শরীর ঘিরে যখন আলো ও অন্ধকার-চেতনা
তাড়িত স্বপ্ন ও বোধের দ্বান্দ্বিক টানাপোড়নে আত্মখন্ডিত
হই-তখন আত্মমেদের আলো জ্বেলে,
খানিক গলনে অন্যথা প্রতিফলনে অগ্নি ঢেলে দিই;
স্মৃতিহাড় পুড়িয়ে নির্মিত হয় কবিতার জরায়ুতে আশ্রয়ের
উপযোগী মনোবীজ,
কল্পভ্রুণ। এমন সব উপাদান কবিতার কল্পনায় কোনো গুহামুখ
থেকে গড়িয়ে নামে! সে গুহামুখ বিবিধ মিশ্রিত নির্মাণের আলো জড়িয়ে যেন
জোনাকী হয়ে ওঠে! জ্বলে,
আবার নিভে যায়। আলো যতখানি অন্ধকার চেনে,
অন্ধকার যতখানি আলোর পরিচয় জানে-আমরা কি ততখানি নিজেকে
জানি?
জানি না। বরঞ্চ,
তারও অধিক রিপু
তাড়নায় পশুবোধে মুখরিত হই। হই বহুখন্ডিত। খন্ডগুলো অংশ
হয়! খন্ডগুলো সমগ্র! কবিতার ঘ্রাণ শরীরে জড়িয়ে যেখানে ছুটে যেতে চাই,
যতদূরে-সেখানে আমার বোধের অনুবর্তী হতে-না-পাড়া
অ-পরিশ্রমী পাঠকের পঙ্গুত্ব তাড়িয়ে জীবনের-কবিতার-কল্পনার-উপলব্ধির
বাইরে ঠেলে দিতে চায়! সীমাবদ্ধতার কাঁটাতারের জর্জরিত,
অভিমানকে ফুলরেণু মনে করে মুখে-হৃৎকমলে-পদযুগলে মেখে
কবিতার বোবা চিৎকার শুনি,
যেখানে এখনকার একটি কবিতা জন্মেই পুনশ্চঃ মরে যায়। নষ্ট
কবিতার বিপরীতে অনিবার্য কবিতার পাঠক হওয়ার অন্ধ উগ্র তীব্র বাসনায়
উন্মুখ। কিন্তু,
কবিতা সেও সমকালের কিছুফেরা মানুষের মতো,
প্রেয়সীর মতো;
আমার কীর্তনখোলার মতন অধরা! শুধু প্রতিকৃতি দেখিয়ে
ঘুমিয়ে যায়। যে ঘুমের কুসুম ভেঙে একটি নতুন লেখা কবিতা নিয়ে উন্মাদনায়
ঘোরে ছুটে যাব একান্ত কোনো আড্ডায়। বিভোর হব। অথচ,
আগামীকালই সে বোধ হারিয়ে বিমর্ষ বেদনায় ভাঙচুর হব!
অজর-অমর;
সময়লীন!
কবিতায় কোনদিনও সামান্যতম দ্বিধা করিনি। হয়ত তাই বারবার ভেঙে যায়
নির্জনতার বিভৎসতা।
কাংখিত
আত্মছায়ার নেপথ্যে এই যে শব্দগহন কল্পকাম,
তাকে ক্রমশঃ গড়িয়ে এনেছে আত্মজীবন। মূর্ত থেকে
বিমূর্ততা-প্রতিমূর্ততাও ভাঙছে প্রতিনিয়ত। তখন হয়তো রাত্রিক্রোড়,
সমগ্রতীর-জীবনবাস্তবতার আড়ালে তার
ঈপ্সিতেরে
খুঁজে-ফেরা;
পেয়ে,
বা না-পেয়ে পুনশ্চঃযাত্রা। কবিতাকে কতটুকুই বা জাগিয়ে
তুলতে পারেন একজন আমৃত্যু নিভৃতচারী নিমগ্ন কবি?
কতখানি শব্দসঙ্গমে চুপিচুপি মন্থন করে নিতে পারেন
কবিতার অমরাবতী পুরী?
কবি অপরাপর ফেঁসে
যান চারদেয়ালের ঘেরাটোপে-তবুও বিবৃত করেন গল্প ফেলে প্রস্থানের
অমৃতকথন। তারপরও কি শেষ হয় শোণিত দিন-রাত্রির সমুজ্জ্বল
উপকথা?
