অধরা মাধুরী (বর্ণময় অন্তরালে )

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

পর্ব-৫

 

 

 

বেশ অনেক দিন বিভিন্ন কাজের মধ্যে অধরাকে নিয়ে ভাবা হয়নি। না ঠিক তানয় ভাবনাগুলো এসেছে কিন্তু আকার পায়নি। আজও সুবুদ্ধির অনেক কাজ। তবুও আজ বেশ কয়েকবার পড়াতে পড়াতে বা কাজ করতে করতে বার বার অধরার জীবন ঘুরে ফিরে এসেছে তার ভাবনায়। আজ ড্রাইভার নেই। নিজেই গাড়ি চালিয়ে ফিরছিল। বেশ কয়েকবার অন্যমনস্ক হয়ে সিগন্যাল জাম্প করতে করতে বাঁচিয়েছে। সুবুদ্ধি সারা জীবন নিজেকে অনেকটা হাঁসের মত রেখেছে। কত মানুষের সঙ্গে মিশেছে কিন্তু কাউকে  সচেতন ভাবে ব্যাথিত করেনি বা কারও মনের সাথে জড়ায়নি। কাউকে শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধার চেষ্টা করেনি। এমনকি শ্রী ওপরেও সে প্রথাগত স্বামীত্ব ফলায়নি। ওঁর দেখা বা জানা অনেকের ক্ষেত্রেই দেখেছে খুব শক্ত করে সম্পর্কের বেড়াগাছ গুলোকে বাঁধতে গেলে হয় শিকড় থেকে উপড়ে যায় আর নয়তো শুকিয়ে যায়। শ্রীকে সুবুদ্ধি চেনে আজ প্রায় তিরিশ বছরের ওপর আজও একটা নতুনত্ব আছে ওদের মধ্যেতার কারণ বোধহয় ওদের মধ্যে শাসনের বেড়াজাল খুব একটা নেই। দুজনে দুজনকে মেনে নিয়ে চলে।

 

গাড়ি চালাতে চালাতে সুবুদ্ধির দিদিমার কথা মনে পড়ে যায়। জীবনে সুখ পেতে হলে কাউকে বা কোনও কিছুকে শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধিসনা পরে খুব কষ্ট পেতে হবে। নিজের ওজন রেখে চল, শ্রদ্ধাবনতঃ হয়ে চল, শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধিসনা বাঁধলে কষ্ট দিবি অন্যকে আর পাবি অনেক বেশী।সুবুদ্ধি নিজের ওজন বজায় রেখে চলতে জানে। কত প্রলোভন জয় করেছে সে এই পাঁচ দশকের ওপর চলার পথে। কত রকমের চরিত্র দেখা হল! সেই পনের বছর বয়েসে ঘরের বাইরে পারাখা, তার পর কত কি করতে করতে এই ব্যাঙ্গালোর শহরে এসে স্থিতি। স্থিতি কি হয়? আর কি কোনও ষ্টেশনে কম সময় দাঁড়ান আবার কোনও ষ্টেশনে দীর্ঘ বিরতি কথাটা ভাবতে ভাবতেই বাড়ির সামনে এসে সুবুদ্ধি গাড়ি থামাল। মন বিড়বিড়াল, ‘কাল থেকে কথা হয়নি, শ্রী বাইরে। আজ কি দিল্লিতে?

 

ওর মা যখন বেঁচে ছিলেন তখন মা বলতেন তুই কি করে একা একা থাকিস? শ্রীমা (বৌমাকে আদর করে ডাকা নাম) সারাদেশ ঘুরে বেড়ায় আর তুইও এরকম করে কি চলে? সুবুদ্ধি মায়ের কোলে মাথা রেখে বলত, ‘এটাই তো পরীক্ষা মাগো আমিও তো সারা পৃথিবী ঘুরেছি এক সময় তখন শ্রী কি করে একা থেকেছে বল?  আসলে কি জান মা বিয়ে একবারই হয় মনের সম্পর্ক একবারই হয় তুমি আর বাবাও তো সারাজীবন একসাথে... কথাটা বলেই মায়ের চোখের জল দেখেছিল আর তক্ষুণি অপরাধীর মত মাকে জড়িয়ে ধরেছিল। সুবুদ্ধির বাবা চলে গেছেন অনেক বছর আগে মা বাবার একসাথে থাকা পঁয়ত্রিশ বছরেরও ওপরতার পর একদিন হঠাত বাবার চলে যাওয়া। এগার বছর মা একা ছিলেন তার পরে। মায়ের সেই যন্ত্রণা সুবুদ্ধি বুঝত। মা বাবার সাথে ওর এখন ধ্যানের মধ্যে, ঘুমের মধ্যে, নীরবতায় কথা হয়।

 

