নব আলোকে বাংলা

উত্তরাধিকার। অঙ্গীকার। দূরদৃষ্টি।

সম্পাদক


সুপ্রতীক অরূপ ঘোষ

 

পাঠক পরিষদঃ চঞ্চল চৌধুরী, শুভলগ্না শোয়ারা

 

প্রকাশকালঃ ২৬শে নভেম্বর ২০২০

টরোন্টো, কানাডা

 

*

*

 

এবারের প্রকাশনা

 

চতুর্দশপদী কবিতা - সনেট



*

সূচিপত্র

সনেট কেন চতুর্দশপদী      প্রমথ চৌধুরী
একদিন     প্রমথ চৌধুরী
সনেট ও ‘চতুর্দশপদী কবিতা’    শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য
আধুনিক বাংলা ছন্দ – পেত্রার্কার সনেটাদর্শ    অধ্যাপক নীলরতন সেন
সোনালি কাবিন – ৮   আল মাহমুদ
বিজয়া দশমী    মাইকেল মধুসূদন দত্ত
সোনালি কাবিন – ১২   আল মাহমুদ
সুখ – ৬   এ টি এম মোস্তফা কামাল
রোমন্থন      সজল শর্মা
সুখ – ৩    এ টি এম মোস্তফা কামাল
সুখ – ৮     এ টি এম মোস্তফা কামাল
মিত্রাক্ষর    মাইকেল মধুসূদন দত্ত
চুম্বন    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শত নাগিনীর পাকে    অক্ষয় কুমার বড়াল
অদ্ভুত অভিসার    দেবেন্দ্রনাথ সেন
হৃদয় সমুদ্র সম    অক্ষয় কুমার বড়াল
সুখ-৯    এ টি এম মোস্তফা কামাল
শৃঙ্গার -রস    শ্রী মধুসূদন দত্ত
উত্তর সাধক     শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য

*

*

*

সনেট কেন চতুর্দশপদী   - প্রমথ চৌধুরী


চৌদ্দ কেন? এ –প্রশ্নে সনেটের মতো বাংলা পয়ার সম্বন্ধেও জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে। এর একটি সমস্যার মীমাংসা করতে পারলে অপরটির মীমাংসার পথে আমরা অনেকটা অগ্রসর হতে পারব।
আমার বিশ্বাস, বাংলা পয়ারের প্রতি চরণে অক্ষরের সংখ্যা চতুর্দশ হবার একমাত্র কারণ এই যে, বাংলা ভাষায় প্রচলিত অধিকাংশ শব্দ হয় তিন অক্ষরের নয় চার অক্ষরের। পাঁচ –ছয় অক্ষরের শব্দ প্রায়ই হয় সংস্কৃত নয় বিদেশী। সুতরাং সাত অক্ষরের কমে সকল সময়ে দুটি শব্দের একত্র সমাবেশের সুবিধে হয় না। সেই সাতকে দ্বিগুন করে নিলেই শ্লোকের প্রতি চরণ যথেষ্ট প্রশস্ত হয়, এবং অধিকাংশ প্রচলিত শব্দই ঐ চৌদ্দ অক্ষরের মধ্যেই খাপ খেয়ে যায়। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, আমাদের ভাষায় দু’অক্ষরের শব্দের সংখ্যাও কিছু কম নয়। কিন্তু সে সকল শব্দকে চার অক্ষরের শব্দের শামিল ধরে নেওয়া যেতে পারে, যেহেতু দুই স্বভাবতই চারের অন্তর্ভুক্ত।
এই চৌদ্দ অক্ষর থাকবার দরুনই বাংলা ভাষায় কবিতা লেখার পক্ষে পয়ারই সর্বপেক্ষা প্রশস্ত। একটানা লম্বা কিছু লিখতে হলে, অর্থাৎ যাতে অনেক কথা বলতে হবে এমন কোন রচনা করতে গেলে, বাঙালি কবিদের পয়ারের আশ্রয় অবলম্বন ছাড়া উপায়ন্তর নেই। কৃত্তিবাস থেকে আরম্ভ করে শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত বাংলার কাব্যনাটক রচয়িতা মাত্রই পূর্বোক্ত কারণে অসংখ্য পয়ার লিখতে বাধ্য হয়েছেন এবং চিরদিনের জন্য বাঙ্গালির প্রতিভা ঐ পয়ারের চরণের উপরেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে রয়েছে।
পয়ারে চতুর্দশ অক্ষরের মত সনেট চতুর্দশ পদের একত্র সংঘটন, আমার বিশ্বাস, অনেকটা একই কারণে একই রকমের যোগাযোগে সিদ্ধ হয়েছে।
বোধ হয় সকলেই অবগত আছেন যে, জীবজগৎ এবং কাব্য জগতের ক্রমোন্নতির নিয়ম পরস্পরবিরুদ্ধ। জীব উন্নতির সোপানে ওঠবার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গেই তার ক্রমিক পদলোপ হয়, কিন্তু কবিতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পদবৃদ্ধি হয়। পদ্য দুটি চরণ নিয়েই জন্মগ্রহণ করে; দ্বিপদীই হচ্ছে সকল দেশে সকল ভাষার আদি ছন্দ। কলিযুগের ধর্মের মতো, অর্থাৎ বকের মতো, কবিতা এক পায়ে দাঁড়াতে পারেনা।

এই দ্বিপদী হতেই কাব্যজগতের উন্নতির দ্বিতীয় স্তরে ত্রিপদীর আবির্ভাব হয়, এবং ত্রিপদী কালক্রমে চতুষ্পদীতে পরিণত হয়। কবিতার পদবৃদ্ধির এই শেষ সীমা।

