৪
'কিন্তু আপনি বলতে চাইছেন না--'গলায় কথা আটকে গেল রেইন্সফোর্ডের ।
'এবং কেন নয়?'
'আপনি সিরিয়াস আমি ভাবতেই পারছি না । এটা একটা ভয়ংকর রসিকতা করছেন আপনি ।'
'কেন আমি সিরিয়াস হবো না ? আমি শিকারের কথা বলছি ।'
'শিকার? জেনারেল জারফ আপনি যা বলছেন সেটা হত্যাকান্ড !'
দরাজ গলায় হেসে উঠলেন জেনারেল জারফ । রেইন্সফোর্ডকে প্রশ্নের চোখে দেখছেন তিনি । 'আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে আপনার মত একজন সভ্য ও আধুনিক তরুন মানুষের জীবনের মূল্য নিয়ে এখনো এত রোমান্টিক বিশ্বাস আঁকড়ে আছে । নিশ্চয়ই গত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা, আপনাকে এ ব্যাপারে---?'
'আমাকে ঠান্ডা মাথায় মানুষ খুন করতে শেখায়নি.' আড়ষ্টভাবে বলল রেইন্সফোর্ড ।
অট্ট হাসির দমকে কেঁপে উঠলেন জেনারেল । 'কী সাংঘাতিক মজার মানুষ আপনি!' বললেন তিনি । 'এমন কি আমেরিকাতেও আজকাল কোন শিক্ষিত তরুনকে, এরকম মধ্য ভিক্টোরিয়ান ধ্যান-ধারনা আঁকড়ে থাকতে দেখা যায় না । এটা অনেকটা একটা লিমুজিন গাড়িতে নস্যির কৌটো পাওয়ার মত ব্যাপার । সন্দেহ নেই আপনার পূর্বপুরুষরা সব পিউরিটান ছিলেন, অনেক আমেরিকানেরই তাই ছিল । আমি আপনার সাথে বাজি ধরতে পারি আপনার এসব তুচ্ছ বিশ্বাস ভেসে যাবে যখন আপনি আমার সাথে শিকারে যাবে । একদম নতুন থ্রিল পাবেন আপনি মি. রেইন্সফোর্ড ।'
'ধন্যবাদ । আমি একজন শিকারী, ঘাতক নই ।'
'ওহ আবার! সেই অপ্রীতিকর শব্দটা!' একটুও না চটে বললেন জেনারেল । 'আমি কিন্তু আপনার ধারনা যে ভুল সেটা এখনই দেখিয়ে দিতে পারি ।'
'তাই?'
'জীবন শক্তিমানদের জন্য । শক্তিমানরাই বাঁচে এবং যদি দরকার হয় শক্তিহীনদের জীবন নিয়ে হলেও । জগতে দুর্বলরা আছে শক্তিমানদের আনন্দের জোগান দিতে । আমার শক্তি আছে, আমি কেন এই ক্ষমতা ব্যবহার করব না ? আমি যদি শিকার করতে চাই, শিকার করব না কেন ? দুনিয়ার আবর্জনাদের আমি শিকার করি । বিভিন্ন ট্র্যাম্প জাহাজের খালাসীদের---চীনা, নিগ্রো, দো আঁশলা, শ্বেতাঙ্গ । একটা ভাল জাতের ঘোড়া বা কুকুরের দাম ওরকম বিশটা মানুষের চেয়ে বেশী ।'
'কিন্তু ওরা মানুষ!' ক্ষেপে গিয়ে বলল রেইন্সফোর্ড ।
'একদম ঠিক কথা,' সায় দিলেন জেনারেল । 'আর সেজন্যই আমি আমার বিনোদনের জন্য ওদের ব্যবহার করি । কারন ওরা চিন্তা করতে পারে, অন্তত একটা পর্যায় পর্যন্ত । সেজন্যই ওরা বিপজ্জনক ।'
'কিন্তু আপনি ওদের কোথায় পান ?'
বাঁ চোখের পাতাটা নামালেন জেনারেল । 'এই দ্বীপটার নাম শিপ ট্র্যাপ আইল্যান্ড,' বললেন তিনি । 'মাঝে মাঝে ফুঁসে ওঠা সাগর আমাকে ওদের উপহার দেয় । যখন ভাগ্য এত সদয় হয় না তখন আমি নিজের ভাগ্যকে একটু সাহায্য করি । জানালার কাছে আসুন ।'
রেইন্সফোর্ড উঠে জানালা দিয়ে সাগরের দিকে তাকাল ।
'সামনে দেখুন!' বলে সামনের রাতের অন্ধকারের দিকে আঙ্গুল তুললেন । রেইন্সফোর্ডের চোখে অন্ধকার ছাড়া কিছু চোখে পড়ছে না । জেনারেল একটা বোতাম চাপতেই আলোর ঝলকানি দেখতে পেল রেইন্সফোর্ড ।
হাসলেন জেনারেল । 'সাগরে একটা চ্যানেলকে নির্দেশ করছে এই বাতিঘর । 'কিন্তু আসলে সেখানে কোন চ্যানেলই নেই, আছে ক্ষুরের মতন ধারাল ডুবো পাহাড়ের সারি । সাগরদানোর মতই যেকোন জাহাজকে ভেঙ্গে ফেলতে পারে যেভাবে আমি এই বাদামটাকে ভেঙ্গে ফেলছি,' বলে শক্ত কাঠের মেঝেতে একট আখরোট ফেলে জুতোর তলা দিয়ে সেটা পিষে ফেললেন জারফ । 'হ্যাঁ, আমাদের বিদ্যুত আছে,' যেন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন এভাবে বললেন জেনারেল । 'আমরা সভ্য থাকার চেষ্টা করি ।'
'সভ্যতা? আর আপনি মানুষ খুন করেন ?'
