htp://www.somewhereinblog.net/blog/Kanka
একি খেলা আপন সনে
কঙ্কাবতী রাজকন্যা
১
আমার মা ছিলেন অপরূপা সুন্দরী। তার কাঁচা হলুদ মাখা গায়ের রঙ,
বাঁশির মত
টিকালো নাক,
বড় বড় কালো ভ্রমরের মতন চোখ আর এক মাথা কুঁচকুঁচে কালো কোকড়া
চুলের অমন অপরূপা সুন্দরী কোনো রমণী আমি আমার জীবনে আর কোনোদিন কোথাও
কাউকেই দেখিনি। তবে কথায় আছে না
'
অতি বড় সুন্দরী না পায় বর,
অতি বড় ঘরনী
না পায় ঘর,
আমার মায়ের ক্ষেত্রে কথাটা একটু ভিন্নভাবে খেটেছিলো।
অতিরিক্ত সৌন্দর্য্যের কারণে বেশ তাড়াতাড়িই বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো তার। তাও যে
সে বিয়ে নয়,
বেশ ভালো ঘরে বরেই বিয়েটা হয়েছিলো। আমার দাদু সে আমলের বেশ
বনেদী বংশের নামজাদা মানুষই ছিলেন। অর্থ,
সম্পদ,
ধনে মানে প্রতিপত্তিশালী এ
বাড়িতে এমন একটি অতি
রূপবতী বউ যেন সেই বাড়ির শান শওকত চাকচিক্য শতগুণ
বাড়িয়ে দিয়েছিলো। শোনা যায় আমার দাদীও ছিলেন নাকি ডাকের সুন্দরী। ঘটকদের
ঘটকালীর তালিকা খাতায় আমার দাদীর নাম ছিলো এক নাম্বারে। আমার দাদুর বাবা
অর্থাৎ আমার দাদীর শ্বশুরমশাই কনে দেখার দিনে তার গলায় পরানো চিকন সোনার
হার নাকি দেখতেই পাননি তার সোনার বরণ গাত্রবর্ণের কারণে। তবে আমার দাদুর
পাশে দাদী যেমন বেমানান ছিলেন,
আমার বাবার পাশে মা ছিলেন ঠিক তেমনি
বেমানান। দাদা ছিলেন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ।
একমাত্র আবলুশ
রঙের
সাথেই
বুঝি তার
গায়ের রঙের তুলনা চলে। বাবা ছিলেন দাদুর কার্বন কপি।
তো
কোনো এক আলোকিত সন্ধ্যায় সারা পাড়া
কাঁপিয়ে ব্যান্ড পার্টি বাজিয়ে আমার
দাদুর পছন্দে ঘরে নিয়ে আসা হলো আমার মাকে। ঢাকা শহরের ওয়ারীর সেই বনেদী
বাড়িটা আমার স্মৃতিতে বড়ই অনুজ্জ্বল। শুধু মাঝে মাঝে মনে পড়ে বাড়িটার
প্রবেশ মুখে দুটি শ্বেত পাথরের হাতির
মূর্তি
ছিল। আমার শিশুবেলায় প্রায়ই
আমাকে সেই হাতীর পিঠে বসিয়ে দেওয়া হত। সেসব অনেক পরের কথা। এখন
আবার ফিরে
যাই আমার অপরূপা সুন্দরী মায়ের বিয়ের দিনগুলোতে।
তখনকার দিনে বিয়ে
শাদীতে পাত্রীদের মতামত নেবার তেমন প্রচলন ছিলনা হেতু মাকে মায়ের বাবা
মানে আমার নানুমশাই যে বিয়েটা দিয়েছিলেন ভালো ঘর বর দেখে সেই ভালো ঘর মায়ের
পছন্দ হয়েছিলো কিনা জানিনা তবে বর যে পছন্দ হয়নি তা খুব ছেলেবেলার স্মৃতি
হলেও আমার বেশ স্পষ্ট মনে পড়ে। বাবা মায়ের সেই
ঝগড়া বিবাদের কুরুক্ষেত্রের
দিনগুলো মনে পড়লেই আমি আজও বিমর্ষ হয়ে পড়ি। তাই সে সব আমি খুব একটা মনে
আনতে চাইনা। বাবা এবং বাবার বাড়ির কোনকিছুই যে মায়ের পছন্দ না এবং মা এবং
তার নিজের বংশ বা তার বাড়ি যে অনেক উচ্চ এটা
