গদ্য কবিতা: সূচনা, বিকাশ ও সম্ভাবনা
ফকির আবদুল মালেক
ভূমিকা
মানুষ তার আপন মনের ভাবনাকে প্রথমত শারীরিক অঙ্গ-ভঙ্গির মাধ্যমে অন্যজনের কাছে প্রকাশ করে,অত:পর নানাবিধ ধ্বনির সাহায্যে। যেহেতু ধ্বনি একস্থান থেকে অন্যস্থানে প্রতিস্থাপিত হয় ইথারের স্পন্দনের মাধ্যমে তাই সেই ধ্বনিকে একটি নির্দিষ্ট গাঁথুনিতে বেঁধে দিয়ে তৈরি করা যায় একটা রিদম। ভাষার উৎপত্তির শুরু থেকে মানুষ সৃষ্টিশীল ভাবনার এই ধ্বনিগুচ্ছ নানাবিধ গাঁথুনিতে গেঁথে অন্যজনের কাছে পৌঁছে দিত। পৃথিবীর প্রতিটি ভাষাই তাই প্রথম উদ্ভব হতে দেখা যায় পদ্যে বা গানে। মানুষের মস্তিষ্কে অন্তঃস্থিত যে মেমোরি সেল রয়েছে সেখানে শ্রুতি বা দৃশ্য দর্শনের মাধ্যমে যেসব তথ্য পাঠানো হয় তাকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে স্মরণযোগ্য করে রাখার জন্য এবং প্রয়োজনীয় সময়ে প্রকাশ করার জন্য প্রয়োজন হয় একটি সুনির্দিষ্ট গাঁথুনি বা ঘটনার পরস্পরা। একটি ছন্দময় গাঁথুনি দিয়ে বেঁধে ধ্বনিপুঞ্জকে যদি মস্তিষ্কে প্রেরণ করা যায় তবে তা মস্তিষ্ক সহজেই স্মরণে রাখতে পারে। ধ্বনিগুলোকে ক্রমাগত সাজিয়ে মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করে,কথা বলে। কিন্তু কথ্য ভাষার সকল শব্দই একটি নির্দিষ্ট রিদমে ফেলা যায় না। যে সমস্ত ধ্বনিসমষ্টি একটি নির্দিষ্ট রিদমে গেঁথে মনের ভাবকে প্রকাশ করা যায় সেই সকল ধ্বনি সমষ্টিকে ক্রমাগত সাজিয়ে পদ্য রচিত হয়, যা দ্বারা মনের আবেগকে অন্যের মাঝে সঞ্চারিত করা যায়। কিছু কিছু ভাব বিন্যাস শব্দের গাঁথুনিতে এতোটাই মাধুর্যমন্ডিত হয়ে উঠে যে, মস্তিষ্কে তা গেঁথে যায় এবং বারবার উচ্চারিত হয়ে আনন্দিত হয়।
মনের ভাবকে প্রকাশ করার জন্য বা মানুষের অভিজ্ঞতাকে অন্যের মাঝে বর্ণনা করার জন্য প্রয়োজন হয়ে উঠে রূপকের। একটি অজানা বস্তুকে বুঝাবার জন্য জানা বস্তুর সাথে বা অজানা ভাবকে বুঝাবার জন্য জানা ভাবকে রূপক হিসাবে ব্যবহার করা হয়। কখনো কখনো এই সকল রূপক শ্রুতিমধুর ধ্বনিপুঞ্জের সাহায্যে কেবল তথ্য বা খবরের সন্ধান দেয় না,তৈরী করে এক ধরনের অনির্বচনীয় আবেগ,আপ্লুত করে মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে। নির্মল আনন্দে আপ্লুত হয়ে উঠে মানুষের মন।
মানুষের মস্তিষ্কের প্রকৃতিই এমন যে,প্রথম অভিজ্ঞতায় সে যে আনন্দে ভেসে যায় তার বহু ব্যবহারে সে বিরক্ত হয়ে উঠে। তার সৃষ্টিশীলতা নতুন অভিজ্ঞতাকে প্রয়োজনীয় করে তুলে। মানুষের মস্তিষ্ক একস্থানে স্থির অবস্থান নেয়না কখনো। মস্তিষ্কের পর্যবেক্ষণ মানুষকে ক্রমে ক্রমে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যায়। নানবিধ পর্যবেক্ষণ প্রকৃতির নানা রীতিনীতকে আত্মস্থ করে মানুষ তার জ্ঞানের উন্মেষ ঘটাতে থাকে। বদলে যেতে থাকে জীবন যাত্রার মান। জটিল থেকে জটিলতর সামাজিক কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে এগুতে থাকে মানুষ। এই যে মানুষের সৃষ্টিশীলতা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম পদ্য বা কবিতা তাও নানারূপ ছন্দের পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে এগুতে থাকে। রূপকে আসতে থাকে নানা বৈচিত্র্য। ভাবে চলে আসে সমৃদ্ধি। তৈরী হতে থাকে কাব্য চেতনা। তৈরী হয় অসাধারণ ভাবের প্রকাশ শব্দের নানাবিধ বিন্যাসে। ছন্দগুলো সরলীকরণের পথ অতিক্রম করে জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে। চলে আসে মাত্রায় গাণিতিক প্রয়োগ।
বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার চেতনায় এনে দেয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন। চলে আসে লিখিত অবয়ব। যে ছন্দগুলো ধ্বনিপুঞ্জের তালের সাহায্যে এগুচ্ছিল তা-ই এক পর্যায়ে অন্য মাত্রায় রূপান্তরিত হয়। অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক,সামাজিক,বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ড পরিচালনা হতে জন্ম নেয় এক ধরনের ভাষা যাকে গদ্য বলা হয়। পরিবর্তিত পৃথিবী অনেক যুদ্ধ,প্রতিহিংসা,সামাজিক অনাচার আর বিপ্লবের মাধ্যমে এগুতে থাকে। কিন্তু মানুষের সৃষ্টিশীলতা থেমে থাকেনা। তার সৃষ্টিশীলতা প্রকাশের জন্য তৈরী হতে থাকে শক্তিশালী বাঁধন,গদ্যের বাঁধন। ভাব প্রকাশের যে মাধ্যমটি ছিলো নারীর মতো কোমল,স্নিগ্ধ, রিদমিক তা কঠিন প্রকৃতির মতো গদ্যে রূপান্তরিত হতে থাকে। তৈরী হতে থাকে এক পৌরুষদীপ্ত ফরমেট। জন্ম নেয় গল্প, ছোট গল্প, উপন্যাসের মতো শক্তিশালী মাধ্যম। পদ্যের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্বিত হয়। কল্পনাপ্রবণ মানুষ সৃষ্টিশীলতাকে নিবেদন করতে থাকে নানামুখী ফরমেটে। পদ্যের শারিরীক কোমল গঠনের কারণে যেখানে সে স্থবির থাকে আর এগুতে পারেনা,সেখানে গদ্য তার ভূমিকায় অনন্য হয়ে উঠে। মানুষ জীবনের জটিলতাকে অত্যন্ত শক্তিশালী দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা চেতনার সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে থাকে।
মানবজাতির সূচনার সেই সহজ-সরল অভিব্যক্তি ছন্দের তালে তালে যে স্পন্দিত হচ্ছিল, অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম হিসাবে সেও তার ফরমেটে পরিবর্তন নিয়ে আসে। কেননা সৌন্দর্য আর মননশীলতা প্রকাশের এই যে অনন্য মাধ্যম পদ্য বা কবিতা তার ভিতর রয়ে গেছে এক ধরনের মাদকতা যাকে কোন কালেই মানুষ হারাতে পারেনি। কবিতায় ক্রমে ক্রমে ভাষাগত ছন্দের আঁটা-আঁটির সমান্তরে ভাবগত ছন্দে উদ্ভাসিত হয়। তার শ্রাব্য সীমারেখা ছাড়িয়ে হয়ে উঠে প্রধানত পাঠ্য।যে সুনিবিড় সুনিয়মিত ছন্দ আমাদের স্মৃতির সহায়তা করে তার অত্যাবশ্যকতা হারিয়ে গেছে। একদিন খনার বচনে চাষাবাদের পরামর্শ লেখা হয়েছিল ছন্দে। আজকালকার বাংলায় যে কৃষ্টি শব্দের উদ্ভব হয়েছে,খনার এই সমস্ত বচন কৃষ্টির ছড়াকে নিশ্চিত এগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এই ধরনের কৃষ্টি প্রচারের ভার আজকাল গদ্য নিয়েছে। ছাপার অঙ্গ তার বাহন,এই জন্য ছন্দের পুঁটুলিতে ঐ বচনগুলো মাথায় করে বয়ে বেড়াবার দরকার হয় না। কাব্য,বুদ্ধির সাথে এর বোঝাপড়া নয়,একে অনুভব করতে হয় রসবোধে। আর এই কাব্য রসবোধকে সুসমন্নত রেখে শুরু হয় গদ্যে কাব্য রচনা।
গদ্য কবিতা কি ?
