নম্রমালিকা উপাখ্যান

ইমন জুবায়ের



মাস কতক হইল, শ্রাবস্তী নগরের ঐশ্বর্যবান শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় মনে মনে দারুণ ক্লেশ ভোগ করিতেছে। সে বণিকের ধর্ম ভুলিয়া গিয়া দিনমানে শ্রাবস্তী নগরে সাধুসন্তগনের ন্যায় ঘুরিয়া বেড়ায়, অধিকরাত্র করিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসে, কোনও কোনও রাত্রে বাড়ি ফিরিতেও ভুলিয়া যায়; তাহার পরিধেয় পরিচ্ছদ শতছিন্ন হইয়া গিয়াছে, তাহার শ্যামল রঙের গাত্রবর্ণ আরও অধিক কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করিয়াছে; তাহার মাথায় জট ধরিয়াছে, চোয়ালখানি ভঙ্গুর দেখায়, চোখের কোণে ধূসরবর্ণের ঘন কষ জন্মিয়াছে। শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় মধ্যবয়েসি বলিয়া দিনমানে রৌদ্রদগ্ধ শ্রাবস্তী নগরের পথে পথে আর অলিতেগলিতে ঘুরিয়া ঘুরিয়া শারীরিক ক্লেশও ভোগ করে বৈ কী।
তাহার মনোবেদনার হেতু- শ্রাবস্তী নগরের এক অপরুপা ভিক্ষুণী । ভিক্ষুণীর নাম নম্রমালিকা।
নম্রমালিকা বয়সে তরুণীই হইবে। নারীসাধিকার ধূসর আভরণে ভিক্ষুণীটির রুপলাবণ্য ঢাকা পড়ে নাই বরং দ্বিগুণ-চর্তুগুণ হইয়া বৃদ্ধি পাইয়াছে। শ্রাবস্তী নগরে তরুণী ভিক্ষুণীটি সদ্য আসিয়াছে- যে বৎসর বুদ্ধ মগধ হইতে জেতবনে আসিলেন, সে বৎসরই ভিক্ষুণী নম্রমালিকা শ্রাবস্তী নগরে আসিয়াছে। তাহার পর বুদ্ধ শ্রাবস্তী নগর ছাড়িয়া চলিয়া গেলেও ভিক্ষুণীটি কী মনে করিয়া যায় নাই । সে যদি শ্রাবস্তী নগর ছাড়িয়া চলিয়া যাইত তো বেশ হইত-মধ্যবয়েসে পৌঁছাইয়া ক্লেশ সহ্য করিতে হইত না: শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় এইরুপ ভাবে বৈ কী।
ভিক্ষুণী নম্রমালিকা কেন ভিক্ষুণী হইল এই প্রশ্নেও শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় দিশাহারা, উদভ্রান্ত।
শ্রেষ্ঠী সঞ্জয়-এর অগাধ সম্পদ-সে তাহার অতুল বৈভব দিয়া কি করিবে? সমূদয় বিত্ত সে অচিরাবতীর জলে বিসর্জন দিবে? বৎসর দুই হইল শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় বিপত্নীক হইয়াছে। তরুণ বয়স হইতেই শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় এর ধর্মে মন ছিল, স্ত্রীবিয়োগ ঘটিলে ধর্মে মন দিল। এমনিতেই সে নির্লোভ ও সৎচরিত্রের -তাহা সত্ত্বেও একদিন ধর্মশালায় নিজ হস্তে সাধুগনকে খাওয়াইবার কালে এক অপরুপা ভিক্ষুণী কে দেখিয়া অবশ হইয়া পড়িল। হলুদ রঙের কষায়বস্ত্র ভেদ করিয়া অপরুপা ভিক্ষুণীর লাবণ্য টলটল করিতেছিল; তাহার দহনে তাহার পর হইতে শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় ক্লেশ ভোগ করিয়া আসিতেছে। শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় সর্বদা সহস্রাধিক সশস্ত্র ভৃত্য পরিবৃত হইয়া থাকে; তাহার অঙুলি হেলনে শ্রাবস্তী নগরে লঙ্কাকান্ড ঘটিয়া যাইতে পারে, তাহার অনুগত অনুচরেরা অনায়াসে ভিক্ষুণী নম্রমালিকাকে হরণ করিতে পারে; হরণ করিয়া নগরের উপান্তের আম্রকুঞ্জের গহীনে প্রমোদভবনে লইয়া যাইতে পারে। নাঃ, তাহা সে করিতে পারে না। সাধারণ গৃহিণী হইলে অপহরণ করিবার কথা ভাবা যাইত, কিন্তু, সাব্ধী ভিক্ষুণী কে কি করিয়া হরণ করে? বুদ্ধ এখনও আর্যাবর্ত্মে বাঁচিয়া আছেন এবং আর্যাবর্তের রাজন্যবর্গ তাঁহাকে অসীম শ্রদ্ধা করে। বুদ্ধনিয়ন্ত্রিত সাব্ধীসংঘের কোনওরুপ অপমান হইলে রাজন্যবর্গ ক্রোধে অন্ধ হইয়া যাইবে না?
শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় বিষম বিপদেই পড়িয়াছে।
তাহা ছাড়া ভিক্ষুণী নম্রমালিকা কে মনের আপন অনুরাগের কথা খুলিয়া বলিতে পারিতেছে না। একজন সংসারত্যাগী নারীর নিকটে মনের আপন অনুরাগের কথা খুলিয়া বলিলে ছোট হইয়া যাইবে না সে? তাহার অহংকার ধুলায় লুটাইবে। ভিক্ষুণী নম্রমালিকা তাহার বলবীর্য বিত্তবৈভব দেখিয়া কাছে আসিবে না। হায়, সে যে সাধিকার জীবন বাছিয়া লইয়াছে!
 

শ্রাবস্তী নগরের পথেঘাটে ঘুরিয়া ঘুরিয়া শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় এর বিমর্ষ ম্লান দিনগুলি অতিবাহিত হইতেছে।
একদিন মধ্যাহ্নবেলায় শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় ভিক্ষুণী নম্রমালিকার সন্ধানে হাঁটিতে হাঁটিতে শ্রাবস্তী নগরীর উপান্তে চলিয়া আসিল। গ্রীষ্মকাল বলিয়াই খরতাপে বায়ু উষ্ণ হইয়া ছিল। রৌদ্র চিতাকাষ্ঠের অগ্নির ন্যায় উজ্জ্বল হইয়া ছিল। শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় ক্লান্ত ঘর্মাক্ত হইয়াই হাঁটিতেছিল। নিকটেই একটি পুস্করিণী চোখে পড়িল বটে তবে পুস্করিণীর পাড়ে একটি হরীতরী বৃক্ষের নীচে এক প্রবীণ সাধু বসিয়া ছিল দেখিয়া সে কৌতুহলী হইয়া উঠিল। কোনও সাধুর সঙ্গে কথা বলিয়া এই প্রথম তাহার মনের ভার লাঘব করিবার কথা ভাবিল।
সে আগাইয়া যায়।
উত্তপ্ত রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনের হরীতরী বৃক্ষের সুনিবিঢ় ছায়ার নীচে উপবিষ্ট মুন্ডিত মস্তক সাধুর কাঁধে একখানি কৃষ্ণ বর্ণের উত্তরীয় দেখিয়া সাধুটিকে শ্রেষ্ঠী সঞ্জয়ের মহাকালিক বলিয়া বোধ হইল। মহাকালিকগন মহাকালের ধ্যান করে; তাহারা কেবলমাত্র ছাগদুগ্ধ ও হরিৎবর্ণের উদ্ভিদ ভক্ষন করিয়া বাঁচিয়া থাকে। উপরোন্ত মহাকালিকগন সংগীতের ঘোরবিরোধী; কেননা, সংগীত মহাকালের শাশ্বত-তরঙ্গের ঐক্যটি বিনষ্ট করে!
শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় সাধুটির সম্মুখে আসিয়া বসিল। সাধুর মুখোশ্রী তাম্রাভবর্ণের এবং শ্বেত তিলকলিপ্ত । শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় কোনওরুপ সঙ্কোচ না করিয়া ভিক্ষুণী নম্রমালিকাবিষয়ক তাহার মনোবেদনার কথা সমস্ত খুলিয়া বলিল। প্রবীণ সাধুটির নাম চন্দ্রকান্ত ; সে সঞ্জয়ের একপাক্ষিক প্রণয়পর্বের সমস্ত বৃত্তান্ত মনোযোগ দিয়া শুনিল। তাহার পর ক্ষাণিক ভাবিয়া বলিল, জীবনে দুঃখকষ্টের অবসান ঘটানোই বোধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির মোক্ষ। তুমি কামলোভের তাড়নায় মোহগ্রস্থ হইয়া পড়িয়াছ বলিয়াই মনোবেদনা পাইতেছ। এরুপ মোহঘোর সম্পূর্নরুপে কাটাইয়া উঠা বড়ই কঠিন।
শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় নিরুপায় হইয়া মাথা নাড়িল।
সাধু চন্দ্রকান্ত বলিল, তুমি বরং সন্ন্যাসী হইয়া যাও না কেন? তা হইলে বৃথা মনঃকষ্টে ভুগিবে না।
শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় তৎক্ষাৎ বলিয়া উঠিল, আমার গৃহীর স্বভাব, সন্ন্যাস আমার জন্মের বীজে নাই। আমি সন্ন্যাস লইলে গুড়ে বালি পড়িবে না?
হুমম। বুঝিয়াছি। বলিয়া প্রবীণ সাধু চন্দ্রকান্ত ক্ষণকাল নিশ্চুপ হইয়া রহিল। অদূরে একখানি গাভী ডাকিল, চৈত্রের বাতাস খড়কুটা উড়াইয়া নিয়া গেল, পুস্করিণীর পাড়ে একজন মধ্যবয়স্কা রমনী আসিয়াছিল, তাহার জল প্রক্ষপনের মৃদু শব্দ উঠিল। পুস্করিণীর পাড়ের সড়কের উপর দিয়া একখানি রাজকীয় রথ চলিয়া গেল। সেই দিকে একবার দৃকপাত করিয়া সাধু চন্দ্রকান্ত বলিল, দেখ বৎস, তুমি নারীটিকে পাইলে ক্ষণকালের সুখ লাভ করিবে বটে তবে তাহার পর মোহ কাটিয়া গেলে দীর্ঘকাল বিষাদ ভোগ করিবে। অহেতুক জীবনে বিষাদ টানিয়া আনিবে কেন? তুমি বরং নারীটিকে দূর হইতেই দেখিবার অভ্যাস কর, তাহার সঙ্গে মানসিক প্রনয়ে লিপ্ত হওয়া তোমাদের গৃহীদের পক্ষে তাহা দোষের নয়, এইভাবে কাল্পনিক তৃপ্তি লাভ কর।
প্রবীণ সাধু চন্দ্রকান্ত এই সমস্ত অনেক কথা কহিল।
সাধু চন্দ্রকান্তর কথায় শ্রেষ্টী সঞ্জয় সন্তুষ্ট হইল।
সে উঠিয়া দাঁড়াইল।
সে আবার রাজপথে হাঁটিতে হাঁটিতে ভাবিল সে আর নম্রমালিকার নিবিড় সান্নিধ্য কামনা করিবে না, তাহার পিছুও লইবে না। সে কেবল দূর হইতে মনশ্চক্ষে নম্রমালিকার সৌন্দর্য লাবণ্য আস্বাদ করিবে, কখনও ছুঁইয়া দেখিতে যাইবে না। আজই সে অচিরাবতীর শান্ত জলে স্নান-অবগান প্রভৃতি নিষ্পন্ন করিয়া আপন গৃহে ফিরিবে। আর নিছক নারীর মূর্তরুপের পিছনে ছুটিবে না; বরং কল্পনারীতে মনস্থির করিয়া সুপ্ত কামনা চরিতার্থ করিবে।


সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইলে শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় অচিরাবতীর তীরে আসিয়া দাঁড়াইল।
গোধূলি লগ্ন অতিক্রান্ত হইলে নদী তীরে অন্ধকার ঘনাইয়া উঠিয়াছিল। এখন সপ্তমীর চাঁদের ক্ষীণ আলোয় অন্ধকার ঈষৎ দূরভীত হইয়াছিল বটে তবে নদীর জল সম্পূর্নরুপে দৃশ্যমান হয় না। বাতাস উত্তাল হইয়া এই পরিবর্তিত পুরুষটিকে ঘিরিয়া ধরিল, যেন তাহাকে নদীবক্ষে টানিয়া ফেলিয়া দিবে। শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় ঈষৎ হাস্য করিল। সে জানে, ঈশ্বর এইভাবেই প্রকাশিত হন, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে ক্ষণে বায়ূর রুপ ধরিয়া আসেন। এই সমস্ত ভাবিয়া শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছিল। কখন যে ভিক্ষুণী নম্রমালিকা নির্জন ঘাটে আসিয়া দাঁড়াইল সে টের পাইল না। ভিক্ষুণী নম্রমালিকা নম্রস্বরে বলিল, শ্রেষ্ঠী?
শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় চমকাইয়া উঠিল না। বরং নম্র স্বরে বলিল, বলুন।
আমি কাল প্রভাতে নগর হইতে চলিয়া যাইব।
শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় চুপ করিয়া থাকিল। বায়ুরুপী ঈশ্বরের কথা ভাবিল। এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলিল। নদীপাড়ের বাতাস ততক্ষণে আরও অশান্ত হইয়া উঠিয়াছে।
আপনার জানিতে ইচ্ছা হয় না আমি কোথায় যাইব?
শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় চুপ করিয়া থাকিল। বাতাসের স্পর্শ বড় মধুর লাগিতেছে।
আপনি কিছু বলিতেছেন না। তাহা হইলে আমি কি চলিয়া যাইব?
শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় চুপ করিয়া থাকিল। সে বিস্মিত হইয়া ভাবিল, আজ কতকিছু ঘটিয়া যাইতেছে, দীর্ঘকাল কিছু ঘটিতেছিল না। তাহার মহাকালিক সাধু চন্দ্রকান্তর তাম্রাভবর্ণের তিলকলিপ্ত মুখোশ্রী স্মরণ হইল।
শ্রেষ্ঠী? আমার উপস্থিতি কি আপনার কাছে অসহ্য বোধ হইতেছে?
শ্রেষ্ঠী সঞ্জয় চুপ করিয়া থাকিল। রাত্রির আকাশে টি টি শব্দ করিয়া কী এক পক্ষি ডাকিয়া গেল ; দুপক্ষ চুপ করিয়া শুনিল। অচিরাবতীর জলে ঢেউ, নদীর জলের রং ক্রমশ উজ্জ্বল হইয়া উঠিতেছিল যতই দিগন্তরেখার ওপরে চাঁদটি পূর্ণবয়স্ক হইয়া উঠিতেছিল...
নম্রমালিকা বলিল, আমি আমার জীবনের উপাখ্যানটি আপনাকে বলিতে চাই শ্রেষ্ঠী?
আমি শুনিব না। এক্ষণে কথা কহিতে পারিল শ্রেষ্ঠী সঞ্জয়।
ভিক্ষুণী নম্রমালিকা নিথর হইয়া থাকিল।
তাহার পর কতকাল যে কাটিয়া গেল ...
তাহার পর নম্রমালিকা চলিয়া গিয়াছিল, তাহার যেখানে যাইবার কথা ছিল, সেখানে। শ্রেষ্ঠী সঞ্জয়ও মনের বিষাদ টের পাইয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়াছিল। কেননা সে জানিত ভিক্ষুণী নম্রমালিকা শ্রাবস্তী নগর হইতে চলিয়া গেলে তাহার দুঃখ আরও প্রগাঢ় হইয়া উঠিবে। সে সেই দুঃখ উপভোগ করিবে বলিয়া নিজেকে সান্ত্বনাও দিয়াছিল ...
 

শেষ