জলাশয় তত দূরে ...

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়


দরজা খুলে একপাশে সরে দাঁড়াল অতীন। ঠিক দরজার চৌকাঠ বরাবর ডান পা বাড়িয়ে বাঁ হাতটা দরজার পাল্লায় রেখে হাসি মুখেই অতীনের চোখে চোখ রাখল কথা। ভেতরে ঢুকবে কি ঢুকবে না--ভাবখানা এইরকমই মনে হল অতীনের। জিজ্ঞেস করল--
--ভয় পাচ্ছ? কোনো ভয় নেই--আমি যা ছিলাম তা-ই আছি!
কথার দু’চোখে বিদ্যুৎ ঝলসালো। অধরে হাসিটা ধরে রেখেই বলল--
--জানি। কথাটা তা নয়--আসলে এই দরজায় হাত রাখতেই মনে হল প্রতিটি জীবনের মতোই প্রতিটি দরজার গল্পও এক একরকম! তাই না?
ঠিক পাঁচ বছর পরে ওরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একে অপরকে সকৌতুকে লক্ষ্য করছিল। বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয় নি কথার চেহারার মধ্যে। সামান্য একটু মেদ বাড়লেও তাতে যেন ব্যক্তিত্বের গভীরতাই বেড়েছে বলে মনে হল অতীনের। পাঁচটা বছর খুব কম নয়--বিশেষ করে জীবনের সুবর্ণ সময়ের প্রেক্ষিতে। কথাকে দেখে মনে হল না সে কলকাতা ছেড়ে দূরে গিয়ে ফের বিয়ে-থা করেছে। যদিও শাঁখা-সিঁদুর থাকা না থাকায় আজকাল কেউ বিবাহিতা কিনা তা নিশ্চিত করে না।
‘প্রতিটি দরজার গল্পও এক একরকম’--কথার উচ্চারিত এই কথাটা ভেতরে ভেতরে অতীনকে বেশ নাড়া দিল। ওর চোখে যে প্রশ্ন তৈরি হল তা বোধহয় কথারও হাসিতে ধরা পড়ল। হাসতে হাসতেই বলল--
--খুব ভাবনায় ফেলে দিলাম তো! ভেতরে আসবো?
বিব্রত অতীন দ্রুত কথার হাত থেকে তার গড়ানো ব্যাগের হ্যাণ্ডেলটা প্রায় কেড়ে নিয়েই বলল--
--কী মুশকিল! এসো, ভেতরে এসো--
অতীনের দু’কামরার ফ্ল্যাটের বিশেষ কিছু পরিবর্তন ঘটে নি। দরজা-জানলার পর্দা, বেডকভার, ডাইনিং টেবিলের ম্যাট, সোফার কভারগুলো মনে হচ্ছে বদলে গেছে। টিভিটাও নতুন এবং বড়সড় ফ্ল্যাট। বদলেছে দেওয়ালগুলোও। নতুন রঙে রাঙানো হয়েছে। আগে দেওয়ালগুলোতে যেসব নানা রঙের ফ্রেমে আঁটা ছবি ছিল এখন সেসব নেই। সে জায়গায় দু’একটা নজরকাড়া পেইন্টিং ফাঁকা জায়গার কিছুটা অধিকার করেছে মাত্র। কিছু দৃষ্টিনন্দন অ্যান্টিক-টাইপ হস্তশিল্পের আমদানি হয়েছে--যার মধ্যে কিছু অসাধারণ ধাতবশিল্পও রয়েছে! এসবই এক সময়ে কথা’র তীব্র প্রত্যাশার মধ্যেই ছিল। নিজের ঘর এসব দিয়ে সাজাতে পারে নি। অথচ অতীন তার শূন্য ঘর যেন কথা’র কথা ভেবেই সাজিয়ে রেখেছে! দীর্ঘশ্বাস অনেক কষ্টে গিলে ফেলল কথা।
--সারা রাত ঘুম হয় নি--এক কাপ কফি করা যাবে?
--ওয়েট আ মিনিট--এক্ষুণি করে আনছি!
--না না, তুমি করবে না। আমি-ই বানাবো। দুধ-চিনি-কফি এসব আছে তো?
