রাঙামাটি ভ্রমণ

গৌতম রায়

পূর্বাপর কথা

আমি ঘুরতে ভালোবাসি। কেন? জানি না। কোথাও থেকে ঘুরে আসার পর বেশ খানিকটা নির্ভার হই। তাছাড়া আত্মপ্রেমে মগ্ন থাকায় দিনে দিনে নাগরিক হয়ে উঠছি কেবল, ঘুরতে গেলে টের পাই নাগরিকতার বাইরেও একটা জীবন আছে- যে জীবনে জন্ম হয়েছিলো আমার। সুতরাং ঘুরতে যাওয়ার কোনো সুযোগ আমি সহজে মিস করি না, বরং নানা ছুতোয় উপলক্ষ্য তৈরি করি। রাঙ্গামাটি আমার তেমনই একটা উপলক্ষ্যের শিকার।
কোনো এক বিকেলে নানান কিছু ভাবতে ভাবতে একটা পাহাড়ের কথাও ভাবছিলাম- চূড়ায় একা একটা ঘর বেঁধে বাকি জীবনটা পার করে দিতে পারবো। তাই কিছুদিন পরই বেরিয়ে পড়ি পাহাড়ে, বান্দরবানে। অসম্ভব মুগ্ধতায় তখন আবিষ্কার করেছি- পাহাড়কে স্পর্শ করা যায়, কিন্তু এর বিশালতায় নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া যায় না।

ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য বিশালতার একটা ছায়া আমার দরকার ছিলো তখন। আর এভাবেই শুরু হলো পাহাড়ের প্রতি আমার ভালোবাসার ক্ষণগুলো...

চট্টগ্রাম পৌঁছতে পৌঁছতে সকাল আটটা বেজে গেলো। এখানে গাড়ি বদলাতে হবে। আর একটু গাড়ি নাকি পাহাড়ে উঠতে পারে না,মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়। কি জানি! হতেও পারে। এখনকার গাড়িটা ভালো না। পুরনো গাড়ি,এসিও তেমন সুবিধার না। তবে সামনের কাতারে সিট পড়েছে বলে পুরো পথটাই দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে।

মাত্র এক সপ্তাহ আগে রাঙ্গামাটি ঘুরে গেছি অফিসিয়াল কাজে। এদিককার রাস্তাঘাট সব চেনা। হাটহাজারি এলাকাটা- ছোট রাস্তা,ভাঙা রাস্তা-তার উপর রাস্তায় একেকজন এমনভাবে গাড়ি চালায় আর রাখে,যেন তাদের পূর্বপুরুষরা এই রাস্তার মালিক ছিলেন। আর বাজার তো মনে হয় রাস্তার উপরে। ত্রিশ কিলোমিটার পথ পেরুতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়।
 


চলতি পথে তোলা পাহাড়ের ছবি

হাটহাজারি পেরুলেই রাউজান। রাউজান পেরুলেই অসম্ভব সুন্দর পাহাড়গুলো কাছে চলে আসতে থাকে। কোনোটা সামনে,কোনোটা পাশে। মাত্র বর্ষা শেষ হয়েছে- প্রতিটা পাহাড়-ই অসম্ভব আবেদনময়ী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চোখের সামনে। দুচোখ ভরে দেখতে থাকি, মাঝে মাঝে দুই-মেগাপিক্সেলের মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করি। কিন্তু চলন্ত অবস্থায় ছবি আসে না। এর-ই মধ্যে দু'দুটো ঝর্ণা দেখে ফেলি- সে কি উচ্ছ্বাস! ঝর্ণা জিনিসটা আমার কোনো কারণ ছাড়াই ভালো লাগে।

রং রাঙে দোচুয়ানি

রাঙ্গামাটিতে কেনাকাটার জন্য তবলছড়ি এলাকাটা বিখ্যাত। আদিবাসিদের তৈরি কাপড়চোপড় বা অন্যান্য জিনিসপত্রের অধিকাংশ দোকানই সেখানে। আমরা সেখানে ঘুরে টুকটাক জিনিসপত্র কিনলাম,যার মধ্যে কয়েক প্যাকেট কাজুবাদামও রয়েছে।

