নারীকুলে রাধারমণ
মোস্তাক আহমাদ দীন
১.
ভাবুক ও রসরাজ
হিসেবে রাধারমণের স্থান যে-শিখরে,
তাতে,
তাকে নিয়ে যতটা মূল্যাঙ্কন হওয়া উচিৎ,
এতদিন তা না-হলেও এখন যে হচ্ছে,
তা খুবই আশাব্যঞ্জক। এই মূল্যাঙ্কনকারীদের মধ্যে
প্রায়-সকলেই রাধারমণের পদ-অন্তরিত বৈষ্ণব রসের দিকটাকে ফুটিয়ে তুলতে
ব্যগ্র। এমন নয় যে তার পদে সেই রস নেই;
বরং আমাদের তো এ-ও অজানা নয়- তিনি দীক্ষা নিয়েছেন
বৈষ্ণব রঘুনাথের কাছে;
নলুয়ার হাওর-সংলগ্ন তাঁর আশ্রম স্থাপনের ব্যাপারটিও তো
তারই প্রমাণবহ। আমাদের অনুযোগ/আপত্তি সেই জায়গায় যেখানে আলোচকেরা
তাঁদের লক্ষ্য মূর্ত করতে গিয়ে পদকারকে তাঁর সত্তার মানব-অনুভূতিগত দিক
থেকে খারিজ করে দেন;
এবং তা কখনও এমন পর্যায়ে পৌঁছায়-আলোচক,
পদকারকে তত্ত্বলীন করে দিয়ে তাঁকে অতিমানবের স্তরে নিয়ে
যেতেও কুণ্ঠা বোধ করে না। তাঁরা ভাবেন- প্রেমপ্রকাশের এই যা কিছু-সে
রাধাই হোক অথবা কৃষ্ণ-সবসময়ই রূপক;-আর
গোলটা এখানেই। অথচ তাঁদেরও অজানা থাকবার কথা নয়-সোনার হাতের কাঁকন কে
কার অলঙ্কার-এরকম উক্তির মীমাংসায় যেতে হলে এখন আর আদি
অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে চাইবেন না পণ্ডিতেরা;
বরং সৌন্দর্য্যই হোক সত্যই হোক-তার মর্মে পৌঁছাতে হলে,
বাস্তব-রূপক-উপমান-উপমেয়সহ একযোগে না গেলে সে-যাত্রা
পূর্ণ হয় না;
কারণ,
রূপকে ছড়িয়ে থাকে পদকারের জীবনাভিজ্ঞতারই চিহ্ন-ফলে,
তাকে ছাড়া মূল্যাঙ্কনটা যে একমুখী হয়ে পড়বে,
এ আর আশ্চর্য কী। দান্তে কবে তাঁর একটি চিঠিতে দি
ডিভাইন কমেডি বিষয়ে লিখেছিলেন-‘এ
কথা বোঝা উচিৎ এই রচনার অর্থ কেবল একরকম নয়;
বরং এর অনেকগুলি অর্থ রয়েছে,
প্রথম অর্থ সঞ্চারিত হয় অক্ষর-শব্দ ভিত্তি করে আর তার
পরের অর্থ নির্ধারিত হয় অক্ষর-শব্দের তাৎপর্য অনুযায়ী;
প্রথমটিকে যদি বলি অভিধাত্মক তাহলে দ্বিতীয়টিকে বলে
রূপকাশ্রিত...সম্পূর্ণ গ্রন্থটির বিষয়,
অভিধাত্মক অর্থ ধরলে বেশ শুদ্ধ আর সরল-তা হলো
মৃত্যুপরবর্তী কালের অবস্থা। ...যদি রূপকের দৃষ্টিকোণ থেকে এ রচনার
ব্যাখ্যা করা হয় তাহলে এর বিষয়-মানুষ,
যে তার স্বাধীন চেতনার অনুশীলনের
ত্রুটি-নির্ভুলতা
অনুযায়ী বিচারের নিক্তিতে শাস্তি বা পুরস্কার পায়। দান্তে তাঁর
ধ্রুপদী
মহাকাব্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে তার একাধিক অর্থগত ব্যঞ্জনার মধ্যে
রূপকাশ্রিত অর্থের যে-সম্ভাবনার কথাটুকু বললেন তা এখনকার মূল্যায়নের
ক্ষেত্রে আরও অধিক প্রাসঙ্গিক। কারণ আমরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের
ইতিহাস পাঠ করে এসে দেখছি,
এই রূপকটাই কীভাবে হয়ে উঠছে ইতিহাসের অবলম্বন। আজকের
সাবলটার্ন স্টাডিজ-এ রাজা-রাজড়ার বাইরের যে ইতিহাস-অনুসন্ধান চলে,
সেই প্রান্তপৃথিবীর মধ্যে সেই তত্ত্ব/রস/লক্ষ্য অভিমুখী