গদ্য কবিতা সে-ই কবিতা যা গদ্যে লিখিত হয়;অন্য কথায় পদ্য ও গদ্যের সংমিশ্রত উৎকৃষ্ট জাতীয় কবিতার নাম গদ্য কবিতা। প্রকৃতির বাস্তবতার কাব্যিক ব্যঞ্জনার নাম গদ্য কবিতা। গদ্য কবিতা প্রচীন যুগে হিব্রু স্কলারদের দ্বারা প্রথম লিখিত হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে নাম-না-জানা কয়েকজন লেখক ইংরেজীতে গ্রীক ও হিব্রু বাইবেল অনুবাদ করেছিলেন। স্বীকার না করে উপায় নেই যে,সলোমনের গান ডেভিডের গাঁথা সত্যিকার কাব্য। এই অনুবাদের ভাষায় আশ্চর্য শক্তি এদের মধ্যে কাব্যের রস ও রূপকে নিঃসংশয়ে পরিস্ফুট করেছে। এই গানগুলোতে গদ্যছন্দের মুক্ত পদক্ষেপ লক্ষণীয়। তথাপিও বলা যায় ১৮৪২ সালে প্রকাশিত হয় Aloysius Bertand-এর Gespard La nuit যা গদ্য কবিতাকে প্রথম স্বীকৃতি এনে দেয়। এর ছন্দোময় ও কাব্যিক ভাষা পরবর্তীতে অনেককে এই ফরমেটে কবিতা লেখাতে আগ্রহী করে তুলে। ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত হয় Bandelaire-এর Petis poems en Prose. অন্য লেখকদের মধ্যে Rimbond এবং Oscar Wilde, Amy Lowell এই ধারায় লেখার প্রয়াস পান। Virginia Wolf কমপক্ষে একটি উপন্যাস এই ধারায় অনুসরণ করেন যেমন করেন Gertrnde Stien- ΤTender Buttons এ। এর শুরু হয় ফ্রান্স থেকে এবং পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। সাউথ আমেরিকায় Pablo Neruda এবং Borges, রাশিয়ার Turgenev, ইতালীতে Marinetti এবং ডেনমার্কে J. B. Jacobson, উত্তর আমেরিকায় Whitman, Robert Bly, W. S. Merwin প্রমুখ এই ধারার স্বার্থক ও প্রমাণিত কবি।
গদ্য কবিতা কি কবিতা?
এই বিষয়ে তর্কের শেষ নেই। কারো মতে গদ্য কবিতা একটি বিশেষ ধারার কবিতাই বটে কেননা এটা রূপক ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। অপর কারো মতে গদ্য কবিতা গদ্য। আধুনিকবাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী T. S. Eliot গদ্য কবিতার বিপক্ষে জোড়ালো বক্তব্য তুলে ধরেন যদিও তিনি নিজে দু-একটি চেষ্টাও করেছেন এই ধারায়। বাংলা সাহিত্যের দিকনির্দেশক যিনি তার কর্মের মাধ্যমে বিশ্ব সাহিত্যে বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেছেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই প্রসঙ্গে বলেছেন -- গদ্যকাব্য নিয়ে সন্দিগ্ধ পাঠকের মনে তর্ক চলছে। এতে আশ্চর্যের বিষয় নেই। ছন্দের মধ্যে যে বেগ আছে সেই বেগের অভিঘাত রসগর্ভ বাক্য সহজে হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করে,মনকে দুলিয়ে তোলে,এ কথা স্বীকার করতে হবে। তবে ছন্দটাই যে ঐকান্তিকভাবে কাব্য তা নয়। কাব্যের মূল কথাটা আছে রসে,ছন্দটা এই রসের পরিচয় দেয় তার আনুসঙ্গ হয়ে। সহায়তা করে দুই দিক থেকে। এক হচ্ছে স্বভাবতই তার দোলা দেবার শক্তি আছে,আর-এক হচ্ছে পাঠকের চিরাভ্যস্ত সংস্কার। এই সংস্কারের কথাটা ভাববার বিষয়।
একদা নিয়মিত অংশে বিভক্ত ছন্দই সাধু কাব্য ভাষায় একমাত্র পাঙ্ক্তেয় পদ্য ছিল। তখন ছন্দে মিল রাখাও ছিল অপরিহার্য। এমন সময় মধুসূদন বাংলা সাহিত্যে আমাদের সংস্কারের প্রতিকুলে আনলেন অমিত্রাক্ষর ছন্দ। তাতে রইল না মিল। তাতে লাইনের বেড়াগুলি সমানভাবে সাজানো বটে,কিন্তু ছন্দের পদক্ষেপ চলে ক্রমাগত বেড়া ডিঙিয়ে। অর্থাৎ এর ভঙ্গি পদ্যের মতো কিন্তু ব্যবহার চলে গদ্যের চালে।