ক্ষণিকের জন্য রাগের ছায়া দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল জেনারেলের চোখে । একইরকম আমুদে, আন্তরিক গলায় বললেন তিনি, 'কী সাংঘাতিক ন্যায়পরায়ন যুবক আপনি ! আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি আপনি যা ভাবছেন আমি সেভাবে বর্বরের মত করি না কাজটা । আমি তাদের প্রত্যেকটা প্রয়োজনের প্রতি খেয়াল করি । তারা যথেষ্ট পরিমানে খাবার ও এক্সারসাইজের সুযোগ পায় । তারা যথেষ্ট হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে । আপনি আগামীকালই দেখতে পাবেন ওদের ।'
'আপনি কী বলছেন ?'
'আমার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দেখতে যাবো আমরা । এটা মাটির নীচের সেলারে অবস্থিত । প্রায় ডজনখানেক ছাত্র আছে এখানে এই মুহূর্তে । এরা সব ডুবে যাওয়া স্প্যানিশ জাহাজ, স্যান লুকার থেকে এসেছে । তবে এই চালানটা খুবই বাজে, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি । জঙ্গলের থেকে জাহাজের ডেকেই এরা বেশী চালু ।' জেনারেল হাত তুলতেই ইভান যে ওদের ওয়েটারের কাজ করছিল, যে ওদের ঘন টার্কিশ কফি এনে দিল । অনেক কষ্টে নিজের মুখ বন্ধ রাখল রেইন্সফোর্ড ।
'দেখুন, আসলে এটা একটা খেলা,' মসৃন গলায় বলে চললেন জেনারেল । 'আমি ওদের একজনকে প্রস্তাব দেই শিকারে যাবার । যথেষ্ট পরিমানে খাবার আর একটা হান্টিং নাইফ দেই তাকে । তিন ঘন্টা সময় দেই আগে যাবার, তারপর আমি সবচেয়ে ছোট ক্যালিবার আর রেঞ্জের পিস্তল নিয়ে ওকে অনুসরন করি । আমার শিকার যদি তিনদিন আমার চোখে ধূলো দিয়ে, এই দ্বীপে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে, তবে সে জিতে গেল । আর--' হাসলেন জেনারেল, 'আমি যদি তাকে খুঁজে পাই তবে সে হেরে গেল ।'
'সে যদি খেলতে অস্বীকার করে তবে ?'
'ওহ,' বললেন জারফ । 'আমি তাকে এই অপশনটা দেই যে খেলতেই হবে সেটা বাধ্যতামূলক নয়, সে মর্জি হলে খেলবে । সে যদি খেলতে না চায় তবে আমি তাকে ইভানের হাতে তুলে দেই । ইভান একসময় মহান জারের খাস চাবুক-বরদার ছিল, স্পোর্টস সম্বন্ধে ওর নিজস্ব কিছু চিন্তা ভাবনা আছে । অবশ্যম্ভাবী ভাবে মি. রেইন্সফোর্ড, ওরা আমার সাথে খেলতে রাজী হয় ।'
'আর যদি ওরা জেতে?'
জেনারেলের মুখের হাসিটা চওড়া হল । 'আজ পর্যন্ত আমি কখনো হারিনি মি. রেইন্সফোর্ড ।' বলে তাড়াহুড়ো করে যোগ করলেন, 'আপনি আমাকে হামবড়া ভাবছেন না আশা করি । বেশীরভাগই আসলে একেবারে প্রাথমিক ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে । মাঝে সাজে আমি বেশ শক্ত লোক খুঁজে পাই । সেক্ষেত্রে আমাকে কুকুর ব্যবহার করতে হয় ।'
'কুকুর?'
'এইদিকে আসুন প্লিজ । আমি দেখাচ্ছি আপনাকে ।'
জেনারেল জারফ, রেইন্সফোর্ডকে আরেকটা জানালার ধারে নিয়ে গেলেন । জানালা থেকে আলো নীচের উঠানে পড়ে বিচিত্র নকশা আঁকছে । রেইন্সফোর্ড দেখতে পেল, নীচের উঠানে প্রায় ডজন খানেক প্রকান্ড কালো কালো ছায়া ঘোরাফেরা করছে । ওর দিকে চাইতেই ওদের সব চোখগুলো জ্বলে উঠল ।
'বেশ ভাল একটা পাল,' মন্তব্য করলেন জেনারেল । 'আমি রোজ সন্ধ্যা সাতটার সময় ওদের ছেড়ে দেই । কেউ যদি সেসময় বাইরে থেকে আমার বাড়িতে ঢোকার বা, ভিতর থেকে বাইরে যাবার চেষ্টা করে তবে অত্যন্ত খারাপ একটা পরিণতি ঘটবে তার ।' বলে ফোলি বার্জারের একটা গানের কলি গুনগুন করে সাধতে লাগলেন জেনারেল ।
'এবারে,' বললেন তিনি । 'আমার সর্বশেষ মাথার সংগ্রহটা আমি আপনাকে দেখাতে চাই । আপনি কী আমার সাথে লাইব্রেরীতে আসবেন ?'
