব স্ত্রীর উদ্দেশ্যে  'কই গো’.. বলে ভেতরে চলে গেলেন।
খেতে বসে জয় খেয়াল করল এদের ফুড হ্যাবিটটা অদ্ভুত। আতপ চালের ভাত। সঙ্গে করলা দিয়ে মৌরলা মাছের ঝোল। ঝাল ঝাল মুরগীর মাংশ এবং টমেটো, বেগুণ, কুচো চিংড়ি ও আলু দিয়ে রান্না করা টকের তরকারী যাকে এরা বলে খাটা। প্রতিটি আইটেমই ঝাল তারপরও কি চমৎকার স্বাদ!

 

হোটেল সেই মোংলা বন্দরে। হোটেল পশুর ইন্টারন্যাশনাল। হোটেলটা এর আগেও দেখেছে জয়। বিশাল কম্পাউন্ডের ভেতরে দাপটের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে নদীর দিকে মুখ করা ঘরগুলো। ওটা মূলত বিদেশি নাবিক ও পর্যটকদের জন্য করা।  অর্ণবদা ঠাট বাটের অভ্যাসটা আর ছাড়তে পারল না। কিছু বললে বলে, ফ্যামিলি ট্রাডিশান, একদিনে বদলানো যায় না ।

তাই বলে জনসেবা করতে এসে ইন্টারন্যাশনাল মানের হোটেল!

বদলাবে, ডোন্ট ওরি, তবে নিড টাইম ডিয়ার!

সেই টাইম যে কবে আসবে কে জানে! অগত্যা সেদিকেই যাত্রা করল দুজনে। বন্দরে ঢুকতে ইপিজেড এর কাছে এসে দুজনেই মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। জয়ের ভেতর থেকে আপছেই শব্দটা বের হয়ে আসে ওয়াও!

হাইওয়ের বিশাল চার লেনের রাস্তার দুইধারে প্রাচীন শিরীষ গাছগুলো দুই পাশ দিয়ে এসে তার বিশাল ডাল পাতা দিয়ে ঢেকে দিয়েছে গোটা রাস্তাটা। এমন ছায়ায় ঘেরা এতো বিশাল একটা রাস্তা সত্যিই বিরল। কী অদ্ভুত! না অর্ণবদা?

অর্ণব এতোটাই মুগ্ধ যে তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দই বের হচ্ছিল না। ওপরে ছায়াঘেরা শিরীষ বন আর নীচে রাস্তার দুপাশে অড়হড়ের গাছ সব মিলিয়ে অসাধারণ দৃশ্য! গাছগুলো কত দীর্ঘকাল ধরে রাস্তার দুপাশে ধারে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে যখন মহীরুহে পরিণত হয়েছে ঠিক তখনই এপারের গাছ ছুঁয়ে দিতে পেরেছে রাস্তার ওপারের গাছকে। গাছ হবার এই এক সুবিধা। দুটো রেললাইন সারা জীবন পাশাপাশি অবস্থান করলেও একে অপরকে ছুঁয়ে দিতে পারেনা কিন্তু গাছগুলো তা পেরেছে। ত্রিশ বছর লাগুক, চল্লিশ বছর লাগুক, দীর্ঘ সময় তবুওতো পেরেছে একে অপরকে ছুঁয়ে যেতে। এক মায়াময় পরিবেশ সৃষ্টি করতে।

জয়ের হঠাৎ মনে হলো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপে এসে পড়েছে তারা। দুজনের কারোরই ব্যাপারটা চোখ এড়ায় না। এত বড় হাইওয়ে সেই তুলনায় গাড়ীর চাপ কম। আগে প্রচুর গাড়ি যাওয়া আসা করত এই রাস্তা ধরে সেই তুলনায় এখন কম। তার কারণ মোংলা বন্দরে এখন আর বিদেশী জাহাজ নোঙর করে না। পশুর নদী ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে গেছে চর পড়ে। ড্রেজিং নেই, নদীর স্বাভাবিকতা রক্ষায় কোনো তৎপরতা নেই। ছোটবেলায় অর্ণব যে প্রমত্তা পশুর দেখেছিল ; যার গর্জে উঠে ছুটে আসা বড় বড় ঢেউ মানুষের মনে ভয় ধরিয়ে দিত, সেই ঢেউয়ের ভেতরেই ছোট ছোট সাম্পানগুলো নদীর এপার থেকে ওপারে পৌছে দিত যাত্রী। উত্তাল ঢেউয়ে কখনো প্রায় শুন্যে ভেসে উঠত যাত্রী বোঝাই সাম্পান আবার কখনোবা প্রায় তলিয়ে যেতে যেতে ভেসে থাকত। অর্ণবের বাবা বলতেন , সাম্পানের গঠন প্রণালী এমন যে প্রচন্ড ঢেউয়ে এটা ডোবে না। তাই এই নৌকা এসব নদীতে সুবিধাজনক। সেই প্রমত্তা নদী এখন প্রায় খালে পরিণত হয়েছে। বন্দর এলাকা তখন সরগরম ছিল। এখন আর সেরকম নেই। নিতান্তই একটা সাদামাটা উপজেলা শহর যেন। শুধুমাত্র নদীর এপারটায় ইপিজেড এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সিমেন্ট ফ্যাক্টরীগুলো আর নদীতে টহলরত নেভীর জাহাজ মনে করিয়ে দেয় এটাও একটা বন্দর।

হাইওয়ের পাশঘেঁষে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামগুলো যার প্রতিটির বাজার জুড়ে অসংখ্য মাছের ডিপো এগুলো সরগরম থাকে গোণের সময়ে। গোণ মানে আমাবশ্যা আর পূর্ণিমা, এই সময়ে চিংড়িগুলো উঠে আসে জালে। তখন বাগদা চিংড়ি, কাকড়া, হরিণা চিংড়ি ও সাদা মাছের ক্রেতা বিক্রেতা ফড়িয়াদের কথাবার্তা, হাঁক-ডাক। ডিপোগুলোতে তখন কাজের ভীষণ চাপ। ঘাড় গুঁজে কাজ করে দলে দলে নারী শ্রমিক। চিংড়ির মাথা খুলে ধুয়ে ফ্যাক্টরিতে পৌছানোর পূর্ব মুহূর্তের কাজ। এখনো গোণ চলছে কিন্তু বাজারের দোকানগুলো ঘিরে সেই ভীড় ভাট্টা বা সরগরম নেই। রাস্তায় সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে নেই মাছ বহনের ট্রাক। মিষ্টির দোকানগুলোতে মাছি ভন ভন করছে। চা এর কাপে ধোঁয়া তুলে এখানে আর জমিয়ে আড্ডা চলছে না । রাজ্যের চাপাবাজিতে আসর মাতিয়ে তুলছেনা হঠাৎ উঠে আসা কোনো নব্য বড়লোক ঘের মালিক। বিষন্ন মুখে মানুষগুলো সারছে তাদের দৈনন্দিন কাজ। শুধু এখন হাওয়ায় ভাসছেনা কাঁচা টাকার ঘ্রাণ। যেন জীবন বয়ে নিয়ে যেতে হয় তাই যাওয়া।

পশুরের খেয়াঘাটে এসে পৌঁছলে ওদের ছেকে ধরে কিছু ট্যুরিষ্ট গাইড। নিতান্তই গ্রাম্য অতি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মতো চেহারা তাদের। পোষাক আশাকে বা কথা বার্তায় কোনো ভাবেই তাদেরকে গাইড হিসেবে চালানো যায় না। বরং ট্রলারের দালাল বললেই ভালো মানায়। কোনো রকমে যাত্রী ঠিকঠাক করে ট্রলারে তুলে দিয়ে কিছু কমিশন হাতানোই যেন তাদের মূখ্য উদ্দেশ্য। এদেরই একজন জয়েপাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল , সুন্দরব যাবেন ছার, সুন্দরবন?

ওদের এ যাত্রা সুন্দরবন যাবার ইচ্ছে না থাকলেও জয় বেশ উৎসাহের সাথে যেন কিছুই জানে না এমন ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে, সুন্দরবন! সেখানে কি আছে?

বাঘ, হরিণ, বানর... গোলপাতা, গড়ান, গজারি, সুন্দরী..., হঠাৎ লোকটা গলার স্বরটা অস্বাভাবিক নিচুতে নিয়ে গিয়ে চর্বিহীন ভাঙ্গা গালে ঘমোটা গোফের ফাঁক থেকে নিষিদ্ধ অঞ্চলের সন্ধান দেয়ার ভঙ্গিতে বলে, পথে যেতে বানিশান্তা

বানিশান্তা! সেটা আবার কি?

ওহ্ চেনেন না? লোকটার উৎসাহ যেন আরো বেড়ে যায়। সে গলার স্বরটা ঐ মাত্রায় রেখেই দ্রুত বলে যায়, নটি বাড়ি ছার, এই এলাকার সবচেয়ে বড় নটিবাড়ি। হাজার হাজার নটির বাস সেখানে। আসলে আমিও চিনতাম না। একদিন ট্রলারে সুন্দরবন যাতি যাতি দেখলাম নদীর পাড়ে এক দঙ্গল মেয়ে স্নানে নামিছে। সেই সিনান সাধারণ মাইয়ে মানুষের সিনান না। গতরে কোনো আব্রু শরম না রাইখেই জলকেলি। রঙ বেরঙের পোষাক আশাক তাদের। সিনেমার দুই নম্বর নায়িকাগের মতো বেঢপ বড় বুক নিয়ে আব্রু ছাড়াই ধ্যান ধ্যান কইরে ঘুইরে বেড়ায়। আমিতো দেইখে একটু অবাক হলাম! পরে  ট্রলারের মাঝি বলল আর কি। তার পর থে তো ঐ পথ দিয়ে নিত্য আসা-যাওয়া।

জয় এবার লোকটাকে ভাল করে নিরীক্ষণ করতে লাগল। কি দেখাতে চায় সে  সুন্দরবন, না কি বানিশান্তা?

জয় ওভাবে চলতে চলতেই লোকটার কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, না ভাই এযাত্রা আর বানিশান্তা দেখার ইচ্ছে নেই।

লোকটা নাছোড়বান্দা সে সঙ্গে সঙ্গে বলে, তাহলে সুন্দরবন ছার!

এবার অর্ণব আর জয় দুজনেই চোখ চাওয়া চাওয়ি করে হেসে ফেলে।

আর লোকটার চোখের সামনে জ্বলতে থাকা ধান্ধার শেষ প্রদীপটাও নিভিয়ে দিয়ে জয়কে বলতেই হয়, সুন্দরবন কয়েকবারই যাওয়া হয়েছে ভাই, এবার আর না, অন্য কোনো সময়..।

যেতে যেতে রাস্তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল একটা বিলবোর্ডের দিকে তাকিয়ে অর্ণব হঠাৎ বলল, একটা জিনিস খেয়াল করেছিস জয়? আগে কিন্তু এরকম ছিল না।

কি, এই যে বিলবোর্ড?

বিলবোর্ড ঠিক না, এগুলো আমাদের ছোট বেলায়ও ছিল। হাইওয়ের পাশ ঘেঁষে স্টেশানগুলোতে। বেশির ভাগই থাকতো ৫৫৫ সিগারেট আর গোপাল বিড়ির এ্যাড। দুর্গা পূজার মন্ডপের অশুরের মতো দেখতে একজন লোক বিড়ি হাতে হাসি মুখে পোজ দিচ্ছে। ''প্রতি টানই সুখ টান'' বা ''গোপাল বিড়ি কেন খাই টানে টানে তৃপ্তি পাই''  এই জাতীয় কিছু লেখা থাকতো। সত্যি বলতে কি, ওই এ্যাড দেখে সদ্য কৈশোরে মনে হয়েছিল একটান দিয়ে দেখলে হয়। এবং বলাই বাহুল্য টান দিয়েও দেখা হয়েছিল। কিন্তু অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর ছিল না। তামাকের কড়া ধোয়া নাকে মুখে যেতেই তীব্র কাশির দমকে দম বন্ধ হবার জোগাড়। তার ওপরে উৎকট গন্ধ। সেই গন্ধ তাড়াতে অনেক কসরত করতে হয়েছিল। সেই তুলনায় ৫৫৫ বেশ এ্যলিগ্যান্ট। হাহাহা।

সেই বিলবোর্ড এখনো আছে তবে সংখ্যায় বেড়েছে ছাড়াও পণ্যের ধরণ চেঞ্জ হয়েছে।

হ্যা এটাই আমি বলতে চাচ্ছিলাম। টোব্যকো থেকে এখন মোবাইল ফোন কম্পানির এ্যাড, ডিটারজেণ্ট থেকে বিউটি সোপ ইত্যাদি।

দেখে মনে হয় মানুষের জীবন যাত্রার মান অনেক বেড়েছে বা সৌন্দর্য সচেতনতা বেড়েছে বা আধুনিক টেকনোলজির সান্নিধ্যে পৌঁছেছে

অথচ জয় মানুষের জীবন যাত্রার মান আদৌ কি বেড়েছে? ন্তত এই অঞ্চলে! ভাব দশ পনের বছর আগে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা আর এখন!

