চৌদলা

আনিসুল হক

 

তিনজন মানবের গল্প। তিনটি অস্তিত্বের গল্প। এমনি গল্প যুগ যুগ ধরে বলা হয়েছে। লেখা হয়েছে কাগজে, যখন মানুষ কাগজের ব্যবহার জানতো, তার আগে গাছের পাতায়, তারও আগে শিলালিপিতে। তারপরেও শেষ নেই এ গল্পের। ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, ভিন্ন প্রকৃতিক স্পর্শকাতরতায় এ গল্পের বিস্তার কালে কালে ও কালেরই ঘূর্ণিতে মিলিয়ে মিশিয়ে।

 

প্রথম মানবের গল্প।

 

যখন প্রকৃতি নিথর, বাতাস শীতল, তখন শিশির জমে গাছের পাতায় পাতায়, মুক্তোর মতো ঝিলমিলিয়ে। প্রথম মানব যখন হাসে, তার একটি হাসির বন্যায় ঝরে পড়ে প্রকৃতির সমস্ত শিশিরবিন্দু একসাথে। তার চোখের তারায় তখন হাজার সমুদ্রের ঢেউ। প্রথম মানবকে কাঁদতে দেখেনি কেউ। অথচ তার বুকের ভেতরেই নিথর মেঘের মতো বরফে জমানো সে কান্না। সে বরফ জমানোই সবসময়। কান্না হয়ে চোখের কোনে সমুদ্র হয়না কখনোই। হলেও কেউ কখনো তা দেখতে পায়নি। মানব তার নিজস্ব গড়া দুর্গে নিজেই যেনো বন্দী। দুর্গের অনেক উঁচুতে গড়া ছোট ছোট জানলা দিয়েই তার ঝর্ণার মতো ছন্দিত হাসির ঝংকার শিশির ঝরায়। কিন্তু বুকের ভেতরে জমানো কান্না বুকের দুর্গেই ঘূর্ণি হয়ে গুমরে বেড়ায় সারাটি সময়। কিন্তু সে কান্নার উৎস কোথায় ? কোন এক অজানা ভয়ে তাই প্রথম মানুষ মসৃ আয়নায় মুখ দেখেনা কখনোই।

দ্বিতীয় মানবের গল্প।

 

দ্বিতীয় মানব যেনো বিষন্ন এক মৌন পাহাড়। তার চোখের তারায় কখনো কোন স্বপ্নের বাগান গড়ে উঠেনা। সমুদ্রের অজস্র ঢেউ বুকের উপর ভেঙ্গে পড়লেও কোন ক্লান্তি আসেনা তার স্থবিরতায়। দ্বিতীয় মানবের হাতে রয়েছে কোন এক স্বর্গপুরি থেকে খসে পড়া সুরেলা এক বাঁশী। কিন্তু সে বাঁশী তার তার হাতে কোন স্বর্গীয় সুরের মূর্ছনা তোলেনা । সে বাঁশী লুকোনো রয়েছে তার বুকের অজস্র গুহার মাঝে সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন মলিন এক গুহায়। সে গুহাতে সূর্যের আলোও ঢোকার আগে থমকে দাঁড়ায় বারবার।
 

তৃতীয় মানবের গল্প।

 

তৃতীয় মানবের বুকের মাঝে ছন্দিত আগুন। বাঁধভাঙ্গা অনুভূতির ঢেউ তার বুকের আগুনকে আরো বেশী উত্তাল করে। যন্ত্রণার তীব্র সমুদ্রে ভেসে ভেসে মলিন তার অবয়ব। কিন্তু তারপরেও চোখের তারায় অজস্র সপ্নের অস্থির উন্মাদনা ঢেকে রাখে সে মালিন্যকে। তার বুকের ভেতরের নরম ভালোবাসাকে বিলিয়ে দিতে তৃতীয় মানব হাতড়ে বেড়ায় কোন এক অস্থির পথ। কিন্তু কোন এক অদৃশ্য আঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে তার স্পর্শকাতর ভালোবাসা পথেরই আনাচে কানাচে। তৃতীয় মানব তাই পথ হারিয়ে পথকেই আগলে আছে বুকে।

কোন এক বাসন্তিক দিনে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় মানব কোন এক চৌদোলায় চড়লো - কি কারণে, তা জানা নেই কারো। হয়তো আকাশ থেকে কোন একটি উল্কা খসে পড়ায় চমকে উঠেছিলো ওরা, হয়তো অনেক অনেক দূরে কোন এক নবাগত শিশুর কান্নায় থমকে গিয়েছিলো ওদের পথ, হয়তো বা ওদের বন্দর থেকে যে জাহাজ ছেড়ে গেলো, তার গন্ত্যব্যস্থল জানার জন্যেই, -- যে কারনেই হোক না কেনো, ওরা চড়লো সে চৌদোলায়। আকাশ তৃপ্ত হলো তার সমস্ত রোদটুকু ওদের গায়ে ঢেলে দিয়ে। বাতাস তার সে আনন্দের ভার বইতে না পেরে, ঝলকে ঝলকে ছিটিয়ে দিলো তার সে আনন্দ বাকী প্রকৃতিতে।

প্রথম দোলার গল্প।

 