'আশা করি আমাকে ক্ষমা করবেন,' বলল রেইন্সফোর্ড । 'আমি আসলেই আজ রাতে ভাল বোধ করছি না ।'
'ওহ তাই?' আন্তরিকতার সাথে জিগ্যেস করলেন জারফ । ' এরকম ঘটা খুবই স্বাভাবিক, বিশেষ করে লম্বা সাঁতারটা দিয়ে নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন আপনি । আপনার একটা লম্বা ঘুম দরকার । তাহলেই আমি বাজি ধরতে পারি যে আপনি আগামী কাল একদম ঝরঝরে বোধ করবেন । এরপর আমরা শিকারে যাবো ঠিক আছে ? আমার হাতে একটা চমৎকার শিকার আছে--' কিন্তু রেইন্সফোর্ড তার আগেই ঘর ছেড়ে যাবার জন্য পা বাড়াল ।
'আমি দুঃখিত আজ রাতে আপনি আমার সাথে যেতে পারছেন না,' বললেন জেনারেল । 'আজকের শিকারটার বেশ তেজ আছে । একটা বড়সড় শক্তিশালী নিগ্রো--তা গুডনাইট মি. রেইন্সফোর্ড । রাতের ঘুম ভাল হোক আপনার ।'
৫
বিছানাটা চমৎকার । সিল্কের পাজামাটা দারুণ নরম এবং শরীরের প্রত্যেকটি লোমকূপ ক্লান্ত থাকলেও রেইন্সফোর্ডের চোখে ঘুম এলো না । চোখ খোলা রেখে শুয়ে রইলো ও । একবার মনে হল বাইরের করিডরে পা টিপে টিপে কে হাঁটছে ।
দরজা খোলার চেষ্টা করত গিয়ে দেখলো দরজা খুলছে না । জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকালো ও । ওর কামরাটা একটা উঁচু টাওয়ারের মধ্যে । দুর্গ-প্রাসাদের আলো নিভিয়ে দেয়া হয়েছে, কিন্তু হালকা আলোর পরশ বোলাচ্ছে এক ফালি চাঁদ । চাঁদের আলোয় উঠানটা অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, সেখানে আবছা কিছু নিঃশব্দ কালো ছায়ামূর্তি নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে ।
জানালায় ওর আওয়াজ পেয়ে উপর দিকে সবুজ চোখে চাইল হাউন্ডগুলো । বিছানায় ফিরে গিয়ে নিজেকে ঘুম পাড়ানোর সমস্ত কৌশল ব্যাবহার করে সে সকালের দিকে হালকা তন্দ্রামত এনেছে, এমন সময় দূরের জঙ্গল থেকে একটা পিস্তলের গুলির শব্দ পেল রেইন্সফোর্ড ।
লাঞ্চেরর আগে জেনারেল জারফের দেখা মিলল । ইংরেজ জমিদারের মতন নিখুঁত টুইডের পোশাকে আপাদমস্তক সজ্জিত তিনি । রেইন্সফোর্ডের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে আন্তরিকভাবে জানতে চাইলেন তিনি ।
'আমার কথা যদি জিগ্যেস করেন,' দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন জেনারেল । 'আমি ভাল বোধ করছি না । গতরাতে আমি আমার পুরনো সমস্যাটার জেগে উঠল ।'
রেইন্সফোর্ডের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তর দিলেন জেনারেল । 'একঘেয়েমী, বিরক্তি ।'
দ্বিতীয়বারের মত ক্রেপ সুজেত প্লেটে তুলে ব্যাখ্যা করলেন জেনারেল : 'গতরাতের শিকার মোটেই ভাল হয়নি । সে লোকের মাথা একেবারে গুবলেট হয়ে গেছিলো । একদম নাক বরাবর সোজা সামনের দিকে এগিয়ে গেছে সে বনের মধ্যে দিয়ে, সেটা অনুসরণ করতে আমার কোন সমস্যাই হয় নি । নাবিকদের নিয়ে এই সমস্যা; তাদের মাথা এত মোটা যে জঙ্গলে কীভাবে চলতে হবে সেটাই ওরা জানে না । ওরা ভীষণ স্টুপিডের মতন কাজ করে যেটা চট করে ধরে ফেলা যায় । ভীষণ বিরক্তিকর সেটা সহ্য করা । আরেক গ্লাস শাবলি নেবেন মি. রেইন্সফোর্ড ?'