অমিত্রাক্ষর ছন্দের মিলবর্জিত অসমতাকে কেউ কাব্যরীতির বিরোধী বলে কাজ মনে করেন না। অথচ পূর্বতন বিধানকে এই ছন্দ বহুদূর লঙ্ঘন করে গেছে। কাজটা সহজ হয়েছিল,কেননা তখনকার ইংরেজী শেখা পাঠকেরা মিল্টন-শেক্স্পীয়রের ছন্দকে শ্রদ্ধা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কী হতে পারে এবং হতে পারে না,তা হওয়ার উপরই নির্ভর করে,লোকের অভ্যাসের উপর করে না,এ কথাটা ছন্দই পূর্বেই প্রমাণ করেছে। আজ গদ্যকাব্যের উপর প্রমাণের ভার পড়েছে যে,গদ্যেও কাব্যের সঞ্চারণ অসাধ্য নয়।
সবশেষে এই একটি কথা বলবার আছে,কাব্য প্রাত্যহিক সংসারের অপরিমার্জিত বাস্তবতা থেকে যতদূরে ছিলো এখন তা নেই। এখন সমস্তকেই সে আপন রসালোক উত্তীর্ণ করতে চায়, এখন সে স্বর্গারোহন করবার সময়ও সংগের কুকুরটিকে ছাড়ে না। বাস্তব জগৎ ও রসের জগতের সমন্বয় সাধনে গদ্য কাজে লাগে কেননা গদ্য সুচিবায়ুগ্রস্ত নয়।
আধুনিক কবিতা:
আধুনিক কবিতা এক আন্তর্জাতিক প্রপঞ্চ, যার নাম আধুনিকতা বা আধুনিকবাদ,যার উদ্ভব ঘটে পশ্চিমে এবং ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র গ্রহব্যাপী । রোমান্টিক আন্দোলনের পর সবচেয়ে ব্যাপক ও সফল সাহিত্য শিল্পান্দোলন আধুনিকতা বা আধুনিকবাদ,যা সারা পৃথিবী জুড়ে সৃষ্টি করেছে অসামান্য সাহিত্য ও শিল্পকলা। আধুনিকবাদ এক বহুমাত্রিক শিল্প-সাহিত্যান্দোলন,যার বিকাশ ঘটেছে নানা রূপে,নানা রীতিতে। আধুনিকবাদেরও চরিত্র হচ্ছে সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রথাগত রাষ্ট্রসীমা ভেঙ্গে ফেলা। এর স্বভাব আন্তর্জাতিকাবাদ। আধুনিকবাদের আগে পশ্চিমে,শিল্পকলার জগতে বিপ্লব ঘটেছে প্রত্যেক শতকেই,বদলও ঘটেছে সংবেদনশীলতার, কিন্তু তা কোন বিপর্যয় সৃষ্টি করেনি। ওই বদল ঘটেছে স্বাভাবিকভাবে। আধুনিকতা এসেছে এক মহা বিপর্যয় রূপে, যা আগের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে সম্পূর্নভাবে। এর স্বভাব বিপর্যয়কর।
১৮৮০ সালকে মনে করা হয় আধুনিকতার সূচনাকাল, যখন দেখা দেন প্রথম আধুনিকেরা- মালার্মে, গতিয়ে, বদলেয়ারের। পশ্চিমে এ সময়, উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে ঈশ্বরকে বাজে কথায় পরিনত করা হয়। কতগুলো বৈজ্ঞানিক হাইপোথিসিসকে কেন্দ্র গড়ে উঠা মতবাদের প্রভাবে তারা ঈশ্বর বিমুখ হয়ে পড়েন। তারা সমালোচনা করেন বুর্জোয়া সমাজের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের। চারপাশের সমাজ তাদের মনে শুধু বমনের উদ্রেক করে। তারা শুরু থেকেই ছিলেন বিদ্রোহী,শ্রদ্ধেয় ছিলেন না,তাদের লেখা অর্জন করে কেলেংকারির ও শিল্পকলায় সাফল্য। ১৯১০ থেকে ১৯২৫ সালকে মনে করা হয় আধুনিকতাবাদের শ্রেষ্ঠ সময়। এই সময়ে বিশশতক দগ্ধ হয় অপব্যয়ী আগুনে,প্রথম মহাযুদ্ধে,মেতে উঠে রক্তপাতে, যুদ্ধের পর অসীম অবিশ্বাস আর হতাশা থেকে জন্ম নেয় বিশ শতকের শিল্পকলা, যার মধ্যে আধুনিক কবিতা প্রধানতম।আধুনিকবাদের নিজের বছর হিসাবে চিহ্নিত করা হয় ১৯২২ কে যে বছর এলিয়টের পোড়ামাটি,রিলকের অর্ফিয়ুসের প্রতি সনেটগুচ্ছ,জয়েসের ইউলিসিস, লরেন্সের অ্যরন্স রড প্রভৃতি সৃষ্টি হয়।