কেন?
সে কথাটা একটু বুঝিয়ে বলা আবশ্যক। আমরা যখন মিল –প্রধান সনেটের গঠনরহস্য উদঘাটন করতে বসেছি, তখন মিত্রাক্ষর যুক্ত দ্বিপদী ত্রিপদী ও চতুষ্পদীর আকৃতির আলোচনা করাটাই আমাদের পক্ষে সংগত হবে। অমিত্রাক্ষর কবিতা কামচারী, চরণের সংখ্যাবিশেষের উপর তার কোন নির্ভর নেই, তাই কোনরূপ অংকের ভিতর তাকে আবদ্ধ রাখার জো নেই।
দ্বিপদীর চরণ দুটি পাশাপাশি মিলে যায়। ত্রিপদীর প্রথম দুটি চরণ দ্বিপদীর মতো পাশাপাশি মেলে, তৃতীয় চরণটির অপর –একটির চরণের অভাবে আলগা ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে এবং অপর একটি ত্রিপদীর সান্নিধ্য লাভ করলে তার তৃতীয় চরণের সঙ্গে মিত্রতাবন্ধনে আবদ্ধ হয়। বাংলা সংস্কৃত ইংরেজী এবং ফরাসী ভাষায় ত্রিপদীর আকৃতি ও প্রকৃতি এইরূপ, কিন্তু ইতালীয় ত্রিপদীর (Tereza rima) গঠন স্বতন্ত্র।

ইতালীয় ত্রিপদীর প্রথম চরণের সহিত তৃতীয় চরণের মিল হয়ে এবং দ্বিতীয় চরণ মিলের জন্য পরবর্তী ত্রিপদীর প্রথম চরণের অপেক্ষা রাখে। ইতালীয় ত্রিপদী তিন চরণেই সম্পূর্ণ। ভাব এবং অর্থ বিষয়ে একটির সহিত অপরটি পৃথক এবং বিচ্ছিন্ন পূর্বাপরযোগ্য কেবলমাত্র মিলসূত্রে রক্ষিত হয়। একটি কবিতার ভিতর, তা যতই বড় হোক না কেন সে যোগের কোথাও বিচ্ছেদ নেই। প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত একটি কবিতার অন্তর্ভুক্ত ত্রিপদীগুলি এই মিলনসূত্রে গ্রথিত, এবং ইস্ক্রুর পাকের ন্যায় পরস্পরযুক্ত। রবার্ট ব্রাউন রচিত The Statue and The Bust নামক কবিতা হতে ইতালীয় ত্রিপদীর নমুনাস্বরূপ ছয়টি চরণ উদ্ধৃত করে দিচ্ছি। পাঠক দেখতে পাবেন যে, প্রথম ত্রিপদীর মধ্যম চরণটির মিলের জন্য দ্বিতীয় ত্রিপদীর প্রথম চরণের অপেক্ষা রাখে –

Ther’s a palace in Florence, the world knows well,
And a statue watches it form the square
And this story of both do our townsmen tell,
Ages ago, a lady there,
At the farthest window facing the East
Asked, ‘Who rides by with the royal air?’

অর্থাৎ ত্রিপদীর বিশেষত্ব হচ্ছে, দুটি চরণ পাশাপাশি না মিলে মধ্যস্থ একটি কিংবা দুটি চরণ ডিঙ্গিয়ে মেলে। ত্রিপদীর এই মিলের ক্ষণিক বিচ্ছেদ রক্ষা করে চারটি চরণের মধ্যে দু-জোড়া মিলকে স্থান দেবার ইচ্ছে থেকেই চতুষ্পদীর জন্ম। দুটি দ্বিপদী পাশাপাশি বসিয়ে দিলে চতুষ্পদী হয়না। চতুষ্পদীতে প্রথম চরণ হয় তৃতীয় চরণের সঙ্গে নয় চতুর্থ চরণের সঙ্গে মেলে, আর দ্বিতীয় চরণ হয় তৃতীয় নয় চতুর্থের সঙ্গে মেলে। এক কথায় চতুষ্পদীর আকৃতি দ্বিপদীর এবং প্রকৃতি ত্রিপদীর।

আমি পূর্বেই বলেছি যে, দ্বিপদী ত্রিপদী ও চতুষ্পদীই পদ্যের মূল উপাদান। বাদবাকি যত প্রকার পদ্যের আকার দেখতে পাওয়া যায়, সেসবই দ্বিপদী, ত্রিপদী এবং চতুষ্পদীকে হয় ভাংচুর করে নয় জোড়াতাড়া দিয়ে গড়া । এই সত্য প্রমাণ করবার জন্য বোধহয় উদাহরণ দেবার আবশ্যক নেই।
কবিতার পূর্ববর্ণিত ত্রিমূর্তির সমন্বয়ে একমূর্তি গড়বার ইচ্ছে থেকেই সনেটের সৃষ্টি। সেই কারণেই সনেট আকৃতিতে সমগ্রতা একাগ্রতা এবং সম্পূর্ণতা লাভ করেছে। ত্রিপদীর সঙ্গে চতুষ্পদীর যোগ করলে সপ্ত পদ পাওয়া যায় এবং সেই সপ্ত পদকে দ্বিগুণিত করে নেওয়াতেই সনেট চতুর্দশ পদ লাভ করেছে। এই চতুর্দশ পদের ভিতর দ্বিপদী ত্রিপদী এবং চতুষ্পদী তিনটিরই স্থান আছে এবং তিনটিই সমান খাপ খেয়ে যায়।

