সুখের লাগিয়া

 

ফিরোজা হারুন

 

।। এক।।

                
ছোটবেলায় কবিতা পড়েছিলাম, ‘হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস।’ লাইনটি পড়ে মনে শক্তি সঞ্চয় করতাম।উতসাহ বোধ হতো। ভবিষ্যত জীবনে আমারাও তুড়ি মেরে যা কিছু অশুভ, অশোভন সব কিছু দূর করে এগিয়ে যাব। মানুষের যত দুঃখ, বেদনা, দুর্দশা, যন্ত্রণা – সব মোচন করে মচোন করে সুখ তৈরি করতে সাহায্য করবো। মনে হতো মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই। ইচ্ছাই তার প্রধান চালিকা শক্তি।

যাত্রা শুরু করেছিলাম এই ধারণা নিয়ে। চলার পথ যে বাধাহীন, সাবলীল ছিল তাও নয়। সব বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে আনন্দকে সংগী করতে চেয়েছি বারবার। আনন্দ পেয়েছি, আনন্দ বিলিয়েছি চারপাশে। দুঃখ দুঃখ ভাব নিয়ে বাঁচতে ভাল লাগে না আমার। কিন্তু না, অদৃষ্টকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারিনি। আনন্দ সৃষ্টির নিরন্তর প্রয়াস আমার বিঘ্নিত হয়েছে। মুখ থুবড়ে পড়েছি বারবার। ভাগ্যের হাতে বড় নির্মমভাবে নিপীড়িত, নিগৃহীত হয়েছি। তবুও উঠে দাঁড়িয়েছি আশায় বুক বেঁধে। অদৃষ্টকে পরিহাস করার সাহস আর নেই। অদৃষ্টই আমাকে পরিহাস করেছে। তাকে মোকাবেলা করাই আমাদের কাজ।

 
‘মনে পড়ে সেই জৈষ্ঠ্যের ঝড়ের রাত্রে নাহিকো ঘুম, অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।’ ছোটবেলার এ দৃশ্যটি আমার জীবনে এক বাস্তব ঘটনা ছিল। নানার বাড়িতে আমার শৈশব কেটেছে। সবুজ শস্যভরা শ্যামল বিস্তীর্ণ মাঠের ওপারে আম, কাঁঠাল, সুপারি-নারকেলের বাগানে ঘেরা আমার মাতামহের গৃহাঙ্গন। পাশেই জলভরা দিঘী। জল টলমল করছে। শান বাঁধানো ঘাট। মৃদু সমীরণে দিঘীর জলে জেগে ওঠে অসংখ্য ঢেউ। তারই মাঝে টুপটাপ করে ভেসে ওঠে নানা রকম মাছ। পুকুরের ওপারে ’ছয়বেহারা’ পালকি চালকের বসবাস। তখনকার দিনে গ্রামে পালকি চড়ে দুলকি চালে মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করতো। বিশেষ করে মেয়েরা। তাদের জন্যে কাঠের তৈরি পালকি অথবা বাঁশের তৈরি ডুলিই একমাত্র যাতায়াত বাহন ছিল। চারজন অথবা দুইজন বেহারা কাঁধে করে যাত্রীসহ পালকি অথবা ডুলি বহন করতো। আজকের দিনে হয়তো সে সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই।

গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে আমার মাতামহ উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তার শিক্ষা গ্রহনের অনেক মজার গল্প আমরা বড় হয়ে শুনেছি। ব্রিটিশের রাজত্বের মধ্যগগণে তখন ভারতবর্ষ। ব্রিটিশ হেড মাস্টার। বাঙালি হিন্দু শিক্ষক। বিদ্বান, জ্ঞানী। মানুষ গড়ার কারিগর। ছাত্রকে মানুষ করার জন্য তারা জ্ঞান ভান্ডার উজাড় করে দিতেন। মুসলমান ছাত্র তিনি একা। তার প্রতি অন্য ছাত্রদের প্রচন্ড কৌতুহল। মুসলমান ছেলে লেখাপড়া শিখতে এসেছে। মদ্রাসায় নয় – ইংরেজী স্কুলে। যেন অবিশ্বাস্য ঘটনা! ক্লাসে একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে অট্টহাসি চেপে রাখার হর্ষধ্বনি শ্রবণে লজ্জায় মাথা নত হয়ে যায়। দু’একবার এমন হওয়ার পর নানাজান সতর্ক হন। লেখাপড়ায় খুব মনোসংযোগ করেন। হাইস্কুলের লেখাপড়া, তাও ইংলিশ মিডিয়াম।পড়া তৈরি করে দেয়ার কেউ নেই। তবুও মেধা ও মননশক্তির অনুশীলন করে তিনি ততকালীন শিক্ষা ব্যবস্থায় এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে ‘গুরু ট্রেনিং’ ও গ্রহন করেন। শিক্ষকতা করার যোগ্যতা অর্জন, অধুনা যাকে টিচার্স ট্রেনিং বলে। তাছাড়া তখনকার রেওয়াজ অনুযায়ী আরবী, ফার্সিতে যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন তিনি। সেই মাতামহ আমার গ্রামেই স্কুলে মাস্টারি করতেন। সৎ জীবন যাপনের জন্য তার দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষকতাই ছিল মহান পেশা। স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। অভাব অনটন কাকে বলে জানতেন না। ধর্ম, কর্ম, পরোপকার করেই জীবন কাটিয়েছেন।

এমন এক মহান ব্যক্তির ঘরে আমার মায়ের জন্ম। প্রথম মহাযুদ্ধের ডামাডোল বাজছে তখন পৃথিবী জুড়ে। ঘরে ঘরে মানুষ যে কোন বিপদের আশংকায় শংকিত। তবুও মানুষের জীবনযাত্রা থেমে নেই। কন্যা সন্তান তখনও পিতামাতার কাংখিত সন্তান ছিলনা। কিন্তু দুই পুত্রের পর আমার মা আশীর্বাদের মত তাদের কোলে এলেন। স্বভাবটি ছিল তার ভারি মিষ্টি। অনেকটা তার মায়ের মতো। স্নেহমাখা- হৃদয় কাড়া। হাঁটি হাঁটি পা পা করে অনন্দে ভরে তুললেন ঐ মাটির গৃহাঙ্গন। তার মা গড়িয়ে দিয়েছিলেন রূপার নূপুর! ঘুংগুরের গোটা লাগানো চরণালংকার। তার পায়ের মধুর ছন্দায়িত শব্দই তার মাকে জানিয়ে দেয় সে কোথায় আছে।

মেয়েদের লেখাপড়া শিখার কোন রেওয়াজ ছিল না তখন। বিদ্যার্জনের অধিকার ছিল কেবল ছেলেদের। অনেক বড় বড় বিদ্বান ব্যক্তির স্ত্রী ও কন্যারা অশিক্ষিত ছিলেন। তাতে লজ্জা বা সংকোচের কোন বালাই ছিল না। মেয়েরা মূর্খ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। মেয়েরা গৃহকর্মে, সূচিশিল্পে বা সৌন্দর্য্য সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত হতো। বড়জোর আরবী পড়া, নামাজ শিক্ষা এবং ফারসি পড়ার অনুমতি দেয়া হতো। তাও অন্তঃপুরে বসে, বাড়ির বাইরে নয়।

শিক্ষক পিতা শিক্ষার মর্ম বুঝতেন। কন্যাকে নিজেই বাংলা ও ইংরেজি শেখালেন। আমার মা কোনদিন বিদ্যালইয়ে পরীক্ষা না দিয়েও যথেষ্ট বিদুষী ছিলেন। পড়াশুনায় ছিলতার গভীর আগ্রহ -আজও আছে। আমার মামারা উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করেন। বড় মামা সরকারি চাকরি নিয়ে শহরে বসবাস করেন। ছোট মামা ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলেতে গমন করেন।
 

সেই সময়ে সরকারি কাজকর্ম করার জন্য যে সমস্ত ব্যক্তি গ্রামে আসতেন তাদের জন্য আমার মাতামহের বাড়িটি ছিল সরাইখানা। আমার নানিজানের হাতের রান্না ছিল বড়ই উপাদেয়। তিনি তার সরকারী চাকুরে পিতার সঙ্গে অবিভক্ত ভারতের লক্ষ্ণৌ, কানপুর, এলাহাবাদ - এ সমস্ত অঞ্চলে কৈশোর কাটিয়েছেন। সেই জন্য তিনি মুঘলদের রন্ধন প্রণালী দক্ষতার সঙ্গে আয়ত্ত্ব করেছিলেন। তার তাহের তৈরি খাবার খেয়ে সকলেই তুষ্ট হতেন এবং ধন্য ধন্য করতেন। সে বাড়ি আদর-যত্ন, খানা পিনার জন্য ছিল খুবই মশহুর। একবার একজন অতিথি বলেই ফেললেন,যে বাড়ির মেয়েরা এত চমতকার রান্না জানেন, সে বাড়ি আসলেই খানদানি বাড়ি। পরবর্তী কালে সেই স্কুল ইন্সপেক্টরের একমাত্র পুত্রের সঙ্গেই আমার মায়ের বিয়ে হয়।
 

