না-দেখা দৃশ্যের ভেতর; সবই
সুন্দর!
সৈয়দ আফসার
আমি আমাকেই খুঁজি ছায়ার ভেতর; ছায়াও আমাকে খুঁজে তার উপর। সে আর আমি একসাথে বেড়ে
ওঠার অবাক মুহূর্তকে না-জড়িয়ে উপলব্ধি করার আগের সম্পর্ককে হাসাই-কাঁদাই; কৌতূহলি
সময়কে অহরহ চিনে রাখি।ছায়া আমাকে ধরে রাখে;
আমিও ছায়াকে। চোখের ভেতর যে
স্বপ্নকে খুঁজি; সে চোখে আবার স্বপ্নকেও জমিয়ে রাখি। আমার দেখার ভেতর পৃথিবী জাগে;
পৃথিবীর সব কায়াও
ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে ছায়ার উপর। ছায়া রোদে পুড়ে,বৃষ্টিতে ভিজে,বরফে
শীতল হয়, বাতাসেও দোলে। টানা অন্ধকারে তারাদেরও
তো একটি ছায়া থাকতে পারে;
জ্যোৎস্না
রাতে হাসনাহেনা ফুলেও ছায়ার দোলাও দেখেছি; পাতার ছায়াও আমাকে ভাবতে
শিখিয়েছে! ফলে শেষরাতে অন্ধকার অতিক্রম করলেই ছায়া-চন্দ্রিমার ভেতর আমার তাগিদ ও
চেতনা ব্যতিক্রমী হয়ে ফিরছে দংশনের দিকে…
এখন প্রশ্ন করাই যায় ছায়া কি দংশন করতে পারে?
কিংবা কেনোই-বা সব মানুষ দায়বদ্ধ থাকে
তাঁর নিজের অর্জিত ছায়ায়? যেকোনো সৃষ্টিসহায়তা মানুষকে আনন্দ দেয়, তৃপ্তি দেয়।
আনন্দ জোগায়,স্বাদগ্রহণ করাতে চায়, গভীরস্পর্শ বা
উপলব্ধির চূড়ায় পৌঁছায়…। কারণ
স্পর্শ আর
উপলব্ধি ধরে রাখার প্রথম সিঁড়ি কিন্তু অদৃশ্য; যার ফলে ভেতর দৃষ্টি খুলে
যায়।এই দৃষ্টি খুলে যাবার পর মানুষ চারপাশে ঘটমান দৃশ্য নিয়ে ভাবে; অদৃশ্য মিহি
সুতোর টানে মনের টনক নড়ে;
উপলব্ধি করে; সুন্দর ভেবে খুলে দেখে; খুঁটেও দেখে; বিজ্ঞ
ভেবে অভিজ্ঞ সাজে।
নিজেকে জানতে, জানাতে তাঁর সুন্দর জীবন নষ্ট করে। তবে এ-ও ঠিক যে
স্পর্শ,উপলব্ধি, অভিজ্ঞতা সবার কাছে এক রকম হয় না। যে কোন বিষয়য়াদি মানুষকে ভাবায়,
উপলব্ধি করায়, কিন্তু সব ভাবনা এক রকম হয়?
সৃষ্টির চেয়ে এ পৃথিবীতে আর কিছু শ্রেষ্ঠ সুন্দর হতে পারে না। সৃষ্টির ভয়ে ক্ষয়ে
যাওয়া বস্তুটিও চোখের ভাষায় ধরা পড়ে; জীবন
ব্যবস্থার মতো মোহের অনীহাও ধাপে ধাপে
পরিবর্তিত হয়; যেভাবে পরিবর্তন ঘটে মনোজগতের চিন্তা-চেতনা; কেননা জোর করে কোন কিছু
সৃষ্টি করা যায় না; আর হলেও সেটার যথার্থটা থাকে না। যার ফলে এখানে অবধারিত ভাবে যে
রূপটি আমাদের সামনে আসে তা হল— জ্ঞান আর ধ্যান এর সম্পর্ক ও কথা, কারণ বই-পুস্তক
পাঠ করে অনেক জ্ঞান অর্জন করা যায়; সৃষ্টির সফলতা আসে না। আবার ধ্যানের দ্বারা
সৃষ্টি সম্ভব কিন্তু পূর্ণতা আসে না। এখন প্রশ্ন তাহলে সৃষ্টির মূলে আসলে কি
প্রয়োজন? আমার ব্যক্তিগত অভিমত যদি ধ্যান আর জ্ঞান যাপিত জীবনের সাথে একাগ্রতার যে
নিবিড় সম্পর্ক হয়; আর সেখান থেকে কিছু সৃষ্টি হয় তা হবে ছুঁয়ে দেখার অনিবার্য কিছু…
আমরা জানি সৃষ্টির বিচিত্ররূপ আছে; আছে গঠন-পঠন কিংবা উম্মেষও।
আমাদের মনোজগত বা ধ্যানজ্ঞান কিন্তু এক জায়গায় স্থির নয়; যা আমরা প্রতিটি ক্ষণেই
