সুকান্তের কবিতায় সমাজ ও পরিপার্শ্ব
সাইফুজ্জামান
বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র-নজরুল পরবর্তী পর্যায়ে সুকান্তের আবির্ভাব স্মরণীয়। কবিতার বিষয় ও বক্তব্যের বহুমাত্রিকতা একটি নতুন সম্ভবনার ইঙ্গিত দেয়। সুকান্ত ভট্টাচার্য এক বিদ্রোহী কবির নাম। বুর্জোয়া রাজনীতির প্রভাব বলয় ভেঙ্গে নতুন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে নিবেদিত কবি সুকান্ত আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন, সমাজচেতনা ও মূল্যবোধ জাগরণে নিবেদিত থেকেছেন। স্বল্প আয়ু কবি এই প্রিথিবীতের চলমান ঘটনা আর রাজনীততে সচেতন ছিলেন। কাব্যচর্চার সময় তাঁর খুব দীর্ঘ ছিল না। তাঁর কবিতা পাঠকের আগ্রহ সঞ্চার করেছে। গবেষকরা নতুন দিক ও বিষয়কে আবিষ্কার করেছেন। কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়নি তাঁর কবিতা। প্রতিনিয়ত সুষমা ও ব্যঞ্জনায় পুষ্ট হয়ে মাধুর্যমন্ডিত হয়েছে । তিরিশের কবিদের কাব্যশক্তি পাঠককে আকৃষ্ট করেছিল। চল্লিশে সুকান্তের কবিতায় উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। তিরিশের কবিরা মানবিক মূল্যবোধ ও আশা নিরাশার দোলাচলে আন্দোলিত হয়ে কবিতাকে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখেছেন। কিন্তু সুকান্ত কবিতার জগতে প্রবেশ করে জীবনের সুন্দর দিক, পৃথিবীর রূপ রহস্য ও মানবিক কল্যাণ বন্দনায় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। জীবন দর্শনজাত তাঁর কবিতায় ব্যঙ্গ বিদ্রূপ, দেশীয় ঐতিহ্য ও সমাজ চেতনার উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। সুকান্ত একটি আধুনিক কাব্য ভাষার সৃষ্টি করেছেন। চল্লিশের অন্য কবিদের থেকে তার স্বতন্ত্রতা তিনি গণমানুষের মুক্তি প্রণোদনা সৃষ্টিতে মগ্ন ছিলেন। তাঁর প্রতিবাদী কন্ঠ সমকাল ও ইতিহাসকে বন্দী করে রেখেছে।
একজন কবি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে বিচ্যুত নয় । চলমান ঘটনাপ্রবাহ ও ভবিষ্যতকে তিনি প্রত্যক্ষ করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভয়াবহতা সুকান্তের কবি চিত্তকে আলোড়িত করে। স্বদেশে বিক্ষোভ , নিরন্ন মানুষের হাহাকার ও প্রতিবাদ কবিতায় তুলে ধরে সুকান্ত নতুন ধারার কবিতা রচনা করেন। নয় দশ বছর বয়স থেকে ছড়া কবিতা সঙ্গীত রচনায় তিনি নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। সুকান্তের পরিবার বদলের সঙ্গে ব্যক্তিগত সুখ দুঃখগাঁথা এইসব কৈশোরিক অনুভূতি ব্যক্ত হয়েছে।
ব্যক্তির বোধ সংক্রমিত হয় সমষ্টিতে। আপনজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সুকান্ত মর্মযাতনায় ভোগেনঃ
বল দেখি জমিদারের কোনটি ধাম
জমিদারের দুই ছেলে রাম শ্যাম।
রাম বড় ভাল ছেলে পাঠশালা যায়
শ্যাম শুধু ঘরে বসে দুধ ভাত খায়।