বাংলা সাহিত্যের তিরিশের দশকের অতি আধুনিকদের মধ্যে দুজন হলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত,বিষ্ণু দে। টি. এস. এলিয়টের কাব্যভাবনা, কবিতাশৈলী ও কাব্যভাষার মধ্যে দিয়ে তাদের নির্মাণ ও সৃষ্টির প্রভাময় উদ্যানকে করে তুলেছিলেন সমৃদ্ধ। বাংলায় ১৯২৫ আধুনিকবাদ-এর সূচনা বছর। আর কয়েক বছর পরই বেরোয় পরিপূর্ণ আধুনিক চেতনা সম্পন্ন কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ। বুদ্ধদেব বসুর বন্দীর বন্দনা(১৯৩০), জীবনানন্দ দাসের ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬), অমিয় চক্রবর্তীর খসড়া (১৯৩৮)। পশ্চিমে আধুনিকবাদ আসে দীর্ঘ প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কিন্তু বাংলায় ছিলনা কোন রকম প্রস্তুতি।আধুনিকতা-পূর্ব বাংলা কবিতা সরল আবেগের কবিতা। কৈশোর বা প্রথম যৌবনের আবেগ,স্বপ্ন কাতরতা-এগুলোই প্রথাগত বাঙলা কবিতার বিষয়। আর তাই কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে যে অভিজ্ঞতা,তা সার্বজনীন অভিজ্ঞতা। তা শুধু কবির নয়,পাঠকেরও অভিজ্ঞতা। আধুনিক বাঙলা কবিতা সার্বজনীন সাধারণ অভিজ্ঞতার বদলে প্রকাশ করে কবির অনন্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা,যা অধিকাংশ সময়ই মানসিক। আর আধুনিক কবিতাকে তাই কবিরা প্রকাশ করেছেন অভিনব ভাষায় ও অলংকারে। বিশ দশকে সূচনা ঘটে যে কবিতার আর ষাটের দশকে যে ধারার কবিদের শেষ উন্মেষ সে কবিতা অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এ ধারায় প্রথম পাঁচজন হলেন জীবনানন্দ দাশ,অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত,বুদ্ধদেব বসু,বিষ্ণু দে।এ ধারায় এঁরা শ্রেষ্ঠ কবি। আধুনিক ধারার কবিরা বাংলা কবিতায় এনে দিয়েছেন সমৃদ্ধি এবং নিয়েছেন পাঠকহীনতার দুর্নাম । এই ধারার শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশই একমাত্র কবি যিনি গেঁয়ো, শব্দ ব্যবহারে অসংযমী এবং এই অঞ্চলের প্রকৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে মিশে গিয়ে গহীন ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে কবিতা লিখেছেন। আর এই কারণেই সময়ের পট পরিবর্তনের সাথে সাথে তিনি হয়ে উঠেছেন আরো গ্রহণীয়।
রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক কবিতা:
আধুনিকবাদের মূল সুর যে,প্রথাকে অস্বীকার করা তার চর্চা রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন করলেও আধুনিক কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য পূর্ববর্তী কাব্যচেতনাকে সম্পূর্নরূপে অস্বীকার করা এর সাথে তিনি একমত পোষণ করেননি।
১৯৩৩ সালে রবীন্দ্রনাত ঠাকুর তাঁর আধুনিক কাব্য প্রবন্ধে বলেন,
মডার্ণ বিলিতি কবিদের সম্বন্ধে আমাকে কিছু লিখতে অনুরোধ করা হয়েছে। কাজটা সহজ নয়। কারণ,পাঁজি মিলিয়ে মডার্ণের সীমানা নির্ণয় করবে কে। এটা কালের কথা ততটা নয় যতটা ভাবের কথা। নদী সামনের দিকে সোজা চলতে চলতে হঠাৎ বাঁক ফেরে। সাহিত্যও বারবার সিধে চলে না। যখন সে বাঁক নেয় তখন সেই বাঁকটাকেই বলতে হবে মডার্ণ। বাংলায় বলা যাক আধুনিক। এই আধুনিকটা সময় নিয়ে নয়,মর্জি নিয়ে।
প্রথম বয়সে যে ইংরেজ কবিদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হল তাঁরা বাহিরকে নিজের অন্তরের যোগে দেখেছিলেন; জগৎটা হয়েছিল তাঁদের নিজের ব্যক্তিগত। আপন কল্পনা মত ও রুচি সেই বিশ্বকে শুধু যে কেবল মানবিক ও মানসিক করেছিল তা নয়, তাকে করেছিল বিশেষ কবির মনোগত।
