প্রত্যাশা

জুয়েল রহমান


রতন এবারই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। বাড়ী থেকেই সে ক্লাস করতে যায়। বাসা থেকে হেঁটে যায় সে বড় রাস্তা পর্যন্ত, তারপর ইউনিভার্সিটির বাসে চলে যায় ক্যাম্পাসে। প্রায় তিন মাস হয়ে গেলো সে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু এখনও এক রাতের জন্যও তার হলে থাকা হয়নি। ওর সাথের যারা হলে থাকে তাদের থেকে সে শুনতে পায় রোমাঞ্চ জাগানিয়া হলের দিন রাতের কথা। খুব ইচ্ছে করে তারও হলে থাকতে, কিন্তু বিবিধ কারণে তা সম্ভব নয়।
পরশুদিন ২১শে ফেব্রুয়ারি, ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকবে। ক্লাসের সালাম, বাদল, মামুন লোভ দেখাচ্ছে আগামীকাল রাতে হলে থাকার জন্য। রাতে শহীদ মিনারে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। রতন কখনও রাতে বা ভোরে শহীদ মিনারে বা প্রভাত ফেরীতে যায়নি। রোমাঞ্চের নেশায় মন অস্থির হয়ে উঠল। কিন্তু বাসা থেকে অনুমতি পাওয়া যাবেনা, এটা সে বিলক্ষন জানে। প্রতি ২১শে ফেব্রুয়ারিতে সরকারী দল ও বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে একটা উত্তেজনা বিরাজ করে, কখনও কখনও তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। কাজেই একটা অদৃশ্য ভয় সবসময় কাজ করে, এবং এই ভয়টা অমূলক নয়। যাই হোক রতন রাতের বেলা বাসায় এসে অনেক করে মা বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, কিন্তু লাভ হলনা। শেষমেষ মাকে ধরে বসল, অনেক কষ্টে তাঁকে রাজী করানো গেলো। অতএব বাবাও একসময় রাজী হলেন।


পরের দিন সকালে ব্যাগ নিয়ে বের হল রতন। আজ রাতে সে বাসায় ফিরবেনা। কিন্তু লতার সাথে একটু কথা বলতে মনটা ছটফট করছে। অতএব ক্লাস বাদ, আগে লতা। হাঁটতে হাঁটতে সে চলে গেল লতাদের বাসায়। লতা বাসায় ছিল, দেখা হল, কথা হল। ‘রাতে কিন্তু আমি ফোন করব, পারলে ধরবা। ফোনটা আমি অনেক রাতে করব’, রতন বলল লতাকে। উত্তরে লতা কিছুই বলল না, শুধু নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল। রতন বের হয়ে আসল লতাদের বাসা থেকে। সময় আস্তে আস্তে দুপুরের দিকে গড়াচ্ছে। প্রকৃতিতে শীত বিদায় নিবে নিবে করেও নিচ্ছে না। এক চনমনে মন নিয়ে এই মিঠে আবহাওয়ায় রতন হেঁটে হেঁটে বড় রাস্তার দিকে যাচ্ছে। সেখান থেকে বাসে করে সে যাবে ইউনিভার্সিটিতে। অঞ্চলটাতে এখনও গ্রামীণ ভাব রয়ে গেছে, অদ্ভুত সুন্দর সবুজের ছোঁয়া চারপাশে।
একই স্কুলের একই ক্লাসের এই দুজন পরস্পরকে চেনে সেই ছোট বেলা থেকে। কিন্তু দুজনের দৃষ্টিতে নতুন আলোর বিচ্ছুরণ হয় কলেজে ভর্তি হওয়ার পর। ভিন্ন ভিন্ন কলেজে পড়েছে তারা দুজন। এই দুই বছরে তারা মনের অনেক কাছাকাছি এসেছে কিন্তু মুখ ফুটে একজন আরেকজনকে কিছুই বলেনি। বলা হবে কিনা তা ভবিতব্যই জানে, হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না।


এই মেয়েটির কাছে আসলেই রতনের পুরো অস্তিত্বে সাড়া পরে যায়। আনন্দ হিল্লোলে মন যেন দুলতে থাকে। শুধু পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকা নয়, কুটকুট করে গল্প করা, কোন বই নিয়ে কথা বলা, কখনও হয়ত শুধুই অনুভূতির গভীরে ডুবে যাওয়া। এই মেয়েটির চারপাশে যেন একটা স্বাস্থ্যবান হাওয়া খেলা করে। স্নিগ্ধতার এক ভরা ডালি নিয়ে সে যেন বসে আছে। লতার হাসিও বেশ গম্ভীর ধরণের। কিন্তু সেই হাসিও রতনের পুরো তনুতে যেন বইয়ে দেয় মেঘ মেদুরের বারতার ঘনঘটা। লতার মধ্যে আধুনিকা সাজার কোন ইচ্ছা নেই, কখনও সে ঐভাবে সাজেনি, অন্তত রতন দেখেনি। রতন ধীরে ধীরে নিজেকে চিনতে পারছে, চিনতে পারছে তার স্বরূপ কে। সেই অন্তরের রূপের বহিঃপ্রকাশই হয়তো জাজ্বল্যমান এই লতা। রতন একটু অস্থির টাইপের ছেলে, তার মনে হয় এই অস্থিরতা স্থির করার জন্যই এই মেয়েটা। জল ভরা পোয়াতি মেঘগুলো যেমন অচল, অটল পাহাড়ে বাধা পেয়ে নিজেকে বিসর্জন দেয়, তেমনি সেও তার অস্থিরতাকে এখানে সঁপে দেয়।


