চির অচেনা
ওভাবে জল ছিটিও না । শাড়ীটা তো ভিজে যাবে।
চমকে উঠলো সেজুঁতি।অনিমেষের কন্ঠ না? কোথা হতে কথা বলে উঠলো অনি? আজ যে খুব সখের একটা নীল শাড়ি পরেছে সেজুঁতি। অনির খুব পছন্দের রঙ। আকাশী নীল। অনির জন্য। অনিমেষ আসবে বলে। তার জন্যই যে সেজুঁতির এত প্রতীক্ষা। কিন্ত অনি যে নেই। আছে শুধু ওর স্মৃতিটুকু। এই স্মৃতিকাতরতা কি সেজুঁতিকে বিভোর করে তুলে বারবার? তাই রিসোর্টের চারধারে ঘেরা খোলা বারান্দায় এসে দাঁড়ালে যেমন ও অনিমেষের স্পর্শ পায় তেমনি রিসোর্টের কাছের ছোট্ট এই জলাধারের পাশে এসে বসলেও সে অনির উপস্থিতি অনুভব করতে পারে। পা দিয়ে জল ছিটালে টের পায় অনির ব্যাকুলতা।
জলাধারের ঐ পাশটাতে অনেক গাছ গাছালী ভরা ছোট্ট একটা জঙ্গল আছে। আর এই জলাধারের প্রবাহ গিয়ে মিশেছে রিসোর্টের বাইরের ঐ দীর্ঘ স্রোতধারার সাথে। জঙ্গলের গাছ গাছালীর মাঝে হারিয়ে যেতে খুব মন চাইছে আজ তার।বড্ড ক্লান্ত সে।প্রিয়জনকে হারানোর যন্ত্রণায় খুব দুখী একটা মানুষ। অনি চলে যাওয়ার পর থেকে ও খুব একা।তাই কাঞ্চনপুরের জনমানবহীন কোলাহলমুক্ত এই রিসোর্ট এখন তার নিঃসঙ্গতার সঙ্গী।
সেজুঁতিদের পারিবারিক ব্যবসার একটা অংশ এই রিসোর্ট। সারাবছর টুরিস্টের আগমনে এর সামনের দিকটায় চলে জমজমাট ব্যবসা। আর পিছনের এই বাগান ঘেঁষা অংশটুকু শুধুই সেজুঁতির । খুব বেশী করে অনিমেষকে খুঁজে পায় সে এই নির্জন জায়গাটায়। কল্পনা আর ভাবনায় রচনা করে অনির সাথে কিছু সুন্দর মুহূর্ত। কিন্তু এ সকল তো তার একান্তই কল্পনা। বাস্তবে? অনি তো নেই। কোথাও নেই। আর সেজুঁতি আছে অনিকে ছাড়া। তারপরও সেজুঁতি মেনে নিতে পারেনা এ সত্যি। মনে প্রাণে বিশ্বাস করে অনি আছে। ও আছে এ মহাজগতের কোথাও না কোথাও। অনি হারিয়ে যায়নি ।মানুষ মরে গিয়েও হারিয়ে যেতে পারেনা। হয়তোবা চলে যায় অন্য কোন জগতে, অন্য কোন অবস্থায়, যা আমাদের ভাবনার যেমন অতীত, বোধেরও তেমনি উর্ধ্বে। অনি হয়তোবা সেখানে।
সেজুঁতি আবারো আনমনে হয়ে উঠে। জলাধারের পাশের ইট বাঁধানো ঘাটের সিঁড়িগুলো একে একে পার হয়ে উপরে উঠে আসে। শাড়িটা ধরেছে একহাতে।একটু এলোমেলো শাড়ীটা ঠিক করে নিয়ে চারিদিকটা দেখে ভাবনার মাঝে আবারো ডুব দেয়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবার আগেই একবার ঘুরে আসবে ঐ জঙ্গলটার দিক থেকে। বাউন্ডারী দেয়ালের পাশে আরো বেশি গাছগাছালি।দু চারটে হরিণও খেলে বেড়ায় ওপাশে। এই অবকাশ যাপন কেন্দ্রটি গহীন অরন্যের হাতছানি দেয়া সৌন্দর্য্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছে বিশেষ ভাবে। হরিণছানাদের ভয় নেই যদিও, তবুও অন্যান্য পশুপাখিদের কথা তো আর বলা যায়না। এসব ভেবে ভেবেই সেজুঁতি এগুতে থাকে গাছপালার ভীড়ে।