'জেনারেল,' দৃঢ় গলায় বলল রেইন্সফোর্ড । 'আমি এই দ্বীপ থেকে এখনই চলে যেতে চাই ।'
ঘন ভুরুজোড়া যেভাবে উপরে উঠে এল যে বোঝাই গেল মনে আঘাত পেয়েছেন জেনারেল । 'কিন্তু বন্ধু!' প্রতিবাদ শুরু করলেন তিনি । 'আপনি কেবল এসেছেন এখানে, কোন শিকারই করলেন না--'
'আমি আজই চলে যেতে চাই ।' রেইন্সফোর্ড দেখল কালো চোখজোড়া তার উপর স্থির হয়ে আছে, মাপ নিচ্ছে তার । হঠাৎ চাঙ্গা হয়ে উঠলেন জেনারেল ।
ধুলো পড়া একটা বোতল থেকে রেইন্সফোর্ডের গ্লাসে শাবলি ঢেলে দিলেন তিনি ।
'আজ রাতে,' বললেন তিনি । 'শিকারে যাবো আমরা---আপনি আর আমি ।'
'না,' মাথা নাড়ল রেইন্সফোর্ড । 'আপনি শিকার করব না ।'
আলতোভাবে কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে হটহাউজে জন্মানো একটা আঙ্গুরে যত্নের সাথে কামড় দিলেন জেনারেল । 'আপনি যা ভাল মনে করেন বন্ধু, তাই করবেন আপনি । আপনার কী মনে হয় না, আমার সাথে খেলা ইভানের হাতে পড়ার থেকে ভাল ?'
মস্ত বুকের উপর আড়াআড়িভাবে হাত রেখে ভুরু কুঁচকে ঘরের কোনার দিকে দাঁড়িয়ে থাকা দৈত্যটার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন তিনি ।
'আপনি বলতে চাইছেন--' চিৎকার করল রেইন্সফোর্ড ।
'প্রিয় বন্ধু,' বললেন জেনারেল । 'আমি কী আপনাকে আগেই বলিনি, আমি শিকারের ব্যাপারে যা মনে করি তাই বলি ? এটা সত্যি দারুণ হবে । এতদিনে আমি আমার সাথে লড়ার যোগ্য একজন প্রতিদ্বন্দ্বী পেলাম !' হাতের গ্লাসটা উঁচু করলেন জেনারেল ।
'আসলে আপনি দারুণ মজা পাবেন এতে,' উৎসাহের সাথে বললেন জেনারেল । 'আপনার ব্রেনটা আমার ব্রেনের বিপক্ষে । আপনার জঙ্গলের অভিজ্ঞতা আমার অভিজ্ঞতার সাথে লড়বে, আপনার স্ট্যামিনা আমার স্ট্যামিনার সাথে । একেবারে আউটডোর দাবা খেলা! আর বাজিটাও একেবারে ফেলনা না, কী বলেন ?'
'আর যদি আমি জিতি--' আরম্ভ করেছিল রেইন্সফোর্ড ।
'তৃতীয় দিনের মাঝরাত পর্যন্ত যদি আপনি আমার চোখকে ধূলো দিয়ে থাকতে পারেন তবে আমি খুশি মনে হার মেনে নেব,' বললেন জেনারেল জারফ । 'আমার পালতোলা জাহাজ আপনাকে মুল ভূখন্ডে, কোন বড় শহরের কাছে নামিয়ে দিয়ে আসবে,' এমনভাবে বললেন জেনারেল, যেন রেইন্সফোর্ড কী ভাবছে সেটা পড়তে পারছেন তিনি ।
'অবশ্যই আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন,' বললেন কসাক । 'একজন ভদ্রলোক এবং শিকারী হিসেবে আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আপনিও আমাকে পাল্টা কথা দেবেন যে আপনি, এই দ্বীপে আপনার ভ্রমণ সম্বন্ধে আপনি কিছু বলবেন না ।'
'আমি সেরকম কোন কথা দিতে পারবো না,' বলল রেইন্সফোর্ড ।
'ওহ, সেক্ষেত্রে---কিন্তু এখন সেটা আলোচনা করছি কেন ?' বললেন জেনারেল । 'তিনদিন পরে এক বোতল ভোভ ক্লিকো শ্যাম্পেনের সাথে আমরা আলাপ করবো সেটা । যদি না--'
ওয়াইনে চুমুক দিলেন জেনারেল ।
তারপরেই চটপট কাজের কথা পারলেন তিনি । 'ইভান, আপনাকে শিকারের পোশাক, খাবার আর একটা চাকু দেবে,' রেইন্সফোর্ডকে জানালেন তিনি । 'আমি আপনাকে চামড়ার মোকাসিন জুতো পরার পরামর্শ দেই, কারন সেগুলো খুব অস্পষ্ট ছাপ রেখে যায় ।
আমার আরেকটা পরামর্শ হচ্ছে দ্বীপের দক্ষিণপুর্ব দিকের বড় জলাভূমিটা এড়িয়ে যাওয়া । আমরা ওটাকে মৃত্যু-জলা বলি, এখানে চোরাবালি আছে । একটা বোকা লোক ওদিকের রাস্তা বেছে নিয়েছিল ।
৬
দুর্গ থেকে বেরোনোর পরের দু'ঘন্টা ধরে ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলছে রেইন্সফোর্ড । 'আমাকে অবশ্যই স্নায়ুর জোর ধরে রাখতে হবে,' দাঁতে দাঁত চেপে বলল ও ।
