গান ও বয়ান: রবীন্দ্রনাথের ‘আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে ...’


ইমন জুবায়ের


এত গান কোত্থেকে আসে? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও বুঝি বেঁচে থাকতে এই প্রশ্নে বিস্মিত হয়েছিলেন -এই প্রশ্নে বোধ করেছিলেন গভীর বিস্ময়পুলক; তাঁর সেই সুগভীর বিস্ময়পুলকও উঠে এসেছে তাঁরই একটি মনোরম গানে ...যে গানে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন: ‘এ তার বাঁধা কাছের সুরে,ঐ বাঁশি যে বাজে দূরে।’ তাইই বলছিলাম যে- এত গান কোত্থেকে আসে?


গান

আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে ...
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে।
একতারাটির একটি তারে গানের বেদন বইতে নারে,
তোমার সাথে বারে বারে হার মেনেছি এই খেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে।

এ তার বাঁধা কাছের সুরে,
ঐ বাঁশি যে বাজে দূরে।

গানের লীলার সেই কিনারে, যোগ দিতে কি সবাই পারে
বিশ্বহৃদয়পারাবারে রাগরাগিণীর জাল ফেলাতে-
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে।

বয়ান:

আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে ...
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে।

আমার = আমাদের কবি। কিন্তু, তোমার = কে? সে যেই হোক। তার সুরে সুর মেলানোই জীবনের পরমার্থ। তার সুরে সুর মেলাতে মেলাতে দিনটি গিয়ে ঠেকে সন্ধ্যায়। তা, কেন সুর মেলাতে হয়? সুর মেলানোই কেন জীবনের অমোঘ লক্ষ?
এই প্রশ্নগুলি উঠে আসে।

একতারাটির একটি তারে গানের বেদন বইতে নারে,
তোমার সাথে বারে বারে হার মেনেছি এই খেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে



কবির হাতে একতারা। সেই একতারা গানের বেদন সইতে পারে না। কিন্তু, এই ‘গানের বেদন’ মানে কি? ভাবছি। গানের বেদন কি সেই পরম মুহূর্ত-যে পরম মুহূর্তে পরিচিত জগতের ওপর থেকে পর্দাটি সরে যায় -পরিচিত জগতের ওপর অপরা জগতের ছায় পড়ে ? আর এই ঘটনাটি ঘটায় সুর ও বাণীর বিস্ময়কর সম্মিলন? হতে পারে। এরপর কবি বলছেন-

তোমার সাথে বারে বারে হার মেনেছি এই খেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে

খেলা? খেলাইতো। খেলা। বা লীলা। এই লীলার কথাই পরে আবার বলেছেন- ‘গানের লীলার সেই কিনারে, যোগ দিতে কি সবাই পারে?’ সবাই পারে না। কবি পারেন। তবে কবির স্বস্তি নেই। কেন? কবি বার বার হেরে যাচ্ছেন যে। খেলায় হেরে যাচ্ছেন। কোন্ খেলায়? তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে\ এই খেলায়। যে খেলা খেলতে খেলতে দিনটি গিয়ে ঠেকে সন্ধ্যায়। এই খেলা খেলতেই হয়। কারণ-

এ তার বাঁধা কাছের সুরে,
ঐ বাঁশি যে বাজে দূরে।

ঐ দূরের বাঁশীর সুর শোনার জন্যই তো সব ফেলে সুরে সুর মেলাতে হয়। কেননা, ঐ পরম মুহূর্তে পরিচিত জগতের ওপর থেকে পর্দাটি সরে যায় -পরিচিত জগতে ছায়া পড়ে অপরা জগতের। অপরা জগতের ছায়টি একপলক দেখে নেওয়ার জন্যই তো মানবজনম? নৈলে এই বেঁচে থাকার অন্য আর কি মানে হতে পারে?
সবাই কি সেই ছায়া দেখতে পারে?
না।

গানের লীলার সেই কিনারে, যোগ দিতে কি সবাই পারে
বিশ্বহৃদয়পারাবারে রাগরাগিণীর জাল ফেলাতে-
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে।

কবিরা ছাড়া আর কেউ তো অপরা জগতের ছায়া দেখবে বলে দিনকে নিরন্তর সন্ধ্যায় ঠেকায় না। সবাই তো চোখের দেখার জগতেই লিপ্ত ...

 

গানের লিংক  http://www.esnips.com/doc/bef34548-6a1a-48af-9286-d917f3e3afbf/Amar-Bela-Je-Jai