ক্লাস, প্র্যাকটিক্যাল শেষে রতন বাদলের সাথে হলে যায়। ভর্তি হওয়ার সময় সে একবার হলে এসেছিল, কিন্তু তখন কাজ শেষে বারান্দা থেকেই সে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু হলের ভিতরে এতো বড় বাগান সে তখন খেয়াল করেনি। আর এতো এতো নাম না জানা গাছ, কতো ফুল ফুটে আছে দেখে তো সে মুগ্ধ। এই বিপুল সৌন্দর্য তাকে স্তব্ধ করে দেয়, করে তোলে খানিকটা বিষণ্ণ। বেশ কিছুক্ষণ সে বিকালের মরা আলোয় বাগানে ঘুরাঘুরি করে রুমে যায়।
হলে রাতের খাওয়া মোটেই ভাল হল না। বিস্বাদ তরকারির ঝোলে ভাসা কবেকার ভাজা একটুকরা মাছ, পানির মত ফ্যাকাসে ডাল, আর কি একটা বিদঘুটে সবজি। এর চেয়ে ভাল কিছু নাকি এখানে আশা করা বৃথা। মুখ বুজে রতন কোনমতে আধপেটা খেয়ে উঠে পরল। খাওয়া নিয়ে সে খুব একটা চিন্তিত না, তার মাথায় ঘুরছে রাতের অভিযান, আরও গভীর রাতে আরও বড় অভিযান –সেই ফোন। সাড়ে এগারটা নাগাদ তারা পাঁচজন বের হল। শহীদ মিনারের কাছাকাছি হলের অবস্থান। কিন্তু একটু এগুনোর পরই আর সামনে যাওয়া গেলনা। নিরাপত্তা বাহিনী পুরো এলাকা ঘিরে আছে। প্রেসিডেন্ট আসবেন, আসবেন প্রধানমন্ত্রী, তারপর অন্যান্য মন্ত্রী এবং আরও হোমরা-চোমরা।


রতনরা একপাশে অপেক্ষা করে। রাত বারোটা বাজলো প্রেসিডেন্ট আসলেন, শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে চলে গেলেন। তারপর প্রধানমন্ত্রী আসলেন, কিন্তু ওনার আসার সময়ই কেমন একটা অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায়। রতন এবং তার বন্ধুরা একটু ভয় পেয়ে যায়। এর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী ফুল দিয়ে চলে গেলেন। উনিও চলে গেলেন আর সাথে সাথে চারদিকে শুরু হল প্রচণ্ড হট্টগোল, সম্ভবত টিয়ারসেলও নিক্ষেপ করা হল। রতন বুঝতে পারেনা কি করবে, তার চোখেমুখে প্রচণ্ড জ্বালা এবং কাশি। এর মধ্যেই এক বন্ধু বলে উঠল চল ওই হলে যাই। আর কোন কথা নেই তারা পাঁচজন অন্ধের মত ছুটতে থাকে। যেদিকে তারা এল এটা তাদের হলের সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে। এখন আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ পুরো এলাকা সিল করে দেয়া হয়েছে। এই ডামাডোলে সময় এখন রাত দেড়টা। রতনকে ফোন করতে হবে, আর সব উল্টাপাল্টা হয়ে গেলেও এটা সে ভুলেনি, ফোন তাকে করতেই হবে।