অধরার কথা মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। শ্রী বা কন্যার শুভার কথা দিনের মাঝে অনেকবার আসে মনে। কিন্তু এই প্রথম কেউ যে ওর কেউ নয় তাকে নিয়ে এত ভাবে সুবুদ্ধি। এটা কি ঠিক? বেঠিক কিছু নজরেও তো পড়েনা তার! অনেক জীবনের কথা ওর কলমে প্রাণ পেয়েছে এর আগে। কিন্তু এই প্রথম কোনও চরিত্র ওকে এতটা ছুঁয়ে আছে। লেখকদের কি সবার এমন হয়! চাবি দিয়ে দরজা খুলে সুবুদ্ধি ঘরে ঢুকল। বুঝল ঘরের শ্রী ফিরে এসেছে। একদিন শ্রী না থাকলে বাড়িটা যেন কেমন শ্রীহীন হয়ে পড়ে। বাড়ি ফিরে দেখে আরেকটা স্পীডপোষ্ট এসেছে। টেবিলের ওপর দূর থেকে দেখেই বুঝল কার ঠিক তখনই শ্রী কিচেন থেকে উঁচু গলায় বলে উঠল তোমার নতুন উপন্যাসের রসদ এসেছে টেবিলের ওপর আছে। শ্রী জানে সবই। তুমি কি দিল্লি থেকে এলে? শ্রী কাছ থেকে তৃতীয়ার তারে উত্তর এল, ‘না চন্ডিগড় থেকে খামটা খোলার এক অদম্য ইচ্ছে হল। কিন্তু সুবুদ্ধি নিজেকে সংযত রাখল। স্নান করে চা খেতে খেতে শ্রীকে বলল, জানঅধরা মাধুরীএকটা উপন্যাস নয় এটাকে কি বলা যায় বলত? এই সৃষ্টিতে আমার নিজস্ব কিছু আছে কি? অধরার পাঠানো রসদ আমি সাজাচ্ছি।শ্রী স্বগোতোক্তি করল তুমি একটু ডিস্টার্ব আছ বলে মনে হচ্ছে! এই হল শ্রী। সব বুঝে ফেলে, বা বুঝে নেয়। নাহ ঠিক তা নয়, আমার কেবল মনে হচ্ছে আমি কেন লিখছি অধরাকে নিয়ে! সুবুদ্ধি এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে চায়ে চুমুক দিল। এরকম তো কত মেয়ের জীবন হতে পারে। শ্রী উঠতে উঠতে বলল, “তুমি মেয়েদের সমস্যা, তাদের জীবন নিয়ে ভাব তাই তুমি লিখছ। এটা আমিতো তোমার শত্রু হলেও অস্বীকার করতে পারবনা। তোমার কলানবমীপড়ে আমি এই বুড়ি বয়েসে তোমার প্রতি আবার আকৃষ্ট হয়েছি অন্য মেয়েদের তো প্রথম বার...” কথা বলেই তাকাল শ্রী তাকাল সুবুদ্ধির দিকে পড়ল সুবুদ্ধির চোখের ভাষাএই লাবন্যময়ীকে তুমি বুড়ি বল?  একটা প্রচ্ছন্ন অহঙ্কার নিয়ে শ্রী রান্না ঘরের দিকে গেল। সুবুদ্ধির হঠাত মান্না দে সেই পুরোন গানের কলি মনে পড়ে গেল বিড়বিড়িয়ে বলেই ফেলল, ‘তুমি একজনই শুধু বন্ধু আমার, একজনই তুমি শত্রু হে, তাই তোমাকেই ভাল লাগে...শ্রী সামনে এসে নীরবে দাঁড়াল  চোখের কোণে হাসিতে এক সরল প্রশ্ন, ‘গাইবে নাকি?সুবুদ্ধি জানে শ্রী সুরে সরস্বতী আর সে নিজে সুরে অসুর। সুবুদ্ধি হেসে বলল, পাগল না কি? আমার বাড়ি ছাড়ার কোনও ইচ্ছে নেই! বলেই দুজনেই হেসে ফেলল। একটা কবিতা শোনাবে?শ্রীর এই আবদার মহার্ঘ সুবুদ্ধির কাছে “...পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থী, আমরা দুজনে চলতি হাওয়ার পন্থী...” সুবুদ্ধিকে থামিয়ে দিল শ্রীর মিষ্টি হাসিতুমি এত লেখ কিন্তু তোমার আমার কাছে আসার সালতি কিন্তু সেই রবীন্দ্রনাথ...!সুবুদ্ধির নীরবতা বলে দিল, ‘তা আর বলতে  রবীন্দ্রনাথ আমাদের শ্বাস প্রশ্বাস, তাই না শ্রী?  

 

এবারে স্পীডপোষ্টে আসা খামটা খুলে পড়তে লাগল। কম্পিউটারে বসার আগে শ্রী একবার এসে সুবুদ্ধির দুই কাঁধে হাত রেখে আলতো করে চাপ দিয়ে বললতুমি লেখ আমি আমার কিছু কাজ করি...আজ রাতে বাইরে খাব কিন্তু...’

 

প্রথমেই অধরা একটা কবিতা লিখেছে চার লাইনের

 

সম্বোধনে কি লিখি তা নিয়ে দ্বিধা নেই হে আমার আরাধ্য

এটাযে ফ্যানমেইল নয় জানেন, আপনার সময় আমার প্রারব্ধ

সকালে নাগপুর উনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের ভেতরে হাঁটছিলাম

নিজেরই অগোচরে আপনার কথা ভেবে এলিয়ে হাসছিলাম

 

আপনি ভাল আছেন আশা করি। আপনার সাজান সংসার নিশ্চয়ই খুব ভাল আছে... আসলে আপনার মত মানুষের সব কিছুই ভাল।

 

বিক্রম আমাকে খুব ব্যঙ্গ করছে আজকাল। কেন জানেন? বলে কিনা, ঠিক সময়ে সিনেমায় নামলে কাজে দিত আর এখন এক বৃদ্ধের কলমে তুমি নায়িকা হবে বলে এইসব ছাইভস্ম লিখছ আর স্পীডপোষ্ট করছ! কথাগুলো বলেই বলল আমি যেন এই সব কথা আপনাকে না বলি। কিন্তু আমি বলে ফেললাম। কেন জানেন? আমি জানিনা। আমি নিজেই বুঝতে পারিনা আমার কথা সব এইভাবে লিখে আপনাকে বলা উচিত হচ্ছে কিনা! কিন্তু এই লেখার সিদ্ধান্ত তো আমার নিজেরই। আপনি তো নিষেধ করেছিলেন শুরুতে। বলে ছিলেন নিজের কথা নিজের কাছেই রাখতে হয়। জানেন আমার না মাঝে মাঝে মনে হয় আমি কি বিক্রমের শাসক ব্যাক্তিত্বের সামনে আরও দুর্বল হয়ে পড়ছি? আমি কি হারিয়ে যাচ্ছি? জানিনা।

 

বর্ণময় অন্তরালেই আমি ছিলাম আছি থাকব কিনা জানিনা। সেটা আপনি জানেন। তাই এই সব আঁকিবুকি ভর্তি কাগজ পাঠালাম।   

 

আমি বাড়ি ছেড়ে আসার পর বেশ কয়েক মাস আমার মা বাবা অন্যান্য আত্মীয়স্বজনেরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন আমাকে নিরস্ত করার জন্য আমাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। আমার বিয়ের জন্য তখনও সম্বন্ধ দেখা হচ্ছে গোপনে। আমাদের বিয়েটাকে বেআইনি বলে প্রমান করার জন্যে সব রকমের চেষ্টা হচ্ছে তখনও! ভাবতে পারেন? বিয়ের পর আমরা দুজন অনেক দিন বিক্রমের বিভিন্ন বন্ধু আত্মীয়ের বাড়িতে রাত কাটিয়েছি। কারণ প্রায়ই বিক্রমের বাড়িতে পুলিশ আসত বিভিন্ন ছলাছলে। আমাদের কাহিনী ঈদানিং কালের রিজওয়ানুর রহমানের প্রেমোপাখ্যানের থেকেও অনেক বেশী বেদনাদায়ক ছিল কিনা জানিনা, তবে আমি খুব মিল খুঁজে পাই। আমাদের পরিবার সেরকম গোঁড়াও ছিলনা বলেই জানতাম। আমরা তো ধর্মান্তরে বিয়ে করিনি কিন্তু... নাহ এসব বিতর্কিত কথা থাক।

 