অনেক উঁচুতে দুলছে দোলা। অনেকটা আকাশের কাছাকাছি। আকাশে যদি মেঘ থাকতো, তাহলে মেঘও ওদের দোলার সাথী হতে পারতো। দুরন্ত গতিতে দুলছে দোলা। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় মানবও দুলছে একই গতিতে। আকাশে কাছাকাছি কোন এক হঠাৎ মেঘে থামলো দোলা ক্ষণিকের জন্যে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় মানব কিছুক্ষনের জন্যে সে মেঘের বসতে একটু থেমে আবার চড়লো ওদের দোলায়। ছুটলো দোলা তার অফুরন্ত গতিতে। প্রকৃতি, পাহাড়, মেঘ ছুটলো ওদের সাথে। কিন্তু দোলার দুরন্ত গতির সাথে পাল্লায় পেরে উঠলো না ওরা। দোলা গিয়ে থামলো অনেকটা নীচুতে, সাগর থেকে কিছুটা দূরে অন্য মানবের বসতে। সেখানে অজস্র সাজানো আলোর মাঝে হঠাৎই দিগন্তে বিদায় নিলো দিন।

- প্রথম মানবের বুকের মাঝে তখনো সে সাজানো আলোর ঝলকানি।
- দ্বিতীয় মানবের হাতে তখন কাগুজে ফুলের মালা।
- তৃতীয় মানবের বুকের খাঁচায় বিদায়ী আলোর তীব্র ব্যথা।

দ্বিতীয় দোলার গল্প।

 

দ্বিতীয় দোলা থামলো একেবারে সমুদ্রের কাছে কোন এক জলছোঁয়া আর্শ্চয্য নগরীর মাঝে। জল আর প্রায় ভেঙ্গে পড়া প্রাসাদের মাঝে অজস্র রংএর হোলিখেলা নগরীর প্রতিটি কোনায় কোনায়। তারপরেও প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় মানবের হাতে কেমন করে যেনো টুকরো হয়ে গেলো নগরীর নিস্তব্ধ বাতাসে তাদের সময়গুলো। নগরীর নৈর্গিক ভালোবাসা, নোনাজলের দূরন্ত ঢেউ, কোনকিছুই ওদের ভেঙ্গে যাওয়া সময়কে জোড়া লাগাতে পারলো না।

- দ্বিতীয় মানবের হাতে তখন কাগুজে ফুলের মালা।
- প্রথম মানবের চোখের তারায় সাজানো রং-এর বাগানবাড়ী।
- তৃতীয় মানব ভাঙ্গা সময়কে বুকে করে র্তীর ব্যথায় বিবর্ণ

তৃতীয় দোলার গল্প।

 

দোলা ছুটলো আবার বিস্তীর্ণ বনভূমি, জলাশয়কে ডানে, বায়ে ও পেছনে রেখে। থমকে দাঁড়ালো এসে এক উঁচু প্রাসাদের পাশে। শ্বেত মর্মরের কঠিন বাঁধনে সাজানো সে প্রাসাদ। তার চুড়োগুলো আকাশকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ভালোবেসে চুমো খায় মেঘের ভাজে ভাজে। তিনজন মানবের কোনো একজনের বুকেও স্পর্শ করলো সে ভালোবাসা। কিন্তু কোনো এক বিপরীত ঘূর্নির কর্কশ ছোয়ায় বুকের ভেতরে বিক্ষোভের দমকে বিক্ষিপ্ত হলো সে ভালোবাসা।

- তৃতীয় মানব নিজেই তখন কোন এক আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত গহন।
- প্রথম মানব কোন এক অজানা অক্ষমতায় বিবস, ক্লান্ত।
- দ্বিতীয় মানবের হাতে তখনও কাগুজে ফুলের মালা।

চতুর্থ দোলার গল্প।

দোলা নামছে এবার শেষ শক্তিকে ধরে ধরে বাতাসের গায়ে ভর করে। এবারের যাত্রা ফিরতি পথের। তারপরেও দোলা কোন এক ভালোবাসার নগরী ছুঁয়ে গেলো একবার। অসংখ্য ভালোবাসার সারে চিত্রিত সে নগরী। কোন কোন মানব সে ভালোবাসায় বিলীন হয়ে নিজেরই বুক হাতড়ে সুখের ছবি আঁকলো।

- দ্বিতীয় মানবের হাতে তখনও কাগুজে ফুলের মালা।
- তৃতীয় মানব তখন আসুরিক অসাড়তায় বিমুঢ়।
- প্রথম মানবের শীৎকারে পাখীরাও বেদনায় ডানা ঝাপটায়।

এমনি করেই শেষ হলো তিন মানবের চৌদোলার যাত্রাপথ। দ্বিতীয় মানব কাগুজে ফুলের মালাটি হাতে নিয়ে নিপুন যত্নে রাখলো বিবর্ণ বাঁশীটির পাশে। তৃতীয় মানব কোন এক কষ্টকে আকড়ে ধরে কোন এক অজানা অভিমানে মিলিয়ে গেলো কোথায় কে জানে। আর প্রথম মানব কোন এক কুহেলিকার নিগুঢ় বন্দীত্বে প্রতিদিন মুখ দেখে তার অমসৃন আয়নায়।


এপ্রিল ১৯, ২০০৮
মিউনি, জার্মানী