বাস্তবের রূপকাশ্রিত বিষয়টুকুর অর্ন্তভুক্তিটাও জরুরি;
কারণ,
এই রূপকের মধ্যে যে-জীবন,
যে-অনুভবগুলো স্পন্দমান,
তার পরিচয় তো আমরা নিরন্তরই পেয়ে থাকি। আজ রাধারমণের
পদের রূপকাশ্রিত বাস্তবের দিকটাকে জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে না-দেখলে
সে-দেখাটাকে খন্ডিত দর্শন বললে তাকে অযৌক্তিক উক্তি বলা যাবে না
নিশ্চয়ই।
২.
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-উক্ত রাধাকৃষ্ণ লীলার পরবর্তী পর্যায়ে কৃষ্ণ যখন
মথুরায় তখনকার রাধার যে-অনুভব,
রাধারমণের অনেক গান সেই অনুভবেরই
গান;
এই
অনুভব বিরহের;-তাতে
কখনও-কখনও অভিমানের সুর বাজলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আকুতিটাই ফুটে ওঠে;
তাই বলে এ কিছুতেই বলা যাবে না-তাঁর গানে কৃষ্ণ-অনুভব
একেবারেই
দুর্লভ।
কথিত আছে-এই গানগুলো গাইবার সময় দিব্যোন্মাদ হয়ে যেতেন রাধারমণ-এ
নিশ্চয়ই রস-অভিভুতিরই পরিচায়ক;
আমাদের আগ্রহ রাধা-অনুভব-এর সেই গানগুলোর দিকে যেখানে
রাধারমণ শুধু বৈষ্ণব রসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন না,
বরং তা চিরায়িত বাঙ্গালি নারীর অনুভবকেই ধারণ করে: এই
অনুভব কখনও বেদনার,
কখনও বিরহের,
আবারও কখনও তা স/নী-রব দ্রোহেরও বটে;
-কথিত
দিব্যোন্মদনা সত্য হলে এই পরিগ্রহণ কিছুটা বিষ্ময়েরই ঠেকবে;
তবে এ-কথা ঠিক-পরিগ্রহণটা সত্য;
এবং এই সত্যতা যে স্বকপোলকল্পিত নয়,
তাঁর নারীভাবনার গানগুলোর মধ্যে মূর্ত হবে অবশ্যই,
এ-ছাড়াও এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অনেকের অভিজ্ঞতা সম্পৃক্ত
ব্যাপারও:- যেমন বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত রাধারমণ-গীতিকা সম্পাদনা
করতে গিয়ে শ্রীনন্দলাল শর্মা তাঁর ভূমিকায় জানাচ্ছেন : কৈশরের
দিনগুলোতে নিজবাড়িতে প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে রাধারমণের গান
বিভিন্ন পালাবপার্বণে শুনতাম। তার গানের বাণী ও সুর আমার কিশোর মনকে
আন্দোলিত করতো। গ্রামের বসন্তরাম মালাকার (প্রয়াত) আমাদের বাড়িতে আসলে
আমার ফরমায়েশ মতো রাধারমণ গেয়ে শুনাতেন। ধামাইল নৃত্যে সম্মিলিত
নারীকণ্ঠে রাধারমণের গান সম্মোহন সৃষ্টি করতো। নন্দলাল বাবুর যে কৈশোরক
অভিজ্ঞতা তা আরও অনেকেরই আকবার কথা,
বিশেষত যারা রাধারমণের পড়শি তাদের অভিজ্ঞতা যে আরও
প্রবল ও ঘনিষ্ঠ হবে,
তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই;
এখনকার কথা জানি না,
এই সত্তর-আশির দশকেও যারা ওই অঞ্চলে শৈশব-কৈশোর
কাটিয়েছেন তাঁরা দেখেছেন-হিন্দু মহিলারা ধর্মীয় কারণে গান গাইতেন ঠিকই,
এর বাইরেও হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মহিলারা
ব্যক্তিগত দুঃখ,
বিরহ এবং দুর্দশাজড়িত নানা বেদনায় গেয়ে উঠতেন রাধারমণের
গান। এর কারণ কী?