ওয়ার্ডসওয়ার্থের জগৎ ছিল বিশেষভাবে ওয়ার্ডসওয়ার্থীয়, শেলীর ছিল শেলীয়,বাইরনের ছিল বাইরনিক। রচনার ইন্দ্রজালে সেটা পাঠকেরও নিজের হয়ে উঠত।
দেখা যাচ্ছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইংরেজী কাব্যে পূর্ববর্তীকালের আচারের প্রাধান্য ব্যক্তির আত্মপ্রকাশের দিকে বাঁক ফিরিয়েছিল। তখনকার কালে সেইটাই হল আধুনিকতা। কিন্তু,আজকের দিনে সেই আধুনিকতাকে মধ্যভিক্টোরিয় প্রচীনতার সংজ্ঞা দিয়ে তাকে পাশের কামরায় আরাম-কেদারায় শুইয়ে রাখাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখনকার দিনে ছাঁটা কাপড় ছাঁটা চুলের খট্খটে আধুনিকতা। আধুনিক কালের মনের মধ্যেও তাড়াহুড়া,সময়ের অভাব। জীবিকা জিনিসটা জীবনের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে। তাড়া-লাগানো যন্ত্রের ভিড়ের মধ্যেই মানুষের হু হু করে কাজ করে, হুরমুর করে আমোদ-প্রমোদ।
গত য়ুরোপীয় যুদ্ধে মানুষের অভিজ্ঞতা এত কর্কশ এত নিষ্ঠুর হয়েছিল যে বহুযুগ ধরে প্রচলিত যত কিছু, আদব আব্রু, সাংঘাতিক সংকটের মধ্যে এমন অকস্মাৎ ছারখার হয়ে গেল; দীর্ঘকাল যে-সমাজস্থিতিকে একান্ত বিশ্বাস করে সে নিশ্চিত ছিল তা একমুহূর্তে দীর্ণবিদীর্ণ হয়ে গেল; মানুষের যে শোভনরীতি কল্যাণনীতিকে আশ্রয় করেছিল তার বিধ্বস্ত রূপ দেখে এতকাল যাকিছুকে সে ভদ্র বলে জানত তাকে দুর্বল বলে, আত্মপ্রতারণার উপায় বলে, অবজ্ঞা করাতেই যেন সে এক উগ্র আনন্দবোধ করতে লাগল; বিশ্বনিন্দুকতাকেই সে সত্যনিষ্ঠতা বলে আজ ধরে নিয়েছে। মধ্য ভিক্টোরীয় যুগ বাস্তবকে সম্মান করে তাকে শ্রদ্ধেয়রূপেই অনুভব করতে চেয়েছিল। এ যুগ বাস্তবকে অবনমিত করে সমস্ত আব্রু ঘুচিয়ে দেওয়াকেই সাধনার বিষয় বলে মনে করে। অতএব মধ্য-ভিক্টোরীয় যুগকে যদি অতিভদ্রয়ানার পান্ডা বলে ব্যঙ্গ কর তবে এডায়ার্ডি যুগকেও ব্যঙ্গ করতে হয় উল্টো বিশেষণ দিয়ে। ব্যাপারখানা স্বাভাবিক নয়, অতএব শাশ্বত নয়। সায়েন্সেই বল আর আর্টসই বল, নিরাসক্ত মনই সর্বশ্রেষ্ঠ বাহন; য়ুরোপ সায়েন্সে সেটা পেয়েছে কিন্তু সাহিত্যে তা পায় নি।
রবীন্দ্রনাথ ও গদ্য কবিতা:
গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক সমস্ত মাধ্যমেই রবীন্দ্রনাথ সফল। কিন্তু তাঁর সেরা সফলতা গীতাঞ্জলীর ইংরেজী অনুবাদ যা তাঁকে এনে দিয়েছিলো বিশ্ব স্বীকৃতি। গীতাঞ্জলীর কবিতাগুলি অনুবাদ করার সময় এবং পরবর্তীতে তার প্রতিক্রিয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গদ্য-কবিতা লেখায় মূল উৎসাহ যোগায়। তিনি বলেন,
গীতাঞ্জলীর গানগুলি ইংরেজী গদ্যে অনুবাদ করেছিলেম। এই অনুবাদ কাব্যশ্রেণীতে গন্য হয়েছে। সেই অবধি আমার মনে এই প্রশ্ন ছিল যে,পদ্য ছন্দের সুষ্পষ্ট ঝংকার না রেখে ইংরেজিরই মতো বাংলা গদ্যে কবিতার রস দেওয়া যায় কিনা।
আধনিকবাদের সূচনা ও প্রতিষ্ঠা লাভের সময়টাতে কি করছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
১৯৩৩ অব্দে প্রকাশিত হয় পুনশ্চঃ, ১৯৩৬-এ শেষ সপ্তক, ১৯৩৬-৩৭ এ পত্রপুট, ১৯৩৭-এ শ্যামলী প্রকাশিত হয়। মোটামোটি বলা চলে কবিতায় এই সময়টাতে রবীন্দ্রনাথ এ কাজগুলি করছিলেন।
পুনশ্চঃ কাব্যের কবিতাগুলো নিয়ে তিনি লিখেন,