তিনি
উঠতে বসতে দিনে চৌদ্দবার
করে দাদুর বাড়ির সকলকেই বুঝিয়ে দিতেন। আমার দাদী শান্ত শিষ্ট
ও নিরীহ
প্রকৃতির হওয়ায় মায়ের সাথে লাগতেন না সহজে। এমনকি দাদুও আশায় থাকতেন,
অমন
রূপসী মেয়ে কালো বরকে মানাতে হয়তো কিছুদিন সময়ই নেবে। সময়ে সবকিছুই ঠিক হয়ে
যাবে এমনই ধারণা ছিলো তাদের।
কিন্তু তাদের
আশা বিফলে
গেল।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে কোনো এক বর্ষণমুখর
ঘোর সন্ধ্যায়
মায়ের সাথে বাবার
তুমুল ঝগড়ার পরে বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। সেই যে তিনি
নিরুদিষ্ট
হলেন। আর কোনো খবরই পাওয়া গেলো না।
এরপর যখন বাবার খবর পেয়েছিলাম আমরা,
তখন
বুড়িগঙ্গায় অনেক জল বয়ে গেছে। তার সেই পাঁচ বছরের শিশু মেয়েটি তখন কৈশোরে
পা দিয়েছে। বাবা কিভাবে কখন,
ঠিক কোনভাবে দেশ ছেড়ে বিদেশে
পাড়ি জমিয়েছিলেন
সেই খবর বাড়ির কেউ
ঘুণাক্ষরেও জানতে পায়নি। সে যাই
হোক বাবার এই
অন্তর্ধানে দাদু কোথায় নিজের সন্তানকে নিয়ে চিন্তা করবেন তা না উনি চিন্তায়
পড়লেন তার এই অসম্ভব
রূপবতী
আগুনের ফুলকীর মত পুত্রবধূটিকে
নিয়ে। আর আমার
অসম্ভব মুখরা এবং এক কথায় বলতে গেলে চরম বদরাগী মা ঘটনার আকস্মিকতায়
বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। আসলে
এই ঘটনায় সম্ভবত তিনি আত্মবিশ্বাস হারিয়েছিলেন।
হাজার হোক কালো বর পছন্দ না হলেও তাকেও যে কেউ অপছন্দ করে
এবং এক কথায়
বিনা নোটিসে ছেড়েও যেতে পারে,
এটা মনে হয় উনি মানতে পারেননি।
তার
সোনার বরণ কালি
হতে লাগলো। অষ্টপ্রহর গঞ্জনা শুনতে হত যার কাছ থেকে বাড়ির
সকলকে,
সেই মানুষটিই কেমন ম্রীয়মান হয়ে পড়তে লাগলো।
তার কষ্ট সইতে পারলেন
না দাদু। যে মেয়েকে এত ঘটা করে ঘরে এনেছেন তিনি,
তার ভাগ্যে এই লিখন?
নিজেকেই দোষী ভাবতে শুরু করলেন।
তারপর তিনি যা করলেন তা কোন
দিন কোন
কালে এই পৃথিবীতে কোনো বাবা,
কোনো শ্বশুর বা কোনো মানুষ করেছে কিনা জানা
নেই আমার।
তিনি আমার মাকে আবার বিয়ে দিলেন। আমার মা তার কথা বিনা
বাক্যব্যয়ে
মেনে নিলেন। ইগো বা আত্ম অহমিকাতেই হোক তিনি আর তার নিজের
বাড়ি মানে নানুর বাড়িতে এই অবস্থায় ফিরে যেতে চান নি। একদিন সন্ধ্যায় খুব
ধুমধাম করে না হলেও বেশ ঘটা করেই অনুষ্ঠানও হলো সেই বিয়ের। মায়ের সাথে আমিও
চললাম সেই নতুন বাবার বাড়িতে।
আমি তখন নিতান্তই শিশু। সকল ঘটনাই আমার জন্য
ছিলো বেশ মজার ও কৌতুকপূর্ণ!
কিন্তু এই নতুন বাবার বাড়ি যাবার
পরদিন হতেই আমি বুঝে গেলাম আমার জীবনে যে এই নতুন পরিবর্তনটা আসলো তা মোটেই
সুখের নয় বা যে সুখের দিন আমি এ ক'বছর
আনন্দে হেসে খেলে কাটিয়েছি তার
অবসান হলো.....