বিক্রম সারাক্ষণ কেবল দুশ্চিন্তায় কাটাত। আমারও সারাক্ষণ খুব দুশ্চিন্তা হত। বিক্রম আমাকে বাইরে থেকে তালা দিয়ে বাইরে যেত। তার দুটো কারণ ছিল। এক, আমার মা বাবার পাঠান পুলিশ খোঁজখবর নিতে এলে যাতে বাইরে থেকেই চলে যায়। আমাকে বলা ছিল, আমি যেন সারাদিন জানালার পর্দার ফাঁকে চোখ রাখি। কিছু গন্ডগোল দেখলেই বিক্রমকে স্টুডিওতে ফোন করে সাবধান করি। তারপর ব্যবস্থা নেওয়া হত। দুই, বিক্রম জানত যে তার খুবই কাছের কিছু লোক ফিল্ম লাইনের দুএকজন নানা অছিলায় আমার সাথে দেখা করার চেষ্টা করবে। বিক্রম আমার রক্ষাকর্তা হিসেবে এই দ্বিতীয় কাজটা করত। কেউ এলেই আমি ওকে আমি ওকে স্টুডিওতে ফোন করে বলতাম আর কোনও বিশ্বস্ত কাউকে ন্ধ্যের পর পাঠাত আমাকে নিয়ে যাবার জন্যে। তারপর সেই রাতটা কোনও বন্ধু বা ওর কোনও দিদির বাড়িতে কাটানো, সে যে কি অনিশ্চয়তা! সেই সময় আমার যে কি অবস্থা, কি বলব! দুটো মাত্র শাড়ি। মায়ের কাছ থেকে আমার নিজের জামা কাপড় জিনিস আনতে গিয়ে সাধুমামা প্রায় চাকরীটাই খোয়াতে বসেছিল। আমার মা যিনি সংগীতে সরস্বতী, যাঁর সুচারু মন থেকে কত সুন্দর গান সৃষ্টি হয়েছে তিনিই বলেছিলেন, বাড়ি থেকে একটি কুটোও আমি পাবোনাশীতের রাতে বিক্রমের ছোড়দির দেওয়া পাতলা শাল গায়ে আমি ঠক ঠক করে কেঁপেছি আর দিদি বলেছেন কাল বাড়ি গিয়ে যেন শালটা ফেরত পাঠাই। আমি আমার বাবার আদরের দুহিতা যার জামা কাপড়ের আলমারি রাখার জন্য আলাদা দুটো ঘর ছিল। সেই বস্ত্রাভাবে সলজ্জ সম্ভ্রম বজায়ে রেখেছি বিক্রমের সাথে বিয়ের পর। আমি সব সয়েছি মুখ বুজে। সব দেখেছি ধৈর্য ধরে শুধু এক আশাতে, আমার প্রেম আমাদের প্রেম যেন সার্থক হয়। কিন্তু কি হল!

 

আমাদের বিয়ের বেশ কয়েক মাস পরেও বিক্রমকে এই থানা, হেডকোয়ার্টার, অমুক এসিপি বা ডিসিপি কত রকম জায়গায় ডেকে নিয়ে ওকে হেনস্থা করার চেষ্টা করেছে তার ইয়ত্তা নেই। আর আমি সব জায়গায় বিক্রমের সঙ্গে গিয়েছি শুধু যাতে বিপদে না পড়ে। যাতে বিক্রমের গায়ে একটা আঁচড়ও না লাগে। কিন্তু কেন? আমার অবক্ত্য যন্ত্রণার কথা আমি কাকে বল? যার প্রেম স্বীকার করে আমি বাড়ি ছাড়া, যাকে বিয়ে করে আমি আমার মা বাবার কাছে ব্রাত্য সেও কি আমার কাছে স্বচ্ছ ছিল? আমাদের বিয়ের আগে পরে বিক্রমের পরনারী সম্পর্কে কৌতুহল বা তারও বেশি কিছুরই তো অভাব ঘটেনি বিক্রমের। বিক্রমের জীবনে আমি একমাত্র নারী নই। বিক্রমের নারীদের মধ্যে এমনও কেউ আছে যার কথা আমি জানলেও কাউকে বলতে পারবনা ভেবে লজ্জায় সিঁটিয়ে থাকব! আমার হাইপারটেনশন মানে ব্লাড প্রেসার বাড়ল ধরা পড়ল বিয়ের পর পরই। সেই থেকে আজও আছে। আমি ওষুধ খাই বা না খাই সে খবর কেউ রাখেনা আমি আশাও করিনা। একজন খুব স্বল্পকালের জন্য এসেছিলেন আমার জীবনে যার সাথে আমার আত্মিক সম্পর্ক হয়েছিল বা আছেন হয়ত আজও কিন্তু তাঁকে আমি আজও দেখিনি। তিনি আমাকে কত করে বুঝিয়ে ছিলেন কেন আমার নিয়মিত ওষুধ খাওয়া উচিত। কি অসাধারণ ধৈর্য ওনার। আমাকে সব এত সহজ করে বুঝিয়ে ছিলেন যাতে আমি নিয়মিত ওষুধ খেয়ে যাই সেই উনিও চুপ আজ কত দিন ধরে! আর আমি তাকেই লিখছি এই চিঠি যাতে উনি আমার কথা লেখেন! কি আশ্চর্য! তাই না?

 

আজ আমি এই যে লিখছি এটাও তাঁর আবিষ্কার। তিনিই হয়ত এই লেখাকে প্রাণ দিতে পারবেন। আমি তো কাদা মাটি বালি জল এক করে রাখছি। হঠাত মনে হল একটা কথা। বলেই ফেলি এখানে। আমি জানি আমার কষ্ট কল্পনা তাও বলি। সেই পরম আরাধ্য মানুষটি যদি সময় মত আমার জীবনে আসতেন তবে কেমন হত আমার জীবন! কেমন হত সেই কবি প্রেমিক মানুষটি যদি আমার স্বামী হতেন বা আমার বন্ধু বা আমার প্রেমিক তাহলে আমার এই লেখার কোনও প্রয়োজন হত কি? আমার জীবন নিয়ে কি অন্য কিছু লেখা হত? সেই লেখা কি আমার পরম আরাধ্য মানুষটি লিখতেন? কে জানে! এই দেখ, মানস ভ্রমনে বেরিয়ে পড়েছিলাম। কোথায় ব্যাঙ্গালোরের ব্যাপ্ত জীবন আর কোথায় নাগপুরের নকল নেতি দিনযাপন! ধ্যাত!

 

আসলে প্রাপ্তব্য তো মাধুকরী। আমার আজ তো আমার গতকালের ফসল ঠিক যেমন আমার আগামীকাল আমার আজকের ভবিষ্যত।

 

বিক্রমের টালিগঞ্জের বাড়িতে আমার গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে খুব একটা সমস্যা হয়নি। আমার শ্বশুরমশাইয়ের আমার প্রতি একটা নীরব স্নেহ ছিল কিন্তু বাড়িতে তাঁর কথা খুব শোনা যেত বা হত না।

 

