বুদ্ধিবৃত্তির জাগরণ ও আহমদ ছফা
সাইফুজ্জামান


সমাজ সংসারে এমন কিছু মানুষ থাকেন যারা স্বেচ্ছায় জনকল্যাণের প্রয়োজনে সাহিত্য রচনায় ব্রতী হন, বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, কবি, ঔপন্যাসিক ও সমাজ চিন্তক আহমদ ছফা ছিলেন তাদের অন্যতম প্রচলিত জীবন ব্যবস্থার প্রতি অনীহা তাঁর সাহিত্যে মানবমুক্তির কথামালা প্রতিধ্বনিত। চলমান রাজনীতি ও সমাজ ব্যবস্থার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি শোষণ বঞ্চনা ও মানুষের মর্মবেদনা উপন্যাস,ছোট গল্প ও বিশ্লেষণমূলক রচনার প্রতিপাদ্য করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে আহমদ ছফা বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাঙালির রাষ্ট্রভাবনা ও মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে জনসম্পৃক্তির বিষয়টি তার সাহিত্যে প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।


আহমদ ছফা ছিলেন রাজনীতিসচেতন সাহিত্যিক। ১৯৬৭তে প্রকাশিত ‘সূর্য তুমি সাথী’ উপন্যাসে গ্রাম ও গ্রামের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন,মানুষের নিরন্তর সংগ্রাম ও সমাজ পরিবর্তনকে আমরা প্রত্যক্ষ করি। সাতবাড়িয়া গ্রামের হাসিম গোকুলের ছেলে কাজী বাড়ির মেয়ে জরিনার প্রেমে পড়ে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়। গ্রামের মানুষ এ বিষয় নিয়ে নানা সমালোচনায় মত্ত হয়। ক্ষুধা,দরিদ্র্য,বাঁচার লড়াইয়ের সঙ্গে গ্রামীণ জনপদে যুক্ত হয় ধর্মবিশ্বাস। পশ্চাৎপদ মানুষের দিনযাপন ছফা মমতার সঙ্গে বিবৃত করেন। অভিমান করে হাকিম গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। গ্রামীণ সমাজ কাঠামোর একটি নিখুঁত বর্ণনা তিনি এ উপন্যাসে দিয়েছেন। গ্রামকে ঘিরে যাদের স্বপ্ন,সংগ্রাম ও দিনযাপন,তারা কীভাবে খোলস থেকে বেরিয়ে পড়ে,মূল থেকে বিচ্যুত হয় এসব বিবরণ,ব্যাখ্যা ও পর্যবেক্ষণ তার সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

ছফা সুস্থ রাজনৈতিক চিন্তাধারার সঙ্গে বাঙালির দিনযাপনকে যুক্ত করেছেন তার উপন্যাস,গল্পের কাহিনীর সঙ্গে। 'ওঙ্কার' উপন্যাসে জীবনবীক্ষণ যা আঞ্চলিক ভৌগোলিক অবস্থান থেকে বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের বৃহৎ পরিসরে সম্পর্ক তৈরি করে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুথানের প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস ওঙ্কারে নারীমুক্তির বার্তা স্পষ্ট। অতাল চক্র উপন্যাসে অন্য এক নারী তায়েবা ক্যান্সার আক্রান্ত। তার মৃত্যু প্রতীকী ব্যবহার করা হয়েছে।