আমার মা ধীর স্থির সুশ্রী এবং অতিশয় দক্ষ একটি মেয়ে। সব সময় মুখে তার মধুর আদুরে হাসি। সকলের জন্য তার মমতার হাত প্রসারিত। খুব সন্তর্পণে প্রবেশ করলেন পরগৃহে। না পরগৃহ নয়, সেটি ছিল তার আপন ঘর। সুখের নীড় রচনার প্রথম সোপান। শ্বশুর-শাশুড়ি বা অন্য কেউ পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াননি। বরং মাতৃস্নেহে বরণ করেছিলেন তাকে। ‘সুখে থাকী, সুখী হও’ – এই আশীর্বাদ করেছিলেন সকলে।
 

একটি শান্তির শ্রী সর্বদা আমার মাকে ঘিরে থাকতো।তাই দিয়ে তিনি সকলের মন জয় করেছিলেন। কিছুকালের মধ্যে পারিবারিক সকল দায় দায়িত্ব এসে পড়লো তার কাঁধে। মা সানন্দচিত্তে সব ভার গ্রহণ করলেন। আনন্দ ধারা বয়ে চললো দুই পরিবারে। আল্লাহ মেহেরবান। তাই সৎ শিক্ষক পিতার ঘরে আনন্দের বন্যা। আকুল পরিদর্শক পিতামহ আমার নিষ্ঠাবান ধার্মিক ছিলেন। তাই সৌভাগ্যের কাছে তার কিছু পাওনা ছিল। সেজন্য তিনি যোগ্য পুত্রের জন্য যোগ্যতর পুত্রবধূর সন্ধান পেয়েছিলেন।


সেই সময়ে, ব্রিটিশ আমলে, খুব অল্পসংখ্যক বাঙালী সরকারি উচ্চপদে আসীন ছিলেন। তারমধ্যে মুসলমানের সংখ্যা ছিল একেবারে নগণ্য। ইংরেজি শিক্ষায় ছিল মুসলমানদের ঘোরতর অনীহা। আমার পিতা ছিলেন মেধাবী ও তুখোড় ছাত্র। কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে এমএ পাশ করেছিলেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মনোনীত হয়েছিলেন ইংরেজ শাসিত ভারত সরকারের বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের জন্য। ভারতের সিভিল সার্ভিস একাডেমি থেকে ট্রেনিং সমাপ্ত করে পাবনায় পোস্টিং নিয়ে আসেন। ইস্ট বেঙ্গলে চাকরী করার অভিলাষ ব্যক্ত করে তিনি আরজি পেশ করেছিলেন উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে। প্রার্থনা মঞ্জুর হয়েছিল। তখন মা আমার নানার বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। শুভ পরিণয়ের অল্পকাল পরেই বাবা দেরাদুনে চলে যান। তাঁর ফিরে আসায় মায়ের বিরহের অবসান ঘটে। তিনি মাকে নিয়ে চলে যান পাবনা। সেখানে সরকারি বাসভবন তাদের জন্য নির্দিষ্ট করা ছিল। ওখানে সদর মহুকুমায় এসডিওর পদে নিযুক্তি পেয়েছিলেন তিনি। মা মনের মাধুরী মিশিয়ে গড়ে তুললেন তাঁর সোনার সংসার। ঘরই যার স্বর্গ-মর্ত্য , ঘর যার সমগ্র বিশ্ব, তার ঘরখানাই তো হতে হবে সুন্দর। তাই তিনি সৃষ্টি করলেন আপন ভুবন। মনের মতো স্বামী পেলে কোন মেয়ে না ঘর সাজায়!
 

আমার বাবা ছিলেন প্রানোচ্ছ্বল আমুদে প্রকৃতির। অফিসের দায়িত্ব পালন শেষে বাড়ি ফিরে মাকে নিয়ে বের হতেন বেড়াতে। দেখতে যেতেন নানা দর্শনীয় স্থান। মাঝে মাঝে ছুটির দিনে দীর্ঘ ভ্রমণে বের হতেন। উত্তর বঙ্গে যত দর্শনীয় – রমণীয় স্থান ছিল সব দেখা শেষ হলো। তখনকার দিনে যাতায়াত ব্যবস্থা এত উন্নত ছিলনা। রাস্তা ঘাটের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। মানুষ ঘোড়ায় চড়ে, গরুর গাড়ি চড়ে গ্রামাঞ্চলে দুর্গম পথে যাওয়া আসা করতো। বগুড়ার মহাস্থানের পুরাকীর্তি, বৌদ্ধদের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন পাহাড়পুর। হিমালয়ের দক্ষিণে এতবড় বিদ্যাপীঠ তখনকার যুগে আর ছিল না। নাটোর দিনাজপুরের শেষ প্রান্ত তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সকল দর্শনীয় স্থান তাঁরা দেখে ফেললেন। জলপাইগুড়ি শিলিগুড়িও বাদ গেল না।


সিভিল সার্ভিসের অফিসারদের ক্লাবে, পার্টিতে, বন্ধু-বান্ধবদের নিমন্ত্রণে- সকল প্রকার উতসবে মা ছিলেন বাবার সহচরী। সাজগোজ করলে মাকে নাকি রাজকুমারীর মতো দেখাত। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে । শালীনতা রক্ষা করে মা সাজগোজ করতেন।বাবা ছিলেন হাসিখুশী প্রাণবন্ত।মা স্বল্পভাষী, বুদ্ধিদীপ্ত। তাঁদের বন্ধু বান্ধবের সংখ্যা ছিল প্রচুর। তাঁদের গৃহ ছিল আনন্দপুরী। তাঁদের প্রতিদিন খুশীর দিন। মানুষ ছিলেন মাত্র দু’জনা। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবে বাড়িটি থাকতো কোলাহল মুখর। উতসব অনুষ্ঠান বাসায় লেগেই থাকতো। তারা এত সুখে ছিলেন যে, সুখের পায়রাটিকে স্বর্গ থেকে ছিনিয়ে এনে তাদের মর্ত্যের গৃহকোণে স্থাপন করেছিলেন।
‘সময় বয়ে যায় নদীর স্রোতের প্রায়।’ তিরিশের দশকের প্রারম্ভেই আমার ভাইয়ের জন্ম হয়। তখনকার দিনে পুত্র সন্তান। তাও আবার প্রথম সন্তান। চাঁদের মুখখানি তার। আশীর্বাদ কেড়ে নিল সকলের। দাদা–নানার পরিবার হলো ধন্য তাদের তৃতীয় পুরুষের আবির্ভাবে। তারা সোনার মোহর ভরে দিলেন ছোট শিশুর ছোট হাতের মুঠোতে।


দিন যায় শিশু বড় হতে থাকে।মুখে তার আধো আধো বোল। পায়ে এলোমেলো পদক্ষেপ। হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় বারবার। প্রথম কবিতা শিখল, ‘হাঁটিতে শিখে না কেহ না খেয়ে আছাড়।’ তার মুখে সে সময় অস্পষ্ট উচ্চারণে ঐ শব্দ কয়টি বড়ই শ্রুতিমধুর ছিল।যতবার পড়ে যেত ততবারই সে কবিতার পঙক্তিটি আওড়াতো। যারা তার কচি মুখের আধো আধো বোল শুনেছিল, তারা প্রত্যেকে তা আনন্দের সাথে স্মরণ করে।


ছয় বছর বয়সে আমার ভাইয়ের হাতেখড়ি হয়, অর্থাৎ স্কুলে নাম লেখানো হয়। তখন আমার বয়স মাত্র দু’বছর। মাতৃক্রোড়ে পরম যত্নে, পরম আহ্লাদে বেড়ে উঠতে থাকলাম। কেটে গেল আরো দু’বছর। এর মধ্যে উত্তরবংগে আমার পিতা অন্য জায়গায় বদলি হলেন। চাকরিতে তার সিনিয়রিটি বৃদ্ধি পেল। তিনি এবার পোস্টিং পেলেন ঢাকায়। তখনকার দিনে কলকাতা ছিল বাঙ্গালিদের সবচেয়ে বড় শহর। লোকে কলকাতায় থাকতে পারলে মহাখুশি হয়। কিন্তু ঢাকা আমাদের বাড়ির কাছেই। ময়মনসিংহ আমাদের আদি নিবাস। আমার পিতা তার বাবার একমাত্র সন্তান ছিলেন বলে ঢাকাতে আসতে পারলেই খুশি। এখান থেকে বাড়ির সংগে যোগাযোগ তথা যাতায়াত কম সময়ে করা সম্ভব। বৃদ্ধ পিতা মাতার খোঁজ খবর রাখা তার একান্ত কর্তব্য।