বিক্রমের ভীষণ দাপুটে প্রভাব ছিল বাড়িতে। দিদিদের প্রথাগত দেশ ছাড়া বাড়ীর আর সব আমার সহ্যের সীমার মধ্যে এসে গিয়েছিল খুব তাড়াতাড়ি। আমি নিজেই জানতাম না যে আমি এত সইতে পারি। দিদিদের দাদাগিরি প্রায়ই সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যেত কিন্তু আমি আমার নতুন আয়ত্ব করা স্থীতধীশক্তি কাজে লাগিয়ে তাদের বেশ হাসি মুখে বিদায় জানাতাম হয় টেলিফোনে নয়তো সামনা সামনি। আমি বড় হয়ে গেলাম হঠাতই কেমন করে একা একা সব সামলাতাম শোবার ঘর, রান্না ঘর, সংসার, বিক্রমের মেজাজ, তার বন্ধুদের, তাদের মধ্যে কিছু সম্ভ্রান্ত হায়নার দলে পড়ে, বাড়িতে পার্টি থাকলেই আমার গা শিউরে উঠত বিশেষত প্রবাদ প্রতিম কিছু পরিচালক বা প্রযোজক আসার কথা থাকলে আমি কেমন আধমরা হয়ে যেতাম। কিন্তু আমি মা কালীর ভক্ত। আমার শক্তি আমার মা কালী। শক্তি বললে কম বলা হবে, আমি মনে করি মা কালী যা চান তাই হবে। এই বিশ্বাস আমি অর্জন করেছি সেই ছোট্টবেলা থেকে। আমাদের বাড়িতে ঘটা করে মা কালীর পুজো হত তার মূল হোতা ছিলেন আমার বাবা সাধু মামা।

 

আমার কথা সব খাপছাড়া। মানিয়ে নেবেন দয়া করে নিশ্চয়ই। বাড়ি ছাড়ার দিনও আমাদের বাড়ির পরিচারিকা মানদা মাসি আমার বিছানা গুছিয়ে রেখেছে। আমার আদুরে জীবন সচল ছিল সেদিনও! আমার জামাকাপড় সবই কেউ না কেউ এগিয়ে দিয়েছে। আমি খুব আদরে মানুষ হয়েছিলাম সব ভালই কি জীবনের প্রথম পর্যায়ে পেয়ে গেছি আমি? তাই কি...? কে জানে!

 

জানেন? আমি শিউরে উঠি! আমি আমার মেয়ে তিতলীর কথা ভাবি আর শঙ্কিত হয়ে উঠি। আমার মেয়েরও সব গুণ আছে। পড়াশোনায় খুব ভাল। গান গায় খুব ভাল। কিন্তু ভীষন অবহেলা করে নিজের গলাকে। কথায় কথায় বদমেজাজী বাবার হাতে মার খায়। সেই মার আমি কোনও দিন দুঃস্বপ্নেও খাইনি কোনও দিনও। এই চন্ডালের রাগের সামনে আমার মেয়েটা রাক্ষসের হাতের মুঠোয় এক সদ্যজাত শালিকের বাচ্চা মত। বাবার কাছে মার খেয়ে তিতলী যখন আমার কোলে মাথা রেখে কাঁদে তখন আমার গাল বেয়ে গরম বিষাক্ত গলানো শীসে নেমে আসে। কেবল ভাবি, আমার জীবনের মত কি আমার মেয়ের জীবনটাও...? নাহ। সে আমি মেনে নিতে পারবনা। আমি বিক্রমকে কতবার বলেছি, মেয়ে বড় হয়েছে এই ভাবে কেউ মেয়ের গায়ে হাত তোলে তার উত্তরে যা যা শুনি তা আর আমি এখানে লিখতে পারবনা। আমিও বাদ যাইনি সেই চন্ডালের রাগের কোপ থেকে। আমার গায়ে কত চিহ্ন আছে যা বিক্রমের পুরুষকারের নিদর্শন। আমার মেয়েরও। আমাকে আমার মেয়ে বেশ কয়েকবার বলেছে, ‘চল না মা, আমি আর তুমি কোথায়ও চলে যাই এই অত্যাচার আর সহ্য হয়নাআমি তো মেয়ের মা তাই পারিনি। কিন্তু এই অসুরক্ষিত জীবন আর কতদিন...?   

 

 

 

 

পর্ব-৬

 

 

 

 

সুবুদ্ধি আজ খুব দ্বিধায় পড়েছে। স্বামী চিন্ময়ানন্দজীর সেই কথাগুলো আবার মনে পড়ে গেল। ‘কাউকে অন্ধকার গহীন বন থেকে তুলে আলো দেখিয়ে রাজপথে এনে দাঁড় করানো তোমার কাজ হতে পারেনা যদি না তুমি তাঁর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নতুন সকালের নব আলোকে তার সাথে পথ চলতে পার’। দ্বিধা হল এই যে, এত প্রতিভাময়ী অধরাকে সে কি করে আলোতে আনবে!
 
অধরার নতুন চিঠিতে একটা কবিতা লিখেছে, সেটা পড়ে কেমন এক বিষাদের সুর বাজছে সুবুদ্ধির মনে। কি নিবিড় ব্যথা নিয়ে লেখা এই অসাধারণ কবিতা। এই প্রতিভা এতদিন কলসীবাঁধা হয়েছিল!
 


যার কোনও আকাশ নেই
তার কি বা রাত কি বা দিন
যে নদী নামেই নদী
তার কাছে জোয়ার ভাঁটা মূল্যহী
দখিনা বাতাস নাকি বৈশাখী ঝড়
পত্রবিহীন শাখা রাখেনা খবর
ঝরণা ধারা আর দু’চোখের জল
একই রঙ এ সেই বোবা অন্তর
সুর বেসুর সবই একাকার
যার ছেঁড়াতার ভাঙ্গা বীণ
স্মরণের আয়নার টুকরো কাঁচে
ইন্দ্রধনু হয়ে যে আলো নাচে
কূল ভাসানো সেই আলোর ধারা
আসেনা তো অন্ধ হৃদয়ের কাছে
আঁকার আগেই যে ছবি মুছে যায়
সাত রঙের খেলায় সে দাসীন...
 
আমার বর্ণময় অন্তরালে থাকাই ভাল। কি বলেন পাঠককুল!
এই জীবনে যা দেখেছি যা পেয়েছি সবই ভ্রান্তি সবই ভুল...


 
আমি কি করে এক কাপড়ে বাড়ী ছেড়ে এসে নিজেকে মানিয়ে নিলাম এক পরিবেশে যা এক রাত আগেও আমার স্বপ্নের অতীত ছিল! জানিনা। জানিনা বলাটা আমার মুদ্রাদোষ নয় হয়ত বা আমার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এই কথাটি। জানিনা। অনেক কিছুই জানিনা। বিক্রমদের পুরোন বাড়িটা এখন আর নেই। সেটা এখন ফ্ল্যাট বাড়িতে পরিণত হয়েছে। তখন ছিল একটা পোড়ো বাড়ির মতন। তিন পুরুষে কোনও যত্ন হয়নি। জানালার কাঠের পাল্লা ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। আমি এসে আমার শাশুড়ির পুরোন শাড়ি দিয়ে রীতিমত ডিজাইন করে হাতে টানা সেলাই মেশিনে বানিয়ে পর্দা লাগিয়ে ছিলাম। একদিন বিক্রম সন্ধেবেলা ফিরে সেই সাজান ঘর দেখে এক্কেবারে অবাক আর আমাকে খুব...! আমি আমার প্রশংসা করতে বসিনি এখন। শুধু ভাবি, আমিতো সব কিছু আপন করেই নিয়েছিলাম তবে আজও কেন আমার জীবনে একটা স্বাভাবিকতা আজও এলনা? কেন আজও আমাকে অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাতে হয়? বিক্রমের ব্যাঙ্কের চাকরীটা আছে কিন্তু ওর খরচের হাত আর বিভিন্ন নেশার সামগ্রীর খরচের তাড়নায় আমাদের আজও কোনও সেভিংস নেই। না না আমি আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থানের কথা বলার কোনও চেষ্টাই করছিনা। সে সাহস আমার নেই। আর বিক্রম সেই কথা জানতে পারলে আমাকে কি আস্ত রাখবে?
 