কেনাকাটা করতে করতেই আমাদের দোচুয়ানি খাওয়ার শখ হয়ে গেলো। সানন্দে ও সাড়ম্বরে ট্যাক্সি করে আমরা রওনা দিলাম,দোচুয়ানি খাওয়ার উদ্দেশ্যে- গন্তব্য বনরূপা বাজার।

বনরূপা বাজারের ঘাটে গিয়ে ছোট্ট নৌকা করে কাপ্তাই লেকের মধ্যে ছোট্ট একটা দ্বীপে পৌঁছলাম- নাম রং রাং। এখানে ছোট ছোট কটেজ আছে- সেখানে বসে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পাবার বেশ সুন্দর ব্যবস্থা! আদিবাসী তরুণদের অনেকেই বিকেল থেকে ভিড় জমায় এখানে- আড্ডার সাথে পান করার উসিলায়। তাছাড়া দোচুয়ানির সাথে খাওয়ার জন্য আলাদা কিছু সুস্বাদু তরকারিও আদিবাসিদের কায়দায় রান্না করা হয় এই রেস্টুরেন্টে,যেগুলো নাকি রাঙ্গামাটিতে খুবই পপুলার। এর একটা হলো মুরগির মাংসের চচ্চড়ি,আরেকটা ঝাল ভেজিটেবল। এরকম আরও কয়েকটা আইটেম আছে। আমরা এই দুটোর অর্ডার দিলাম।

মুরগির মাংসের চচ্চড়িটার বিশেষত্ব হলো এটা রান্নার সময় তেল একেবারেই ব্যবহার করা হয় না। মুরগি টুকরো টুকরো করার পর সিদ্ধ করা হয়। সাথে বাঁটা কাঁচামরিচ ও আলাদা ভিজিয়ে রাখা কাঁচামরিচের পানি যোগ করা হয়। পাশাপাশি ধনে পাতা এবং এ ধরনের আর কী কী যেন দেওয়া হয়। খুবই ঝাল লাগে খেতে! ভেজিটেবলেরও একই অবস্থা। বরবটি সিদ্ধ করা হয় কাঁচকি মাছের সাথে। সেখানেও প্রচুর ঝাল! মজার ব্যাপার হলো- হোটেল ম্যানেজার জানালেন- যারা ঝাল খেতে পারে না,তারাও নাকি এই প্রচুর ঝালের তরকারি আগ্রহ নিয়ে খায়। আমি বলি- আগ্রহটা কি দোচুয়ানি পেটে পড়ার আগে আসে নাকি পরে? ম্যানেজার হাসেন।


সুবলং, পরে পেদা টিং টিং


রাঙ্গামাটি শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে আপনি ট্রলার বা বোট ভাড়া করতে পারবেন, সারাদিনের জন্য ভাড়া করলে দেড় থেকে দু হাজার পর্যন্ত টাকা নিবে। একটা মাঝারি আকৃতির বোটে ত্রিশ জন বসা যায়। পর্যটন থেকেও বোট ভাড়া করা যায়, তবে রেট বেশি। ছোট বোটের ভাড়াও কম নয়। রিজার্ভ বাজার থেকে বোট বা ট্রলার ভাড়া করলে একটু কম দামে পাওয়া যাবে। এক হাজার থেকে বারোশর মধ্যে হয়ে যাবে। তবে পর্যটন বা অন্যান্য সংস্থার ট্রলারের মতো দেখতে সুন্দর না বলে অনেকে সেগুলো ভাড়া নিতে চান না। এগুলো ছাড়াও কেয়ারি সিন্দবাদ আছে যেটি রাঙ্গামাটি থেকে সুবলঙের উদ্দেশ্যে দিনে দুবার যাতায়াত করে। অবশ্য নিজের মতো করে ঘুরতে চাইলে সেগুলো না নেওয়ার পরামর্শ দিবো। কারণ এই ট্রিপগুলো বুড়িছোঁয়ার মতো করে একেকটা জায়গায় যায় আর ফিরে আসে। এতে মন ভরে না।

