সম্পর্ক
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

হাঁটতে হাঁটতে একবার পেছন ফিরে তাকালেন গায়ত্রী। অনেকটা পেছনে ফেলে এসেছেন মিমিকে। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে হাঁটার অভ্যেস নেই ওদের। রাতে শুতে শুতে ওদের মাঝরাত গড়িয়ে যায়। গায়ত্রী নদীর দিকে তাকালেন। পূবের আকাশটা সামান্য লালচে হয়ে উঠছে। জলে তার প্রতিফলন স্রোতের মাথায় মাথায় ছড়িয়ে পড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় থালার মতো সূর্য দেখা যাবে।
গায়ত্রী নিত্যদিনের মতো কদমগাছের মোটা শেকড়ের ওপর গুছিয়ে বসলেন। গাছটা বেশ বড়। বয়সও নিশ্চয়ই কম নয়। প্রাত:ভ্রমণে বেড়িয়ে অনেকেই একটু বিশ্রামের জন্য এখানে বসে। গায়ত্রী বছর পাঁচেক ধরে মর্ণিংওয়াক করছেন। চিনি সামান্য বেশি। উত্তরবঙ্গের জলহাওয়ার সঙ্গে চিনি আর বাতের সখ্যতা একটু কেশিই। সামান্য হলেও বাড়তির প্রবণতার জন্য ডাক্তারের পরামর্শে প্রতিদিন সকালে হাঁটতে মন্দ লাগছে না।
--বাব্বা! তুমি এতো জোরে হাঁটো কি করে ঠাম্মা? আমি তো হাঁপিয়ে উঠেছি--
--পাঁচ বছরের অভ্যেস যে দিদিভাই! তুমি সত্যিই হাঁপাচ্ছো। এখানে বসে একটু দম নিয়ে নাও--
--সেই ভালো!
মন্দিরা নামটা ছেলের খুব অপছন্দ না হলেও বৌমার আদপেই পছন্দ হয়নি। তখন নাকচ করার ক্ষমতা ছিল না। তাই পোষাকী নাম মন্দিরা থেকে গেলেও আধুনিকা মা মন্দিরাকে মিমি বলে ডাকে। এটা ওর ডাক নাম হলেও আসলটা নামটা প্রায় এই নামের নিচে চাপা পড়ে গেছে। এবারে মাধ্যমিক দেবে মিমি। গোলগাল চেহারা। এই বয়সেই নাকের ওপর হালফ্যাশানের চশমা বসে গেছে। গায়ত্রীর গা ঘেঁষে বসে পড়লে মিমি।
--এই ঠাণ্ডায় তুমি ঘামছো কি গো?
অবাক হয়ে মিমি গায়ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। গায়ত্রীর নাকের ডগায় এবং কপালে কিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। সুন্দর ফর্সা মুখটা লালচে দেখাচ্ছে। নদীর জল থেকে লালচে আলোর প্রতিফলনে লালচে ভাবটা মাঝে মাঝে গাঢ় হয়ে উঠছে। গায়ত্রী ইতিমধ্যে গায়ের হাল্কা মণিপুরী চাদরটা খুলে কোলের ওপর রেখেছেন। মিমি চাদরটা টেনে নিয়ে ভাল করে নিজের গায়ে জড়িয়ে নিল। কার্তিকের মাঝামাঝি এখানে সকাল সন্ধ্যায় ভালই ঠাণ্ডা লাগে। তবে সকালে হাঁটাহাঁটি করলে অতটা ঠাণ্ডা লাগে না। মিমির কথা শুনে গায়ত্রী মৃদু হাসলেন।
--তোমার মতো হাঁটলে আমি ঘামতাম না। আমি যে অনেক জোরে হেঁটেছি!