এই যে আমি বিক্রমের ভয়ে শিউরে থাকি এটাই আমার কাছে কেমন যেন দম বন্ধ করা এক অবস্থা। গত সতের বছরে বিক্রম আমাকে যত গয়না তৈরী করে দিয়েছে সেগুল সবই আমি ওকে ওরই প্রয়োজনে ওর হাতে তুলে দিয়েছি। কখনই মনে হয়নি যে আমি নিস্বঃ। আমার কোনও ইনসিকিওরিটি কখনও কাজ করেনি। কিন্তু বিক্রম যখন আমার গান বন্ধ করে দিল খরচের দোহাই দিয়ে তখন আমার নিজেকে নিস্বঃ বলে মনে হয়েছিল। আমার আরাধ্য মানুষটি কত করে বলে বলে আমাকে আবার গানের মধ্যে ফিরিয়েছিলেন! কিন্তু বিক্রম সেটা চায় কি? কিন্তু ওর স্ত্রী খুব ভাল গান গায় এটা কেউ বললে ওর বুকটা গর্বে স্ফীত হয়।আমি ওর সম্পত্তি। তাই ও যখন চাইবে আমি গান গাইব আর যখন...এটা আমার ইনসিকিওরিটি! যখন ও আমাকে বলে, নাগপুরের কোনও ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের জন্য মডেলিং করতে তখন আমার নিজেকে খুব ইনসিকিওর্ড বলে মনে হয়। আর রেগে গেলে বা অর্থাভাবে ও যেসব কথা আমাকে বলে সে সব কথা ভাবলে আমার মধ্যে একটা ভয়ার্ত মানবী কুঁকড়ে থাকে। মনে হয় আমি মানুষের জীবন যাপন করিনা আর। আমি কি করি? কেউ আমায় বলে দেবে কি? নাহ! কেউ নেই আমি জানি।
 
রাতারাতি অনাড়ম্বর ঠিকানা পরিবর্তন আমার। মেয়েদের ঠিকানা পরিবর্তন হয়, করতেই হয়। ঠাকুমা বলতেন মেয়েরা প্রথম জীবনে বাবার, দ্বিতীয় জীবনে স্বামীর আর পরিণত জীবনে পুত্রের। আমার ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই আমি বাবার ছিলাম আর যাকে বিয়ে করলাম সে নামেই স্বামী কিন্তু বদরাগী পিতৃসুলভ আচরণের দ্বারা তাড়িত। আর আমার পুত্র নেই।কন্যাসন্তান। সেও একদিন ঠিকানা পরিবর্তন করবে। তবে শেষ জীবনে আমি কার? জানিনা। আমি কি অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাই বিয়ের পর সেই প্রথমদিন থেকে তা কি কেউ জানে? জানিনা! বিয়ের পর প্রায় প্রতিদিন একবার ননদিনিদের কেউ না কেউ একজন সময় করে ফোন করে আমার মাথা খারাপ করার কাজে ব্রতী হতেন। তাতে নিজেকে বেশ শাসিত মনে হত। মনে হত এ’ কি অসহ্য এক অবস্থা! আসলে বিক্রমের থেকে ওর দিদিরা সবাই অনেক বড়। সবচেয়ে বড়দিদির বয়স তখন বাষট্টি। আর সবচেয়ে ছোট দিদির বয়েস একচল্লিশ। আমি তখন তেইশ আর বিক্রম সাঁইত্রিশ। শ্বশুর মশাইয়ের চুরাশি আর শাশুড়ি মা তখন গত হলেও তার একটা বড় ছবি ফ্রেমে বাঁধান আমাদের শোবার ঘরেই ছিল। কি রকম এক বৃদ্ধসভাবৃত আভ্যন্তরীন অবস্থা আমার তেইশ বছর বয়েসে কেউ কি ভাবতে পারে?
 
আমি কি করে বাড়ী ছেড়ে বেরোলাম সেদিন বিক্রমের বাড়ী যখন আসছি তখনও আমি একমুখী তীরের মত ছুটেছি। আজও আমার সেই একই অবস্থা। ফেরার কি কোনও পথ সেদিন ছিল? না ছিলনা। আজও কি আছে? নাহ নেই।
 
আমার মা বিক্রমের ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছিলেন আর আমি বিক্রমের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছিলাম। বিক্রম প্রায়ই সময়ে অসময়ে বাড়িতে চলে আসত। কেউ না থাকলেও একা একা অন্ধকার ড্রয়িংরুমে বসে থাকত। কার জন্য? তবে সেদিন ছাতের ওপর আমাকে জড়িয়ে ও বলেছিল, ওর অপেক্ষার কারণ ও আশ্রয় দুইই ছিলাম আমি। আমিও কেমন যেন কাঁচপোকার মত আগুনের কাছে এগিয়ে আসছিলাম সেই সব দিন গুলোতে!
 
এক অটল বিশ্বাস নিয়েই আমি সেদিন বাড়ি ছেড়েছিলাম। সেই বিশ্বাস ছিল বিক্রম। বিক্রমের চোখের চাউনি বা একটা কথাই শিরোধার্য ছিল আমার কাছে সেই সব দিন গুলিতে। বিক্রমের সেবা করা আমার কাছে ধর্ম হয়ে গিয়েছিল। আমার কেবল মনে হত বিক্রম ছাড়া আমার জীবন বৃথা। আমার বিশ্বাস ছিল বিক্রমই আমার পরিত্রাতা। আজও আছে কি? এই প্রশ্ন কেন? কেন তা তো জানিনা। প্রশ্ন এল মনে, তাকে লুকোইনি কোণে। ছন্দে লিখেই আমার কবির কথা মনে হল। কি অসামান্য কবিতা লেখেন তিনি। আর আমি কিনা তাঁকেই লিখছি ছন্দে! ধৃষ্টতা মার্জনীয়।
 