হ্যা বদলেছে। তবে বদলটা যদি পজিটিভ হয় তাহলে বলার কিছু থাকে না। আর বদলে যাওয়াটা যদি এমন হয় তাহলে সেটাকে কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।

তোর কি মনে হয় না, এই বদলে যাওয়ার পেছনে মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতাও দায়ী। শুধুমাত্র প্রকৃতির ওপরে দোষ চাপিয়ে দিলেই তো হবে না।

হ্যা একই সাথে দায়ী সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাও। এই যে দেখো, প্রতিটি দেয়াল কেমন পণ্যের বিজ্ঞাপনে ছাওয়া। কিসের এ্যাড নেই বলো, মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে প্লাস্টিকের গৃহ সামগ্রী পর্যন্ত। অথচ আগে এই সব দেয়াল ভরে থাকতো রাজনৈতিক স্লোগানে। সেই সব স্লোগানে থাকতো মানুষের জীবন পদ্ধতি নির্ধারণের সব দাবী।

ওগুলো শুধু সমাজতান্ত্রিক দলগুলোর চিকায় লেখা থাকতো। জাতীয়তাবাদের ধারায় বিশ্বাসী বর্তমান পুঁজিবাদী দলগুলো কিন্তু কখনোই ও ধরণের স্লোগানে দেয়াল ভরিয়ে তোলেনি। ওদের বেশিরভাগ স্লোগানেই নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা বা অমুক নেতার মুক্তি চাই জাতীয়।

তবুও মানুষের জীবন ধারণের মধ্যে এক ধরণের নির্মলতা তো ছিল। অ্যাট লিস্ট বহুজাতিক কম্পানির পণ্য নির্ভর সমাজ ব্যবস্থা ছিল না।

আর একথা ঠিক যে মানুষকে এই রাজনীতি বিমুখ করেছে কিন্তু রাজনীতিবিদেরাই। তাদের ত্রুটিপূর্ণ সব কর্মকান্ড। বিশাল নির্বাচনী ব্যয়ে জিতে আসা। আর তারপর সেই টাকা রিকভার করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়া। জনগণের কথা ভাববার সময় কোথায়!

তবে দেয়াল লিখন বাতিলের নির্দেশটা বোধহয় নির্বাচন কমিশন থেকে এসেছে।

ওদের স্বার্থটা কি? এর পেছনে কি এইসব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কোনো পরোক্ষ প্রভাব আছে?

থাকতে পারে, আবার নাও থাকতে পারে। সে যাক! দেয়াল যাদের আছে তারা এই চান্সে দু পয়সা কামিয়ে নিচ্ছে। একদিকে দেয়াল রিপেয়ারের কাজ হয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে টাকাও পাচ্ছে। হা হা হা।

তুই হাসছিস জয়!

এক্ষেত্রে হাসি দিয়ে দুঃখ চাপা দেয়া ছাড়া আর কি করার আছে? সেদিন ব্রিটিশ কাউন্সিলের করা এক জরিপে দেখলাম এসেছে এদেশের ৬৪% তরুণই এখন আর রাজনীতি সচেতন নয়। এতে তাদের কোনো ইন্ট্রেস্ট নেই।

হুম্ কথাটা যদি ঠিক হয় তাহলে কিন্তু সেটা এক ধরণের অশনি শংকেত।

হ্যা এটাকে কিন্তু একটা দেশের জন্য খুব পজিটিভ সাইড বলা যায় না। একটা দেশের সুষ্ঠু ভবিষ্যত- হোয়াই নট বর্তমান? বর্তমানও ডিপেন্ড করে সেই দেশের প্রতিটি মানুষের রাজনীতি সচেতনতার ওপরে। এটাকে কোনো ভাবেই ইগ্‌নোর করার উপায় নাই।

তবে সচেতনতা যে একদম নেই তা কিন্তু না। এই যে দেখলি না, আজ ইউনিয়ন কাউন্সিলে ডাকা সভায় আমরা যখন উপকূলের সমস্যা নিয়ে কথা বলছিলাম তখন মমো মেয়েটা কেমন বলে উঠল, ‘পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে সবুজ বেষ্টনী গড়বেন আপনারা। কোমর সমান পানিতে গাছ বেঁচে থাকবে?’ ওর প্রশ্নটা কেমন প্রহসন বল?

এটা এক অর্থে সচেতনতা, অন্য অন্য অর্থ করলে কিন্তু ঠেকে শেখাও বলা যায়। দেখো এই জলাবদ্ধতা দারিদ্রের করাল গ্রাস হয়ে ওদের ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সত্যিই ধীরে ধীরে দারিদ্রের দিকে এগিয়ে যাওয়াটা যে কী ভীষণ কষ্টের!

তবে তুই একটা চিজ্।

কি রকম?

এখানে এসে এ্যাকসিডেন্টটা ঘটিয়ে তুই কাজটা ভালই করেছিস।

এ্যাকসিডেন্টটা আমি ইচ্ছে করে ঘটাইনি।

তা ঘটাসনি তবে কাজটা ভালো হয়েছে। ওদের সাথে আমাদের একটা রিলেশনশিপ গ্রো করেছে। একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত জায়গায় এমন একটা বনডিং দরকার ছিল।

তোমার কি মনে হয় না যে, আমি এ্যাকসিডেন্ট না করলেও মজনু সাহেবকে আমরা পেতাম। কারণ ইউনিয়ন কাউন্সিলে ডাকা আমাদের মিটিংয়ে তিনি গেলেও আমাদের সাথে এভাবেই কো-অপারেশন করতেন বলে আমার ধারণা।

না সে কথাটাও আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না একেবারে। তবে এই যে এদের পুরো পরিবারটার সাথে একটা সম্পর্ক তৈরি হলো এটা কিন্তু হুট করে হওয়া সম্ভব ছিল না। আমাদের কাজে নারী পুরুষ সবার ইনভলভেন্স থাকলে সুবিধা হয় বুঝলি না! হ্যা বুঝলাম।

তাছাড়া দেখলাম মমো মেয়েটার ভালই ইন্ট্রেস্ট আছে।

মমো মেয়েটা একটু অদ্ভুত ধরণের। হিমান্তিকার সাথে যখন ওর পরিচয় হবে, হিমান্তিকার নিশ্চই ভালো লাগবে ওকে। আবার কি জানি নাও লাগতে পারে। এটা খুব বিস্ময়কর যে হিমান্তিকার কোনো মেয়ে বন্ধু নেই। মেয়েদের সাথে নাকি ওর সহজে ভাব হতে চায় না। কোনো মেয়েই নাকি ওকে বুঝতে পারে না। শুধুমাত্র ওর বোন মৃত্তিকা আপু ছাড়া। এও কি সম্ভব! নাকি  মৃত্তিকা আপুকে ও এতোটাই ভালোবাসে যে অন্য কাউকে স্পেস দিতে চায় না। হতে পারে আবার নাও পারে। তবে মেয়েদের সম্পর্কে হিমান্তিকার প্রধান যে অবজেকশান সেটা হলো- ওদের মেয়েলি আচরণ। মেয়েলি কথাবার্তা । আচ্ছা, এটা কেমন কথা? মেয়েরা মেয়েদের মতো আচরণ করবে না তো কি করবে ছেলেদের মতো! হিমান্তিকার সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি। জয় মনে মনে স্পষ্টতই বিরক্তি দেখায় হিমান্তিকার ওপরে।

আচ্ছা মমো মেয়েটা কি তাকে কোনোভাবে প্রভাবিত করেছে? ওরা যখন ওয়ার্কশপে বলছিল সবুজ বেষ্টনীর কথা- তখন মমোই প্রথম প্রশ্ন করেছিল। ফিরোজা নীল শাড়ীতে কী অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল ওই শ্যামলা রঙেরর মেয়েটাকে। দীর্ঘ টানা চোখে কোনো কাজলের ছোঁয়া নেই। সম্পূর্ণ নিরাভরণ। ঈষৎ কোকড়ানো চুল পেছনে পনিটেল করে বাঁধা আর চোখে মুখে এক অদ্ভুত দীপ্তি নিয়ে সে যখন বলছিল, শুধু সবুজ বেষ্টনী গড়লেই হবে? সে তো দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এর ভেতরে কতো ঝড়, কতো জলোচ্ছ্বাস, কতো সিডর, কতো ইলা আঘাত হানবে। এতোদিন কি আমরা এই উপকূলের মানুষরা বেঁচে থাকতে পারব? এই মুহূর্তে এই লবণাক্ততা এই জলাবদ্ধতা থেকে আমাদের রক্ষা করার জন্য কি কোনো পরিকল্পনা নেই আপনাদের? ’

জয়ের ভেতরটা যেন আমূল কাঁপিয়ে দিয়ে গেল এই জিজ্ঞাসা। সত্যিই তো! ওরা এখন কি করবে? কি খাবে? ঘনিয়ে আসা নিকট অন্ধকার ভবিষ্যতে। পানি আর পানিতে টং বেঁধে আছ চারিদিক। ধান হয় না। মাছে ভাইরাস।

সবুর নামের একজন মৎসচাষী যখন বর্ণনা করছিল তার ঘের থেকে উঠে সা ভাইরাস অক্রান্ত চিংড়ি নামের কংকাল। তার সেই হাহাকার কাঁপিয়ে দিচ্ছিল আকাশ বাতাস।

মানুষের দিনের পর দিন বিত্তের নেশায় অন্ধ হয়ে ওঠা। স্বার্থপরতা, এককেন্দ্রিকতা, কাঁচা টাকার ঝংকার এই সবই ছোট ছোট ঘেরে বন্দী করেছে তাদের। অবরুদ্ধ হয়েছে পানির স্বাভাবিক চলাচল।  আর ধীরে ধীরে প্রকৃতি এক সময় শোধ নিয়েছে। প্রকৃতির প্রতিশোধ বড় নির্মম। সত্যিইতো মমর কথাইতো ঠিক। কাল যারা খাবে কি তার নিশ্চয়তা নেই তাদেরকে কথা শুনিয়ে কি হবে?

তাই জয় বলল, অর্ণবদা আমাদের কাজের স্ট্রাটেজি চেঞ্জ করতে হবে।

হ্যা তুই ঠিক বলেছিস, আমিও তাই ভাবছিলাম। ফার্স্ট অফ অল এদের এই জলাবদ্ধতা থেকে বের করে আনতে হবে। এই নিয়ে একজন এক্সপার্টের সাথে আমার কথাও হয়েছে। ওনারা আসবেন এখানে। মাছে ভাইরাস ধরার মূল কারণ ওরা কি বলছেন জানিস?

কি?

এই যে সবাই আলাদা আলাদা করে ছোট ছোট করে ঘিরে নিয়েছে তাদের জমি। আর সেখানে দীর্ঘদিন ধরে পানি স্থির হয়ে আছে। সেই বদ্ধ পানিতে ঢেলেছে বস্তা বস্তা লবণ। তার ওপরে আইলার পানি। সব মিলিয়ে জগাখিচুড়ি অবস্থা

এখন এই সব বদ্ধ জমি উন্মুক্ত করে দিতে হবে। শ্যাওলা ধরা স্থির পানিতে দিতে হবে চাষ। জোয়ার-ভাটার পানি আসা যাওয়ার জন্য খালের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে হবে। আর সবার ওপরে যেটা করতে হবে সেটা হলো সমবায় ভিত্তিতে চিংড়ি চাষ। চাষ হবে এক সঙ্গে। যার যার জমির রেশিও অনুযায়ী সে ভাগ পাবে।

সেই দেখলে তো রিটার্ন টু ইডেন।

এক সময়ে সবাইকে ফিরতে হয়। সব তত্ত্বেরই তো একটা পজিটিভ দিক থাকে। তাকে সব ক্ষেত্রে কি অস্বীকার করা যায়? সোস্যালিজমকে যেমন অস্বীকার করা যায় না, তেমনি পুঁজিবাদও কি অতটা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা যায়? যায় না। কিছুটা সুফল হলেওতো ভোগ করছিস- কি বল?

ব্যাপারে জয়ের কিছু মতভেদ থাকলেও এই মুহূর্তে বলতে ইচ্ছে করছে না চারদিকের সবুজ আর বিস্তীর্ণ জলাভূমি তার ভেতরে এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে এসেছে। এখানে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করা যায় না। কিছুতেই না।

পানিতে পা ছোঁয়ানোর সাথে সাথে মমোর গোটা শরীরে একটা শিহরণ বয়ে গেল। প্রতিদিন গোসল করতে এসে সে কিছুক্ষণ পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকে। আর পুকুরের ঠিক মাঝখানে যেখানে টুনি সমেত একটা শুকনো বাঁশ পুতে রাখা আছে -যেন কেউ রাতের বেলা এসে মাছ ধরে নিয়ে যেতে না পারে সেখানে রোজ দুপুরে এই সময়ে এসে বসে একটা মাছরাঙা পাখি। গাঢ় নীল, লাল আর হালকা হলুদে মেশানো এই অসম্ভব সুন্দর পাখিটা একদৃষ্টে চেয়ে থাকে পানির দিকে। কখন একটা মাছ ভেসে যাবে ওখান থেকে আর ঝপ করে সে তুলে নেবে তার দুপুরের খাবার। মমো প্রতিদিন এই দৃশ্যটা দেখার জন্য সন্তর্পণে ঘাটে এসে পা ডুবিয়ে বসে থাকে।
আজ ওসব কিছুই তার চোখে পড়ছে না। পাখিটা আছে কি নেই। সে যেন এক ঘোরের মধ্যে রয়েছে কদিন ধরে। মাঝে মাঝে সে যেন সত্যিই অনুভব করতে পারছে যে পৃথিবীটা ঘুরছে। সে যেন দেখতে পাচ্ছে এই বলয়ের ধীরে ধীরে ঘুরে যাওয়ার দৃশ্য। তবে কি সে সত্যিই প্রেমে পড়েছে জয়ের কথা বলার ভঙ্গি, জয়ের ছটফটানি, ওর সিল্কি চুল চোখের ওপর এসে পড়া, সব কিছু প্রতি মুহূর্তে চলন্ত ছবির মতো মমোর চোখে ভেসে ওঠে। এর নামই কি ভালোবাসা সে যেন এই প্রথম অনুভব করতে পারছে তার অস্তিত্ব তার নারীত্ব। ধীরে ধীরে তার হাত উঠে আসে বুকে, যেখানে চাঁদের পেয়ালা উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে কতদিন ধরে, কিন্তু সে অনুভব করেনি । এই প্রথম যেন সেই চাঁদ জেগে উঠলো। জ্যোৎস্না ছড়াল বনে বনে।

