স্বপ্ন
লীমা জামান শিল্পী

চুলোয় চাল চড়িয়ে মেয়েটি দৌড়ে এলো বারান্দায়। না চড়ুই পাখিটি নেই। কেন যে একটি চড়ুই বারবার তার দিকে উঁকি দিয়ে ফিরে যাচ্ছে। কিচির কিচির কিক। কি বলছে পাখিটি। এটা কি কোন খেলা। তার ভাল্লাগছে না এসব। আপাতত সে ভাবছে গত রাতে স্বপ্নটা নিয়ে।
ভাবনার ঘূর্ণিজালে মাঝে মাঝে সে ভুল রাস্তায় হাঁটে। কলেজ থেকে তার বাড়ী হাটার পথ। একদিন ক্লাস শেষে এলোমেলো পায়ে সে হেটে চলেছে বড় রাস্তার পাশ দিয়ে। যেখান দিয়ে দৌড়ে যায় বড় বড় গাড়ী। সহপাঠী যে মুগ্ধ চোখে প্রায় তাকাতো রিক্সা থামিয়ে বিষ্মিত চোখে বললো,তুমি একা এদিকে কোথায় যাচ্ছো? মেয়েটি বলেছিল,বাসায় !
এমন আনমনা মেয়েটি। কি মনে হতে একদিন খুব সেজে কলেজে গেল। ঘনিষ্ঠ বন্ধুটি ছুটে এলো
: দেখতো শীলা কেমন লাগছে টিপটা কি বাঁকা হয়েছে?
: করেছিস কি? পায়ের দিকে তাকা তুই না একটা আজব!
পায়ের দিকে চেয়ে দ্যাখে বাবার বাথরুম স্যান্ডেল পরে চলে এসেছে যেটা কম করে তার পা থেকে পাঁচ ইঞ্চি লম্বা। তবু সে ভাবছে শীলাটা ইদানিং আজব শব্দটা বেশী ব্যবহার করছে।
এখন মেয়েটির বয়স বেড়েছে। ছাব্বিশ বছর গুনলে অনেক। স্বভাবে কৈশোরের চাপল্য। চিন্তায় একেবারে প্রাজ্ঞ,প্রাচীন।
ঘন্টার পর ঘন্টা সে দাঁড়িয়ে দ্যাখে পিঁপড়েদের পথচলা। চারিদিকে কতো কি ঘটছে। কিছুদিন সে খুব ভাবলো আকাশ গ্রহ নক্ষত্র এসব নিয়ে। নক্ষত্র মৃত্যুকে মনে করিয়ে দেয়। দাদুকে ক্যান্সার নির্ঘাত নিয়ে যাবে। মৃত্যুই যদি অনিবার্য তবে কেন কষ্ট? কে সৃষ্টিকারী কে ধ্বংসকারী ? জন্মান্তর সে কি? উহ্ কোন প্রশ্নের উত্তর মেলে না। না, সে দর্শন শাস্ত্রের ছাত্র বা শিক্ষক নয় তবু তার মাথাটা এসব ভাবনায় ভারী।
একটি সুন্দর প্রজাপতি সিঁড়ির পাশে পড়ে আছে। কেউ ভ্রূক্ষেপ করছে না। নীল শরীরে সোনালী কারুকাজ। অবহেলা। অবহেলা পেলে নাকি জড় পদার্থও দূরে সরে যায়। প্রজাপতি তো জীবন্ত সে কেন পালিয়ে যাচ্ছে না। সরারাত অবহেলিত সুন্দর মাথায় সূচ ফুটিয়েছে। ভোরবেলা দ্যাখে পিঁপড়ে সৈন্যরা ছিড়ে খুড়ে খাচ্ছে অভিমানী প্রজাপতিটির লাশ। চোখ জ্বলছে। কে তার ভেতর প্রজাপতিটির জন্য এতো মমতা ঢুকিয়ে দিলো। কে?
প্রতিবেশীনীর প্রশ্ন, ভাবী কাঁদছেন কেন? কি খুঁজছেন?
হ্যাঁ,আমার সোনায় বাঁধানো হীরের দুলটা পড়েছিলো সিড়িতে হারিয়ে গেল যে!