আসলে সেদিনও আমি একা ছিলাম আজও একা। সেইদিন থেকেই আমি একা! আমার মাকে আমি বন্ধু ভাবতাম অনেকটা প্রথাগত ভাবে যেমন ভাবে আর সব মেয়েরা পায় মাকে। আমিও মাকে সেই ভাবে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মা কি আমার বন্ধু ছিল? জানি না। আমার বন্ধুরা যারা আমাকে একদিন স্কুলে না দেখলে বাড়ী চলে আসত তারা আমাকে আমার বিয়ের পর সম্পূর্ণ বয়কট করল আমার মায়ের অঙ্গুলিহেলনে। নাকি তারা সবাই মনে মনে হেসেছিল স্কুলের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রীর পীড়া ও পরিতি দেখে! আমি কি সিনিক্যাল হয়ে পড়ছি? জানিনা আজ আর কিছুই পরস্কার করে ভাবতে পারিনা।! আমার বন্ধু বান্ধব আত্মীয়স্বজন সবাই আমাকে ত্যাগ করল আমার বিয়ের পরে আর আমি কেমন একা হতে লাগলাম। বিক্রমের ফিল্ম লাইনের কিছু ভাল বন্ধু ছিল যারা নাগপুরে বিক্রম চাকরী নিয়ে আসার পরে আর যোগাযোগ রাখেনি। কেন? জানিনা।
 
বিক্রম আমার স্বামীর সব ভূমিকা পালন করত, করার চেষ্টা করত। বিক্রম আমাকে ভালই বাসত কিন্তু কিরকম যেন এক মালিক সুলভ আচরণের বশবর্তি হয়ে ও আমার সাথে কথা বলত। খুব অল্পদিনের মধ্যেই আমি আবিষ্কার করলাম বিক্রমের চন্ডালরূপটা। ওর সৌম্যরূপ ও প্রেমিকসুলভ কন্ঠস্বর সবাই জানে কিন্তু এই হঠাত বিস্ফোরণের রূপটি আমি প্রথম যেদিন দেখি সে রাতে আমি ঘুমোতে পারিনি। তখন আমি নদী পেরিয়ে নৌকো পুড়িয়ে ফেলেছি। আমার ফেরার কোনও পথ নেই। তখনও আমার মা বাবা বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কি ভাবে বিক্রমকে বেকায়দায় ফেলা যায়! মূলতঃ আমার মায়ের চেষ্টাতেই সব হত আর বাবা ছিলেন কর্মনির্বাহী। কিন্তু আমার বাবা? যিনি আমাকে না দেখে দিন শুরু করতেন না তিনি কি করে...! কত কি নতুন শিখতে লাগলাম সেই তেইশ বছর বয়স থেকে।
 
বিক্রমকে বিভিন্ন থানায় ডেকে নিয়ে যাওয়া হত ভয় দেখিয়ে মুচলেখা দেবার জন্য যাতে সে স্বীকার করে নেয় যে সে আমাকে আমার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে করেছে আর আমি সব যায়গায় যেতাম ওর সঙ্গে এবং আমার কথা বলতাম। আমার বেশ মনে আছে টালিগঞ্জ থানার ওসি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন,  'আপনি কি ওঁদের (আমার মা বাবার) নিজের সন্তান?' আমার অসাড় করু হাসিই সব বলে দিয়েছিল, তাই দেখেই কি তিনি আর কিছু বলেননি? জানিনা।
 
বিয়ের পর বিক্রমের তখন কোনও পাকাপাকি রোজগারের ব্যাবস্থা ছিলনা। ফিল্ম লাইনে যেমন হয়। আজ এল পয়সা আবার কবে আসবে কে জানে? সহ অভিনেতা বা সহপরিচালকদের জীবন কখনই নিশ্চিত ছিলনা সেই সব দিনগুলোতে। এখনও কি সেই অবস্থা? আমি এরই মধ্যে সব চালাতাম। আমি যেন ক্রমেই এক নতুন ক্ষমতা অর্জন করছিলাম সেই দিনগুলোতে। নিজের ভেতরে ভেতরে আরও সাহসী হয়ে উঠছিলাম। আমার ভেতরে নীরব সেই ডানপিটে মেয়েটা আমাকে চালাত। আবার সেই আমিই নীরবে বিক্রমের অত্যাচার সহ্যও করতাম। আমি বলে বলে ওকে ফিল্মলাইনের বাইরে আনার চেষ্টা করেছি। কারণ ঐ জগতের আচার আচরণ সব কেমন যেন অদ্ভুত অস্বস্তিকর লাগত আমার। বিক্রম বি কম পাশ করেছিল। আমি ওকে রোজ বলতাম কোনও চাকরীর চেষ্টা করতে। সামাজিক ও আত্মিক সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আমার অনিশ্চয়তার দিনগুলি কি উতকন্ঠার মধ্যে কাটত তা আমিই জানি। অনেক অজানা নাম না জানা ছবিতে বিক্রম সহ অভিনেতা বা সহ পরিচালকের কাজ করেছে। কিন্তু কখনই কোনও নাম হয়নি ওর। সেও কি এক অদ্ভুত গ্রহের ফের?
 
ইতিমধ্যে বিক্রম ফিল্ম ফাইন্যান্সের মিডলম্যান হিসেবে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের সঙ্গে লিয়াঁজ পার্সন হিসেবেও কাজ করতে শুরু করেছে। যখন কোনও ছবি থাকতনা হাতে তখন ও এই সব করত। কি করবে? পাপী পেটের দায় আর তার ওপর দায় হল নতুন বিয়ে করা সুন্দরী বৌ। ‘আমার সুন্দরী হুরী পরী বৌটা’ এই কথাটা বিক্রমের মুড ভাল থাকলে আমি প্রায়ই শুনতে পেতাম সেই সব দিনগুলোতে। প্রেম করে বিয়ে করে ফেলেছে এমন একজনকে যার বাবা মা তার স্বামীকে শেষ করে দেবার যার পর নাই চেষ্টা চালাচ্ছে।
 
খুব ভাল নেগোশিয়েটর ছিল বিক্রম। সেটা আমি ওর কথাতে আমার মুগ্ধ হয়ে থাকা থেকেই বুঝতাম। আজও আছে। ও যখন কথা বলে তখন অন্যেরা শোনে। ওর নিজের অর্থনৈতিক স্থিরতা না থাকলে কি হবে ওর ক্লায়েন্টদের স্বার্থ ও খুব ভালই রক্ষা করত। ওর কথার মধ্যে এক আকর্ষণীয় মাধুর্য আছে।
 