বলতে বলতে কিচেনের দিকে পা বাড়ালো কথা। অতীন দ্রুত ওর পাশে এসে বলল--
--তুমি রেস্ট নাও। আমি কফি নিয়ে আসছি--
--রেস্ট নেব কেন? পাহাড় চড়ে আসি নি। আরামেই এসেছি। শুধু ভাল ঘুম হয় নি। অবশ্য কিচেনে তুমিও আসতে পার--তবে কফি আমি-ই বানাবো। তুমিও খাবে তো?
--হ্যাঁ, আসলে তোমার জন্যেই ওয়েট করছিলাম।
কিচেনের এলোমেলো ছন্নছাড়া চেহারাটা খুব অবাক করল না কথাকে। এরকমটাই তো হওয়ার কথা। এখানে আসার আগে থেকেই কথা’র জানা ছিল অতীন বিয়ে করে নি। একলাই থাকে। দু’কামরার একটা বড়সড় ফ্ল্যাটে একাকী পুরুষ মানুষের নিয়ন্ত্রণে খুব সাজানো গোছানো থাকার কথাও নয়। বিশেষ করে, যার প্রয়োজনের সিংহভাগই বাইরেই মিটে যায়। গ্যাস আছে। দুধ-চিনি-কফিও রয়েছে। কিছু ডিম আর স্প্যাগোটির প্যাকেট ও কুকিং অলিভ-অয়েলের একটা বোতল ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না কথা’র।মূল খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটাও বাইরে সেরে আসে অতীন। বেচারা! এবার আর তার দীর্ঘশ্বাস চাপা থাকল না।
--বিয়ে করলে না কেন? এভাবে একলা থাকার মধ্যে যথেষ্ট ঝুঁকি থাকে না কি?
--একই প্রশ্ন তো আমিও করতে পারি তোমাকে!
--নিশ্চয়ই পার। তবে এ প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়া যাবে না। ভীষণ জটিল এবং অনেকটাই নিজের ব্যর্থতাকে বড় করে তোলার মতো যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে।
--আমিও ঠিক এই কথাটাই ভাবছিলাম--ব্যর্থতা!
--আশ্চর্য্য! তুমিও নিজেকে ব্যর্থ মনে কর?
--না, ঠিক ব্যর্থ নয়। বলতে পার অনেকটাই অক্ষমতা!
--মানে নিজের যা কিছু তা ধরে রাখার ক্ষমতার অভাব?
--তোমার কি মনে হয়?
--আমারও তাই মনে হয়--বুঝতে না পারা, বোঝাতে না পারা--অক্ষমতাই তো! অক্ষমতার লজ্জার নাম-ই হয়তো ব্যর্থতা--লড়াইয়ের ক্ষমতাটাও কেড়ে নেয় শেষপর্ন্ত!
কফিতে চুমুক দিতে দিতে কথাকে গভীর দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে যাচ্ছিল অতীন। কথা বুঝতে পারলেও তার মধ্যে কোনোরকম অস্বস্তি তৈরি হচ্ছিল না। কোনো দিন-ই কি অস্বস্তি বোধ করেছিল সে? অতীনের চোখে কখনো লালা ঝরতে দেখে নি কথা। তাই বলে হঠাৎ কখনো মুগ্ধতাও দেখে নি তা বলা যাবে না। এখন এই মুহূর্তেও অতীনের চোখে নীলাকাশ মুগ্ধতা দেখতে পাচ্ছে কথা। নিরবতা ভেঙে কথায় ফিরল অতীন--
--পাঁচ বছর পরে হঠাৎ তোমার ফোন পেয়ে রীতিমতো অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। পাঁচ বছর আগে আমার মোবাইল ছিল না। ল্যাণ্ডফোনও কবেই ফেলে দিয়ে এসেছি। তাই মোবাইলে তোমার গলা শুনে--
--জোর ধাক্কা খেয়েছো! খুবই স্বাভাবিক। তবে আমি কিন্তু এই পাঁচ বছরে প্রায় প্রতিদিন তোমার ফোনের আশায় ছিলাম। কেন ছিলাম তা অবশ্য ঠিক বলতে পারব না। শেষপর্যন্ত আমি-ই ফোন করলাম!
--অবাক হয়েছিলাম ঠিক-ই, কিন্তু খারাপ লাগে নি। ইন ফ্যাক্ট--তোমার উদ্দেশ্য জেনে আমি বেশ এক্সাইটেড হয়েছিলাম।
--আমার একটু আশঙ্কা ছিল--ব্যাপারটাকে পাগলামি বলে উড়িয়ে দেবে কিনা!