সত্যি আশ্চর্য এইভাবে ঠিক এই জায়গায় কোন প্রজাপতি আর আসবে না যদিও আসে তবে তার রং নিশ্চয় নীল হবে না। নীল যদি হয়ও তবে সে হয়তো কেউ ছুঁয়ে দেবার আগেই উড়ে যাবে অন্য কোন খানে। রাতে সে যে কবিতা লিখেছে এই কবিতা সে দ্বিতীয়বার লিখবে না। যদিও বা লেখা হয় তবে লিখতে বসার ভঙ্গীটি নিশ্চয় পাল্টে যাবে। একই ঘটনা দ্বিতীয়বার ঘটে না ঠিক সেই ঘটনার অনুবাদে। সামান্য হলেও বদলে যায়। কিন্তু সে আজ ভাবতে চায় গত রাতের স্বপ্নটা নিয়ে।
বহুকাল আগে সে একটা উপন্যাস পড়েছিল, দ্বিতীয় সত্তার সন্ধানে। মধুকর চরিত্রটি তাকে বিভ্রান্ত করেছিল। 'মেলিতেছে অংকুরের পাখা লক্ষ লক্ষ বীজের বলাকা।' এসব বাক্য বহুদিন তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
বারান্দার টবে ফুটে আছে ফুল আছে না ফোটা কুঁড়ি। প্রায়ই রাতে বিছানা ছেড়ে উঠে আসে মেয়েটি। দেখে কুঁড়ি কিভাবে ফুল হয়ে যায়। এ অভিসারে কালকের রাতটা ছিলো কুয়াশাচ্ছন্ন। টুলে বসে হঠাৎ চোখে পড়লো আকাশে পূর্ণ চাঁদ আর এদিকে আশ্চর্য সুন্দর চোখের পুরুষ মূর্তি ঝড়ের বেগে তার হাত ধরে টানছে। বলছে,মাধবী চলো তোমাকে অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখাবো!
মেয়েটি দেখলো ওর এক হাতে তার হাত অন্য হাতে ধরা প্রিয় সাদা রং এর কিছু ফুল। এবং অবাক হয়ে দেখলো সেই ফুলে নীল একটি প্রজাপতি তিরতির করে কাঁপছে সোনালী নক্সার পাখা তার। ছেলেটি বড় অস্থির ব্যস্ত ভঙ্গিতে আবার তার হাত ধরে টানছে। মেয়েটি বিব্রত হয়ে বললো,কে আপনি? আমার নাম তো মাধবী নয়। ছেলেটি খুব ঠান্ডা গলায় বললো -আমি মধুকর। মেয়েটি ভীষণ ভাবে চমকালো। চোখ মেলে দেখলো কেউ নেই শুধু বাতাসে কাঁপছে সেই না ফোটা কুঁড়ি।
কলিং বেল বেজে চলেছে। টুং ............. টাং শব্দটা তো বেশ। শুনলে নাচের একটা তাল চলে আসে শরীরে। ঘড়িতে ঘন্টা বাজলো ঢং ঢং ঢং ! দুপুর দুটো। শব্দটা কেমন যেন বিপদ সংকেত। হঠাৎ সে বিদ্রোহী একটা ভঙ্গিতে নেচে উঠলো। আমি সেই দিন হবো শান্ত যবে .........। কড়া নড়ছে। দরজা খুলে দেখলো ভদ্র লোক উত্তেজিত গলায় বলছে,আগুন ধরেছে নাকি? গন্ধ কিসের? দৌড়ে খালি হাতে হাঁড়ি নামাতে গিয়ে দ্যাখে ভাত পুড়ে কয়লা আর এদিকে মেয়েটির একটা হাত পুড়ে কাবাব। অগত্যা না খেয়েই কর্তা গেলেন কর্মে। মনে মনে বললেন - ছেলে মানুষী।
মেয়েটি বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ। কার জন্যে যেন বুকের কোথাও বেদনা অনুভূত হচ্ছে। কার জন্যে মধুকর? ঠিক তাই। গত রাতের স্বপ্ন কি সে কোনদিন দেখবে না ? যদি দেখতো। মধুকর! ওহ মধুকর দেখা দাও। দেখা দাও।
কি আশ্চর্য! সেই একই দৃশ্য । ওকে হাত ধরে টানছে অন্য হাতে ধরে আছে সাদা ফুল প্রজাপতিও ঠিক আছে। বলছে মাধবী চলো ....
মেয়েটি বলছে,আমার নামতো মাধবী নয়...। তবু সে প্রচন্ড জোরে হাত চেপে ধরেছে। চলো মাধবী চলো। দেরী হয়ে যাচ্ছে। অনেক দেরী ......।
-কে আপনি? আমার নাম তো মাধবী নয়!
সাইড টেবিলে রাখা কাঁচের ফুলদানী ভেঙ্গে মেয়েটির ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলো। তাকিয়ে দেখে ফুলতো নয় সাদা বালিশে পড়েআছে যন্ত্রনায় নীল ঝলসানো একটি হাত যে হাত শোভিত করার চেষ্টা করছে একগাছি সোনার চুড়ী।
ব্যথায় কাতর হাত খিদের আগুন পেটে নিয়ে মেয়েটি ভেবে চলেছে। একই স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি। এক। হুবহু এক কিন্তু গতকাল স্বপ্নটা সে রাতে দেখেছিল ।