অনিশ্চয়তা আমার দিন রাতের সঙ্গি তখন। বিক্রমের প্রেম ও হঠাত ওর ব্যবহারিক বিস্ফোরণ এই দুয়ের মধ্যে আমি চিড়ে চ্যাপ্টা। কাকে বলব! কার সাথে শেয়ার করব। কেউ নেই। আমি বুঝে ফেলেছিলাম মাঝ নদীতে বিশ্রাম নেওয়া যায়না। সাঁতার কেটে যেতেই হবে। ইতিমধ্যে একদিন ই বি আই সি আই ব্যাঙ্কের কলকাতার চীফ ম্যানেজার প্রদীপ মুন্সী সাহেব এলেন আমাদের বাড়ীতে ডিনারে। সেটা কিছুটা আমার প্ররোচোনায় বিক্রম ব্যাবস্থা করেছিল। মুন্সী সাহেব সত্যিই সুপুরুষ। গ্রীকদের মত পেটা চেহারা পঞ্চাশোর্ধ সেই মানুষটির। খুব ভাল মানুষ ছিলেন। কথায় কথায় বলে ফেললেন, তিনি নিজেই বললেন, বিক্রম যদি বাইরে যেতে চায় তবে ওকে তিনি নতুন ব্র্যাঞ্চের দায়িত্ব দিতে চান।আমি এত খুশী এই ক'মাসে আর কখনও হইনি। তখন আমি মা হতে চলেছি। মুন্সী সাহেব কি তার দরদী মন দিয়ে বুঝেছিলেন যে আমি কি অসহায় অবস্থায় আছি? জানিনা।
 
শুরুতে বিক্রম কলকাতা ছাড়তে চাইছিলনা। আমি এই প্রথম বিক্রমের ওপর আমার প্রভাব খাটালাম। কান্না কাটি, ওর অন্যায় আবদার আরও কত কি। আমি প্রায় সব রকম ভাবে বিক্রমের মাথা পরিষ্কার করলাম। আমরা এলাম আকোলায়। মহারাষ্ট্রের এই ছোট্ট শহরে বিক্রম এই প্রাইভেট ব্যাঙ্কে ই বি আই সি আই এর ম্যানেজার হয়ে এল। বিক্রম ওর নিজের কাজে খুব দক্ষ। কিন্তু ওর ব্যক্তিগত অনুশাসন বলে কিছু নেই। মদ্যপান ও সিগারেট এই দুই ওর চাইই। শরীর তাই মাঝে মাঝেই সঙ্গ দেয়না। আমি কিছু বললেই বলে, ‘তোমাকে কি খারাপ রেখেছি আমি? এত পিটপিট করলে এখান থেকে যেতে পার।’ যেদিন বিক্রম প্রথম এই কথাগুলো বলেছিল সেদিন আমি সারারাত কেঁদেছিলাম। আর কিই বা করতে পারি আমি? আমার মা বাবা থেকেও নেই।নেই কোনও ভাই বোন। কোনও বন্ধুও নেই। বিক্রম যেদিন প্রথম আমার গায়ে হাত তুলেছিল সেদিন থেকে আমি আরও পাথর হয়ে গিয়েছিলাম।
 
আমি বেশ সাজানো কেয়ারী করা ফুলের টব হয়ে ছিলাম বিক্রম চৌধুরীর সংসারে। আমাকে সর্বত্র বেশ আকর্ষণীয় হয়ে যেতে হত।আজও হয়। আমি না সাজলে আমার গায়ে হাত ওঠে। কেউ জানেনা এসব যন্ত্রণার কথা। আমার রূপ, আমার গানের গলা ও আমার রুচি সব কিছুরই মাত্রাবাধা ব্যবহার করেছে বিক্রম এই সতের বছরে। আমাকে ফিল্মে নামানোর চেষ্টাও করেছে। কিন্তু যখন দেখেছে চারিদিকে শকুনের ভীড় তখন আবার মত পাল্টেছে। কিন্তু বিক্রম আমার মালিক হয়েই থেকেছে। আমি হলাম বিক্রম চৌধুরীর কেনা বাঁদি। সতের বছর ধরে গলার কাছে দলা পাকিয়ে থাকা আজ এই কথা গুলো বলে ফেলে আমার একটু হালকা লাগল। কিন্তু কিসের হালকা বোধ? আমি তো জানি আমার এই জীবন থেকে কোনও নিষ্কৃতিও নেই!
 
আমি সেই যেদিন বাড়ী ছেড়েছি সেইদিন দুপুর থেকে আজও উতকণ্ঠা আমার চিরসাথী। আমি উতকন্ঠার চির সাথী। সাথী আমার নাম। বিক্রমের দেওয়া! আমি আমার সদ্যজাত মেয়েকে কোলে নিয়ে রান্না করেছি, বাড়ীর সব কাজ করেছি, গুরুচন্ডালী মেজাজের স্বামী সামলেছি। আমি বাড়ীর বাইরে পা রাখিনি বছরের পর বছর। হ্যাঁ মাঝে মাঝে বেড়াতে গেছি সপরিবারে। সপরিবারে কথাটা লিখেই কেমন ফিক করে হাসলাম। কেন? আরে আমি ছোটবেলা থেকে পরিবার বলতে কাকা কাকি, জ্যেঠা জ্যেঠি, মামা মামী ও আরও কত আত্মীয় স্বজন তাদের ছেলেপুলেরা সবাকে বুঝতাম আর সতের বছর ধরে আড়াই জনের পরিবারে আমি ডানা ভাঙ্গা টিয়া পাখীটি হয়ে আছি। কেমন সেজেগুজে নীরব শ্রোতা ও অচল দর্শক আমি।
 
নেটে বন্ধুত্ব করার অনুমতি মিলেছে আমার পিতৃপ্রতিম স্বামীর কাছ থেকে এই বছর খানেক হল। কেন পেলাম? সেও বেশ মজার। বিক্রম রাতে ও ছুটির দিনে অনেকের সাথে চ্যাট করে। আমার মেয়ে একদিন সেটা বুঝে ফেলে যে চ্যাটে তার বাবার কত রকমের বন্ধু ও বন্ধুনী আছেন। বেশির ভাগই বন্ধুনী। আমার কানে কথাটা তক্ষুণি আসে। আমি সাহস করে বলি, আমাকে শেখাবে চ্যাট করা? বিক্রমের হাঁপর দোলান শাসনের হাসি সেদিন দেখার মত। ভাবখানা এমন যেন একটি বাচ্চা মেয়ে বলেছে যে সে হাইওয়েতে লং ডিস্ট্যান্স বাস চালাবে! যাইহোক বিক্রম খুব বেশীদিন আমাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারলনা। ঐ যে ভেতরের সেই ডানপিটে মেয়েটা জেগে উঠল। এখন আমি সব সাইটে যাই। দেখি, অনেকটা মানস ভ্রমণের পথে উইন্ডো শপিং করার মত। এমনি করেই এক রবিবার দুপুরে এক বাংলা সাইটে পড়লাম সুবুদ্ধি সেনশর্মার লেখা। এত ভাল লাগল যে ওনাকে মেইল করলাম। উত্তর পেলাম তবে সেটা আউট অফ অফিস মেইল রেসপন্স।
 
তার পর সুবুদ্ধি সেনশর্মার সাথে পরিচয় হল। চ্যাট ও টেলিফোনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তিনি আমাদের বাড়ীর একজন হলেন কিন্তু কি আশ্চর্য আজও আমাদের চাক্ষুষ দেখা হয়নি। উনিই আমাকে বার বার বলে বলে, বিক্রমকে বুঝিয়ে আবার গানের চর্চায় ফিরিয়েছেন। সবই টেলিফোনে বা চ্যাটে। বিক্রম যে সেটা খুব ভাল মনে নেয়নি তা আমি জানি। এই যে আমি লিখছি এ আমার আজও বিশ্বাস হয়না! আর এটা বিক্রমের একদম পছন্দ হয়না। এই সবই সুবুদ্ধির দান। কিম্বা বলতে পারি আমার সু বুদ্ধির উদয়ন। জানিনা। কিন্তু এসব যে বিক্রমের এক্কেবারে পছন্দ নয়! মাঝে মাঝেই টিপ্পনি শুনি আমি। ‘কজন পড়ল তোমার লেখা, গুনেছ সাথী?’ আমি নীরবে হাসি। যে জীবনে একটা বই পড়লনা, মানুষ হয়ে মানুষীর মনকে বুঝলনা কিন্তু তাকে ছিন্নভিন্ন করে রাখল, কোনওদিন কিছু লিখলনা, কিছু সৃষ্টি করলনা সে আমাকে টিটকিরি দিচ্ছে! তখনই মনে হয়,এ সবই আমার প্রাপ্য কারণ আমার আজকের জন্যে আমিই দায়ী...

 

 

 

 

পর্ব-৭

 

 

 

 

কান্তকবি সুকান্তের এক কষ্টোক্তি দিয়ে এই অধ্যায় শুরু। বসন্তের কোকিল কেশে কেশে রক্ত তুলবে, সে কিসের বসন্ত? বসন্তের কোকিল হয়ত সে নয়। কিন্তু বরাবরই সে কন্ঠনির্ভর। প্রগলভ নয় তবে সে বিষয়সমৃদ্ধ। কথা, বলার থেকেও ভাবা বেশী। সেটাই তার পেশা। সেই সুবুদ্ধির কথা বন্ধ হয়ে গেছে। কি করে? গলার ওপর অত্যাচার সেই ছাত্র জীবন থেকে। শ্লোগান মুখী শানান সংগীতের মত ঝলক দিয়ে উঠত সেই চোদ্দ বছর বয়েস থেকে। মনের মধ্যে সেই দুর্দ্দাম প্রতিবাদী কন্ঠ এখনও দুন্দুভি বাজায়। প্রতিবাদে, প্রতিরোধে, প্রতিশোধে কমরেড, গড়ে তোল গড়ে তোল গড়ে তোল ব্যারিকেড,আমার ভায়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী, জীবনে মরণে সেকথা কি আমি কখনও ভুলিতে পারি? এই তো সেদিনের কথা। তাই কি? ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৪ দীর্ঘ পনের বছর সুবুদ্ধি এই নিয়েই দিন কাটিয়েছে। মনের ভেতর একটা চাপা কষ্ট আছে। মনের কষ্ট মনে রেখে সে এখনও কাজ করে যায়। এখন মন মাঝে মাঝে খুব ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। ওর থেকে ওর স্ত্রীর মন বেশী ভারাক্রান্ত এই নির্বাক সুবুদ্ধিকে দেখে। ঘর ছাড়া পর ঘেরা জীবন সুবুদ্ধির বয়ঃসন্ধি কাল থেকেই। তার পর দীর্ঘ সাড়ে তিন দশকের ওপর গড়ে দিনে আট থেকে দশ ঘন্টা ক্রমাগত কথা বলা, পড়ানো, বোঝানো, নীরবতা ছিলনা তার জীবনে প্রায় চার দশক ধরে। কিন্তু আজ সে নীরব। কন্ঠ তাহার রুদ্ধ আজিকে। বাঁশী তো ছিলই না জীবনে কখনও তাই বাঁশী সংগীতহারা হবার প্রশ্ন ওঠেনা। বন্দুকের গুলির আওয়াজ এখন আর তাকে টানেনা, বন্দুকের নলই হল প্রকৃত শক্তির উতস একথা যে ভুল তা সে বুঝেছে বহুকাল আগে। কিন্তু বাকরুদ্ধ সুবুদ্ধির কলমের শক্তি আছে। বাকশক্তিতে সে বিশ্বাস করে এখনও কিন্তু কথা বলতে পারেনা। আজ তার বাকশক্তি নিঃশব্দ নীরব কিন্তু তার কলম রুদ্ধ হয়ে যায়নি। সাময়িক থেমেছিল। তাই আবার কলম ধরেছে সুবুদ্ধি...


আজ অনেক দিন পরে সুবুদ্ধি লিখতে বসেছে। মাঝের ক’টা মাস সুবুদ্ধির কেমন গেছে সে কেবল ঈশ্বরই জানেন। এখনও খুব একটা ভাল নয়। শরীর ও সেই সংক্রান্ত নানান ঝামেলায় লেখা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ভাবনাগুলো আসে আর যায় কিন্তু লেখা আর হয়না। তাই এক শনিবারের সন্ধ্যার সব কিছু এমনকি ঘড়ি ধরা বিশ্রামও বাতিল করে লিখতে বসেছে সুবুদ্ধি। ধরার সব নিয়ম বদলে গেছে সুবুদ্ধির জীবনে গত ছ’মাসে।


ইতিমধ্যে অনেক চিঠি এসেছে অধরার। কত কথা সে বলতে চেয়েছে। কিছু চিঠি এখনও খোলাই হয়ে ওঠেনি। সুবুদ্ধি খুব লজ্জিত বোধ করছে। ধীরে ধীরে অধরার না পড়া একটা চিঠি খুলে প্রথম পাতায় আটকে গেছে সে।


বর্ণময় অন্তরালে থাকা এই নাম না জানা বিদূষী মহিলা কি করে এতদিন ধরে এই সুপ্ত প্রতিভার বর্ণচ্ছটার ওপর ধুষর রঙ মেখে বসে আছে! অধরার চিঠিতে সাধারণত একটা সম্বোধন থাকে। আজ সেখানে একটি কবিতা –
 


হারানো সুর
 

ছিঁড়ে যাওয়া তানপুরার তারে
সুর গিয়েছে সরে সরে
কেন তারে নতুন করে
নতুন তারে বাঁধতে যাওয়া
পরিপূর্ণ বিশ্বাসে আর
আবেগঘন আশ্বাসে
ফিরে কি কখনও পাবে
সে তার পুরোন চাওয়া পাওয়া
শ্বাসরুদ্ধ দমবন্ধ সারাদিন
তানপুরা করুণ হেসে বলে
সুরস্থব্ধ আমি আজ রঙহীন
কবে হব, হব কি আবার রঙ্গিন
কথা দিতে পারিনে ভাই
তোমার সাথে দুটো কথা কব
সে সময়ও নাই
তবে জেনো তুমিই আমার সব
বেশতো ছিলে নীরব
বৃথা কেন এ কলরব!
 


কত না বলা কথা! কত যন্ত্রণার কথা না বলে অধরা বলে দিয়েছে! এরপর অধরার কলমে তার বর্ণময় অন্তরালের কথা।

আমার পরম আরাধ্য মহাশয়,
এর মাