একটি মা, পাহাড় ভ্রমনে বিভ্রম এবং ধ্যানমগ্ন অন্ধকারের ছাইপাখি

 

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

 

০১.
যারা পাহাড়ে গিয়েছিলো-- এক এক করে আসুক সকলে। তোরা এবং তোদের মুখের হালকা রেখা কল্পনা করতে পারি এই দিবসের শেষে। কেনো যে দিনের শেষ হয়, জানি না।
আমি অনেকদিন আর নৌকোভ্রমণে যাই নি। ভ্রমণের মধ্যে এক প্রকার বিভ্রমের মতো বিষয়াদি আছে।

নৌকো আর পাহাড় বিপরীত প্রস্থান। মাকে বললাম, তোর পাহাড় কেমন?
বললো, কাছে সবুজ, আর দূরে নীলাভ।

০২.
কোথাও পাহাড় আছে বৈশাখে একাকার। মাঝখানে উপত্যকার মায়া টেনে নিয়ে যেতে চায় দিগন্তের কাছে। পাহাড়ে উঠতে উঠতে একজন মানুষ কতো বছর বাঁচে? সিসিফাস উঠতো পাথর ঠেলে। সেই পাথর গড়িয়ে পড়তো, আবার উঠতো। সিসিফাস নতজানু না হয়ে এই শাস্তি মেনে নিয়েছিলো। এটা তার হিরন্ময় অহম। আমি এবং তুমি তার চিন্ময় সন্তান। আমরাও পাথর ঠেলে পাহাড়ে উঠি, পাথরের সাথে গড়িয়ে পড়ি। এইসব সংগঠন শিখে ফুরিয়ে যাই না।
আমার আর ঘোর ভাঙে না। যারা পাহাড়ে আগুন জ্বালায়, যারা ঘোর পূর্ণিমায় জল এনে ভিজিয়ে রাখে উঠান আর বারান্দার কারুকাজ, যারা দুরন্ত বৈশাখে বনে বনে ঘুরে ঘুরে জ্বালায় চোখের বৃক্ষ, যারা গাছ আর আগাছার নিবিড় রাখীবন্ধন-- আমি তাদেরই একজন। আমাকে যদি চিনতে না পারো তবে ফিরে যাও অলিখিত গুহার ভিতর। ওখানে সূর্য গিয়ে তোমাকে ডেকে নেবে একদিন, খুব ভোরবেলা।
ভোরের অবসান হয়, অন্ধকার পুড়ে ছাইপাখি হলে আমরা প্রত্যেকে সিসিফাসের নিয়তি মেনে নিই দুবাহুতে।

আর একটি মা জননী হয়ে উদাস চোখে আমাদের আরোহণ আর অবরোহণ অবলোকন করেন।

০৩.
শৈশবের পাহাড় ছিলো আমার মা। শৈশবে আমার মায়ের মুখ মনে পড়ে না কিছুই, মনে পড়ে না কেমন ছিলো যুবতি মায়ের মুখের রেখা।
আমরা দূরের একটা পাহাড়ের গুহায় থাকতাম, পাহাড়ের পায়ের কাছে দিঘি ছিলো একা।দিঘিতে স্নান করতে নেমে দুপাটি ঝিনুক তুলে আনতাম প্রতিদিন, ঝিনুকে নাম ছিলো কেবলই ঝিনুক। মা বলতো, এর বুকে মুক্তো থাকে।
প্রতিদিন খুলতাম, বালি থাকতো, বালি আর বালি। বালিকে পরিণত তাপ ও চাপ দিলে মুক্তো হয়, নাকি কাঁচ হয় আর জানতে ইচ্ছে করে না।
মা, মুক্তোর রঙ কী?
রঙ নাই।
তার মানে তুইও দেখিস নি।
না দেখলেই কী! যেমন নাম দিবি তেমন।
তুইতো বুড়ো রবীন্দ্রনাথ, শুধু দাড়ি নাই, এই যা।