বরঞ্চ,
সে
আরো মাংস-মজ্জা-মেদ-রক্ততাপ-জটিল গ্রন্থির বিন্যাস নিয়ে ফুঁসে ওঠেন এবং
এভাবেই কবিতার সঙ্গে নিভৃতে নির্জন পথের বাঁকে দেখা হয়। যদিও শরীরে
লাগেনি ক্ষয়শ্বাস।
কবির আত্মবিশ্বাস,
অহেতু যন্ত্রণা কি জীবনকে দলিত করার জন্য?
এতসব প্রশ্নঘূর্ণি এড়িয়ে আমিও বলি : অসংখ্য তারার রাত
ছিল কাল। তারার আলোর ন্যায় সত্যপথে আড়ষ্ট কোনো বোধ আমাকেও ছিঁড়ে ফেলে।
অন্যমুখী সন্ধ্যায় শব্দময় নিমজ্জনে আমারও যে হৃদয়তন্ত্রী ছিঁড়ে যায়!
কবি যেখানে বলেন সকল আচ্ছন্ন শান্ত
স্নিগ্ধতারে
নষ্ট করে ফেলছে-তবুও তো আজ মানুষের মাঝে রক্তাক্ত হচ্ছে আরো
যন্ত্রণাদায়ক বেদনাবোধ,
যার কোনো অস্তিমতা নেই। তখন তো কবিকে স্থির-স্থিরতর
বিষয় তাড়িত করে-যদিও সত্য সুদূর আচ্ছাদিত;
তবু দূরতরকালে পৌঁছতে হলে অনিঃশেষ ক্রান্তিবলয়ের সত্য
সূর্যের দিকে আমাদের ধাবমানতা জরুরী। আজ এতগুলো কৃষ্ণপক্ষ পার হয়েও,
আমাদের কুৎসিত কদর্যতা আবিষ্ট করে ফেলছে আমাদের মন,
অবশ হয়ে উঠছে আমাদের মেধা। তাই তো নতুন স্বরায়নের দাবী
নিয়ে ওস্কার জানাচ্ছে কবিতা ও তার সমুদ্রস্থানের ভাষা। যেখানে
কবিতাকল্পে-মহাজিজ্ঞাসার স্রোতমূলে কথারা ভষ্ম হয়ে বোধের পোষাক
পরিধানরত। ব্যক্তিবোধের মিস্টিক আলোছায়ার ঘেরাওয়ে কবিতাকে বিকেলের
ক্ষয়ে ভগ্ন,
দুষ্ট,
স্বল্পায়নের রূপ দিতে চায়;
কিন্তু প্রতিভাকে রূপান্তরের প্রক্রিয়া মনে হলে
অন্তকরণে মেধালগ্ন অঙ্কুর জন্ম হয় কবিতার-অন্তগূঢ় জীবনবোধের।
আমাদের কবিতাযাপনের যা-কিছু সুষম-উর্বর শুষে নিতে চায় সমকালীন
অস্থিরতা। আর,
চতুর্দিকে জেগে-ওঠা ভাঁড়,
পা হড়কে কিছু নগ্ন পায়ের চিহ্নরূপ দেখি। দেখি সাংকেতিক
প্রতিভাস। বিমূর্তায়নে,
কম্পমানতায় অনুভব করি : কবি এক দক্ষ কামার-যার হাপরের
দাহে নিদাঘ জ্বলে অগ্নিশ্বাস;
হয়ত এও একদিন পুড়িয়ে ছাই করে দেবে। নিছক আগুন ও মোমময়
শরীরের গলন নয়-কবি,
যার অস্থি ও মেদে জারিত
প্রত্ন
জীবনরস,
মেধা-মননের যৌথ প্রযোজনায় কোনো বিকল্প/তৃতীয় মঞ্চ দখলের
পাঁয়তারা নয়। বরঞ্চ,
এ এক বিভাজিত রূপায়ন যা কবিকে মিডিয়া-মুখরতায় সামিল হতে
দেয় না। মহাকাল এসে ডুবিয়ে দেয় এই শব্দভাসানের তরী। যেন প্রথার অনুকূলে
না যেয়ে,
কবিতার বাঁকে সূত্রসন্ধানে জ্বলে-পুড়ে খাক হোকে কবি! নয়তো,
আসুন দাহ করি আত্মকুশপুত্তলিকা...