অসীম দার এক বন্ধুর ট্রলার আছে- তিনি সেটা নিয়ে উপস্থিত রিজার্ভ বাজার ঘাটে। বিশাল ট্রলার- যাত্রী মাত্র আমরা তিন জন আর বোটম্যান। আস্তে আস্তে ট্রলার চলা শুরু করলো। এরই মধ্যে শুরু করলো ঝিরঝির বৃষ্টি। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই আমরা ছাদে বসলাম- কাপ্তাই লেক আর পাহাড় দেখতে দেখতে এগুতে লাগলাম সুবলঙের দিকে।


পানি-পাহাড়, একে মিশেছে অন্যের সাথে
 

ছবির মতো সুন্দর পাহাড়গুলো পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। দুদিকে পাহাড়, মাঝখানে লেক।
আমরা এগুচ্ছি আর টুকটাক এসব কথা বলছি। এর মধ্যে কচুরিপানায় বসে থাকা বক দেখছি, দেখছি জেলেদের মাছ ধরার চিত্র। লাইনের লঞ্চ যাচ্ছে আর আসছে- এগুলো এই পথে বরকল, জুরাইছড়ি, বাঘাইছড়ি, লঙগদু ইত্যাদি এলাকায় যাতায়াত করে। বেশ কিছু দম্পতি ছোট বোট এবং স্পিডবোট নিয়ে আমাদের আগে আগে চলে যাচ্ছে। একটি মেয়ে হাত নাড়লো কি আমাকে দেখে? ধন্দে পড়ে যাই।


এই লাইনে যাতায়াত করে লংগদু, বাঘাইঝড়ি, জুড়াইছড়ির লঞ্চগুলো


এরই মাঝে কথা শুরু হলো লেকের ব্যবহার নিয়ে। অনেকের হয়তো জানা নেই, কাপ্তাই লেক হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় লেক- আয়তন ৭২৫ বর্গকিলোমিটার। কিন্তু এর যথাযোগ্য ব্যবহার হচ্ছে কিনা বলা মুশকিল। অসীম দা, বোটম্যান এবং স্থানীয় আরও অনেকের সাথে কথা বলে জানলাম- এই লেকের ওপর নির্ভরশীল প্রায় পঞ্চাশ হাজার পরিবার। অধিকাংশই জেলে। তবে লেক থেকে মাছ প্রতিনিয়ত ধরা হলেও মাছ ছাড়ার কোনো উদ্যোগ প্রায় দেখাই যায় না। মাঝেমাঝে সরকারি উদ্যোগে কিছু পোনা বা ডিম ছাড়া হলে সেটা যথেষ্ট না। ফলে লেকের পানি আস্তে আস্তে মাছশূন্য হয়ে যাচ্ছে।

 

 ছবিঃ পাহাড় থেকে তোলা কাপ্তাই লেকের ছবি


এ এলাকায় একটা উপজেলার সাথে আরেকটার পার্থক্য করা কঠিন। এই যে বরকল উপজেলা- সেটার স্বাগতম চিহ্ন বসানো আছে একটা পাহাড়ের উপর, যেখান থেকে বরকলের সীমানা শুরু। আমরা দেখতে দেখতে সুবলং-এ চলে আসলাম।
 



স্বাগতম বরকল উপজেলা
 

আস্তে আস্তে আমাদের ট্রলার সুবলঙে ভিড়লো। তবে সুবলঙের ঝর্ণা দেখে কিছুটা হতাশই হলাম। ক্ষীণ একটা ধারা প্রবাহিত হচ্ছে সেখানে। সাধারণত দু-তিন দিন বর্ষা থাকলে এই ঝর্ণার যৌবন নাকি উপচে পড়ে। গতকাল বৃষ্টি না হওয়াতে নাকি পানি বেশি নেই। তবে যা আছে তাও একেবারে কম নয়। আমরা আস্তে আস্তে ঝর্ণার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। মনে হলে প্রতিটি পানির বিন্দু আমার হৃদযন্ত্রটা পাশ দিয়ে শব্দ করে করে বয়ে যাচ্ছে।