ঢাকায় এসেই আমার মা গ্রামে সকলের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত করতে গেলেন। প্রথমে আমার দাদার বাড়ি–পরে নানার বাড়ি। বাবা এদিকে সরকারি বাংলো পেলেন। মা আমাদের নিয়ে বাসায় এলেন। ছেলেকে স্কুলে দিলেন। তারপর মনপ্রাণ ঢেলে দিলেন গৃহস্থালী সাজাবার কাজে। তার যা স্বভাব।


পুলিশের একটি ট্রেনিং সেন্টার ছিল ঢাকায়। একদিন আমার বাবা ইমতিয়াজ খান কোন এক সরকারি কাজে ঐ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যান। সেখানে কাজ শেষ করতে তার বেশ সময় লেগে যায়। তিনি অফিস থেকে বেরিয়ে দ্রুত কয়েকটি করিডোর অতিক্রম করে পোর্টিকোতে অপেক্ষমান তার জীপের সামনে এসে দাঁড়ান। চালক জীপের দরজা খুলে দেয়। তিনি জীপে ওঠার উদ্যোগ নেন। ঠিক সে সময়ে অতর্কিতে তিনি মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। ততক্ষণাত তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং তখনই মৃত্যুবরণ করেন। ড্রাইভার কিছু না বুঝেই চিতকার শুরু করে। অনেকেই ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। ঘটনার আকস্মিকতায় সকলেই হতবাক-সকলেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কি করে সম্ভব হলো এমন মর্মান্তিক ঘটনা? কেন এমন ঘটলো এ প্রশ্ন সবার মুখে। কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারল না।

পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে সর্বপ্রকার কর্তব্য পালনে দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হত। পুলিশের দায়িত্ব ও কর্তব্যের অন্ত নেই। সর্বপ্রকার পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য তাকে প্রস্তুত থাকতে হয়। সর্বোপরি আত্মরক্ষার কৌশলও তাদের জানা থাকা বিশেষ প্রয়োজন। দুর্বৃত্তের দমন পুলিশের প্রধান কাজ। সেজন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সাধারণ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করার পদ্ধতি শেখানো হতো। সেদিন সেই একাডেমিতে সে সময় রাইফেল চালানোর মহড়া চলছিল। একজন প্রশিক্ষণার্থীর রাইফেলটি হাত থেকে ফসকে যায়। সুতরাং বন্দুকের নল লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। তারই অস্থির একটি আঙ্গুলের চাপে উত্তপ্ত সীসাটি নিক্ষিপ্ত হয়ে আমার বাবার মস্তক বিদীর্ণ করে।
 

যেখানে থেকে গুলিটি আসে সেটা ছিল বিল্ডিং এর পেছন দিকের একটি মাঠ। বেশ দূরে। বাগানের বৃক্ষলতা, একাধিক বারান্দার রেলিং পেরিয়ে, সামনের বাগানের ঝোপঝাড় ভেদ করে, গুলিটি তার গন্তব্যস্থল খুঁজে পায়। আমার পিতার যমদুত হয়ে নিমেষেই তার প্রাণ হরণ করে নিয়ে যায়। কেউ কল্পনাও করতে পারছে না ঐ এতদূর হতে গুলি এসে শরীর বিদ্ধ হতে পারে। কেউ যদি কোন অবজেক্ট বা বস্ত এভাবে রেখে তাকে নিশানা করে গুলি করতে চায়, তবুও তা অসম্ভব বলে সকলের মনে হয়েছে। এক সেকেন্ড আগে অথবা এক সেকেন্ড পরে হলেও এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটতে পারতো না। নিয়তির নিষ্ঠুর খেলা । ফেরায় কার সাধ্য! আমার পিতা চলে গেলেন। তিনি জানতেও পারলেন না তিনি মারা গেছেন।
 

আমার মায়ের কাছে সংবাদটি পৌঁছে দেয়ার জন্য বাড়িতে এলেন ট্রেনিং একাডেমির উর্ধ্বতন ব্রিটিশ কর্মকর্তা ও আরো কয়েকজন। মা তাদেরকে দেখে খুশি হলেন। তিনি বললেন, আপনারা বসুন। উনি এখনি এসে পড়বেন। আজ উনার একটু আসতে দেরিই হচ্ছে। তারা কেউ কোন কথা বললেন না। গম্ভীর এক পরিবেশ। আমার তীক্ষ্ণধী মা কিছু একটা আঁচ করে বললেন, আপনারা মনে হয় কোন সমস্যায় পড়েছেন। একটু অপেক্ষা করুন। আমি এখনই লোক পাঠিয়ে উনাকে খবর দিই। উত্তরে তারা জানতে চাইলেন বাড়িতে আর কে  কে  আছেন? আমার মা সে সময়ে একাই ছিলেন বাসায়। আর আমরা দুজন অবোধ শিশু। এমন সময় পাশের বাংলো থেকে ছুটে এলেন দুই মহিলা। তারা ও অন্যরা এ দুঃসংবাদ ইতিমধ্যে পেয়ে গিয়েছিলেন। তারা আসতে সেই ভদ্রলোকের জন্য একটু সুবিধা হলো। তারা আমার মাকে ধৈর্য্য ধারণ করার উপদেশ দিলেন। ইশ্বরের অমোঘ বিধানের ওপর কারো হাত নেই- একথা বললেন। অতঃপর এই মর্মান্তিক সংবাদটি তারা তাকে দিলেন। মা জান্নাতুল ফেরদৌস যেন অকস্মাত বধির হলেন। কিছুই শুনতে পেলেন না। তিনি আবার জানতে চাইলেন তারা কি বলতে চান। কে মারা গেছে? কে কাকে গুলি করেছে। কোথায় সেই ব্যক্তি?

 

উত্তরদাতাদের কন্ঠ বাষ্পরুদ্ধ। একটুক্ষণ বিরতির পর তারা পুনরায় উচ্চারণ করলেন সেই মর্মভেদী দুঃসংবাদ। আমার মা বিস্ময়ে বিমূঢ়। অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্তব্ধ হলেন। যেন কিছুই তার শ্রুতিগোচর হয়নি।

 

মায়ের বর্ম ছিলেন আমার বাবা। কোন বিপদে আপদে তিনি মাকে নিরাপদ রাখতেন। এখন তার পাশে কেউ নেই। মা আবারও জানতে চাইলেন, এ ঘটনা সত্য কিনা। এবার কেউ উত্তর দিলেন না। তিনি জানতে চাইলেন, তিনি এখন কোথায়? কোন হাসপাতালে কি অবস্থায় আছেন?  এ প্রশ্নেরও কোন উত্তর মেলেনি। হঠাত আমার মা চৈতন্য লুপ্ত হলেন। তিনি পাশের ভদ্রমহিলার কোলে ঢলে পড়লেন। খবর শুনে অনেকেই ছুটে এলেন। খবর পাঠানো হলো গ্রামে দুই বাড়িতে। বাসা লোকে লোকারণ্য। এমন সময় আমার বাবা এলেন। ঘরে নয় প্রশস্ত বারান্দায়। দুগ্ধ ফেননিভ নিজের শয্যায়-মাটির বিছানায়।

 

মা জানতেও পারলেন না যার জন্য তিনি সারা বিকেল অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন, তিনি এসেছেন নীরবে, নিঃশব্দে। অন্যদিন বাড়িতে পদার্পণ করেই যিনি সহাস্যচিত্তে দুই শিশু সন্তানকে বুকে তুলে নিয়ে তার গৃহে প্রবেশ করতেন, এই ছিল তার নিত্যদিনের রুটিন, আজ তার ব্যতিক্রম হলো। এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনায় বাচ্চারাও হতবাক। তারা বুঝতে পারছে না কি ঘটেছে। তবে একটা কিছু যে খুবই খারাপ ঘটেছে, তা তারা অনুমান করতে পেরেছে।

 

অবশেষে আমার মায়ের জ্ঞান ফেরে। তিনি এত লোকজন দেখে ভীত হন। অল্প সময়ের মধ্যে বুঝতে পারলেন সব কিছু। তিনি উঠে দাঁড়ান এবং ঘরের বাইরে এসেই সেই ভয়ংকর দৃশ্য দেখতে পান। তিনি বাবার লাশের পাশেই বসে পড়েন। তাকে ব্যাকুল আবেগে জেগে উঠার জন্য ডাকতে থাকেন। তার ধারণা, একটা গুলির আঘাতে হয়তো তিনি চেতনা হারিয়েছেন। হয়তো প্রয়োজনীয় শুশ্রূষায় তিনি আবার উঠে বসবেন। আমার মা আমার বাবার ঘুম ভাঙাতে ব্যর্থ হন। তিনি ভবালেন এটা তার অক্ষমতা। তিনি নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলেন।

 

আমার বাবা নিশ্চিন্তে ঘুমাতেন। জানতেন যে, সময় মতো মা তাকে জাগিয়ে দেবেন। দিতেনও প্রতিদিন। আজ তার ব্যত্যয় ঘটলো। যে প্রদীপ নতুন সলতা তৈলযোগে কেবলই আলো দিতে শুরু করল, সে কেন এখনই নির্বাপিত হবে? কোন নিষ্ঠুর দানবের ক্রুদ্ধ ফুতকারে এক নিমেষেই নিভে যাবে তার উজ্জ্বল শিখা?