দুর্লভ মনির মতো স্তন
ঘন হলো বাসনার তাপে।
 

চেনা কবিতার পঙক্তিমালা। অথচ অবিশ্বাস্য মনে হতো। দুহাতে আঁজলা ভর্তি পানি তুলে সে গড়িয়ে দেয় সেই চাঁদে। আর ঠিক তখনই - পাখিটা ঝটিতে ডানা ঝাপটে দুপুরের নীরবতা ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়ে তারস্বরে চিৎকার করে উড়ে যায় দূরে, হয়তো ওর নীড়ে। তাহলে কি লজ্জা পেল সে! আজ তাকে ভাসিয়ে দিয়ে জলে, চাঁদের জল এখন গড়িয়ে নামে আরো গভীরে, গহীন থেকে গহীনে।
মমো হাত বাড়িয়ে সাবানটা তুলে নেয়। হাটু অবধি পানিতে নেমে কালচে খয়েরি রঙের কস্কো সাবানটা ধুন্ধলের খোসায় লাগাতে গিয়ে গেল ভেঙ্গে চার টুকরো হয়ে। এক টুকরো গড়িয়ে পড়ে পানিতে নিমেষে তলিয়ে গেল। বাকী টুকরোগুলো কোনোমতে শিং মাছের মতো খোসায় চেপে ধরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মম। সাবানটাও শেষ হয়ে গেল! একদিন ফুরাবে জানত মমো । শেষ হতে হতে কেমন পাতলা কাচের মতো হয়ে এসেছিল এপাশ থেকে তাকালে রঙীন কাঁচের আড়ালে যেমন ওপাশটা দেখা যায়, তেমনি গাছপালা কালো কালো দেখা যেত। ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত সাবানটা শুধু এই চাপটার অপেক্ষায় ছিল। এখন কি হবে! মমোর বুকের ভেতরটা ছলাত করে ওঠে। এর আগে শ্যাম্পুর বোতলটা ফুরিয়ে গেলে তেতুলের ক্কাথ দিয়ে চুল ধোয়া চলছে। বয়ামের পুরনো তেতুলও ফুরিয়ে এসেছে। আর তেতুল গাছটাতো লবন পানি উঠে সেই যে মরতে বসল প্রথমে ধীরে ধীরে সব পাতাগুলো হলুদ হয়ে হয়ে এলো এর পর আস্তে আস্তে তামা রঙ ধারণ করে এখনো তার অস্তিত্বের ঘোষণা করছে। একজন গাছ কাটা লোক জোগাড় করতে পারলে ওটাকে কেটে ঐ কংকাল হয়ে ঝুলে থাকার হাত থেকে নিস্তার দেয়া যেত। আচ্ছা, শ্যাম্পু ফুরালে না হয় তেতুলের ক্কাথ চলে, সাবান ফুরালে কি দিয়ে চলবে মশুর ডাল! সে তো অনেক দাম মানুষ খেতেই পায় না। তাহলে রিঠা। কিন্তু সে গাছটাও তো সেবার সিডর এসে উপড়ে দিয়ে গেল। আমলকি গাছের মাথাটাও ডালপালা সমেত কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গেল। নারকেল সুপারি গাছগুলো গোড়ায় পানি জমে কেমন ঝিমোচ্ছে। এ বছর একটাও নারকেল হয়নি। ধীরে ধীরে সব ফুরিয়ে আসছে..। এক সময় চাল ফুরাবে..।

অথচ একসময় কত সুখে ছিল তাদের। আব্বার ছিল একটা মাছের ঘের। সেই ঘেরে বৈশাখ মাস থেকে ভাদ্রমাস পর্যন্ত আমাবশ্যার গোনে বাগদা চিংড়ি জালে উঠে আসত ঝাঁকে ঝাঁকে। মণকে মণ মাছ আর হাজার হাজার টাকা। ঐ ক-মাসে তাদের বাড়িতে যেন উৎসব লেগে থাকতো। এক একদিন ঝুড়ি ভরা সাদামাছ আসত বাড়িতে। সাদা মাছ মানে যে মাছ চিংড়ি মাছ তা না- পার্শে, পাতাড়ি, টেংরা, ছোট চিংড়ি ভাটা মাছ আরো কত কি। দুই তিনজন মহিলা মিলে কুটাতো আর তাজা তাজা পার্শে মাছ ভাজা আহ্ কি স্বাদ! এখনো যেন জিভে লেগে আছে। ভাবতেই মমোর জিভে জল এসে যায় । মাছ না জিভে আসা জল গিলে ফেলে দু হাতে পুকুরে পাতলা সরের মতো পড়ে থাকা হালকা সবুজ শ্যাওলা সরিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মমো । পানিতে পড়ে একটু শান্তি পায় সে। সব দুশ্চিন্তাগুলো এ সময়ে একে একে কেটে যেতে থাকে লাটাই থেকে ঘুড়ি কেটে যাবার মতো। কিন্তু ঐ মিনিট দশেকের জন্যই, ওপরে উঠলেই গাছের ডালে ঝোপে জঙ্গলে পড়ে থাকা কাটা ঘুড়ির মতো ছিপকে থাকা দুশ্চিন্তাগুলো আবারও জেগে উঠতে থাকে।

সারা গায়ে ডোক খেয়ে ট্যামের মতো ফুলে ফুলে ওঠা সিলভারের কলসিটা এক হাতে অন্য হাতে কাপড় ও বালতি নিয়ে এদিকে আসছে বড় বুবু। বুবুর বিয়ে হয়েছে এই একটা বাড়ি পরেই পাশের বাড়ির শামীম ভাই এর সাথে। প্রেমের বিয়ে। এক সময় সুখেই ছিল তবে এখনতো সবারই ছন্নছাড়া অবস্থা। পানি নিতে বুবুর এখন এই পুকুরে আসা ছাড়া উপায় নেই ওদের বাড়ির পুকুরটা তো আইলার পানিতে একাকার হয়ে গেছে। ও পানি আর ব্যবহার করার উপায় নেই। বেশিরভাগ মানুষেরই পানির সঙ্কট। গ্রামের বেশিরভাগ মেয়েরাই এখন ওদের পুকুর থেকে পানি নিয়ে যায়।
কিরে মমো তোরে বলিছি না পুকুরে ঝাপাঝাপি একটু কম করবি।
এই, এসেই জ্ঞান দিতে শুরু করলি! তার চেয়ে জ্ঞানটা অন্য দিকে খাটা তো বুবু।
কোথায় খাটাব?
বলতো সাবান না থাকলে তার বিকল্প হিসেবে কি ব্যবহার করা যায়?
মলি হয়তো কিছু ভাবছিল অন্যমনষ্ক ভাবে বলল জানি না।
তুই জানিস। একদিন বলেছিলি, বল আবার।
আরে সেগুলো কি এখন আর চাইলেও পাবি নাকি! গাছগুলো যেভাবে বিলীন হচ্ছে..। ভালো এঁটেল মাটিও তো এখন পাওয়া যায় না। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। কেন হঠাৎ সাবানের কথা জানতে চাইছিস কেন, তোর সাবানটা কি ফুরিয়ে গেছে?
হ্যা।
ভাবিস না কালকে আমি একটা কিনে দেব, শত হলেও বিয়ের কনে।
বিয়ের কনে না ছাই! আমার হবু বর তো লাপাত্তা ।
লাপাত্তা নারে ফিরবে, এখন ফিরলেও তো এখন কোনো লাভ নেই। চারদিকে তো শুধু পানি আর পানি। শহরে একটু থিতু হতে পারলেই ও ফিরবে। তোরে কোনো চিঠি পত্র দেয় না?
আরে আমার সাথে সে রকম কোন সম্পর্ক নাকি যে চিঠি দেবে! আর আমি ওসব বিয়ে টিয়ে করব না।
তাহলে কি করবি শুনি! আমাদের অবস্থাতো দিন দিন দেখতিছিস, যা-ই ফুরোচ্ছে তা আর ফিরে আসার উপায় নেই। এমনকি সাবান ফুরোলেও চিন্তায় পড়ে যেতে হয়; সেখানে তুই এ কথা বলিস কি করে!
আমার অতো ভাবনা নেই। কিছু একটা করবানি। বি এ টা পাশ করিছি কি জন্যি আর তাছাড়া এই বিয়েটা হবে না দেখো বুবু।
কেন তুই কি করে বুঝলি?
আমি অনেক কিছু বুঝতে পারি যেটা তোমরা পার না।
মলির বুকের ভেতর থেকে একটা লোহার বল গড়িয়ে যায়। তাহলে কি মম সব কিছু জেনে গেছে নাকি ও বুঝতে পেরেছে সত্যি সত্যি। ওর কল্পনা শক্তি কতটা ক্ষণিকের জন্য বুঝবার চেষ্টা করে মলি।
হ্যা, মমোর সাথে যে ছেলেটার বিয়ে ঠিক হয়েছিল সে কোনো এক কারণে পিছিয়ে পড়েছে। এই বৈশাখে ওদের আখদ্টা করে রাখার একটা প্রস্তাব উঠেছিল পারিবারিক ভাবে। আপত্তির কোনো কারণ ছিল না কোনোদিক থেকেই। কিন্তু হঠাৎ করেই জহির জানিয়ে বসল যে, সে বৈশাখে আসতে পারবে না, তার কোনো ছুটি নেই। এমনকি জৈষ্ঠ্য বা আষাঢ়েও না। অফিসের কাজে নাকি ভীষণ ব্যস্ত, এই সময়ের মধ্যে বিয়ে টিয়ে করা সম্ভব না। করে তো ঔষধ কম্পানির রি-প্রেজেন্টেটিভের চাকরি- কি জানি কি এমন ব্যস্ততা!
কিন্তু বিয়েটা বৈশাখে হওয়ার কথা বলেও যখন পিছিয়ে গেল, মমো সেদিনই বলেছিল , দেখো বুবু এই বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হবে না।
কি করে বুঝলি তুই বেশি জানিস ঝাঝিয়ে উঠেছিল মলি।
বেশি জানা না বুবু, এটা কমন সেন্স এর ব্যাপার। সব কিছু ঠিক ঠাক হয়ে যাবার পর ছুটির অজুহাত দেখানো..। তুমি বুঝতে পারতিছো না?
মলি কোনো কথা বলতে পারেনি সেদিন।
আঙ্গুল দিয়ে পানিতে কাল্পনিক দাগ কাটতে কাটতে মমো বলল, বুবু আমি জানি তোমার মনটা অনেক নরম। এমন একটা আঘাত তুমি হঠাৎ করে সামলে উঠতি নাও পার তাই বলতিছি। কারণ তুমি মনে মনে একটা আশা করে আছো আর সেই আশাটা ভেঙ্গে গেলি কষ্ট পাবারই কথা। সে জন্যিই আগে থেকে সতর্ক করা। স্বপ্নটা তুমি ভেস্তে দাও, দেখবা যেদিন চূড়ান্ত কথাটা শুনবা সেদিন আর কষ্ট পাবা না ।
কিন্তু তুই কি কইরে এতটা নিশ্চিত হলি তোর সাথে কি কোনো কথা হইছে জহিরের?
নাহ্ তেমন কিছুই না। কেন তুমি একথা জানতি চাচ্ছ কেন?
না জহির তো তোর সম্পূর্ণ অচেনা না; তাছাড়া অইজকাল বিয়ের কথা হলি ছেলে মেয়েতে তো কথাবার্তা হয়!
আমাদের তেমন কিছুই হয়নি বুবু। হলি তুমি জানতে।
মমো সন্তর্পণে চিঠিটার কথা এড়িয়ে যায়। একথা সত্য যে জহির সেবার মমোকে একটা চিঠি লিখেছিল। সেখানে বৈশাখে এসে বিয়ের কথাটা প্রায় তিনবার স্পষ্ট করে লিখেছিল সে। সে-ই প্রথম সে-ই শেষ।
মলি বেশ ভাবনায় পড়ে যায় তাহলে কি মমো সত্যি সত্যিই কিছু বুঝতে পেরে গেছে মলির স্বামী শামীম সেদিনই কথাটা শুনে এসে বলেছে মলিকে।
মলি একটা কথা বলি?
আলনায় কাপড় গুছিয়ে রাখতে রাখতে হঠাৎ থেমে গিয়ে জানতে চাইল সে, কি কথা তুমি এমন আমতা আমতা করতিছ কেন? কোন খারাপ সংবাদ?
ঠিক তা না। আসলে কিছু খবর আছে যা কতটা খারাপ বা কতটা ভালো সেটা যে মুহূর্তে শোনা হয় সেই মুহূর্তে নির্ধারণ করা ঠিক না। হতি পারে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনা ভালর জন্যেই ঘটিছে।
কি আঁৎকে ওঠে মলির ভেতরটা। দুঃসংবাদ কিছু শুনবে সে এখন নিশ্চিত।
আসলে কি জানো, আমাদের মমোর ভাগ্যটা হয়তো ভালই।
মন থেকে পাথরটা নেমে যায়। কেন হঠাৎ কি জন্যি ওর ভাগ্যটা ভালো মনে হচ্ছে তোমার মৃদু হেসে ভ্রুভঙ্গি করে মলি।
এবার মলির ডান হাতটা আলতো করে হাতে তুলে নেয় শামিম। জহির মনে হয় এই বিয়েটা এখনই করবে না।
মানে স্বামীর হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে মলি।
আসলে ওদেরও ঠিক দোষ দেয়া যায় না। আমাদের এখানকার চাষাবাদের জমিজমা যে ভাবে দিন দিন পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে তাতে এ জায়গার ওপরে মানুষের ভরসা কোথায় এমন একটা জায়গা ছেড়ে ধীরে ধীরে উচু জায়গার সন্ধানে সবাই পাড়ি জমাতি চাবে। আর সেই সুযোগটা যখন কারো হাতের মুঠোয় এসে ধরা দেয় তখন সেডা কে ছাড়তি চায় বল?
হুম্, স্বার্থপররা তো ছাড়তি পারবেই না।
আজকাল নিঃস্বার্থ মানুষই-বা তুমি কোথায় পাতিছ মলি?
জীবন! আর সেই জীবন টিকিয়ে রাখতে যখন প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয় তখন এসব ঠুনকো কথা দেয়া বা কোনো অঙ্গীকারের কী মূল্য থাকতে পারে?
প্রায় ভুতগ্রস্তের মতো উঠে জানালার কাছে দাঁড়ায় মলি। দূরে দেখতে পায় বিঘত পানিতে ডুবে থাকা আধমরা বিবর্ণ চালতা গাছটা। ছোট ছোট ফল সমেত যেন মৃত্যুর প্রহর গুনছে। শেকড়গুলো পচে যাচ্ছে এক এক করে। ধী-র পচন। সেদিকে তাকিয়ে থেকেই বলতে থাকে মলি, তার মানে জহিরের যেখানে পোষ্টিং সেখানেই কোনো মেয়েকে বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছে সে?
সেটাকি ও খুব ভুল করেছে তোমার মনে হয়?
ভুল না ঠিক সেটাতো আমি জানতি চাচ্ছি না! ও তাই করতিছে কি না?
এখনো করেনি তবে করবে কথাবার্তা প্রায় পাকা হয়েছে। তুমি কিছু চিন্তা কর না মমোর জন্য। এর চেয়ে ভালো ছেলে আমি ঠিক করে আনবো মলি। আমিই আনবো, আলতো করে মলির কাঁধে হাত রাখে শামিম। মলি কোনো কথা বলে না। একটু যেন কেঁপে ওঠে সে। মলি কি কাঁদছে ওর চোখের দিকে তাকাতে সাহস পায় না সে।
এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে, সেটা মেয়েটা আঁচ করেছে অথচ মমোর যেন তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। হাসতে হাসতে বলল, তুমি এতো ভেব না তো বুবু, কাজ একটা প্রায় পেয়ে গেছি।
কি সেটা শুনি?
ঐ যে ইউনিয়ন কাউন্সিলে জয় ভাইরা আসে না, ওদের একটা সংগঠন আছে সেখানে কাজ করব।
বললিই হলো কাজ করব! আমাদের কি সেই আর আগের মতো অবস্থা আছে নাকি যে, জনসেবা করলি পেট ভরবে।
জয় নামের ছেলেটারে তো তুমি দেখনি বুবু, তার চোখের ভেতরে সে কি এক তেজ জ্বল জ্বল করে। তার দিকে তাকালে শান্তি হয় বুবু- মনে হয় এখনো সব কিছু শেষ হয়ে যায় নি। চাইলে এখনো আমরা বাঁচতে পারি ওরা পারে আমাদের বাঁচাতে। বাঁধ দিতে পারে তীর ঘেঁষে। বাঁধ দেবার জন্য ওরা বিদেশের কাছ থেকে আদায় করতি পারে ক্ষতিপূরণ, এই পুকুরেও ফোটাতে পারে ১০১টা পদ্ম।
আমি ওর সব কথা হয়তো শুনিনা বা শুনলেও বুঝতে পারি না সব তবে এটুক বুঝি, তারা পারবে।
সেদিন কি বলছিল জানো?
কি?
এই যে এখন যত প্রাকৃতিক দুর্যোগ সেগুলো যতটা না প্রাকৃতিক তার চেয়ে বেশি মানুষের তৈরি। উন্নত দেশ গুলো তাদের ভোগ বিলাসের জন্য গড়ে তোলে শিল্প কল কারখানা আর ঐ সব কারখানা থেকে নিসৃত কার্বন-গ্যাস ইত্যাদির প্রভাবে সৃষ্টি হয় প্রকৃতি বোমা, যা লন্ড ভন্ড করে দেয় আমাদের জীবন-সংসার। পথে বসিয়ে দেয় মধ্যবিত্তকেও।
আমি বললাম, কী যে সব বলেন আপনি! আমাদের এখানে পানি জমিছে তাতে বিদেশীরা ক্ষতিপূরণ দেবে কেন?
তুমি জানো না। ওরা দেবে, দিতে বাধ্য।
জীবন-সংসার এসব ও কি ফিরিয়ে দিতে পারবে?
তাই কি সম্ভব কারো পক্ষে?
সেই ক্ষতি তো পূরণ হওয়ার না।
তাহলে?
এই যে মানবেতর জীবন! এর থেকে মুক্তিই বা কম কিসে?
আপনারা সত্যিই পারবেন মমোর চোখে অবিশ্বাস আর একই সাথে বুকে ধিক ধিক করে জ^লে আশার আলো।
পারতে যে হবেই। ওর বলার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছিল এই পানি টেনে আবার সব আগের মতো হবে। গাছ ভর্তি আম, জাম, জামরুল, করমচা, বাতাবি, পেয়ারা থাকবে আবার। আমাদের উঠোন ভরা ধান, সোনালি ডোরা কাটা বাগদা চিংড়ি আর সেই সাথে টাকা। সেই টাকায় সদায় পাতি আলতা, ক্রিম, পাউডার, তেল-সাবান। জয় বলিছে বিদেশের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ এনে ওরা বাঁধ দেবে এই শ্যামনগর নদীর পাড়ে। দিনের পর দিন আর পানি এসে আর টং ধরে জমে থাকবে না।
মমোর চোখে স্বপ্নের ঘোর দেখতে পায় মলি। ওকে আবার বাস্তবে ফিরিয়ে আনতেই পুকুর ঘাটে রোদে রাখা সবুজ রঙের কাচের বোতলটার দিকে চোখ রেখে বলে, ওটা বড়দার সরষের তেলের বোতল না?
ওপরে উঠে তোয়ালেটা মুখে শরীরে গড়িয়ে পড়া পানিতে আলতো করে চেপে ধরতে ধরতে অন্যমনস্ক ভাবে মমো বলে, হুম্।
বোতলের ভেতরের সরষের তেলও তো তলানীতে এসে ঠেকেছে আর বড়জোর তিন দিন ব্যবহার করতে পারবে। এভাবে সব ফুরতে লাগলে কি হবে ভাবিছিস মমো বড়দার সেই ছেলেবেলা থেকে অভ্যাস । সেই ছোটবেলা থেকে তার একটু এ্যজমার ধাত থাকায় দাদী তারে গোসলের আগে গায়ে সরষের তেল মাখিয়ে দিত। বর্ষাকালে হয়তো দুপুর বেলা ফুটবল খেলে সারা শরীরে কাদা মেখে এসেছে, সেই কাদা কোনোমতে ধুইয়ে তেল মাখিয়ে তার পর গোসল। বড়দা এখন আর ঠান্ডা পানিতে গোসলই করতে পারে না হাপানির টানটা বেড়ে যায়। শহরের বড় ডাক্তার বলেছিল ইনহেলার ব্যবহার করতে। কিছুদিন ব্যবহার করে ভালও ছিল, কিন্তু এখন আর মাসে মাসে অত টাকা.. পোষাতে পারে না। বড়দারও তো আয় বলতে কিছু নেই এখন। ওঝা বদ্দি তাবিজ তেল পড়া পানি পড়া চলে সবই। কিন্তু ভালো হয় কই! মাঝে মাঝেই হাপানীর টানটা কাবু করে ফেলে তাকে। কি হবে তাদের!
মলি মনে মনে বলে, বাস্তবে ফিরে আয় মমো। নইলে যে আমার চেয়েও বেশি কষ্ট পাবি তুই।

