আমেরিকার এপার ওপার

রাগিব হাসান

 

ragibhasan@gmail.com                http://www.ragibhasan.com/

 

যাত্রা হলো শুরু


গুগলের হেড কোয়ার্টার সিলিকন ভ্যালির কেন্দ্রের মাউন্টেইন ভিউ শহরে, ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের উত্তর দিকে, সান ফ্রান্সিস্কোর অদূরে। আর আমার বিশ্ববিদ্যালয় হলো ইলিনয়ের আরবানা-শ্যাম্পেইন শহরে, যা মিডওয়েস্টে পড়ে। এটা হলো শিকাগোর ২০০ মাইল দক্ষিণে। ম্যাপে আমার যাত্রা পথ দেখতে পাবেন, মোট পথ হলো ২২০০ মাইলের মতো।

পথে আমরা পেরিয়েছি ৫টা স্টেট। ইলিনয়ের পরে আইওয়া, নেব্রাস্কা, ওয়াইওমিং, ইউটাহ, নেভাডা, তার পরেই ক্যালিফোর্নিয়া। এর মধ্যে শুরুর স্টেট গুলো বেশ সমতল, উঁচু নিচু নেই একেবারেই। কিন্তু ওয়াইওমিং থেকে শুরু হয় প্রচন্ড খাড়া পর্বত। এর মধ্যেই ৬০-৭০ মাইল গতিতে গাড়ি চালাতে হয়।

যাত্রা শুরুর প্ল্যান ছিলো সকালে। কিন্তু আরবানা শ্যাম্পেইনে আমাদের বিশাল সংসার। মানে, বাসাটা ছোট্ট, কিন্তু আমার স্ত্রী জারিয়া বাংলাদেশ ও দুনিয়ার আরো অনেক দেশের হস্তশিল্পের জিনিষ দিয়ে মনের মতো ঘর সাজিয়েছে। তাই অন্যদের মতো গ্রীষ্মের এই তিন মাস সাবলেট দেয়া সম্ভব ছিলো না।  আসার আগে যদ্দুর সম্ভব ঘরের সবকিছু বেঁধেছেদে আসলাম আমরা, সব করতে করতে বিকাল ৩টা বেজে গেলো।

আমার গাড়িটা পুরনো হলেও ইঞ্জিন বেজায় ভালো। গুগলে ইন্টার্নশিপ ঠিক হওয়ার সময়ই সিদ্ধান্ত নেই, পুরো পথ ড্রাইভ করে যাবো। অনেক ভোগান্তি হলেও এটা পুরা জীবনের মতো একটা অভিজ্ঞতা - একটা মহাদেশ পাড়ি দেয়া! যথারীতি বাংলাদেশী "অভিজ্ঞ" ভাইয়েরা হাইকোর্ট দেখানো শুরু করলো, এতোটা পথ পাড়ি দিতে গিয়ে আমরা মরুভূমিতে আটকা পড়বো আমার পুরানো গাড়ি বিকল হয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি। (এখন সেই "বিশেষ-অজ্ঞ"দের চেহারা দেখা দরকার!!)। কিন্তু আশা দিলেন প্রফেসর সালিম রশিদ ... উনি বললেন, এরকম একটা অভিযাত্রা উনারো স্বপ্ন ছিলো, কিন্তু বাচ্চাদের জন্মের পরে আর হয়ে উঠেনি। তাই সময় থাকতে সাহস করে রওনা দিয়ে দেয়াটাই ভালো।

যাহোক, বিকেল তিনটাতে যাত্রা শুরু করলাম। আমেরিকার যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত চমৎকার। হাইওয়েগুলো ইন্টারস্টেইট নামে পরিচিত, শুধু নির্দিষ্ট জায়গা বা এক্সিট দিয়েই এখানে ঢোকা যায়। হাইওয়েতে সব গাড়িই অন্তত ৬০ হতে ৭৫ মাইল (১০০ হতে ১২০ কিমি/ঘন্টা) বেগে চলে। তবে রাস্তা এতোই মসৃন যে, মোটেও টের পাওয়া যায়না।

তিন মাসের নতুন সংসার পাতার জন্য আমরা এটা সেটা নিতে নিতেই গাড়ির ট্রাঙ্ক আর পিছনের সীট ভরে গেছে পুরাপুরি। আমি ড্রাইভিং শিখেছি আমেরিকাতে এসেই, নিজে গাড়ি কিনে তার পর। শিকাগো গেছি অনেক বার, কিন্তু সেটা মাত্র ১৬০ মাইলের পথ। আর এখানে আমি পাড়ি দিবো তার ১৫ গুণ পথ।