তীব্র বেগে নিচে পড়া পানি, ক্যামেরা এই বেগ সহ্য করতে পারে নি


পাথরের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকা ঝর্ণা
 

ঘণ্টাখানেক ঝর্ণার নিচে থেকে রওনা দিলাম সুবলং বাজারের উদ্দেশ্যে। দুপুর গড়িয়ে গেছে। মারাত্মক ক্ষুধা লেগেছে। ওখানকার হোটেল সৌদিয়াতে টাটকা মাছ দিয়ে খাওয়া শেখ করে, ট্রলার ঘুরিয়ে রওনা দিলাম পেদা টিং টিং-এর উদ্দেশ্যে। পেদা টিং টিং একটা চাকমা শব্দগুচ্ছ, যার অর্থ হচ্ছে পেট টান টান। অর্থাৎ মারাত্মকভাবে খাওয়ার পর পেটের যে টান টান অবস্থা থাকে, সেটাকেই বলা হয় পেদা টিং টিং। এই রেস্টুরেন্ট কাম হোটেলটি গড়ে তোলা হয়েছে যাতে দর্শনার্থীরা কাপ্তাই লেকে ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে পেট টান টান করে খেয়ে যান।


পেদা টিং টিং-এর ভিতরের দৃশ্য
 

এই ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যেও বিকেলের সূর্য যাওয়ার আগে উঁকি দিয়ে গেলো। আমরা আস্তে আস্তে ভিড়লাম রিজার্ভ বাজার ঘাটে। অসীম দার বন্ধু, যিনি বোট দিয়েছিলেন তার লোক আসলেন টাকা নেওয়ার জন্য। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম অন্তত হাজার দেড়েক টাকা চাইবেন। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে চাইলেন মাত্র সাড়ে পাঁচশ টাকা। কেন?
উত্তরের জানালেন, অসীম দার অতিথিদের কাছ থেকে তিনি টাকা নিতে পারবেন না। জাস্ট তেল খরচটা নিচ্ছেন। আমরা বললাম, আমাদের জন্য তো তাহলে আজকে আপনার লাভের টাকাটা মার গেলো! তিনি কী যেন ভেবে বললেন, টাকার চেয়েও বড় হলো সম্পর্ক।

বিগল বিচি, কচি বাঁশ বা ক্যাবাং-এর রাত

রাঙ্গামাটির সাজেকে ভয়াবহ ইঁদুর বন্যার কথা নিশ্চয়ই খেয়াল আছে- মাত্র মাস কয়েক আগের কথা। পালে পাল ইঁদুর এসে সাজেক এলাকার সব বাঁশের ফুল খেয়ে ফেলেছিলো। এই ফুল খেলে ইঁদুরের প্রজনন ক্ষমতা বাড়ে বলে সংশ্লিষ্ট এলাকার পাহাড়ি মানুষরা মনে করেন। আর এরকম ঘটনা নাকি ২৫-৩০ বছরে একবার দেখা যায়।

বনরূপা বাজারে গিয়ে ছোট ছোট কচি বাঁশ দেখে ওই ঘটনার কথা মনে পড়লো। অসীম দাকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, ওই কারণেই এ বছর কচি বাঁশ খুব কম পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি যে বাঁশের গুচ্ছ একসময় মাত্র দশ টাকা করে বিক্রি হতো, এ বছর সেগুলোর দাম আশি টাকা পর্যন্ত উঠেছে। কথায় কথায় আরও অনেক কিছু জানা হলো- কীভাবে কচি বাঁশ রান্না করতে হয়, স্বাদ কেমন ইত্যাদি ইত্যাদি। সুবলং থেকে ফেরার পর হোটেলে মাত্র ঢুকেছি, এমন সময় অসীম দা জানালেন, রাতে তার বাসায় খেতে হবে। খাঁটি আদিবাসি কায়দায় রান্না করা হবে- বলেও অভয় দিলেন তিনি।