উপলব্ধি করি; তাই প্রতিটি সৃষ্টির আনন্দই আলাদা আলাদা প্রকাশ পায়। আনন্দই অন্য নামই
যে আহ্লাদ-আকর্ষণ; আর আহ্লাদ-আকর্ষণই হচ্ছে ঘোরলাগা সময়ের ভেতর পুঙ্খানুপুঙ্খ
রূপে
নিজেকে জানার জাগিয়ে রাখার শ্রেষ্ঠ উপায়। আর তা যদি হয় কবিতা! কবিতা তীব্রযন্ত্রণা
থেকে চিন্তা আর চিন্তা থেকে দানাবাঁধা ধ্যানের খেলা। কবিতা তিনটি শব্দের মায়ায়
বাঁধন ছন্দ ও জীবন। জীবনের প্রেরণা
মুহূর্ত্ব আর ছন্দের দোলা; তাও একটি কবিতার ভাষা।
ইচ্ছাটাই মানুষের ভেতর উদ্ভট চিন্তার জোগান দেয়; ছায়ার বাকল খুলে দেখা, করাতের
আলদাঁত ছুঁয়ে বাতাসের ডানায় চড়া! এরকম যদি হত কবিতার ভাষা। শব্দবদ্ধকথা মানে নড়েচড়ে
বসা; কবি কবিতা লিখেন তাঁর মতো করে আর পাঠক সে লেখা থেকে স্বাদ গ্রহণ করেন নিজের মতো
ভেবে। কবিতার অর্থ-ব্যঞ্জনা
উপলব্ধি পাঠক ভেদে ভিন্ন হয়; ভিন্ন হতে বাধ্য; এই পাঠক
ভেদে বদলে যাওয়াটাই কবিতার শক্তি। কবির প্রাজ্ঞতা। কবিতা একটি অপরিচিত চারাগাছের মতো,
যাকে প্রতিদিন আলো-বাতাসে রেখে পরিচর্যা করতে হয়। যত বেশি পরিচর্যা হবে চারাটিও
স্বরূপে বেড়ে উঠে। পরিচর্যাকারী ভাবেন— রোপনের সময়; ঋতুর কথা; বীজের কথা; পরিশেষে
তাঁর চিন্তা আসে মাটির আর্দ্রতা-উর্বরতা।
চারা উঠার আগে কি আমরা দেখেছি তার না-ফোটার
যন্ত্রণা…?
ঠিক তেমনি ভাবে একজন কবিকেও এমন ভাবতে হয় কবিতার জন্ম বীজের কথা।
ফুল
যেভাবে ফোটে সৌরভ ছড়ায়; নাকের ডগায়।
সব সুন্দর থেকেই চেষ্টার শুরু। কবিতা আমার কাছে অন্ধঘড়ির কাটার মতো অবিরাম ঘুরে
যাওয়া রহস্যখাতা। কবিতা আমার কাছে প্রেম না-আসা প্রিয়ার চুম্বনানুভবের মতো... কবিতা
আমার কাছে হাজার মুখের ভিড়ে একটি প্রিয় মুখকে চিনে নেবার মতো। কবিতা আমার কাছে
নিজের ভেতর নিজে খুঁজে দেখার জন্য। কবিতা আমার আরাধনা; শেষমৃত্যুর সান্ত্বনা।…
সবাই অদৃশ্য সময়কে কাছে ডাকে, অদৃশ্য স্থানকে নিজের কল্পনায় বুনে; অদৃশ্য বস্তুকে
দেখার আকাঙ্ক্ষা মনে পুষে; যখন শিশু ছিলাম বাড়ি চারপাশ আমার কাছে যেমন সুন্দর ছিল;
ভাবতাম পাশের বাড়ির দৃশ্য আরো সুন্দর হয়ত; যখন বাবার হাত ধরে এবাড়ি-ওবাড়ি ঘুরতাম
তখন পুরো পাড়া দেখার বাসনা জাগত; যখন বুঝতে শিখলাম পুরো গ্রাম ঘুরলাম ভিন্ন অনুভূতি
জাগতে শুরু হল… কৈশোরে বাবাকে যখন শহরে যেতে দেখতাম; বাবা ফিরে আসার পর শহরের গল্প
শুনতে অস্থির
থাকত মন; তখন কি অস্থিরতার মানে জানতাম? মনের ঘরে না-দেখা
দৃশ্যকে কল্পনাই আমার কবিতা। না-আসা যৌবন থেকেই পরবাসের স্বপ্ন মন দোলাতে থাকে।
পরবাসের অদৃশ্য-সৌন্দর্য্য কেন যে চোখে জাগছিল বহুজাত মোহ
জালে…। যা দেখা হয়নি তার সবই সুন্দর;
একথাটি ভাবতে-ভাবতে এইমাত্র জানালার ফাঁক দিয়ে তাকালাম; সিগ্রেট টানতে-টানতে শেষটানে
পাশে শহরের জ্বলে থাকা রাতের সোডিয়াম আলো ছড়িয়ে থাকার দৃশ্য দেখলাম; দেখা দৃশ্যরাও
চোখের ভেতর মনে হচ্ছে আঁকাবাঁকা; আমি যেন ঝুলে পড়ছে বাড়ির ছাদে…