 

এ প্রশ্নের জবাব কারও জানা নেই। মানুষ ক্ষুদ্র জীব। জীবন মৃত্যুর রহস্য তার বোধগম্য নয়। তার কেন জন্ম হয়েছে সে জানে না। তার জীবন কি ভাবে কোন পথে প্রবাহিত হবে তা সে জানে না। তার কোথায় কিভাবে জীবনাবসান হবে, অস্তিত্ব লয় পাবে, তাও জানে না। এক অমোঘ রশি ধরে মানুষ সমুখ পানে এগিয়ে চলে। চলাই তার ধর্ম, চলাই তার কর্ম। নিয়তি তাকে কোথায় নিয়ে যাবে কেউ তা জানে না। মানুষ কত কি আবিষ্কার করছে, কত অজানাকে জানতে পারছে, কিন্তু জানতে পারছে না তার ভাগ্যের কথা, তার ভবিষ্যতের কথা। তার পরিণতির কথা।


আমাদের মায়ের সুখের সংসার এক উন্মত্ত দৈত্যের মুগুরের আঘাতে চুরমার হয়ে গেল। আমরা চিরকালের জন্য অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হলাম। আমার বাবা সংসারের সবটুকু আলো , সবটুকু আনন্দ সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। আমাদের বাড়ি শূন্য, আমাদের ঘর শূন্য। এত আত্মীয়স্বজন শুভার্থীর মাঝে আমরা যেন এক নির্জন দ্বীপের বাসিন্দা। আমার তো বোঝার বয়স ছিল না। তবুও মনে হট তিনি আবার আসবেন; রোজ বিকেলে যেমন আসতেন। আমার ভাই বুঝেও বিশ্বাস করতে চাইতেন না। তিনি ভাবতেন একদিন না একদিন তিনি আসবেন। না এসে কি পারেন? কত দিন তিনি আমাদের ছেড়ে থাকবেন? কিন্তু তিনি কোনদিন আর একটিবারের জন্যও এলেন না!
বিজন বনে গেলেন চলে আলোর দীপটি নিয়ে।
আমরা যে তার ফেরার আশায় রইলেম পথ চেয়ে।
তারপর আমার ভাই সেই ছোটবেলা থেকেই মুখখানি ভার করে রাখতেন। এখনো তার স্বভাবটি গাম্ভীর্যপূর্ণ। বাবার মতো আমুদে নয়।
 

।। দুই।।

 

বাবার তীরোধানে আমাদের শহর ছেড়ে গ্রামে যেতে হচ্ছে। তাছাড়া সরকারি বাংলো আর কতদিন আমরা ধরে রাখবো? আমাদের ঢাকা ত্যাগের পূর্ব মুহূর্তে এক তরুণ ভদ্রলোক আমাদের বাসায় এসে হাজির। অত্যন্ত বিষন্ন, বিমর্ষ তার চেহারা। মায়ের সাক্ষাত প্রার্থনা করলেন। মা তখন অনেকটা অন্য জগতের বাসিন্দা। নিজের দিকে , সংসারের দিকে মাঝে মধ্যে নজর দিতেন। নানি, দাদিরাই সংসার দেখতেন। তবুও মা এলেন তার সামনে। মাকে দেখে তার কন্ঠ বাস্পরুদ্ধ হলো। কি কারণে তিনি এসেছেন, কি বলতে চান, মা স্পষ্ট করে জানতে চাইলেন। তরুণ ভদ্রলোক অতিশয় বিনয় সহকারে এ বক্তব্য পেশ কররলেন তার মর্মার্থ হলোএই যে, সেদিন বাবার মৃত্যুর জন্য তিনি দায়ী। তার অনভ্যস্ত হাত হতে হঠাত রাইফেলটি পড়ে যাওয়ার জন্যই সেই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
‘আমার জন্যই আপনাদের পরিবারের এতবড় সর্বনাশ হয়েছে। আমাকে আপনারা শাস্তি দিন। যা শাস্তি দিবেন মাথা পেতে নেব। অনুশোচনার গ্লানিতে আমার হৃদয় মন আত্মা এক মুহূর্তের জন্যও স্বস্তি পাচ্ছে না। আমি কেন ঘাতক হলাম? আমার হাতে কেন এক নিরাপরাধ মানুষের মৃত্যু হলো?’
তরুণ ভদ্রলোক কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। বললেন, ‘আমার স্বাভাবিক আহার নেই, নিদ্রা নেই। অপরাধবোধ আমার আত্মাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আইনের চোখে আমার শাস্তি নেই। কারণ ঘটনা অতর্কিতে ঘটেছে। ইচ্ছে করে ঘটাইনি। তাই আমাকে শক্ত ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। মিন্তু আমি এ জীবন দিয়ে কি করবো? আমায় আপনি শাস্তি দিন। কঠিনতম শাস্তি। যাতে মুক্তি পাই, শান্তি পাই।’
আমার মা ও অন্যরা কোন মন্তব্য করেননি। তাদের বলার কিছুই ছিল না। আমার মামা তরুণ ভদ্রলোককে ভাল ভাল কথা বলে বিদায় করলেন। ঘরের দিকে মুখ ফিরিয়ে মামা বারান্দায় উঠে এলেন। দীর্ঘ টানা বারান্দার একেবারে শেষ প্রান্তে একটি লেখা তার চোখে পড়লো। আগে যারা ছিলেন তাদের কেউ একজন ওই লেখাটি বেশ বড় হরফে লিখে দেয়ালে টাঙ্গিয়ে রেখেছিলেন। কেন যে নিয়ে যাননি সংগে করে, তা তারাই জানেন। লেখাটি কার হৃদয় নিঃসৃত বাণী তাও জানা যায়নি। ওখানে লেখা ছিলঃ


‘চিরকাল একি লীলা গো অনন্ত কল্লোল
ডান হাত হতে বাম হাতে লও
বাম হাত হতে ডানে
নিজ ধন তুমি নিজেই হরিয়া
কি যে কর কে বা জানে।।’


লেখাটি বারবার পড়লেন মামা। মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল। কেন এমন হয় পৃথিবীতে? মানুষের জীবন কতটুকু? তার মধ্যে অকালে ঝরে যাওয়া। তাও অপঘাতে? এই কষ্টের বোঝা এই পরিবার কিভাবে বইবে – কিভাবে সইবে? এই সীমাহীন বেদনার ভার কিভাবে লাঘব করা যাবে – কে জানে!
বেশী সুখ মানুষের কপালে সয় না। আমার মা তার পুড়ে যাওয়া সংসার গুটিয়ে গ্রামে তার পিত্রালয়ে ফিরে গেলেন। সবুজ বনানী ঘেরা গ্রামের সুশীতল ছায়াতলে বৃদ্ধ পিতামাতার স্নেহের আড়ালে তিনি স্বান্তনা খুঁজে পাবার প্রয়াস পান। আমাদের লালন পালনের ভার নানা নানিই গ্রহণ করেন।


