আবুল হাসানের কবিতায় অন্তর্গত
ক্ষরণ
সাইফুজ্জামান
কবিতায় বিচ্ছিন্নতাবোধ, আমুগ্ধতা ও স্পর্শকাতরতা নিয়ে ষাট দশকে আবুল হাসানের
আবির্ভাব। প্রাত্যহিক বিবরণী তার কবিতার বর্ণনাকে শক্তিময় করেছে। জীবনানন্দনীয়
মুগ্ধতা নিয়ে প্রকৃতি প্রেমিক কবি আবুল হাসান বারবার ফিরে দেখেছেন স্বদেশ, নিঃসঙ্গ
মানুষ ও মানুষের অন্তর্গত ক্ষরণ। গভীর আবেগস্পর্শী বক্তব্য রূপক, চিত্রকল্প ও ভাষার
বুননে বিদ্যুৎ চমক সৃষ্টি করেছে। স্মৃতি, স্বদেশ, ব্যক্তিগত বিষয়, প্রেম, নাগরিক
চেতনা ঘিরে তার কবিতা বিকশিত। কবিতাবদ্ধ থেকেছে একাকিত্ব, দুঃখ-কষ্ট ও যাপিত জীবন।
আবুল হাসানের সৃষ্টি জগৎ প্রণয় বিরহ, প্রতারক সময় এবং স্বদেশ বন্দনায় মুখর। তার মা
বাংলার সব মায়ের প্রতিনিধি হয়ে গেছে অনায়াসে। বোন বাঙালির অহংকারের উত্তরাধিকার।
প্রেমিকা চেনা জনপদের রহস্যময়ী বান্ধব।
আবুল হাসান চারপাশের সামাজিক, রাজনৈতিক প্রতিবেশ থেকে কবিতার উপকরণ সংগ্রহ করেন।
ষাট দশকের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ আবুল হাসানের কবিচিত্তে আলোড়ন তোলে। প্রথম পর্যায়ে
রচিত কবিতা ‘শিকারী লোকটাতে’ তিনি দ্যুতিময় বিভায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন। ১৯৭২-এ
প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাজা যায় রাজা আসে’-তে তিনি স্বদেশ, প্রকৃতি আর
মানুষের অন্তর্গত বোধে শাসিত। উৎসর্গপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমার মা মাতৃভূতির মতো
অসহায়’। ব্যক্তিগত অনুভূতিজারিত পঙক্তিমালা আত্মপ্রত্যয়ী, সংযত ও দৃঢ়। সমাজ,
মানুষের হৃদয়াবেগ, হাহাকার, বৃক্ষ, ফুল, মমতা ও ভালোবাসায় আর্দ্র কবিতা রহস্যময় জগৎ
সংসারের সীমানা চিহ্নিত করে। যাপিত জীবন থেকে তিনি তুলে এনেছেন রঙ ও বিষণ্ণতা।
বাঙালির মমতা, ক্ষরণ, দুঃখ আর প্রেমের অতল তল ছুঁয়ে পঙক্তি রৌদ্র-ছায়ায় ঘেরা মেঘের
গভীরে হানা দেয়।
অন্তরঙ্গ স্মৃতিময় বক্তব্য পাঠককে বিমোহিত করেঃ
অবশেষে জেনেছি মানুষ একা!
জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা
দৃশ্যের বিপরীতে সে পারে না একাÍ হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনদিন।
ফাতিমা ফুফুর প্রভাতকালীন কোরানের
মর্মরিত গানের স্মরণে তাই কেন যেন আমি
চলে যাই আজো সেই বর্ণির বাঁওড়ের বৈকালিক ভ্রমণের পথে
যেখানে নদীর ভরা কান্না শোনা যেত মাঝে মাঝে
জনপদবালাদের স্ফুরিত সিনানের অন্তর্লীন শব্দে মেদুর।
......
আসতেন পাখী শিকারের সূক্ষ্ম চোখ নিয়ে দুলাভাই!
ছোট বোন ঘরে বসে কেন যেন তখন কেমন
পানের পাতার মতো নমনীয় হতো ক্রমে ক্রমে!
আর অন্ধ লোকটাও সন্ধ্যায়, পাখীহীন দৃশ্য চোখে ভরে!
দীঘিতে ভাসতো ঘনমেঘ, জল নিতে এসে
মেঘ হয়ে যেতো লীলা বৌদি সেই গোধূলি বেলায়
পাতা ঝরবার মতো শব্দ হতো জলে ভাবতুম
এমন দিনে কি ওরে বলা যায়?
