একি খেলা আপন সনে
কঙ্কাবতী রাজকন্যা
পর্ব -৭
বাবুটা একটু একটু হাঁটতে শিখছে। আমি যখন স্কুল
হেকে ফিরি যেখানেই থাকুক ছুটে আসে সে। আমাকে জড়িয়ে ধরে কত যে চুমু খায়। কত কি যে
বলে। কি যে সুন্দর ওর ছোট্ট ছোট্ট হাত পা, ভেজা ভেজা ঠোঁট। ও সবচেয়ে বেশী খুশী হয়
ওর আঙ্গুলে নেইলপলিশ দিয়ে দিলে কিন্তু মায়ের কড়া নিষেধ ওকে এইসব দেওয়া যাবেনা। তাই
আমি যখন ওকে লুকিয়ে নেইল পলিশ দিয়ে দেই সে তার কয়েকটা গজানো দাঁত বের করে এমন এক
হাসি দেয় মনে হয় পৃথিবীর সব দুঃখ ভুলে যাওয়া যায় সেই হাসিটা দেখেই। কিন্তু খুব
তাড়াতাড়ি আবার রিম্যুভার দিয়ে মুছে দিতে হয় আমাকে ওর নেইলপলিশের রঙ। নইলে মা ভীষণ
রাগ করবেন। এই কাজটা করলেই তার মুখ থেকে সেই অনাবিল স্বর্গীয় হাসিটা মুছে গিয়ে এক
মুহূর্তে তা চিল চিৎকারে পরিণত হয়। তাড়াতাড়ি তখন ওকে ভুলাতে হয় আমার পাখি দেখিয়ে,
ফুল দেখিয়ে কিংবা টিকটিকি। ওর গায়ে এক অদ্ভুত গন্ধ! সবচেয়ে সুন্দর ওর চকচকে
চোখজোড়া।
ওকে এক জোড়া জুতো কিনে দেওয়া
হয়েছে। হাঁটলেই পিক পিক শব্দ করে আর লাইটও জ্বলে তার সাথে সাথে। ও সারাবাড়ি সেই
জুতো পরে ঘুরে বেড়ায়। সারাবাড়ি মুখরিত করে তোলে ওর জুতোর পিক পিক শব্দে।
কাল বাবুর জমদিন হবে। কত যে আয়োজন। ঘর সাজানো
হচ্ছে রঙ্গিন বেলুনে, ফিতেয় নানারকম সজ্জায়। সারাবাড়ি গমগম উৎসব মুখর আনন্দে।
বিকেলের দিকে আসলো বিশাল তিনতলা কেক। সেই কেক গাড়ি থেকে নামিয়ে ভেতরে ধরে আনতেও
লাগলো তিনজন মানুষ। কেক দেখে আমি মুগ্ধ। গোলাপী সাদা মিশেলের বিশাল গোলাকার কেকের
ওপরটা। তার উপরে আবার কলাম করে করে আরোও দুটি গোলাকৃতি কেক বসানো। একদম উপরেরটায় এক
ঘোড়ার গাড়িতে বসে আছেন অচিন দেশের কোন অজানা প্রিন্সেস। আমি মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে
রইওলাম সেই কেকটার সামনে। আমি যতদিন আমার বাবার বাড়িতে ছিলাম প্রতি জন্মদিনেই দাদু
কেক আনতেন। সাথে জামা এবং উপহারও থাকতো তবে এমন বিশাল কেক
আমি আমার জীবনে এই প্রথমই দেখলাম। আমার জন্মদিনগুলো নিয়ে সবচাইতে বেশী মেতে
উঠতেন দাদু। এত আত্মীয় অভ্যাগতিওদের দাওয়াত করাটা তার পছন্দ ছিল না বটে তবে সবচেয়ে
এক মজার ব্যাপার ছিল আআর জন্মদিনে দাদু আমাকে নিয়ে যেতেন এক আজব জায়গায়। সেখানে
আমার থেকেও ছোট ছোট বাচ্চারা ছিল। ওদের বাবা মা কেউ নেই। কয়েকজন মহিলা যারা কিনা
ওদের সাথে রক্তের বাঁধনে বাঁধা নয় তারাই দেখাশুনা করতেন তাদের। সেই বাড়িটাতে ঢোকার
গেটের মুখে লেখা থাকতো করিমুন্নেসা এতিমখানা। আমি আর দাদু ওদের জন্য অয়ে যেতাম
বিরিয়ানি আর মিষ্টি।
এই জন্মদিন উপলক্ষে বাবুর জন্য যে জামাটা
বানানো হয়েছিল সেটাও ছিল ঐ কেকের প্রিন্সেসের জামা। বাবুটাকে যখন মুকুট পরিয়ে ঐ
জামায় সাজিয়ে আনা হলো মনে হচ্ছিল যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা এক দেবশিশুই। কিন্তু এত
লোকজন অতিথি অভ্যাগতদের দেখে শুরু হল তার কান্না! এমনই কান্না যে সকলের কান ফাটে আর
একটু হলে। সে কিছুতেই কেক কাটবে না ছুরি ধরবে না।যতই মা কোলে নিয়ে ওকে দিয়ে কেক
কাটাতে চায় সে ছুরি ফেলে উলটা দিকে মুখ ফিরিয়ে হাত পা ছুঁড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত
কোনরকমে মায়ের হাত দিয়েই কেক কাটার পালা সাংগ করতে হলো।
কেক কাটা, ডিনার এসবের পরেও ছিল একজন বিশেষ অতিথি শিল্পীর সংগীতের আয়োজন।
অনুষ্ঠান শেষ হতে বেশ রাত হলো। ড্রইংরুমের এক কোন ভরে উঠলো নানারকম উপহারে। অতিথিরা
চলে যেতেই বাবা, মা এবং নতুন বাবার মা সবাই মিলে বসলো সে সব উপহার দেখতে। নানারকম
ব্যাটারি চালিত হাতি ঘোড়া, বাঘ ভালুক ও নানারকম খেলনার মাঝে অবাক হয়ে দেখলাম আমি এক
প্রমান সাইজ ডল পুতুল। পুতুলটি কি সুন্দর। সবুজ চোখের মনি ঢাকা পাপড়ি একটু নাড়া
দিলেই বুজে ফেলে। হালকা গোলাপী রঙ তার ঠোঁট। আমি অবাক হয়ে সেটাই দেখছিলাম। হঠাৎ
নতুন বাবার মা আমার হাত থেকে নিয়ে নিলেন পুতুলটা। বললেন প্যাকেটে তুলে রাখ। নষ্ট
হয়ে যাবে। হঠাৎ ভীষণ অপমান আর অভিমানে লাল হয়ে উঠলাম আমি। সেই অপমানটা মনে পড়লে আজও
গা শির শির করে। বুকের ভেতর বয়ে যায় জ্বলে যাওয়া উষ্ণ প্রস্রবন!
