বাদল বরিষণে

 

ফিরোজা হারুন

 

গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহে  যখন বিশ্ব চরাচর অগ্নিস্নানে দগ্ধিভুত হয়, বর্ষা নামে প্রকৃতির আশীর্বাদ হয়ে। তার শীতল জলধারা সকল তাপ-জ্বালা ধুয়ে মুছে শান্ত করে বিশ্ব চরাচর। র্ষার শান্তির বারি সিঞ্চনে সিক্ত হয় প্রকৃতি, মানুষ এবং মানুষের চিত্ত। মেঘের ছায়ায় আশ্রয় পায় তৃষিত ধরণী আর তৃষ্ণার্ত মানুষের প্রাণ। এত সুখ আর এত শান্তি যেন কিছুতেই নেই। নবধারায় স্নাত মানুষের হৃদয় বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। কবিত্বে ভর করে তার তনু-মন। ছন্দে, লয়ে আন্দোলিত হয় অন্তর। আনন্দে বিরহে সে হয় উদ্বেলিত। তার নম্রকন্ঠ বলে,

 

‘এমন দিনে তারে বলা যায়

এমন ঘনঘোর বরিষায়

এমন মেঘস্বরে-বাদল ঝরঝরে

তপনহীন ঘন তমসায়’

 

প্রিয় মানুষটির জন্য প্রাণ কেঁদে উঠে। বিরহে ব্যাকুল হয় অন্তর। মন বলে এখনি যদি তাকে কাছে পেতাম, খুলে  দিতাম অন্তরের ঝাঁপি; যে কথা কোনদিন তাকে বলতে পারিনি, আজ প্রাণ খুলে এই বর্ষণমুখর অন্ধকারে হৃদয়ের সকল দুয়ার খুলে প্রাণের সকল বারতা তাকে জানিয়ে দিতাম।

 

বর্ষণ মন্দ্রিত রাতে একা ঘরে, মেঘের গুরু গুরু গর্জনে নূপুর নামের মেয়েটি বারবার কেঁপে উঠে। সে বর্ষা ভালবাসে, মেঘ ভালবাসে। আজ তার বিরহি হৃদয় প্রিয় বিচ্ছেদের বেদনায় ব্যাকুল। বৃষ্টি ভেজা র খেলার সংগী ছিল পাশের বাসার নিক্বণ। তার সংগে বৃষ্টিতে খেলা করতো। সে ছিল এক অন্তহীন সুখস্মৃতি। ধীরে ধীরে আরো সময় পেরুলো। নিক্বণ চলে এলো দেশের বাইরে।  আজকাল ফোন দূরত্বকে জয় করেছে। ফোনেই তারা দুজন দুজনকে কাছে পায়। আনন্দে সময় কেটে যায়। হঠাত একদিন নিক্বণের সাড়া পাওয়া গেল না। রাস্তায় একটি অ্যাকসিডেন্টে সে জ্ঞান হারায়। নূপুরের  বিশ্বাস হয়না এসব কথা। তারপর সত্যি সত্যি নিক্ব ফোন এলো। খুব দুর্বল কন্ঠস্বর । নূপুর আশ্বস্ত হয়। কিন্তু কান্না আর থামে, বাদল ধারার সংগে পাল্লা দিয়ে চলে। বর্ষার কোন আনন্দের গানই এখন আর ভাল লাগেনা।  শুধু একটি গানই নিক্বণের উদ্দেশে গায়,

 

'এমনি বরষা ছিল সেদিন

শিয়রে প্রদীপ ছিল মলিন

তব হাতে ছিল অলস বীণ

মনে কি পড়ে প্রিয়! '

 

এমন সময় একদিন সাত সাগরের ওপার এক পরিষ্কার কন্ঠস্বর ভেসে আসে।

শুভ জন্মদিন নূপুর। আজ তোমার জন্মদিন মনে আছে তো? তুমিও কাছে নেই বর্ষার কদমফুলও নেই। তবে একটি গান শোনাতে পারি। তোমার আপত্তি নেই তো?

 

নূপুর কেঁদে ফেলে আবেগ জড়িত কন্ঠে বলে, গাও প্লিজ, গাও লক্ষীটি!

 

'এসো হে সজল শ্যাম ঘন দেয়া

এসো কুঞ্জ ছায়ায় এসো, তাল তমাল বনে

এসো শ্যামল

ফুটাইয়া যুথি কুন্দ নিপ কেয়া

এসো হে সজল শ্যাম ঘন দেয়া

বারিধারে এসো চারিধার ভাসায়ে

বিদ্যুত ইংগিতে দশদিক হাসায়ে

বিরিহিনী মেঘ জ্বালায়ে

আশার আলেয়া

ঘনদেয়া 

মোহানীয়া

শ্যামপিয়া

এসো হে সজল শ্যাম ঘন দেয়া'

 

ইথারের তরংগে সুদুরের ওপার হতে ভেসে আসতে থাকে নিক্বণের ভরাট গলায় মায়া ভরা বর্ষার গান। বৃষ্টির জলে ভিজতে না পারলেও নূপুরের অধীর চিত্ত নিক্বণ ধ্বনিতে সিক্ত হতে থাকে।