বলতে বলতে দক্ষিণে ব্রিজের দিকে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন গায়ত্রী। পড়নের শতচ্ছিন্ন শাড়িটা পাড়ে খুলে রেখে সটান নদীতে সেমে গেল পাগলী মেয়েটা। এই ছোট্ট শহরের সকলেই ওকে চেনে। কোথা থেকে এসেছে--কোথায় যাবে তা অবশ্য কেউ জানে না। হঠাৎই একদিন গায়ত্রীর মতো সকলেই ওকে লক্ষ্য করেছে ভিক্ষে করতে। কোর্টের বারান্দায় মন্দিরের চাতালে কুকুরকুণ্ডলী পাকিয়ে রাত কাটায়। দেখতে দেখতে এই শহরে বছর চারেক কেটে গেল মেয়েটার। শতচ্ছিন্ন একটা ময়লা ফ্রকে ওর বাড়ন্ত শরীরটা গায়ত্রীর চোখে কাঁটার মতো বিঁধতো। একদিন ওকে বাড়িতে ডেকে পেট পুরে খাইয়ে একটা শাড়ি-শায়া-ব্লাউজ কাজের মেয়েটাকে দিয়ে পরিয়ে দিয়ে ছিলেন। তারপর থেকে প্রতিদিনই মেয়েটা একবার না একবার বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়াবে। কাজের মেয়েটাকে বলা আছে যা-হোক কিছু খাবার দিতে।
এইভাবেই চলছিল। হঠাৎই একদিন মেয়েটাকে দেখে মনে মনে ভীষণভাবে ধাক্কা খেয়েছিলেন গায়ত্রী। বেওয়ারিশ পাগলী মেয়েটাও রেহাই পায়নি। ওর শরীর জুড়ে মাতৃত্বের লক্ষণ দেখতে দেখতে প্রকট হয়ে উঠেছিল!
ওর দিকে চোখ পড়লেই গায়ত্রী নিজেই কেন যেন ভীষণ বিচলিত এবং অপমানিত বোধ করেন। নারীত্বের এক অসহনীয় অপমানের জ্বলন্ত প্রতিমূর্তির মতো মেয়েটা নির্বকারভাবে পথে ঘাটে হেঁটে চলে। গায়ত্রী পরোক্ষে যতটা সম্ভব মেয়েটাকে নজরে রাখেন।
--দেখ দেখ ঠাম্মা, পাগলীটা কেমন এই ঠাণ্ডায় স্নান করছে!
গায়ত্রী দেখলেন আসন্নপ্রসবা মেয়েটা মানসাই নদীর ঠাণ্ডা জলে একবার করে ডুব দিচ্ছে আর দু'হাত তুলে উদীয়মান সূর্যের দিকে তাকাচ্ছে! গোটা শরীর বেয়ে নেমে যাচ্ছে জলে ধারা। লালচে সোনালি আলোয় মাখামাখি ওর পরিপূর্ণ নিরাবরণ শরীর এক অসাধারণ দৃশ্যের জন্ম দিচ্ছে। মিমির চোখে একরাশ মুগ্ধতা। লজ্জা কিংবা ঘৃণার কোনো রেখাই মিমির চোখে-মুখে ফুটে ওঠেনি। গায়ত্রী অবাক হলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘাড় ঘুরিয়ে উত্তরের দিকে তাকালেন।


হন হন করে হেঁটে আসছেন কমলেশ। আজ একটু দেরি করে ফেলেছেন। কপালে চিন্তার কয়েকটা রেখা নিয়ে এগিয়ে আসা কমলেশের কথাই এখন ভাবছেন গায়ত্রী।
বছর পাঁচেক আগেই শিক্ষকতার জীবন থেকে অবসর নিয়েছেন কমলেশ। দুটি ছেলে একটি মেয়েকে মানুষ করেছেন--বিয়ে দিয়ে সংসারী করেছেন। জীবনের যাবতীয় সঞ্চয় দিয়ে ছোটখাটো একটা ছিমছাম বাড়িও বানিয়েছেন। দুই ছেলে এই বাড়িতে বসবাস করলেও ওদের হাঁড়ি পৃথক। দু'দিকের দুই রান্নাঘর থেকে যখন যা জোটে তাই দিয়ে কমলেশের একার পেট 'চলে যায়'!