--অনেক ভেবে দেখলাম, পাঁচ বছর পরে আমরা কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি কেমন আছি তা একবার মুখোমুখি হয়ে দেখা দরকার, বোঝা দরকার।
--ঠিক তাই! তাহলে আমরা কাল-ই রওয়ানা হচ্ছি তো?
--হ্যাঁ, কাল রাতে ট্রেন। আজকের রাতটা তোমাকে এখানেই থাকতে হবে। অবশ্য তোমার যদি আপত্তি না থাকে।
--কিসের আপত্তি? নিরাপত্তার ভয়? এখন আর ওসব নিয়ে ভাবি না। কাউকে কোনো কৈফিয়ৎ দেওয়ারও নেই। পাঁচটা বছর তো কেটেই গেল--
--কিন্তু কোনো খবর না দিয়ে হঠাৎ হাজির হওয়াটা ঠিক হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না--
--খবর দিয়ে গেলে আসল ছবিটাই দেখা যাবে না--চিন্তার কি আছে?
অতীন কিন্তু একেবারে নিশ্চিন্ত ভাব দেখাতে পারল না। গত পাঁচ বছরে কারুর সঙ্গে কোনো যোগাযোগই ছিল না। গতকাল হঠাৎ কথা ফোন না করলে পাঁচ বছর আগের অসংখ্য ছোটবড় মুহূর্তগুলো অতীন বার বার ফিরে দেখার কথাই ভাবত না।
সুজয় ও কেয়া হাজারিবাগ জেলার রামগড়ে থাকে। ছোটখাট একটা সেরামিক ফ্যাক্টরি কিনেছে। সেখানে ঠিক কি কি তৈরি হয় সে সম্পর্কে অতীনের স্পষ্ট ধারণা নেই। রামগড় থেকে রাঁচি ও হাজারিবাগের দূরত্ব সামান্যই। বলতে গেলে এই দুই বিখ্যাত হাওয়া বদলের জায়গার ঠিক মাঝখানেই রামগড়ের অবস্থান।


রাঁচির হোটেলে ঘন্টাখানেক রেস্ট নিয়ে ফ্রেশ হয়ে রামগড়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল কথা ও অতীন। ছোটখাট একটা পাহাড় ডিঙিয়ে রামগড়ে পৌঁছুল ন’টা নাগাদ। হাইওয়ের পাশেই সুজয়ের ছোটখাট বাংলো। ভাড়ার গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বাংলোর গেটের সামনে থমকে দাঁড়াল কথা। অতীনের চোখে চোখ রেখে বলল--
--এখন একটু নার্ভাস লাগছে। সুজয় রেগে যাবে না তো!
অতীনও থমকে গিয়েছিল গেটের সামনে। ভেতরে ভেতরে সে-ও একটু অস্বস্তি অনুভব করছিল। পাঁচটা বছর খুব কম সময় নয়। তারও আগের পাঁচটা বছরের প্রতিটি মুহূর্তের ইতিহাস জড়িয়ে আছে ওদের স্মৃতির সঙ্গে। কেউ কি কিছুই মনে রাখে নি? মৃদু হেসে অতীন বলল--
--নার্ভাস লাগবে কেন? তুমি তো কিছু ফেরৎ চাইতে যাচ্ছ না! অবশ্য আমার তাই বিশ্বাস। ওরা কেমন আছে--যা চেয়েছিল তা পেয়েছে কিনা--সেটাই তো জানতে চাও, তাই না?
--আর তুমি? তুমিও কি তাই চাও না?
--আমিও তো তাই দেখতে এসেছি। সে রকমই তো কথা ছিল!
যদি আমরা দেখি ওরা সত্যি সত্যি খুব সুখে আছে--আমাদের কেমন লাগবে!
কথা’র কথায় একটু চমকালো অতীন। এভাবে এক মুহূর্ত আগেও সে কিছু ভাবে নি। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করল
অতীন--খারাপ লাগবে? নিজেকে পরাজিত ব্যর্থ মানুষ মনে হবে? অতীন বলল--
--কি জানি! আগে তো ওদের দেখি!
--সত্যি কথা বলবো? আমার ভীষণই খারাপ লাগবে। অথচ ওরা খুব খারাপ আছে দেখলেও বোধহয় ভাল লাগবে না!