এর দেড়মাস পরেই এলো আমার জন্মদিন। আশা
করেছিলাম প্রতিবারের মত মা রাত ১২ টায় উইশ করবে কিন্তু মা মনে হয় সেবারে ভুলেই
গেলেন আমার জন্মদিনের দিনটা। বাবা ফিরতে সেদিন মা বাবার অনেক রাত হলো। আমি অন্যান্য
দিনের মতই মা বাবার ফেরর অপেক্ষায় জেগে ছিলাম তবে সেদিন বেরিয়ে আসলাম আমার নিজের
শোবার ঘর থেকে। ওত রাতেও আমাকে জেগে থাকতে দেখে মা ভুত দেখার মত চমকে উঠলেন। তারপর
ভীষণ বিরক্ত হয়ে তার টকটকে লাল রক্তচক্ষু নিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, এত রাতেও ঘুমাও নি
কেন? কাল সকালে স্কুল আছে না! যাও ঘুমাতে এখুনি। আমি ভয় পেয়ে দৌড়ে পালালাম। সারারাত
আমি সেদিন দু’চোখের পাতা এক করিনি। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়লাম।
স্কুল যাবার সময় পার হয়ে যেতেও উঠছিনা দেখে শিউলি আমাকে ডেকে উঠালো। মা বাবা
এবং বাবু সকলেই মনে হয় তখনও ঘুমিয়ে। কোথাও তাদের কোনো সাড়া পেলাম না। যখন বের হবো ও
বাড়ি থেকে দাদু ফোন করলেন। ফোন কানে দিতেই উনি বললে, শুভ জন্মদিন দাদুভাই। আজ
বিকালে তোমাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসবো। রেডি থেকে কিন্তু। আমি কোন কথার উত্তর দিতে
পারলাম না। ফুঁপিয়ে উঠলাম। স্কুল যাবার পথে গাড়িতে আমার কান্না দেখে ড্রাইভার চাচু
বললেন, কাইন্দো না মা।
পৃথিবীতে চক্ষের জলের কুন দাম নাই। শক্ত হও। লোহার মত শক্ত। পাষানের মত
কঠিন। আমার মনে পড়লো করিমুন্নেসা এতিমখানার শিশুদের কথা। দাদু বলেছিলেন ওদের বাবা
মা নেই। আমার তো সবই আছে। বাবা, মা, দাদু, দীদা তবুও...
স্কুলে এসে জানতে পাই আন্তঃজেলা সাংস্কৃতিক
প্রতিযোগীতার কথা। আমাদের স্কুলের কিছু মেয়েদেরকে সিলেক্ট করা হয়েছে। সিলেক্ট
করেছেন মুনমুন আপা তার দলীয় নৃত্যের একজন অংশগ্রহনকারী হিসাবে আমাকেও। তিনমাস তালিম
দেওয়া হবে। সেই প্রথম অমন নূপুর নিক্কনের ছমছম গা শিউরে ওঠা ধ্বনির সাথে পরিচয়।
ভারী ছোট ছোট ধাতব পাতের মাঝে ছোট ছোট বলগুলো কি করে অমন মন কাড়া আওয়াজ তোলে ভেবেই
পাইনা আমি। আমি মন দিয়ে মুনমুন আপার কথা শুনি। তার শিখিয়ে দেওয়া তাল মুখস্থ করি।
ধা ধিন ধিন ধা, না তিন তিন না, তেটে
ধিন ধিন ধা ।। সোম, ফাঁক, তবলা, বোল এসবের মাঝে আমি নতুন এক জগতের সন্ধান
পাই। ঘুমের মাঝেও আমি বিড় বিড় করি, ধা ধিন ধিন ধা, না তিন তিন না...
বেহালা পড়ে থাকে ঘরের কোনে আমি তখন নতুন নেশায়
মত্ত। মাকে জানাই আমি পাকাপাকি ভাবেই নাচ শিখতে চাই। মা রাজী হন না। আমি হাল ছাড়ি
না। একদিন ছুটির দিনে চুপি চুপি ফোনে যোগাযোগ করি ঝুমকি ফুপুর সাথে। ঝুমকি ফুপুর
কথার অবাধ্য হবে এ বাড়ির কেউ? কার ঘাড়ে কয়টা মাথা? এরপর আমি মুনমুন আপার বাসায় যেতে
শুরু করি প্রতি সপ্তাহে দু’দিন নিয়ম করে। বাকী দিনগুলোতে নিজে নিজেই চলে চর্চা।
মুগ্ধ হয়ে দেখি আমি উনাকে। কি কঠিন ছন্দে নেচে চলেন উনি। প্রতিটা মুদ্রা, তাল, লয়
ছন্দের এক অদ্ভুত ধ্বনি ওঠে। আমার কিছুতেই অমন হয় না। কিন্তু নিরলস প্রচেষ্টার কোন
ত্রুটি রাখি না আমি। ১৩ বছর বয়সে মুনমুন আপার কাছে আমার যে হাতেখড়ি, তা চলে আরও
প্রায় বছর তিনেক। আমার আগ্রহ আর অধ্যাবসায় দেখে উনি আমাকে বলেন বিশ্ব ভারতীতে
অ্যাডমিশান নিতে। উনার কাছে আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি বিশ্বভারতীর কথা। বিশ্বভারতীর পাঠ
ভবন, শিক্ষা ভবন, বিদ্যা ভবন, আম্র কুঞ্জ, ছাতিম তলা আমার অদেখা চোখেও স্বপ্ন হয়ে
ঘোরে আর আমি ঘুরে ঘুরে বেড়াই সেই অনাবিল শান্তির শান্তি নিকেতনে সবুজ ঘাসে ঘাসে। এই
স্বপ্ন পূরণ হতে খুব বেশী কাঠ খড় পোড়াতে হল না। তবে আমার এই স্বপ্নের দেশে যে
স্বপ্ন পূরণের আগেই আমার সাথে দেখা হলো হয়তো বা নিজের মনের অজান্তেই স্বপ্নে দেখা
স্বপনকুমারের। সেই পরিচয়, সেই প্রথম দেখার ক্ষণ, সেই প্রথম ভাল লাগা, ভালোবাসা মনে
পড়লেই আজও নিজের দু’গালে ছড়ানো আবীর দর্পন ছাড়াও দেখতে পাই আমি।
পর্ব - ৮
দোলন! দোলনের সাথে যখন আমার প্রথম দেখা হলো, প্রথম
দেখাতেই দোলন আমার হৃদয় দুলিয়ে দিল। তার অন্তর্ভেদী সুগভীর সমুদ্র নীল চোখের