দুর্গের দরজাটা যখন ওর মুখের উপর বন্ধ হয়ে গেল তখন ওর মাথাটা ঠিক পরিষ্কার ছিল না । ওর প্রথম চিন্তা ছিল জেনারেল জারফের সাথে দূরত্ব বাড়ানো । অনেকটা আতংক তাড়িত হয়ে অন্ধের মত কাজটা করেছে ও । নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে এলে থেমে পরিস্থিতির জরিপ করল ও । সে বুঝতে পারছে সামনে গিয়ে কোন ফায়দা নেই, শেষমেষ ওকে সাগরে গিয়ে থামতে হবে । ওর গতিবিধি যেহেতু দ্বীপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, সুতরাং একথা বিবেচনা করেই তাকে চলতে হবে ।
'আমি ওকে একটা ট্রেইল দেব অনুসরণ করার জন্য,' বিড়বিড় করল রেইন্সফোর্ড । বুনোপথটা ছেড়ে সোজা পথহীন জঙ্গলে ঢুকে পড়ল ও । চলার পথে একের পর এক জটিল প্যাঁচ তৈরি করছে ও । ইংল্যান্ডের শিয়াল শিকারের সব কাহিনী মনে করে শিয়ালের মতন ডজ দেয়ার চেষ্টা করছে ও । রাতের বেলা, বনে ঢাকা একটা রিজের উপর উঠে এল ক্লান্ত রেইন্সফোর্ড । হাত পা ছিলে গেছে গাছের ডালের ঘষায় । এখন গায়ে শক্তি থাকলেও সামনে এগোনো ঠিক হবে না, জানে ও । বিশ্রাম নেয়া দরকার, 'শিয়ালের খেলা খেলেছি আমি, এবার গল্পের বিড়াল হতে হবে আমাকে,' ভাবল ও । বড় বড় ডালপালা নিয়ে একটা মস্ত বড় গাছ কাছেই দাঁড়িয়ে, তরতর করে গাছটায় উঠে, একটা ডালে শরীরটা এলিয়ে দিল ও । বিশ্রামের পর কিছুটা আত্ববিশ্বাস ফিরে এল ওর । এমন কী জেনারেল জারফের মত দুঁদে শিকারীও ওর হদিস পাবে না এখানে । রাতের বেলা ওর জঙ্গলের মধ্যে ওর ট্রেইল ধরে অনুসরণ করে আসতে পারে কেবল এক শয়তান, হতে পারে জেনারেল নিজেই এক শয়তান--
আহত সাপের মত এগিয়ে এল রাত । কিন্তু রেইন্সফোর্ডের চোখে ঘুম এল না যদিও অরণ্যের মৃত্যুর নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে । ভোরের দিকে যখন হালকা ধূসর রং নিচ্ছে আকাশ, তখন কোন হঠাৎ জেগে ওঠা পাখির ডাকে জেগে উঠল রেইন্সফোর্ড । রেইন্সফোর্ড যে পথে এসেছিল ঠিক সেই পথেই কেউ সাবধানে ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে কেউ এগিয়ে আসছে । ডালের সাথে শরীরটাকে মিশিয়ে পাতার পর্দার ফাঁক দিয়ে সাবধানে নীচে চাইল রেইন্সফোর্ড ।
জেনারেল জারফ নীচে দাঁড়িয়ে আছেন, অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন চারপাশটা । একেবারে গাছটার নীচে এসে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লেন তিনি । চিতাবাঘের মত নিজেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল, কিন্তু ও থেমে গেল যখন ও দেখল জেনারেলের হাতে একটা ছোট অটোমেটিক পিস্তল শোভা পাচ্ছে ।
বেশ কয়েকবার মাথা নাড়লেন জেনারেল, যেন ব্যাপারটা ধাঁধায় ফেলছে তাঁকে । তারপরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একটা কালো সিগারেট ধরালেন তিনি । ধূপের মত সুবাস এসে লাগল রেইন্সফোর্ডের নাকে ।
নিশ্বাস বন্ধ করে রাখল রেইন্সফোর্ড । মাটি থেকে ইঞ্চি ইঞ্চি করে উপরের দিকে চোখ বোলাচ্ছেন জেনারেল । সবগুলো পেশী শক্ত করে ঝাঁপ দেয়ার জন্য তৈরী হল রেইন্সফোর্ড, কিন্তু শিকারীর তীক্ষ্ণ চোখ রেইন্সফোর্ড যে ডালে আছে তার ঠিক নীচে এসে থেমে গেল; রোদে পোড়া মুখে হাসি দেখা গেল । খুব কায়দা করে একটা ধোঁয়ার রিং ছেড়ে যেপথে এসেছিলেন সেদিকে ফিরে গেলেন জেনারেল জারফ ।
ফুসফুসে আটকা বাতাসটা শব্দ করে ছাড়ল রেইন্সফোর্ড । প্রথম চিন্তাটা প্রায় অবশ করে দিল ওকে । জেনারেল তাহলে রাতের বেলাতেও এরকম কঠিন ট্রেইল অনায়াসে ট্র্যাক করতে পারেন ! অলৌকিক ক্ষমতা আছে তাহলে জেনারেলের । একটুর জন্য শিকারকে মিস করেছেন কসাক জেনারেল ।
রেইন্সফোর্ডের দ্বিতীয় আরো ভয়ংকর চিন্তাটায় , সমস্ত শরীর বেয়ে শিরশিরে একটা অনুভূতি নেমে গেল তার । জেনারেল হাসলেন কেন ? কেনই বা ফিরে গেলেন তিনি ফিরতি পথে ?'