অশ্বত্থ গাছের বিরাট শাখা নুইয়ে পড়ে আছে জলাধারের শেষ প্রান্তে।পাখির কিচির মিচিরে বনের এই গহীন ভিতরটা মুখরিত। বেশ ঘন বনের গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের সোনালী আলো মাঝেমাঝে ঝিকিমিকি করে। পায়ের নীচে এবড়ো থেবড়ো সরু পথ চলে যাচ্ছে বহুদূরে আরো গহীনে। সেজুঁতি নিজেও ভাবেনি এই রিসোর্টের পরিধি এতটা বিশাল। হেঁটে যতই সামনে এগুচ্ছে ততই মনে হচ্ছে শেষের দেখা আর মিলবে কি? পাখির গান, সুমিষ্ট সুরেলা কন্ঠধ্বনি ওকে আরো মোহগ্রস্ত করে তুলেছে। ও এগিয়ে চলেছে বনপথ ধরে কোন এক অজানা আকর্ষণে। মোহাবিষ্ট সেজুঁতি হারিয়ে গেছে প্রকৃতির মাঝে। হারিয়ে গেছে নিজের নিজ থেকে। কোন এক সুরেলা সুরধ্বনি বাজছে চারিধার। টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেজুঁতিকে কোন এক অনন্ত অসীমে। অজানা সে জগত। চারিদিকে ঘন বন। কাঠবেড়ালীর ছোটাছুটি। হঠাতই সেজুঁতি সম্বিত ফিরে পেল। কাঠবেড়ালীদের আনন্দ দেখে মনে হলো হাতের ব্যাগে সে যে কয়টা বাদাম নিয়ে এসেছিল ওগুলো ওদেরকে দিলে কেমন হয়। হাতের ব্যাগটা খুলে বাদামের প্যাকেটটা বের করতেই সেজুঁতি আবিষ্কার করলো বাদামগুলো যেন পুরোনো হয়ে গুড়ো গুড়ো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এত পুরোনো তো হবার কথা নয়। আজ বিকেলে এখানে আসবার আগেই তো বাদামগুলো কিনে প্যাকেট করে ব্যাগে ভরেছে। কিছু বুঝতে না পেরে আনমনেই বাদামের প্যাকেটটা ব্যাগে ভরতে গিয়ে লক্ষ্য করলো হাতের ব্যাগটাও বেশ পুরোনো মনে হচ্ছে। চোখের ভুল নয়তো? তার প্রিয় ঝকমকে এই পার্সটা এত পুরোনো দেখাবার তো কথা নয়। মাত্র সেদিনই তো কেনা হল বাজার থেকে। আর এ কয়েকদিনেই এত মলিন আর এত ধূসর হয়ে গেল। যেন জাদুঘরে রেখে দেয়ার মতন কোন অ্যান্টিক। নিজের চোখের ভুলে নিজেই হাসলো। আর ঠিক এ সময়েই পেছন থেকে একটি কাঠবেড়ালী টুক টুক করে ডেকে উঠলো। যেন কাঠবেড়ালীটি ওকেই ডাকছে। ওর দিকে চেয়ে চেয়েই ডাকছে। সেজুঁতি আবারো পেছন ফিরে চাইলো। গুড়ো গুড়ো বাদামের কণাগুলো ওকে দেবার জন্য মন চাইলেও তা পারলোনা। কাঠবেড়ালীকে একঝলক দেখে সেজুঁতি আবারো সামনে এগুবার চেষ্টা করলো । কিন্তু অত্তটুকুন কাঠবেড়ালী নাছোড়বান্দা যেন। আবারো টুক টুক করে ডেকে উঠলো। সেজুঁতি পেছনে ফিরে চাইতেই দেখলো গাছে গুঁড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাসিমাখা মুখে অনিমেষ। এও নিশ্চয়ই চোখের ভুল। আরো একটি ভুল । কারণ অনিমেষ আসবে কোথা থেকে? অবাক হয়ে চেয়ে রইলো সেজুঁতি বেশ খানিক্ষণ। অনিমেষ কাছে এলো। সাদা আভায় আলোকিত হয়ে উঠেছে বনের পরিবেশ। মাঝে অনিমেষ দাঁড়িয়ে ঠিক ওর সামনে। বিশ্বাস করতে না পারলেও অস্ফুট কন্ঠে বলল, তুমি?
অনিমেষের সেই মনভোলানো হাসি। অনাবিল প্রাণোদীপ্ততায় ভরপুর। খুব আদুরে গলায় বলল,
-এসো সেজুঁতি। এসো আমার সাথে।
সেজুঁতি কিছু না বুঝে হাত বাড়ালো । এ স্পর্শ তার বহুদিনের চেনা। এ তো তারই অনিমেষ। কিন্তু এ গহীন জঙ্গলে সে এলো কোথা হতে? মাস ছয়েক আগের সেই অ্যাকসিডেন্টে অনিমেষ তো তাকে ছেড়ে চলে গেছে তারই চোখের সামনে। আজ তার এমন কেন হচ্ছে? সবকিছু যেন এলোমেলো। সেজুঁতির প্রশ্নভরা চোখের বিস্ময় অনিমেষ ঠিকই বুঝতে পেরেছে। তাই হাতের আলতো চাপে অনিমেষ বললো,
-আমি তোমারই অনি। সেজুঁতি । আমি তোমারই অনি।তোমার অপেক্ষায় ছিলাম এতদিন। যেমন ছিলে তুমি।আজ আবার এক হলাম আমরা। এবার আর ছাড়াছাড়ি নয়।
কিন্তু সেজুঁতি আবেগে উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে পারছে না কেন? ওর অনিকে ছুঁয়েও ওর মনে বারবার প্রশ্ন এসে দাঁড়াচ্ছে, তাহলে কোথায় ছিলে এ ছয় মাস অনি?