ষাটের দশকের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ঘটনা গণঅভ্যুথান ও মুক্তিযুদ্ধ আহমদ ছফা তাঁর উপন্যাসে ধারণ করেছেন। ভোলার তামাপুকুর গ্রামে আলী কেনানের আবির্ভাব। গভর্নরের পিয়ন আলী কেনানের দোর্দণ্ড প্রতাপ। চাকরিচ্যুত হয়ে পীর সেজে ঢাকার মাজারে তার তেলেসমাতি একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন পর্বে বিবৃত। ঊনসত্তর,সত্তর ও পরবর্তীকালে পঁচাত্তরের রাজনৈতিক ঘটনার ঘূর্ণি আহমদ ছফা তার উপন্যাসে ধারণ করেছেন। আলী কেনানের মুখ থেকে শোনা যাক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ড পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে : শেখ মুজিবুর বাইচ্যা নাই,আমি ঢাকায় থাকুম কেরে? হের সমাজতন্ত্র অইল না আমি হইলদ্যা পাখীরে হারাইলাম। ভোলায় চইলা যামু। তাই তরা আমারে একটি লঞ্চের টিকিট কাইট্যা দে (একজন আলী কেনানের উথাপ-পতন, ছফা রচনাবলী ২য় খণ্ড পৃ-৭০)।

গাভী বিত্তান্ত উপন্যাসে ক্ষমতাধর মানুষদের ক্ষমতা প্রয়োগের ছল ছাতুরী,সুবিধাভোগের কলাকৌশল উঠে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদে আসীন ব্যক্তি। উচ্চশিক্ষিত ও ডিগ্রিধারী মানুষদের চালচলন, ক্ষমতালিপ্সা ও তাদের চারপাশের কাচের দেয়ালে আহমদ ছফা গভীর মনোযোগের সঙ্গে দৃষ্টি নিবন্ধ করেন। ঠিকাদার ঘোরে। মস্তান ঘোরে। অর্থের লালসায় মত্ত একদল মানুষ কীভাবে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বন্দি করে,ছফা তা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। সমাজ ও পরিপার্শ্বের মানুষ তার কাছে ধরা দেয়। সমাজ একদিনে পচনের দিকে যায় না। মানুষের লোভ,হিংসা, কাম ও অর্থলিপ্সুতার কাছে পরাজিত হয় মূল্যবোধ ও মানবতা। আবার মানুষই উদ্ধার করে কল্যাণ ও সুন্দরকে।

প্রবন্ধগ্রন্থে বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস-এ বুদ্ধিজীবীদের স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে যথার্থভাবে। আমাদের সমাজে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সামাজিক জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম। সেই বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সুবিধা ভোগ করেন বেশি, নিজের স্বার্থরক্ষার প্রয়োজনে সত্য ও মিথ্যে মিশিয়ে যা বলেন, তাতে তাদের মতলববাজি মনোভাবের প্রকাশ ঘটে। ছদ্মনাম ব্যবহার করে তারা বিবৃতি দেন, নিবন্ধ রচনা করেন ও ভাষ্য পরিবেশন করেন। নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে তারা বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করেন। আবার কখনও কখনও সাধারণ মানুষদের কাছে নিজেদের অবস্থান অনেক উঁচুতে চিহ্নিত করেন। আহমদ ছফা প্রচলিত রাজনৈতিক মতবাদে আস্থাশীল ছিলেন না। অপছন্দ করতেন মতলববাজ বুদ্ধিজীবীদের। নির্মোহ থেকে তিনি তার পর্যবেক্ষণ ব্যক্ত করেছেন।