চাহনীতে ক্ষণিকের জন্য আমার হৃদস্পন্দনই বুঝি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। জানিনা বোকার মতন
ঠিক কি করেছিলাম আমি সে সময়, মানে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম হা করে ওর দিকে। তবে হাতের
কনুই এ প্রচন্ড এক চিমটিতে আমার সম্বিত ফিরেছিল। নায়লা আমার হাতে চিমটিটা দিয়েই
ক্ষান্ত হলো না, কানে কানে ফিসফিস করে বললো, অমন কেবলার মত হা করে তাকিয়ে দেখছিস
কি? লজ্জা পেয়ে তড়িঘড়ি সামনে পা বাড়ালাম।ফিরে এলাম আমার আপন কুটিরে।
কিন্তু আমার যে কি হল এরপর! সারা সন্ধ্যা আমি আনমনা হয়ে রইলাম। চোখে বিঁধে রইলো
একটি বিকেল আর বকুল বিথীতে সবুজ ঘাসের গালিচায় একটি গাছের গোঁড়ায় বসে থাকে ঝাঁকড়া
চুলের সেই বংশীওয়ালা। এমন তো কখনও হয় না। কত দিন কত মানুষকেই তো দেখেছি ঘরে বাইরে
পথে ঘাটে! আজ আমার একি হলো! মনে হলো সে কত দিনের চেনা। তার জন্যই অপেক্ষা করেছিলাম
আমি এই আঠারোটি বছর! আমি বারবার হারিয়ে যাচ্ছিলাম কোথায় যে। আমার অবস্থা দেখে নায়লা
মজা শুরু করলো।
ওগো বাঁশিওয়ালা, বাজাও তোমার বাঁশি
শুনি আমার নতুন নাম,
এই বলে তোমাকে প্রথম চিঠি লিখছি
বুঝলে তো?
আমি তোমার বাংলাদেশের মেয়ে...
তোমার চরণে হবে কি একটু ঠায়?
হা হা হা ... উচ্ছ্বল হাসি আর দুষ্টুমিতে মেতে উঠলো ও। নায়লা আমার সেই প্রবাসী
জীবনের সাথী, হরিহর আত্মা নায়লা। আমরা একই রুমেই থাকতাম। একই খাবার ভাগ করে খেয়েছি।
একই দুঃখ এবং শোকও ভাগ করে নিয়েছিলাম আমরা দুজনা। আমার সেই প্রথম প্রেম, উদাসী মন,
উড়ু উড়ু হৃদয়, সকল আবেগ ও অনুভূতির সঙ্গীই ছিল সে। কত লুকানো বিকেল, কত আনন্দ সুখের
স্মৃতি, কত বেদনা আর কত অভিমান যে আমি গচ্ছিত রেখেছিলাম ওর বুকের সিন্দুকে। সে সব
আর কখনও কাউকেই বলা হয়নি আর হবেও না কোনদিন, সে বেশ জানি।
সে যাইহোক, সে রাতের খাবারের পর লাইট অফ করে শুয়ে ছিলাম আমরা। জানালা দিয়ে সেদিন
আকাশ ভাঙ্গা জ্যোৎস্না। আমাদের গায়ে এসে পড়েছিল সেই স্নিগ্ধ মধুর তীব্র আলো।
জানালার শিক গলে বাঁকা বাঁকা জ্যোৎস্না – নকশা আমার বুকের ’পরে শাড়ির আঁচলের
কুঁচিরে ভাঁজে ভাঁজে সৃষ্টি করেছিল আরেক নকশা। আজও মাঝে মাঝেই পূর্ণ শশীকলায় খেলে
যাওয়া জ্যোৎস্নায় তাকালেই আমার মনে পড়ে সেই জ্যোৎস্না আঁকা শাড়ির কুঁচির ভাঁজে খেলে
যাওয়া স্মৃতিময় রাত। নায়লা একা একা বক বক করে চলেছিল। আমার কানে কিছুই ঢুকছিল না।
এক সময় সে এই জ্যোৎস্নার ঢল দেখেই বুঝি গাইয়ে শুরু করলো,
চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙ্গেছে, উছলে পড়ে আলো
ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধসুধা ঢালো।
নায়লার গান আর চাঁদের আলোর হাসি একাকার হয়ে যাচ্ছিল সেই মায়াবী রাত। আমি অপলক চেয়ে
রইলাম। জানালা গলে গাঢ় নীল আকাশের বুকে তখন ফাগুনের শ্বেত শুভ্র মেঘ। ভেসে যাচ্ছিল
যেন অমল ধবল পালের কোন আকাশ খেয়াযান। নায়লা গাইছিল আর মন্ত্রমুগ্ধের মত আমি ডুবে
যাচ্ছিলাম সেই গানের বাণীতে বাণীতে, প্রতি চরণের অমৃতধারায়, ওর গানের সাতেহ সাথে
পাখা মেলে দিয়েছিল রাত প্রহরের সেই উদাসী মেঘমালা।
নীল গগণের ললাটখানি, চন্দনে আজ মাখা
বাণী বনের হংস ইথুন মেলেছে আজ পাখা –
পারিজাতের কেশর নিয়ে, ধরায় শশী ছড়াও কি এ
ইন্দ্রপুরীর কোন্ রমণী বাসরপ্রদীপ জ্বালো
জানালা দিয়ে কোন রজনীগন্ধার গন্ধ ভেসে আসছিল না সেদিন। তবে কোন এক অজানা ফুলের
গন্ধে তখন চারিধার মৌমিতাল। অনেক পরে জেনেছিলাম সে নাকি ছাতিম ফুলের গন্ধ ছিল।
ছাতিম ফুলের ঝাঁঝালো গন্ধটা দূর হতে ভেসে আসছিল বলেই বুঝি অজানা অচেনা এক মাদকতার
সৃষ্টি করেছিল সেই রাতে। হঠাৎ আমার খুব কান্না পাচ্ছিল! আমার মনে হচ্ছিল এই বিশাল
পৃথিবীতে আমার কোথাও কেউ নেই, যার বুকে মুখ গুঁজে আমি ঢেলে দিতে পারি আমার সকল
দুঃখজল। আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। আমার কান্নার শব্দেই বুঝি নায়লা আমার পাশে উঠে
এলো। আমরা দু’জন বহুরাত অবধি বসে রইলাম পাশাপাশি বারান্দার আলসে ঘেঁষে। কাঁধে কাঁধ
রেখে বয়ে নিতে চাইলো বুঝি আমার সকল দুঃখ এই উচ্ছ্বল প্রনবন্ত বন্ধুটি আমার...