আমার ভাইকে কিছুদিনের মধ্যে শহরে মামার বাসায় রেখে হাইস্কুলে ভর্তি করা হলো। পর্যায়ক্রমে আমিও আরো কয়েকবছর পর মক্তবের পাঠ শেষ করে শহরে চলে এলাম। শহরের লেখাপড়া গ্রামের চাইতে যথেষ্ট কঠিন। তবে কয়েক মাসের মধ্যেই আমাদের লেখাপড়া আর কঠিন মনে হলো না। কয়েক ক্লাস ওপরে এসে আমরা প্রথম সারিতে চলে এলাম। আমার মা এতদিনে সম্বিত ফিরে পেলেন। তিনি আমাদের দিকে ফিরে তাকালেন। আমাদের নিয়ে আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। আবার আশায় বুক বাঁধলেন।
যথাসময়ে আমি ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করায় ঢাকায় ইডেন কলেজে ভর্তি হলাম। এবার আমিও মামার বাসায়। মামী কিছুতেই হস্টেলে থাকতে দেবেন না। আমার ভাই মামার বাসায় থাকার দরুণ নানাজানের আর্থিক চাপ একটু কম হতো। এবার আমিও মামার বাসায় এসে হাজির। আমার ভাই ছাত্র ভাল ছিলেন। তাই রেজাল্টও ভাল হয়েছে। সেজন্য ইতিহাস বিভাগেই শিক্ষক নিয়োগ পেলেন। নানাজানের দায়িত্ব একটু কমলো। আমার ভাই আমার পড়াশুনার খরচের ভার নিলেন। আমার ভাইয়ের নাম ইসতিয়াক খান। বাবা তার নিজের নামের সাথে মিলিয়ে পুত্রের নামকরণ করেছিলেন।

 

আমরা দুই ভাই বোন এখন মামার বাসায়। মামার দুই ছেলে এক মেয়ে।আমরা সকলেই আপন ভাই বোনের মত। তখনকার দিনের মানুষরা আত্নীয় স্বজনদের প্রতিপালন করতেন। বিশেষ করে যারা শহরে বসবাস করতেন। গ্রামের আত্মীয়দের, এমনকি অনাত্মীয়দের ছেলেদেরকেও বাসায় রাখতেন। তাদের পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতেন। আজকে সে রকমটি কল্পনা করাই যায় না। গ্রামের একটি ছেলেকে বাসায় থাকতে দেয়ার কথা ভাবলে অনেকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে।
হতাশা আমার ভাল লাগে না। দুঃখ দুঃখ ভাব নিয়ে থাকা আমার একদম পছন্দ নয়। কারণ জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বিষণ্ণতাই আমাদের নিত্যসঙ্গী। সেইজন্য মনে মনে পণ করেছিলাম আনন্দে থাকবো। হাশিখুশী থাকব। আমি যেখানে থাকতাম আনন্দ থাকতো আমার সংগে সংগে। মামার বাড়িতে তাই আমিই ছিলাম সকলের ভাল লাগার উতস। সব কাজেও ছিলাম পটু। বাসায় যার যা দরকার – আমি সাহায্যের হাত বাড়াতাম। সেজন্য হয়তো বা মামী আমার ওপর খুব খুশী ছিলেন। নির্ভর করতেন তিনি আমার কাজের ওপর, কথার ওপর। তিনি একটু আরামপ্রিয় ছিলেন।একটু সাজগোজ পছন্দ করতেন। আমি তাকে সেসব সুযোগ করে দিতাম। বাড়ির প্রতিটি সদস্য আমার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে-বিশেষ করে মামীর ছেলেমেয়েরা। তারা আমার কথা খুব গুরুত্ব দেয় এবং আমারই আদর্শে অনুপ্রাণিত। বয়সে আমার অনেক ছোট হলেও তারাও বেশ সুন্দরভাবে বড় হতে লাগলো।
আমি এখন উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ব্রতী। ইতিমধ্যে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা দিয়ে অনেক জল প্রবাহিত হয়েছে। অনেক ঋতু দীর্ঘ সময় ধরে আবর্তিত হয়েছে। অনেক শীত , অনেক গ্রীষ্ম, অনেক বর্ষা আমাদের আমাদের জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। এক নিদারুণ সত্যকে বহন করে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। আমি কিন্তু হেরে যাওয়ার পাত্রী নই। সব কাজে আমার উতসাহ। মাকে সুখী করতে হবে। আমাদের সুখ দেখে মা শান্তি পাবেন।


আমার লেখাপড়ার শেষ অধ্যায়। ময়মনসিংহের মেয়েদের ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হলাম বি. টি. পড়ার জন্য; তাও শেষ হলো একদিন। এবার চাকরির জন্য দরখাস্ত করে চাকরি পেলাম। পোস্টিং হলো বিদ্যাময়ী স্কুলে। খুশীতে প্রাণ চঞ্চল হয়ে উঠলো। কারণ এই স্কুল আমার প্রাণের মতো প্রিয়। আমি এই স্কুলেরই ছাত্রী। ছাত্রী ছিলাম আগে- এখন টিচার হিসাবে কেমন লাগবে, তাই ভাবছি। মামার বাড়ি ছেড়ে এবার স্কুলেরই হস্টেলে টিচারদের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষে থাকার জায়গা পেলাম। আমার মাতামহ এতদিনে বার্ধক্যের ভারে নুয়ে পড়েছেন। বিশেষ কোন অসুখ বিসুখ ছিল না তাদের। তবু শরীরের কাঠামো জীর্ণ –শীর্ণ হলো। আমরা দুই ভাই বোন তাদের সামনেই প্রতিষ্ঠিত হলাম। আমার দাদা-দাদীও খুব আনন্দিত হলেন। তাদের জীবন প্রদীপ নিবু নিবু। হয়তো আমাদের দুই ভাই বোনের সাফল্য দেখার জন্য বেঁচে ছিলেন।চাকরিতে যোগদান করে দেখতে গেলাম তাদেরকে গ্রামে। প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করলেন। অতীতের কথা স্মরণ করে চোখের পানিতে বুক ভাসালেন। সেটি ছিল তাদের সংগে আমার শেষ দেখা।

প্রথম কর্ম জীবন আমার। বুঝে নিতে দেরী হলো না। একটা কথা প্রচলিত ছিল তখন। শিক্ষকতাই মেয়েদের জন্য উত্তম পেশা । সবচাইতে মর্যাদাসম্পন্ন, সম্মানের। ততদিনে শিক্ষকতায় মেয়েদের সংখ্যা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সকলের সহযোগীতা পেলাম। কাজও ভাল লাগলো।
এমন সময় একদিন সংবাদ এলো আমার দাদা এন্তেকাল করেছেন। শিক্ষিত, সৎ প্রতিষ্ঠিত এবং সকলের ভালবাসা পাওয়া একজন ব্যক্তিত্ব পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। একসময় তার জয়জয়কার ছিল। ইংরেজ আমলে পশ্চাদপদ মুসলমান সমাজে তার মত সুশিক্ষিত , চিন্তাশীল লোকের সংখ্যা খুব বেশী ছিল না। এর কয়েক মাস পরে আমার দাদীও পরকালের ডাক শুনতে পেলেন। তিনি পরম শান্তিতে ইহধাম ত্যাগ করলেন। একটি প্রজন্ম শেষ হয়ে গেল।

 
আমার চাকরী পাওয়ার পর আমার নানা-নানীও হঠাত অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাদের সব দায়িত্ব যেন শেষ। এবার তাদের ছুটি। হয়তোবা আমাদের দুই ভাইবোনের মানুষ হওয়া পর্যন্ত তারা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে নিজেদের চালু রেখেছিলেন। এতদিনের পথচলা শেষ। জীবনের শেষ স্টেশনে এসে বসে আছেন। গাড়ির অপেক্ষায়। যার যার গাড়ি এলেই উঠে চলে যাবেন।
আমার মায়ের অনুরোধে একবার আমরা সকলেই মামাদেরসহ বাড়ি গেলাম। খুব হৈচৈ। কারো কোন কাজ নেই। অফিস নেই, স্কুল নেই, কলেজ নেই। শুধু গল্প, ভাল ভাল খাওয়া আর আনন্দ করা। বৃদ্ধ নানা-নানী, মধ্যবয়সী মা, মামা, মামী, আমরা তরুণ কিশোর ভাই বোনেরা – সব একবয়েসী হয়ে গেলাম। মনে হলো, আমরা কেউ বড় নই, কেউ ছোট নই। সব সমান। এবারকার মতো আনন্দ আমরা জীবনে কোনদিন পাইনি। আমার মা, মামা-মামীদের ছেলেমানুষী দেখে আমরা অবাক হয়ে গেলাম। পরম আনন্দে কেটে গেল বেশকিছু দিন। এবার যার যার কাজে ফিরে যাওয়ার পালা।