হেঁটে হেঁটে তারা পৌঁছে গেল আরেক হলে। হলের ভিতরে ঢুকতেই ডান পাশে চোখে পরল এই মুহূর্তের চরম আরাধ্য বস্তুটি - রং উঠা, ক্ষয়ে যাওয়া, প্রাচীন এবং নিষ্প্রাণ কয়েন বক্সটিকে। রতনের পকেটে আছে সিকি আর আধুলি, এগুলি সে আগেই সংগ্রহ করেছিল।
অন্য বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সে এগিয়ে যায় বক্সটির দিকে। কিন্তু অস্বস্তি যে চরমে উঠল, এতো রাতে ফোন করা কি ঠিক হবে? রতন বলেছিল ফোন করবে কিন্তু লতা তো কিছু বলে নাই। এই মেয়ে তো সহজে কোন কিছু বলেনা। ও যদি এখন প্রত্যাশা নিয়ে জেগে থাকে, হয়তো বসে আছে ফোনের পাশে। প্রত্যাশা! এই মুহূর্তের কি বিশাল একটা শক্তিধর শব্দ। মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত নরনারীর অদৃশ্য দৃষ্টি এখন শুধুমাত্র এইখানে নিবদ্ধ, সবাই কায়মনো বাক্যে একটা ফোনের প্রার্থনা করছে।
কিন্তু ফোন যদি না ধরে, যদি লতা জেগে না থাকে? প্রত্যাশায় ফুলে ফেঁপে উঠা বেলুনটা মুহূর্তেই হয়তো বুদ্বুদের মত মিলিয়ে যাবে। নিবিড় আশা ভঙ্গের বেদনায় নীল হয়ে যাবে রতন। ফোন না করলে কি হবে? রতন ফিরে আসে, কিন্তু না সে আবার এগিয়ে যায়। এটা শেষ না করা পর্যন্ত সে স্বস্তি পাবেনা, ভিতরে ঘুন পোকা তার অস্তিত্বকে আঁচড়াতে থাকবে। যা হবার হবে ভেবে সে রিসিভারটা তুলে নেয়, কয়েন ঠেলে দেয় আর ফোনটা হয়ে উঠে জীবন্ত। রতন কাঁপা কাঁপা হাতে নম্বরগুলো ঘুরাতে থাকে, আর সেই সাথে দুলতে থাকে তার মন, একবার এদিক, একবার ওদিক। অবশেষে নম্বর ঘুরানোর পালা সাঙ্গ হল, ওপাশে রিং হচ্ছে। প্রত্যাশার পারদটাও সমস্ত পূর্বাভাসকে মিথ্যা প্রমাণ করে তর তর করে ব্যারোমিটারের শেষ ঘরটাকেও ঠেলে উপরে উঠে যাচ্ছে।
মাত্র চার বার রিং হতেই লতা ফোন ধরল। হ্যালো শব্দ শুনতেই রতনের পুরো শরীর যেন কুয়াশার মত বাষ্প হয়ে উঠল। মনে হচ্ছে তার চারপাশে কিছুই নাই, এক অপার্থিব পরিবেশে সে ভেসে বেড়াচ্ছে। গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছেনা, হাঁসফাঁশ করতে থাকে রতন। স্বাভাবিক হতে যেন কয়েক যুগ লেগে গেল। অবশেষে সে বলতে পারল, ‘তুমি এখনও জেগে আছ!’। লতার উত্তর, ‘তুমি তো বলে গেলা অনেক রাতে ফোন করবা’। আহ কি শান্তি, এই শান্তির নাম কি? মনে হয় যা পাওয়ার যোগ্য সে নয় তাই সে পেয়েছে। ঐ কণ্ঠে আছে বিশ্বাস, আশ্বাস হয়তো নির্ভরতাও। আর এই মুহূর্তটিকে আমার শুধু আমার করে নেয়ার বোধের অতীত এক তীব্র অনুভূতিতে রতনের সমগ্র সত্তা আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কয়েকটি কথাই সে বলতে পারল, অথচ কতো কিছু বলবে বলে সে ভেবে রেখেছিল, কিছুই মনে পরলনা। রিসিভার কানে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। লতাকে বলল যে সে কিছুই বলতে পারছেনা, অতঃপর ফোন রেখে দিল।
তীব্র এক ক্লান্তি গ্রাস করল তাকে, সেই ক্লান্তির মধ্যে নেই কোন ক্লেদাক্ত অনুভূতি বরং আছে স্নিগ্ধ জলে ডুবে যাওয়ার এক স্বর্গীয় অনুভূতি। রতন ধীরে ধীরে হলের বাগানে নেমে যায়। পুরানো কাস্তের মত ক্ষয়ে যাওয়া ক্রমান্বয়ে বিলীয়মান ঘোলাটে চাঁদ পশ্চিম আকাশে হেলে পরেছে। বাতাসে একটু হিমেল ভাব, বিশাল বাগানের এখানে ওখানে অন্ধকারের ছোপ, লাইটপোস্টের আলো সেগুলোকে দূর করতে পারেনি।


সময়ের মহাসমুদ্রে তার এই অতি অতি ক্ষুদ্র আবর্তনের কোন মূল্যই নেই, কোন আন্দোলনও এখানে সৃষ্টি হবেনা। কিন্তু রতনের কাছে এই অনুভূতি প্রবাল ভাবে জান্তব। কালের পরিক্রমায় একসময় সে বুড়ো হয়ে যাবে। হয়তো এই মেয়েটির সাথেই সে বাঁচবে। কোন এক গভীর রাতের হিমেল বারান্দায় দুজনে পাশাপাশি বসে এই ঘটনার স্মৃতি চারণ করবে, আর স্মিত হাসিতে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকবে।
আর কি হতে পারে?
এই মেয়েটি তার সাথে নাও থাকতে পারে।

***