রাতে সেজেগুজে অসীম দার বাড়ি গেল।

এর মধ্যেই টেবিলে খাবার সাজানো শুরু হয়েছে। অনেকগুলো আইটেম, কিন্তু আমরা কেবল অপরিচিত আইটেমগুলোর প্রতি আগ্রহ দেখালাম। শুরু করতে হয় নাকি বিগল বিচি দিয়ে।

বিগল বিচি দেখতে ছোট ছোট দানার মতো- হালকা তেলে ভাজা হয়েছে। এমনিতে এর কোনো স্বাদ নেই। এটি মূলত খেতে হয় শুটকি মাছ ও কাঁচামরিচের ভর্তার সাথে। তখনই আসল স্বাদ পাওয়া যায়। অসীম দার মা প্রচণ্ড ঝাল ভর্তা বানিয়েছেন- জানালেন এটি ঝালই খেতে হয়, না হলে পরের আইটেমটির স্বাদ ভালো পাওয়া যাবে না।

পরের আইটেমটিই আসলে আমাদের আরাধ্য আইটেম। কচি বাঁশের তরকারি। এটি দু'ভাবে রান্না করা হয়েছে- একভাগে পুঁইশাকের সাথে সিদ্ধ করে তরকারি, আর আরেকভাগে ভাজি। দুটির স্বাদই অপূর্ব! কিংবা জীবনে প্রথম খাচ্ছি বলে আমাদের কাছে অপূর্ব লাগছে। যাই হোক, বেশ উপভোগ করেই খেলাম আমরা। পুঁই শাক খাওয়ার ঝামেলায় না গিয়ে একটা একটা করে বাঁশ ধরছি আর কচকচ করে খাচ্ছি। কচি বাঁশ খেতে খুবই নরম- মুখে দেওয়া মাত্র গলে যাচ্ছে। আসলে এগুলোর স্বাদ বলে বুঝানো যাবে না! বুঝতে হলে খেতে হবে!

এর পরের আইটেমটি ক্যাবাং। এখানেও বাঁশের কারবার। তবে এই বাঁশ খাওয়ার না। শক্তসামর্থ বাঁশের খোলের ভেতর কাঁচকি মাছ ভরে সেখানে তেল-মশলা দিয়ে বাঁশটিকে পোড়ানো বা ঝলসানো হয়েছে। এই পদ্ধতিতে আদিবাসিরা শূকরের মাংস রান্না করলেও আমাদের জন্য কাঁচকি মাছ রান্না করেছেন অসীম দার মা- শূকরের মাংস খাই কিনা এই সন্দেহে। তবে এটিও খেতে দারুণ হয়েছে। হাজার হলেও নতুন স্বাদ! বাঁশ যে শুধু দেওয়ার জিনিস না, এ দিয়ে আরও অনেক কিছু করা যায়- সেটি ভালোভাবে বুঝা গেলো।

আরও অনেক পদের রান্না ছিলো। মুরগির মাংস, মাছের তরকারি ইত্যাদি ইত্যাদি। খাওয়ার আগে অসীম দার বাবা বলছিলেন- খেয়ে যেন পেদা টিং টিং বলতে পারি। আমরা এতোই খেলাম যে, পেদা টিং টিং বলার মতো সামর্থ্যও নাই।