যতদিন স্ত্রী বেঁচে ছিলেন ততদিন সংসারের আসল চেহারাটা কেমন ঠিক বোঝেননি। বছর চারেক আগে স্ত্রী বিয়োগের পর থেকে কমলেশের জীবনে একটু একটু করে অন্ধকার নেমে এসেছে। দুই পুত্রবধূর হুকুম তামিল করতে করতেই তাঁর সারাটা দিন কখন একসময় রাতের গভীর অন্ধকারে ডুবে যায় টের পান না।
একসময় কমলেশ নানান কাগজে কবিতা লিখতেন। প্রাসঙ্গিক বিষয়ে খবরের কাগজে প্রচুর চিঠিপত্র লিখতেন। পড়াশোনাও করতেন প্রচুর। তাঁর লেখা সেইসব চিঠিপত্র এবং কবিতার কাটিং দুটি ফাইলে বড় যত্ন করে তুলে রেখে গেছেন তাঁর স্ত্রী। এখন আর তাঁর কিছুই লেখা হয় না। ইচ্ছে হলেও সময় হয় না।
প্রাত:ভ্রমণের প্রথম ঊষায় নদীর ধারেই গায়ত্রীর সঙ্গে কমলেশের আলাপ। বিষণ্ণ একটি মানুষ চুপচাপ হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে এসে কিছুক্ষণ পূবদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
প্রথমদিন রীতিমতো হাঁপ ধরে গিয়েছিল গায়ত্রীর। কদমগাছের শেকড়ে বসে দম নিচ্ছিলেন। কমলেশও এখানেই বসে বসে প্রতিদিন সূর্য ওঠা দেখেন। আকাশ পরিষ্কার থাকলে উত্তরের কাঞ্চনজঙ্ঘার সোনালি উজ্জ্বল শীর্ষদেশও দেখা যায়। সেদিন গায়ত্রীকে বসে থাকতে দেখে কমলেশ ইত:স্তত করছিলেন। গায়ত্রীই আহ্বান জানিয়েছিলেন--
--বসবেন এখানে? বসুন না!
বসতে না পেরে একটু কষ্টই হচ্ছিল কমলেশের। চারপাশ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে। দু'জন পরস্পরকে চেনেন। গায়ত্রী মেয়েদের স্কুলের বড়দি। বয়সে কিছুটা ছোট হলেও সামাজিক প্রতিষ্ঠার দিক থেকে তিনি কিছুটা এগিয়ে ছিলেন। পাশের ছেলেদের স্কুলের প্রাক্তন ইংলিশ টিচার কমলেশ যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বসেছিলেন। স্মিত হাসার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা যে পারেননি সেটা বুঝতে পেরেই নদীর দিকে তাকিয়েছিলেন। গায়ত্রীর মনে হয়েছিল ধন্যবাদ জাতীয় কিছু একটা কমলেশ অস্ফূটে উচ্চারণ করেছিলেন।
--ডাক্তারের নির্দেশে আমি আজ থেকেই শুরু করলাম।
গায়ত্রী একটু হাসলেন। দু'জন বয়স্ক নর-নারী পাশাপাশি বসে কথা না বলে গোমড়া মুখে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে থাকবে এটা ভাবতেই হাসি পাচ্ছিল গায়ত্রীর।
--সুগার?
কমলেশ খুব আস্তে প্রশ্নের ঢঙে কথাটা আলতো করে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন।
--সামান্য বটে--তবে সাবধান হওয়া ভালো। আপনার?