যারপরনাই বিস্মিত হল অতীন। মুগ্ধ চোখে তাকাল কথার মুখের দিকে। সামান্য হেসে বলল--
--এখানে তোমার আসাটা বোধহয় ঠিক হল না!
--এখন আমারও তাই মনে হচ্ছে!
--এনিওয়ে, ঘরের দরজা থেকে ফিরে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?
--না না, ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না। ভেতরে চলো!
গেটটা ঠেলে ভেতরে পা রেখেই কথা বলল--
--আজ একত্রিশে ডিসেম্বর। ঠিক এই দিনেই ওরা--
--হ্যাঁ, পঁচিশে ডিসেম্বর গেট-টুগেদার খাওয়া-দাওয়া হৈ-হুল্লোড় গান-গল্প! আমি কিছু বুঝতেই পারি নি! তুমি পেরেছিলে কথা?
--একটু একটু বোধহয় বুঝতে পারছিলাম--সুজয় বদলে যাচ্ছে।
--সুজয়ের সঙ্গে কেয়ার একটা কেমেস্ট্রি তৈরি হচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু এত বড় সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে বুঝতে পারি নি! আমি বোধহয় কেয়ার বদলে যাওয়াটা ঠিক ধরতে পারি নি। তুমি কি করে বুঝলে সুজয় বদলে যাচ্ছে?
--পুরুষের বদলে যাওয়াটা বিবাহিত মেয়েরা বিছানাতেই স্পষ্ট বুঝতে পারে। তোমাদের বুঝতে অনেকটা সময় লাগে। অনেকে শেষপর্যন্ত বুঝতেই পারে না। কারণ, বিছানায় মেয়েদেরও যে একটা বিশেষ ভূমিকা থাকে এটা তোমরা প্রায় বোঝো-ই না। কেয়াদি হয়তো তোমাকে ততটা সময় বোঝার জন্য দেয় নি!
লম্বা টানা বারান্দায় উঠে আসার সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে বেরিয়ে এল কেয়া। বেশ একটু রুগ্ন দেখাচ্ছে ওকে। হাসিটাও তত ঝকঝকে নয়। আসন্ন মাতৃত্বের কারণেও হতে পারে। নিজের পুরনো স্বভাবে ফিরে যাওয়ার চেষ্টায় কলকল করে উঠতে চাইল কেয়া--
--কী আশ্চর্য্য! বলা নেই কওয়া নেই তোরা একসঙ্গে দু’জন এখানে?
আচমকাই অতীনের মনে হল এই কেয়াকে সে চেনে না। কথা কেয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল--
--ক’মাস কেয়াদি?
--আট মাস রানিং।
মুখের হাসিটা ধরে রাখার চেষ্টা করলেও কথার মনে হল, কেয়া এখন মানসিক এক জটিল অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এ সময়ে পরিবার বিচ্ছিন্ন একাকীত্বই হয়তো তাকে কিছুটা হলেও উদ্বেগের মধ্যে রেখেছে।
--সুজয়কে দেখছি না! কোথাও বেরিয়েছে নাকি?
অতীন কেয়ার চোখে চোখ রেখে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল।
--মেয়েকে স্কুলে দিতে গেছে। এখনই আসবে। তোমরা ঘরে এসো।
--তাহলে এটা তোমার সেকেণ্ড ইস্যু? মেয়ে কত বড় হল কেয়াদি?
--চার প্লাস চলছে। তোরা গল্প কর--আমি কফি নিয়ে আসি। লুচি-বেগুনভাজা চলবে তো?
--শুধু কফি হলেই হবে কেয়াদি। আমরা হোটেল থেকে ব্রেকফাস্ট সেরেই এসেছি।
--তোরা কি বিয়ে করবি?
কেয়ার এই অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে কয়েক মুহূর্তের জন্যে ঘরের মধ্যে হিমশীতল নিরবতা নেমে এল। কথা ও অতীন পরস্পরের দিকে তাকাল। কথাটা আচমকা মুখ থেকে ছুটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেয়ার মুখচোখ লাল হয়ে উঠলো। এক সেকেণ্ড আগেও ভাবে নি এমন একটা বে-আক্কেলে প্রশ্ন সে করে বসবে! কথা ভেতরে ভেতরে দারুণ অবাক হলেও বাইরে অবিচলিত থেকেই পাল্টা প্রশ্ন করল--
--আমরা বিয়ে করি নি বলে তোমার কেন মনে হচ্ছে কেয়াদি? আমরা কি বিয়ে করতে পারি না?