সবাই শহরে চলে গেল। বাড়ি ভীষণ ভাবে নির্জন হয়ে গেল। ভাঙ্গলো মিলন মেলা। বাড়িটিকে ঘিরে ধরলো নীরবতা। মা সংসারের হাল ধরেছেন দীর্ঘদিন পর। আমার মাতামহ এবাদত বন্দেগিতে জীবন উতসর্গ করেছিলেন।আমরা বাড়ি হতে চলে আসার পর একদিন নামাযের সিজদায় তার হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যায়। তিনি আর উঠতে পারলেন না। তিনি এন্তেকাল করলেন। বয়স হয়েছিল তার যথেষ্ট। কিন্তু পিড়ীত ছিলেন না। খাওয়া দাওয়া, চলা ফেরা সবকিছু তিনি নিয়ম মতো করতেন। সেজন্যই বার্ধক্য ব্যাতীত তার আর কোন ব্যাধি ছিল না। তিনি ভাগ্যবান। কারো অনুগ্রহের পাত্র হতে চাননি। তার আত্মসম্মান জ্ঞান ছিল খুব প্রখর। আকস্মিক মৃত্যুতে তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হলো। মানুষ মরণশীল। গভীর সন্তাপের মাঝেও এভাবে সান্ত্বনা লাভের প্রয়াস পাই।
আমার সহকর্মীরা ভাল। শিক্ষিত পরিবেশ। সহকর্মীদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। মাঝে মাঝে যারা শহরে নিজের বাসায় থাকেন, তাদের ওখানে যাই। একদিন বিকেলে মনোয়ারা নামের এক শিক্ষিকার বাসায় বেড়াতে যাই। রাজশাহী থেকে এক ভদ্রলোক ময়মনসিংহ এসেছেন। তার সেখানে সরকারি কাজ ছিল। এই ছেলেটির নাম শিহাব আহমেদ। মনোয়ারার ভাই তার বন্ধু। বিশ্ববিদ্যালয়ে সতীর্থ ছিল। সেই পরিচয়ে শিহাব ওদের বাসায় উঠেছেন। বিকেলে চায়ের টেবিলে তার সঙ্গে পরিচয় হয়। স্বল্পভাষী ভদ্রলোক। তবুও অনেক প্রসংগে আলাপ হয়। মনে হলো বুদ্ধিমান। লক্ষ্য করলাম তার চিন্তাধারার সাথে আমার চিন্তার যথেষ্ট মিল রয়েছে।


ময়মনসিংহে কেটে গেল আমার কয়েক মাস। একদিন খবর পেলাম আমার মাতামহী গুরুতর অসুস্থ। মা বাড়িতে একা। আমরা সকলেই গ্রামে চলে গেলাম। ভাগ্য ভাল আমাদের যে, তার সংগে শেষ দেখা হলো। তিনি আমাদের চিনতে পারলেন। কথা বলার শক্তি ফুরিয়ে গিয়েছিল। তাই নীরবে চোখের জল ফেলে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। নানী পূন্যাত্মা ছিলেন। সারাজীবন তিনি মানুষের সেবা করেছেন। মানুষকে ভালবেসেছেন। তাই হয়তো তার রোগহীন শরীর জীর্ণ শীর্ণ হয়ে প্রাণ ধারণের ক্ষমতা হারায়। যে মাটি হতে তিনি সৃষ্টি হয়েছিলেন, সেই মাটিতেই তিনি ফিরে গেলেন।

 

এবার আমার মায়ের কথা ভাবতে হবে। নির্জন বাড়িতে তাকে একা রাখা ঠিক হবে না। কারণ মৃত্যু তার জীবনকে বারবার আন্দোলিত করেছে। সেই জন্য মাকে ঢাকায় আমার মামার বাসায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। মামা মামী একরকম জোর করেই মাকে নিয়ে এলেন। ধর্মীয় করণীয় সব অনুষ্ঠান শেষ করে মা ঢাকায় এলেন।


মামার এক দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাইকে নানাজান বাড়িতে রেখেছিলেন। তার নাম নুরু মিয়া। নানাজানের ফাই ফরমাশ খাটতো। সে ছিল নানাজানের ডান হাতের লাঠি। মা তাকে বিয়ে দিলেন। বাড়িঘরের, ক্ষেত খামারের সব দায়িত্ব নুরু মিয়েকে বুঝিয়ে দিলেন। নতুন বউ নিয়ে সে শুরু করল যাত্রা সেই বিরান বাড়িতে।


কোন ব্যক্তি যদি মারা যান তবে তার বিষয় সম্পত্তি, ধন দৌলত তার যথার্থ উত্তরাধিকারের হাতে পড়লো নাকি অন্য লোকের ভোগে লাগলো, তাতে তার কিছুই যায় আসে না। আসে যায় যতদিন তিনি জীবিত থাকেন।
মায়ের হলো গ্রাম থেকে শহরে প্রত্যাবর্তন। জীবন যে কত কক্ষপথে আবর্তিত হয়। দীর্ঘকাল গ্রাম্য পরিবশে বাস করে তিনি প্রকৃতির সংগে মিশে গিয়েছিলেন। বাড়ির দক্ষিণে আম, জাম, বকুল, পিয়ালের বিস্তৃত বাগান। বিশাল বাগানের চারপাশ ঘিরে আছে দীর্ঘ আনারসের সারি। যখন মৌসুম আসে শত শত আনারসের ফুল মাথা উঁচু করে বের হয়, সৃষ্টি হয় অপূর্ব দৃশ্যের। মনে পড়ে সেই কথাটি, ‘বাগান থেকে বেরুলো টিয়ে, সোনার টোপর মাথায় দিয়ে।’


বাড়ির উত্তর দিকে বাঁশ বাগান। মলয় হিল্লোলে তার পাতায় বেজে উঠে মর্মর ধ্বনি। এই কম্পনের মৃদু ঝংকারে যে আলাপন সৃষ্টি হয় তার সংগে সেখানকার মানুষের পরিচয় কতই না নিবিড়। ভোর না হতেই চেনা অচেনা পাখির মধুর কূজনে চারিদিক হয় মুখরিত। সে এক অনির্বচনীয় আনন্দ। তারপর  সোনার থালার মত সূর্যি মামার উদয়। কোমল আলোর পরশে মানুষ জেগে ওঠে, নিদ্রার মোহমুক্তি ঘটে। শহরে এসে মায়ের এই সময়টুকুর জন্য প্রাণ কেমন করে। খুব তার কষ্ট হয়। কিন্তু উপায় নেই। নিয়তির বিধান। তবে মাঝে মাঝে মা গ্রামে যান। চির পরিচিত গ্রাম, জন্মস্থান। আত্মার সংগে তার বন্ধন। শয়নে স্বপনে ঐ জগতেই থাকেন। শুধু জাগরণে তিনি শহরে-অন্য এক পরিবেশে। এটাই এখন বাস্তব।


।। তিন।।


সবুজ গ্রামখানি। দিগন্ত জোড়া ঢেউ খেলানো শস্যক্ষেত। কিন্তু সমীরণে শ্যামলা মায়ের সোনালী আঁচল খানি দুলে ওঠে। পেছনের ফেলে আসা সেই শান্তির নীড়ের কথা মা ভুলে যেতে পারেন না। তাকে ফিরে ফিরে সেখানে যেতে হয়। সেই বাড়ি, সেই ঘর, সেই আঙ্গিনা, দীর্ঘ পুকুর, বাগান, গাছ গাছালি, ক্ষেত খামার সব আছে। নেই শুধু প্রাণের মত প্রিয় মানুষগুলো । সেই সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা। প্রতিদিন ভেসে আসে সুমধুর আজানের ধ্বনি। মানুষ কোথায় যায়? তাদের স্বপ্নে গড়া, পরিশ্রমের ফসল – সব কিছু আছে। অথচ তারাই নেই! আমার নানা নানীর জীবদ্দশায় বাড়ি কেমন গমগম করতো। কত মানুষের পদচারণায় মুখরিত থাকতো এই প্রাংগন। কতজনার সুখে দুঃখে, সমস্যা সমাধানের জন্য আমার নানাজান সারাজীবন ব্যয় করেছেন, আজ তারা কেন নেই? কেমন করে নেই? এই বাড়িতে আজ অন্য বসতি, অন্যরকম কোলাহল!       