মধ্যবিত্তের শ্রেণী চরিত্রে বুদ্ধিজীবীদের স্ববিরোধিতার উদাহরণ আমাদের চারপাশে বিস্তর। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অঙ্গনের পরিবর্তনে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকায় প্রতিভাস লক্ষণীয়। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের একীভূত হওয়া স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বুদ্ধিজীবীরা কোন না কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। আহমদ ছফা তার প্রবন্ধগ্রন্থে উল্লেখ করেন : কবি সাহিত্যিক লেখকরা গর্ভিণী নারীর মতো। তারা জাতির গড়ে ওঠার, বেড়ে ওঠার, বেঁচে থাকার ভ্রূণকণা অন্তর্লোকে ধারণ করে থাকেন। জাতীয় জীবনে যা ঘটে গেছে অতীতে, যা বর্তমানে ঘটেছে সব সৃজনশীল অন্তর্লোকে তরঙ্গিত হয়, তারই আলোকে তারা অনেক সময় তারা ভাবের আবেশে সামনের দিকে অঙুলি নির্দেশ করে বলেন এই হতে যাচ্ছে। এবং এইই হবে। কিন্তু বাংলাদেশে তেমন কবি, তেমন সাহিত্যিক তেমন উপন্যাস লিখিয়ে কিংবা গাল্পিক কি আছেন? নেই। আমাদের যে ক’জন নামকরা কবি কিংবা সাহিত্যক আছেন, তাদের বেশিরভাগের প্রতি মানুষ খুব শ্রদ্ধার মনোভাব পোষণ করে না। বাংলাদেশে আজকের দিনে লেখকেরা কবিরা সামাজিক দিক দিয়ে বোধ হয় সম্মানহীন জীব। তারা পত্রিকার রবিবাসরীয় সংখ্যার জোগানদার, রেডিও টেলিভিশনের অঙ্গসজ্জা ও বিকৃত রুচিহীন নিরস পাঠ্যপুস্তক প্রণেতার অধিক কিছু নন (বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, পৃ. ২১-২২ প্রকাশকাল : ১৩৭৯)।

শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আহমদ ছফা ব্যক্তিগতভাবে তার রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের সমর্থক ছিলেন না। তিনি তার রচিত গ্রন্থ শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ শেখ মুজিবের মাহাত্ম্য, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দুর্বলতা সম্পর্কে মতামত তুলে ধরেছেন। আহমদ ছফা দ্বিধাহীন ভাবে স্বীকার করেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও শেখ মুজিবুর রহমান এ দুটো যমজ শব্দ। একটা আরেকটার পরিপূরক এবং দুটো মিলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের উজ্জ্বল-প্রোজ্জ্বল এক অচিন্তিত পূর্ব কালান্তরের সূচনা করেছে (শে. মু. র ও অন্যান্য পৃ-১১)।


আমরা যখন কাউকে মূল্যায়ন করি তখন ব্যক্তিগত সম্পর্ক মুখ্য হয়ে যায়। ব্যক্তিগত সম্পর্কের সঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্বাস দিয়ে সামাজিক অবস্থা ও ব্যক্তি মূল্যায়ন করতে গিয়ে পক্ষপাতদুষ্ট হয় মানুষ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সম্পর্কে নির্মোহভাবে কোন গ্রন্থ রচিত হয়নি, হয়নি এদের সাফল্য-ব্যর্থতা চিহ্নিতকরণ।
আহমদ ছফা ব্যক্তিগত দুর্বলতা প্রাধান্য দেননি। সাধারণ জনতার কাতারে গিয়ে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকের দৃষ্টিতে জাতীয় নেতৃবৃন্দের অবস্থান ও কর্মকা সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন।
ইতিহাসের নির্মমতা, বিশ্বাস পরিবর্তন ও জাতীয় আশা আকাঙ্খার মেরুকরণ নিয়ে প্রাণবন্ত, সরস ও বিশ্লেষণমূলক কথামালা তার রচনায় বিস্ফোরিত হয়েছে। এটা ঠিক বাঙালি যে স্বপ্ন দেখেছিল স্বাধীন দেশে তা পূরণ হয়নি। জাতীয় নেতৃত্বের দিকনির্দেশনায় ব্যর্থতা, সংগ্রাম, জনতার লক্ষ্যহীন যাত্রা ও আন্তর্জাতিক আগ্রাসন স্বপ্ন ও প্রাপ্তির মধ্যে বিস্তর ফারাক তৈরি করে। কেউ কেউ হয়তো ব্যাখ্যা করবেন এভাবেন্ধ স্বাধীনতার পর অস্থিরতা স্বাভাবিক বিষয়।
আহমদ ছফা নির্দিষ্ট গোষ্ঠী-রাজনীতিতে যুক্ত হননি। তার সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-ভাবনা তাকে ঐতিহ্য অন্বেষণ, স্বজাতির বীরত্বগাথা ও মানুষে মানুষে সম্প্রীতির সম্পর্ক নির্মাণে প্রাণিত করে। ব্যক্তি বন্দনায় তিনি ব্যস্ত হননি। বরং সমালোচনা ও বিশ্লেষণে মগ্ন তার সত্তা সত্য প্রকাশে উচ্চকিত থেকেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী, গেটে, রবীন্দ্রনাথ, পাকিস্তানের সমাজ ও রাজনীতির বহুতল খুঁড়ে তিনি গবেষণার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। মওলানা ভাসানী সম্পর্কে ছফা বলেন : মওলানা ভাসানীর রাজনীতিতে যথেষ্ট পরিমাণ বিচ্যুতি ছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে ওগুলো ছিল সামাজিক বিচ্যুতির রাজনৈতিক রূপায়ণ। চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রসর না হলে ওগুলো কাটিয়ে ওঠা একরকম অসম্ভব। মওলানা ভাসানী কী ছিলেন না তার কর্মকাণ্ডের বিচারে সেটা মুখ্য বিবেচনা করা নিশ্চয় রাজনৈতিক সুস্থতার পরিচয়ক নয় (মওলানা ভাসানী : শে. মু ও অ পৃ.৪১)।


বিশ শতকের বাঙালি মুসলমানদের জাগরণের ইতিহাস গৌরবের। রবীন্দ্র ভাবনা, দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, দস্তয়েভিস্কি, বার্ট্রান্ড রাসেলের দর্শনের প্রতিক্রিয়া, সুলতানের চিত্রকলা বিশেষায়িত নানাদিক 'বাঙালি মুসলমানের মন' গ্রন্থে আহমদ ছফা তুলে ধরেছেন। পুথি সাহিত্যের বিপুল সম্পদ মুসলমানদের কাছে কীভাবে ধরা দিল তার বিচার-বিশ্লেষণ, ফার্সি উর্দুচর্চা পলাশির যুদ্ধের পরের সময়ের জাগরণ নিয়ে তিনি বিস্তর ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝির হোসেন মিয়া কীভাবে তার অস্তিত্ব রক্ষায় সংগ্রামে নিয়োজিত থাকে বহুবিবাহ-জেলেপল্লীতে অবাধ যাতায়াত আবার সামাজিক প্রতিপত্তি অর্জনের মোহ তাকে গ্রাস করে না। হোসেন মিয়া স্বভাব কবি। লালন শাহ, হাছন রাজার মতো হাজার কবি একজনকে আবিষ্কার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় করেছেন। ছফা এই চরিত্রের শীর্ষে তাঁর বিচার-বিশ্লেষণ বন্দি করেন। 'বাঙালি মুসলমানের মন' গ্রন্থের নিবন্ধসমূহ আহমদ ছফা বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা ও ছোট কাগজের জন্য রচনা করেছিলেন। গবেষণা নিবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে যে মনোযোগ যে বিচার ও যে বুদ্ধিমত্তার স্ফুরণ ঘটে তার সবটুকুই এ গ্রন্থে উথাপিত। একুশে ফেব্রুয়ারি বাহাত্তুর যে বীভায় উদ্ভাসিত তা নিয়েও ছফা তার সজ্ঞান ব্যাখ্যা-বক্তব্য উদারীকরণ করেছেন। ছফার বক্তব্য : আজ বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাভাষী মানুষ বাহান্নের শহীদদের স্মরণ করছেন। একটি জনযুদ্ধে জয়ের আনন্দ নিয়ে, একটি নতুন সম্ভাবনাময় শোষণমুক্ত সুসভ্য সমাজ সৃজনের দৃঢ় আকাংখা স্পন্দিত অন্তরে একটি প্রবল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি ফ্যাসিবাদী সেনাবাহিনীর নির্মম নৃশংস ইতিহাসের নজিরবিহীন হত্যাকান্ডের করুণতম বেদনায় আপ্লুত বাংলাদেশের মানুষ বাংলাভাষী মানুষ-সমগ্র বাঙালি জাতি রাইফেল কামান, মেশিনগান ধরা, কড়া পড়া হাত, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার বিসর্জিত প্রাণ শহীদদের অম্লান স্মৃতির প্রতি সম্মাননায় পরস্পরযুক্ত করেছেন (একুশে ফেব্রুয়ারি উনিশশো বাহাত্তুর, পৃ. ৯০)।


আহমদ ছফা স্বজাতি, স্বধর্ম ও স্বকর্মে বাঙালির আত্মপরিচয়ে নানাদিক তুলে ধরেছেন। সংস্কার, বিশ্বাস ও পশ্চাৎপদ জীবনাচরণ থেকে বেরিয়ে এসে আলোর দিকে অভিযাত্রায় তিনি এ জাতির মনোযোগ অনগণ্য বিবেচনা করেছিলেন। আহমদ ছফা সমাজ ও চারপাশের মানুষের জীবন জিজ্ঞাসায় আন্দোলিত ছিলেন। তিনি মহৎ জীবন দর্শনের অধিকারী ছিলেন। তার সাহিত্যে সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণ ও শুভতার প্রকাশ ঘটেছে। সাহিত্যিক হিসেবে, মানুষ হিসেবে আহমদ ছফা নিষ্ঠার সঙ্গে মানবকল্যাণে নিয়োজিত ছিলেন।


ব্যক্তি আহমদ ছফা ছিলেন অনেক উঁচুতে। আহমদ ছফা প্রখ্যাত অনেক সাহিত্যিকের প্রথম লেখা প্রকাশে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করেছেন। আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত লেখকেরা নতুন লেখকদের গ্রন্থে প্রকাশের ব্যাপারে সব সময় সচেতন থাকেন না, ছফা ছিলেন। প্রকাশককে নতুন গ্রন্থ প্রকাশে তিনি অনুরোধ করেছেন।


অনেক তরুণ লেখকের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল ছিলেন আহমদ ছফা। লেখালেখিতে উৎসাহ প্রদান ও তরুণ কর্মীদের নির্ভরতার জন্য তার ব্যক্তিগত উদ্যোগ-সহযোগিতা ছিল। কঠিন বাস্তবতার দিকে আমরা এখন এগিয়ে যাচ্ছি। এই বাস্তবতার আঁচ অনুভব করার সময় সবার মনে পড়ে যায় আহমদ ছফার মতো সাহিত্যিক ও অভিভাবকের।


আহমদ ছফা ছিলেন নির্ভীক সাহিত্যিক। তার সাহিত্যে সাধারণ মানুষের মুক্তি প্রণোদনা প্রবলভাবে উপস্থাপিত ছিল। সমাজ রূপান্তর প্রয়াসী ছফা সমাজের অভ্যন্তরের পচন দূর করতে নিরন্তর লিখেছেন। তিনি ছিলেন সমাজ চিন্তক ও দার্শনিক লেখক। তার সাহিত্য পাঠ তরুণ প্রজন্মকে জীবন, জগৎ ও মানুষকে জানার সুযোগ দেবে। পাঠক তার সামনে উপস্থাপিত কাজটি শনাক্ত করার সুযোগ পাবেন তার সাহিত্য কীর্তি থেকে। আহমদ ছফা বাংলা সাহিত্যে অনুসরণীয় একজন সাহিত্যিক। তার সাহিত্যে মানবমুক্তি, জীবন অন্বেষার উপাদান সমৃদ্ধ। তার স্বপ্ন ও আকাঙ্খা বিস্তৃত।