--আমার কোনো রোগ নেই। অবশ্য রাতে ঘুম না হওয়াটা যদি রোগ হয় তাহলে--
--কোনো রোগ নেই তবু এত ভোরে বেরিয়ে পড়েন কেন? আমি হলে দিব্যি কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতাম।
--ভোরের এই স্নিগ্ধ সতেজ পরিচ্ছন্ন সময়টুকুই আমার নিজস্ব সময়। শুয়ে থেকে নষ্ট করতে ইচ্ছে হয় না।
শেষের এই সামান্য দুটি কথাতেই গায়ত্রী কমলেশকে তাঁর পরিচিত আর পাঁচজনের বাইরের মানুষ বলে মনে হয়েছিল। টুকরো টুকরো এইরকম সাধারণ কথাবার্তা ধীরে ধীরে অনেক বেড়ে গিয়েছিল। গোটা কমলেশকে গায়ত্রী পুরোপুরি জেনে বুঝে গিয়েছিলেন। একসময় ভারী আশ্চর্যের মনে হলেও তাঁরা পরস্পরকে 'তুমি' সম্বোধন শুরু করে দিয়েছিলেন। কবে তা শুরু হয়েছিল মনে নেই কারো। তবে হঠাৎ যেদিন খেয়াল হয়েছিল সেদিন সাতান্ন বছরের গায়ত্রী নিজের কাছেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিলেন। দর্পণে নিজের চোখে চোখ রাখতেও সে যে কী বিড়ম্বনা! অথচ তখন আর আনুষ্ঠানিকতায় ফেরার পথ ছিল না।
পরে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে গিয়ে বুঝেছেন দু'জন উদার সংস্কৃতিমনস্ক নি:সঙ্গ নারী-পুরুষ পরস্পরের প্রতি আন্তরিক সহমর্মিতার সূত্র ধরেই মনের দিক থেকে খুব কাছাকাছি এসে গেছেন।
গায়ত্রীর দুই ছেলের একজন থাকে কলকাতায়, অন্যজন মুম্বাইতে। মেয়ে থাকে পাঞ্জাবে। সকলেই সুপ্রতিষ্ঠিত। তিন বছর আগে স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে গায়ত্রীও একেবারেই নি:সঙ্গ। ছেলেমেয়েরা সকলেই নিজেদের কাজকর্ম ও সংসার নিয়ে দারুণ ব্যস্ত। মায়ের কাছে আসার সময় হয় না ওদের। বাপের মৃত্যুর তিন বছর পরে ওরা সকলে একসঙ্গে এসেছে বিশেষ কারণেই। আজই গায়ত্রী তাঁর স্কুলের চাকরি থেকে অবসর নেবেন। অবসরের পর তাঁর আর এখানে একলা পরে থাকার মানে হয় না। বয়স হচ্ছে। কে দেখাশোনা করবে? এখানকার পাট চুকিয়ে গায়ত্রী কলকাতা কিংবা মুম্বাইতে গিয়ে থাকুন। ছেলেমেয়েদের বক্তব্য এটাই।
গায়ত্রী অবশ্য তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট বুঝতে পেরেছেন। এই বাড়ি বিক্রী করে ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে তিনি ভাগের মা হয়ে পুত্রবধূদের নিয়ন্ত্রণে বাকি জীবনটা কাটাবেন। তাঁর স্বাধীনতা ইচ্ছা অনিচ্ছা সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হবে ওদের কর্তৃত্বে! গায়ত্রী তা আদৌ চাইছেন না। আজ রাতেই তিনি তাঁর মতামত স্পষ্ট জানিয়ে দিতে চান।

কমলেশ মিমির পাশে বসে একটু হাসলেন। গত দু'দিনেই কমলেশের সঙ্গে মিমির বেশ আলাপ জমে উঠেছে।
--আপনিও তো খুব ঘামছেন কমলেশদাদু! ঠাণ্ডা লাগছে না আপনার?
--না দিদিভাই। আমরা তো ঠাণ্ডার দেশেরই লোক । তবে আজ একটু বেশি জোরে হেঁটেছি মনে হচ্ছে--
কমলেশ সত্যিই একটু হাঁপাচ্ছেন। গায়ত্রী দেখলেন কমলেশের রগের পাশ দিয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। কপালও বেশ ভিজে। একটু উদ্বিগ্ন হলেন। প্রেশার কমে যাচ্ছে না তো? গায়ত্রী তাড়াতাড়ি নিজের আঁচল দিয়ে কমলেশের কপাল ঘাড় গলা মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন--
--প্রেশারটা ঠিক আছে তো? রাত্রে কি একেবারেই ঘুম হয়নি?
--না না, সব ঠিকই আছে।
কমলেশ মিমির অবাক গোল গোল দুটো চোখের দিকে তাকিয়ে বিব্রত বোধ করছেন।
--কবিতার বই প্রেস থেকে আজ কয়েক কপি অন্তত: দিয়ে যাবে তো?