মামাদের দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই নুরু মিয়াকে গ্রামের বাড়ি ঘর, বিষয় সম্পত্তি সব কিছু দেখাশোনার ভার দেয়া হলো, যেহেতু  নুরু মিয়া বাল্যকাল হতেই সেই বাড়িতে অবস্থান করছিল। নানাজানের ফুট ফরমাশ খাটতো। বলতে গেলে সে ছিল নানাজানের বিশ্বস্ত অনুচর-সহচর। সেই জন্য নুরু মিয়ার এত সব বুঝে নিতে কোন অসুবিধে হয়নি।
প্রথম প্রথম আমার মা প্রায়ই গ্রামে যেতেন। কারণ তার সদ্য প্রয়াত মাতা পিতার স্মৃতি তাকে খুব পীড়া দিত। গ্রাম ছেড়ে আসার জন্য গ্লানি বোধ করতেন। তিনি ভাবতেন এটা অন্যায়। বাবা মায়ের অবর্তমানে বাড়ি বিরান করা ঠিক নয়। বংশধর তবে কিসের জন্য? ‘বংশে বাতি দেয়া’ – একটা  কথা প্রচলিত আছে দেশে। সেই জন্মের ভিটায় সন্ধ্যে দেবার কেউ রইলো না। আল্লাহর নাম উচ্চারণ করারও কেউ নাই। নুরু মিয়াই এখন ভরসা। অথচ এসব কর্তব্য পালন করতে হয় বংশধরদেরকেই।


আমার মা ওখানে থাকতে চেয়েছিলেন। ভাগ্য বিড়ম্বিত বিধ্বস্ত আমার মা। তাকে ঐ নিঃসংগ পরিবেশে ফেলে রাখা সমীচীন নয় বলেই একপ্রকার জোর করেই নিয়ে এসেছি মামার বাসায়। মামী অসাধারণ মেয়ে। অসাধারণ বলেই আমরা চিরকাল মামার পক্ষপুটে তার নিজের সন্তানের মত আশ্রয় পেয়েছি। না হলে আমাদের কত যে কষ্ট হত, তা হয়তো কল্পনাও করা যায় না আজ। আমরা পিতৃহীন। পিতৃহীন বলে আমাদের যে কষ্টের সম্মখীন হবার কথা ছিল, সেরকমটি হয়নি কেবল আমার বড়মামার জন্য। তিনি তার পরিবারের সকলকে খুশি রেখে আমাদেরকে তাদের সংগে সম্পৃক্ত করে নিয়েছিলেন। আমার পিতা জীবিত থাকলে তাঁর সঙ্গে যে সম্পর্ক গড়ে উঠতো, আমার সঙ্গে আমাদের সেই সম্পর্কই স্থাপিত হল। আমরা ভুলে গিয়েছিলাম যে আমরা মামাতো ফুফাতো ভাই বোন।        


নুরু মিয়ার নিজের জমিজমা ছিল  না বললেই চলে। ছিল কেবল বাড়ি ভিটা। ফসলী জমি বিক্রি করে শেষ করে গিয়েছিল তার বাবা।
বড় দুই ভাই আসাম গিয়ে বসতি গড়েছিল। আমার নানাজান তাদেরকে সেখানে মাত্র দশ টাকায় এক বিরাট এলাকা ক্রয় করে দিয়েছিলেন। এলাকা বলতে তখন বনজংগলে পূর্ণ অঞ্চল বোঝায়। বাঘ-হরিণ, অন্যান্য বন্য জীব জন্তুর বাসস্থান ছিল সেটা। জংগল পরিষ্কার করিয়ে নানাজান তাদেরকে একটি সুরক্ষিত ছোট বাড়ি তৈরি করে দিয়ে এসেছিলেন। নুরু মিয়ার ভাইরা কঠিন পরিশ্রম করে দিনের পর দিন গাছপালা কেটে সেখানে আবাদী জমি তৈরি করে চাষাবাদ আরম্ভ করে। তাদের ছেলেমেয়েরা ছিল এই অমানুষিক পরিশ্রমের সহযোগী। প্রায় দশ পনের বছর এই জঙ্গল পরিষ্কার করে তারা আসামে অনেক ফসলী জমির মালিক হয়। এত গাছপালা তারা কেটেছিল যে সেগুলো বিনে পয়সায়ও নেবার লোক ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে এসব কাঠ ঘড়-বাড়ি তৈরির কাজে ও জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আসবাব পত্রও তৈরি করে ওরা যথেষ্ট। বন-জংগল সাফ করতে গিয়ে তাদেরকে কত যে হিংস্র জন্তুর মোকাবেলা করতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।


নুরু মিয়ার ভাইরা মাঝে মাঝে নিজ গ্রামে বেড়াতে আসত। তাদের কাছে আসামের নিবিড় অরণ্য আবাদের গল্প শোনা যেত। গ্রামের লোকেরা গোল হয়ে তাদেরকে ঘিরে সন্ধ্যার পর সেই রোমাঞ্চকর কাহিনী শুনত। সে অরণ্য ছিল আদিম অরণ্য। সৃষ্টির শুরু থেকেই সেইসব বৃক্ষের জন্ম। সেসব গাছপালা এতই প্রাচীন যে বয়স নির্ণয় করা সাধ্যের বাইরে। সেই বন ছিল শ্বাপদ সংকুল। হিংস্র বাঘ, ভল্লুক, সিংহ, শৃগাল অন্যদিকে মৃগ, শাখামৃগ, ময়ূর সহ পাখ-পাখালির অন্ত ছিলনা। সেই বনানী কেবলমাত্র বৃক্ষলতা, জীবজন্তুর মেলা ছিল তা নয়, সেখানে ছিল নাম না জানা ফলের গাছ, মন মাতানো বন কুসুম, ঝোপঝাড়, ছন, ঘাস প্রাকৃতিক প্রাচুর্যের সমাহার। শুধু যেন মানুষই বেমানান সেখানে।


গল্প বলতে বলয়ে নুরু মিয়ার কৃষক ভাইয়েরাও কবি দার্শনিকের মত হয়ে যেত। বন জংগলের সাথে সংগ্রাম তাদের। ফসল উতপাদনেও প্রচুর পরিশ্রম। এভাবেই চলতে থাকে তাদের ঘরে বাইরে সংগ্রামী জীবন। নুরু মিয়ার ভাইরা একা নয়। এখানে আরো কয়েক ঘর পরিবার ছিল। তারা লাগালাগি ঘর তৈরি করে বসবাস করত যাতে কোন এক ব্যক্তির বাড়িতে বন্য জন্তু ঢুকে পড়তে না পারে। যখন বাঘ লোকালয় আক্রমণ করত তখন সংঘবদ্ধ ভাবে তারা তা প্রতিহত করত বল্লম এবং বাঁশের তৈরি বর্শা দিয়ে। ভোরে উঠে ওরা অনেক সময় দেখত বিরাট বিষধর সাপ উঠানে কুন্ডলি পাকিয়ে ফণা তুলে বসে বিশ্রাম করছে। একবার নাকি কয়েকজন কাঠুরিয়া বনের ভেতরে একটা বড় কাঠের গুঁড়িতে বসে কল্কিতে ধূমপান করছিল। ধূমপান শেষে কল্কির জ্বলন্ত অংগার সেই কাঠের গুঁড়িতে ঢেলে দেয়। কাঠের গুড়িটা যেন একটু নড়ে উঠে। ভয়ে কাঠুরিয়ার দল তফাতে সরে যায়। দেখে ওটা আরো নড়তে চড়তে শুরু করেছে। প্রকৃতপক্ষে সেটা কাঠ ছিল না। একটি অজগর সাপ লম্বা হয়ে শুয়ে ছিল।


আরেকবার ছেলেরা জংগল থেকে একটি হরিণশাবক ধরে নিয়ে আসে। সাঁঝের আঁধার নেমে আসার পর একটি গুনগুনিয়ে কান্নার করুণ শব্দ শোনা গেল, যেমন নতুন বউ শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে কাঁদে। ভুতের কথা স্মরণ করে সকলে ভয়ে শিউরে উঠলো। পরে দেখা গেল হরিণ শিশুটি খুব ছটফট করছে। তখন বাড়ির সকলে বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করল সেই মা হরিণটি নিজের জীবনের বিপদ তুচ্ছ করে বাচ্চার জন্য ছুটে এসেছে শত্রু শিবিরে। ছেলেরা উল্লসিত হয় এমন একটি শিকার হাতের মুঠোয় পেয়ে। হরিণটি আটক করার জন্য ফাঁদ পাতে। কিন্তু তাদের বাবার দয়া হয়। সে ছেলেদের নিরস্ত করে। মৃগ শিশুটিকে মুক্ত করে দেয়। শাবকটি তার মায়ের সংগে নিমেষেই বনপথে অদৃশ্য হয়। এরকম অনেক মজার গল্প নুরু মিয়ের ভাইয়েরা শুনিয়ে যায়।


আসামে গিয়ে তাদের অবস্থা ভাল হয়। স্বচ্ছল জীবনের অধিকারী হয়। পরবর্তীকালে তাদের বংশধরেরা লেখাপড়া শিখে শিক্ষিতের পেশাও গ্রহণ করে। নুরু মিয়ার অন্য ভাইয়েরা দিনমজুরের কাজ করে। তারা অলস। শ্রমবিমুখ। কিন্তু পরিশ্রম না করে যে সুখ পাওয়া যায় না, তারা তা জানে না। নুরু মিয়া শান্তশিষ্ট বলে আমরা তাকে পছন্দ করতাম। সেজন্য নানাজান তাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। সে বিশ্বাসী, পরিশ্রমী। কখনও কোন ক্ষতি করেনি। বরং ক্ষতি রোধ করার চেষ্টা করেছে। কখনো কল্পনা করেনি যে, সে একদিন এই ‘রাজবাড়ির’ মালিক হবে। সময়ের স্রোত তাকে কোথা হতে কোথায় নিয়ে এলো, আবার কোথায়ই বা নিয়ে যাবে!