...রস-সঞ্চারণ
প্রক্রিয়ার সমান্তরালে তাঁর গানে এমন কি বিষয় ঢুকে পড়েছে যে এরা একাত্ম
হয়ে পড়তেন?
সমাজে নারীর যে-অবস্থান-নানা প্রক্রিয়ায় বিশেষ করে ধর্মের বাইরের
যে-দিকটার উপর ভিত্তি করে বঞ্চনা চলে,
তারই রূপকায়ত বাস্তবটুকু ধারণ করে বলেই যে এই একাত্মতার
ব্যাপারটি ঘটে,
তাতে সন্দেহ কিছু নেই।
৩.
নারীদের বিষয়ে মনু বলেছেন: পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্ত্তা রক্ষতি
যৌবনে/রক্ষতি স্থবিরে পুত্রা স্ত্রী স্বাতন্ত্র্য মর্হতি॥ (নবম অধ্যায়
শ্লোক ৩)... অর্থাৎ কুমারী অবস্থায় পিতা রক্ষা করবে,
যৌবনে রক্ষা করবে স্বামী,
বার্ধক্যে রক্ষা করবে পুত্র,
স্ত্রীদের কখনোই স্বাতন্ত্র্য দেওয়া যাবে না। মনুর
শ্লোকগুলির রচনাকাল-নির্ণয়ের দুরূহতা স্বীকার করেও পণ্ডিত মানে অনুমান
করছেন,
এগুলোর বিকাশ ঘটেছে খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
এরপর কয়েকটি শতক চলে গেল। রাধারমণ যখন তার গানে এই শ্লোক নিয়ে আসবেন
তখনও কি মনুশ্লোক-উক্ত এই ধারণার পরিবর্তন হয়েছে?
রাধারমণ যে-সমাজে বেড়ে উঠেছেন সেখানে নানা অনাচার রোধের
জন্যে নারীর স্বাতন্ত্র্য লোপ করার ক্ষেত্রে একটা স/অ-চেতন মানসিকতা তো
ছিলই,
কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া নারীরাও তো ততোটা কুণ্ঠিত ছিলেন বলে মনে হয় না।
রাধারমণ জন্মেছেন ১৮৩৪ সালে,
ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স তখন চৌদ্দ;
এরপর ঈশ্বরচন্দ্রের চেষ্টায় ১৮৫৫ সালে বিধবা বিবাহ আইন
বলবৎ হবে ঠিকই,
কিন্তু তার সহগামীর সংখ্যা তখনো থেকে যাবে একেবারেই
হাতে-গোনা। ওই সময় সোমপ্রকাশ নামক সাময়িক পত্রটিতে প্রখ্যাত ব্যক্তি
দ্বারকানাথ মিত্রকে অভিযুক্ত করে ছয়জন বিধবা মহিলা তাঁদের পত্রে লিখেন
: ‘বাবুর
স্ত্রীবিয়োগ হইলে দুইবার বিবাহ করিলেন ছয়মাস অতীত হইল না। জজবাবুর
সন্তান-সন্তুতি বর্তমান। আমরা যে আদৌ পতি কেমন তাহা জানিলাম না। বাবু
কি আমাদের দুঃখ একবারও অনুভব করিয়া দেখিলেন না?