জেনারেল আসলে খেলা করছেন ওর সাথে! বিশ্বাস করতে না চাইলেও সকালের সূর্যের মতই পরিষ্কার । আরেক রাতের শিকারের জন্য ওকে তুলে রেখেছেন । কসাক এখানে বিড়াল আর রেইন্সফোর্ড ইঁদুর । তাড়া খাওয়া শিকারের অন্ধ আতংকের ধাক্কাটা জীবনে প্রথম বুঝল রেইন্সফোর্ড ।
'আমাকে নার্ভ হারালে চলবে না ।'
গাছ থেকে পিছলে নেমে পড়ল ও, মনকে বাধ্য করছে ও একটা প্যাটার্নের মধ্যে চিন্তা করতে । তিনশো গজ দূরে একটা বিশাল মরে যাওয়া গাছ আরেকটা ছোট জীবিত গাছের উপর হেলান দিয়ে রয়েছে । খাবারের পোঁটলাটা ফেলে, খাপ থেকে ছুরি বের করে কাজে নেমে পড়ল রেইন্সফোর্ড ।
কাজটা শেষ হল অবশেষে । শ'খানেক ফিট দূরে একটা পড়ে থাকা গাছের গুঁড়ির নীচে শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগল রেইন্সফোর্ড । বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না । বিড়াল আবার এল ইঁদুরের সাথে খেলা করতে ।
ব্লাডহাউন্ডের মত আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে ট্রেইল ধরে এগিয়ে এলেন জেনারেল জারফ । কোন কিছুই ওই কালো চোখজোড়া থেকে এড়াচ্ছে না, ঘাসের একটা বাঁকা ডগা কী শ্যাওলার উপর ক্ষীণ আঁচরের দাগ । এত মনোযোগ দিয়ে অনুসরণ করছিলেন জেনারেল, যে রেইন্সফোর্ডের পাতা ফাঁদটা দেখার আগেই বেরিয়ে থাকা ফাঁদের ট্রিগারের কাজ করা ডালটায় পা দিয়ে বসলেন । কিন্তু স্পর্শ করার সাথে সাথে বানরের ক্ষিপ্রতায় পিছু হটলেন জেনারেল । কোনমতে জীবিত গাছটা দিয়ে ঠেকনা দেয়া মরাগাছটা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ল । দ্রুত সরে যাওয়াতে কাঁধে আঘাত পেলেন জেনারেল নাহলে এর তলে পিষ্ট হয়ে যেতেন তিনি । টলে গেলেও পড়ে গেলেন না তিনি, হাত থেকে পিস্তলটাও পড়ল না । একহাতে আহত কাঁধটা ডলতে লাগলেন । তারপর রেইন্সফোর্ড জেনারেলের অট্টহাসি শুনতে পেল ।
'রেইন্সফোর্ড,' বললেন জেনারেল । 'আপনি যদি কথা শোনার আওতার মধ্যে থেকে থাকেন তবে আপনাকে কনগ্রাচুলেট করতে চাই আপনাকে । পৃথিবীর খুব বেশি সংখ্যক মানুষ এই মালয় মানুষধরা ফাঁদ বানাতে জানে । আমার সৌভাগ্য যে আমিও মালাক্কাতে শিকার করেছি । আপনি খুবই ইন্টারেস্টিং লোক দেখা যাচ্ছে । আমি এখন আমার জখমটা ব্যান্ডেজ করতে যাচ্ছি, আঘাতটা খুবই অল্প অবশ্য । আমি আবার ফিরে আসব ।'
আহত কাঁধটা ডলতে ডলতে জেনারেল চলে গেলেন । রেইন্সফোর্ড তার পালানো অব্যাহত রাখল । কয়েক ঘন্টা অন্ধের মত ছুটল ও । সন্ধ্যা নামল আঁধার এল, এখনো ও ছুটে চলেছে । পায়ের মোকাসিনের নীচে মাটি এখন নরম ঠেকছে । ঝোপঝাড় এখানে ঘন, বাতাসে দুর্গন্ধ ভাসছে । পোকা মাকড় ওকে কামড়াচ্ছে সাংঘাতিকভাবে ।
তারপর হঠাৎ আগে বাড়তেই পা ডুবে গেল নরম কাদায় । পা টা টেনে তোলার চেষ্টা করল ও, কিন্তু কাদা এমনভাবে ওর পা টেনে ধরল যেন একটা প্রকান্ড জোঁক আটকেছে পায়ে । সাংঘাতিক বেগ পেতে হল ওকে পা টা মুক্ত করার জন্য । ও জানে এখন ও কোথায়, ডেথ সোয়াম্প--মৃত্যু জলায় চোরাবালি এলাকায় এসে পড়েছে ও ।
হাতজোড়া এমন শক্তভাবে মুঠি পাকিয়ে আছে যেন স্নায়ুগুলো অন্ধকারে কোন অদৃশ্য শক্তি ছিঁড়ে নিতে চাইছে । নরম মাটি একটা আইডিয়ার বীজ রোপন করল রেইন্সফোর্ডের মনে । ডজনখানেক ফুট পিছনে হটল রেইন্সফোর্ড, তারপরে একটা প্রাগৈতিহাসিক বিভারের মতন মাটি খুঁড়তে লেগে গেল ।
