'আপনাদের এখানকার জঙ্গলে একটা বুনো
জানোয়ার আড্ডা গেড়েছে,' স্টেশনে যাবার পথে বললেন শিল্পী কানিংহ্যাম । একবারই
মুখ খুলেছিলেন তিনি, কিন্তু যেহেতু তার সঙ্গী ভ্যান চিল, নিজের সম্পর্কে
একটানা বক বক করে চলেছিলেন, তাই এই নিরবতা বেশি কানে বাজেনি ।
'এক আধটা পথ ভুল করে চলে আসা শেয়াল বা আর কয়েকটা উইজেল আসতে পারে, এর বেশি
মারাত্বক কিছু নয়,' বললেন ভ্যান চিল । আর কোনো কথা বললেন না শিল্পী ।
'আচ্ছা "একটা বুনো জন্তু" বলতে আপনি ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন?' তাঁরা প্রায়
প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে গেছেন এমন সময় জানতে চাইলেন ভ্যান চিল ।
'ও কিছু না, আমার কল্পনা, আমার ট্রেন এসে গেছে,' বললেন কানিংহ্যাম ।
সে দিন বিকেলে ভ্যান চিল তাঁর বনে ছাওয়া বিশাল সম্পত্তির মধ্যে হাঁটতে
বেড়িয়েছিলেন । তাঁর স্টাডিতে একটা স্টাফ করা বিটার্ন পাখি আছে, বেশ কিছু বুনো
ফুলের নাম জানেন তিনি; সুতরাং তাঁর খালা যে তাঁকে একজন বিশিষ্ট প্রকৃতিবিদ
ভাবেন তাতে হয়তো কিছুটা সত্যের অপভ্রংশ আছে । সে যাই হোক, বেশ হাঁটতে পারেন
তিনি । আর যখন তিনি হাঁটতে বের হন তখন চারপাশের সবকিছু খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে
দেখার অভ্যাস আছে তাঁর । কোনো বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্য থেকে নয়, স্রেফ পরে যাতে এ
ব্যাপারে আলাপ করতে পারেন তাই এই পর্যবেক্ষণ । যখন ব্লু বেল ফুলেরা কুঁড়ি মেলে,
আশপাশের সবাইকে ভ্যান চিল জানিয়ে দেন কী ঘটছে ।
তবে এই বিশেষ বিকেলে ভ্যান চিল এমন একটা জিনিস দেখেছিলেন সেটা তাঁর সাধারন
অভিজ্ঞতার বাইরে । ওক গাছে ঘেরা একটা খোলা মাঠের ধারে পানির একটা ডোবা, ডোবার
ঠিক পারেই একটা পাথরের তাক মতো জায়গা । যেখানে বছর ষোলো বয়সের একজন দিগম্বর
কিশোর চিৎ হয়ে রোদের মধ্যে শুয়ে আছে । ওর ভেজা খাটো চুল মাথার ঠিক মাঝখানে
দু' ভাগ হয়েছে ।
হালকা বাদামী চোখ , এতো হালকা যে প্রায় বাঘের মত জ্বলজ্বলে চোখজোড়া মেলে
ছেলেটা ভ্যান চিল কে দেখছে । দৃশ্যটা এতোই অভিনব যে ভ্যান চিল জমে গেলেন পথের
উপর । ছেলেটা কে হতে পারে? মিলারের বউ তার ছেলে হারিয়েছে প্রায় মাস দুই আগে,
ধারনা করা হয় মিলের পাশ দিবে তোড়ে বয়ে যাওয়া স্রোতে হারিয়ে গেছে সে । কিন্তু
সে তো স্রেফ বাচ্চা ছিল, এ তো সাবালকত্বের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে প্রায় ।
'তুমি এখানে কী করছো?' জানতে চাইলেন ভ্যান চিল ।
'রোদ পোয়াচ্ছি, আর কী করব?' জবাব দিল ছেলেটা ।
'কোথায় থাকো তুমি?'
'এই বনেই থাকি আমি ।'
'বনে থাকতে পারো না তুমি,' বললেন ভ্যান চিল ।
'এখানকার বন থাকার জন্য চমৎকার,' খানিকটা গর্বের ছাপ ছেলেটার গলায় ।
'কিন্তু রাতে ঘুমাও কোথায় তুমি?'
'রাতে ঘুমাই না আমি । রাত হচ্ছে আমার জন্য সবচেয়ে ব্যাস্ত সময় ।'
বিরক্তি বোধ করলেন ভ্যান চিল । রহস্যটা তিনি ঠিক ধরতে পারছেন না ।
'তুমি খাও কী?' জিগ্যেস করলেন তিনি ।
'মাংস,' যেন জিভে পানি এসে গেছে এমন ভাবে বলল ছেলেটা ।
'মাংস? কীসের মাংস?'