রাত ১২টায় হোটেলে ফিরে আবারও একটু বেরুলাম। রাঙ্গামাটির দিন আমাদের যথেষ্ট আপ্যায়ন করেছে- রাতগুলো কি এই ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করবে? শহরের উঁচুনিচু পথে আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে নানা কিছু ভাবছিলাম- কেন যে এসব ভাবনা আসে- ভাবছিলাম, এই যে এতোগুলো টাকা খরচ করে আসলাম, এ দিয়ে গ্রামের একটা পরিবারের গোটা মাসের খরচ চলে যায়! আর আমরা কিনা আনন্দ করে টাকাগুলো উড়িয়ে দিচ্ছি। এটাই বোধহয় সভ্যতা, নগরায়ন কিংবা উন্নতির ফসল।

ঠিক তক্ষুণি মুষলধারে বৃষ্টি নেমে ভিজিয়ে দিয়ে গেলো- প্রকৃতির কান্না, নাকি গরীবের কান্না বুঝতে পারলাম না। এগুলো হয়তো আদৌ কোনো কান্না না, কান্না ভেবে আমরা সুখ পাই।
 

শিংঘবা- শেষ ও শুরুর মিলনস্থল

কোথাও বেড়াতে গেলে শেষ দিনটাতে আমি খুব বিষন্ন হয়ে যাই। মনের মধ্যে ঘুরতে থাকে- আজই শেষ দিন!
শেষ দিনে আমাদের প্রথম গন্তব্য পর্যটন, আর সাথে ঝুলন্ত সেতু। পর্যটনে যাওয়ার পরই বুঝলাম এখানে না থেকে শহরের হোটেল সুফিয়াতে থেকে আমরা কী ভুলটাই না করেছি! এক্কেবারে প্রকৃতির মাঝে হোটেল, পাহাড়ের উপর, পাশে কাপ্তাই লেক। শহর থেকে দূরে- নীরব, নিস্তব্ধ। ভাড়াটাড়াও দেখলাম খুব একটা বেশি না- সামান্য একটু বেশি। তা বেড়াতে এসেছি- ওটুকু কনসিডার করাই যায়! যাক, শেখা হলো, ভবিষ্যতে এলে এখানেই থাকবো। সমস্যা একটাই- শহরটা একটু দূরে বলে তড়িত প্রয়োজনে কিছু কেনাকাটা করা যায় না!

আমরা ক্যালেন্ডার বা পত্রপত্রিকায় নানা ফিচারে যে ঝুলন্ত সেতুটি দেখে থাকি- সেটি এই রাঙ্গামাটির। অথচ এটি কিন্তু পুরোপুরি ঝুলন্ত নয়। মাঝখানে দুটো খুঁটি আছে। সত্যিকারের ঝুলন্ত সেতু দেখতে হলে যেতে হবে বান্দরবানে- মেঘলা স্পটে। ওটা ছোট, কিন্তু পুরোপুরি ঝুলন্ত। এই ঝুলন্ত সেতুতে উঠে একটা মজা করা যায়- দু'চারজন হলে পুরো সেতুটাই আস্তে আস্তে ঝুলানো যায়। আমরাও একটু একটু সেতু ঝুলালাম, নিজেরাও ঝুললাম।




কাপ্তাই লেকের ঝুলন্ত সেতু
 

দুপুরে পর্যটনে খেলাম- বেশ আয়েশ করে। কাপ্তাই লেকের কাতল মাছ ভেজে দিতে বললাম। ডালটা চমৎকার ছিলো।

শেষের দিন যেহেতু, মোটামুটি উদ্দেশ্যহীন ঘোরাফেরা করছি। পর্যটন থেকে শহরে আসার পথে একটা কালীমন্দির দেখলাম, বেশ অনেক বছর আগের স্থাপনা। এদিকে তবলছড়ি এসে কেনাকাটার ইচ্ছা জাগলেও মনমতো কিছু পেলাম না। রাঙ্গামাটি-বান্দরবানের কাপড় আগে খুব পছন্দ হতো, এখন পছন্দটা বদলে গেছে। কাপড়ের মান, ধরন ও ডিজাইন ঠিক আগের মতোই আছে বলে হয়তো বর্তমানের এই না-পছন্দ! আদিবাসিদের এটা কি ঐতিহ্যকে ধরে রাখা নাকি সময়ের সঙ্গে ডিজাইন পরিবর্তন করতে পারার অক্ষমতা- ঠিক বুঝতে পারি না।
 