কিন্তু এ তো বিশেষ ছয়জন বিধবার আকুতি মাত্র,
আরও কেউ-কেউ এই দুঃখ উপলব্ধি করেছেন ঠিকই কিন্তু তারা
তা প্রকাশের ভয়/সংস্কার কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এমন অবস্থায় বিদ্যাসাগর
বিধবা বিবাহ আইন বাস্তবায়িত
করলেন ঠিকই কিন্তু সমাজে তার প্রভাব কতটুকু পড়েছিল
সে-বিষয়ে এন্তার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা যায়। আমরা সেদিকে না গিয়ে শেষ
বয়সে একটি চিঠিতে বিদ্যাসাগর যে-মন্তব্যটি করেছিলেন তা পাঠ করলেই ওই
সময়টাকে মোটামুটি বুঝে-উঠতে পারব। তিনি লিখেছেন-আমাদের দেশের লোক এত
অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূর্ব্বে জানিলে আমি কখনই বিধবাবিবাহ বিষয়ে
হস্তক্ষেপ করিতাম না। তৎকালে সকলে যেরূপ উৎসাহ প্রদান করিয়াছিলেন
তাহাতেই আমি সাহস করিয়া এ বিষয়ে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম নতুবা বিবাহ ও আইন
প্রচার পর্যন্ত করিয়া ক্ষান্ত থাকিতাম। দেশহিতৈষী সৎকর্মোৎসাহী
মহাশয়দিগের বাক্যে বিশ্বাস করিয়া ধনেপ্রাণে মারা পড়িলাম।’
দেশহিতৈষী সৎকর্মোৎসাহী-এই দুটি বিশেষণের অধিকারী কারা,
যাদের নিয়ে বিদ্যাসাগর সক্ষোভ শ্লেষোক্তি করতে বাধ্য
হয়েছিলেন?
বিনয় ঘোষের মতে,
এরা হলেন সেই মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণী,
বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কার শিক্ষাসংস্কার যাদের মধ্যে
সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। বিনয় ঘোষের মার্কসীয় বীক্ষণের প্রতি কারো-কারো
ভিন্নমত থেকে যেতে পারে কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্রের সংস্কৃতি যে অন্তেবাসীদের
নিকট গিয়ে পৌঁছাতে পারেনি,
তা তো ভুল নয়।
রাধারমণ এরকমই এক প্রান্তপাড়ার অধিবাসী। যেখানে বিদ্যাসাগরের সমাজ ও
শিক্ষা-সংস্কারের প্রভাব গিয়ে পৌঁছাবার কথা না,
সেখানে একজন লোকায়ত রাধারমণের গান পৌঁছাতে পারে ঠিকই,
কারণ রাধারমণ দেহ-মনে সেই অঞ্চলেরই বাসিন্দা।
তত্ত্বের
আবরণ থাকলেও তার গান এমনভাবে সেখানকার বিষয় ধারণ করে,
যে-কারো মনে হতে পারে তিনি অন্যের,
বিশেষ করে রাধা/নারীভাব-বাস্তব অর্থে তিনি নিজেও বুঝি
যাপন করে চলেন। তাই তাঁর গানে রাধাকে কখনো বিদ্রোহী,
কখনো বিরহী,
আবার কখনো অতিশয়
সমর্পিতপ্রাণাও
দেখা যায়। তাঁর গান থেকে নজির তুলে দেওয়া যেতে পারে-
আমার নারীকুলে জন্ম কেন দিলায় রে দারুণ বিধি
নারীকুলে জন্ম দিয়া ঘটাইলায়
দুগর্তি
রে।
শিশুকালে পিতার অধীন,
যৌবনেতে স্বামীর অধীন রে
ওরে বৃদ্ধকালে পুত্রের অধীন আমারে বানাইলায় রে।