২
নতুন বাবার বাড়িতে যখন
পৌঁছলাম
তখন বেশ রাত। অবশ্য রওয়ানা দিয়েছিলামও আমরা ও
বাড়ি হতে বেশ দেরী করেই। নয়তো ওয়ারী থেকে ধানমন্ডি কতটুকু আর দূরত্ব ছিল?
তখনকার দিনে আজকের মত এত যানজট তো ছিলো না। সব রাস্তাই ফাঁকা ফাঁকা লাগতো।
গাড়ি ঘোড়াও এমন গিজগিজ করতোনা সারাটা পথ জুড়ে। আমি বসেছিলাম মায়ের পাশ
ঘেঁষেই,
গাড়ির পেছনের সিটে। আমার নতুন বাবা,
মধ্যে মা আর জানালার কাঁচের
ধারে আমি। গাড়িতে চড়লেই আমার সবচাইতে বেশি আনন্দের কাজটাই ছিলো রাস্তা বা
বিপনী বিতানগুলির আলোকসজ্জা দেখা ও তাদের নামগুলো বানান করে করে পড়া।
সিনেমা হলগুলোর সামনে বিশাল বিশাল রঙ্গিন সব ছবি আর তার নাম ধাম পরিচয়
আমাকে এক বিশেষ আনন্দ দিত। সেদিনের ওয়ারী থেকে
ধানমন্ডি ভ্রমনটুকুর অল্প
ঐটুকু পথেই আমি যথারীতি দোকানের আলো আর নামগুলি দেখছিলাম। দেখতে দেখতে কখন
যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম,
জানিনা। আমার বামদিক ছুঁয়ে বসেছিলেন মা। মায়ের নতুন
লাল শাড়ী চোলির জরি,
চুমকীর খসখসে ছোঁয়া এবং বিদেশী পারফিউমের সেই গন্ধের
মাদকতাটা আজও মাঝে মাঝে কোথা থেকে যেন ভেসে আসে। আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়
অতীতের সেই নতুন অধ্যায়ের সূচনার দিনটিতে।
গাড়ি ব্রেক করতেই আমার
ঘুম ছুটে গেলো।
চারিদিকে লোকজন,
উৎসবের রই রই আমেজে ঐ মধ্য রাতেও সরগরম
হয়ে উঠলো চারিপাশ। সবাই নতুন বউকে নিয়ে
ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমার নতুন বাবার
রাশভারী মা ধান দূর্বা দিয়ে বরণ করলেন মাকে। পাও ভিজিয়ে দিলেন দুধ আলতার
গামলায়। আমার দিকে কারো কোনো খোঁজই রইলো
না। হই হই এর মাঝে আমি মায়ের থেকে
বিছিন্ন হয়ে পড়লাম। সবাই এগিয়ে নিয়ে
চললো মাকে। আর আমি হতভম্ভের মত কিছুক্ষণ
একা একা দাঁড়িয়ে রইলাম পিছে। আমার সামনে পড়ে রইলো দুধ আর আলতা মেশানো
অপরূপ সেই শ্বেত পাথরের গামলা। যেই অদ্ভুত সুন্দর পৃথিবীর মায়াময় সেই রঙ
তরলে মা পা ডুবিয়ে চললেন তার নতুন গৃহে। সেই হালকা গোলাপ ছোঁয়া রঙের মোহময়
রঙ্গিন তরল পাত্র তির তির করে কাঁপছিলো তখনও আমার সামনে এক অদ্ভুত
নিসঙ্গতায় আমাকে সঙ্গ দেবার জন্যই মনে হয়।
কিছুক্ষণ
পর বুড়োমত এক লোক আমাকে দেখে হই হই করে উঠলো।
-
আরে কি ব্যপার!
কি সমস্যা এখানে দাঁড়িয়ে কেনো একা তুমি মা?
তোমার মা কোথায়?
কার সাথে এসেছো তুমি?
কোন বাড়ির মেয়ে?
উনার এক গাঁদা প্রশ্নে আর মন খারাপ করা অকারণ অজ্ঞাত কারণে আমি ভ্যা করে কেঁদে
ফেললাম। অনেক কষ্টে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললাম,
-
আমি আমার মায়ের সঙ্গে এসেছি।
উনি উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,
-
আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। মা তো আর হারিয়ে যান নি। চলো চলো ভেতরে চলো। আমি তোমাকে মায়ের
কাছে নিয়ে যাচ্ছি।
উনার
হাত ধরে ভেতর বাড়িতে চললাম আমি। বিশাল ঝাঁড়বাতিওয়ালা বিস্তৃত বসার ঘরের
মাঝে তখন মানুষের ঢল নেমেছে। এত রাত্রিতেও এত আয়োজন!