কয়েক দিনের মাঝেই নায়লা খবর নিয়ে এলো। তার হাড়ির খবর। নাম ধাম পরিচয় বংশ ও কূলের।
আর সেদিন দুপুরেই হঠাৎ দেখা হয়ে গেল তার সাথে সংগীত ভবনের রিহার্সেল চত্বরে। নতুন
এবং পুরোনোরা মিলে চলছিল আসন্ন বসন্ত উৎসব অনুষ্ঠানের রিহার্সেল। আমরা যখন পৌছুলাম
সেখানে, রিহার্সেল ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। গোল সার্কেলে বসে তখন গানের ছেলেমেয়েরা
গাইছে বসন্ত সংগীত। তড়িঘড়ি এক কোনায় গিয়ে একটু জায়গা করে বসতেই উল্টোদিকে চোখ পড়লো।
সেই অন্তর্ভেদী সমুদ্র নীল চোখ। এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমারই দিকে। বিশাল সে
প্রাঙ্গনেরর সমবেত সংগীতে তখন গমগমে চারিধার – চারিদিকে আছড়ে পড়ছিল সেই সুর ও
বাণী...
রাঙ্গা হাসি রাশি রাশি অশোক পলাশে
রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে,
নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল...
রাশি রাশি অশোক পলাশ শিমুলের রাঙ্গা আবির লাগলো বুঝি আমারর চোখে মুখে। রাঙ্গা হয়ে
উঠলাম আমি। কি এক অজানা অচেনা নেশায় ডুবে যাচ্ছিলাম জানিনা। রাঙ্গা হিল্লোলে আলোড়িত
তখন আমার হৃদয়। সে হৃদয় তার আপন হাতে দোলে। আমার গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছিল না।
চারিদিকে সঙ্গীতের মূর্ছনা আর আমার সারা দেহে এক অজানা কাঁপন। কি এক ঘোর আবেশে
সম্মোহিত নিবদ্ধ আম্মার দুই চোখ ঐ আঁখির কোলে। আসন্ন বসন্তের আগমনে সকলে গাইছে গলা
ছেড়ে আর আমি বিভোর কোন এক অজানা সম্মোহনের মায়াজালে।
বেণুবন মর্মরে দখিন বাতাসে,
প্রজাপতি দোলে ঘাসে ঘাসে
মৌমাছি ফিরে যাচি ফুলের দখিনা,
পাখায় বাজায় তার ভিখারির বীণা,
মাধবীবিতানে বায়ু গন্ধে বিভোল...
আমার মনের অজানা সব অলিগলিতে উরে চললো লক্ষ প্রজাপতি। মৌমাছিদের গুন গুন গুঞ্জরনে
বিভোরিত তনুমন। রিহার্সেল শেষ হতে সেদিন সন্ধ্যা হয়েছিল মাসব্যাপী এই রিহার্সেল
আমাদেরকে কাছাকাছি এনে দিল খুব দ্রুত।
প্রেমে পড়লাম আমি। সে এক উথাল পাথাল প্রেম...
দোলন আমার স্বপ্নলোকের রাজকুমার, যার হাতে অবলীলায় তুলে দেওয়া যায় এ হৃদয়, পরম
নিশ্চিন্ততায়, নির্ভরতায়। কোনদিন আমায় কেউ এই অভয় দেয়নি। কোনদিন আমার খুব কাছের কেউ
হয়নি। কোনদিন আমার আপন কেউ ছিল না। কোনদিন আমাকে কেউ বাড়িয়ে দেয়নি কোন আশ্বাস বা
সহযোগীতার হাত। কোনদিন কেউ আমাকে ভালোও বাসেনি খুব অবলীলায় নিঃসংকোচে। দোলন আমার
সেই আশ্রয়, যার বুকে মুখ লুকিয়ে ঢেলে দেওয়া যায় গত জীবনের সকল দুঃখ তাপ। দোলনের
সাথে পরিচয় বা এই প্রনয়ের পর অনেকটাই বদলে গেলাম আমি। আমি বলতে গেলে ভুলেই গেলাম
আমার গত জীবনের সকল অপ্রাপ্তি। আমার মন সব সময় ভরে থাকতো অজানা এক ভালো লাগার
আনন্দে। আমার ধ্যান, জ্ঞান, ভাল লাগা এবং ভালবাসার প্রতিটা তন্ত্রীতে মিশে গেল
একটাই নাম – সে দোলন।
রোজ সকালে ঘুম ভেঙ্গে উঠেই যার মুখটা মনে পড়তো সে দোলন। তড়িঘড়ি স্নান সেরে কোনমতে
শাড়ি পরে ক্লাসের অনেক আগেই আমি ছুটতাম বাড়তি সময়টুকু দোলনের পাশে থাকবো বলে। ও রোজ
আমার জন্য প্লাস্টিক ব্যাগে করে আনতো সকালের শিশির ভেজা ফুল। কখনো বেলী, কখনো জুঁই,
কামিনী, শিউলী কিম্বা মাধবীলতা। ওদের বাগানের ফুল। ওর বৌদির হাতের লাগানো ফুলগাছের
সেই স্নিগ্ধ সজীবতায় আমি খুঁজে ফিরতাম এক অজানা মমতার স্পর্শ, যে মমতার ছোঁয়া
প্রোথিত থাকে কোন শতবর্ষী বটবৃক্ষের শিকড়ে শিকড়ে। কোনো স্বর্ণলতার সাধ্য কি সেই
মমতার ঘ্রান পাবার?