যখন কবিতাগুলো পড়বে তখন পূর্বাভাস মতো মনে করো না এগুলো পদ্য। অনেকে সেই চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে রুষ্ট হয়ে ওঠে। গদ্যের প্রতি গদ্যের সম্মান রক্ষা করে চলা উচিত। পুরুষকে সুন্দরী রমণীর মতো ব্যবহার করলে তার মর্যাদাহানি হয়। পুরুষেরও সৌন্দর্য আছে,সে নারীর সৌন্দর্য নয়।
পুনশ্চঃ কবিতাগুলোকে কোন সংজ্ঞা দেবে? পদ্য নয়, কারণ পদ নেই। গদ্য বললে অতিব্যপ্তি দোষ ঘটে। পঙ্খিরাজ ঘোড়াকে পাখি বলবে না ঘোড়া বলবে? গদ্যের পাখা উঠছে এ কথা যদি বলি তবে শক্রপক্ষ বলে বসবে পিঁপিলিকার পাখা গজে মরিবার তরে। জলে স্থলে যে সাহিত্য বিভক্ত, সেই সাহিত্যে এই জিনিসটা জল নয়,তাই বলে মাটিও নয়। তাহলে খনিজ বলতে দোষ আছে কি? সোনা বলতে পারি এমন অহংকার যদি বা মনে থাকে,মুখে বলবার জো নেই। না হয় তাঁমাই হলো,অর্থাৎ এমন কোন ধাতু যা দিয়ে মূর্তি গড়ার কাজ চলে। গদাধরের মূর্তিও হতে পারে,তিলোত্তমাও হতে হয়। অর্থাৎ রূপরসাত্মক গদ্য,অর্থ ভারবহ গদ্য নয়, তৈজস গদ্য।
শেষ সপ্তক প্রসঙ্গে কবি লিখেন-
সম্প্রতি কতগুলো গদ্য কবিতা জড়ো করে শেষ সপ্তক নাম দিয়ে একখানি বই বের করেছি। সমালোচকরা ভেবে পাচ্ছেন না ঠিক কি বলবেন। আমি কাব্যের পসারি, আমি শুধাই- লেখাগুলোর ভিতর কি স্বাদ নেই, ভঙ্গি নেই, থেকে থেকে কটাক্ষ নেই,সদর দরজার চেয়ে এর খিড়কির দুয়ারের দিকেই কি ইশারা নেই,গদ্যের বকুনির মুখে রাশ টেনে তার মধ্যে কি কোথাও দুলকির চাল আনা হয়নি, চিন্তাগর্ভ কথার মুখে কোনখানে অচিন্ত্যের ইঙ্গিত কি লাগল না,এর মধ্যে ছন্দোরাজকতার নিয়ন্ত্রিত শাসন না থাকলেও আত্মরাজকতার অনিয়ন্ত্রিত সংযম নেই কি? সেই সংযমের গুনে থেমে-যাওয়া কিংবা বেঁকে-যাওয়া কথার মধ্যে কোথাও কি নীরবের সরবতা পাওয়া যাচ্ছে না? এই সকল প্রশ্নের উত্তরই হচ্ছে এর সমালোচনা।
১৯৩৬-৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর পত্রপুট। তাঁর বিখ্যাত কবিতা পৃথিবী এই কাব্যের অন্তর্ভুক্ত। পৃথিবীতে তাঁর দক্ষতার অসাধারণ পরিচয় মিলে। তাঁর চিন্তা-চেতনা,ভাষা বিন্যাস, শব্দ চয়নে, রূপকে তিনি যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তা বিরল।
আবার ফাল্গুনে দেখেছি তোমার আতপ্ত দক্ষিণ হাওয়া
ছড়িয়ে দিয়েছে বিরহমিলনের স্বগতপ্রলাপ আম্রমুকুলের গন্ধে;
চাঁদের পেয়ালা ছাপিয়ে দিয়ে উপচিয়ে পড়েছে স্বর্গীয় মদের ফেনা;বনের মর্মরধ্বনি বাতাসের স্পর্ধায় ধৈর্য্য হারিয়েছি
অকস্মাৎ কল্লোলোচ্ছ্বাসে
আধুনিক কবিতা ও গদ্য কবিতা:
আধুনিক কবিতা মূলত তার অভিব্যক্তির জন্য বৈশিষ্ট্যময় আর গদ্য কবিতা তার আঙ্গিক গঠনে। গদ্যে আধুনিক কবিতা লেখা যেতে পারে যেমন পারা যায় রোমান্টিক ধারার কবিতা। তখন তাকে গদ্য-কাব্যই বলা যাবে কিন্তু গদ্য-কাব্য হলেই তাকে আধুনিক কবিতা বলা যায় না। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্য-কবিতা। জীবনানন্দ দাস কিছু অসাধারন গদ্য কবিতা লিখেছেন যা সম্পূর্ন আধুনিক ধারার স্বার্থক কবিতা। আধুনিক কবিতা ছন্দে লিখা যায় কিন্তু গদ্য কবিতা ছন্দ মুক্ত থাকে।
কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ কি আত্মনিমগ্ন থেকেছেন? যে অসময়টাকে সারা পৃথিবীর কাব্যজগত কেঁপে উঠেছিল।
আধুনিকবাদ কবিতায় তিনি কি ঐ ধারাকে ঠিক আত্মস্থ করতে পারেননি? নাকি তিনি সচেতনভাবেই সেই ধারাকে উপক্ষা করে গেছেন আর দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন যে, আগামী দিনের কাব্য হবে গদ্য-কাব্য !