ভুত রেস্টুরেন্টের কোনার টেবিলে প্রায় আধ শোয়া হয়ে বসে আছে অর্ণবদা। হাত দুটো ঘাড়ের পেছনে রেখে বডিটা এলিয়ে দিয়ে পা দুটো ল্পম্বা করে ছড়ানো। চোখ বন্ধ। হঠাৎ দেখলে মনে হবে ঘুমিয়ে পড়েছে। টেবিলের ওপরে এক কাপ কফি যথারীতি ধোয়া তোলা বন্ধ করে এখন শীতল হতে চলেছে। দূর থেকে দেখে ঘুমই মনে হচ্ছে। তার পাশের টেবিলেই চার পাঁচটা সুন্দরী মেয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আশে পাশে এমন সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে বসে বসে আছে সেখানে এমন পোজে একটা এ বয়সের একটা তরুণ বসে থাকে কি ভাবে? পৃথিবীর কোনো মেয়েকেই কি পাত্তা দেয় না অর্ণবদা ? না কি মেয়েরা এমন ছেলেদেরকেই পছন্দ করে। ড্যাম স্মার্ট, বুদ্ধিদীপ্ত। হিমিকাকে সহজে বোঝা যায় না তারপরও এটা বোঝা যায় যে,অর্ণবদার জন্য সে মোটামুটি পাগল! যদিও এখনকার মেয়েরা অনেক হিসেবি,তারা প্রেমে পড়লে দিশেহারা হয় না। তাদের মধ্যে ভাবালুতা নেই। অনেক ষ্ট্রেইট ফরোয়ার্ড হয়ে গেছে ওরা । মানুষের সব রকম সম্পর্কই কি তাহলে খুব স্বাভাবিক হয়ে আসছে? আবেগহীন প্রেম,ভালোবাসাহীন বন্ধুত্ব ! হতেও পারে আবার নাও হতে পারে, এই ব্যাপারটা নিয়ে জয় এখনো কনফিউজড। তবে হিমিকা ঠিক ওরকম মেয়ে না। অর্ণবদার সাথে তেমন কোনো রিলেশানশিপ গ্রো করলে তাকে বলতো। তবে ও যে তাকে খুব এ্যাডমায়ার করে সেটাতো বোঝাই যায়। সেদিন কথা প্রসঙ্গে বলছিল, তুই ঠিকই বলেছিলি জয়, অর্ণব কিন্তু ড্যাম স্মার্ট !
- তুই যে এটা ভাবছিস সেটা তোর চোখ দেখেই বুঝতে পেরেছি।
- তাহলে তো তোকে চক্ষু বিশেষজ্ঞ বলতে হয়।
- তোর চোখ বুঝতে চক্ষু বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না। অর্ণব ড্যাম স্মার্ট না হলে তোকে যে দ্বিতীয় বার আর ওখানে পাওয়া যেত না সেটা বুঝতে কোনো বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না।
- তুই যেটা ভাবছিস সেটা ঠিক না। তোদের বিষয়টা আমার ভালো লেগে গেছে। এটাইতো এখন বিশ্বে একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাড়িয়েছে,তাই..!
মোক্ষম উত্তর। একটু লজ্জায়ই ফেলে দিল মেয়েটা,জয় অপ্রস্তুত হেসে বলল,আই এ্যাম জাস্ট কিডিং হিমি..।
ব্যাপারটা যতটা সত্যি হয় ততটাই ভাল।
প্রসঙ্গ পাল্টাতে জয় বলল,মেয়েরা বোধ হয় পলিউশন কম করে।
- কথাটা সত্যি কিন্তু তুই কি করে শিওর হলি?
- শিওর হই নি । তাহলে ‘বোধ হয় ’ বলতাম না।
- আমাকে ইমপ্রেস করার জন্য বললি?
মনে মনে বলল,ঠিক তাই। তবে মুখে বলল,না ঠিক তাও না। দেখ আমাদের সামনের টেবিলে যে মেয়েগুলো বসে আছে তাদের সবার সামনে একটা করে ম্যাঙ্গো জুসের গ্লাস। অথচ ছেলেদের অড্ডায়.. ধোয়া ছাড়া জমেই না।
হ্যা ঠিক ধরেছিস। এজন্য তোর একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য। আর সাথে পলিউশনটাও কমা হা-হা-হা।
যাক বাবা,রাগ তাহলে কমেছে! মাথাটা একটু হালকা লাগে জয়ের..।