দোলনের কাছে আমি অবাক হয়ে শুনতাম ওদের একান্নবর্তী সংসারের গল্প! কি অপরিসীম মমতায়
ওর বড় বৌদি বড় করেছেন ১০ বছরের মা হারা এই দেবরটিকে। এই মাতৃসমা বড় বৌদি যে ওর কাছে
মায়ের মতই ভালবাসার তা আমি খুব বুঝতাম ওর শ্রদ্ধা আর মমতায় মেশানো আলাপচারিতায়। মনে
মনে আমিও দেখতাম বড় বৌদির মুখ, তার মাতৃস্নেহ কোন এক অজানা কল্পনায়, ওর ফ্যামিলি
এলবামের ছবিগুলি দেখে দেখে আমার মনে হত সবাই আমার যেন শত জনমের পরিজন। ওর ছোট টিফিন
বক্সে বৌদির হাতের বানানো পায়েস কিংবা চাপাতি সব্জীতে লেগে থাকতো এক অন্যরকম
ভালবাসার ঘ্রান। আমরা দুজন ভাগাভাগি করে খেতাম সে সব খাবার কোন বকুল কিংবা কদম
ছায়ায় বসে। প্রায় বিকেলেই আনরা হেঁটে যেতাম বহুদূর। দোলনের সাইকেলের পিছে চড়ে মাঝে
মাঝেই চলে যেতাম কোপাই নদী বা খোয়াই এর ঘাটে। ঘুরে বেড়াতাম নদী তীর ধরে। ঘুরে ঘুরে
কিনতাম নানারকম শিল্পকর্ম বা অকারণ হাবিজাবি। একসাথে গান গাইতাম দুজনে গলা ছেড়ে।
মোট কথা হাওয়ায় ভেসে উড়ে যাবার ছিল সেই দিনগুলো...
পর্ব -৯
প্রথম প্রেম, প্রথম চুম্বন অথবা প্রথম হৃদয়ের ভাঙ্গন। এসবের কোনটার তীব্রতাই নাকি
কোনটার চাইতে কম নয়। এই কথার সত্যতা সেই জানে যে প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খায়। ভেসে ওঠা
হয়ে ওঠেনা তার আর কোনদিন চোখের সামনে ভেসে যেতে দেখা খড়, কুটো বা একখন্ড কাঠ।
কোনকিছুই ধরে বাঁচার সাধ জাগেনা তখন আর তার। এই ডুবে যাওয়াটাই তখন আনন্দের। এই ডুবে
যাওয়াতেই তখন তার সকল সত্য। সেই দিনটির কথা যখন আমার মনে পড়ে, এতগুলো দিন পরেও
লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে উঠি আমি। আজকালকার প্রেমিক প্রেমিকারা হয়তো একথা শুনে হাসবে।
ভাববে এ আমার ঢং বা ভড়ং। কিন্তু আমি জানি সে সত্য। আমি জানি সেই শিহরণ। প্রথম চুমুর
স্মৃতি।
দিনটি ছিল আষাঢ়ের দ্বিতীয় দিন। তার আগের দিনেই বর্ষামঙ্গল উৎসবে সারাদিন নেচে গেয়ে
কাটিয়েছি আমরা। পরদিন ছুটির দিন থাকায় আগে থেকেই নৌকা ভ্রমনে যাবার কথা ছিল আমাদের।
ভোর হতেই শুরু হলো ঝুম বর্ষা। ঘন কালো মেঘে আকাশ ছিল ছাওয়া। তবুও সেই বর্ষা কিংবা
বাদল আটকে রাখতে পারেনি আমাদের সেই প্রণয় অভিসার। সেই প্রবল বরিষণ ভেদ করেও আমরা
হাজির হয়েছিলাম কাঁচমন্দিরের পেছনের চাতালে। তখন সকাল ন’টা বা দশটা হবে। এই মেঘ
বাদলে নৌকায় যাওয়া ঠিক হবে না ভেবে মদিরের পেছনের দিককার শান বাঁশানো ঢাকা দেওয়া
ধাপগুলির একটাতে বসেছিলাম আমরা।
চারিদিক মুখরিত রুমঝুম বৃষ্টির তানে। আমার পরনে চওড়া নীলপাড় সাদা রঙ শাড়ি। খোঁপায়
গুঁজেছি তার কিছু আগেই বৃষ্টিস্নাত বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল। সামনে গাঢ় সবুজ রঙ
কচুপাতার উপর বৃষ্টির জল পড়ে পড়ে হীরকখন্ড হয়ে সাথে সাথেই তা ভেঙ্গে পড়েছিল। আমি
অপলক চেয়ে দেখছিলাম সেই মোহময় দৃশ্য। দোলনের কাঁধে মাথা রেখে ওর পাশে বসেছিলাম
চুপচাপ। সেই মায়াবী সৌন্দর্য্যে ডুবেছিলাম অনেকটা সময়। কোথাও ব্যাঙ ডেকে চলছিল
একঘেয়ে সুরে ঘ্যাঙ্গর ঘ্যাং, ঘ্যাঙ্গর ঘ্যাং। মাঝে মাঝেই আকাশের বুক চিরে চারিদিক
আলোকিত করে বিদ্যুতের ঝিলিক উঠেছিল। কামিনী ফুলের গাঢ় মাতাল করা গন্ধ কি এক অপরূপ
মাদকতা ছড়াচ্ছিল চারিদিকে। সেই মাদকতায় হারালাম আমরা।
সেই আবেশিত মোহময় বাদলের দিনে রবিঠাকুর কি অলখে বসে দেখেছিলেন দুটি প্রেম পিয়াসী
জীবন্ত মূর্তি চিত্রের আকুল ভালবাসা? লিখেছিলেন কি বহুদূর হতে আমাদেরকেই স্মরণীয়
করে কোন মেঘমল্লার রাগপ্রধান প্রেম সঙ্গীত? সকলের আগোচরে নীরবে নিভৃতে অস্ফুটে কি
বেজেছিল সেদিন কোন নেপথ্য কবিতা। জানা নাই, জানা নেই তার কিছুই আমার। শুধু আজও
হৃদয়ে বাজে সেই অপঠিত কবিতা। হৃদয় জুড়ে আজও বাজে গুন গুন সুর,
অধরের কানে যেন অধরের ভাষা।
দোঁহার হৃদয় যেন দোঁহে পান করে।
গৃহ ছেড়ে নিরুদ্দেশ দুটি ভালোবাসা
তীর্থযাত্রা করিয়াছে অধর সংগমে।
দুইটি তরঙ্গ উঠি প্রেমের নিয়মে
ভাঙিয়া মিলিয়া যায় দুইটি অধরে।
ব্যাকুল বাসনা দুটি চাহে পরস্পরে
দেহের সীমায় আসি দুজনের দেখা।
প্রেম লিখিতেছে গান কোমল আখরে
অধরেতে থর থরে চুম্বনের লেখা।
দুখানি অধর হতে কুসুমচয়ন,
মালিকা গাঁথিবে বুঝি ফিরে গিয়ে ঘরে।
দুটি অধরের এই মধুর মিলন
দুইটি হাসির রাঙা বাসরশয়ন॥
এরপর পৃথিবীর সকল শোক তাপ দুঃখ কষ্ট ভুলেছিলাম আমরা। এতদিনের সকল না পাওয়ার
বেদনাগুলো কোথায় যে হারিয়ে গেল একে একে, কোন অগোচরে লুকালো তারা, সে জানা নেই আমার।
আমরা তখন নতুন জীবনের স্বপ্নে বিভোর দুটি ডাহুক ডাহুকী। আমি ধরেই নিলাম আমাকে আর
কখনও ফিরে যেতে হবে না আমার পুরোনো গ্লানিময় পরিমন্ডলে, যেখানে আমার কেউ নেই, আমার
জন্য অপেক্ষা করে নেই কেউ কোথাও। এ যাবৎকালের সকল উপেক্ষা, অবহেলা বা নিজের সাথে
নিজের করা সকল সংগ্রামের ইতিহাস ধূলো চাপা পরে গেল আমার দোলনের ভালবাসার কাছে। দোলন
তখন আমার পৃথিবী। আমার নিশ্চিন্ত নির্ভরতায় জেনে গেলাম দোলন আর কখনও আমাকে এক ফোটা
দুঃখ পেতে দেবে না কোন ভাবেই। আমার এই এতটুকু জীবনে ভেতরে ও বাইরের ক্রমাগত লড়াই-এ
ক্লান্ত আমি। অবসর নিলাম নিজের দায়িত্ব থেকে।
বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত ও শীত পেরিয়ে এলো বসন্ত। দোল পূর্ণিমার সন্ধ্যায় দোলন আমাদের
কিছু কাছের বন্ধুদেরকে নেমতন্ন করলো। সারাদিন বসন্ত উৎসবের পর আমরা বেশ ক্লান্ত
পরিশ্রান্ত হলেও আমার উৎসাহের কোন কমতি ছিলনা। দোলনদের বাড়িত সেই আমার প্রথম যাওয়া।
ওর কাছে এত শুনেছি ওদের বাড়ির কথা যে ওদের মোড়ের নুয়ে পড়া তাল গাছ হতে শুরু করে
খিড়কি দুয়ার, পেছনের পুকুর, বড় বাড়ির প্রশস্ত চাতাল সবই মনে হলো যেন অনেকদিনের
চেনা। আমি একের পর এক ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম ঐ বাড়ির আনাচে কানাচে।
ওদের সিড়িঘরের কিছুটা অন্ধকারছন্ন ভুতুড়ে নীরবতায় পা দিতেই নাকে আসলো এক অদ্ভুত
ধোঁয়াশা গন্ধ। পরে জেনেছিলাম বড় বড় ধান আর চালের ডোল রেখে দেওয়ায় অবদ্ধ ঘরে অমন
নেশা লাগা গন্ধের সৃষ্টি হয়েছিল। পায়ে পায়ে উঠে আসলাম ছাদে। বিশাল ছাদের এখানে
ওখানে শ্যাওলা জমা দাগ। এক কোনে কিছুটা উঁচু জায়গায় বয়ামে করে আচার শুকাতে দেওয়া
হয়েছে। কুলবড়ই আর তেঁতুলের আচারের পাশে আমি দেখলাম কুলোয় করে শুকাতে দেয়া হয়েছে
সোনালী রঙের আমসত্ব। জিভে জল এসে গেল আমার। কিন্তু কে কি বলে ভেবে আর হাত দিলাম না।
ছাদের আলসেতে ভর দিয়ে দেখছিলাম নীচের আম বাগান আর নানারকম ফলের বাগানের দৃশ্য। হঠাৎ
পেছনে দোলন এসে দাঁড়ালো। আমাকে অমন চোরের মত একা একা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে
বোধহয় একটু অবাকই হয়েছিল! দোল উৎসবের আনন্দযজ্ঞে সেই বিকেলেও মেতে উঠেছিল সবাই নীচে
ওদের প্রশ্বস্ত চত্বরে। কিন্তু সেই হোলির আনন্দ থেকেও সেদিন বেশি অনন্দ ছিল আমার
দোলন – আমার এক ও অদ্বিতীয় ভালবাসার আবাসস্থলটির ক্ষুদ্র আনাচ কানাচ, গলি ঘুপচির
আবিষ্কারে।
দোলন হঠাৎ ওর মুঠোভর্তি আবীর আচমকা আমার দুগালের ছড়িয়ে দিতে হাত বাড়ালো। আমি বুঝে
উঠেই পালাতে চাইলাম কিন্তু সে আমাকে বন্দী করে ফেললো। তারপর মুঠো মুঠো আবীরের রঙ্গে
আমাকে রাঙ্গিয়ে তুললো। আর তারপর সেই পড়ন্ত বিকেলের সোনারঙ আলোয় দুটি তৃষিত অধর ঢেলে
দিলো এক অন্যের অধরে শত সহস্র শতাব্দীর প্রেম সুধা। হঠাৎ পিছনে চোখ পড়তেই দেখলাম,
ধপধপে চুলের শ্বেত শুভ্র বসনা এক নারীমূর্তি। যার চোখে সেই বিকেলে দেখেছিলাম ভয়ঙ্কর
জ্বলন্ত আগুনের ফুল্কি। সে আগুনে দগ্ধ ও ভস্মীভূত হয়ে গেলাম আমি। ভীষণ অপরাধীর মত
মন নিয়ে পালিয়ে এলাম সেদিন ওবাড়ি থেকে। কিন্তু এরপর...