সেজুঁতির শাড়ির আঁচলে মুখটা আলতো ভাবে ছুঁয়ে অনি বললো, অন্য এক ইউনভার্সে। তোমার জগতের মতো ঠিক অন্য একটি জগতে। তোমার পৃথিবীর মতো এ আরেক পৃথিবী যেখানে এখন তুমি এসেছো। আমার অ্যাকসিডেন্টের পর এখানে আমি এসেছি পড়েছি। আসলে অ্যাকসিডেন্টের পর নয়। বরং বলা চলে এখানে আসার পরপরই ঐ পৃথিবীতে আমার অ্যাকসিডেন্ট ঘটেছিল। তারপর থেকেই আমি তোমার অপেক্ষায় রয়েছি সেজুঁতি । সময় এখানে স্থির। কিন্তু তোমার এই আগমন মুহূর্তে আমাদের সেই ফেলে আসা পৃথিবীতে সময় আরো বিশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আর এখনও ঠিক বিশ বছর পর সেই জগতের পৃথিবীতে তোমার বাবা মা কাঞ্চনগড়ের সেই রিসোর্টের পাশে বসে থাকেন আনমনে। তোমায় খুঁজে বেড়ান সেই বাগানে, যে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে তুমি আজ আমার কাছে এসেছো। কিন্ত এখানকার ডাইমেনশান তাদের ডাইমেনশান থেকে আলাদা হওয়াতে তারা যেমন তোমায় দেখতে পান না , তুমিও পাও না। আমিও তো পাইনি এতদিন সেজুঁতি। কিন্তু আমার আবেগ, আমার অনুভূতি তোমায় আমার কাছে টেনে এনেছে আমার এই জগতে।চারিদিকে তাকিয়ে দেখ। তোমাদের কাঞ্চনগড়ের রিসোর্টের সেই বাগান। আর তেমন কি কিছু চোখে পড়ে? ঐ স্থাপনাগুলো? ইট বাঁধানো পুকুরের পাড়গুলো? চেয়ে দেখ, বহুদিনের শ্যাওলা জমে থাকা ও দিকটা আর কেউ ব্যবহার করে না। তার কারণ একটাই। তুমি যে মুহূর্তে এখানে প্রবেশ করেছ সে সময় থেকে তোমার পৃথিবীতে নিখোঁজ তুমি। হাজার খোঁজাখুঁজির পর তোমায় না পেয়ে তোমার পরিবার এই রিসোর্টের ব্যবসা বন্ধ করে দেন। আজ প্রায় বিশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে ওখানে। রিসোর্টের ও দিকটায় মানুষের কোলাহল মুখরিত পদচারণা আর দেখা যায় না।যে দুজন মানুষ তোমায় খুঁজতে বারবার এ রিসোর্টে ফিরে আসেন তাদের পক্ষেও সম্ভব হয় না এই ডাইমেনশানে তোমার কাছে চলে আসা। পৃথিবীতে তুমি নেই বিশ বছর। আর আমি মৃত অ্যাকসিডেন্টে। আমার দেহ পড়ে আছে ওখানকার মাটিতে। এই ডাইমানশানে আমি নতুন দেহ ধারণ করেছি। কিন্তু তুমি ওখানে কোথাও নেই। তুমি এসেছো পৃথিবীর সেই দেহ ধারণ করেই। এক মুহূর্তের এদিক সেদিকে বিশটি বছর পেরিয়ে গেছে বলে তোমার সাথের সব কিছু পুরোনো হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও সেজুঁতি, তোমার পরনের সেই শাড়িটা? আমারই দেয়া এই নীল শাড়িটায় তুমি এখনো সুন্দর। তুমিতো আগের মতনই আছো।
কথাগুলো বলে অনি যখন শান্ত হল, হঠাতই যেন সেজুঁতি সম্বিত ফিরে পেল। তার সকল অনুভূতি দিয়ে অনিমেষকে সে আগের মতন করেই অনুভব করলো। অনিমেষের খুব একটা খটকা লাগেনি সেজুঁতির এই অপার বিস্ময়। তাই সেজুঁতি প্রশ্ন করার আগেই অনি উত্তরটা দিয়ে দিল। সেজুঁতি এ জগত থেকে আবারো আগের জগতে ফিরে যেতে পারবে যদি প্রকৃতি এখানেও কোন অ্যাকসিডেন্ট নির্ধারিত করে রাখে। আর ততদিনে ফেলে আসা পৃথিবীর সময় আরো দুদশক বা চারদশক পেরিয়ে যেতে পারে । তখন সেজুঁতি ফিরে যাবে তার পুরোনো পৃথিবীর ভবিষ্যতের নতুন সময়ে। পুরোনো মানুষরা আর হয়তো বা থাকবে না। নতুন প্রজন্মের কাছে তার দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতি তাকে তখন করে তুলবে চির অচেনা।
হুমায়রা হারুন
নভেম্বর, ২০০৯