পরাজয় মেনেই,
কবিকে লেখা শুরু করতে হয়। বোধের জঙ্গম যখন আর কবিকে নিস্তার দেয় না,
তখনই জন্ম হয় মুগ্ধায়িত কবিতার। জীবন যখন আত্মনিগ্রহের
নামান্তর-সেখানে কবিতাই একজন কবির প্রকৃত আশ্রয়। নির্জন হয়ে-ওঠার
প্রক্রিয়ায় কবি কি নিমগ্ন হন আত্মরতি তাড়নায়! তবু আবদ্ধতা ক্রিয়ান্বয়ী।
এমন আরকে ডুবে থেকে,
মহাপৃথিবীর যাবতীয় বোধ ও ভাষার সাথে আত্মাকে জাগরিত করে
নেবার ক্রমপর্যায়টি কবি একাকী-গোপনে সেরে নেন। তাই কবিতার রহস্যময়তা
চিরকালই অমীমাংসিত। কবি,
যিনি ভিড়ের বাইরে লিখে যান,
যা জীবনের বাইরে অন্য কিছু নয়;
স্বতঃস্ফূর্ত শারীরিক রচনার কথাবিন্যাস-ইন্দ্রিয় ও
প্রত্যক্ষ অনুভব এবং অপ্রত্যক্ষতারও চিরসুদূর কল্পনালোক।
আসলে কবিতা কেবল মায়ামুক্তি বা বন্ধনমুক্তি নয়;
বরঞ্চ মায়তাড়িত বিস্তারও। রিপু যার প্রধান মাধ্যম। তাই
তো কবিরা বীভৎস ক্ষত,
মাছি,
নোংরামি,
যোনির আলো-অন্ধকার কবিতায় নিয়ে আসতে চায়। কবিতার সঙ্গে
জুড়ে দিতে চায় সমকালে ও অনিবার্য চেতনতা।
তবুও কবিতাপাঠ শেষাবধি আত্মমগ্ন,
নব্য আধুনিকতার ধারণ ও পাঠকের মনোভঙ্গির উপর বর্তায় এবং
তা চরমভাবে অবাধ-এজন্যই কবিতাকে আত্মজীবনের ভাষা বলি।
তাহলে কি পুনরায় শুরু হবে শুদ্ধ-শুদ্ধতর কবিতার খোঁজ?
পাঠক শুদ্ধতর কবিতার খোঁজে তড়িঘড়ি চষে বেড়াবে,
এমন ঝোঁক-তীক্ষ্ণ
চাহিদা বা বাংলা কবিতার জনপ্রিয় ধারার
কবিতার এমন দুর্দশা নয়-তা মানি;
কিন্তু আমিও কি পাঠক হয়ে,
অন্তর্নিরিখে ভালো কবিতার সন্ধান করি না এ সময়ের
বিভিন্ন কাগজে,
পাণ্ডুলিপিতে,
পুস্তকে?
করি। কেননা জানি,
যা নতুনভাবে নৈঃশব্দ্যকে জাগিয়ে তুলতে পারে,
হয়ত তা-ই নতুন কবিতার মুখ। এভাবে কবিতার
নিবিড় পর্যটনেই কবিতাকে চিনতে চাই। এ ভাবনা কি খুবই আত্মগত। তা জেনে-অন্যথা,
না জেনেই আমি/আপনি নির্দ্বিধায় একটি বোধমুখর কবিতার
নিকটবর্তী হতে পারি...
তাহলে?
কবিতাপাঠে আমি কি চাই?
কোন আপেক্ষিক সত্যকে খুঁজে ফিরি?
সত্যিই কি কবিতায় কিছু খুঁজি?
কোনো সত্যবোধ বা ভাঙ্গনের নতুনতর আবিষ্কার?
কবিও যেমন পুড়ে-পীড়নে গোপনে তৈরী হন,
তেমনি সচেতন পাঠক্রমে তার অভ্যাস নির্মিত করে। মার্জিত
হয় রুচিবোধ;
আত্মবোধে মশগুল থাকে।
হয়ত,
আমাদের-তরুণদের কবিতা অনেকখানি ম্লেচ্ছ,
সংখ্যালঘু,
জৈবনিক যন্ত্রণাতাড়িত,
সাময়িক মুহূর্তযাপনের... কালের খাতায় অন্তত এমনই সব
অভিযোগ উঠছিল। হে অগ্রজবৃন্দ,
এসবই আমাদের কবিতার পীড়ন। আমরা চাই অনিবার্য কবিতা,
সে-কবিতাকে যদি সমালোচকরা
‘শুদ্ধ
কবিতা’
অভিহিত করেন তাহলে সায় রইলো। এই চিরকালীন প্রস্তুতিপর্বে,
আত্মনিয়োজিত হলে কবিতায় আসবে দ্যুতিকামিনী অক্ষয়তা। তবে
বিগত সময়খন্ডের উত্তাল দিনগুলির মতো আত্মজিজ্ঞাসাকে আত্মজিঘাংসায়
রূপান্তর কামনা করি না। জীবনলগ্নতার বয়ানে সামিল হবার পর,
যদি কবিতা অধিক ক্রিয়ান্বয়ী হতে চায়;
তবে তা পাক :
...নিরর্থকতা
>
অর্থকতা >
দ্ব্যার্থকতা >
বহুবাচনিকতা
>
অতিবাচনিকতা...