পর্ব ১০ (শেষ পর্ব)
ওদের বাড়ি থেকে ফিরে আসার দু’দিনের মাথায় দোলনের বড় বৌদি
আমাকে একটি চিরকুট পাঠালেন। হলের দারোয়ান এসে সে চিরকুট দিয়ে গেল যখন তখন দেখলাম
চিরকুটে বৌদি লিখেছেন, উনি আমার সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে চান। আমি খুব অবাক
হলাম। কারণ উনি লিখেছিলেন উনার সাথে এই একান্ত সাক্ষাৎকার সম্পর্কে আমি যেন দোলনকে
কিছু না জানাই। এটা আমার আরোও বেশী অবাক হবার কারণ। বুঝলাম না আমি, এই কথা দোলনকে
না জানানোর কি আছে? জানালে সমস্যা কি? কি যেন এক অকারণ আশংকায় দুরু দুরু করছিল মন।
বৌদি নিষেধ করেছেন দোলনকে কিছু না জানাতে অথচ আমি দোলনকে কোন কিছুই কখনও লুকাই না,
লুকাইও না কোনদিন। সাত পাঁচ ভেবে শেষ পর্যন্ত আমি বৌদির কথা অমান্য করে দোলনকে
জানানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।
খবরটা শুনে দোলনও বেশ অবাক হলো। একটু গম্ভীর হয়ে উঠলো ও। কিন্তু আমাকে সে আশ্বাস
দিলো, বললো কোন চিন্তা না করতে। ও বললো, বৌদি যখন ডেকেছে আমার যাওয়া উচিৎ। তবে উনি
ভালো বলুক আর মন্দ বলুক তা নিয়ে আমাকে মাথা না ঘামাতে। আমি যেন মোটেও বিচলিত না হই
সেই ব্যাপারে পই পই করে বলে দিল। আমার খুবই ভয় করছিল। লজ্জাও লাগছিল। বার বার চোখে
ভেসে উঠছিল সেদিন বিকেলে ওদের ছাদের উপরে দেখা সাদা ধপধপে ঐ শনচুলো বুড়িটার অগ্নি
দৃষ্টিকেই। না জানি কি লাগিয়েছে বুড়িটা দোলনের বৌদিকে। দোলনের কাছে জেনেছি উনি
দোলনের বিধবা পিসিমা। ১৩ বছর বয়সে বিধবা হয়ে এ বাড়িতেই কাটিয়েছেন তার সারাটা জীবন।
ভীষণ বদরাগী আর সনাতনী উনি। সেদিন বিকেলে দোলনের এক গাদা বন্ধু বান্ধবের হুল্লোড়
উনার মোটেও পছন্দ হয়নি। বলতে গেলে ভেজা কাপড়েই নাকি থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ
করেন।ওতেই উনার মানসিক শান্তি। আত্মার পরিশুদ্ধ হয়।
সে যাই হোক, সকল লজ্জা ভয় কাটিয়ে পরবর্তী ছুটির দিনে আমি
দোলনের সাথেই ওদের বাড়িতে গেলাম। দোলন বসে রইলো বারবাড়িতে। আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন
এক পুরোনো ঝি গোছের কেউ একজন। তখন ভর দুপুর। সারাবাড়ি খা খা করছিল কি এক আশ্চর্য্য
মৌনতায়। চারিদিকে শানশান শূন্যতা। অথচ দুদিন আগেও যখন এ বাড়ি ঘুরে গেলাম সারা বাড়ি
গমগম করছিল অতিথি অভ্যাগত এবং এ বাড়ির সকল বাসিন্দাদের পদচারনায়। আজ এই ভর দুপুর
বলেই কিনা জানিনা সবাই হয়তো রেস্ট নিচ্ছেন যার যার ঘরে তবু এক মহা শূন্যতা ঘিরে ছিল
বাড়িটাকে। ঝি টি আমাকে সোজা বৌদির শোবার ঘরে দরজায় নিয়ে গেল।
দরজায় টোকা দিতেই বৌদি বললেন, ‘ওকে ভেতরে পাঠিয়ে দে আর তুই
জলখাবার নিয়ে আয় মেয়েটার জন্য। ওর সাথে আমার কথা আছে।’ আমার ভীষণ লজ্জা লাগছিল।
লজ্জায় পা সরছিল না ভেতরে যেতে। ঝি ইশারা করলো। আমি পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম বৌদির
সামনে। বৌদি একটা ছোট নিচু জলচৌকিতে বসে ছিলেন। সুঁচ সুতো এবং একটি কাপড়ে কি যেন
নকশা বুনছিলেন উনি। সে সব পাশে সরিয়ে রেখে আমাকে বসতে বললেন সামনের চেয়ারে। আমার
খুইব অস্বোয়াস্তি হচ্ছিল। আমি জড়সড়ো হয়ে বসলাম। বৌদি বললেন, সহজ হয়ে বসো মেয়ে।
তোমাকে কিছু কথা বলতে ডেকেছি আমি। উনার শান্ত শিষ্ট অদ্ভুত ব্যাঞ্জনাময় স্বরের মাঝে
কি ছিল জানিনা। আমার অন্তর কেঁপে উঠলো। ঘর পোড়া গরু আমি, সিঁদুরে মেঘ দেখলে যে শুধু
ভয় পাই তাইই নয় আমি খুব খেয়াল করেছি আমার জীবনের দুঃসময়ের মুহূর্তগুলোতে আমার খুব
ইনট্যুইশন কাজ করে। আমি বুঝতে পারি ঠিক এর পরবর্তীতে কি ঘটতে যাচ্ছে আমার জীবনে।
আমি নিশ্চিত বুঝে গেলাম বৌদি আসলে কি বলতে ডেকেছেন আমাকে। কি বলতে চান উনি।
যে ঝি টি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল সে একটি ট্রেতে করে নাড়ু, নারকেলের চিড়ে,
নিমকি আরও কি কি যেন নিয়ে এলো। ট্রে টা আমার পাশে নীচু টিপয়ের ওপর রেখে চলে গেল।
বৌদি আমার হাতে একটি সবুজ রঙ পানীয়ের গ্লাস তুলে দিলেন। বললেন, এই নাও কাঁচা আমের
শরবৎ খাও। আমাদের বাগানের আম। খুব ভাল আম। উনি আমার হাতে যে অপূর্ব সুন্দর সবুজ
পান্না রঙের পানীয়ের গ্লাসটি তুলে দিলেন, আমি কিছু না বলে গ্লাসটি হাতে ধরে রইলাম।
উনি বললেন, ‘দেখো তোমাকে আমি আজ এখানে যে কথা বলতে ডেকেছি সে কথা শোনার পর তোমার
ভেতরে কি প্রতিক্রিয়া হবে আমি জানিনা তবে নিশ্চিত ভাবেই আঁচ করতে পারি মোটেও তা
আনন্দের হবে না। তুমি হয়তো অপমানও বোধ করতে পারো। কিন্তু আমার উপদেশ থাকবে তুমি
সেটা করবে না। কারণ এখানে আসলে আমাদের করণীয় খুব একটা কিছু নেই। আমি, তুমি, দোলন
সবাই আমরা নিয়তির হাতে বাঁধা।’
এতগুলি কথা একসাথে বলে থামলেন উনি। আমি স্থির বসে ছিলাম সেই
পান্না সবুজ রং তরলটির দিকে তাকিয়ে। পায়ের নিচে হিম শীতল নকশা কাটা সাদা কালো চেক
বোর্ড ডিজাইনের মেঝে। সেই শীতলতা আমার পা দিয়ে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে উঠছিল তখন। একটি
খুব অজানা শীতল শিরিশিরে অনুভূতি। উনি ফের বলতে শুরু করলেন, ‘দোলনের সাথে যে তোমার
একটি গাঢ় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা আমরা আসলে জানতাম না। সেদিন দোলপূজোর দিনে তুমি
আমাদের এখানে না আসলে হয়তো জানা হতো যখন তখন আর এ ক্ষতিপূরণের সময় থাকতো না।’ চমকে
উঠলাম আমি! ক্ষতি! কি ক্ষতি করেছি আমি তাদের! চোখে ভাসলো ফের সেই শনচুলো বুড়িটার
অগ্নিদৃষ্টি। উনি বলেই চলেছিলেন, ‘আসলে যে সম্পর্কের সুতো ধরে তোমরা আগচ্ছো তা বড়ই
অমজবুত ওও ভুল সূত্র। তোমাদের বয়স কম। এত বিচার বুদ্ধি বিবেচনা যে নেই সে আমি জানি।
তাই তোমাকে এসব বলতে আমার আজ এখানে ডাকা। তুমি বা তোমরা যা ভাবছো তা কখনও কোনদিন এ
বাড়িতে গৃহীত হবে না। কোনভাবেই না। আর আমার দৃঢ় ধারণা তোমার পরিবারও এ সম্পর্কের
স্বীকৃতি দেবেনা। কাজেই এখনও সময় আছে মেয়ে। তুমি এ ভুল করো না। আমিও একটি মেয়ে। আমি
তোমার কষ্ট বুঝি এবং বুঝবোও। তবুও তোমাকে অনুরোধ করছি, এ কষ্ট স্বীকার করে নিয়ে
জীবনের আরও বড় কষ্টকর পথে না হাটার জন্য। কথাগুলো আমি দোলনকেই বলতে পারতাম কিন্তু
দোলনকে না বলে তোমাকে বলার কারণ কি জানো? কারণ মেয়েরাই সব পারে। দোলন হয়তো পারবে না
এ কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে। আর তাই এ কঠিন কাজটি তোমাকেই করতে হবে।’
আমার পায়ের তলায় মাটি দুলছিলো। লজ্জা ক্ষোভ ঘৃনা আর অভিমানে
মাথা ঘুরছিল আমার। তবুও আমি শান্ত থাকলাম। শান্ত থাকার অভিনয় করলাম। এ অভিনয় তো বহু
আগেই শিখে গেছি আমি। সবকিছু শোনার পর গ্লাসটি মেঝের উপরে নামিয়ে রাখলাম আমি আর
তারপর সোজা উঠে হেঁটে বেরিয়ে এলাম। উনি আমাকে ফিরে ডাকলেন না একটাবারও। আমি নিশ্চিত
জানি উনার প্রশ্নবোধ্য চোখ দুটি আমার পিঠে গাঁথা ছিল।
দোলন বাগানেই বসেছিল। আকাশে আসন্ন শীতের বিকেলের সূর্য তখন হেলে পড়েছে। ওদের
বারবাড়ির সিঁড়ি হতে সামনে বিস্তৃত সোজা সরু রাস্তাটি ধরে আমি ওকে কিছু না বলে একা
বেরিয়ে এলাম। পেছনে পড়ে রইলো ইউক্যালিপ্টাসের সারি বাঁধা সরু পথটি।
আমার মাথা কাজ করছিল না তখন। আমি শুধুই সামনে এগুচ্ছিলাম। বেশ কিছু কাঠবেড়ালী এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছিল। আমার এই চরম অপমান ও পরম দুঃখের মুহূর্তেও আমি অবাক হয়ে দেখলাম পথের ধারে যতদূর চোখ যায় বিছানো চাদরের মতো বিস্তৃত লজ্জাবতী গাছ হালকা বেগুনী – গোলাপী রঙের তুলতুলে ঝুরি ঝুরি ফুলে ছেয়ে আছে। কি অপরূপ সৌন্দর্য্য! পৃথিবীতে মানুষ নামক প্রানীদের মাঝে কত জটিলতা, কুটিলতা অথচ প্রকৃতির সৌন্দর্য্যে সে সবের বালাই নেই। কি অপরূপ সৌন্দর্য্য আর মায়া মমতা নিয়ে পথের ধারে পায়ের কাছে পড়ে আছে লজ্জাবতী সজ্জা। অবাক হতে হয়। দোলন হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। আমি বেশ কিছুদূর যেতে ও দৌড়ে এসে আমার হাত ধরলো। জানতে চাইলো কি হয়েছে?
আমি উত্তর দিলাম –
কিছু না...
দূরে কোথাও তখন কোকিল ডাকছিল, কুহু কুহু কুহু কুহু...
আমার মনে তখন...
কি জানি কিসেরও লাগি প্রাণ করে হায় হায় –
পিক কিবা কুঞ্জে কুঞ্জে কুহু হু কুহু হু কুহু হু গায়
আমি হেটঁ চলছিলাম সামনে। গন্তব্যবিহীন, উদ্দেশ্য বিহীন কোথায় চলেছিলাম জানিনা। পথের
উপরে বিশাল একটি গাছ হলুদ হলুদ অপূর্ব ক্ষুদে ফুলে ছেয়েছিল। বাবলাই হবে বোধহয়। দোলন
নিঃশব্দে আমার পাশে পাশে হাঁটছিল। আমি নির্ভয়ে হেঁটে চলছিলাম সেই অজানা অচেনা
রাস্তায়। হয়তো সেদিন দোলন আমার পাশে ছিল তাই সন্ধ্যা হবার পরেও এই অচেনা বনাঞ্চলে
কোন ভয় ছিল না আমার। যদিও আমি জানতাম বাকী জীবনটা এরপর আমার একাই হাঁটতে হবে...
বুকের মধ্যে শূন্যতার কাঁপন। কি এক অজানা ব্যথায় বুক ভেঙ্গে যাচ্ছিল আমার কিন্তু আমি প্রাণপণে চাইছি আমি কোনভাবেই ভেঙ্গে পড়বোনা। কাঁদবোনা আমি। কিছুতেই না...
***