পেত্রার্কার সনেটের অষ্টক পরস্পর মিলিত এবং একাংগীভূত দুটি যমজ চতুষ্পদীর সমষ্টি; এবং প্রতি চতুষ্পদীর অভ্যন্তরে একটি করে আস্ত দ্বিপদী বিদ্যমান। ষষ্ঠকও ঐরূপ দুটি ত্রিপদীর সমষ্টি। ফরাসী সনেটেও ঐ একই নিয়মে গঠিত, উভয়ে ভিতর পার্থক্য শুধু ষষ্ঠকের মিলের বিশিষ্টতায়। ফরাসি ভাষায় ইতালীয় ভাষার ন্যায় পদে পদে ছত্রব্যবধান দিয়ে চরণে চরণে মিলনসাধন করা স্বাভাবিক নয়; সেইজন্য ফরাসি সনেটে ষষ্ঠকের প্রথম দুই চরণ দ্বিপদীর আকার ধারণ করে।
সনেট ত্রিপদী ও চতুষ্পদীর যোগে ও গুণে নিষ্পন্ন হয়েছে বলে চতুর্দশপদী হতে বাধ্য।

*****

***

সনেট ও ‘চতুর্দশপদী কবিতা’
শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য


ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য সাহিত্যের সংস্পর্শে আসিবার ফলে পাশ্চাত্য কাব্যসাহিত্যের যে সকল বিভিন্ন রূপ বাংলা সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করে, সনেট তাহাদের অন্যতম। মধুসূদনই বাংলা সাহিত্যে ইহার বহিরঙ্গ–রূপটির প্রবর্তক; কিন্তু ইহার আত্মাটির মধ্যে যে ইহার বিশিষ্ট পরিচয়টি প্রকাশ পাইয়াছে, তাহা তিনি কতদূর তাঁহার রচিত এই শ্রেণীর কবিতার মধ্যে সঞ্চারিত করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন তাহাই বিচারের বিষয়। কারণ, আত্মার পরিচয়ই যথার্থ পরিচয়, বাহিরের পরিচয়ে যে সৌষ্ঠবই থাকুক, যতক্ষণ পর্যন্ত ইহা আত্মার সঙ্গে যোগ স্থাপন করিয়া উঠিতে না পারিয়াছে, ততদিন পর্যন্ত তাহার কোন মূল্য নাই। বিশেষত বহিরঙ্গগত রূপটির অনুকরণ করা যত সহজ, আন্তরাত্মার সন্ধান পাওয়া তত সহজ নহে; এমনকি,সন্ধান পাওয়া অনেক সময়ে কঠিন না হইলেও ইহাকে দেশান্তরের সমাজ , ভাষা ও রস সংস্কারের মধ্যে আনিয়া প্রতিষ্ঠিত করা সর্বদা সহজ সাধ্য নহে। এক একটি জাতির সুদীর্ঘ রস সংস্কার অনুসরণ করিয়া সাহিত্যের এক একটি রূপের এক একদেশে বিকাশ হইয়া থাকে। প্রাচীন ইতালী জাতির গৌরবময় ঐতিহ্যপূর্ণ রস সংস্কারের ধারা অনুসরণ করিয়া ইহার বিশেষ একটি যুগে ইহার নিজস্ব জাতীয় কবি –চেতনায় সনেটের মত রস –বস্তুর সৃষ্টি হইয়াছিল; ইহার আত্মার প্রতিটি সূক্ষ্মতম শিরা উপশিরা, দেহের প্রত্যকটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সেই জাতির রসলোকে বিধৃত। সুতরাং স্বতন্ত্র পরিবেশে ইহার বহিরঙ্গের অনুকরণ করিতে গিয়া সর্বদাই যে অন্তরাত্মার উপলব্ধি এবং তাহার অভিব্যক্তিও সার্থক হইবে, এমন কথা কল্পনাও করা যায় না।
প্রেম পেত্রার্কীয় সনেটের উপজীব্য। ইউরোপের নবজাগরণের যুগেও ইহার উপর ভিত্তি করিয়াই ইউরোপের বিভিন্ন জাতির সনেট রচিত হইয়াছিল – কিন্তু পেত্রার্কার জীবন ও শিল্পবোধ সকলের ছিল না, থাকিবার কথাও নহে, -সেইজন্য নূতন নূতন যুগে নব নব কবির রচনায় ইহাদের মধ্যে রূপ ও ভাবগত কিছু বৈচিত্র্যো যে সৃষ্টি হইয়াছে, তাহাও অস্বীকার করিবার উপায় নাই। কিন্তু সেইজন্য সর্বদেশেই পেত্রার্কার আদর্শেই সনেট রচিত হইয়াছে এই কথা দাবী করা যায় না।
সনেটের একটি বিশেষ গুন এর গীতি–ধর্মিতা (lyricism), একটি বিশিষ্ট বহিরঙ্গরূপের মধ্যে তাহা সর্বত্র রক্ষা পাইলেও, ইহার যে একটি অপরিহার্য গুণ, ইহা প্রেমভিত্তিক, তাহা রক্ষা না পাইলে, তাহাকে সনেট আক্ষা দেওয়া কতদূর সঙ্গত হয়, তাহা বিবেচনা করিয়া দেখা প্রয়োজন। কোন বিশেষ রচনা চতুর্দশপদী কবিতা হইতে পারে, কিন্তু সেই গুণেই ইহা সনেট হইতে পারে না।
পেত্রার্কার সনেট চিরন্তন মানবের প্রেম–কথা, মধসূদনের ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী তাঁহার নিজস্ব জীবন–কথা।