যদি আমি পুরুষ হইতাম মোহন বাঁশি বাজাইতাম রে
কত নারীর মন ভুলাইতাম বাজাইয়া মুরলী রে।
ভাইরে রাধারমণ বলে নারীজনম যায় বিফলে রে
না নাগিল সাধের জনম বন্ধুয়ার সেবায় রে।
যারা রাধরমণের অঞ্চলের অধিবাসী তারা জানেন এটি তাঁর বিখ্যাত একটি গান।
কিন্তু বিষ্ময়ের বিষয় এই গানটি অনেক প্রধান সঙ্কলনগুলোতে নেই। এমনিতে
বিভিন্ন আসরে গানটি তো গাওয়া হয়ই তবে সাধারণত ঘরোয়া (মেয়েলি) আসরে এটি
উপভোগ্য হয়ে ওঠে বেশি। এর কারণটি উপরে আলোচিত। গানটির ধুয়াপদের প্রথম
পঙক্তিটি প্রশ্নের মতো শুরু হয়ে দ্বিতীয় পঙক্তিটিতে এসে অভিযোগের রূপ
পায়। এই অভিযোগটি
কিসের,
তা আলোচনা করার আগে নারীকুলে-জন্ম-হওয়ায় কী ঘটেছে,
তা দেখা যেতে পারে;
এর জন্যে তাকে শিশুকালে পিতার,
যৌবনে স্বামীর এবং বৃদ্ধকালে পুত্রের অধীন থাকতে হলো।
নারীকে এরূপে রাখবার বিধান মনুর বেঁধে-দেওয়া;
রাধারমণ যখন রাধার মুখ দিয়ে এই কথাগুলো বলান/বলেন,
তখন মনে হয় এই বিধানের তার শ্রদ্ধা নেই। প্রথম অন্তরায়
দ্বিতীয় পঙক্তিটিতে
‘বানাইলায়’
ক্রিয়াপদটি বেশ আক্ষেপ ধারণ করছে,
আর পুরো অন্তরটিই বলছে অধীনতা-বিষয়ে তার যথেষ্টরকম
আপত্তির কথা;
দ্বিতীয় অন্তরাটি রাধা/রাধারমণ,
পুরুষ/কৃষ্ণ হলে কী করতেন সেই বিষয়: মোহন বাঁশি বাজিয়ে
নারীদের মন ভোলাতেন। তা কি আক্রোশমূলক?
তা হয়ে থাকলে,
সে-আক্রোশ-রাধা না কৃষ্ণ-বন্ধুয়ার প্রতি?
ঠিক বোঝে আসে না;
বিশেষ করে শেষ অন্তরায় গিয়ে যখন গানটির বিষয়ে মোটামুটি
মীমাংসায় যেতে পারি সেখানে দ্বিতীয় অন্তরাটিকে প্রক্ষিপ্ত বলে মনে হয়।
এর একটি ভিন্নপাঠ থাকায় সন্দেহ আরো গাঢ় হয়ে ওঠে। ধুয়াপদে নারীজন্মজনিত
যে-দুর্গতির কথা বলেছেনে রাধারমন তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় শেষ অন্তরায়
এসে। বলছেন ‘নারীজনম
যায় বিফলে;
বিফল,
কারণ এই জনম বন্ধুয়ার সেবায় লাগছে না;
বাধা একটাই: পিতা-পতি-পুত্রজনিত অধীনতা। ফলে,
ধুয়াপদে উল্লিখিত অভিযোগ-বিদ্রোহাভাস যে-টুকু মেলে,
তা শেষ অন্তরায় এসে অভিমান-অনুযোগে রূপ নেয়। কিন্তু
গন্তব্যবিন্দুতে আসবার আগে ধুয়াপদে উক্ত
‘ঘটাইলায়’
ক্রিয়াপদ এবং বিশেষত
‘দুর্গতি’
শব্দটি বঞ্চিত নারীদের যে-পরিস্থিতি তুলে ধরে তা আমাদের
বঞ্চনার ইতিহাসযুক্ত সময়কেই তীব্রভাবে মনে করিয়ে দেয়।
মান ভাঙ রাই কমলিনি চাও গো নয়ন তুলিয়া
কিঞ্চিত দোষের দোষী আমি চন্দ্রার কুঞ্জে গিয়া।
এক দিবসে রঙে ঢঙে গেছলাম রাধার কুঞ্জে
সেই কথাটি হাসি হাসি কইলাম তোমার কাছে।
আরেক দিবস গিয়া খাইলাম চিড়া পানের বিড়া
আর যদি যাই চন্দ্রার কুঞ্জে দেওগো মাথার কিরা।