আধুনিক ধারার শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ যে দক্ষতা দেখিয়েছেন তা তাকে এনে দিয়েছে অনন্য অবস্থান। রবীন্দ্রনাথের পরে,এমনকি কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথ সহ বিচার করেও জীবনানন্দ দাশকে বাংলা কবিতায় দেন শ্রেষ্ঠত্বের অবস্থান।শিল্পকলায়,কবিতার সাথে কামের রয়েছে একটি গভীর সম্পর্ক। কোন কিছুই উৎকৃষ্ট শিল্পকলা হয়ে উঠে না যদি না তার ভেতর বয়ে চলে কামের উচ্ছ্বল ধারা। যৌবন,যৌনতা, সৃষ্টিশীলতা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। যৌবনে রবীন্দ্রনাথ যে সৃষ্টিশীলতায় মেতে উঠেছিলেন সোনার তরী,চিত্রা কাব্যে,মধ্য বয়সে ক্ষণিকা আর বলাকা'য় এবং গানের ভুবনে যে সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন,শেষ জীবনে এসে আধুনিকবাদের তোলপাড় করা ভাঙ্গাচুড়ার সময়টাতে তিনি যে কাব্যচর্চা করেছেন, তা অসাধারণ অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেও তা রবীন্দ্রনাথের মানের সাথে তাল মেলাতে পারেনি বলে বলা যায়।
গদ্য কাব্যে রবীন্দ্রনাথ যেন এক নেতা,পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন কিন্তু সৃষ্টিশীলতার যুদ্ধের ময়দানে সেনাপতি হয়ে লড়তে পারেননি। প্রান্তরে প্রায় একই সময়ে অনন্য কবি প্রতিভা জীবনানন্দ দাশ যৌবনের সৃষ্টিশীলতার গগনচুম্বী অবস্থানে আধুনিক ধারায়,আরো স্পষ্ট করে বললে রবীন্দ্র বলয় থেকে বেরিয়ে এসে লিখেছেন ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬),বনলতা সেন(১৯৪২)। আর আরো কিছু পরে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ রূপসী বাংলা (১৯৫৭)।
জীবনানন্দ দাশ সহ আরো যারা আধুনিক ধারায় চর্চা করেছিলেন,তারা এক একজন অনন্য কবি প্রতিভা,উচ্চ শিক্ষিত। সমকালীন বিশ্ব সাহিত্যে যারা সাবলীল বিচরণ করেছেন তারা রবীন্দ্রনাথকে নেতা মেনে তার কমান্ডে বা দেখানো পথে কবিতা চর্চা করেননি। ফলে গত শতাব্দীর মধ্যে থেকে শেষের দিকে আধুনিক কবিতার ব্যাপক চর্চা হয়। ছোট বা বড় অনেক কবিই আধুনিক ধারায় লিখেন এবং সফল হন। তাই বলা চলে গদ্য কাব্য তেমনভাবে চর্চা হয়নি যদিও আধুনিক ধারার অনেক কবিই তাদের কাব্যগ্রন্থে দুচারটি গদ্য কাব্য লেখার চেষ্টা করেছেন। স্পষ্টত: বলা চলে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ যে গদ্য-কাব্যের ধারা তৈরী করার পথ দেখিয়েছিলেন আধুনিক কবিতার ব্যাপক প্রভাবে তা স্থবির হয়ে পড়ে।
বিশ্ব সাহিত্যেও নানা চড়াই উতড়াইয়ের পর এক পর্যায়ে গদ্য-কাব্য স্থবির হয়ে পড়ে। কিন্তু ১৯৮৯ সালে Simic তার গদ্য-কাব্যের বই The World doesnt End পুলিৎজার পুরস্কার পাবার পর আবার গদ্য-কাব্যের নানা সংস্করণের প্রকাশনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইতিহাসের প্রায় প্রতি অধ্যায়েই গদ্য-কাব্য ছিল পরীক্ষামূলক বা বিকল্প ধারার সাহিত্য চর্চা কিন্তু বর্তমানে তা এখন মূলধারায় প্রতষ্ঠিত রূপ নিচ্ছে। বর্তমানে গদ্য-কাব্যের সংকলন প্রায়ই চোখে পরে। এখন প্রায়শই দেখা যায় মূলধারার কবিরা গদ্য-কাব্যের পূর্ণ বই লিখছেন। ১৯৮০ সালের শেষের দিকে এই ধারার লেখা জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয় এবং বিশ্ব সাহিত্যের বিভিন্ন নামী দামী জার্নালে যারা পূর্বে গদ্য কবিতাতে মনোনিবেশ করেননি তারাও গদ্য কবিতাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
যারা প্রতিভাবান,বয়সে তরুণ,যৌবনের সৃষ্টিশীলতায় উদ্দীপ্ত তারা গদ্য কাব্যের এই ধারাটিকে আত্মস্থ করে চর্চা করতে পারেন। হয়ত এতে কবিতারই জয় হবে। তবে স্মরণ রাখতে হবে গদ্য কাব্য যেহেতু ছন্দের স্বাধীনতা নিয়ে কাব্য চর্চা করে তাই যথেচ্ছার ভাবে অযোগ্য লোকের দ্বারা হাস্যস্পদ উপাদানে পরিণত হতে পারে। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যকে পুনরাবৃত্তি করেই এই প্রসঙ্গের ইতি টানতে চাই।
ছন্দে লেখা রচনা কাব্য হয়নি তার হাজার প্রমাণ আছে,গদ্য রচনাও কাব্য নাম ধরলেও কাব্য হবে না তার ভুরি ভুরি প্রমাণ জুটবে। গদ্য সহজ সেই কারেণেই গদ্যছন্দ সহজ নয়। সহজের প্রলোভনেই মারাত্মক বিপদ ঘটে,আপনি এসে পড়ে অসতর্কতা। অসতর্কতাই অপমান করে কলালক্ষীকে, আর কলালক্ষী তার শোধ তোলেন অকৃতার্থতা দিয়ে। অসতর্ক লেখকদের হাতে গদ্যকাব্য অবজ্ঞা ও পরিহাসের উপাদান স্তুপাকার করে তুলবে এমন আশঙ্কার কারণ আছে। কিন্তু এই সহজ কথাটা বলতেই হবে,যেটা কাব্য সেটা পদ্য হলেও কাব্য,গদ্য হলেও কাব্য।