*****

***

আধুনিক বাংলা ছন্দ – পেত্রার্কার সনেটাদর্শ
অধ্যাপক নীলরতন সেন

পেত্রার্কীয় সনেটে অষ্টকের মাত্র দুটি মিল এবং ষটকের দুটি (বা তিনটি) মিল একটি সুস্পষ্ট ক্রমবিন্যাসে আবর্তিত হবার ফলে ছন্দ ধ্বনিগত এবং ভাবগত বন্ধনমুক্তির একটি পরিপূর্ণতা লক্ষ্য করা যায়। উৎকৃষ্ট পেত্রার্কীয়া সনেট সম্পর্কে ইংরেজ কবি Theodore Watts Dunton যে ছন্দোবদ্ধ সুন্দর সংজ্ঞাটি দিয়েছেন তার অংশ বিশেষ এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে।

Yon silvery billows breaking on the beach
Fall back in foam beneath the star-shine clear,
The while my rhymes are murmuring in your ear
A restless love like that the billows teach ;
For on these sonnet-waves my soul would reach
From its own depths, and rest within you, dear,
As, through the billowy voices yearning here
Great nature strives to find a human speech.
A sonnet is a wave of melody :
For heaving waters of the impassioned soul
A billow of tidal music one and whole
Flows in the “octave,” then returning free,
Its ebbing surges in the “sestet” roll
Back to the depths of Life’s tumultuous sea.

এই কথারই ইংগিত দিতে গিয়ে প্রমথ চৌধুরী তাঁর স্বভাব নিপুণ চটুল ভাষণে বলেছেন, -
ভালবাসি সনেটের কঠিন বন্ধন।
শিল্পী যাহে মুক্তিলভে অপরে ক্রন্দন।।

ইংরেজী কবি ডি. জি. রসেট আদর্শ পেত্রার্কীয় সনেটের এই চতুর্দশপংক্তিক স্বল্পায়তনে ভাব ও ছন্দের বিস্ময়কর প্রকাশাবেগ স্মরণ করেই লিখেছেন –A Sonnet is a moment’s monument.

***

*******

কিছুটা শিথিল পংক্তিমিলে পেত্রার্কীয় আদর্শে রচিত মধুসূদনের একটি উৎকৃষ্ট সনেট বিজয়া–দশমী। শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য তার ‘গীতিকবি শ্রীমধুসূদন’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘বাঙ্গালী জীবনের বিজয়া দশমীর বেদনাটি মধুসূদনের কবিমন গভীরভাবে অভিভূত করিয়াছিল। এ বেদনা যে বাঙ্গালী মাত্রেরই একটি সার্বভৌম বেদনা, তাহা কবি নিজের জীবন সূত্রেই উপলব্ধি করিয়াছিলেন, সেইজন্য যে বেদনার ভাষা নাই, সে বেদনা বুঝাইতে মধুসূদন বিজয়া দশমীর চিত্রটির আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন। বাঙ্গালীর হৃদয়ের মর্মস্থলটুকু যে কি ভাবে মধুসূদন সন্ধান করিয়া লইতে পারিয়াছিলেন, ইহা হইতে সার্থক পরিচয় তাঁহার কাব্যে আর কোথাও পাওয়া যায় না।'

আধুনিক বাংলা ছন্দে অধ্যাপক নীলরতন সেন এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, ‘প্রাচীন এবং মধ্যযুগের পদ্যে আঠারো মাত্রিক পংক্তি বিক্ষিপ্তভাবে কদাচিত ব্যবহৃত হলেও পূর্ণাবয়ব মহা –পয়ারবন্ধের কবিতা ইতিপূর্বে কোনও কবিই রচনা করেননি। এ ছন্দের বাকধর্মী ভাবপ্রকাশক শক্তি সম্পর্কেও ইতিপূর্বে কোন কবিই সচেতন হননি।’ কিন্তু কবি আল মাহমুদ ইতালিয়ান সনেট ও শেক্সপিরিয়ান সনেট –এর রীতিকে অনুসরণ না করে নতুনরূপে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের আঠার মাত্রার পংক্তি রচনা করে অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন তার রচিত ‘সোনালি কাবিন’ গ্রন্থে। এ টি এম মোস্তফা কামালের 'সুখ -৬' ও এমন একটি রচনা।

 

সোনালি কাবিন - ৮
আল মাহমুদ

অঘোর ঘুমের মধ্যে ছুঁয়ে গেছে মনসার কাল
লোহার বাসরে সতী কোন ফাঁকে ঢুকেছে নাগিনী,
আর কোনদিন বলো দেখবো কি নতুন সকাল ?
উষ্ণতার অধীশ্বর যে গোলক ওঠে প্রতিদিনই ।
বিষের আতপে নীল প্রাণাধার করে থরো থরো
আমারে উঠিয়ে নাও হে বেহুলা, শরীরে তোমার,
প্রবল বাহুতে বেঁধে এ-গতর ধরো, সতী ধরো,
তোমার ভাসানে শোবে দেবদ্রোহী ভাটির কুমার ।

কুটিল কালের বিষে প্রাণ যদি শেষ হয়ে আসে,
কুন্তল এলিয়ে কন্যা শুরু করো রোদন পরম ।
মৃত্যুর পিঞ্জর ভেঙে প্রাণপাখি ফিরুক তরাসে
জীবনের স্পর্ধা দেখে নত হোক প্রাণাহরী যম্,
বসন বিদায় করে নেচে ওঠো মরণের পাশে
নিটোল তোমার মুদ্রা পাল্টে দিক বাঁচার নিয়ম ।

***

সোনালি কাবিন -১২
আল মাহমুদ

নদীর সিকস্তী কোনো গ্রামাঞ্চলে মধ্যরাতে কেউ
যেমন শুনতে পেলে অকস্মাৎ‌ জলের জোয়ার,
হাতড়ে তালাশ করে সঙ্গিনীকে, আছে কিনা সেও
যে নারী উন্মুক্ত করে তার ধন-ধান্যের দুয়ার।
অন্ধ আতঙ্কের রাতে ধরো ভদ্রে, আমার এ-হাত
তোমার শরীরে যদি থেকে থাকে শস্যের সুবাস,
খোরাকির শত্রু আনে যত হিংস্র লোভের আঘাত
আমরা ফিরাবো সেই খাদ্যলোভী রাহুর তরাস ।

নদীর চরের প্রতি জলে-খাওয়া ডাঙার কিষাণ
যেমন প্রতিষ্ঠা করে বাজখাই অধিকার তার,
তোমার মস্তকে তেমনি তুলে আছি ন্যায়ের নিশান
দয়া ও দাবিতে দৃঢ় দীপ্তবর্ণ পতাকা আমার;
ফাটানো বিদ্যুতে আজ দেখো চেয়ে কাঁপছে ঈশান
ঝড়ের কসম খেয়ে বলো নারী, বলো তুমি কার ?

***

সুখ -৬
এ টি এম মোস্তফা কামাল

ভাবের সুতায় দেখি ধরা পড়ে কতো আকূলতা,
হৃদয় অতলে ঢাকা ভালো মন্দ যতো আর্তি আছে
বের হতে চায় শুধু কথা হয়ে তুমি এলে কাছে।
আমার জমানো কথা, আসো যদি, শোনাবো সুলতা।
একা একা বলে বলে শিখে রাখি সেই সব কথা;
বিমুগ্ধ মোড়কে ঢাকা কথামালা ভুলে যাই পাছে।
সুখের নরোম ঘুমে ডুবে যাবো, ভেতরে যা আছে
সব যদি বলা যায় একে একে তোমাকে সুলতা।

হঠাৎ জোছনা রাতে তুমি এসে আমার সমুখে
নীরবে দাঁড়ালে আর চোখ তুলে চোখেই তাকালে।
পলকে অনেক কথা বলা হলো, কথা নেই মুখে !
নীরব ভাষায় হলো কথকতা কথার আকালে !
সব কথা বলা হলো ভেবে মন বাজে রিনি ঝিনি!
তুমি গেলে মনে হলো, কী অবাক, কিছুই বলিনি !

***

 

 

বাংলা সনেট রচনার সূত্রপাত হয় ১৮৬০ সালে। অধ্যাপক নীল রতন সেনের আধুনিক বাংলা ছন্দ গ্রন্থে উল্লেখিত, 'মধুসূদন ভবিষ্যদবাণী করেছিলেন, if cultivated by men of genius, our sonnet in time would rival the Italian. – ভাবের দিক দিয়ে মধুসূদন যতিপ্রান্তিক ‘মিত্রাক্ষর’ ছন্দের শৃংখল ছিন্ন করেছেন বটে তবু চোদ্দমাত্রার পয়ার পংক্তিবন্ধ রক্ষা করে চলেছেন। মধুসূদনের আর কোনও কাব্য আদর্শ বা রচনারীতি পরবর্তী কবিরা ঠিক ভাবে অনুকরণ করেন নি। একমাত্র সনেটের ক্ষেত্রেই দেখা যায় তিনি উত্তরসূরীদের মধ্যে আরও প্রাণবন্তভাবে বেঁচে রয়েছেন। সেদিক থেকে বিচারে মধুসূদনের সনেট রচনা বাংলা ছন্দের এবং কাব্যেরও বটে ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।' বর্তমান সময়ের কবিদের মাঝে এ টি এম মোস্তফা কামাল, সজল শর্মার সনেটসমূহ সেই প্রতিভার স্বাক্ষরই বহন করে।

 

সুখ – ৩
এ টি এম মোস্তফা কামাল

দুয়ারে দাঁড়িয়ে তুমি ডেকেছো আমাকে
হাত নেড়ে, সেও অতি সাধারণ নাড়া !
কোমল হাতের এই অমোঘ ইশারা
নিতে পারে সহসাই কতদূর কাকে
সেদিন বুঝেছি আমি। কী যে যাদু থাকে-
তারাও জানে না কিছু, ভুক্তভোগী যারা !
বীজের গভীর বুকে লুকানো যে চারা,
অঙ্কুরিত হয়ে যায় মায়াবী সে ডাকে !

আমি গেছি নিশি পাওয়া মানুষের মতো
তোমার অনেক কাছে, যতোটা পেরেছি।
মাঝে যে দেয়াল ছিলো তুচ্ছ কারণের
মোটেও ভাবিনি আমি, অভাগার মতো
অজানা কারণে শুধু চুটিয়ে হেরেছি;
সুখ তৃষ্ণা এভাবেই মিটেছে মনের !

***

সুখ -৮
এ টি এম মোস্তফা কামাল

কখনো কেঁদোনা মেয়ে তোমাকে বলেছি।
যেদিন তুমি ও আমি গেছি নিধুবনে,
নিশিথের মতো আমি অচেনা হয়েছি !
ঘোর লাগা চোখ ভেসে রঙ লাগে মনে !
ক্ষমা করো চুমু খেয়ে করেছি যে পাপ;
খুলে ফেলা খোঁপা তুমি ইচ্ছে মতো বাঁধো।
তোমার সোহাগী হাতে রাখিনি গোলাপ,
কিছুই বলিনি পাছে দুঃখ পেয়ে কাঁদো।

সেদিন আঘাত দিলে দেখে ভয়ে ভয়ে
নিজেকে বলেছি নিজে, কেঁদোনা, কেঁদোনা !
অনিচ্ছায় কেঁদে ফেলে দেখি সবিস্ময়ে
জল হয়ে গলে গেলো জমাট বেদনা !
সবিনয় স্বীকারোক্তি শোন প্রিয়তমা,
কান্নাটাই শ্রেষ্ঠতম সুখের উপমা !

***

মিত্রাক্ষর ছন্দ সম্পর্কে মধুসূদনের মনোভাব ব্যক্ত করতে গিয়ে শ্রীযুক্ত নীলরতন সেন তার আধুনিক বাংলা ছন্দ গ্রন্থে বলেছেন, ‘মধুসূদন কৈশোরকাল থেকেই এক ভিন্নতর আবহাওয়ায় বড় হয়ে উঠেছেন। দীর্ঘকাল ধরে তিনি শেক্সপীয়র মিল্টনের নাটক কবিতার অনুশীলন করেছেন। ক্লাসিক গ্রীক ল্যাটিন সংস্কৃত কাব্যের রসাস্বাদন করেছেন। প্রাচ্য পাশ্চাত্য ক্লাসিক সাহিত্য এবং Blank -verse ছন্দোবন্ধে মিল্টনের মহিমান্বিত কাব্য পাঠের ফলে, মিত্রাক্ষর ছন্দের পঙক্তি – প্রান্তিক যতি –শৃংখল মোচন করে কাব্যের ভাবমুক্তির পথ প্রশস্ত করতে গিয়ে তিনি এই heroic Blank –verse এর আদর্শ গ্রহণ একান্ত স্বাভাবিক পন্থা রূপেই মনে করেছেন। The words came unsought floating in the stream of inspiration. যতিপ্রান্তিক মিত্রাক্ষর ছন্দকে মধুসূদন যে মনোভাব নিয়ে দেখেছেন একটি সনেটে তা সুন্দর প্রকাশ করেছেন।’

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত পয়ারের সংজ্ঞা নির্দেশে বলেছিলেন, 'আট –ছয় আট –ছয়। পয়ারের ছাঁদ কয়।' পয়ার ছন্দের ওপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ছন্দের অর্থ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘পয়ার ছন্দের বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে, তাকে প্রায় গাঁঠে গাঁঠে ভাগ করা চলে, এবং প্রত্যেক ভাগেই মূল ছন্দের একটা আংশিক রূপ দেখা যায়।' কড়ি ও কোমল কাব্য গ্রন্থের তেমনি একটি সনেট ‘চুম্বন।’ শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য তার গীতিকবি শ্রীমধুসূদন গ্রন্থের ‘উত্তর সাধক’ রচনায় বলেছেন, “রবীন্দ্রনাথ তাঁহার নিজস্ব ভঙ্গিতে মৌলিক প্রতিভার প্রেরণায় যে চতুর্দশপদ বিশিষ্ট কবিতা পরবর্তী কালে রচনা করিয়াছেন, তাহাও যেমন ‘সনেট’ নহে, তেমনই মধুসূদনের আঙ্গিকগত অনুকরণ হইলেও ভাবগত অনুকরণ –জাত রচনাও নহে।  রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা অন্যকে অনুকরণ করিবার প্রতিভাই নহে; সুতরাং রবীন্দ্রনাথের মধ্যে মধুসূদনের ভাবগত প্রভাব অনুসন্ধান করা বৃথা।

 

মিত্রাক্ষর
মাইকেল মধুসূদন দত্ত

বড়ই নিষ্ঠুর আমি ভাবি তারে মনে,
লো ভাষা, পীড়িতে তোমা গড়িল যে আগে
মিত্রাক্ষর রূপ বেড়ি! কত ব্যথা লাগে
পর’ যবে এ নিগড় কোমল চরণে–
স্মরিলে হৃদয় মোর জ্বলি উঠে রাগে !
ছিল না কি ভাব–ধন, কহ, লো ললনে,
মনের ভাণ্ডারে তার, যে মিথ্যা সোহাগে

ভুলাতে তোমারে দিল এ তুচ্ছ ভূষণে?
কি কাজ রঞ্জনে রাঙি কমলের দলে?
নিজ –রূপে শশিকলা উজ্জ্বল আকাশে!
কি কাজ পবিত্রি মন্ত্রে জাহ্নবীর জলে?
কি কাজ সুগন্ধ ঢালি পারিজাত বাসে?
প্রকৃত কবিতা রূপী প্রকৃতির বলে,–
চীন-নারী-সম পদ কেন লৌহ –ফাঁসে?