হস্তবুলি মাথে গো দিলাম তবু যদি না মান
আর কতদিন গেছি গো রাধে সাক্ষী প্রমাণ আন।
নিক্তি আন ওজন কর দন্দলে বসাইয়া
অল্প বয়সের বন্ধু তুমি মাতি না ডরাইয়া।
ভাইরে রাধামরণ বলে মনেতে ভাবিয়া
আইজ অবধি কৃষ্ণনাম দিলাম গো ছাড়িয়া।
তত্ত্বধারার গানে,
বিশেষত দেহতত্ত্ব,
আত্মতত্ত্বে কখনো-সখনো গুরুতত্ত্বেও নারীদেরকে
সাধনপন্থের নানারকম অন্তরায়রূপে দেখা যায়;
কারণ তাদের সৌন্দর্য মোহবিস্তারক,
ছলযুক্তও বটে,
ফলে মায়াজালরূপে উপস্থাপন করলে,
যেহেতু এই রূপকের বাস্তবটাও মিথ্যে কিছু নয়-তার
যুক্তিটা দাঁড়ায় ভালো। রাধারমণের রূপকটা অন্যরকম। তিনি এই জায়গায়
পুরুষকে নিয়ে এসে সমাজে অবস্থানকারী কিছু পুরুষের যে-চরিত্র এঁকেছেন,
তা অনবদ্য। গানটির ধুয়াপদের প্রথম পঙক্তিতে রাইকে মান
ভাঙার কথা বলে দ্বিতীয় পঙক্তিতে গিয়ে কৃষ্ণ বলছে-কিঞ্চিত দোষের দোষী
আমি চন্দ্রার কুঞ্জে গিয়া। পঙক্তিটিতে কিঞ্চিত শব্দের ব্যবহারটাই
পুরুষচরিত্রকে একদম পষ্ট করে তোলে-যেখানে পুরুষ/কৃষ্ণ তার এই
অন্যচারিতাকে
স্খলনই
মনে করছে না। ধারণা করা যায়,
এটা পুরুষতন্ত্রের প্রতি রাধারমণের একধরনের ব্যঙ্গ এবং
এরপরে কৃষ্ণের যে ফিরিস্তি তাতে সে নিজে হাসির পাত্র বৈ অন্যকিছু নয়।
কিন্তু এসব তো রূপক আর সমাজের
বাস্তব:
রাধারমণকে যেতে হচ্ছে তার নিজের বাস্তবে,
ধরতে হচ্ছে রাধাভাবের সাজ;
ফলে,
গানের প্রথাগত বয়ন ভেঙে যেখানে আগের অন্তরাগুলির
পরম্পরা অনুযায়ী ভণিতা-পদে কৃষ্ণের কথা-বলার রীতি সেখানে তিনি নিজে
অভিমানী রাধার রূপ নিয়ে হাজির-
‘ভাইরে
রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া/আইজ অবধি কৃষ্ণ নাম দিলাম গো ছাড়িয়া।’
তাঁর এই অভিমানের মধ্যে দ্রোহও রয়েছে-এই ভাবনাকে
কেউ-কেউ অতিকল্পন হিসেবে অভিযুক্ত করে হয়ত বলতে পারেন,
এতে কৃষ্ণের মতি-ফেরাবার গোপন আকাংখাও
তো থেকে যেতে পারে;
কিন্তু আশা করি,
একথা সকলেই স্বীকার করবেন যে,
এর মাধ্যমে কোনো-কোনো দলিতার ইচ্ছেপূরণও ঘটে। রাধারমণের
গান তার এই বহুমুখিতার জন্যেই আমাদের এত আগ্রহের বিষয়। নিচে রাধারমণের
ওই প্রবণতাধর্মী কয়েকটি গান মুদ্রিত হচ্ছে,
যা পাঠ করলে প্রোক্ত মন্তব্যের যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া
যাবে আশা করি।
কৃষ্ণ আমার আঙিনাতে আইতে মানা করি।
মান ছাড় কিশোরী।
যাও
যাও রসরাজ,
এইখানে নাহি কাজ
যাওগি তোমার চন্দ্রাবলীর বাড়ি।
চন্দ্রাবলীর বাসরেতে সারারাত পোহাইলার
রঙ্গে
এখন বুঝি আইছ আমার মন রাখিবারে।
ভাবিয়া রাধারমণ বলে দয়ানি করিবে মোরে
কেওড় খোলো রাধিকা সুন্দরী।