যুদ্ধের সময় ফ্রান্সে মাটি খুঁড়েছে রেইন্সফোর্ড, যখন এক মুহূর্তের দেরী মৃত্যু ডেকে আনতে পারে । সেসব খোঁড়াখুঁড়ি আজকের খোঁড়ার তুলনায় নস্যি । গর্তটা ক্রমেই বড় হলো, এবং যখন ওর কাঁধ পর্যন্ত গভীর হল গর্তটা । তখন উঠে কিছু শক্ত ডাল কেটে আগা ছুরি দিয়ে চোখা করল ও । সেগুলো গর্তের নীচে এভাবে পুঁতে দিল যেন চোখা দিকটা থাকে উপরে । তারপরে ক্ষিপ্র হাতে ঘাস, লতাপাতা দিয়ে একটা মাদুর মত বানিয়ে সেটা দিয়ে গর্তটা ঢেকে তার উপরে মাটি চাপা দিল । তারপরে ঘামে ভেজা ক্লান্ত শরীরে একটা বাজ পড়া গাছের পিছনে গুঁড়ি মেরে বসল ।
সে জানে তার অনুসরণকারী আসছে তার পিছন পিছন । নরম মাটিতে হালকা পায়ের আওয়াজ পেল ও, তারপরে জেনারেলের সিগারেটের সুবাস ভেসে এল ওর নাকে । রেইন্সফোর্ডের মনে হল জেনারেল অস্বাভাবিক দ্রুত আসছেন, গাছের নীচে গুঁড়ি মেরে বসে ও জেনারেল বা ওর পাতা ফাঁদ কোনটাই দেখতে পাচ্ছে না । ফাঁদের ডালপালা ভেঙ্গে পড়ার শব্দে ও আরেকটু হলে আনন্দে চিৎকার করে উঠত, কারন এর পরেই তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার শুনতে পেল ও । লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল ও, কিন্তু সাথে সাথেই বসে পড়ল ও । গর্তটার ইলেকট্রিক টর্চ হাতে তিন ফিট দূরে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে ।
'চমৎকার দেখিয়েছেন আপনি রেইন্সফোর্ড,' বললেন জেনারেল । 'আপানার বার্মিজ বাঘ-ধরা ফাঁদ আমার একটা অন্যতম সেরা কুকুরের প্রাণ নিয়েছে । আবারো আপনি টেক্কা দিলেন । আমি দেখতে চাই পুরো হাউন্ডের পালটার বিরুদ্ধে আপনি কী করতে পারেন । চমৎকার সন্ধ্যাটার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ মি. রেইন্সফোর্ড ।'
পরদিন সূর্য ওঠার সময় একটা নতুইন শব্দ শুনে বুঝল রেইন্সফোর্ড নতুন হুমকি উপস্থিত এখন । একপাল ব্লাডহাউন্ডের গলাছেড়ে ডাকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ।
রেইন্সফোর্ড জানে সে দুটো কাজ করতে পারে, একটা হচ্ছে সে যেখানে আছে সেখানেই বসে থাকতে পারে, সেটা হবে আত্মহত্যা । আর হচ্ছে সে এখান থেকে পালাতে পারে, তা হবে অবশ্যম্ভাবী পরিণতিকে কিছুক্ষণের জন্য ঠেকিয়ে রাখা । এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে চিন্তা করল ও। একটা অসম্ভব আইডিয়া মাথায় আসতেই ও বেল্ট কষে বেঁধে জলাভূমি ছেড়ে অন্যদিকে হাঁটা ধরল।
কুকুরের ডাক কাছিয়ে আসছে, আরো কাছে, আরো । একটা রিজের উপরে জন্মানো গাছে চড়ে রেইন্সফোর্ড দেখল মাত্র সিকি মাইল দূরে ঝোপের মধ্যে নড়ছে একটা কিছু । চোখ সরু করে ও জেনারেল জারফের ঋজু দেহায়বটা দেখতে পেল । পাশেই ইভানের বিশাল কাঠামোটা যেন কোন অদৃশ্য শক্তি টেনে নিয়ে চলেছে, বোঝা গেল কুকুরপালের লাগাম ধরে আছে ইভান ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা তার খোঁজ পেয়ে যাবে । পাগলের মত চিন্তা চলছে রেইন্সফোর্ডের মাথায় । উগান্ডায় শেখা একটা কৌশল মনে পড়ল ওর । একটা নমনীয় ডালে ধনুকের মত বাঁকিয়ে তার মাথা শিকারের ছুরিটা বাঁধলো যেন ফলাটা থাকে ট্রেইলের দিকে । একটা জংলী লতা দিয়ে ডালটা বেঁধে রাখল । এর পরে প্রাণভয়ে দিল ছুট । নতুন ঘ্রাণ পেয়ে গলা চড়ালো শিকারী কুকুরের দল । রেইন্সফোর্ড এখন বুঝতে পারছে তাড়া খাওয়া জানোয়ারের মনের অনুভূতি ।