***

চুম্বন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অধরের কানে যেন অধরের ভাষা।
দোঁহার হৃদয় যেন দোঁহে পান করে।
গৃহ ছেড়ে নিরুদ্দেশ দুটি ভালোবাসা
তীর্থযাত্রা করিয়াছে অধর সংগমে।
দুইটি তরঙ্গ উঠি প্রেমের নিয়মে
ভাঙিয়া মিলিয়া যায়​​ দুইটি অধরে।
ব্যাকুল বাসনা দুটি চাহে পরস্পরে
দেহের সীমায় আসি দুজনের দেখা।
প্রেম লিখিতেছে গান কোমল আখরে
অধরেতে থর থরে চুম্বনের লেখা।
দুখানি অধর হতে কুসুমচয়ন,
মালিকা গাঁথিবে বুঝি ফিরে গিয়ে ঘরে।
দুটি অধরের এই মধুর মিলন
দুইটি হাসির রাঙা বাসরশয়ন॥

***

শ্রী ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তার লেখা দেবেন্দ্রনাথ সেন স্মরণে উল্লেখ করেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতিভায় যখন সকলেই মুগ্ধ ও আত্মবিস্মৃত সেই যুগেও দেবেন্দ্রনাথ স্বকীয় স্বাতন্ত্র্য সম্পূর্ণ বজায় রাখিয়াছেন।’ অপরদিকে শ্রী অধীশ চন্দ্র সাহাও তার ‘দেবেন্দ্রনাথ সেনঃ জীবনী ও কাব্য বিচার’ অভিসন্দর্ভে বলেছেন, “সনেট রচয়িতা রূপে দেবেন্দ্রনাথ বাংলা কাব্যে একটি গৌরবের স্থান অধিকার করে আছেন। তার সমগ্র রচনার অর্ধেকেই চতুর্দশপদী কবিতা। মধুসূদনের চতুর্দশপদী কবিতা এবং রবীন্দ্রনাথের কড়ি ও কোমল কাব্যের সনেটগুলো দেবেন্দ্রনাথ সেনের নিকট আদর্শ রূপে প্রতীয়মান হয়। এছাড়াও দেবেন্দ্রনাথ সেন অক্ষয় কুমারের সনেটের সঙ্গেও পরিচিত ছিলেন। সংখ্যার দিক থেকে দেবেন্দ্রনাথের সমগ্র রচনার অর্ধাংশই সনেট বা সনেট – কল্প চতুর্দশপদী কবিতা।
অক্ষয়কুমারের প্রথম দিকের সনেটগুলির উপজীব্য প্রেম; তাঁর প্রধান কৃতিত্ব এই যে পেত্রার্কা সনেটের দৃঢ় রূপবন্ধের মধ্যে রোমান্টিক প্রেম চেতনার অভিব্যাক্তি যে কত সহজ ও স্বচ্ছন্দে সম্ভব, কয়েকটি চমৎকার সনেট লিখে তিনি তার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। বেদনার গীতোচ্ছ্বাস যে সনেটের সংহত কঠিন কাঠামোর মধ্যে আড়ষ্ট হয় না, বরং ‘শুক্তির মধ্যে মুক্তার মত’ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁর ‘সন্ধ্যায়’ সনেটটি এর প্রকৃষ্ট নিদর্শন।” অক্ষয়কুমারের প্রথম দিকের রচনা ‘হৃদয় সমুদ্র সম’ ও 'শত নাগিনীর পাকে' এবং দেবেন্দ্রনাথ সেনের রচনা ‘অদ্ভুত অভিসার’ চমৎকার  চতুর্দশপদী রচনা।

শত নাগিনীর পাকে
অক্ষয় কুমার বড়াল

শত নাগিনীর পাকে বাঁধ’ বাহু দিয়া
পাকে পাকে ভেঙে যাক্‌ এ মোর শরীর!
এ রুদ্ধ পঞ্জর হ’তে হৃদয় অধীর
পড়ুক ঝাঁপায় তব সর্বাঙ্গ ব্যাপিয়া!
হেরিয়া পূর্ণিমা –শশি টুটিয়া লুটিয়া
ক্ষুভিয়া প্লাবিয়া যথা সমুদ্র অস্থির;
বসন্তে বনান্তে যথা দুরন্ত সমীর
সারা ফুলবন দলি’ নহে তৃপ্ত হিয়া।

এদেহ পাষাণ ভার কর গো অন্তর
হৃদয় -গোমুখি –মাঝে প্রেম –ভাগীরথী,
ক্ষুদ্র অন্ধ পরিসরে ভ্রমি’ নিরন্তর
হতেছে বিকৃত ক্রমে, অপবিত্র অতি।
আলোকে –পুলকে ঝরি, তুলি’ কলস্বর
করুক তোমারে চির স্নিগ্ধ –শুদ্ধমতি!

*** 

অদ্ভুত অভিসার
দেবেন্দ্রনাথ সেন

মাধবের মন্ত্রসিদ্ধ মোহন মুরলী
ধ্বনিল রাধার চিত্ত –নিকুঞ্জ –মোহনে,
অমনি রাধার আত্মা দ্রুত গেল চলি
শ্যামতীর্থে, শ্যামাঙ্গিনী –যমুনা –সদনে!
গেল রাধা; তবে ঐ মন্থর গমনে
মঞ্জুল –বকুল –কুঞ্জে , কে যায় গো চলি?
আকুল দুকূল, ম্লান কুন্তল, কাঁচলি;
ঘুম যেন লেগে আছে নিঝুম লোচনে!

নাহি জ্ঞান, নাহি সাড়া! টানে তরুদল
লুন্ঠিত অঞ্চল ধরি ! মুখ –পদ্মোপরি
উড়িয়া বসিছে অলি গুঞ্জরি গুঞ্জরি;
বিহবলা মেখলা চুম্বে চরণের তল!
আগে আত্মা, পরে দেহ, যাইছে তুহার
রাধিকা রে, বলিহারি তোর অভিসার!