এভাবেই কি কবিতা পরস্পর সম্পকসূত্রের বিনুনি গাঁথে?
হয়ত,
হয়ত নয়। কিন্তু কবিতা পাঠকের মননজাত এক অনায়াস স্পষ্ট
দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আস্বাদনের কল্পনাসৃষ্টি ও বোধরস জন্মায়। যা হতে তৈরী
হয় বাচনিকতা-প্রতিবাচনিকতার। এবং বহুরৈখিকতার নীরিক্ষণগুলো দ্রুত চিনে
নেবার প্রয়াস পাই। কবিতার সন্ধিস্থলে না ঘুরে কবিতার প্রতি পাঠকের
মনোযোগ ঘোরানোর অতিরিক্ত দাবী কবিতার কখনোর ছিল না। অথচ,
আমাদের লিখিয়েরা এই নষ্ট সময়বৃত্তে এমন পাঠশালায়ই
অন্তর্ভুক্ত। তবুও এর বাইরে কেউ কেউ!
কবিতাকে বোধচারিতার দিকে ঠেলে দিয়ে,
এইসব পরিষদ-মঞ্চ-সভা ভঙ্গ করে হঠাৎ কবিতায় জনমানুষের
অভিজ্ঞতায় লালিত হয়ে,
অথবা নিভৃতে নির্জন কুহকের অনুসরণ করতে পারেন এখনকার
কবি। এক্ষেত্রে আমরা এতদিন যে নির্জন কবিতার কথা বলেছি,
হয়ত তা বাঁক নিতে পারতো অধিকতর নির্জনতায়।
বহুবর্গীয়করণে। তা আর হলো কৈ! কবিতা লিখিত হলো অনেক
লিখনকৌশল-চাতুর্যচক্রের সম্মিলনে। কবিতার যতখানি আড়াল থাকার কথা
ছিল-নিঃশব্দতায়,
কবিরও;
তা ছিঁড়ে কবিতার-কবির নগ্ন মিডিয়া প্রচারণা একজন প্রকৃত
কবিকে গহন একাকীত্বে তলিয়ে ফেলে। তার সন্ধ্যা-রাত্রিগুলো কেবলই
অপ্রাপ্তি নিয়ে ঘরে ফেলে। সে অপ্রাপ্তি শব্দের-কবিতার শক্তির;
নতুন কল্পনা মনীষার,
নতুন স্বপ্নের উন্মেষনা-ঘটার। এখনকার কবির যন্ত্রণা
পীড়ন তো অধিক। তাকে জীবন-অনুষ্ঠানের যাবতীয় নারকীয় কর্মযজ্ঞের পাশাপাশি
আত্মবোধকে দূর বাতিঘরের আলোকশিখার মতো জ্বেলে-জিইয়ে রাখতে হয়। অধিকন্তু
এগিয়ে যেতে,
আত্মপীড়নকে ক্ষয়ের আদলে জেনে,
সেই অনিঃশেষ ধ্বনিময়তা,
নিখাদ বোধকামীতার উপাদান ছড়ানো নিরাময় কবিতার খুব
কাছাকাছি হব আমরা একদিন,
খুব শীঘ্রই-এ কথা নিশ্চয়ই বলতে পারি। তবে কবে?
এই প্রশ্নের উত্তর সেদিনই পাব যেদিন নির্দ্বিধায় আমরা
কবিতার আবেদনকে নিবিড় অভিধা দিতে পারব,
কবিতার মায়াবী অঞ্চলে অকৃত্রিম বোধ জাগরণে মৃদু শ্বাস
নিতে পারবো;
যখন
মনে হবে এ হাওয়া খোলা ময়দানের। সমিতি-সভার চেয়ারগুলো পর্দার পেছনে
সরিয়ে রাখুন! আমরা কবিতা নিয়ে উৎক্ষিপ্ত হতে চাই জীবনের যত্রতত্র ভীড়ে;
গোপনে অন্তত একবার/পুনর্বার নিজ জিজ্ঞাসার ভেতর,
সাময়িকতা ও সীমানার বাইরে।