গায়ত্রীকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল। কমলেশ মৃদু হাসলেন। গায়ত্রীর চাপাচাপিতেই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'যাপন বৃত্তান্ত' প্রকাশিত হতে চলেছে আগামী সন্ধ্যায়। গ্রন্থপ্রকাশ উপলক্ষ্যে একটা ছোটখাট কবিসম্মেলনের আয়োজন করেছেন গায়ত্রী তাঁর বাড়ির লনে। অনেক নবীন প্রবীণ কবি সাহিত্যিক আসবেন। আজ গায়ত্রীর কর্মজীবনের অবসান। কাল সকাল থেকেই নতুন জীবনে প্রবেশ। নতুন কাজ--নতুন দায়িত্ব। একলা হলে হয়তো পারতেন না। কমলেশ তাঁর পাশে রয়েছেন। তিনি পারবেন। জীবনের অন্তিম মুহূর্তটাও তিনি বৃথা ব্যয় করতে চান না।
--ঠাম্মা দেখ দেখ, পাগলীটা কেমন ছটফট করছে!
মিমি হঠাৎই নদীর পাড়ে লুটিয়ে পরা পাগলী মেয়েটার দিকে হাত তুলে চিৎকার করে ওঠে। একসঙ্গে চমকে দূরে মেয়েটার দিকে তাকালেন গায়ত্রী আর কমলেশ। নির্জন নদীর তীরে বালির ওপর আসন্নপ্রসবা পাগলী মেয়েটা যন্ত্রণায় হাত-পা ছুঁড়ছে। একেবারে নগ্ন অসহায় মেয়েটার দিকে নিষ্পলক কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে গায়ত্রী চেঁচিয়ে উঠলেন--
--কমলেশ, একটা রিক্সা বা ভ্যান যা পাও নিয়ে এসো--এক্ষুণি!
বলেই গায়ত্রী যথাসম্ভব দ্রুত মেয়েটার কাছে ছুটে পৌঁছে গেলেন। নদীর তীরে পড়ে থাকা শতচ্ছিন্ন ঘাড়িটা মিমি তাড়াতড়ি তুলে এনে গায়ত্রীকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটার শরীরে যত্ন করে জড়িয়ে দিল! গায়ত্রী মনে মনে ঈশ্বরের কাছে কাতর প্রার্থনায় ভেঙ্গে পড়লেন, মা ও শিশু যেন বেঁচে থাকে! গায়ত্রীর নতুন জীবনে এঁদের তাঁর বড়ই প্রয়োজন।


হাসপাতালে সকাল আটটা নাগাদ একটি ফুটফুটে মেয়ের জন্ম দিল পাগলী মেয়েটা। বাইরের পৃথিবীর এক কণাও ধুলো-ময়লা শিশুটাকে স্পর্শ করেনি। শিশুটাকে অবাক বিস্ময়ে দেখতে দেখতে মিমি গায়ত্রীর একটা হাত শক্ত করে ধরে ফিস ফিস করে বলে ওঠে--
--একে তুমি বাড়ি নিয়ে যাবে ঠাম্মা!
--হ্যাঁ দিদিভাই। এদের আমিই নিয়ে যাবনা হলে এরা রাস্তায় বেঘোরে মরে যাবে--
--খুব ভাল হবে ঠাম্মা! কিন্তু মা-বাবা রেগে যাবে না তো?
--নিশ্চয়ই যাবে। কিন্তু কি করা যাবে বলো?
--তোমার বাড়িতে তুমি যাকে খুশি আশ্রয় দিতে পার। তাই না ঠাম্মা?
গায়ত্রী নি:শব্দে তাকালেন মিমির দিকে। অত্যাধুনিক শহুরে সমাজে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা মেয়েটাকে দেখে মনে হয়েছিল বয়সের তুলনায় নিতান্ত খুকি সেজে থাকার শিক্ষায় পটু একটা পুতুল ছাড়া অন্য কিছু নয়্ কিন্তু এই দু'তিন দিনে, বিশেষ করে আজকের ঘটনায় মিমি হঠাৎই যেন নিজেকে নারী হিসেবে আবিষ্কার করে ফেলেছে। বছর পনের বয়স তো হয়েই গেল।
গায়ত্রী হাসপাতালের সুপারকে বলে এলেন সদ্যজাত শিশু ও মা-কে তিনিই নিয়ে যাবেন।

রাতে খাবার টেবিলের আবহাওয়া আজ একটু ভারি বোধ হল গায়ত্রীর। সারাদিন তাঁর নি:শ্বাস ফেলার সময় ছিল না। দীর্ঘদিনের কর্মজীবনের শেষ মুহূর্তগুলো স্মৃতি কাতরতায় আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। কচিকাঁচা ছাত্রীদের সজল নিষ্পাপ মুখগুলো তাঁকে আজ সারাদিন বিমর্ষ করে রেখেছে।
মেঘলা মুখে বড়ছেলে দিব্য কোনোরকম ভণিতা না করেই গায়ত্রীর দিকে তাকিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করল--
--তুমি নাকি একটা পাগলী আর তার অবৈধ সন্তানকে এই বাড়িতে এনে তুলতে চাও?