'আপনি যদি এতোই জানতে উৎসাহী হয়ে থাকেন তো বলি । খরগোশ, বুনো মুরগি, পোষা
মুরগি, ভেড়ার বাচ্চা, মানুষের বাচ্চা যদি ধরতে পারি । যদিও ওগুলো সাধারনত রাতে
তালা মারা থাকে । দু'মাস হয়ে গেল আমি কোনো বাচ্চার মাংসের স্বাদ নিয়েছি ।'
শেষ বিদঘুটে মন্তব্যটা উপেক্ষা করে সম্ভাব্য চোরাশিকার সংক্রান্ত আলোচনায় টেনে
আনতে চাইলেন ভ্যান চিল ।
'কী বাজে বকছ তুমি, তুমি খড়গোশ খাওয়ার ব্যাপারে,' বললেন তিনি । 'আমাদের এসব
পাহাড়ী খড়গোশ ধরা চাট্টিখানি কথা নয় ।'
'রাতে আমি চার পা দিয়ে শিকার করি ।' আরেকটা বিদঘুটে জবাব এল ছেলেটার কাছ থেকে
।
'মানে বলতে চাইছো তুমি কুকুর দিয়ে শিকার করো?' আন্দাজে ঢিল ছুঁড়লেন ভ্যান চিল
।
গড়িয়ে পিঠের উপর শুলো ছেলেটা । গলা দিয়ে যে নীচু পর্দার হাসিটা বের হল তার,
সেটা খুব প্রীতিকর নয়, শব্দটা অনেকটা চাপা গর্জনের মত ।
'আমার মনে হয় না কোনো কুকুর আমার সঙ্গ চাইবে, বিশেষ করে রাতের বেলায় ।'
এই অদ্ভুত চোখওয়ালা, আজব ছেলেটার মধ্যে কোনো আস্বাভাবিকতা আছে, ক্রমেই
অনুভুতিটা গাঢ় হচ্ছে ভ্যান চিলের মধ্যে ।
'তুমি এই বনে থাকতে পারবে না,' জোরগলায় বললেন ভ্যান চিল ।
'আমার মনে হয়, আমার বনে থাকা আপনার বাসায় থাকার চেয়ে ভাল ।' বলল অচেনা কিশোর
।
এই বুনো, দিগম্বর কিশোরকে ভ্যান চিলের গোছানো সংসারে নেয়ার চিন্তাটা সত্যি
বেশ আতংকজনক ।
'তুমি যেতে না চাইলে আমি জোর খাটাবো,' বললেন ভ্যান চিল ।
একঝলকের মধ্যে পুকুরের পানিতে ডাইভ দিয়ে পড়ল ছেলেটা । তার পরের মুহুর্তে
ভ্যান চিল যে পারে আছেন সেখানে পৌঁছে ভোঁদরের ক্ষিপ্রতায় নিজের শরীরটাকে
ডাঙ্গায় এনে ফেলল । এতই চমকে গেছিলেন ভ্যান চিল যে এক পা পিছনে হটতে গিয়ে পা
হড়কে শ্যাওলা পারে চিৎপাত হয়ে পড়ে গেলেন । বাঘের মত বাদামী চোখজোড়া নিজের
চোখের খুব কাছে দেখতে পেয়ে নিজের অজান্তেই একটা হাত গলার কাছে উঠে এল তাঁর ।
আবার সেই বিদঘুটে হাসিটা হাসল ছেলেটা, তবে এবারে গর্জন, হাসিকে প্রায় তাড়িয়ে
দিয়েছে । তারপরেই আরেকটা ঝটিতি দেহ সঞ্চালনে ফার্ন আর ঝোপঝাড়ের আড়ালে অদৃশ্য
হয়ে গেল সে ।
'কী আশ্চর্য একটা বন্য জন্তু!' কোনোমতে আঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আপন
মনে স্বগোতোক্তি করলেন ভ্যান চিল । তারপরেই মনে পড়ল কানিংহ্যামের মন্তব্যটা 'আপনাদের
এখানকার জঙ্গলে একটা বুনো জানোয়ার আড্ডা গেড়েছে,।'
ধীর পায়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে আজকের দেখা আশ্চর্য কিশোরের কোনো ব্যাখ্যা
দেয়া যায় কি না ভাবতে লাগলেন ভ্যান চিল ।
ইদানিং বনের পশুপাখির সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে লক্ষণীয় ভাবে । খামার থেকে মুরগি
হারিবে যাচ্ছে, খড়গোশ পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ছে । পাহাড় থেকে ভেড়ার বাচ্চা চুরি
যাওয়ার খবর এসেছে তাঁর কানে । ব্যাপারটা কী এমন হতে পারে যে আজকে দেখা অচেনা