স্মরণ প্রদেশ থেকে এক একটি নিবাস উঠে গেছে
সরজু দিদিরা ঐ বাংলায়, বড় ভাই নিরুদ্দিষ্ট,
সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি সাথে কোরে নিয়ে গেছে গায়ের হালট
একে একে নদীর ধারার মতো তারা বহু দূরে গত
(পাখী হয়ে যায় এই প্রাণ)
গ্রাম্যদৃশ্য, স্মৃতি হাহাকার, নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত আবুল হাসানের কবিতায় জীবনের
উচ্ছ্বাস, প্রেমাকুলতা ও গভীর উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। পাখির মতো তার অস্থির চঞ্চল
চোখ বাংলার এই জনপদের প্রতি প্রান্ত ছুঁয়ে যায়। তার কবিতায় গ্রামের জীবনের ছবি ও
নৈসর্গিক বর্ণনা বিপুলভাবে উপস্থিত। মুগ্ধতার পাশাপাশি হাহাকার ঘিরে আছে তার কবিতায়।
বারবার ফিরে গেছেন আবুল হাসান প্রিয় মানুষ, গ্রাম, প্রকৃতি ও স্বজনের কাছে। তিনি
আত্মকথনে মগ্ন থেকেছেন।
তার কবিসত্তা, বাউল চেতনা ও বৈষ্ণবীয় দর্শনে মগ্ন। মানবিক সম্পর্ক সমাজ ও
পারিপার্শ্ব থেকে আবুল হাসান কবিতার উপাদান সংগ্রহ করেছেন। মৃত্যু ভাবনা, ক্লান্তি,
হতাশা তার কবিতায় উঁকি দিলেও আবুল হাসান জীবনের জয়গানে আলোড়িত। সুন্দর তার আরাধ্য।
প্রেমে অবগাহিত তার কবিতার অন্তর্দেশ। তার কবিতায় উত্তম পুরুষে বিবৃত স্মৃতি, ঘটনা
ও বিচিত্রবোধ সঞ্চারিত। পাশ্চাত্য কবিতার বিষয় উপকরণের সঙ্গে আবুল হাসান দেশীয়
উপাদান এমনভাবে একীভূত করেছেন তার কবিতা চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠেছে। সৌন্দর্য কাতরতা
তার প্রিয় বিষয়। আলো, নিসর্গ ও নারীকে আবুল হাসান এমন এক বিন্দুতে এনে দাঁড়
করিয়েছেন, যেখানে এক শাশ্বত বাঙালি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। প্রেমাকাংখী এক মানব হৃদয়
খুঁড়ে দেখে রহস্যময় জগৎ সংসার। নিজস্ব ভাবনায় শিল্পরূপ দিয়ে তিনি ব্যক্তির অন্তর্গত
ভুবন উন্মোচন করেছেনঃ
প্লাস্টিক ক্লিপের মতো সহস কোকিল যেই বনভূমি গেঁথে নেয়
সবুজ খোঁপায় ভোরবেলা-ময়ূরের পেখমের মতো খোলা রোদে বসে
ব্লাউজের বোতাম লাগিয়ে মিসট্রেস আসে ইশকুলে আর
কয় ঝাঁক বালকের নির্দোষ নিখিল ভরা ক্লাসরুমে এসেও সে শোনে
বন খোঁপা বাঁধা কোকিলের কাজল কূজন তার চুলে, চমৎকার
চিরোল গ্রীবায়, শেষে গৌর লাজুক শিরায় শিহরিত শুধু
পেতে গিয়ে এক হারানো প্রেমের ঘ্রাণ, বয়ে নেয় সে তখন
কী যে এক আর্দ্র পরাজয় তার আÍব্যস্ত অতীতের অথই সীমায়!
......
তুমি ভূখণ্ডের মানে এই ঢাকা শহরের সবুজ তনয়া নারী
তুমি কি বোঝ না তার তিরিশ বছরকাল কুমারী থাকার অভিশাপ?
বোঝ নাকি
তিরিশ বছর কত কাঁদায় যৌবন ঐ কোকিলের পাষণ্ড রোদন
......
অভিমানী সর্বস্ব খোয়ানো ঐ মেয়ে
মানসিক শ্রমে জব্দ জীবনধারিণী
ওকে দয়া করো
হে ভোর
হে স্ট্রীট
শিশুক্লাস
বনের বিজন
সাঁঝ বেলা!
(মিসট্রেসঃ ফ্রি স্কুল স্ট্রীট)
‘যে তুমি হরণ করো’ কাব্যগ্রন্থে আবুল হাসান উল্লেখ করেন, ‘বিপ্লবী কবি, প্রেমিক ও
পরাজিত মেঘদল ছাড়া পৃথিবীর সব ভুল শোষক-শাসক পারিতোষিক ভণ্ড, সমালোচক ও স্থূল
সৌন্দর্যধারকদের জন্য এই বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করছি।’ অনেক স্বপ্ন নিয়ে বাঙালি
মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেয়। স্বাধীনতার পর সাধারণ মানুষের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা তীব্র হয়ে
ওঠে। এ কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতা স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় আক্রান্ত। উদিত দুঃখের দেশ,
গ্রাম্য মানুষের নিস্তরঙ্গ দোলাচল, প্রণয়, বিরহ, দেশ ও সমকাল ঘিরে আবুল হাসানের
কাব্যযাত্রা অব্যাহত থাকে।
ধ্যানমগ্ন কবি নিসর্গ ও মানুষের কাছে সমর্পিত। কালো কৃষক প্রতিবাদী মানুষের প্রতীক
হয়ে যায়ঃ দুঃখের এক ইঞ্চি জমিও আমি আনাবাদি/রাখব না আমার ভেতর।
(কালো কৃষকের গান)
আবুল হাসান শান্ত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছেন। কবি শত্রুতা, যুদ্ধ, স্বাধীনতার তিলক
উৎকীর্ণ বাংলায় সাধারণ মানুষের মনোযন্ত্রণা, রক্তক্ষরণকে গভীর মমতায় নিজের মধ্যে
ধারণ করেন। তিনি উচ্চারণ করেনঃ
লক্ষ্মী বউটিকে/আমি আর কোথাও দেখি না/হাঁটি হাঁটি শিশুটিকে/কোথাও দেখি না/কতকগুলি রাজহাঁস দেখি/কতকগুলি মুখস্থ মানুষ দেখি, বউটিকে কোথাও দেখি না/তবে বউটি কি রাজহাঁস/তবে শিশুটি আজ/সবুজ মাঠের সূর্য, সবুজ আকাশ/কেবল উৎসব দেখি/ স্বাধীনতা দেখি/ তবে কি আমার ভাই আজ/স্বাধীন পতাকা?/তবে কি আমার বোন তিমিরের বেদীতে উৎসব (উচ্চারণগুলো শোকের)
আবুল হাসানের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পৃথক পালঙ্ক’ ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত। পৃথিবীর
রূপ-বৈচিত্র্য, জীবনের ইতিবাচকতা ও মানুষের ভালোবাসায় অবগাহিত তার সত্তা। আবুল
হাসান দার্শনিক চোখে সমাজের অভ্যন্তরের ভাঙা-গড়া, পতন ও উত্থানকে প্রত্যক্ষ করেছেন।
সপ্রতিভ জীবন, আলো-আঁধার, মেঘলা দুপুর, ক্লান্ত মানুষ তার ছায়াসঙ্গী। কান পেতে তিনি
নদী ও মানুষের অন্তর্গত ভাঙনের শব্দ শুনেছেন। আবুল হাসানের কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ
নতুন অর্থবোধক দ্যোতক তৈরি করে। আবুল হাসান শান্তি অন্বেষী। পৃথক পালঙ্ক
কাব্যগ্রন্থের কবি স্বীকার করেন মানুষ যদিও বিরহকামী কিন্তু মিলনই মৌলিক। পতিতার
মুখাবয়বে খুঁজে পান প্রত্যাখ্যাত প্রেমিকাকে। ‘বেশ্যার বেদনাবোধে বুক ঢেলে/কাঁদছে
কামুক’ উচ্চারণের সঙ্গে পরাজিত প্রেমিকের অবনত চেহারা ভেসে ওঠে। সবুজ রঙের শীত,
কথার নরম কেক, কাঁকড়ার মতো বিছানায় শুয়ে থাকি, লাল বিড়ালের থাবার মতো চাঁদ এসব
চিত্রকল্প শাশ্বত বাংলা আর বাঙালির জীবন প্রবাহ থেকে আবুল হাসান সংগ্রহ করেছেন।
আবুল হাসান প্রেমিক কবি। ভালোবাসা খুঁজতে গিয়ে প্রবল গৌরবকে লালন করেনঃ
ভালোবাসা মানে এই পরস্পর শান্তি আর একতাবদ্ধতা
ভালোবাসা মানেই তো একে অপরের প্রতি সুবিশ্বাসী হওয়া
ভালোবাসা মানেই তো হৃদয়ের ইতিহাস থেকে সব ঐতিহ্য ধারণ করা
ভালোবাসা মানেই তো একতার ঊর্ধ্বে সুসংহত হওয়া
ভালোবাসা মানেই তো ক্ষণবিভ্রমের শেষ
(ওরা কয়েকজন)
ওরা কয়েকজন কাব্যনাট্যে আবুল হাসান স্মৃতি, বেদনা, স্বপ্ন, গ্রাম, পাহাড়,
রৌদ্র-ছায়ার সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন। রেলওয়ে স্টেশনে অপেক্ষারত কয়েকজন তরুণ-তরুণীর
বিক্ষিপ্ত ভাবনায় স্মৃতি, জীবন ও প্রেম উপলব্ধি জাগ্রত হয়। নারী নিঃসঙ্গ কাতরতা থেকে
রচিত আবুল হাসানের কবিতা রহস্যময়তা তৈরি করে। তার কবিতা আত্মস্মৃতি, যাপিত জীবন ও
প্রবহমান সময়কে চিত্রিত করে।