যাহোক, আরবানা থেকে আইওয়ার পথে চললাম। বিস্তির্ণ পথ, দুই পাশে ভুট্টা আর সয়াবীন ক্ষেত। ইলিনয় পুরাটাই চ্যাপ্টা একটা এলাকা, পাহাড় তো দূরের কথা, টিলাও নাই। পিওরিয়া নামের মাঝারি সাইজের একটা শহর পেরিয়ে আমরা এসে পৌছালাম যখন আইওয়ার দ্বারপ্রান্তে, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। তার পরেও অন্ধকারে ৩/৪ ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে রাত ১০টার পরে এসে পৌছালাম আইওয়ার বড় শহর দ্য মইনে। পথ পেরিয়েছি তখন ৩৫০ মাইলের মতো।

সমতল থেকে পর্বতে



ছবিঃ ওয়াইওমিং এর পাহাড় পর্বতের দৃশ্য


আইওয়া স্টেট বিখ্যাত হলো গম চাষের জন্য। এছাড়াও ভুট্টা চাষেও এরা এগিয়ে। ফলে আইওয়া পার হওয়ার সময় ভুট্টা বা গম ক্ষেত দেখা, আর দু একটা গরুর ঘাস খাওয়া ছাড়া আর কিছুই দেখা হয় নি।

নেব্রাস্কাতেও অবস্থা তথৈবচ। প্রচন্ড সমতল ভূমি, এক জায়গায় তো প্রায় ৪০ মাইলের মতো সরলরৈখিক যাত্রা।

যাত্রার প্রথম দিন সকাল দশটার বদলে বেলা সাড়ে তিনটায় রওনা হয়েছিলাম, পেরিয়েছি মাত্র ৩৫০ মাইল। তাই ক্ষতিপূরণ করার জন্য দ্বিতীয় দিন লম্বা টান দিলাম। আইওয়ার দ্য মইন শহর থেকে বেলা ১১টায় রওনা হয়ে বিকালের দিকে নেব্রাস্কার শহর লিংকনে কিছুক্ষণ থামলাম। কিন্তু লক্ষ্য রাতের মধ্যে পরের স্টেট ওয়াইওমিং এ পৌছানো। তাই চালাতে থাকলাম।

গরম কালে এখানে সূর্য অস্ত যায় অনেক দেরিতে। রাত ৮টার সময় সূর্য ডুবে, আর আলো থাকে আরো ঘন্টা খানেক। এভাবে রাত ১০টা পর্যন্ত গাড়ি চালিয়ে ওয়াইওমিং এর সীমান্তে এসে পৌছালাম।

কিশোর বয়সে প্রচুর পড়েছি, সেবা প্রকাশনীর ওয়েস্টার্ন বই, আর ঐ বই গুলোতে ওয়াইওমিং এর কথা রয়েছে অনেক। এটা আমেরিকার সবচেয়ে জনবিরল রাজ্য। পুরা স্টেটের লোকসংখ্যা মাত্র ৫লাখ। অথচ এলাকায় এটা বাংলাদেশের দ্বিগুন।

ওয়াইওমিং এ পৌছানো মাত্র টের পেলাম, সমতল ভূমি পেরিয়ে এসেছি, পাহাড় পর্বত শুরু হলো। ওয়াইওমিং স্টেটের প্রস্থ হলো ৩৭৫ মাইলের মতো, এখানে আস্তে আস্তে রাস্তা উপরে উঠতে উঠতে স্টেটের মাঝখান নাগাদ প্রায় ৬০০০ ফুট উচুতে উঠে যায়। রাস্তার দুপাশে পাহাড়, আর অনেক জায়গায় এই মে মাসেও বরফ জমে আছে। বাংলাদেশের পাহাড়ি শহর চট্টগ্রামের বাসিন্দা হলেও দেখেছি কেবল মাটির পাহাড়, এখানে এসে পাথরের পর্বত দেখা আর তা ডিঙানো হলো।

যাহোক, এত কিছু দেখেছি পরের দিনে, আগের রাতের অন্ধকারে আর কিছুই দেখিনি। রাত ১১টার দিকে যখন আমাদের রাতের গন্তব্য শাইয়ান শহরে পৌছানোর চেষ্টা করছি, তখন পথে ঘোর অন্ধকারের মধ্য দিয়ে আঁকা বাঁকা পাহাড়ি রাস্তা পেরুতে হয়েছি বিস্তর। গোদের উপরে বিষফোঁড়ার মতো আবার বেশ কিছু জায়গায় রাস্তার কাজ চলছে, ফলে দুই লেনের হাইওয়ে এক লেন হয়ে গেছে, ব্যারিকেডের মধ্য দিয়ে খুব সাবধানে অন্ধকারে গাড়ি চালাতে হচ্ছে।

এর মধ্যে আবার অন্য সমস্যা উদয় হলো। পাহাড়ি জায়গায় পোকা থাকে জানতাম, কিন্তু পঙ্গপালের মতো পোকার মেঘ রাস্থা ঢেকে রেখেছিলো। ফলে গাড়ির কাঁচ আর হেডলাইটের আলো ঝাপসা হয়ে শেষপরের দিন আধা ঘন্টা ধরে কাঁচ আর হেডলাইট সাফ করেছি।

শেষে রাত সাড়ে এগারোটার দিকে পৌছালাম শাইয়ান শহরে। Cheyenne এর উচ্চারণ শাই-আন। এটা ওয়াইওমিং এর রাজধানী, ও বৃহত্তম শহর। জনসংখ্যা কত তা শুনলে অবশ্য হাসি পায়, মাত্র ৫৫ হাজার!! (আমার মনে হয় ঢাকার একটা মহল্লাতেও এর বেশি লোক থাকে)। তবে শহরের এলাকাটা খুব সুন্দর, পাহাড়ের মাঝে মালভূমির মতো। শহরের পত্তন হয়েছিলো উনবিংশ শতকে কাউবয় আর র‌্যাঞ্চারদের ওয়েস্টার্ন যুগে, গরু পালন আর অন্যত্র প্রেরণের কেন্দ্র হিসাবে। শহরের নাম এসেছে এখানে বাস করা শাই-আনাহ নামের নেটিভ আমেরিকানদের নাম হতে। আজ অবশ্য তারা নেই, তাদের বদলে সাদারাই এখানকার প্রধান বাসিন্দা।

প্লান ছিলো, শাইয়ান শহরে ঢুকে ডেইজ ইন বা অন্য কোনো মোটেলে থাকবো। আগে বুকিং দেয়া হয়নি, ভেবেছিলাম হাজির হলেই হবে। কিন্তু বিধি বাম, রাত ১২টার সময় হলিডে ইন, ডেইজ ইন সহ গোটা দশেক মোটেল চষে ফেললাম, কোনো কারণে ঐ রাতে কোনো হোটেলে একটা রুমও নেই। কঠিন চিন্তার কথা, আর সামনে কয়েকশো মাইলের মধ্যে অন্য কোনো শহরও নেই যে সেখানে যাবো। জারিয়ার তো প্রায় কেঁদে ফেলার দশা।

রক্ষাকর্তা হয়ে এলো গুগলের ফোন ভিত্তিক সার্ভিস। গুগল ৪১১ এর নম্বরে ফোন করে বললাম শহর আর স্টেটের নাম, আর মোটেল খুঁজছি, এটা। ভয়েস রিকগনিশন সফটওয়ার আমার কথা থেকে শব্দ নিয়ে সার্চ করে রেজাল্ট হিসাবে মোটেলের তালিকা বললো। তা থেকে খুঁজতে খুঁজতে পেলাম "লিটল আমেরিকা" রিসর্ট। জলদি সেখানে গিয়ে তো অবাক, অন্য হোটেলে যা ভাড়া চেয়েছে, তার অনেক কমে চমৎকার একটা রিসর্ট। হিলটনের চাইতেও অনেক চমৎকার রুমগুলো, আলাদা বারান্দা সহ। পরে জেনেছি এটা এখানকার স্থানীয় রিসর্ট চেইন, বাইরে অতো নাম ডাক নেই, কিন্তু স্টেটের ভিতরে বেশ বিখ্যাত।

দিন শেষে কত পথ চলেছি হিসাব করতে বসে বিস্মিত হলাম, সারা দিনে চলেছি ৬৫০ মাইল! এক দিনে মোট ১৩ ঘন্টার মতো গাড়ি চালিয়েছি (মাঝে খাওয়া ও তেল নেয়ার বিরতি সহ)। আমার আগের ব্যক্তিগত রেকর্ড ছিল আগের দিন ৩৫০ মাইল চালানো। যাহোক, অন্তত প্রথম দিনের দেরির ক্ষতি পূরণ করতে পারলাম।

 


ছবিগুলো মরমন টেম্পল স্কয়ার এলাকার

 

ওয়াইওমিং থেকেই পাহাড় ডিঙানো শুরু হলো। আগের রাতে দেখে রেখেছিলাম, ওয়াইওমিং এর মাঝামাঝি একটা জায়গা সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ৬০০০ ফুট উঁচুতে রয়েছে। হাইওয়ে আই-৮০ ঠিক ঐ জায়গা দিয়েই গেছে।

রাস্তা আস্তে আস্তে উপরে উঠছে, অনেক জায়গায় চেষ্টা করেও গাড়ির গতি ৪৫ মাইলের বেশি তুলতে পারিনি, এতোই খাড়া রাস্তা। যাহোক, বিদ্ঘুটে সব পাহাড় পর্বত পেরিয়ে পেরিয়ে দিন শেষে এসে পৌছালাম ইউটাহ'র সল্ট লেক সিটিতে।

ইউটাহ বেশ ইন্টারেস্টিং একটা স্টেইট। এই স্টেইটটাই হলো মরমনদের ঘাঁটি।

মরমন কি সেটা বলা যাক। উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে জোসেফ স্মিথ নামের এক লোক স্বপ্ন দেখলেন, এক ফেরেশতা তাঁকে এসে বলছে, তাঁর বাড়ির কাছে এক পাহাড়ে মাটির নীচে সোনার পাতায় লেখা একটা বই রয়েছে। বইতে লেখা আছে যীশু খ্রিস্টের কথা। মূল থীমটা হলো, বাইবেল ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ আদি রূপে নাই, এই বইটার মাধ্যমে ফিরে আসবে খ্রিস্ট ধর্মের মূল কথা ইত্যাদি ইত্যাদি। বইটা মিশরী হায়েরোগ্লিফিকে লেখা, যা পড়ার কৌশল জোসেফ স্মিথকে ঐ ফেরেশতা বাতলে দিয়েছিলো। তবে বইটা টুকে নেয়ার পরে ঐ সোনার পাতাগুলো ফেরেশতা নিয়ে চলে গেছিলো। স্মিথ নিজেকে নবী হিসাবে ঘোষণা করেন এবং বুক অফ মরমনের মাধ্যমে ধর্ম প্রচার শুরু করেন।

নিউইয়র্কের লোকেরা জোসেফ স্মিথের এসব কথা বিশ্বাস করেনি, বরং মারধর করে ভাগিয়ে দিয়েছিলো। অবশ্য জোসেফ স্মিথের অনুসারীও জুটে গেছিলো অনেক। তাদের নিয়ে স্মিথ চলে আসেন মিসৌরীর ইন্ডিপেন্ডেন্স এলাকায়। কিন্তু সেখান থেকেও তাড়িয়ে দেয়া হয় এদের। চলে আসে তারা ইলিনয়ে। কিন্তু গোড়া খ্রিস্টানেরা মরমনদের জীবনাচরণ সহ্য করেনি, ১৮৪৪ সালে এক দল খ্রিস্টান এসে জোসেফ স্মিথকে ফাঁসিতে লটকে মেরে ফেলে।

ব্রিগহাম ইয়ং এর নেতৃত্বে মরমনেরা পশ্চিমে গিয়ে জনবিরল ইউটাহ এলাকায় বসতি গাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য পাহাড় পেরিয়ে, বিশাল তৃণভূমি পেরিয়ে তারা যাত্রা শুরু করে। ঐ সময় তাদের অনেকের ঘোড়ার গাড়িও ছিলো না, তাই হাতে টানা ঠেলাগাড়িতে করে জিনিষ নিয়ে রওনা হয় কয়েক হাজার মরমন।

ইউটাহে মরমনদের স্বপ্নের ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায়। গোড়া রক্ষনশীলতা ছাড়াও মরমনদের আরেকটা বৈশিষ্ট্য ছিলো বহুবিবাহ, যা খ্রিস্টান ধর্মের অন্য অধিকাংশ গোষ্ঠী প্রচন্ড ঘৃণার চোখে দেখতো। মরমনেরা একেক জন ৪-১০টি করে বিয়ে করতো। পরে অবশ্য ১৮৯২ সালের দিকে ইউটাহ যখন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য হতে চায়, তখন তাদের শর্ত দেয়া হয়, বহুবিবাহ বাদ দিতে হবে। ঐ সময় হঠাত করে মরমনদের তখনকার নবী "স্বপ্ন দেখলেন", বহুবিবাহ বাদ দেয়ার কথা কোনো ফেরেশতা এসে তাঁকে বলছে।

সল্ট লেক সিটিতে তাদের প্রধান মন্দির অবস্থিত (ওরা ওদের চার্চকে মন্দির বলে)। পুরা স্টেইটেই মরমনদের প্রভাব বেশ। অবশ্য আজও মরমনদের অন্য খ্রিস্টানেরা একটু খারাপ চোখে দেখে, মরমনদের অনেকেও আবার গোপনে ৩/৪ বৌ নিয়ে চলে। কিছু দিন পর পরই দুয়েকজন মরমনের শাস্তি হয় বহুগামিতার দায়ে।

যাহোক, আমরা সল্ট লেক সিটিতে ছিলাম একেবারে শহরের কেন্দ্রে, টেম্পল স্কয়ারের পাশে। সকালে উঠে যাত্রা শুরু না করে আমি আর জারিয়া চলে গেলাম টেম্পল স্কয়ারে। ওখানে রয়েছে মরমনদের সোনা মোড়ানো গোল্ডেন টেম্পল, ব্রিগহাম ইয়ং এর বাড়ি, ওদের অ্যাসেম্বলি হল, মরমন চার্চের প্রধান কেন্দ্র, ইত্যাদি ইত্যাদি। মরমনরা সারা দুনিয়ার বহু ভাষা জানা সিস্টারদের প্রস্তুত রেখেছে, দুনিয়ার যে দেশ থেকে লোক আসে, তাদের নিজের ভাষায় মরমনদের গুণগান গেয়ে বেড়ায়।

সল্টলেক থেকে বেরুতে বেরুতে লাগলো বিকাল ৩টা। শহর থেকে বেরুতেই পড়লো গ্রেট সল্ট লেক। অসাধারণ দৃশ্য।


সল্টলেক সিটির মরমন মন্দির দেখে বেরুতে বেরুতে বিকাল তিনটা। আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম, ঐ দিন আর বেশি চালাবোনা, সাড়ে তিনশ মাইলের পরে থামবো। যাত্রা বাকি আর ৭০০ মাইলের মতো, তার মানে ২২০০ মাইল পথের ১৫০০ মাইল পেরিয়ে এসেছি।

সল্ট লেক সিটি থেকে বেরিয়ে একটু আসতেই অসাধারণ এক দৃশ্য চোখে পড়লো। হাইওয়েটা চলে গেছে সল্ট লেকের পাশ দিয়ে, আর তার ওপারে রয়েছে পাহাড়। জারিয়া জানালার মধ্য দিয়ে মনের সুখে ছবি তুলে চললো। আমিও চলার ফাঁকে ফাঁকে দেখতে লাগলাম।

প্রাগৈতিহাসিক যুগে এখানে বিশাল বড়ো একটা হ্রদ ছিলো। আস্তে আস্তে শুকিয়ে গিয়ে আকারে অনেক ছোট হয়ে এসেছে, তার পরেও এই হ্রদটার ক্ষেত্রফল হলো ১৭০০ থেকে ৩৪০০ বর্গমাইল। এর ক্ষেত্রফল প্রতিনিয়ত পালটায়, খুব অগভীর বলে শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে ছোট হয়ে আসে। এটা দুনিয়ার ৪র্থ বৃহত্তম সমাপনী হ্রদ (যেখানে নদী এসে শেষ হয়েছে), আর সব ধরণের হ্রদের মধ্যে এটা আকারে ৩৪তম।

এই সল্ট লেকের পানি কিন্তু প্রচন্ড লবনাক্ত। আসলে তিনটা নদী এখানে খনিজ লবনে পূর্ণ পানি নিয়ে আসে, কিন্তু বাষ্প হয়ে উড়ে যাওয়ার সময় লবন রয়ে যায়। লাখ লাখ বছর ধরে এভাবে চলতে থাকায় হ্রদের পানি লবনে সম্পৃক্ত। আর এতো বেশি লবন থাকার জন্য এখানে মানুষ ডুবে না, ভেসেই থাকে এমনি এমনি। হ্রদে মাছ নেই বেশি, তবে লবন পানির চিংড়ি, আর বিভিন্ন সারস জাতীয় পাখি রয়েছি অনেক।


[ছবিগুলো ক্যামেরা ফোনে জারিয়ার হাতে তোলা, অনেক ছবিতেই ধবধবে সাদা যা দেখছেন, তা কিন্তু পানি না, বরং লবনে ঢাকা প্রান্তর। আর একটা পাহাড় খোদাই করে তৈরী করা একটা টানেলের ছবি আছে, ওর মধ্য দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়াটা ছিলো এক নতুন অভিজ্ঞতা]
 

ঐ যে বলেছিলাম, প্রাগৈতিহাসিক কালে হ্রদটা আরো অনেক বড় ছিলো, তাহলে হ্রদের আগের এলাকায় কী হয়েছে? সেটাই দেখার মতো আরো চমৎকার জিনিষ। বনভিল সল্ট ফ্ল্যাট, বা বনভিলের লবন সমতল হলো হ্রদের পুরানো এলাকা - মরুভূমিতে যেমন বালি জমে থাকে, এখানে তেমন যতদূর চোখ যায়, ধবধবে সাদা লবন জমে আছে। অসাধারণ দৃশ্য , লবনের সাদা প্রান্তরের মধ্য দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। দূরে লবনের প্রান্তরের মধ্য থেকে হঠাৎ গজানো পাহাড়গুলোকে মনে হচ্ছে, যেনো শূন্যে ভেসে আছে।

ইউটাহ যখন শেষ হয়ে আসছে, তখন আরেকটা ইন্টারেস্টিং জিনিষ চোখে পড়লো। প্রায় ৪০ মাইল পথ একেবারে সোজা রাস্তা চলে গেছে। একটুও বাঁক নেই। তাকালে সামনে বহু দূরে পথ দেখা যাচ্ছে। আমার ২২০০ মাইল যাত্রায় এরকম আর চোখে পড়েনি।

নেভাডাতে প্রবেশের মুখেই শুরু হলো সিয়েরা নেভাডা পর্বতমালা। পাহাড় পর্বতে পুরো পথ ভর্তি, প্রচন্ড জনবিরল। আর শুরু হলো মরুভূমি। অবশ্য সিনেমাতে দেখা মরুভূমির মতো ধুধু বালি নয়, এই মরুভূমিটা ক্যাকটাসের ঝোপে ভর্তি।

উইনেমুকা। নামটাই কেমন বিদঘুটে, কিন্তু এই শহরটা হলো সল্ট লেক হতে ক্যালিফোর্নিয়ার ঠিক মাঝপথে। তাই এখানেই থামার প্ল্যান করেছিলাম। নেভাডা আমেরিকার খুব অল্প এলাকার একটি, যেখানে জুয়া খেলা বৈধ। জুয়ার নগরী লাস ভেগাস নেভাডাতেই অবস্থিত, তবে দক্ষিণ মাথায়। আমরা যাচ্ছি মাঝের রাস্তা দিয়ে। উইনেমুকা শহরে এসে পৌছেছি রাত ১০টার দিকে, একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে বেরুলাম। শহর প্রচন্ড ছোট, থাকে কেবল হাজার পাঁচেক লোক, কিন্তু নেভাডা তো, কাজেই এখানেও ক্যাসিনোর কমতি নেই। লাস ভেগাসে আমরা দুইবার গেছি, তাই ক্যাসিনো দেখেছি ঢের। তবে এই ছোট শহরেও দেখি মধ্যরাতেও প্রচুর লোক ক্যাসিনোতে হাজির। এই ক্যাসিনোতে রাতের খাওয়া সেরে, স্লট মেশিনের আশে পাশে ঢু মেরে, রুমে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেলো।
নেভাডার উইনেমুকা থেকে যাত্রা করতে করতে ১১টা বেজে গেলো। পাহাড়ি রাস্তা, একবার উঠছে, আবার নামছে। ছোটবেলায় নাইট রাইডার নামের সিরিজটা দেখতাম, মরুভূমির মধ্যের রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। নেভাডার রাস্তা ঘাটও এরকম। তবে অন্য মরুভূমির সাথে পার্থক্য হলো, এই মরুভূমিটা ধুধু বালুচর নয়, বরং ক্যাকটাসে ছাওয়া মলিন, বিরান প্রান্তর। মাঝে মাঝে গড়িয়ে আসছে গোলাকার বলের মতো মরা ক্যাকটাস।

নেভাডার শেষপ্রান্তে প্রায় ৫০ মাইল সোজা সরল রেখার মতো রাস্তা গেছে। এখানে পাহাড় থেকে নেমে আসছে বলেই বোধহয় পুরোটাই দেখা যায় নামার সময় ... খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার।

নেভাডা পেরিয়ে যখন ক্যালিফোর্নিয়ার সীমানায় পৌছালাম, শুরু হয়ে গেলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চমৎকার প্রকাশ। ক্যালিফোর্নিয়া আবিষ্কার করেছিলো স্প্যানিশরা, সেই ৫০০ বছর আগে। স্পেনের হাত থেকে মেক্সিকোর শাসনে ছিলো শ দেড়েক বছর আগেও। তার পর উনবিংশ শতকের মাঝের দিকে মেক্সিকোর সাথে রীতিমত যুদ্ধ করে আমেরিকা ছিনিয়ে নেয় ক্যালিফোর্নিয়া সহ পশ্চিম দিকের অনেক গুলো রাজ্য।

আর এর ঠিক পরে পরেই এখানে সোনা পাওয়া যায়, উনবিংশ শতকের গোল্ড রাশ শুরু হয় তখন। সেই থেকেই ক্যালিফোর্নিয়া স্বপ্নরাজ্য হিসাবে আমেরিকাতে সমাদৃত।

চারিদিকের ল্যান্ডস্কেপ যে পালটে গেছে, ঢোকার সাথে সাথেই বুঝেছিলাম। মরুভূমি গায়েব, তার বদলে গাঢ় সবুজ গাছে ঢাকা পাহাড় শুরু। ঢোকার মুখেই পড়লো লেক টাহো, এই এলাকার বেশ নাম করা একটা টুরিস্ট স্পট। এখানে থেমেছি কিছুক্ষণ, দেখলাম আশে পাশের সব গাড়িতেই হয় মাউন্টেইন বাইক, অথবা জেট-স্কী বাঁধা আছে। বোঝা গেলো, সপ্তাহান্ত পেয়ে অনেকেই ছুটি কাটাতে এসেছিলো।

লেক টাহোর পরে শুরু হলো প্রচন্ড খাড়া আরো বেশ কিছু পাহাড় ডিঙানো। অনেক জায়গাতেই প্রচন্ড বাঁক। আর ক্যালিফোর্নিয়া বলেই ঝাঁকে ঝাঁকে গাড়ি। প্রায় ঘন্টা দুয়েক এই পাহাড়ে উঠা আর নামা করতে করতে অবশেষে পৌছালাম সমতলে।

ক্যালিফোর্নিয়াতে এসে রাস্তার দুপাশে বাগান দেখে মনটা ভরে গেলো। ৬টা স্টেট পার হয়ে আসলাম, আর কোথাও হাইওয়ের দুপাশে ফুলের গাছ লাগানো নেই। আর এখানে ঠান্ডা মোটেও পড়ে না, গরমও খুব বেশি পড়ে না, সেজন্য নানা গাছপালার প্রাচুর্য।

যাত্রার শেষের দিক - ইন্টারস্টেট ৮০ ছাড়তে হলো, ৬৮০ আর ৮৮০ ঘুরে যখন এসে  পৌঁছালাম আমাদের গন্তব্য - সিলিকন ভ্যালির মাউন্টেইন ভিউ, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের চাবি নিয়ে রেখেছিলো বন্ধু শিশির, ওর সাথে যখন অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে পৌছালাম, রাত প্রায় ১০টা।

গাড়ির ওডোমিটারের দিকে তাকালাম - যাত্রা শুরুর পর প্রায় ২২৫০ মাইল পেরিয়ে গেছে! আর সময় লেগেছে চার দিন ৩ ঘন্টা। বুধ বার সন্ধ্যায় রওনা দিয়ে পৌঁছেছি রবিবার সন্ধ্যায়।

[সমাপ্ত]