ছেলেটা পোচিং এ চৌকস কিছু কুকুর নিয়ে রাতের বেলা শিকার করে বেড়াচ্ছে ? ও বলল
রাতের বেলায় ও 'চারপায়ের' সাহায্যে শিকার করে ।
তারপরে আবার ও বলেছে ওর কাছে কোনো কুকুর আসবে না, 'বিশেষ করে রাতের বেলায় ।'
গত দু'মাসে পোচিংএর কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বজ্রাহতের মত পথের উপর দাঁড়িয়ে
পড়লেন ভ্যান চিল । দু'মাস আগে মিল থেকে হারানো বাচ্চাটা । এতো কাল ধরে নেয়া
হচ্ছিল যে মিলের পাশের স্রোতে ভেসে গেছে ও । কিন্তু বাচ্চার মা বলেছে,
পাহাড়ের দিক থেকে, মানে পানির বিপরীত দিক থেকে একবার বাচ্চার চিৎকার শুনেছিল
সে । ছেলেটা বাচ্চার মাংস খাওয়ার ব্যাপরে যেন কী বলেছিল? ছি! ছি! এমন কথা
ঠাট্টা করেও বলা উচিত না ।
স্বভাব মত বাড়ি ফিরে কী দেখেছেন সে ব্যাপারে মুখ খুললেন না ভ্যান চিল । এমন
একজন দুর্বৃত্তকে নিজের জমিদারীতে রেখেছেন জানলে, এলাকার কাউন্সেলর এবং
জাস্টিস অভ দ্য পিস হিসেবে নিজের অবস্থান তো খর্ব হবেই, এমন কী হারানো
জানোয়ারগুলোর ক্ষতিপুরণের দাবিও উঠতে পারে । ডিনারের সময় স্বভাব বিরুদ্ধভাবে
মুখে কুলুপ এঁটে রাখলেন তিনি ।
'এমন চুপ করে আছ কেন তুমি?' জানতে চাইলেন তাঁর খালা । 'লোকে ভাবতে পারে তুমি
একটা নেকড়ে দেখেছ ।'
পুরনো প্রবাদটা জানেন না ভ্যান চিল । তাঁর মনে হল কথাটা লাগসই হল না । এস্টেটে
কোনো নেকড়ে দেখলে গোটা দুনিয়াকে জানান দিতেন তিনি ।
পরদিন নাশতার সময়েও গতকালের অস্বস্তি যায় নি, ভ্যান চিল টের পেলেন । পাশের
শ্হরটাতে গিয়ে কানিংহ্যামকে খুঁজে বের করার তাগিদ অনুভব করলেন তিনি । তিনি
এখানে একটা বুনো জন্তু আড্ডা গেড়েছে বলতে তিনি ঠিক কী বলতে চেয়েছিলেন জানা
দরকার । এ সংকল্প করা মাত্রই আগের হাসখুশি ভাব খানিকটা ফির এল তাঁর । মর্নিং
রুমে গিয়ে সিগারেট ধরাতে যাবর সময় এমন কী একটা গানের কলিও গুন গুন করে ভাঁজতে
লাগলেন তিনি । কিন্তু দরজা পেরিয়ে ঘরে পা দিতেই গান বন্ধ হয়ে গেল তাঁর ।
ডিভানের উপর আয়েশ করে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে গতকালের সেই রহস্যময় উলঙ্গ কিশোর
!
তার গা এখন ভিজে নেই, তবে আর কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ল না ভ্যান চিলের ।
'এতো বড় সাহস তোমার?' ভ্যান চিলের ক্রুদ্ধ প্রশ্ন ।
'আপনিই আমাকে বনে থাকতে নিষেধ করেছেন,' শান্ত গলায় উত্তর দিল ছেলেটা ।
'কিন্তু আমি তোমাকে এভাবে আসতে বলিনি! এখন যদি আমার খালা এসে দেখে তোমাকে ?'
বিপর্যয় এড়ানোর জন্য মর্নিং পোস্টের কাগজটা ছেলেটার গায়ে চাপা দিয়েছেন এমন
সময় তাঁর খালা পা রাখলেন ঘরে ।
'একটা পথ হারানো ছেলে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে খালা--আর ও, ও স্মৃতিও
হারিয়েছে । 'ও কে, কোথা থেকে এসেছে সব ভুলে বসে আছে ।' ছেলেটার মুখের দিকে
চাইলেন তিনি, পাছে আবার সব ফাঁস করে দেয় অচেনা অতিথি ।
মিস ভ্যান চিল উৎসাহী হয়ে উঠলেন । 'হতে পারে ওর অন্তর্বাসে ধোপার বাড়ির দাগ
দেয়া আছে?'
'আমার মনে হয়ে ও সে সবও হারিয়েছে ।' মর্নিং পোস্টটা জায়গা মত রাখার আপ্রাণ
চেষ্টা করছেন ভ্যান চিল ।
একটা ঘরছাড়া, ন্যাংটো বালককে দেখে মিস ভ্যন চিলের দরদ উথলে উঠল, যত উথলে উঠত
কোন রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া বেড়াল-কুকুরের ছানাকে দেখলে ।
'আমাদের যা কিছু করার তা আমরা করব,' ঘোষনা করলেন তিনি । কিছুক্ষনের মধ্যেই
লোক পাঠিয়ে রেকটরি থেকে এক প্রস্থ জামা-কাপড় আনিয়ে নিলেন তিনি । কিন্তু
জামা-কাপড় পরেও ছেলেটার অদ্ভুত ভাব গেল না ভ্যান চিলের চোখে । যদিও মিস ভ্যান
চিলের মায়া পড়ে গেল অনাথ বালকের উপর ।
'ওর আসল নাম কী জানার আগে পর্যন্ত ওকে আমাদের একটা কিছু নামে ডাকতে হবে । "গাব্রিয়েল
আর্নেস্ট" নামটা বেশ চলনসই ।' বললেন খালা ।
সায় দিলেন ভ্যান চিল, যদিও কোনো শান্ত সুবোধ বালককে ঘরের মধ্যে পাচ্ছেন বলে
মনে হচ্ছে ভ্যান চিল । পোষা বুড়ো স্প্যানিয়েল কুকুরটা যখন ছেলেটাকে এক নজর
দেখেই ঘর ছেড়ে ছুটে ফলবাগানের দূরের এক কোনায় গিয়ে কুঁই কুঁই করতে লাগল মনের
খুঁতখুঁতানি আরো বেড়ে গেল তাঁর । কাঁচার ক্যানারি পাখিটা যে সাধারনত কিচির
মিচিরে ভ্যান চিলকে পাল্লা দেয়, খাঁচার কোণায় তার ভয়ার্ত ক্যাঁচর ক্যাঁচর শুনে
কানিংহ্যামের সাথে সময় নষ্ট না করে সাক্ষাতের সংকল্প করলেন তিনি ।
তিনি যখন স্টেশনের দিকে যাচ্ছেন, তাঁর খালা তখন বিকেলের চায়ের দাওয়াতে সানডে
স্কুলের পিচ্চিদের আপ্যায়নের ভার বুঝিয়ে দিচ্ছেন ।
দেখা করার পর কানিংহ্যাম প্রথমে মুখ খুলতে চাইলেন না । 'আমার মা মাথার
সমস্যায় মারা গেছেন, আর সেজন্যই আশা করি আপনি বুঝবেন যে কোনো প্রায় অবাস্তব
ব্যাপারে আমি খুব মাথা ঘামাই না ।'
'কিন্তু আপনি ঠিক "কী" দেখেছেন ?' জোর দিয়ে জানতে চাইলেন ভ্যান চিল ।
'আমি যা দেখেছি তা এতো অদ্ভুত যে কোনো মানুষ তা বাস্তব বলে ভাবতে পারবে না ।
গতকাল বিকেলে আমি আপনার সাথে সাথে ফলের বাগানের গেটে ঝোপের বেড়াটার কাছে
দাঁড়িয়ে সুর্যাস্ত দেখছিলাম । হঠাত আমি দেখলাম একজন নগ্ন কিশোর, ধরে নিলাম
আশপাশের কোনো পুকুরে সাঁতার কাটতে এসেছিল, আমার মতই পাশের ন্যাড়া পাহাড়ের ঢালে
দাঁড়িয়ে সুর্যাস্ত দেখছে । ও বসার ভঙ্গিতে এতোটাই বুনো, পৌরানিক কোনো
চরিত্রের ভাব ছিল যে ওকে আমি কোনো মডেল হিসেবে ব্যবাহার করব কি না ভাবতে
লাগলাম । কিন্তু যেই না সুর্য দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল আর আকাশ ধুসর রং নিল,
তক্ষুনি সেই আজব ঘটনাটা ঘটল । দেখি ছেলেটা স্রেফ অদৃশ্য হয়ে গেছে!'