***

হৃদয় সমুদ্র সম
অক্ষয় কুমার বড়াল

হৃদয় সমুদ্র সম আকুলি উচ্ছ্বসি
আছাড়ি ‘পড়িছে আসি’ তব রূপ –কূলে !
হৃদয় পাষান –দ্বার দাও –দাও খুলে।
চিরজন্ম লুটিব কি ও পদ পরশি?
অনুদিন –অনুক্ষণ দুরাশায় শ্বসি
বৃথায় পশিতে চাই ঐ মর্ম –মূলে ।
লক্ষ্যহীন –নেত্রে নারী, সাজি নানা ফুলে,
মরণ –লুন্ঠন হের, -স্থির গর্বে বসি।

কি মমত্বহীন তুমি, রমণী –হৃদয়!
এত বর্ষে, এই স্পর্শে, এ চির –ক্রন্দনে ,
এত ভাষ্যে, এই দাস্যে, এ দৃঢ়বন্ধনে,
দানব সদয় হয়, ব্রহ্মান্ড বিলয়।
বিফল উদ্যম শ্রম, বিক্রম, বিনয় –
নিত্য পরাজিত আমি তোমার চরণে।

***

শ্রী অধীশ চন্দ্র সাহা তার গবেষণা কর্মে আরোও বলেছেন, “অক্ষয় কুমারের হৃদয় সমুদ্র সম কবিতাটি পেত্রার্কা সনেটের আদর্শে রচিত। অষ্টকে যে ভাবের বন্ধন, ষটকে সেই ভাবের মুক্তিলীলা এবং অষ্টক ষটক মিলে একটি পরিপূর্ণ একক ভাবের নিটোল রসরূপায়ন। তবে সর্বত্র কবি এ কৃতিত্ব দেখাতে পারেন নি। ‘তাহার সনেটগুলি ভাবে ও ভাষায় যেমন সুসমৃদ্ধ, গীতিরসে তেমন সমুজ্জ্বল নয়।’[১] আসলে অক্ষয় কুমারের কাব্যপ্রেরণার মধ্যে একপ্রকার অসমতা ছিল। ‘তাঁহার সনেট সমূহে গাঢ়তা ও শিথিলতায় যুগপৎ অবস্থিতিও তাঁহার কাব্য প্রেরণার অসমত্বের পরিচায়ক।[২] দেবেন্দ্রনাথ যখন সনেট রচনায় ব্রতী হন তখন অক্ষয় কুমারের এই সনেটগুলির আদর্শও তাঁর সামনে ছিল। ‘দেবেন্দ্রনাথ সেনের এবং অক্ষয় কুমার বড়ালের চতুর্দশপদীতে পরিণততর রূপ সৌকর্য দেখা গেছে। অবশ্য চতুর্দশপদীর নিখুঁত ভাব –শাসন দেবেন্দ্রনাথের লেখাতেই বেশি চোখে পড়ে।’ [৩]”

[১] মোহিতলাল মজুমদারঃ বাংলা কবিতার ছন্দ
[২] শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা
[৩] হরপ্রসাদ মিত্রঃ সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা ও কাব্যরূপ

***

সুখ-৯
এ টি এম মোস্তফা কামাল

বাবার দোহাই দিয়ে যেদিন অরণি
চলে গেলে বউ হয়ে মাঘের আটাশে,
সেদিন তাকিয়ে দেখি পাখিরাও হাসে;
বেদনার মনিহার গলায় পরোনি।
আমার দুঃখের কথা হিসেব করোনি।
সুখের নেশায় তুমি উড়েছো আকাশে,
পুরনো পালকগুলো পড়েছিলো ঘাসে;
সেসব কিছুই তুমি গোনায় ধরোনি।

অচিরেই ঘোর কেটে গিয়েছে শুনেছি,
চিরকাল ঘোর লাগে কেটে যাবে বলে।
কখন সে দিন আসে প্রহর গুনেছি;
শোনা যায় মুখ ঢেকে সোনালী আঁচলে,
আমার স্মৃতির বুকে ফেল দীর্ঘশ্বাস!
সেটাই আমাকে দেয় সুখের সুবাস !

***

 

উত্তর সাধক
শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য

মধুসূদনের অন্যান্য বিষয়ক রচনার যেমন উত্তর সাধকের সন্ধান পাওয়া যায়, তাঁহার ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’রও উত্তর সাধক আছে। বহিরঙ্গের দিক দিয়াই হউক, কিংবা অন্তঃপ্রকৃতির দিক দিয়াই হউক, তাঁহার ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’র অনেকে অনুকরণ করিয়াছেন। মধুসূদন পয়ারের অনুরূপ চৌদ্দটি অক্ষর যুক্ত পদ অবলম্বন করিয়াই তাঁহার ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ আদ্যোপান্ত রচনা করিয়াছেন। ইহার মধ্যেও মধুসূদনের বিদ্রোহী মনোভাবের পরিবর্তে রক্ষণশীল মনোভাবেরই পরিচয় প্রকাশ পাইয়াছে। ইহাতে পেত্রার্কীয় আদর্শে বাংলা কবিতা রচনা করিতে গিয়াও যে বাংলার প্রচলিত পয়ারের চৌদ্দটি অক্ষরের পদের উপরেই তাঁহার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল, তাহা লক্ষ্য করিবার বিষয়।

উপসংহার

চতুর্দশপদী কবিতা এবং সনেট রচনার ক্ষেত্রে আজ অব্দি বাংলাভাষায় কাব্যরচনার ক্ষেত্রে মধুসূদনের উত্তর সাধক যেমন আছেন, ভবিষ্যতেও তেমন থাকবেন। । বাঙালী কবিমন তার চিন্তায় চেতনায় স্পন্দিত ছন্দের প্রলেপ চৌদ্দ বা আঠারো অক্ষরের মধ্যদিয়ে প্রকাশ করবেন অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সাথেই।

***

 

আর্কাইভ