 

রাঙ্গামাটি শহরের শ্রী শ্রী রক্ষা কালী মন্দির
 

ঘুরতে ঘুরতে গেলাম রাজবনবিহার। রাজবনবিহার ছাড়িয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা যেখানে থাকেন, সেই আশ্রমের দিকে এগুতে থাকলাম। অদ্ভুত সুন্দর জায়গা! পাহাড় আর বনের মধ্যে ছড়ানো-ছিটানো তাদের বাসস্থান। বেশ শান্তির, ঠাণ্ডার, আরামের! এরই মাঝে অনেকগুলো বানরের কিচিরমিচির শুনে সামনে এগিয়ে গেলাম। সে কী অবস্থা! অনেকগুলো বানর- ঘুরছে-ফিরছে-খাচ্ছে। ছবি তোলার চেষ্টা করলাম- কিন্তু বানরগুলো মনে হয় দুই-মেগাপিক্সেল তেমন একটা পছন্দ করে না।



রাজবন বিহার, রাঙ্গামাটি
 

সেই প্রথমদিন থেকেই মাথায় একটা শব্দ ঘুরছে- শিংঘবা। আমরা যে হোটেলটাতে আছি, তার ঠিক সামনেই একটা রেস্টুরেন্টের নাম শিংঘবা। এর অর্থটা আমাদের হোটেলের কেউ বলতে পারলো না। এর মধ্যে দু-তিনবার ঘুরেও এসেছি রেস্টুরেন্টটা থেকে- ঈদের কারণে বন্ধ। অদ্ভুত শব্দটা মাথায় ঘুরছে তো ঘুরছেই!

রাত হয়ে গেছে, পরদিন সকালে উঠেই ছুট লাগাতে হবে ঢাকাপানে। হোটেলে ফেরার আগে আবার ঢু মারলাম শিংঘবায়। একজনকে পাওয়া গেলো। তিনি জানালেন- শিংঘবা হলো চাকমা শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো বৈঠকখানা বা ড্রয়িংরুম।

বৈঠকখানা বা ড্রয়িংরুম আসলে শেষ ও শুরুর মিলনস্থল। কোনো ঘরে প্রবেশ করতে চাইলে আপনাকে যেমন শিংঘবা মাড়িয়ে যেতে হবে, তেমনি বেরুবার সময় শিংঘবা দিয়ে বের হয়ে যেতে হবে

রাঙ্গামাটিতে শিংঘবার সাথে দেখা হলো ফিরে আসার সময়। হয়তো প্রতিটা ভ্রমণেই শিংঘবারা শেষের সময়ই বিদায়  দেয় বাইরের আগন্তুকদের। রাঙ্গামাটি কি এটা প্রতীকের মাধ্যমে কিন্তু হাতেকলমে বুঝিয়ে দিলো? তারপরও নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর কন্ঠে (গানের লিংক) সেই লাইনগুলোঃ

রাঙা মাটির রঙে চোখ জুড়ালো, সাম্পান মাঝির গানে মন ভরালো
রূপের মধু সুরের যাদু কোন সে দেশে, মায়াবতী মধুমতি বাংলাদেশে

ও সেই রোদের আলো শিশির ছুঁয়ে, এ কোন খুশির কথা যায় শুনিয়ে
একটু দোলা দিয়ে এই বাতাসে, মগ্ন করে রাখে কার আবেশে
রূপের মধু সুরের যাদু কোন সে দেশে, মায়াবতী মধুমতি বাংলাদেশে

ও সেই ফুলের হাসি মাঠের বুকে, সবুজ আশার কেন পরান মাখে
একটু অনুরাগে লাল পলাশে, অন্ধ করে রাখে কার পরশে
রূপের মধু সুরের যাদু কোন সে দেশে, মায়াবতী মধুমতি বাংলাদেশে
 ***