সাধারণ কথা! কিন্তু এই পোড়া দেশে ঘরে বসে যে দুধভাত খাওয়া যায় না। নিত্য অভাব এসে দাঁড়িয়ে থাকে দরজায়। বৈরী প্রকৃতি আর শোষণ বঞ্চনা মানুষের প্রতিরোধ শক্তি সঞ্চার করে। মানুষ প্রিতিবাদে ফুঁসে উঠে। সুকান্তর মানসগঠনে তার বন্ধু বান্ধব ও স্বজন পরিজন ভূমিকা পালন করেছিল। সহপাঠীরা সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশে অনুপ্রাণিত করে। সুকান্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘সপ্তমিকা।’ সুকান্ত যখন লিখতে শুরু করেন তখন এমন বয়স যখন ভাবালুতা আর কিশোর মনের কৌতুহল তাকে লিখতে প্রাণিত করে। বন্ধুদের সান্নিধ্য ও বামপন্থী রাজনীতিবিদদের বক্তব্য, বিবৃতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সুকান্ত কবিতায় বিদ্রূপ ও বিপ্লবী চেতনাকে ধারণ করেন। তাঁর কবিতায় স্বজাতি ও স্বদেশের বিচিত্র রূপ চিত্রিত হয়েছে। তাঁর সৃজনশীলতা পাঠকমহলে তাকে স্বতন্ত্র অবস্থানে নিয়ে গেছে। গল্পদাদুর আসরে রেডিওতে কবিতা আবৃত্তিতে তিনি অংশ নিতে থাকেন। এ সময় পূর্বাভাসে প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতা ‘প্রথম বার্ষিকী’। সুকান্ত রচিত কয়েকটি সঙ্গীত পরিবেশিত হয় পঙ্কজ কুমার মল্লিকের কন্ঠে।
কিশোর বয়স থেকে লেখালেখি করলেও সুকান্তর কাব্যপ্রতিভার প্রকৃত বিকাশ ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে। পরাশক্তির দোর্দণ্ড প্রতাপ, মৃত্যুর বিভীষিকা, অসম প্রতিযোগিতা তার কবিচিত্তকে রক্তাক্ত করে। ১৯৪০ এ সুকান্ত দ্রোহী কন্ঠে উচ্চারণ করেনঃ
কেঁদেছিল পৃথিবীর বুক
গোপন নির্জনে
ধাবমান পুঞ্জ পুঞ্জ নক্ষত্রে কাছে
পেয়েছিল অতীত বারতা
মেরুদন্ডজীর্ণ তবু বিকৃত ব্যথায়
বার বার আর্তনাদ করে
আহত বিক্ষত দেহ মুমূর্ষু চঞ্চল
তবুও বিরাম কোথা ব্যাগ্র আঘাতের।
[পরাভব]
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকরের কবিতা সুকান্তকে আকৃষ্ট করে। তিনি রবিঠাকুরের কবিতার মাঝে মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। সুকান্তর কবিতায় মানবতাবাদ ও দ্রোহের সম্মিলন ঘটেছিল। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত মন্বন্তর, ফ্যাসিস্ট শক্তির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে যুক্ত হয় সংগ্রামী জনতা। সুকান্ত জ্বলে ওঠেন। অত্যাচারের বিরুদ্ধে উচ্চকিত হয় তাঁর কন্ঠ। তিনি কবিতায় প্রতিবাদকে ধারণ করেন। সুকান্ত চারপাশের পৃথিবীর আর সমাজের অভ্যন্তরের অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হন। তাঁর কন্ঠে স্বাভাবিক প্রকাশ ঘটেঃ
অবাক পৃথিবী। অবাক করলে তুমি।
জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি
অবাক পৃথিবী। আমরা যে পরাধীন
অবাক, কি দ্রুত জমে ক্রোধ দিন দিন।
... ... ........ ... ... ......
হিসেবের খাতা যখন নিয়েছি হাতে
দেখেছি লিখিত ‘রক্ত খরচ’ তাতে।
এদেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম
[অনুভব ১৯৪০]
বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে,
আমি যাই তার-ই দিনপঞ্জিকা লিখে
এত বিদ্রোহ কখনো দেখিনি কেউ
দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ
... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
প্রত্যেহ যারা ঘৃণিত ও পদানত
দেখ আজ তারা সবেগে সমদ্যুত।
তাদের দখলের পিছনে আমিও আছি
তাদের মধ্যে আমিও যে মরি-বাঁচি
.......................................