!
আমি ভড়কে গেলাম। ঘুম
আমার তখন পুরোই ছুটে গিয়েছিলো। দেখলাম মা আর আমার নতুন বাবাকে পাশাপাশি
বসিয়ে নানা বয়সী বিশেষ করে বর্ষীয়সী নারী পুরুষেরা মিষ্টি মুখ করাচ্ছেন।
নানা রকম উপহার দিচ্ছেন। আশীর্বাদ করছেন।
উনি বললেন, কোথায় তোমার মা খুকি? খুঁজে বের করো এখন...
আমি দূর থেকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিলাম মাকে। সাথে সাথে উনার চেহারা গম্ভীর হয়ে
গেলো। উনি আমার হাত ধরে নিয়ে গেলেন কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক দঙ্গল মহিলা, বালিকা
টাইপ মেয়েদের কাছে। ওদের মাঝে মিষ্টি চেহারার এক ২০/২৫ বছরের তরুনীকে ডেকে বললেন,
- এই মেয়েটি নতুন বউমণির আগের পক্ষের মেয়ে। একা একা কাঁদছিলো বাইরে দাঁড়িয়ে। এর
খেয়াল রেখ।
উনার
কথায় মেয়েগুলির মাঝে চাঞ্চল্যটা সেই বয়সেও বেশ খেয়াল করেছিলাম আমি। বুড়ো
লোকটি সরে যেতেই তারা কানাকানি,
ফিসফিস স্বরে নিজেদের মাঝে কি বলাবলি করে
হাসাহাসি করতে শুরু করলো। শুধু মিষ্টি চেহারার সেই মেয়েটি এসে আমার হাত
ধরলো,
বললো তুমি কিছু খাবে?
চলো তোমাকে তোমার ঘরে নিয়ে যাই। ঘুম পেয়েছে
নিশ্চয় তোমার...
আমি কিছু বলার আগেই সে আমাকে হাত ধরে
নিয়ে চললো।
লম্বা করিডোর পেরিয়ে নিয়ে আসলো একটি বন্ধ দরজার সামনে। বন্ধ দরজার গায়ে
কাঁঠের পদ্মফুলের কারুকাজ। এত অদ্ভুত সুন্দর কিন্তু কালো কুঁচকুঁচে সেই
কাঠের দরজাটা দেখেই আমার মনে পড়ে গেলো বাবা মায়ের সেই
দুর্বিষহ
ঝগড়া
বিবাদের দিনগুলোতে বাবাকে দেওয়া মায়ের সেই তীক্ষ্ণ গালমন্দগুলি। যার মাঝে
একটি ছিলো তার ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ
নিয়ে। মা বলতেন আবলুশ কাঠ। আমি নিজেকেই
প্রশ্ন করলাম মনে মনে এটাই কি সেই আবলুসশ কাঠ?
আমার মন হঠাৎ এত দিন পরে বাবার জন্য কেন
যে মুচড়ে উঠলো। ঐ মেয়েটি তাড়া দিলো।
-
যাও যাও তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। ছোট মানুষ এত রাত কি জাগতে পারে?
আমার
বলতে ইচ্ছা হচ্ছিলো,
আমি একা একা ঘুমাতে পারবোনা,
মায়ের কাছে যাবো। কিন্তু
বলতে গিয়েও
মনের কথাটা ঢোক গিলে ফেললাম সাথে সাথেই। আমি বুঝে গেলাম এই
কথা বলার সময় মানে স্থান,
কাল,
পাত্র এখন নয়।
মেয়েটা আমাকে আমার
বিছানা দেখিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে চলে গেলো। আমার রাতের পোষাক বা অন্যান্য
কিছুই আমার সাথে নেই। আমি সেই জরি ঝকমকা জামাটা পরেই নরম তুলো তুলো বিছানার
উপরে বসে রইলাম। বাইরের হট্টগোলের ক্ষীণ
আওয়াজ ভেসে আসছিলো এত দূরেও বন্ধ
দরজা ভেদ করে।
আমার বুকের মাঝে এক অকারণ শূন্যতা হু হু করে উঠলো সব কিছু ছাপিয়ে।
আমি
আকুল হয়ে কাঁদছিলাম।
সেই মধ্যরাতের বদ্ধ ঘরটির দরজা,
জানালা,
দেওয়ালগুলি
নীরব সাক্ষী হয়ে রইলো
১১ বছরের
সেই আমির আকুল কান্নার...
৩
খুব ভোরে ঘুম ভাঙ্গলো আমার। ঘুম ভেঙ্গে চোখ মেলতেই অজানা পরিবেশ,
অচেনা
ঘরের
ছাদ,
দরজা,
জানালা,
আসবাবপত্র এবং দেওয়ালে ঝুলানো বড় বাতি বা
অপরিচিত ফ্যানগুলো দেখে ঠিক মনে করতে খানিকটা সময় লাগলো যে কোথায় আছি আমি।
চারিদিকে শুনশান নীরবতা। মনে হচ্ছিলো কোনো মৃত্যুপুরীতেই বুঝি শুয়ে ছিলাম
এতক্ষণ। এরপর প্রথমেই মনে পড়লো কাল রাতে মায়ের লাল শাড়ি চোলিতে বঁধু সাজা
চেহারাটা। কাল মা যখন সেজেছিলেন আমি খুব অবাক হয়ে দেখছিলাম। এত সুন্দর
লাগছিল মাকে। কিন্তু আজ সকালে সে চেহারা মনে পড়তেই বুকের ভেতরে কোন গোপন
কুঠুরীতে হুহু
করে মন
কেঁদে উঠলো। আমার হঠাৎ মনে হলো মা এই এক রাতেই অনেক দূরে চলে
গেছেন আমার থেকে।
দরজা খুলে খুব সন্তর্পণে লম্বা করিডোর ধরে সোজা
বের হয়ে এলাম বাইরে। অত
ভোর বেলাতেও বাড়ির সদর দরজাটা হাট করে খোলা দেখে
বেশ অবাক হয়েছিলাম। পরে জেনেছিলাম খুব ভোরে ও বাড়ির কাজের লোকজন সবাই উঠে
পড়ে এবং ভোরবেলা জানালা দরজা খোলা এবং সন্ধ্যায় বা রাতে বন্ধ করার
দায়িত্বটাও ওদেরই উপরে থাকে। বড় দরজাটা পেরিয়েই ঘন সবুজ লন। অপরূপ
সব ফুল
ফুটে আছে গাছে গাছে। চেনা অচেনা শিশির ভেজা কোমল ফুলগুলো শুভ্র সুন্দর
স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছিলো। আমি ভেজা ঘাসে পা ফেলে হাঁটছিলাম। এরপর যতদিন ও
বাড়িতে ছিলাম খুব ভোরে উঠে ঐ সবুজ লনটাতে হাঁটার আনন্দটুকু ছিলো আমার
একান্ত ভালো লাগার মুহূর্তটুকু।
বাগানের মাঝে মাঝে পাথরের বেঞ্চ বসানো
ছিলো। আমি গিয়ে তারই একটায় বসলাম। নতুন পরিবেশ,
নতুন একটা আকাশ,
নতুন নতুন
আশপাশের গাছপালা,
প্রাচীর,
গেট। কতক্ষণ
সেখানে বসে ছিলাম জানিনা তবে হঠাৎ
সম্বিৎ ফিরলো কারোর
ডাকে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম কালকে রাতের সেই বুড়ো মত লোকটা।
হাতে
ফুলগাছে পানি দেবার ঝাঁঝরি আর এক গোছা নীল রঙের পাইপ নিয়ে দাঁড়িয়ে
আছে। তিনি বললেন,
-
এত ভোরবেলা জেগে ওঠো তুমি খুকি?
বাহ বেশ ভালো অভ্যাস তো। ভোরের বাতাস
স্বাস্থ্যের
জন্য ভালো।
আমি অবাক হয়ে জিগাসা করলাম তাকে,
-
তুমি কে?
এই বাড়িটা কি তোমার?
উনি জীব কেটে আঁতকে উঠলেন।
বললেন,
-
রাম রাম
!
আমার বাড়ি হতে যাবে কেন
আমি এ বাড়ির বলতে পারো একজন পুরোনো চাকর।
আমি উনার নিজেকে চাকর বলা দেখে আরও অবাক হলাম,
জানতে চাইলাম,
-
চাকর!
উনি আমার জিজ্ঞাসা করার ভাবটা দেখে হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন,
-
চাকরই তো। মানে আমি এ বাড়ির মালী। আজ বহু বছর হলো এখানেই রয়ে গেছি।
ফুলেদের ভালোবাসায় পড়ে গেছি। দেখ
এই বাগানের সব ফুলগুলিকে। কত যত্ন করে
আমি ওদের বড় করে তুলি। ফুলগুলি সব শিশুর মত। এই যে তুমি এখন শিশু। ধীরে
ধীরে বড় হবে। অনেক বড় হবে একদিন
....
উনি আরও কি কি সব বলে যাচ্ছিলেন। আমি উনাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
-
তোমার নাম কি?
সে
বললো,
তার নাম রমেশ। আরও জানালেন আমি যেন তাকে রমেশ চাচা বলে ডাকি। উনি
গাছে পানি দিচ্ছিলেন,
আগাছা পরিষ্কার করছিলেন আর আমি ঘুরে ঘুরে তার সাথে
তার কাজ দেখছিলাম। বাগানের কোনে
এক বিশাল গাছে ফুল ধরে ছিলো বড় বড় অদ্ভুত সুন্দর! আমি জানতে চাইলাম, এগুলো কি ফুল।
উনি জানালেন এই গাছ বেশ দুর্লভ। এই গাছের ফুলকে নাগলিঙ্গম বলে। উনি আরও বললেন,
- দেখেছ খুকি। এই ফুলের মাঝে কেশরগুলো কেমন নাগিনীর ফনার মত বাঁকানো। এই ফুলের অনেক
গুণ। অনেক কদর। উনি একভাবে কথা বলেই যাচ্ছিলেন। এমন সময় কালকে রাতের মিষ্টি চেহারার
সেই মেয়েটি আমাকে ডাকতে এলো,
- ওমা! সারাবাড়ি তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি আর তুমি এখানে? চলো চলো তোমার মা তোমার খোঁজ
করছেন।
"আমার মা" কথাটা কানে যেতেই এক রাশ অভিমান হঠাৎ কই থেকে এসে যে আমার বুকের পাঁজরে
চেপে বসলো! মেয়েটির সাথে আমি গিয়ে দাঁড়ালাম ওদের বিশালাকৃতির ডাইনিং হলে।
মা, নতুন বাবা, নতুন বাবার রাশভারী মা আরও কে কে সব বসেছিলো সেখানে বড় ডাইনিং
টেবিলটা ঘিরে। মায়ের এক পাশের চেয়ারটা খালি ছিলো। হয়তো আমার জন্যই। আমি গিয়ে
দাঁড়ালাম মায়ের পাশ ঘেঁষে। কি সুন্দর একটা মিষ্টি গন্ধ মায়ের গায়ে। কিন্তু অবাক হয়ে
সে বয়সেও লক্ষ্য করলাম, এই গন্ধটা আমার অচেনা। এই অচেনা গন্ধটা এই বাড়ির গন্ধ। এই
বাড়ির ইট কাঠ পাথরের। মনে হলো এই আলাদা রকম গন্ধটা খোদাই করে চিরস্থায়ী বসানো
রয়েছে। মাকে আমার দূরের কেউ মনে হচ্ছিল। এক রাতেই মা যেন অনেকখানি অচেনা হয়ে গেছে।
মা ফিস ফিস করে বললেন,
- কই ছিলে? মুখটা এত শুকনো কেনো? রাতে খাওনি?
এমন করে বললেন যেন কেউ শুনতে না পায়। আমার বুক ফেটে কান্না আসছিলো। অনেক কষ্টে আমি
সে কান্না সামলালাম। চারিদিকে গুরু গম্ভীর থমথমে লাগছিলো। নতুন বাবার মা, মোটা সোটা
ভীষণ গম্ভীর মুখের ঐ মহিলাটা আমাকে একদমই যে পছন্দ করছেন না সে আমাকে আর কারো বলে
দিতে হয়নি। ও বাড়িতে আমার থমথমে পরিবেশের সেই শুরু। আমি যে ও বাড়ির অপাংক্তেয় একজন
তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে ঐ মহিলা ছিলেন একাই একশো। প্রতি পদে পদে উনি
বুঝিয়ে দিতে চাইতেন আমি যেন কখনই এ বাড়ির প্রতি কোনো রকম দাবীই মনের কোনাতেও স্থান
না দেই। ও বাড়ির কোন কিছুর প্রতি দাবী আমার কখনই ছিলো না, করিওনি কোনদিন। শুধুই
নিজের উপর নিজের দাবীটাকেই জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম একটা সময়....
(পর্ব ৪-৬ এখানে)