--ঠিকই শুনেছিস। না হলে ওরা বাঁচবে না। খোলা আকাশের নিচে এই শীতে দুজনেই মরে যাবে--
--এরকম তো আরো অনেকেই আছে--তুমি নিষ্চয়ই তাদের সকলকে এই বাড়িতে আশ্রয় দেবে না?
--এই এলাকায় এরকম অসহায় আর কেউ নেই। তবে থাকলে তাদেরও নিয়ে আসতাম।
--শুনলাম কমলেশ বলে কে একটা বুড়ো ভাম আছে তাকেও নাকি এ বাড়িতে থাকার জন্যে নেমতন্ন করেছো?
গায়ত্রী খাবারের প্লেটটা একটু ঠেলে দিয়ে দিব্য'র মুখের দিকে কঠিন চোখে তাকালেন।
--কমলেশ তোমার বাবার বন্ধু ছিলেন। সেই হিসেবে ওঁকে তোমার কাকা বলা উচিত ছিল দিব্য!
--কিন্তু মা, আপনি তো আমাদের বাড়িটাকে ধর্মশালা বানাতে পারেন না?
বড় বৌ শ্যামলীর কথা শুনলেন গায়ত্রী। কিন্তু ওর কথার কোনো উত্তর দিলেন না।
--এই বাড়িতে তুমি যা খুশি তাই করতে পারে না মা। এসব আমরা মানতে পারব না।
ছোটছেলের মুখটাও দেখলেন গায়ত্রী। কথা বলার সময় ওর চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে চেপে বসে। ভাল কথাও কানে অন্যরকম করে বাজে।
--কি মানতে পারবি আর পারবি না সেটা তোদের ব্যাপার। আমি তোদের মানা না মানার ওপর বিন্দুমাত্র নির্ভরশীল নই। আমার অবসর জীবনটা আমি কিভাবে কাটাবো সেটা অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা করে ঠিক করে রেখেছি। যেমন ভেবেছি তেমনভাবেই বাকি জীবনটা কাটাবো আমি।
--তার মানে? তুমি কি এখানেই থাকবে নাকি?
মেয়ে দীপ্তি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল গায়ত্রীর দিকে।
--তোরা কি ভেবেছিস? আমি তোদের সঙ্গে কলকাতায় কিংবা মুম্বাইতে অথবা তোর সঙ্গে পাঞ্জাবে গিয়ে থাকবো?
--নিষ্চয়ই থাকবে! এখানে কে দেখবে তোমাকে?
দিব্য বেশ জোরের সঙ্গেই কথাটা বলে ভাইবোনের সমর্থন চাইল। সকলেই দিব্য'র পাশে রয়েছে দেখে গায়ত্রী বললেন--
--গত বছর তোদের মামার বাড়ি গিয়েছিলাম দু'দিনের জন্যে। বেড়াতে নয়। আমার প্রাপ্য পৈতৃক অংশটুকু ভাইপোকে লিখে দিতে গিয়েছিলাম। তোরা জানিস আমার বিধবা মা এখনও বেঁচে আছেন। কেন যে মানুষ দীর্ঘায়ু হও বলে আশীর্বাদ করে কে জানে!......কিভাবে আছেন জানিস?