[অনুভব ১৯৪৬]
সুকান্ত কবিতায় যুগের দাবিকে প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানবতা পদদলিত হয়। দুর্ভিক্ষ দুর্দশা আর সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে কবিতা হয়ে ওঠে প্রতিবাদের ভাষা ও আত্মবিকাশের অন্যতম বাহন। জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ গণবিক্ষোভ ও মেহনতী মানুষের মুক্তিসংগ্রামে কবিতা নিয়ামক শক্তির আধার হিসেবে এসময়ে বিবেচিত হয়। ‘ছাড়পত্র’ ‘ঘুম নেই’ ‘মিঠে কড়া’ ও ‘পুর্বাভাস’-এ যে কবিকে আমরা দেখি সে কবি প্রেমিকার চুল, চোখ কিম্বা কিম্বা বন্দনাকে মুখ্য করে দেখেননি, মাটির কাছাকাছি থেকে সাধারণ মানুষের আনন্দকে স্পর্শ করার চেষ্টা করেছেন। মানুষ্কে তা অধিকার বিষয়ে সচেতন করতে সুকান্ত প্রয়াসী ছিলেন। মানবপ্রেম ও জীবনবাদীতা সুকান্তের কবিতার প্রাণশক্তি। কলম চারাগাছ সিগারেট প্রভৃতি বিষয় কবির কাছে নতুন ব্যঞ্জনা নিয়ে ধরা দিয়েছে। আপন বক্তব্যে দুঃখী মানুষের আত্মকাহিনীতে লেখা কবিতা হয়ে যায় বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনাময়। ‘কলম’ কত কি লেখে; ইতিহাসের ধারাভাষ্য লেখে, সময়কে বন্দী করে রাখে, কলম কি মজুর ও বেকারের কাহিনী লেখে? এমন প্রশ্ন সুকান্ত করেন। সুকান্ত সিগারেটের ভস্ম আচরণের সাথে মানুষের মিল খুঁজে পান। তার স্বাগতোক্তিঃ আমরা সিগারেট/তোমারা আমাদের বাঁচতে দাও না।
সুকান্ত কৌতুহলী। তার কবিতা জীবন ও জনপদের মানুষের দিনযাপনকে তুলে ধরে। সুকান্ত মানুষের সুক্ষ্ম অনুভূতি ও পর্যবেক্ষণকে কবিতাতে বিন্যাস করেন। কবি সুকান্ত সমগ্র বিশ্বের চলমানতাকে কবিতাবদ্ধ করেন। স্বদেশ ও স্বজাতির মঙ্গলচিন্তা তেহকে তিনি বিচ্ছিন্ন হননা। সত কবির দায়বদ্ধতা থেকে তার কবিতা হয়ে ওঠে সর্বজনের চিন্তা ও আচরণের নান্দনিক ফসল। ব্যঙ্গ, কৌতুক তিনি প্রকাশ করেছেন। প্রচন্ড আত্মসম্মানবোধ তার কবিতার দীপ্তি ছড়িয়েছে। মাতাহ উঁচু করে দাঁড়াবার সাহস ও প্রত্যয় তার কবিতার বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে। তার কবিতায় প্রকৃতির রূপরহস্য বিবরণীর পাশাপাশি জগতসংসারের নিয়িমহীনতার বিষয়টি স্পষ্টতর হয়ে ঊঠেছে। অনিঃশেষ জীবনস্পন্দনকে উজ্জীবিত করেছেন কবি সুকান্ত। সুকান্ত অস্বীকার করেছে অনিয়ম ও প্রভুতন্ত্রকে। সুকান্ত ক্রমশ জীবনের ইতিবাচকতায় মগ্ন থেকেছেন। তার রচিত রানার কবিতায় একজন পেশাজীবী হয়ে ওঠেন সমাজের মহানায়ক।
রানার ছুটেছে তাই ঝমঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে
রানার চলেছে খবরে বোঝা হাতে
রানার চলেছে, রানার।
রাত্রির পথে পথে চলে কোন নিষেধ জানে না মানার
দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার-
কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার।
.....................