টেবিলের কাছাকাছি যেতে দেখল অর্ণব যথারীতি চোখ বন্ধ করে আছে আর তার কানে হেড ফোন লাগানো।
অর্ণবদা ! জয় আস্তে করে হাত রাখল কাঁধে। চোখ খুলল অর্ণব।
হেই! তুই এসে গেছিস! চট্ করে রিস্ট ওয়াচের দিকে তাকাল অর্ণব,ইউ আর ফাইভ মিনিটস লেট ।
অর্ণবদার ঐ কথার কোনো পাত্তা না দিয়ে বলল,তুমি কি ঘুমাচ্ছিলে নাকি?
- নাহ্ জাষ্ট চোখ বন্ধ করেছিলাম। কি খাবি বল্ ?
- আপাতত কফি বল।
- শুধু কফিতে এরা কতক্ষণ বসতে দেবে? অন্য কিছু খেলে বল অর্ডার করে রাখি।
- খাব পরে ;এখন ইচ্ছা করছে না। কফিই বল,নাহ তুমি বসো আমিই বলে আসছি।
ফিরে এসে চেয়ারে বসতে বসতে জয় বলল,কি করছিলে? গান শুনছিলে?
- আরে নাহ! রেডিও শুনছিলাম। এদেশের রেডিওগুলো কি ধরণের প্রোগ্রাম করে তাই বুঝবার চেষ্টা করছিলাম। মিডিয়া এখন আমাদের খুব দরকার হবে বুঝলি না! সব ধরণের এ্যাওয়ারনেসের জন্যই দরকার মিডিয়া।
কিন্তু আমাদের রেডিও শোনার জন্য তো চোখ বন্ধ করার কোনো ব্যপার নেই। ওটা শুনলেতো কোনো রকম আবেশ হয় না বরং বিজ্ঞাপনে বিজ্ঞাপনে কান ঝালাপালা।
- চোখ বন্ধ করে ভাবছিলাম ওদের ওখানে একটা প্রোগ্রাম ম্যানেজ করার কথা। আচ্ছা,আমাদের পরিচিতদের মধ্যে রেডিওতে কেউ নাই?
- আছে,পল্লব ভাই আছে তরু আছে নো প্রবলেম। তুমি শুধু গেলেই হবে।
- নাউ কাম টু দ্য পয়েণ্ট। রিগার্ডিং স্পনসর। আমরা কোথায় কোথায় নক করব আর তারা কতটা সাড়া দেবে ভেবেছিস কিছু?
- অর্ণবদা প্রবলেম তো এখানেই।
- কি ধরণের?
- তুমি জানো না?
- জানি,তবু তুই বল তোর পয়েন্ট অব ভিউ টা শুনি।
- শোনো,আমাদের এখানে সুন্দরী প্রতিযোগিতা বা মিউজিক্যল ট্যালেন্ট হান্ট এ যতো স্পনসর জোটে সেটা কিন্তু অন্য কোনো ব্যাপারে জোটানো মুশকিল।
- হ্যা মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এটাইতো স্বাভাবিক।
- কিন্তু অর্ণবদা সমস্যা হলো আমাদের,আমরা ঐ ধরণের কোনো ইস্যুতে স্পন্সর চাচ্ছি না। তাছাড়া রিসেসানে বাজেট কমে গেছে। যারা বিজ্ঞাপন দেয়,স্পনসর করে তারা এসব ব্যপারে কতটা উৎসাহী হবে বলা মুশকিল। কারণ সবাই তো শিল্প ভিত্তিক বাণিজ্যের সাথে জড়িত। আর চেইন সূত্রে শিল্প মানেই কার্বণ নিঃসরণ প্রকারন্তরে গ্রীন হাউজ এফেক্ট।
আমরা সার্ভিস বেজড অরগানাইজেশানগুলোকে নক করব। ব্যাংক,বীমা,মোবাইল ফোন কম্পানি। ওরা লোক দেখানোর জন্যও অনেক সময় এসব বিষয়ে স্পনসর করে থাকে।
- হ্যা সেটা ঠিক তবে আগে দেখতে হবে ওদের টার্গেট পিপল কারা এবং ওরা কার কাছে কতটা দায়বদ্ধ।
- যেসব প্রোগ্রামে হাজার হাজার মানুষ আসে সেসব প্রোগ্রামেই ওদের উৎসাহ বেশি। এই যে দেখ এদেশে বিদেশি বড় বড় এয়ারলাইন্সগুলো আসতে খুব একটা ইন্টারেষ্ট দেখায় না। তার কারণ কি? কারণ ব্যবসার কারণে হাইফাই লোকেদের এখানে আসার প্রয়োজন কম। কত বছর ধরে কোনো বিনিয়োগই নেই ধরতে গেলে।
- তার পরও ঠিক মতো ধরতে পারলে স্পন্সর দু একটা জুটে যেতে পারে। শোন, ‘কার্বণ নিঃসরণ কমাও’ এই স্লোগানটা এখন ওয়ার্ল্ডে একটা হট কেক। ২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ২.২ মিলিয়ন বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এক ঘণ্টার জন্য বাতি নিভিয়ে রেখে ওরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ একটা ক্যাম্পেইন করেছিল। আর এখন দেখ এবছর এই ক্যাম্পেইনটা প্রায় সব দেশেই হচ্ছে। ২০০৭-এ শুধু অস্ট্রেলিয়ায় আর এ বছর ২০১০ এ এসে ৮৮টি দেশে চার হাজার শহরের পাঁচ মিলিয়ন মানুষ ১ ঘণ্টার জন্য বাতি বন্ধ রেখে এই আয়োজনে অংশ নিচ্ছে। তাহলে..?
তাহলে কি ?
- তাহলে আমরা স্পন্সর পাব না কেন? আজকাল অনেক কম্পানিই এ ধরণের প্রোগ্রামে স্পন্সর করতে আগ্রহী। ওদের ভেতরে ভেতরে যা-ই থাকুক না কেন।
- তাহলে আমরা আমাদের ক্যাম্পেইনটা শুরু করছি কবে থেকে এবং কোথা থেকে?
- আমাদের প্রথম প্রেস কনফারেন্সটা হবে প্রেস ক্লাবে। সেখানে পেপার প্রেজেন্ট করার জন্য দু একজন স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবি রাজি হয়েছেন। তারপর কিছুটা মিডিয়া কভারেজ পাবার পর বাকি ক্যাম্পেইনগুলো হবে টিএসসি সহ দেশের সব সরকারি ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। আমরা আরো কয়েকটা ওয়ার্কশপ করবো এর ভেতরে মাঝে মাঝে বিভিন্ন এরিয়ায় ক্ষতিগ্রস্তদেরও একটা ড্যাটা তৈরি করব,কিছু ডক্যুমেন্টারি ..ইত্যাদি,ইত্যাদি।
- তাহলে আগামী পরশু আমরা আর একটা মিটিং কল করি!
- হ্যা তার পর আঁট ঘাট বেধে কাজে নেমে পড়ি,কি বলিস?
- অফকোর্স! দেরি করার কোনো সুযোগ নেই।

১০

অনেকদিন পর হিমান্তিকার মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছিল সেদিন। বিকেলে ছাদে হাটাহাটি করছিল সে। অফিস জয়েন করার পর থেকে জীবনটা যেন চিড়িয়াখানার বন্দি জীবের মতো হয়ে গিয়েছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই অফিসে ছোট আর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে ফিরতে টায়ার্ড। ছাদে হাটার আর ইচ্ছে থাকে না। আর ছুটির দিনে, বিগত ছয় দিনের জমে থাকা ব্যক্তিগত কাজগুলো করে উঠতেই আর হাতে সময় থাকে না। তার ওপরে যদি শপিং-এ যেতে হয় বা কোনো সোস্যাল প্রোগ্রামে এটেন্ড করতে হয় তাহলে তো আর কথাই নেই। প্রায় প্রতিদিনই ছাদের বাগানের গাছগুলোর জন্য মনটা ছটফট করে। কেমন আছে ক্যালেন্ডুলা বা পিটুনিয়া? কি কি নতুন ফুল ফুটল এ-ক’দিনে? মধুমঞ্জুরির ফুলগুলো যখন লতা সহ ঝুলে পড়ে কেবল তখনই তার জানালা থেকে দেখা যায়। ওরাও যেন জানান দেয়,আমরা আছি। তাই আজ অনেকদিন পর ছাদে এসে ভালো লাগছে। পশ্চিমের আকাশে মেঘ জমেছে। সুরমা রঙের গম্ভীর ঘণ মেঘ এসে ঢেকে ফেলেছে আকাশ। প্রকৃতিতে আজ কি এক অদ্ভুত সুন্দর রঙের খেলা। আকাশের ঐ বিশেষ রঙের সাথে হলুদ অলকানন্দায় মিশে ছাদের এদিকটায় যেন অগুন ধরে গেছে। যে আগুন সব পুড়িয়ে খাক করে দেয় সেই আগুন না,যে অগুনে মানুষ ওম পায় সেই আগুন যেন। উত্তাপ আছে অথচ প্রচন্ডতা নেই। আনন্দে অত্মহারা সে গান গেয়ে ওঠে,
 

'...আলোতে কোন গগনে মাধবী জাগল বনে,
এল সেই ফুল জাগানোর খবর নিয়ে।
সারাদিন সেই কথা সে যায় শুনিয়ে...'
 

হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই তীব্র বাতাস শুরু হয়ে গেল। বাতাসের সঙ্গে জোর বেগে ছুটে আসছে ধুলো বালি..। হিমান্তিকা দৌড়ে চিলে কোঠার সামনে শেডের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। মিনিট খানিক পরেই নামল ঝুম বৃষ্টি। বছরের প্রথম কাল বৈশাখী। বড় বড় ফোটা মাটিতে পড়ে ধোয়া সমেত উঠে আসতে লাগল মাটির সোদা গন্ধ। আহ কী অসাধারণ সৌরভ! একেই বোধহয় বলে বেঁচে থাকা! চিড় বিড়িয়ে যখন নামছিল জলের ধারা, ভীষণ ইচ্ছে করছিল ভিজতে। কিন্তু পেছন থেকে মা এর কড়া নিষেধাজ্ঞা ভেসে এলো, হিমিকা একদম বৃষ্টিতে ভেজার চেষ্টা করবে না। কিছু হলে আমি কিন্তু তুলকালাম বাঁধাব।
এই তুলকালাম বাধানোর ভয়েই অগত্যা শেডের নিচে বসেই বৃষ্টির আমেজ নেয়া চলল। এমন একটা রোমান্টিক পরিবেশে তার মনে উঁকি দিতে থাকে সেই চিঠিগুলো যা মেইল হয়ে আসে তার কাছে । প্রতিদিনের মতো সেদিনও ফেসবুকে  মারছিল হিমান্তিকা । দেখল মেসেজ বক্সে একটা পার্সোনাল মেসেজ এসেছে। সেখানে একটা ইমেইল এড্রেস।
তোমার সাথে কথা বলতে চাই। ভীষণভাবে চাই। কথাটা যে আমাকে বলতেই হবে তোমাকে--। প্লিজ মেইল কোরো।
ওই লেখাটার ভেতরে কিছু একটা ছিল যা ভীষণ কৌতুহলি করে তোলে তাকে। সেই থেকে হিমান্তিকা ওকে মেইল করতে থাকে...।

হিমান্তিকা,
এটা হয়তো প্রেম নয় বা তীব্র কোনো আকর্ষণও নয়। তারপরও প্রতি মুহূর্তে তোমাকে মনে পড়ে আমার..।
কিছু একটা আছে তোমার সাথে,আমি ঠিক ওভাবে তোমাকে বোঝাতে পারছি না।
আমি প্রতি মুহূর্তে তোমাকে কেন অনুভব করি? ... এটা বন্ধুত্ব এমনকি প্রেম ও নয়।
তার ওপরের, ভেতরের বা গভীরের কিছু। এভাবে শুনে খুব অবাক লাগছে নিশ্চই! তাও এতো হঠাৎ করে।
আর লাগাটাইতো স্বাভাবিক। এভাবে না হলে কি করে বলতাম! ইনিয়ে বিনিয়ে? বা সাজিয়ে অথবা বানিয়ে বানিয়ে বললে বেশি ভালো হতো? না হতো না। কিছুতেই না। আমি কি প্রেম নিবেদন করছি?
আমি নিজেই জানি এটা কোনো দুর্ণিবার আকর্ষণ নয়... এ এক অদ্ভুত কিছু,যার সত্যি কোনো নাম হয় না।
পারলে তুমি একটা নাম দেবে।


কে এই মানুষটা? এতো স্পষ্ট করে বলছে অথচ নাম ঠিকানা বিহীন। স্পষ্টতার কি নমুনা! ইমেইল আইডিতে আছে নীল সমুদ্র। ফেসবুকেও তাই। কোনো ছবি নেই প্রোফাইলে,একটা মাত্র সমুদ্রের ছবি। ফ্রেইন্ড লিস্টে  তাদের কোনো মিউচ্যুয়াল ফ্রেইন্ড নেই। সে থাকে বলছে নেব্রাসকায়। হিমান্তিকার পরিচিত কেউ না অথচ তকে চেনে। চিঠি পড়ে মনে হয় পরিচিত কেউ, এভাবে ছদ্মবেশে...। তবে তার লেখার ভেতরে যে প্রজ্ঞা যে বুদ্ধির দীপ্তি তাতে মনে হয় অর্ণব। অর্ণবই। অর্ণব মানে তো সমুদ্র। হিমান্তিকা ভেতরে ভেতরে রোমাঞ্চিত হয়,সত্যিই কি সে? তবে মনের গভীরে কোথায় যেন একটু খুঁত থেকে যায়। অর্ণব তো তাকে সরাসরিই বলেছিল। হিমান্তিকা দেখ,আমি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে, ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলতে পারি না। তাই হয়তো অনেকে আমাকে পছন্দ করে না। বাট আই লাইক ইউ। ইনফ্যাক্ট তোমার কাজের প্রতি যে একটা ডেডিকেশন এই এ্যাটিচিউটটা আমার ভালো লেগেছে। মনে হয় আমরা দুজনে অনেকদূর যেতে পারব, কি বল?

দুজনে শব্দটা হিমান্তিকার ভেতরে এক কম্পন সৃষ্টি করলেও মুখে বলল, দুজনে? আর সামাজিক জীব হওয়ার কষ্টটাকে এই প্রথম উপলদ্ধি করল সে। অর্ণব যেন সম্বিত ফিরে পেয়েছে সেভাবে বলল, নাহ্ সবাই।
ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে তাই তখনই রিপ্লাই করতে বসল সে,

সত্যিই ভালোলাগা,আকর্ষণ বা প্রেম নয়। কামনা নয় বা কোনো মানব মানবীর সম্পর্ক নয়।  তার বাইরের কিছু বা তার চেয়ে বেশি কিছু । কি হতে পারে? আমি কবি নই বা দার্শনিকও নই।
তাই আমার মনে হচ্ছে এটা ভালোবাসা। ভালোবাসা যে শুধু প্রেম বা আকর্ষণ তাতো নয়।
ভালোবাসার যে অনেক রঙ! রঙধনুর সাতটি রঙ তার সাথে মিলে জুলে অসংখ্য রঙ...।
অফকোর্স ভালোবাসা ! অনেক ওপরের বা গভীরের কিছু।

হিমান্তিকা,
তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে কতো সরল তুমি।
জীবনের সব জটিলতার কত সহজ সমাধান তুমি বের করতে পার।
... হ্যা হতে পারে হয়তো ভালোবাসাই...।


এই মেইলগুলো হিমান্তিকার জীবনের সব রং কেমন বদলে দিতে লাগল। কিছু না খুব সিম্পল এক একটা চিঠি অথচ তাই দেখে তার চোখে জল আসতে লাগল। সে তীব্রভাবে তার মেইল এর অপেক্ষায় থাকতে লাগল। ও খুব ব্যস্ত থাকে। সব সময় নেটে আসতে পারে না। সে হয়তো একটা মেইল করে হিমান্তিকা করে চারটা। আবোল তাবোল কত কথা বলে যায়..। এরই মধ্যে আরো একটা মেইল এলো,

নেব্রাসকায় আসবে? কতো কথা যে জমে আছে! এভাবে বলে সে কথা শেষ করা যাবে না।
তোমার সামনে দাড়িয়ে বলতে হবে..।
তোমার স্পর্শে - তোমার সৌরভে যে কথাগুলো ভিন্ন রঙ নিয়ে আসবে বসন্তের মতো।


হিমান্তিকা লিখল,তাহলে যে বাবা কে দিয়ে একটা পাওয়ার অফ এ্যাটর্নি লিখিয়ে নিতে হবে তোমার!
- এখনই? না দেখেই,না জেনেই,পাওয়ার অফ এ্যাটর্নি দেবেন বলে তোমার মনে হয়? আর তা ছাড়া তুমিওতো আমাকে দেখনি।
- কি করে দেখবো বল! তুমি সামনে এসে দেখা দিলেইনা সেটা সম্ভব।
- তাইতো তোমাকে আসতে বলছি।
- তার চেয়ে বরং তুমি আসো ;সেটা বরং অনেক সহজ হবে।
- তুমি বললে আমি এক পায়ে খাড়া,কি›ত্ত ম্যাম তখন আমাকে তুমি চিনতে পারবে তো!
মুহূর্তে হিমান্তিকার বুকের ভেতরে একটা গরম লোহার বল গড়িয়ে যায়,সে এক বুক উৎকন্ঠা নিয়ে বলে তুমি কি আমার পরিচিত কেউ নও?
- এতোদিন পরেও কি আমরা অপরিচিত হিমিক?
- না মানে হঠাৎ কেন যেন মনে হলো...।
- তুমি তো আসবে না, তাহলে কি আসবো আমি?
- তোমার ছদ্মবেশ ভেঙ্গে?
- ছদ্মবেশ না ভেঙ্গে কি করে অসব বল ? যে কথা বলতে চাই সেটাতো ছদ্মবেশে মানায় না। তবে তুমি কতটা আমাকে চাও সেটা না জেনে ছদ্মবেশ ভাঙ্গার সাহস হয় না।
- মানে?
- মানে আমাকে নিয়ে তোমার কোনো ইচ্ছা আছে কি না। আর আমার ভেতরে এমন কি আছে যা অন্য সবার থেকে আমাকে বৈশিষ্ট্যময় করে তোলে। বা এমন কি আছে যা কোনোদিন তুমি ভুলতে পারবে না। এসব কথা এবং এর সাথে জুড়ে অনেক কথা যা এভাবে বলে শেষ করা যাবে না।
- কেন তোমার চিঠি,তোমার ভাষা এ সব কিছুই অন্যরকম। সত্যি অ-ন্য-র-ক-ম।
- তাই! অমার কি মনে হচ্ছে জানো?
- কি?
- এভাবে না তোমাকে অমার প্রিয় কবির কবিতায় বলি,
 

'একরকম পাখি আছে যারা
দিগন্ত পেরিয়ে বলতে বলতে যায়

একরকম বৃষ্টি আছে যারা
ঝরতে ঝরতে বলে

একরকম ভাষা আছে যা অচেনা বর্ণমালায় জানায়

কিছু একটা হবে
কিছু একটা হবে
তোমাদের দুজনের একাকীত্বের জীবনে
যা প্রেমের চেয়েও বিরাট,
এবং ভালোবাসার চেয়েও কঠিন.. '
 

- কবিতাটা কার?
- তুমি খুঁজে বের করো।
- এই মুহূর্তে বুঝতে পারছি না, তবে যারই হোক, হ্যা সত্যিই! হয়তো কিছু একটা হবে।
- তাহলেতো আসতেই হয়।
- আমি সেই দিনের অপেক্ষায় থাকব।...

এমন সময় নীচে গেটে শব্দ হতে সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখল,জয় সিএনজি স্কুটার থেকে নেমে সিএনজি চালকের সথে মহা হাঙ্গামা জুড়ে দিয়েছে।
- কি বলেন কি আপনি! আপনার মিটারে উঠেছে ২৫ টাকা,আপনি আমাকে দয়া করে নিয়ে এসেছেন সে জন্য আমি বড়জোড় ৩০ টাকা দিতে পারি কি›ত্ত তাই বলে ৫০ টাকা! ভাই আমিতো টাকা ঘুষ খেয়ে,ডাকাতি করে আনি না। এর চেয়ে বেশি দিতে পারব না। সিএনজি-স্কুটার চালক সমানে গজ গজ করছে, আর জয়ও নাছোড়বান্দা। কি,ভাবেন কি আপনারা নিজেদেরকে? কোথাও যেতে বললে সোজা বলে দেয় যাবো না। আজকাল নতুন ফন্দি,বলে গ্যাস নাই। যত্তোসব! পিটিয়ে সব দেশছাড়া করে দেয়া লাগে..।
- কিরে জয় শুধু শুধু ভিজছিস কেন? ওপরে উঠে আয়।
- তোর মতো সোনার চামচ মুখে নিয়ে জ›মাই নি তো.. তাই ভিজছি।
খোঁচাটা গায়েই মাখল না হিমান্তিকা। বলল, তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে ইচ্ছে করে ভিজছিস।
- অনেকটা ঠিক ধরেছিস; তবে তুই ভিজছিস না কেন হাঁদারাম?
ইশারায় গাল ফুলিয়ে মাকে দেখাল সে।
- আয় নীচে আয় কথা আছে।
- তুই না বললেও আসতাম। এখন বরং তুই ছাদে আয় এখানে বসে কথা বলি।
- ওকে আই এ্যম কামিং!
- শোন! হালিমা বুয়াকে বলিস তোকে একটা শুকনা তোয়ালে দিতে।
জয় যখন ওপরে এলো তখন ওকে বেশ বিষন্ন দেখাচ্ছিল। কি যেন একটা টেনশান কাজ করছে ওর ভেতরে।
হিমান্তিকা বলল কিরে, তোর কি কোনো কারণে মন খারাপ?
- মন খারাপ না, মেজাজটা খারাপ।
- কেন? ঐ সিএনজি চালকের সাথে ঝগড়া করলি তাই?
- আরে নাহ্!
হঠাৎ আমূল বদলে গিয়ে বলল, আচ্ছা হিমি! চেনা রাস্তায় মানুষ যখন হারিয়ে যায়, চেনা মানুষগুলোকেও যখন অচেনা লাগে তখন মানুষ কি করে?
বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে হিমান্তিকার! কেন কি হয়েছে জয়?
- তেমন কিছু না। স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে ও।
- নিশ্চই তেমন কিছু,নইলে তুই ওভাবে বলতিস না।
- নাহ্ বাদ দে।
- আচ্ছা,আর আমাদের উপকুলে যাবার কি হলো?
- তোদের মতো লোক সঙ্গে থাকলে যা হয়,তাই হয়েছে।
- মানে? আমরা আবার কি করলাম?
- তুই এখনো কিছু করিসনি তবে সারাদিনতো থাকিস অফিসে পড়ে। আর অর্ণবদা..।
হঠাৎ করেই একটা বিট মিস করে সে, অর্ণব সে কি করল?
- কি করে নাই বল! দেখতো কত কষ্ট করে কতদিন ধরে পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা চাঁদা সংগ্রহ, স্পনসর যোগাড়, সরকারী অনুমতি সহ সব প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি এখন শুধু যাবার অপেক্ষা কিন্তু কয়েকদিন ধরে অর্ণব এর কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তার সেল ফোন ও অফ। জয় এরপর কোন ভূমিকা না করেই বলল তুই আমার সঙ্গে এক জায়গায় যেতে পারবি? এক্ষুনি!
-কোথায়?
-অর্ণব এর ওখানে।
অজানা আশংকায় বুকটা কেঁপে উঠলো হিমান্তিকার,বলল কেন অর্ণবের কি কিছু হয়েছে? খারাপ কিছু?
- খারাপ কি ভালো জানি না, তবে আমি ওকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই যার উত্তর ওকে দিতেই হবে। সে কিছুতেই আমাদের মূল্যবোধকে নিয়ে খেলতে পারে না।
- কেন, কি? কি করেছে সে?
- ঐ শালা বিচ! একটা মাল্টিন্যাশনাল এ্যাগ্রো সিডস কম্পানিতে চাকরী নিয়েছে। যারা ওদের উৎপাদিত হাইব্রীড বীজ এদেশে বিক্রি করবে। বীজ গুলো আদৌ এদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু উপযোগী নয়। যার ব্যবহারে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে কৃষকরা।
- অর্ণব এমন একটা কম্পানীতে চাকরী নিয়েছে? হিমান্তিকার বিস্ময় এর সীমা থাকে না! অথচ তাকে জানালো না? কেউ না জানুক, তাকে তো জানাতে পারতো! কারণ গত দু মাসে সংগঠনের কাজ করতে গিয়ে তারাতো অনেকটাই কাছাকাছি চলে এসেছিল যা অন্য সব কিছু থেকে আলাদা। নাকি এটা শুধু ওয়ান সাইডেড ছিল? যদিও তারা মুখে তখনো কিছুই বলেনি! তবে অনুভব করেছে বার বার। সব কথাতো বলতে হয় না! কিছু কথা বোঝা যায়। তাহলে ঐ মেইল গুলো কার? ওহ গড!
কিন্তু হিমান্তিকা কিছুতেই যেন জয়ের কথাটা মেলাতে পারছে না। তার সব সময় মনে হয়েছে অর্ণব অন্যদের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। তার শিক্ষা রুচিবোধ অনেক উচু তারে বাঁধা। তার মুখে যেন ফুটে থাকে একটা জ্যোতি। তার প্রতিটি কথার ভেতর মিশে থাকে প্রবল আত্মবিশ্বাস। কোনো বিষয়েই পুরোপুরি না জেনে সে কিছু বলে না। এমনই তার ব্যক্তিত্বের প্রখরতা যে সে অন্য কাউকে খোঁচা মেরে কিছু বলে না। তর্ক ভিন্ন দিকে মোড় নিতে চাইলে অনেক সময় বলে, এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। কিছু মন্তব্যও করতে পারব না। তখন মনে হয় তার মতো সত্যবাদী আর জ্ঞানী আর কেউ নেই। এমন সাত পাঁচ কত কিছু ভাবতে ভাবতেই জয় আবার হুংকার ছাড়ে...
- কি তুই যাবি না ?
ওর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে হিমান্তিকা অস্ফুটে বলে,চল!

১১


বনানীতে অর্ণবদের বাড়ীর গেটে পৌছে প্রথম ভুল ভাঙলো হিমান্তিকার । বিশাল তিনতলা পুরনো বনেদী বাড়ী। সে যে এতটা রিচ ফ্যামিলির ছেলে সেটা সে এর আগে বুঝতে পারেনি। জয় জানত কিন্তু ও কখনো বলেনি। কারো ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে ওর উৎসাহ বরাবরই কম। ওরা সেখানে পৌঁছার পর নীচ তলার বিশাল ড্রইং রুমে ওদের বসিয়ে কাজের লোকটা ভেতরে গেল অর্ণবকে ডাকতে।
প্রায় সাথে সাথেই অর্ণব এসে ঘরে ঢুকলো এবং স্বভাবসুলভ ভাবেই বলল, আরে তোমরা! হোয়াট এ প্লিজেণ্ট সারপ্রাইজ!
হিমান্তিকাই প্রথম কথা বলল, অনেক দিন তোমার কোন খোঁজ নেই, তাই এলাম!
- সত্যি তাই? কি সৌভাগ্য আমার! নাকি অন্য কিছু জয়?
জয় এবার ও কোনো কথা বলল না।
- আসলে আমিই যেতাম তোমাদের কাছে কিন্তু কদিন ধরে এত ব্যাস্ততা যে সময়ই পাচ্ছি না। এই যে আমাদের বাড়ীটা দেখছো, গত পরশু থেকে এটাকে খালি করা হচ্ছে বাড়ীটা গেছে প্রমোটরের হাতে মাল্টিষ্টোরেড হতে। আর বাড়ীর লোকেরা সাময়িক ভাবে অন্যত্র শিফট করেছে। আমাকে অপাতত আরো দু একদিন থাকতে হবে এখানে-একা।
‘একা’ শব্দটা যেন বেশ একটু জোরের সঙ্গে বলল।
- এতো সুন্দর বাড়িটা তোমরা ভেঙ্গে ফেলছ!
- হ্যা, কি করব বল! বাবা মা যতদিন ছিলেন তাদের পুরনো ভ্যালুজ বলো বা ভালোবাসা যাই বলো, সে কারণে বাড়িটা ভাঙ্গা হয়নি এখন তাঁরা আর নেই- তাই এতোবড় বাড়ি এভাবে ফেলে রেখে লাভ কি? ভাড়াও পাওয়া যায় না। মেনটেনেন্স এসব নিয়ে নানা রকম প্রবলেম। এই যে দেখ সেই যুগে চীন থেকে আনা খোদাই করা রঙিন স্টেইন-গ্লাস। এখন মেনটেনেন্স এর অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই সবাই মিলে ডিসিসান নিয়ে প্রমোটরকে দিয়ে দিলাম। আমার একটু খারাপ লাগছিল, এত দিনের বাড়ি- এখানেই জন্ম এখানেই বেড়ে ওঠা, এতো দিনের ¯মৃতি।
- এটাকে কি এভাবে টিকিয়ে রাখা যেত না। না কি সম্ভবই ছিল না।
- না। আসলে বাস্তবতার সামনে এসব ইমোশোনের কোনো দাম নেই। ঝড়ের বাতাসের মতো ইমোশোন উড়ে যায়।
- কিন্তু এখনো অনেকে ইমোশান পুরনো ভ্যালুজ এসবকে মূল্য দেয়।
- যারা দেয় তারা পিছিয়ে থাকে। সময়ে সাথে বা সময়ের আগে যারা থাকে তারাইতো আধুনিক মানুষ। তারাই তো গড়ে আগামীর পৃথিবীটাকে।
- আগামীর পৃথিবীর জন্য এমন কিছু বিসর্জন দেয়া!
- মানতে একটু কষ্ট হয়, এই আর কি। কিন্তু মানিয়ে যায় এক সময়, সময়ের সাথে।
- অথচ কাচের গ্লাসে চিড় ধরে যাওয়া দাগের মতো একটা দাগ থেকে যায়, তাই না অর্ণব?
- হ্যা যারা বেশি ইমোশোনাল তাদের জন্য। এ এক ধরণের দুঃখ বিলাস মূলত সুখি মানুষের জন্য। আর যাদের জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে হয় তাদের এসব সময় কোথায় হিমান্তিকা?
- হ্যা এটা ঠিক বলেছ। কিন্তু তোমাদের নিশ্চই যুদ্ধ করতে হয় না!
- বাইরে থেকে যাকে যত বড় দেখায় ভেতর থেকে তার যুদ্ধটাও কিন্তু ততটাই বড়। মাঝে মাঝে সে নিজের স্বার্থেই যুদ্ধ লাগিয়ে দেয়।
- তোমার সাথে কথায় পারা যাবে না।
- এটা ঠিক না। এর মানে তুমি আর তর্ক করতে চাচ্ছ না।
ঠি-ক আছে তর্ক যখন করতে চাচ্ছ না বরং চল তোমাদেরকে বাড়ীটা একটু ঘুরিয়ে দেখাই। যেহেতু এটা আর বেশীদিন থাকছে না ..., বিশেষত তোমাকে, হিমান্তিকার দিকে ঘুরে বলল সে।
- কেন? আমাকে কেন?
- নাহ, তেমন কিছু না, তবে মেয়েদের এ্যানটিকের প্রতি একটু আকর্ষণ থাকেতো তাই! স্পষ্টতই কথা ঘোরালো অর্ণব।
ফার্ণিচারগুলো প্রায় সব সরানো হয়ে গেছে দেখবার মতো কিছুই ছিল না। তাই সহসাই ওরা চারতলায় চলে এলো। সেখানে চিলেকোঠার সাথে একটা ঘর যেটা ছিল অর্ণবের ষ্টাডি রুম রাজ্যের সব বইয়ে ঠাসা। সেটা দেখে ওরা ছাদে রাখা পাথরের মোড়া গুলোতে বসল।
- তুমি আমাদের সাথে এমন করলে কেন অর্ণব দা? এই প্রথম কথা বলল জয়।
- কি করেছি? তুই কিসের কথা বলছিস?
- ঐ যে শুনলাম তুমি নাকি চাকরী নিয়েছ?
- ওহ এই কথা? হ্যা নিয়েছি । আমাকে একটা কিছু করে খেতে হবে না?
- কংগ্রাটস অর্ণব! এটাতো সুখবর! কিন্তু তুমি আমাদেরকে জানালে না কেন?
- কি করে জানাবে হিমান্তিকা ? ও যেটা করছে সেটাতো আমাদের রুলস বিরোধী । সারাদিন পরিবেশ পরিবেশ করে এখন জি এম বীজ, হাইব্রীড বীজ এর বাজারজাত করবে ঐ মাল্টিন্যাশনাল কম্পানির হয়ে। তোমরা বলবে এসো আমাদের বীজ চাষ কর, ধানে গোলা ভরে যাবে। কিন্তু তোমরা বীজ সংরক্ষণ করতে পারবে না। বীজ আমরা দেব। প্রতিবার বীজ আর ভাল ফসলের আশায় অতিরিক্ত সার কীটনাশক কিনতে গিয়ে ফতুর হবে কৃষক। দূষিত হবে পরিবেশ কীটনাশকের বিষে। আর ঘামে রক্তে ভেজা টাকা যাবে ওদের হাতে।
তোমার সব কিছু ছিল ভন্ডামী অর্ণব দা! তুমি এভাবে নিজেকে প্রমোট করেছিলে ঐ সব মাল্টিন্যাশনাল কম্পানির কাছে তোমার ক্যাপাবিলিটি প্রুফ করতে ; আর আমাদেরকে তুমি ব্যবহার করেছ সিড়ি হিসেবে। তুমি ও তোমরা কিছু লোক ঐ মিথ্যে জনসেবার বেসাতি কর নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য।
- তোর কথা শেষ হয়েছে ? দেন লেট মি সে। জয়, বি প্রাকটিক্যাল ম্যান! দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে সেই তুলনায় কৃষি জমি কমছে। এত এত মানুষ খাবে কি? হাইব্রিড ফসল না উঠলে? সে কথা একবারও ভেবেছিস ! দেখ তোরা যেভাবে ভাবছিস আমি এর সম্পূর্ণ বিরোধিতা করছি না। কিন্তু এ কথা তো সত্য যে আমাদের প্রকৃতিতে কিছু পরিবর্তন দেখা দিয়েছে । বেড়ে যাচ্ছে জনসংখ্যাও সুতরাং সেই অনুযায়ী খাদ্যের যোগান থাকাটাও তো একান্ত জরুরী। আর এ জন্যইতো এ্যগ্রো সীডস গুলো এত প্রসার লাভ করছে। প্রকৃতিগত পরিবর্তনের কারণে আমাদের চাষাবাদে এসেছে ব্যপক পরিবর্তন। আগে বছরে একবার বা দুবার ধান উৎপন্ন হতো এখন একই জমিতে সর্বোচ্চ চারবার ও চাষ হয়। সে জন্য জমির উর্বরতা হারাবেই আর সেই পরিমান সার সেচ কিটনাশক ইত্যাদি কৃষককে দিতেই হবে। ইটস সো সিম্পল!
- হ্যা তাই তো বললাম হাইব্রীড ফসল মানেই সেই চেইন মার্কেটিং; আর সব টাকা ঐসব বহুজাতিক কম্পানির হাতে।
- মানে তো সেই একই দাড়াল না, তোমরা কৃষকের বীজ সংরক্ষণের অধিকার কেড়ে নিচ্ছ। উৎপাদনে তাদের সব রকম স্বাধীনতা হরণ করছো তোমরা। ওদের উৎপাদন ক্ষমতা এখন তোমাদের হাতে বন্দি।
- তুমিও হিমান্তিকা ! ওদের সাথে গলা মেলালে।
- আশ্চর্য! তুমি আমাকে ওদের থেকে আলাদা ভাবছ কেন? আমরা দুজন তো একই আদর্শে বিশ্বাসী, আর তোমাকেও তো তা-ই ভেবেছিলাম। বায়োটেকনোলজি হলো একটা অপরিণামদর্শী বৈজ্ঞানিক উদ্যোগ যা একটা সময়ে নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যেতে এবং গোটা বংশগতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে।
- কিন্তু হিমান্তিকা এই কথাটার কেউ প্রমাণ দিতে পারবে?
- কি ভাবে দেবে বল, এটাতো সবাই জানে যে কম্পানিগুলোর সত্বাধিকারী থাকার কারণে জিএম ফসলের ওপরে কোনো রকম স্বাধীন গবেষণা নিষিদ্ধ। তাহলে কি করে পারবে প্রমাণ দিতে? কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বা রিসার্চ প্রতিষ্ঠানে বায়োটেকনোলজির বিপক্ষে গবেষণা র জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ হয় না।
ভারতের একটা গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে বিটি তুলার উৎপাদনের ফলে মাটির অনুবীজের পরিমাণ আশংকাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। বিটি তুলার গাছ ও ক্ষেতের ঘাস খাবার পর গবাদি পশুর মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে সেখানে।
একটা ফসল যে নিজেই নিজের কীটনাশক তৈরী করতে পারে সে কি আর বিষাক্ত না! এটাকি প্রমাণের অপেক্ষা রাখে বল? কিন্তু তোমরা শুধু শুধু অভিযোগ করছ। বীজে টার্মিনেটর প্রযুক্তি এখনো এখানে ব্যববহৃত হচ্ছে না। তেমন হলে আমি না হয় এই জবটা করব না।
-কিন্তু সব বাদ দিলাম তুমি, তুমি অর্ণবদা! সব জেনে শুনে কিভাবে জয়েন করলে বলত?
- কই আমিতো এখনো মনে করছিনা যে আদর্শ চ্যুত হয়েছি।
- তবে দেখিয়েছো। দাঁতে দাঁত চেপে বলে জয়।
- জয় তুই এখনো ছেলে মানুষ, রেগে আছিস তাই বুঝতে পারছিস না।
জয় মোহ গ্রস্তের মতো বলে, হ্যা বুঝতে পারছি। এদেশের উৎপাদনে কৃষকের কোন হাত থাকবে না। প্রতিবার তোমাদের কাছে যেতে হবে আর সেটাই বাণিজ্য।
- এটা ঠিকই, কৃষি এবং বাণিজ্য এ দুটো বহুদিন ধরেই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মার্ক্সের অর্থনীতি ও কি এর বাইরে কিছু বলে?
- হ্যা বলে, উৎপাদনী শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্ক মিলে হলো উৎপাদন ব্যবস্থা। আর উৎপাদনী শক্তি হচ্ছে কাজ জানা মানুষ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও সেই সম্পদকে কাজে লাগানোর ক্ষমতার পর্যয়কে। অনাদিকে উৎপাদন সম্পর্ক বলতে তিনি বুঝিয়েছেন জিনিস তৈরি করতে হলে মানুষে মানুষে যে সম্বন্ধ তৈরি হয় তাকে। মানুষ একা বাঁচে না। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। আর সমাজ জীবন গড়ে ওঠে শ্রম বিভাজনকে কেন্দ্র করে। সবাই এক কাজ করেনা, করে ভিন্ন ভিন্ন কাজ। কিন্তু এ কাজের মধ্যে গড়ে ওঠে একটা সাধারণ সম্পর্ক। তা না হলে অর্থনৈতিক উৎপাদন পড়তে চায় অচল হয়ে...। কি›ত্ত তোমাকে আমি এসব কেন বলছি?
- বলছিস এজন্যে যে তুই নিজেই নিজের কথার জালে আটকা পড়ছিস।
- এই যে আমরা বীজ উৎপাদন করে দিচ্ছি , এটাকে কি কাজ ভাগ করে নেয়া বলে না?
- না বলে না, আর কেন বলে না সেটা আগেই বলেছি। আই ডোন্ট রিপিট।
- বুঝতে পারছি এখন তোকে বোঝানো যাবে না তোর মাথাটা গরম হয়ে আছে। জয় তুইতো এখনো বেকার তাই না?
- হ্যা কেন? তোমাদের ওখানে চাকরি দেবে নাকি? লিসেন অর্ণবদা, ওসব চাকরি আমি করি না।
- ওসব চাকরি সবাই পায় ও না।.. যাক সে কথা। তোকে আসল কথাটা বলি। জয়, জীবনটাতো ছেলে খেলা না। এই পুঁজিবাদি সমাজে সম্মান নিয়ে টিকতে গেলে মানি ইজ এ ফ্যক্টর। গরীব থাকার মধ্যে কোন কালেই কোন কৃতিত্ব নেই রে! র্ফাষ্ট অফ অল তোকে ভাবতে হবে এই সব জনসেবা দিয়েতো পেট চলবে না। ক্ষতি কি, যদি এমন হয় প্রথম জীবনে এসব ভাঙ্গিয়ে ভাল চাকরী হলো তারপর টাকা পয়সা বাড়ী গাড়ী ফরেন ট্যুর সব হলো । শেষ জীবনে বিদেশী সংস্থার টাকায় অর্থপুষ্ট হয়ে মানুষকে এসব সতর্কবাণী প্রচার করে অনেক বাহবা কুড়ানো যাবে এখন এসব বাদ দে ভাই!
হিমান্তিকার অবাক হবার সীমা থাকে না । তুমি এসব কি বলছ অর্ণব! তাই বলে তুমি অন্য কোনো জব পেলে না!
- তুমি কেন ঐ জয়টার মত অবাক হচ্ছো হিমান্তিকা ? আমার সব স্বপ্নের সাথেতো তুমিও জড়িয়ে আছ।
যেন একটু কেঁপে ওঠে ভেতরে ভেতরে হিমান্তিকা । চকিতে তাকায় জয়ের দিকে, কিন্তু জয়ের মুখের রেখায় কোনো পরিবর্তন নেই। তেমনি রাগী ভঙ্গীতে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে।
অর্ণব বলেই যাচ্ছে, আর তা ছাড়া কেউ যদি অস্ত্রের কারখানায় কাজ করে সে তো আর অস্ত্রবাজ হয়ে যায় না!
- সে যায় না, তবে সেটা আর এটা এক কথা নয়। তুমি এটা করতে পার না। পরিবেশবাদী আর জিএম ফুড? ইমপসিবল!
- কিছু দিন করি পরে না হয় করবো না, এটাইতো আর শেষ কথা নয়।
আর একটা কথা, তুমি বললে, তোমার সব স্বপ্নের সাথে আমিও জড়িয়ে আছি, তোমার এসব দুঃস্বপ্নের সাথে আমি কি ভাবে জড়ালাম বুঝলাম না অর্ণব।
অর্ণব কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল এমন সময় কিড়মিড়িয়ে ওঠে জয় ,ওর সাথে কি তর্ক করছিস হিমান্তিকা! ওর উদ্দেশ্যটাই তো ভাল না।
তার মানে? কি বলতে চাস তুই ।
- বলতে চাই, আমরা নিপীড়িতদের ডাকে সবার আগে সাড়া দেই তাই তোমরা বারে বারে আমাদেরকেই কলের ক্রীড়ানক এর মত ব্যাবহার কর। আমাদের রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও মানসিকতাকে পণ্য করে খোঁজ ওপরে ওঠার সিড়ি! তোরা তোদের সো কলড জনসেবায় আমাদের টেনে আনিস কি জন্য শয়তান! যত সব জ্ঞান পাপী!
এক মুহূর্তে যেন উন্মাদের মত হয়ে যায় জয়। হঠাৎ কোনো এক আদিম বাইসনের মতো বিকট শব্দ করে ঝাপিয়ে পড়ে অর্ণব এর ওপর। আর পলক পড়ার আগেই এক ধাক্কায় অর্ণব গিয়ে ছাদের রেলিং এর ওপর পড়ে.. ।
পুরনো বিল্ডিং, রেলিং নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল, ঘটনার আকস্মিকতায় টাল সামলাতে না পেরে এক নিমেষে অর্ণব নীচে কংক্রিট এর চাতালে...।
রক্তে পৃথিবী যেন ভেসে যেতে লাগলো। সেই অর্ণব যে আমাদের এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার স্বপ্ন দেখাত। বলত, স্বপ্নের আবাস ভূমি। যে এই কিছু মাত্র আগেও আমাকে নিয়ে তার জীবনের স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করেছিল। শুধুমাত্র একটা আচমকা ধাক্কা তার জীবনটাকে, তার মেধাকে তার পরিকল্পনাকে, স্বপ্নকে কোন এক অতল গহ্বর এ নিয়ে গেল যেখান থেকে আর ফিরে আসার উপায় নেই..।

১২

 

জয় ভীষণ হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল তখন, দৌড়ে গিয়ে অর্ণবদের বড়ির ল্যান্ড ফোন থেকে হসপিটালে ফোন করে এ্যাম্বুলেন্স চেয়ে..।

এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই জয় হিমান্তিকার হাত ধরে এক নিমেষে ও বাড়ি থেকে কখন রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে,কেউ দেখেনি। কাজের লোকটাও হয়তো বাড়ী ছিল না তখন । হিমান্তিকার সারা শরীরে একটা অদৃশ্য কম্পন যেন ঝাঁকুনি দিয়ে যাচ্ছিল।  ভেতরটা বার বার গুলিয়ে উঠছিল। সেই অবস্থাতেও জয় শক্ত করে তার হাত ধরে রেখেছিল। ওরা দুজনেই খুব দ্রুত রাস্তা পার হচ্ছিল কোন ট্রাফিক সিগনাল না মেনেই। রাস্তার দুদিক থেকেই সাঁ-সাঁ করে বাস, কার, ট্যাক্সি, অটোরিক্সা আসছিল যাচ্ছিল। এরই মধ্যে একটা গাড়ি প্রায় ওদের চুল ছুঁয়ে চলে গেল, তার খানিক  দূরত্বে যে গাড়িটা ছিল সেটা হার্ড ব্রেক করে থেমে গেল। ব্রেকের শব্দে রাস্তা জুড়ে একটা গুঞ্জন উঠলো। ড্রাইভার একটা অশালীন মন্তব্য ছুড়ে দিল- বলল, প্রেমে অন্ধ হইয়া গেছে!

অন্য সময় হলে জয় কি করতো জানি না, কারণ ও খুব সহজেই রি-এ্যাক্ট করে। এই নিয়ে অনেক সময় ওর বন্ধুদের বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। কিন্তু এবার সে কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাল না। কিছুই শুনতে পায়নি এমন ভঙ্গিতে আইল্যান্ডে এসে দাড়াল। উল্টো দিক থেকে একটা খালি সিএনজি ট্যাক্সি আসতেই জয় একেবারে পথ রোধ করে দাড়াল তার।

- যাবেন?

- কোথায়?

- আপনি যেখানে যেতে চান সেখানেই। আমাদের কথায় তো আর আপনারা চলেন না! জয়ের বলার ভঙ্গিতে প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গের সুর।

 

ট্যাক্সি ড্রাইভার এবার বিগলিত হাসি দিয়ে বলে, উত্তরা গেলে যাইতে পারি। আমি ঐ দিকেই যামু।

ওরা নিঃশব্দে ট্যাক্সিতে উঠে বসে।

উত্তরা পৌছে ওরা আবার অন্য একটা ট্যক্সি নিল বাড়ী ফিরবে বলে। সারা পথ কোন কথা হয়নি ওদের । ভেতরে ভেতরে অজানা ভয়ে উত্তেজনায় কাঁপছিল দুজনেই। রাস্তার ট্রাফিক পুলিশকে ও ভয়ংকর লাগছিল সেদিন। বাড়ী ফিরে হিমান্তিকার জ্বর উঠে যায় ১০৩ ডিগ্রী।

একটা শুন্য পৃথিবী প্রতিনিয়ত পাক খেয়ে যায় চোখের সামনে। কালো আকাশ লাল সমুদ্র নিয়ে। ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকে সে। ধীরে ধীরে হিমান্তিকার যেন এক গভীর অন্ধকার কূয়ায় ডুবে যাওয়ার অনুভূতি জাগতে থাকে, যার ঠান্ডা পানি তার সারা গায়ে সূঁচ ফোটাতো।

 

এরপর হিমান্তিকার কাছে প্রশ্ন করে সেই অদৃশ্য কন্ঠস্বর। এরপর কি হলো হিমান্তিকা?

হিমান্তিকা ধীরে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, ...এর কিছুদিন পরে একদিন আমাকে একটা মেইল করেছিল জয়। যেখানে লেখা ছিল,

 

হিমিকা,

 

শুরুতেই তোর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। শুধু তোর কাছে, অন্য কারো কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবার প্রয়োজন হয়তো পড়বে না, কারণ অর্ণবদার বাবা মা তো কবেই পরপারে চলে গেছেন। জানি অনেক বড় পাপ করেছি অজানতে। তুই যেমন জানিস আমিও জানি ওটা ছিল একটা দুর্ঘটনা। তারপরও যেহেতু পাপ করেছি প্রায়শ্চিত্ত তো আমাকেই করতে হবে তাই সেখানে যাচ্ছি সেই সব ভাগ্যপীড়িত মানুষের কাছে । পৃথিবীটাকে আমরা বাসযোগ্য করতে চেয়েছিলাম। অন্যদের কথা জানি না, তুই তো চেয়েছিলি। তুই যাকে বলতিস স্বপ্নের আবাস। ভাবছিস হলো না কোন কিছুই কারো জন্যে থেমে থাকে না হিমিকা! জানি আর কেউ যাবে না, তবে স্বপ্ন যারা দেখে সেই স্বপ্ন স্বার্থক করার দায়ও তাদের ওপরেই বর্তায়। তাই কেউ না গেলেও আমাকে যেতে হবে সেখানে । প্রায়শ্চিত্তের এর চেয়ে উত্তম পন্থা আর কিছু খুঁজে পাইনি। ভালো থাকিস, ভালোবাসা নিস, হৃদয়ের সকল ভালোবাসা তোর জন্যে। তুই না চাইলেও তোরই জন্যে। আর কবিতাটা তোর জন্য-

 

'' আমিতো ভিক্ষুকের মতো চেয়েছি তোমাকে..

আমি- যার পদতলে লুটায় মাঠির পৃথিবী

আমি- যার মুঠোয় ভরা থাকে গুড়ো হয়ে যাওয়া মুক্তো

                         আর ধুলো হয়ে যাওয়া সোনা-

আমি-যে দাঁড়ায় সমুদ্রে জলের মুকুট পরিহিত

         যে চলে বিদ্যুৎ মেঘে মেঘে তরবারির মতো..

সেই আমি, যে আড়ালকে বলে দাঁড়াও, একটু আমার জন্য, তোমার ভিতরে ঢুকে বলব নিজেকে, জানো আমার পথেও সব খোয়া গেছে এক পেছনের ঘুমের দেশে বয়ে.. জানো আড়াল, কি করে হাহাকার করে ফিরছি আমি!...

আমি ভিক্ষুক হয়ে দাড়িয়ে আছি তোমার সকাশে

                              তোমার দরজায়

যে কোনো মূল্যে কিনে নিতে পারো, জেনে রেখ

                                      শুধু তুমি!...''

 

পৃথিবীটা যেহেতু   গোল দেখা হয়ে ও যেতে পারে কোনো এক দিন ॥

ভালো থাকিস...

 

জয়।

 

হিমান্তিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ঘর নিস্তব্ধ। ঘড়ির কাঁটার শব্দ স্পষ্ট।

- জানো, এই যে বাক্যটা, হৃদয়ের সকল ভালোবাসা তোমার জন্যে এই বাক্যটা দিয়েই শুরু করা একটা নামহীন চিঠি ছিল আমর জীবনের প্রথম প্রেম পত্র । তখন আমি সদ্য কৈশোর পেরিয়েছি। মানুষ হয়তো প্রথম প্রেম পত্রের ভাষা কখনো ভোলে না। জানিনা এমন একটা সিচুয়েশান ক্রিয়েট না হলে আমিও ভুলে যেতাম কি - না। আর এই কবিতাটা -এই কবিতাটা পেয়েই আমি একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হলাম। ঠিক তখন থেকে আমার মনে আর কোনো সন্দেহ রইল না যে, ঐ বিশেষ মেইলগুলো সব জয়ের পাঠানো।

- কিন্তু তুমি কি করে এতোটা নিশ্চিত হলে?

- কারণ এই কবিতাটা এবং সুনীল সমুদ্র নামের ই-মেইল আইডি থেকে পাঠানো সব কবিতাগুলো একজন কবির লেখা। কবি জয়ন্ত ভৌমিকের। তখন আমি ব্যাপারটা খেয়াল করিনি কিন্তু পরে খেয়াল হলো। আর ঠিক তখনই আমার মনে হলো, তাহলে কি জয়!

 

যেহেতু আমি ঐ কবির খুব ভক্ত তাই জয় ওকে একদম সহ্য করতে পারত না। সব সময় আমাকে ক্ষ্যপানোর চেষ্টা করত বলত, যে কবি রাজনৈতিক কবিতা লেখে না সে কোনো কবিই না। তোর মতো একটা মেয়ে কী করে যে এমন একজন কবিকে... হা-হা-হা! কথা শেষ না করে ঝড়ের বাতাসের মতো হেসেই উড়িয়ে দিতে চাইত সব। জানেন ডক্টর, জয় একমাত্র জয়ই এমনটা করতে পারে আমার জন্য। হিমান্তিকাকে ভালোবেসে জয় সব করতে পারে। নিজের সব ভালোলাগাকে ওর ভালোলাগার জন্য বিসর্জন দিতে পারে। এমন কি আশ্রয় চাইতে পারে অপ্রিয় কবির কাছেও।

 

তবে জয় এর ওপর এই প্রথম আমার সন্দেহ হতে লাগলো; তবে কি সে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়েই অর্ণব এর সাথে এমনটা করেছে? না কি শুধুমাত্র আমার সামনে ওকে ছোট করতে চেয়েছিল? এই সব নানা প্রশ্ন আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল প্রতিদিন। কিছুতেই নিজেকে আর নিরপরাধী ভাবতে পারছিলাম না। সবাই অর্ণবের এই মৃত্যুকে অ্যাকসিডেন্ট হিসেবে দেখলেও আমি, একমাত্র আমি বিষয়টা নিশ্চিত হতে পারছিলাম না।

জয় আমার বন্ধু, আমি কোনোভাবেই ওর ক্ষতি হোক চাইনি, আবার নিজেকেও ক্ষমা করতে পারিনি। একটা অপরাধবোধ আমাকে কুরে কুরে খেয়েছে এবং সেটা এত ভয়াবহ হবে আমি বুঝতে পারিনি। শুধু মনে হতো কেন অর্ণবকে সেদিন হসপিটালে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত থাকিনি? ও হয়তো বাঁচতেও পারতো। যদিও তার মাথা ফেটে....!  হিমান্তিকা কথা শেষ করতে পারে না ডুকরে কেঁদে ওঠে, ওর দু চোখে জলধারা এই প্রথম দেখছেন ডাক্তার সিদ্ধার্থ।

 

কিছুক্ষণ পরে স্বাভাবিক হয়ে আবার বলতে শুরু করে, এরপর চাকরিটা ছেড়ে দিলাম, মানুষের সাথে মেশা বন্ধ করে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলাম দিন দিন। কিন্তু কোন কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না অবশেষে নিজেকে আর বহন করতে পারছিলাম না তাই ভাবলাম ..! তার পর তো এখানে.. ..।

- আর জয়?

- সেই যে চলে গেল! জয় এর আর কোন খোঁজ পাইনি। হয়তো ওর বাকী জীবনটা কোন কথিত অ্যাক্টিভিস্টদের মতোই   কাটবে। ওর মত ডেডিকেশন আর কারো মধ্যে দেখিনি। তাই হতে পারে সে হবে চে-গুয়েভারা মত কেউ। যে নিপীড়িতের  জীবনধারাকে বদলে দেবে। অন্তত চেষ্টা করবে। এখন আর কারো ব্যক্তিত্বকেই খাটো করে দেখার মত ইমম্যাচিওরিটি আমার নেই.. .. ..।

আর তুমি, যেতে চাওনা সেখানে?

জয় চাইলে নিশ্চয়ই যাবো। আমি শুধু ওর ডাকের অপেক্ষায় আছি।

- আর খুনের ব্যাপারটা...?

- না! প্রায় চিৎকার করে ওঠে হিমান্তিকা । ও খুন করেনি আমি জানি। আর ওটা ও ইচ্ছে করেও করেনি। একমাত্র আমিই জানি ওটা একটা অ্যাকসিডেন্ট ছিল। নিছক দুর্ঘটনা। এবং এটা এখন আমি বিশ্বাসও করি।

- তাহলে তুমি কেন কষ্ট পাচ্ছ ?

- পাব না! আমি মানুষ যে ডক্টর।

- কিন্তু তুমিতো কোনো অপরাধ করনি।

- হয়ত!  তবে হ্যা এখন থেকে সেটাই আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে চাচ্ছি।

 

এবার বলতে শুরু করেন ডাক্তার সিদ্ধার্থ, হয়তো হিমান্তিকাকে তীব্রভাবে ভালোবাসার পর জয়ের অন্যদের প্রতি ভালোবাসার বোধগুলো ভোতা হয়ে গিয়েছিল। তবে ট্র্যাজিক দিক কি জানো হিমান্তিকা তুমি ওর প্রেমটাকে ঠিকঠাক মতো বোঝোইনি কখনো।

- হ্যা, হয়তো ও আমাকে বোঝাতে চেয়েছে কিন্তু আমি বুঝতে চাইনি। কারণ ভালোবাসা এমন এক তরঙ্গ বা অনুভূতির নাম যা বোঝা যায়। সব সময় বলা লাগে না। আর তাই বুঝতে না পারার মতো অতটা ইনসেন্সিবল মানুষও আমি নই। বুঝতে চাইনি এজন্য যে, আমি হয়তো ওর মতো কাউকে চাইনি আমার জীবনে। আর সেই না চাওয়াটা, ওর ভেতরের ওকে চিনতে না পারাটাই ছিল আমার জীবনের সব চেয়ে বড় ভুল।

 

এরপর একটা হালকা আলোয় ভরে গেল ঘরটা । হিমান্তিকা দেখলো দূরে বসে আছেন ডাক্তার সিদ্ধার্থ।

- আজ আমার অনেক অস্বস্তি কেটে গেছে ডক্টর! ভীষণ হালকা বোধ করছি নিজেকে।

 

ডাক্তার এর ঠোঁটে মিষ্টি হাসির রেখা তিনি এখন কিছু বলবেন তার এই পেশেন্টকে- যে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনে প্রবেশ করতে চলেছে।

 

...............
 

        © লেখক