 

।। চার।।


ছোটবেলায় ভূগোলের প্রথম পাঠ ছিল, ‘কয়েকটি ঘর লইয়া একটি বাড়ি হয়। কয়েকটি বাড়ি লইয়া একটি পাড়া হয়। কয়েকটি পাড়া লইয়া একটি গ্রাম হয়।’ বাড়ির সেই সংজ্ঞায় নানাজানের বাড়িতে অনেক ঘর ছিল। একটি বড় আটচালা, দুটি চৌচালা টিনের, ছনের ছাউনিতে রন্ধনশালা, ঢেঁকিশালা, খড়ির ঘর ছিল। মাঝখানে বিরাট উঠোন, নিকোনো বারো মাস, বর্ষাকাল বাদে। বাহির বাটিতে ছিল দুইদিকে বিরাট বারান্দাওয়ালা বৈঠকখানা, দহলিজ, দীঘি, গোয়ালঘর, গরুদের দিনের বেলায় বিশ্রামের জন্য খোলা চালাঘর। যেন এক এলাহী কারখানা। নুরু মিয়ে এখন এই এলাহী কারখানার মালিক।

 

আমার মাতামহের আটচালা ঘরখানি তালাবদ্ধ থাকে। মামারা বাড়িতে গিয়ে সেই ঘরে থাকতেন। নুরু মিয়া অন্য একটা চৌচালা ঘরে থাকে। প্রথম কয়েক বছর বেশ চলতে থাকলো আগের নিয়মেই। বর্গাদাররা ঠিকমতোই ফসল দিয়ে যেত। গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ, মাঠ ভরা সোনার ফসল। শুধু ঘর ভরা মানুষ নেই।


শহরের জীবন অন্যরকম। চাকুরীজীবী মামা। সময় বের করে গ্রামে যাওয়া ধীরে ধীরে হ্রাস পেল। সুতরাং মায়ের যাওয়া কমে গেল। তিনি তো একা একা গ্রামে যেতে পারেন না। বছরে অন্তত একবার যেতে হয় মামাকে ধান বিক্রি করার জন্য। পরবর্তীকালে বছরে একবার যাওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। ওদিকে নুরু মিয়ার সংসার বড় হতে থাকে। প্রায় প্রতি বছরই তার সংসারে একটি করে নতুন সদস্যের আগমন ঘটে। পাঁচ বছরে সে তিনটি সন্তানের জনক হয়। এই পাঁচবছরে আমার মাতামহের সংসারের নিয়মকানুন সব পালটে যায়। সেই সব সুধীজনরা তাদের নিয়ম, শৃংখলা, আদর্শ সব সংগে করে নিয়ে গিয়েছেন। এখনকার লোকদের এখনকার নিয়ম। নিয়ম না বলে অনিয়ম বললেই ভাল হয়। বর্গাদাররা নুরু মিয়ের শাসন মানতে চায় না। তারা চলে গেছে অন্য লোকের খামারে। পাঁচ বছরেই ‘রাজার বাড়ির’ জৌলুস, অভিজাত চেহারা মলিন হয়ে যায়। চারিদিকে জংগল, জংগলের স্তুপ জমির উর্বরতা হ্রাস, ফসলের ঘাটতি সব যেন ধ্বংসের দিকে। অনেকদিন পর বাড়ি গেলে ক্ষীয়মান চেহারাই চোখে পড়ে। নুরু মিয়া পরিশ্রমী। একা কুলিয়ে উঠতে পারেনা।


নানাজান বিরাট আরাম কেদারায় বসে গড়গড়ার নল মুখে নিয়ে তাম্বাকু দিয়ে তামাক খেতেন। তার হুকুম, তার শাসন, তার সাংসারিক বুদ্ধির সংগে কারো তুলনা চলে না। সুতরাং নুরু মিয়ার প্রাণান্ত। তাকে তো কেউ পাত্তাই দেয়না। বিষয় সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ এত সহজ কাজ নয়। তবুও নুরু মিয়াই সব দেখে।


এদিকে আমরা বড় হয়েছি। লেখাপড়া শিখেছি। চাকরি করছি। জীবনের উত্থান পতন আমাদের শহরে যেমন, গ্রামেও তেমন। তবে ওখানকার ধাঁচটা একটু অন্যরকম। নুরু মিয়ার সংসারের কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়ি ভরা ছেলেমেয়ে। সব ঘর ওরা দখন করেছে। তবুও জায়গা হচ্ছে না।


সেবার আমরা সকলেই গিয়েছিলাম গ্রীষ্মের ছুটিতে। ওদের থাকার অসুবিধা দেখে মা নুরু মিয়াকে নানাজানের আটচালা ঘরে থাকার অনুমতি দিলেন। কেবল দু’খানা বড় কামরা তালাবদ্ধ রইলো আমাদের জন্য, শহরের মেহমানদের জন্য। নুরু মিয়ার অবস্থা দেখে আমার মামা ধান বিক্রি করে টাকা নেয়ার জন্য গ্রামে আসা ছেড়ে দিলেন। এখানকার ফসলে নুরু মিয়ারই চলে না। ওর স্ত্রীও পরিশ্রমী মেয়ে-সংসারী, কিন্তু এত পুত্র কন্যার জন্ম দিয়ে সে নাজেহাল, পঞ্চাশ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত সন্তান উতপাদনের হাত হতে তার নিস্তার নেই। গ্রামাঞ্চলে সন্তান লালন পালনের তেমন বিশেষ কোন কাজ নেই। তাদের জন্য ভাত রান্না করাই প্রধান কাজ। অন্যান্য পরিচর্যা সবই প্রাকৃতিক। পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখা , কাপড় চোপড় পরানো, আদব কায়দা সেখানো-এসবের বালাই নেই। সেজন্য প্রায়ই অসুখ-বিসুখে তারা পটল তলে। যারা আয়ু নিয়ে আসে, তারা যমের চোখে ধুলো দিয়ে কোনরকমে বেঁচেবর্তে থাকে। দিগম্বর একপাল ছেলেমেয়ে। কোমরে একটা মোটা কালো সুতায় তাগা বাঁধা, একরাশ তাবিজ গলায় ঝুলছে। ওই তাবিজই তাদের রক্ষা কবচ। যমদূত যেন বেশী কায়দা করতে না পারে, সেজন্য এত তাবিজ তারা সংগ্রহ করে মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছ থেকে। তাতে ফল ভাল হয়। বেশীর ভাগ সন্তানই বেঁচে যায়। বাকীরা ঝরে পরে অকালেই। এভাবেই দিন যায়। নুরু মিয়া মাঝে মঝে শহরে আসে। মৌসুমের ফল, সবজি নিয়ে আসে। তারও বয়স বাড়ছে। সংসার বিশাল হচ্ছে। দায়িত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমস্যা জাল বিস্তার করছে। নুরু মিয়া সেই সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। কি শহরে, কি গ্রামে বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঝামেলাও বাড়ে। জীবন নদী কোন বাঁকে মোড় ঘুরে তা কেউ জানে না।


শেষ পর্যন্ত শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে নুরু মিয়ার বারোটি সন্তান জীবিত রইলো। ছয়টি পুত্র, ছয়টি কন্যা। প্রথম সন্তানটি তার পুত্র। নাম জনাব আলী। বড় পরিশ্রমী, পিতার মতো। চাষবাসের কাজ ছেলেবেলা থাকেই করে, মনোযোগ সহকারে। এই ছেলেই বলতে গেলে নুরু মিয়ার দক্ষিণ হস্তের লাঠি। পুত্রদের মধ্যে দ্বিতীয়টি লাঠিয়াল। পেশীশক্তির চর্চা করে। খুব সাহসী। যেখানে দাংগা-হাংগামা, সেখানেই তার দলের ডাক পড়ে। তবে একেবারে বখে যায়নি। অন্য সময়ে সে
‘গিরস্তির’ কাজও করে।

 

......... চলবে

© লেখক