দম নিতে থামতে হলো ওকে । ব্লাডহাউন্ডগুলোর চিৎকারও হঠাৎ থেমে গেছে, ছুরিটার কাছে নিশ্চয়ই পৌঁছে গেছে ওরা ।
উত্তেজিতভাবে একটা গাছে চেপে ফেলে আসা পথের দিকে চাইল ও । মনের কোনে আশাটা নিভে গেল দপ করে যখন দেখল জেনারেল জারফ বহাল তবিয়তেই দাঁড়িয়ে আছেন, তবে ইভান খতম হয়েছে । ফাঁদের ডালটায় বাঁধা ছুরিটা একেবারে ব্যর্থ হয়েছে তা বলা যাবে না ।
ও গাছে থেকেই নামতেই হাউন্ডের দল আবার গর্জে উঠল ।
'মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে ! মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে !' হাঁপাতে হাঁপাতে বিড়বিড় করল রেইন্সফোর্ড । সামনে গাছপালার ফাঁক দিয়ে এক চিলতে নীল সমুদ্র দেখা যাচ্ছে । কাছিয়ে আসছে কুকুরের দল । সাগরের দিকে ছুটল রেইন্সফোর্ড, জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই দুর্গের একটা অংশ চোখে পড়ল তার দূরে । কিন্তু সৈকতটা পানির বিশফুট উপরে গিয়ে শেষ হয়েছে । একমুহূর্ত ইতস্ততঃ করল সে, তারপর কুকুরের ডাকটা শুনে পানিতে ঝাঁপ দিল ।
জেনারেল আর তাঁর কুকুরের দল যখন সাগরের ধারে পৌঁছালো, থমকে দাঁড়ালেন কসাক । বেশ কয়েকমিনিট সাগরের নীল-সবুজ পানির দিকে তাকিয়ে থাকলেন তিনি । তারপর কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে বসে পড়লেন মাটিতে । রুপার ফ্লাস্ক খুলে ব্র্যান্ডিতে চুমুক দিতে দিতে সিগারেট ধরিয়ে 'ম্যাডাম বাটারফ্লাই' অপেরা থেকে গুনগুন করে গান ধরলেন তিনি ।
কাঠের প্যানেল দেয়া মস্ত ডাইনিং রুমে সে রাতের জেনারেলের ডিনারটা চমৎকার হল । এক বোতল পোল রজার আর আধ বোতল শামবারতঁ খতম করলেন তিনি । কিন্তু দুটো ঘটনার স্মৃতি ডিনারটা পুরো উপভোগ করতে দিল না । এক, ইভানের মতন আরেকটা লোক জোগাড় করাটা বেশ কঠিন হবে; দুই তাঁর শিকার ধরা পড়েনি ।
ডিনার শেষের ড্রিংকে চুমুক দিতে দিতে ভাবলেন জেনারেল, অবশ্য আমেরিকান লোকটা নিয়ম মেনে খেলেনি । লাইব্রেরিতে গিয়ে রোমান সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াসের রচনা পড়ে নিজেকে শান্ত করলেন তিনি । দশটা সময় নিজের শোয়ার ঘরে গেলন তিনি, চমৎকার ক্লান্তির আলস্য ভর করছে তাঁর শরীরে । সামান্য চাঁদের আলো আছে, তাই জানালার ধারে গিয়ে নীচের উঠানে চড়ে বেড়ানো কুকুরদের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'পরের বার ভাল শিকার হবে ।' তারপর ঘুরে আলো জ্বালালেন ।
বিছানার চাঁদোয়ার পিছনে লুকিয়ে থাকা একটা লোক এখন ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে !
'রেইন্সফোর্ড!' চিৎকার করলেন জেনারেল । 'এখানে এলে কীভাবে?'
'সাঁতরে এসেছি,' জবাব দিল রেইন্সফোর্ড । 'জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হেঁটে আসা থেকে অনেক তাড়াতাড়ি হয়েছে আমার ।'
শব্দ করে শ্বাস টানলেন জেনারেল । 'আপনি অভিবাদন করছি আপনাকে,' হেসে বললেন তিনি । 'আপনি খেলায় জিতেছেন ।'
রেইন্সফোর্ড হাসলো না । 'আমি এখনো একটা তাড়া খাওয়া জানোয়ার,' নীচু, খসখসে গলায় ফিসফিস করে বলল ও । 'তৈরী হোন জেনারেল ।'
অনেক নীচু হয়ে বাউ করলেন জেনারেল । 'আমি বুঝতে পারছি,' বললেন তিনি । 'আমাদের মধ্যে একজন নীচের কুকুরগুলোর খোরাক হবে । আর আরেকজন এই চমৎকার নরম বিছানায় ঘুমাবে । সুতরাং হুঁশিয়ার !'
এত আরামদায়ক বিছানায় আসলেই কখনো ঘুমায়নি স্যাঙ্গার রেইন্সফোর্ড !
শেষ