রাধাভাব

 

নির্মল হালদার

 

এক শীর্ণ নদীর পারে আমার এক বন্ধু থাকে। বন্ধু কী, চিরসখা বলাই বোধহয় শ্রেষ্ঠ কাজ হবে। কেননা, চিরসখার জন্যই যে মন করে আছাড়ি-পিছাড়ি।

 

তার মন আমার মতো কাঁদুক, আমি চাই না, চাইলেও কাঁদবে না সে। সে যে চিরসখা যার বাঁধনে বিরহ।

বিরহ বিষও। আজ বিষের থালা উপভোগ করছি। এই উপভোগই আমাকে ভোগবিলাস থেকে দূরে রাখে। তাই, আমি আছি এখনও আরাধনায়।

 

যদি ফুল ফোটো, যদি সৌরভ এসে আকুল করে চরাচর, তাই ধ্যান, তাই কান্না, তাই হাহাকার। আর্তি এবং না-পাওয়ার বেদনা।

 

মূর্তি আছে কিন্তু অধরা। আর অধরা মাধুরীকে ছন্দোবন্ধনে রাখা কি যে কঠিন। সারা জীবনের মন দিলেও  ধরে  রাখতে পারব না।

 

কি রাখতে পারি, কি ধরে রাখতে পারি এই এক জীবনে, কিছুই না। নিজেকেও যে ধরে রাখতে পারি না। এই ধরিত্রী, প্রকৃতি-সমস্তই থেকে যাবে, যেমন থাকার। শুধু নিজে থাকব না।

চিরসখা থাকবে আমার। আমি চলে গেলেও আমার আঞ্জলি থাকবে। সে যদি ছুঁয়ে না দেখে তুব অঞ্চলিতে মাছি পড়বে না। অঞ্চলিও যে এক একটি কবিতা।

 

চিরসখাকে লিখন বলেও ডাকতে পারি। সে যখন আবছা আঁধার নদীপায়ে হেঁটে যায়, সে যখন বইয়ে মুখ গুজে থাকে, সে যখন তাকিয়ে থাকে দূরে কোথাও, তখন আমি ডেকেছি, লিখন... লিখন। তোর কপালে যে ঘামের বিন্দু, আয় আমি শুষে নিয়ে তোকে দেখাবো, আমার পিপাসা।

 

পিপাসা মিটবে না বলেই তোকে কাছে পেলাম, তুই কথারূপ, তুই অন্বয়। তুই শ্রী, তুই আম্রপল্লব। তুই পলাশের রক্তিম। তুই শূন্য মাঠের বেদনা। তুই খেজুর গাছের রসের আবেগ। তুই থৈ থৈ দুঃখ আনন্দ আলো।

আমি খুবই সাধারন পরিবারের এক সন্তান, বাবা ছিলেন চালের দোকানি। তার ছেলে কি সাহস যে কবিতা লেখে, ধ্যানে মগ্ন থাকে, চাঁদকে চাঁদ না বলে ফাঁদ বলে। তাকে তো সইতেই হবে বেদনাভার, বিরহ।

 

বিরহের পাত্র থেকে উছলে-ওঠা কনাগুলি ধানের কণা নয়, তা কেবল বেদনা।

 

ধান ফলানোর মন্ত্র আমি জানি না, চাষবাস জানি না, শুধু কাব্যচর্চা। শুধু প্রেম। ভালোবাসা ভালোবাসা করে শীর্ণতার দিকে যাওয়া। কঠিন ও জটিল সময়ের উপযুক্ত আমি না, আমাকে পেতেই হবে বঞ্চনা, অপমান, মুখ-ফিরিয়ে-যাওয়া উপেক্ষা।

 

অপেক্ষা কারো নাম হলেও উপেক্ষা কারো নাম নয়। আমি যে চাই না, উপেক্ষার উপেক্ষা। কেউ-ই চায় না। একটি পোকাও দাবি করে, প্রেম।

প্রেম নিঃস্ব করে। এই নিঃস্বতাই সম্পদ। গৌরবও।

 

এসো গৌরব, আমাকে নাও।

 

চিরসখার প্রতি আমার যে মোহ, মোহের বিস্তার, তা-ই আমার কবিতাও। আমার বাঁচার রসদও। চিরসখার নিষ্ঠুরতাও আমার সময়কে কেড়ে নেয়।  আমি দেখি, ফুল ফুটেছে, সূর্য উঠেছে, ডাকছে পাখিরাও। এই সঙ্গে আমা রক্তের গতিও অব্যাহত । আমি সাজাতে থাকি আমার অঞ্জলি।

 

পুষ্প আছে মনে, মনকে সাজাই নানা রঙে নানা কান্নায় । রঙের সঙ্গে অশ্রুজল না মিশলে রঙও যে ফিকে হয়ে যায়।

 

আমি ম্লান করবো না আমার চিরসখাকে আমার আহাদ। এসো আহ্লাদ যে- কোনো মুহূর্তে, আমার চারদিকেই দুয়ার।

 

দূরত্ব নেই কোথাও, তবু নিকটে যাবার বেলা বয়ে যায় যাদের তারা অভাগা। আমিও অভাগা বলে দূরকে নিকট করে উঠতে পারছি না আজও। অস্থিরতা বেড়েই চলে।

 

তবে কী খুঁত আছে সাধনায়?

 

প্রশ্ন থাকে উত্তর নেই সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তে কেবলই প্রশ্নেরা ঘুড়ে বেড়ায়। আর আমি মাঠপ্রান্তরে ঘুরে বেড়াই, যদি খুঁজে পাই তাকে। সে-ইতো উত্তর। তার ভেতরেই একটা পথ, সারাদিন হাওয়া বয়, পাতা ওড়ে। সুর ভেসে বেড়ায়।

 

ও আমার রোগা কালো বাঁশি, তোমার ভেতরে শুয়ে থাকার সাধ পূর্ণ না হলে আমি যে পুড়তে পুড়তেও পুড়বো না।

 

© অর্কিড ৪~ সম্পাদকঃ সৈয়দ আফসার