মায়ের চোখ ছলচ্ছল করে তাকিয়ে থাকে পাহাড়ের ওপারে, অনেক দূরে।

০৪.
সব দুডানা উড়ে যায় দূরে। একটি শাদামেঘ ভাসে একা; পাহাড় এবং আমি কখনো কান্ত হই না পরস্পরকে খুঁজে খুঁজে।
একটা পাহাড়ের গল্প বলি। আমি গিয়েছিলাম। অনেক উচু পাহাড়। দুইহাজার ফিট অথবা সাতশো ফিট এইজাতীয়। পাহাড় রক প্রথমে উঠতে দিতে চান নি। পরে বললেন, বয়স কম, উঠে যেতে পারবেন।
আমার মুঠোর মধ্যে একটি পাতাবাহার ছিলো ভয়ানক আত্মবিশ্বাসী। অর্ধেক উঠে আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। পাতাবাহার আমাকে বুকে চেপে ধরে বাতাস থেকে খুলে খুলে আনছিলো মাইল মাইল অক্সিজেন। আর এইচ-টু-ও জাতীয় কিছু। আমার ঘুমের মতো বিভ্রম হচ্ছিলো, সবকিছু ভুলে গিয়ে আবারও মনে পড়ছিলো।
আহা সুন্দর আহা সুন্দর, তুমি তো পাতাবাহারের দেশে নিয়েছো শরণ। পাহাড়টির পাদদেশে যেহেতু ঝর্ণার উদ্ধত পতন ছিলো-- আমরা ভেবেছি তার বিনম্র উৎস দেখে ফিরে যাবো রূপকথার ভিতর। আমরা রূপকথার থেকে এসে দেখলাম আমাদের ঘরের হাড়গোর কারা যেনো সেঁটে দিয়েছে জলের ধার ঘেঁষে উত্থিত পাহাড়ের পাঁজরে।
তুমি কি ভাবছো মদ খেয়েছি? নাহ্, ওসব প্রাচীন ওষুধে কী আর হবে!

দূর থেকে আমার মা সবকিছু জেনে গিয়ে জানলায় তাকিয়ে থাকেন। মনে মনে আমাকে বলেন, তোর চুলটা এতো বড় হয়েছে কেনো রে?

০৫.
সে আমাকে অনেকদিন পাহাড়ে নিয়ে গিয়েছে। নিমফুলের রঙ চিনিয়ে তারপর বলেছে, যাই।
কোথায়?
জানি না।
কেনো এসেছিলে?
হাওয়া এসেছিলো।
সে আমাকে বলেছে পাহাড়েরও ডানা থাকে। আমি অবাক হয়ে তার চোখের ভিতর তাকাতে গিয়ে দেখি ডানার বিস্তার।
পাহাড়ের ডানা থাকে কীভাবে আবার?
উড়ে গেলে দেখতে পাবে।
কবে উড়ে যাবে?
অন্ধকার দেবদারু হয়ে দাঁড়িয়ে থেকো, দেখতে পাবে।
উড়ে গেলে ঝর্ণাগুলি সব পালক হয়ে ঝরে পড়বে রোদের করতলে!
যাই।
কেনো?
আমি পাহাড় হবো। আমার মাংসের ভিতর রোদ জেগে আছে।
রোদ বুঝি তোমার সেই ডানার বীজাণু?
সে নিরুত্তর। শুধু একটু হেসে চুপ। একটু আনমন জলপাই বন। একটু হরিতকীর ঘ্রাণ তাকে ঘিরে থাকে।
তারমানে তোমারই ডানা হবে?
সে আমার চোখের ভিতর তাকিয়ে থাকে, তাকিয়ে থাকে, তাকিয়ে থাকে।
আর আমার কান্নার রঙ আছে রঙহীন। অবশেষে সে বললো, আমিই তোর মা।
মা!