রানার! রানার।
এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে?
রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে?
ঘরেতে অভাব; পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো ধোঁয়া
পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু টাকাকে যাবে না ছোঁয়া।
..........................................
সময় হয়েছে নতুন খবর আনার
শপথের চিঠি নিয়ে চল আজ
[রানার]
পাঠকরা রানার-এর জীবন কাহিনীতে একাত্ম হয়ে যায়। রোমাঞ্চিত হতে হয় বর্ণণার দক্ষতায়। জীবন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে যারা কবিতা রচনা করেন তারা চরিত্রের সঙ্গে মিশে যান। তাদের অনুভূতি, জীবনের টানাপোড়েন নিজের মধ্যে জারিত করে যে কবিতা লিখিত্য হয় তার বহুতল বোধ পাঠককে আলোড়িত করে।
তারুণ্যের অহঙ্কার সুকান্ত ভট্টাচার্য। সুকান্তের কবিতায় রাজনীতি অধিক মাত্রায় ক্রিয়াশীল। সচেতন কবি রাজনীতির ঘূর্ণিতে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন। সুকান্ত তাই করেছিলেন। ‘পূর্ণিমার চাঁদ ঝলসানো রুটি’ এমন বক্তব্যে কোন চমক নেই, কিন্তু আকর্ষণ আছে। এ আকর্ষন ক্ষুদার্থ দরিদ্র জনমানুষের। জাগ্রত জীবনকে গভীর মমতায় তিনি এঁকেছেন। অনন্ত অনেষ্বা সুকান্তের কবিতাকে মহিমান্বিত করে। দুর্ভিক্ষ, মহামারী, ব্যক্তিগত দুঃখকে জয় করার শক্তি মানুষের মধ্যে নিহিত আছে- এ বিষয় সুকান্ত প্রকাশ করেন। তার কবিতা জীবনক ও দুঃখকে আপন করার মন্ত্রণা দেয়। সুকান্ত রচিত কবিতা ছড়া ও পত্রসাহিত্যে মুন্সিয়ানার ছাপ পরিলক্ষিত হয়। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে উপমা ও বক্তব্যে ঋদ্ধ করার ক্ষমতা তিনি যেভাবে আয়ত্ত করেছিলেন তা বয়সের অভিজ্ঞতা থেকে নয়, বরং জীবনকে কম বয়সে বুঝে নেয়ার ক্ষমতায়। তিনি বলেনঃ
লাল আগুন ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে
কী হবে আর কুকুরের মত বেঁচে থাকায়
কতদিন তুষ্ট থাকবে আর
অপরের ফেলে দেওয়া উচ্ছিস্ট হাড়ে?
..............................