--অবশ্যই পারিস। এখনো করিস নি কেন তাই ভাবছি আমি! তবে যদি সত্যি বিয়ের কথা ভাবিস তাহলে খুব দেরি করিস না।
বলে রান্না ঘরে চলে গেল কেয়া।

বেশ উত্তেজিত হয়েই কেয়াকে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকলো সুজয়। বাইরে থেকে ওর বাইকের শব্দ শুনতে পেয়েছিল অতীন ও কেয়া। একই সোফায় পাশাপাশি ওদের বসে থাকতে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো সুজয়। বোকার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেণ্ড। সুজয়ের চিৎকার শুনে রান্নাঘর থেকে প্রায় ছুটে বেরিয়ে এল কেয়া। অনেকটাই হতভম্ব সুজয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল--
--কি হল? এত চিৎকার করছো কেন?
ততক্ষণে বিস্ময়ের ভাবটা কিছুটা সামলে প্রায় তেড়িয়া মেজাজেই সুজয় বলল--
--দিন দিন খুব দুর্বিনীত হয়ে উঠছে তোমার মেয়ে। জেদি একরোখা, কথা শোনে না। প্রতিদিন স্কুলে নানান অভিযোগ--সারাটা দিন করোটা কি? মেয়েটাকে সহবৎ শেখাতে পার না?
দৃশ্যতঃই বিব্রত বোধ করছিল কেয়া। প্রসঙ্গ পাল্টাতে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে--
--কারা এসেছে দেখ আগে! আমি তো ভীষণ অবাক হয়ে গেছি--
--অবাক হওয়ারই তো কথা! কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ কি ব্যাপার আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না!
সুজয়ের মুখে একটুও হাসিখুশির রেখামাত্র নেই। অতীন লক্ষ্য করছিল সুজয়ের অস্বস্তি আড়ালের চেষ্টাটা। কথা সুজয়ের মাখন মাখন চেহারার ওপর একটা রুক্ষ বাদামি আস্তরণ লক্ষ্য করে ভেতরে ভেতরে বিশ্বাস করতে চাইছিল সুজয় এই পাঁচ বছরে যা চেয়েছিল তা পায় নি। সম্ভবতঃ হারিয়েছে অনেক কিছুই। অতীন কিছু বলার আগেই কথা
বলল--
--হঠাৎ মনে হল তোমরা কেমন আছ একবার দেখে যাওয়া উচিত আমাদের!
--তোমাদের মানে? তোমরা কি বিয়ে করেছো--নাকি লিভ-ইন করছো?
--আশ্চর্য্য! কেয়াদিও একটু আগে এই প্রশ্নটাই করেছিল। তোমরা দুজনে কেমন আছ--যা পাওয়ার জন্যে তোমরা ঘর ভেঙে নতুন ঘর বাঁধলে তা পেলে কিনা--কতটা পেলে তা তো আমরা দুজনেই দেখতে আসবো! অন্য আর কার আমাদের মতো কৌতুহল থাকবে!
কথা সুজয়ের চোখে চোখ রেখেই কথাটা বলল।
--ওকে, ফাইন! দেখ আমাদের। যা দেখতে এতদূরে ছুটে এলে তোমরা তা দেখতে পাও কিনা!
বলে ভেতরে চলে গেল সুজয়।
অনেক বদলে গেছে সুজয়। বদলটা অবশ্য শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। বদলাতে বদলাতে সুজয় নিজেকে ঠিক কেমন ভাবে গড়ে তুলেছে তা এই কয়েক মুহূর্তের দেখায় বোঝা সম্ভব নয় বলেই মনে হল কথা’র। অতীনেরও মনে হল--এই কেয়াকে সে চেনে না। সেই চপলতা চাঞ্চল্য অকারণে খিলখিল করে হেসে ওঠার কেয়া কি করে এতটা বদলে যেতে পারে অতীনের মাথায় ঢুকলো না। সুজয়ও তো বেশ হৈ-চৈ প্রবণ ছিল--এতটা রাশভারি প্রকৃতি তার তৈরি হল কি করে!


বেশ পুতুল পুতুল দেখতে হয়েছে মেয়েটা। একটু জড়োসড়ো প্রকৃতির। খুব একটা সুজয়ের ধারে কাছে যেতে চায় না। কেয়াকেও খুব একটা আঁকড়ে ধরতে চায় না। আপন খেয়ালে নিজের পুতুলগুলোকে বার বার সাজায় আর দু’হাতের তালুতে ধরে অপলকে চেয়ে থাকে! বাইরের লোকজন দেখলে নিজের জন্যে আড়াল খোঁজে। তবু যখন কথা ওর হাত ধরে ওকে নিজের কোলের কাছে টেনে আদর করল মেয়েটা বাধা দিল না। কিছুক্ষণ কথার কোল ঘেঁষে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকল। অতীনও একবার হাত বাড়িয়ে মেয়েটাকে কাছে টেনে আদর করল। সুন্দর শান্ত পুতুলের মতো মেয়েটাকে একনজরেই ভাল লেগে গেল ওদের।
বিকেলের মন-খারাপের আলোয় বাংলোর লনে বাচ্চাটার হাত ধরে ঘোরাঘুরি করছে কথা। অসম বয়সী দু’জন দিব্যি হাসছে কথা বলছে। ছাদের রেলিংয়ে ভর দিয়ে ওদের লক্ষ্য করছিল অতীন।
--চা নাও।
চায়ের কাপ হাতে প্রায় নিঃশব্দেই পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে কেয়া। কেয়ার দিকে ফিরে হাত বাড়াল অতীন--
--ডাকলেই পারতে। এই অবস্থায় সিঁড়ি ভাঙা ঠিক নয়।
--কি করে জানলে? কথা বলেছে বুঝি?
--সাধারণ জ্ঞান। কাউকে বলতে হয় না।
চা’য়ে চুমুক দিতে দিতে কেয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে অতীন জিজ্ঞেস করল--
--আমার মধ্যে সেইসব ছিল না যা তোমার প্রত্যাশায় ছিল। সুজয়ের মধ্যে তার অনেকটাই ছিল। তোমার তো সুখী হওয়ার কথা কেয়া! কিন্তু তুমি ভাল নেই কেন?
--দু’তিন ঘন্টার মধ্যেই বুঝে গেলে আমি ভাল নেই? আসলে আমি ভাল নেই এটাই তুমি দেখতে চাইছো!
কেয়ার চোখমুখ রক্তিম রঙ নিচ্ছে। খালি কাপটা কেয়ার হাতে দিয়ে অতীন বলল--
--না, আমি তা দেখতে চাইছি না। তুমি আগের চেয়েও প্রাণবন্ত ঝকঝকে জীবন যাপন করছো দেখলে আমি খুশিই হতাম। তুমি আমার মধ্যে যা পাও নি তা নিশ্চয়ই তোমাকে দারুণভাবে হতাশ করেছিল। সুজয়ের চালচলন কথাবার্তা শরীর এবং স্মার্ট রোমান্টিক অ্যাপ্রোচ যে তোমাকে তোমার নিজের ঘর সম্পর্ক ভাঙতে বাধ্য করেছিল তা তো মিথ্যে নয়। তবুও আমার কেন মনে হচ্ছে--একজনের মধ্যে সেই সবকিছু পাওয়া যে সম্ভব নয়, তা যদি তুমি বুঝতে!
--তুমি ভুল করছো অতীন। সুজয়ই আমার স্বপ্ন ছিল। এখনও আছে। আমি হারতে শিখি নি। ছোটখাট কিছু সমস্যা আছে ঠিকই--আরও একটু সময় লাগলেও সব ঠিক করে নেব আমি।
--পারবে না। কারণ, ঠিক এই কথাটাই যখন আমাকে বলার ছিল তখন বলতে পার নি। সুজয় বলতে দেয় নি। আর এখনও সুজয়ই তোমার সবকিছু এলোমেলো করে দেবে। সুজয় আমার আশৈশবের বন্ধু--ওকে আমি চিনি।
শূন্য চায়ের কাপ নিয়ে ধীরে ধীরে সামনে থেকে সরে গেল কেয়া। অতীন আকাশের দিকে তাকাল। লালচে আলো ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমের আকাশ জুড়ে। আকাশও মাঝে মাঝে মন খারাপের রঙে নিজেকে রাঙিয়ে তোলে!