'কী! স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে?' জানতে চাইলেন উত্তেজিত ভ্যান চিল ।
'না, এইখানেই সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনাটা ঘটল,' বললেন শিল্পী । 'পাহাড়ের ঢালে খোলা
জায়গাটায় যেখানে ছেলেটা দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে দেখলাম একটা কালচে ধুসর, হলদে
চোখে মস্ত বড় নেকড়ে । আপনি ভাবতে পারেন--'
চিন্তা ভাবনা করার মত ফালতু কাজে সময় নষ্ট করলেন না ভ্যান চিল । সোজা
স্টেশনের দিকে উধর্্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করেছেন তিনি । টেলিগ্রাম করার চিন্তাটা
বাদ দিয়ে দিলেন তিনি মন থেকে । 'গাব্রিয়েল আর্নেস্ট একজন মায়ানেকড়ে,' তাঁর
খালা এ রকম টেলিগ্রামের নাও অর্থ উদ্ধার করতে পারেন । তাঁর একমাত্র আশা হচ্ছে
সুর্য ডোবার আগেই বাসায় ফেরা । যে ক্যাবটা ভাড়া করে রেখেছিলেন স্টেশনের ও পারে
তা অসম্ভব ঢিমে তালে চলছে বলেই তাঁর ধারনা । পড়ন্ত সুর্যের আলোয়, গাঁয়ের
রাস্তা গোলাপী-বেগুনি রং নিয়েছে যখন বাসাব পৌঁছে খালাকে কিছু না খাওয়া কেক
আর জ্যাম সরিয়ে রাখতে দেখলেন তিনি ।
'গাব্রিয়েল আর্নেস্ট কই?' প্রায় চিৎকার করে জানতে চাইলেন তিনি ।
'ও টুপদের বাচ্চাটাকে বাসায় পৌঁছে দিতে গেছে । এতো দেরী হয়ে গেছে যে একা একা
ছাড়তে পারলাম না বাচ্চাটাকে । কী সুন্দর সুর্যাস্ত তাই না?'
কিন্তু সুর্যাস্তের সৌন্দর্য নিয়ে কোনো মন্তব্য না করেই টুপ পরিবারের
ঠিকানার দিকের সরু রাস্তা ধরে দৌড়াতে শুরু করেছেন ভ্যান চিল । রাস্তার
একদিকের বাঁকে একদিকে নেমে গেছে মিল-পারের সেই স্রোতধারা, অন্য পাশে উঠে গেছে
ন্যাড়া পাহাড়ের ঢাল । দিগন্ত রেখার উপর অপসৃয়মান সুর্যের লালচে গোলকটা দেখা
যাচ্ছে । আরেকটা বাঁক ফিরলেই যাদের খুঁজছেন সেই যুগলটিকে দেখা যাবে আশা করছেন
তিনি । ঠিক তখনই সুর্য অস্ত গেল, রঙহীণ হয়ে পড়ল গোটা পৃথিবী । একটা ভয়ার্ত
চিৎকার শুনে থমকে দাঁড়ালেন ভ্যান চিল ।
টুপদের বাচ্চাটা বা গাব্রিয়েল আর্নেস্ট কাউকে আর এর পরে দেখা যায় নি । তবে
দ্বিতীয়জনের কাপড়চোপড় ঠিক নালাটার ধারেই পাওয়া গেছে, যাতে মনে হয় যে বাচ্চাটা
পানিতে পড়ে গেছিল আর তাকে বাঁচাতে পানিতে ঝাপ দিয়েছে ছেলেটা । তবে একজন একই
পথে বাড়িফিরতি শ্রমিকের ভাষ্য অনুযায়ী একটা শিশুর আতংকিত চিৎকার শূনেছে সে ওই
জায়গায় ।
এগারো সন্তানের মা মিসেস টুপ সন্তান হারানো বেদনা স্থৈর্যের সাথেই মেনে
নিয়েছেন, কিন্তু ভ্যান চিলের খালা, তাঁর সদ্য পাওয়া পোষ্য হারানোর বেদনা এতো
সহজে মেনে নিতে পারলেন না । তাঁর চেষ্টাতেই স্থানীয় গির্জায় একটা পিতলের
স্মারক-ফলক লাগানো হলো, যাতে লেখা ছিল
অচেনা বালক গাব্রিয়েল আর্নেস্টের
স্মৃতির উদ্দেশ্যে, যে কি না অন্যকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছে
খালার প্রায় সমস্ত আব্দারে সন্মতি দিলেও এই স্মারক ফলকে এক পয়সা দান করতে
অস্বীকার করলেন মি. ভ্যান চিল ।
শেষ