তার চেয়ে পোষমানাকে অস্বীকার করো
অস্বীকার করো বশ্যতাকে
চলো শুকনো হাড়ের বদলে
সন্ধান করি তাজা রক্তের
তৈরি হোক লাল আগুনে, ঝলসানো আমাদের খাদ্য।
শিকলের দাগ ঢেকে দিয়ে উঠুক
সিংহের কেশর প্রত্যেকের ঘাড়ে।
[১-মে’র কবিতা ’৪৬, ঘুম নেই]
বিংশ শতকে জাতীয়-আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাম্রাজ্যবাদী বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে যে আন্দোলন সূচনা হয় তার ঢেউ বাংলা সাহিত্যে এসে পড়ে। বাংলা কবিতায় সংক্ষুব্ধ কন্ঠস্বর আমরা প্রত্যক্ষ করি। সাম্রাজ্যবাদী চক্রের আগ্রাসন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ধর্ম বিশ্বাসে নিপতিত হলে স্বদেশের ঐতিহ্য অন্বেষণে সচেষ্ট হন এ সময়ের কবিরা।
বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীতে গণচেতনায় যুদ্ধের ভয়াবহতা, ঔপনেবেশিকতা শোষণের বিপর্যস্ততা ও অবক্ষয়ী মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এ দ্বান্দ্বিক সময়ে সুকান্ত কবিতায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেন। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শোষকের বিরুদ্ধে তাকে কথা বলতে হয়। এ অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য বিদ্রোহ ও প্রতিবাদ ছিল বোম্বাই-এ নাবিক বিদ্রোহ (১৯৪৬) তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৭-৪৮) আহমেদাবাদে বস্ত্রশ্রমিকদের কর্মবিরতি। সুকান্তের কবিতায় জীবনের উচ্ছ্বাস প্রবলভাবে অনুরণিত। এ কবিতা মর্মপীড়ন হাহাকার ও দুকূলব্যাপী দুঃখকষ্ট তুলে আনেন। সুকান্ত ভুলে যাননি মানবজীবন সুখদুঃখে আন্দোলিত।
সুকান্ত ছিলেন সব্যসাচী কবি। সুকান্ত একসংগে সমকাল ও ভবিষ্যতের কথা বলেছেন। অতীত নিয়ে তার দুঃখবোধ নেই। বর্তমান থেকে উদ্দীপ্ত তার কন্ঠ চিরকালের বাণী ধারণ করে। সমাজের দুই শ্রেণী শোষক ও শোষিতের লড়াইকে সামনে রেখে সুকান্ত কবিতার বিহির্ভাগ অন্তর্জগতকে পূর্ণতা দিয়েছেন।
সুকান্ত বলেনঃ
তোর সেই ইংরেজীতে দেওয়ালির শুভেচ্ছা কামনা
পেয়েছি, তবু আমি নিরুতসাহে আজ অন্যমনা
আমার নেইকো সুখ, দীপান্বিতা লাগে নিরুতসব
রক্তের কুয়াশা চোখে, স্বপ্নে দেখি শব আর শব।
এখানে শুয়েই আমি কানে শুনি আর্তনাদ খালি,
মুমূর্ষু কোলকাতা কাঁদে, কাঁদে ঢাকা কাঁদে নোয়াখালি।
[দেওয়ালী]
মন্বন্তর কবিকে রক্তাক্ত করেছে। তাঁর কবিচিত্তে হাহাকার থেকে জেগে ওঠার আহ্বান প্রতিধ্বনিত হয়েছে। কোন অবি তার সময় থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, কবি সুকান্তও ছিলেন না। শুধু বেঁচে থাকাই জীবনের সবকিছু নয়। প্রবল শক্তিতে উঠে দাঁড়াবার সাহস মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে।
‘বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি’, ‘ঠিকানা আমার চেয়েছ বন্ধু’, ‘জনতার মুখে ফোটে বিদ্যুতবাণী’, ‘কারা যেন আজ দুহাতে খুলেছে, ভেঙ্গেছে খিল’, ‘বলতে পারো বড় মানুষ মোটর কেন চড়বে’ কবি সুকান্তর অত্যন্ত স্পর্শী পঙক্তিমালা। তিনি সমাজ সচেতন কবি। সুকান্ত তার পূর্বসূরি কবিদের অব্যক্ত কথাকে কবিতায় পূর্ণতা দিয়েছেন। তার কাব্যভুবনের অনেকখানি অংশজুড়ে রয়েছে শ্রেণী চেতনা ও দর্শন। তার দর্শন মুক্তির পথ খুঁজে পাবার। জীবনকে গভীর মমতায় সুকান্ত বার বার আবিষ্কার করেছেন। মাঝেমধ্যে হতাশা এসে ভর করলেও তা ছিল সাময়িক। জীবনের ইতিবাচকতা ও আশাবাদ সুকান্তর কবিতার ভিত্তিভূমি। সুকান্ত কবিতাকে আধুনিকতার সঙ্গে সেতুবন্ধন রচনা করেছেন।