অসৌন্দর্য কী?

মূলঃ উমোবার্তো একো                      অনুবাদঃ তারিক টুকু

 

[উমবার্তো একো ঔপন্যাসিক, চিহ্নবিজ্ঞানী এবং অধ্যাপক। ‘অন আগলিনেস’ নামে তাঁর সম্পাদনায় একটি প্রবন্ধ-সংকলন থেকে এ লেখাটি নেয়া হয়েছে।]


প্রতিটি শতাব্দীতেই শিল্পী ও দার্শনিকেরা সৌন্দর্যের নানারকম সংজ্ঞা দিয়েছেন। সেই কাজের জন্য তারা ধন্যবাদার্হ যে, এর ফলে সৌন্দর্যের ইতিহাস পর্যায়ক্রমিকভাবে সুগঠিত হয়েছে। কিন্তু অসুন্দর’-এর নিয়ে তাদের তেমন কিছু বলতে দেখা যায়নি। অধিকাংশক্ষেত্রে, অসুন্দরকে সুন্দরের বিপরীত বলেই ভেবে নিয়েছেন তারা। একারণেই অসুন্দর বিষয়ে ক্ষীণাংঙ্গী আকারেরও কোনো গবেষণা পাওয়া যাবে না।

অসৌন্দর্যের যে ইতিহাস, তার সাথে সৌন্দর্যের ইতিহাসের বেশ কিছু চরিত্রগত মিল আছে। প্রথমত, আমরা ধরে নিতে পারি যে, জনমানুষের যে রূচি, তার সাথে ঐ সময়কালের শিল্পীরূচির কিছু সাদৃশ্য আছে। পৃথিবীর বাইরে থেকে কোনো ব্যাক্তি যদি সমসাময়িক আর্ট গ্যাল্যারীগুলো ঘুরে দেখতে এসে প্রথমেই মুখোমুখি হন পিকাসোর আঁকা কোনো নারী-মুখের এবং তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকেরা যদি সেটাকেই প্রশংসা করেন সুন্দর বলে, তবে পিকাসোর আকা নারীদের মতোই হবে পৃথিবীর সুন্দরী নারীরা- এমন একটি বিভ্রম তার মনে গেথে যাবে। কিন্তু তিনি যদি অন্য কোনো ফ্যাশন শো-তো কিংবা মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগীতা দেখে থাকেন, তাহলে তার মনে জায়গা করে নেয়া সৌন্দর্যের সংজ্ঞাটি আরও বিস্তৃত ও পরিবর্তিত হবে।

দূর্ভাগ্যজনকভাবে, আমরা যখন দূর-অতীতের দিকে তাকাই, সুন্দর কিংবা অসুন্দর যাই হোক না কেন; সেটাকে ব্যাখ্যা করার পক্ষে আমরা কোনও উপলদ্ধিতে পৌছাতে পারি না। কেননা, সে সময়ের যা কিছুর সন্ধানই আমরা পাই না কেন, তা আছে মূলত শিল্পবস্তু হিসাবে। আমাদের কাছে এমন কোনো তাত্বিক প্রমাণ নেই, যার সাপেক্ষে এগুলোকে নান্দনিক সৌন্দর্য্য বা ভক্তিবোধ বা শুধু আনন্দ থেকেই উৎসরিত বলে চিহ্নিত করা যায়।

একজন পশ্চিমার পক্ষে, আফ্রিকানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত মুখোশগুলোকে মনে হবে ভয়ংকর। একজন আফ্রিকানের কিন্তু তা মনে হবে না, তার কাছে সেই মুখোশগুলোই হয়ে দাঁড়াবে আরাধনার স্বর্গীয় প্রতীক। আবার অপশ্চিমী কোনো ধর্মে বিশ্বাস করেন, এমন কারো কাছে যিশুখ্রীস্টের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অবমাননার, তার রক্তাক্ত পরিণতির বর্ণনাগুলো ঠেকতে পারে বিরক্তিকর; যদিও সেই অসৌন্দর্যই খ্রীস্টানদের মনে সহানুভূতির উদ্রেক ঘটায়, তাদের আবেগাকুল করে তোলে।

মধ্যযুগে জেমস অব ভিট্রি, ধর্মীয় রচনাগুলোর সৌন্দর্যকে প্রশংসা করতে গিয়ে স্বীকার করেন যে, ‘যাদের একটি মাত্র চোখ ছিল, সেই সাইক্লোপস-রা সম্ভবত দুই চক্ষুওয়ালা প্রানীদের দেখে দারুন আশ্চর্য হতো, যেমন আমরা বিস্মিত হবো একচক্ষু বা তিনচক্ষু বিশিষ্ট কোনো প্রাণীকে দেখলে।’ এর এক শতাব্দী পরে ভল্টেয়ারের লেখায় (তাঁর ফিলসফিক্যাল ডিকশন্যারিতে) দেখতে পাই সেই কথাটিরই অনুরণণ: ‘একটি ব্যাঙ কে জিজ্ঞাসা করো, সত্যিকারের সৌন্দর্য্য কী... ...সে উত্তর দেবে, তার সঙ্গীনির সৌন্দর্যই তার কাছে প্রকৃত সৌন্দর্য্য: তার ছোট্ট মাথার দুইদিকে বসানো বর্তুল চোখ, প্রসারিত গ্রীবা, উদরের হলুদাভা এবং বাদামী পিঠ...। এই প্রশ্নই যদি কোনো প্রেতকে জিজ্ঞাসা করো তবে সে বলবে, ‘সৌন্দর্য্য একজোড়া শিং, তীক্ষ্ণ নখর ও একটি লেজের এক সমন্বিত রূপ’!

সুন্দর কিংবা অসুন্দর যার উপরই কোনো বৈশিষ্ট্য আরোপ করা হয় না কেন, তা আসলে কোনো নান্দনিক বিচার থেকে আসে না, আসে সমাজ-রাজনীতির নানারকম আচার থেকে। তার একটি অনুচ্ছেদে কার্ল মার্কস, অর্থ কীভাবে অসুন্দরের পক্ষে গান গায়,সে বিষয়ে লিখেছিলেন, ‘যেহেতু অর্থ দিয়ে যে কোনও কিছুই কিনে নেয়া, মালিক হওয়া সম্ভব সেহেতু, এটি এমন বস্তু যার মূল্য অনেক।... আমি যতটুকু অর্থের মালিক, আমার ক্ষমতা ততটুকুই। আমি কে এবং আমার পক্ষে কী কী করা সম্ভব তা আসলে আমার ব্যাক্তিত্ব নির্ধারণ করে দেয় না। আমি অসুন্দর কিন্তু এই অর্থের বলেই আমার পক্ষে যে কোনো সুন্দরীকে একরকম কিনে নেয়া সম্ভব। এর অর্থ, আমি আসলে কুশ্রী নই; কেননা, কুশ্রীতার ফলাফল, এর হীনমন্যতা, এই সবকিছুই অর্থের ক্ষমতার কাছে অকার্যকর হয়ে যায়। ’

সুতুরাং, অসুন্দর কি শুধুই সৌন্দর্য্যরে বিপরীত দিক? অসৌন্দর্য্যের ইতিহাস শুধুই কি কেবল সৌন্দর্য্যরে ইতিহাস নামক মসৃণ মুদ্রার উল্টোপিঠ? অসুন্দরের ইতিহাস রচনার সময় আমাদের তাই সতর্ক হতে হবে। মনে রাখতে হবে ম্যাকবেথের ডাকীনিদের সেই আয়রনি ‘ সুন্দরই কদর্য, আর কদর্যতাই সৌন্দর্য্য’!