নিচে বাইকের শব্দ শুনে লনের দিকে ঝুঁকে তাকাল অতীন। সুজয় ফিরলো। সুজয়কে দেখেই বাচ্চা মেয়েটা এক ছুটে ঘরে চলে গেল! বাইকটা দাঁড় করিয়ে কথার মুখোমুখি দাঁড়াল সুজয়। বিকেল দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছিল সন্ধ্যার আলোছায়ার মধ্যে। ওরা বেশ কিছুক্ষণ কথা বলবে। সুজয় কি বোঝাতে চেষ্টা করবে--কথাকে ছেড়ে কেয়াকে নিয়ে ঘর বাঁধা ঠিক হয় নি? নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে শরীরই সুজয়ের প্রাথমিকতা। শারীরিক সৌন্দর্য্য ও লাবণ্যে কথা এখন আগের চেয়েও গভীর এবং পুষ্পসম্ভবা! অতএব সুজয় যদি কথার সামনে কাঁদুনি গাইতে শুরু করে অতীন মোটেও অবাক হবে না।

প্রায় আধঘন্টা পরে ছাদে এল কথা। অন্ধকার নেমে এলেও চারপাশের ক্ষীয়মাণ আলোয় ছাদে একটা আলো-আঁধারি তৈরি হয়ে গেছে। কথা অতীনের পাশে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। সামান্য হলেও কথার উত্তেজনার শারীরিক বিচলন টের পাচ্ছিল অতীন। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর কথা বলল--
--কী মারাত্মক ভুল করেছিলাম সুজয়কে বিশ্বাস করে! ঈশ্বর রক্ষা করেছেন আমাকে। এখনও লোকটা আমাকে কি বলতে চাইছিল জান--
--জানি। কিন্তু শুনতে চাই না। নিজেকে শান্ত করো। আর একটু সময় নাও। আমাদের দুজনেরই আর ফেলে আসা দিনগুলিতে ফিরে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই। এখানে একবার আসা দরকার ছিল--আর কখনো দরকার হবে না।
--একটা কথা বলবো? ফিল্মি শোনাবে কিন্তু--
--জানি, তোমার মধ্যে একটু ফিল্মি ব্যাপার আছে। বলো কি বলবে?
--বাচ্চা মেয়েটা কিন্তু সুজয়ের নয়।
--তার মানে? কী বলছো যা-তা!
--মেয়েটা তোমার। ডিএনএ টেস্ট করে আমার কথা মিলিয়ে নিতে পারো। ঘর ছাড়ার মাসখানেক আগেই কনসিভ করেছিল কেয়াদি। কনফার্ম ছিল না বলে তোমাকে বলতে পারে নি।
--কেয়া বলেছে?
--আর কে বলবে?
বলতে বলতে অতীনের খুব কাছে সরে এল কথা।
--অসম্ভব! এ হতেই পারে না। হলেও সুজয়ের সঙ্গে ঘর বাঁধার জন্যেই হয়তো ও ব্যাপারটা চেপে গিয়েছিল!
কথা একটু হেসে অতীনের দিকে তাকিয়ে বলল--
--তোমাকে আজ সকালেই বলেছিলাম, শয্যাসঙ্গীর বদলে যাওয়াটা মেয়েরা যত দ্রুত টের পায় ছেলেরা তা পায় না। তুমিও টের পাও নি। তাই কিছু বুঝতেও পার নি!
--সুজয় জানে?
--হয়তো জানে না। তবে সন্দেহ করে মনে হয়। আর এটাই কেয়াদির জীবনের একটা বড় সমস্যা। আচ্ছা, আমি যদি মেয়েটাকে দত্তক নিতে চাই, কেয়াদি দেবে? অবশ্য যদি তোমার আপত্তি না থাকে!
--কেয়া কি দেবে? যদি দিতে চায়ও--সুজয়ের ইগো প্রবলেম বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কেূয়ারও মনে হতে পারে ও আমার কাছে হেরে গেল! তবু একবার কখনো বলে দেখতে পার!
--আমার মনে হয় মেয়ের সুন্দর স্বাভাবিক ভবিষ্যতের কথা ভেবে কেয়াদি রাজি হয়েও যেতে পারে!
--এনি ওয়ে, তুমি এত ভাল কেন কথা! হতভাগা সুজয়টা তোমাকে বুঝলো না কেন কে জানে!
--ডু য়্যু লাইক টু হাগ মী? আমি কিছু মনে করবো না!
কথাকে বুকের মধ্যে টেনে নিতে নিতে অতীন প্রায়ান্ধকার সিঁড়ি দিয়ে একটা লম্বা ছায়াকে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে দেখলো!

***