একটু থেমে গায়ত্রী সকলের দিকে তাকালেন। সকলেই বিরক্তচোখে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তিনি বললেন--
--মায়ের ঘরে মা একলা রাত কাটান। নিজের শোবার ঘরটাও হাতছাড়া হয়ে গেছে। নাতি তাঁকে পাঠিয়ে দিয়েছে সিঁড়ি ঘরে। তোরা দেখেছিস ঘরটা। ছোট্ট--হাওয়া-বাতাস খেলে না। অন্ধকার ঘুপচি ঘরে পরিত্যক্ত পুরনো আসবাবের মতো মা আমার নি:সঙ্গ জীবন যাপন করছেন। আমার ভায়েরা তাদের বৌ-নাতি-নাতনিরা সকলেই ভীষণ ব্যস্ত। ঐ ঘরে উঁকি দেওয়ার সময়ও তারা পায় না। মা এখন সকলকে চিনতেও পারেন না। অথচ ওঁর শরীরের রক্তস্রোতেই ওদের জন্ম--বাড়বাড়ন্ত!
--দিদার গল্প শুনে কি লাভ? তোমার কি বলার আছে বলো--
অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে দিব্য। প্রসঙ্গ না পাল্টে গায়ত্রী বলতে থাকেন--
--রাতে সারারাত প্রায় জেগে থাকেন। তেষ্টায় বুকের ছাতি ফেটে যাবার উপক্রম হলে অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ান যখন পা দুটো ঠক্ ঠক্ করে কাঁপে। চোখে দেখতে পান না। হাতড়ে হাতড়ে জলের গ্লাস কাঁপা কাঁপা হাতে মুখের কাছে ধরে দু'এক ঢোক জল খেতে না খেতেই গ্লাস হাত থেকে পড়ে যায়। প্রায় রাতেই বিছানা ভিজে যায়। নাতি-নাতনি এমন কী বৌ'রা পর্যন্ত ভিজে বিছানা নিয়ে ঠাট্টা করে! মায়ের দু'চোখে এখন অফুরন্ত জল। গোটা সংসারটাই তাঁর চোখে ঝাপসা। আমি ওঁকে বারবার আমার সঙ্গে আনতে চেয়েছিলাম। এলেন না। স্বামী সন্তানের স্মৃতি মেয়েদের পাথরের জীবন দান করে রে দিব্য--তুই বুঝবি না! কিন্তু আমি আমার মায়ের মতো নই। আমি ঐ জীবন কিছুতেই চাইতে পারি না।
--দিদার জীবনের সঙ্গে তুমি তোমার তুলনা করছো কেন? তোমাকে আমরা মোটেই ওভাবে রাখবো না--
--নিজের শেকড় উপড়ে গেলে আর শক্ত হয়ে দাঁড়ানো যায় না বাবা! আমি এখনো যথেষ্ট কর্মক্ষম আছি। নিজের ইচ্ছে মতো স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই। তোমাদের দয়া নির্ভর জীবনে আমার কোনোরকম আগ্রহ নেই।
--তার মানে তুমি এই বাড়ি বিক্রি করে আমাদের সঙ্গে যাবে না?
দিব্য সরাসরি জানতে চাইল।
--না।
--কমলেশবাবুর সঙ্গে এই বাড়িতে একসঙ্গে থাকতে তোমার লজ্জা করবে না?
--কি আষ্চর্য! লজ্জা করবে কেন? আমরা পরস্পরকে দেখাশোনা করবো। পাগলী মেয়েটা আর তার বাচ্চাটা আমাদের সঙ্গে থাকবে। বাচ্চাটা বড় হবে, পড়াশোনা করবে--
--কিন্তু লোকে কি বলবে? কমলেশবাবুর সঙ্গে একসঙ্গে এই বাড়িতে এই বয়সে--ছি: ছি:!
বড় বৌ শ্যামলী গায়ত্রীর সিদ্ধান্তটা কল্পনা করেই যেন কুঁকড়ে গেল ঘেন্নায়।
--এক বাড়িতে কি বলছো বৌমা? আমার ঘরে গিয়ে দেখে এসো দুটো খাট দু'দিকের দেওয়ালের পাশে নেখেছি। আমরা তো একই ঘরে থাকবো। তা না হলে পরস্পরকে সাহায্য করবো কি করে? দেখাশোনা করবো কি করে?
--মা! চুপ করো তুমি। তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছো?
দিব্য চিৎকার করে ওঠে। হাতের সপাট ধাক্কায় টেবিলের ওপর সাজানো কাচের বাসনপত্র ঝনঝন শব্দে মেঝেয় ভেঙ্গে পড়ে।
--বাবার কথা মনে পড়ছে না তোমার? এই ব্যাভিচার সমাজ মেনে নেবে? মাথা সোজা রেখে এই শহরে হাঁটতে পারবে?
মেয়ে দীপ্তি কেঁদে ফেললো হাউ হাউ করে।
--অযথা তোরা হৈ-হৈ করছিস। এই বয়সে ব্যাভিচারী হওয়া যায় না। স্রেফ একটু ভাল ভাবে বাঁচার জন্যে একটা সুস্থ সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করা যায়। আমি তো তাই করেছি। এতে অন্যায় কি দেখছিস তোরা আমি তো বুঝতেই পারছি না।
--মাগো! এই বয়সে নতুন করে প্রেম! এতো ফিল্মেও হয় না!
বিদ্রূপে ঝলসে ওঠে বড় বৌ শ্যামলী।
--ফিল্মেও যা হয় না তা তুমি কি করে বুঝবে বৌমা? এসব বোঝবারই বা দরকার কি তোমার? আমাকে আমার মতো থাকতে দাও তোমরা। তোমাদের সঙ্গে আমি যাচ্ছি না এটাই আমার শেষ কথা!
গায়ত্রী টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই দিব্য বলে ওঠে--
--এই বাড়ি তোমার একার নয়। আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি। আমরা ঠিক করেছি এই বাড়ি আমারা বিক্রি করে দিয়ে যাব।
--তা কি করে হয় দিব্য? এ বাড়ির মালিক তোর বাবা নন। আমার নামেই বাড়ি। যতদিন বেঁচে আছি ততদিন---দলিলপত্র দেখতে চাইলে দেখতে পারিস!
গায়ত্রীর ঘোষণায় সকলে স্তম্ভিত হয়ে গেল। সকলকে নির্বাক পাথর করে দিয়ে গায়ত্রী নি:শব্দে নিজের ঘরে ঢুকে খিল দিয়ে দিলেন!

প্রাত:ভ্রমণের জন্য তৈরি হয়ে নিচে নেমে গায়ত্রী দেখলেন মিমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে নদীর দিকে মুখ করে। গায়ত্রী পেছন থেকে মিরি কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন--
--কি দিদিভাই আজ আমার সঙ্গে হাঁটবে না?
--না ঠাম্মা। আজ সকালেই যে আমরা চলে যাচ্ছি। গোছগাছ সব হয়ে গেছে।
--তাই বুঝি?
গায়ত্রীকে কেউ এ কথা জানায়নি। সম্ভবত: রক্তমাংসের তৈরি সম্পর্কের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তা গতরাত্রেই শেষ হয়ে গেছে!
--জানো ঠাম্মা, মা-বাবা আমাকে মিমি বলে ডাকে। ছোট্ট ছোট্ট জামাকাপড় পড়তে বলে। আধুনিক শহুরে হতে বলে। অথচ নিজেরা দেখ, কাল তোমার সঙ্গে কেমন বিশ্রী ঝগড়া করলো! তোমার কত পিছনে পড়ে আছে ওরা।
--আমাকে তোর খারাপ লাগছে না দিদিভাই!
--একটুও না। তুমি তোমার মতো বাঁচবে--অন্যকে বাঁচাবে--এর মধ্যে খারাপের কি আছে? আমিও তো তাই করবো ঠাম্মা!
--হ্যাঁ দিদিভাই, তাই করবে। তবে তার আগে ভাল আর মন্দের তফাৎটাও বুঝতে শিখবে। ভুল হয় না যেন!
--ঠাম্মা!
--কিছু বলবে দিদিভাই?
--পাগলী মেয়েটার বাচ্চাটার নাম আমি দেব?
--ওরে বাবা! এর মধ্যে নামও ভাবা হয়ে গেছে?
--হ্যাঁ। আমার দেওয়া নাম রাখবে?
--রাখবো। বলো কি নাম?
--ওর নাম রেখো গায়ত্রী। অনেকদিন পরে যদি আমি কখনো এখানে আসি তখন--
বলতে বলতে একছুটে ভেতরে চলে গেল মিমি।
গায়ত্রী সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে ভাবলেন রক্তমাংস শেষপর্যন্ত কাউকেই ছাড়ে না!

 

(শেষ)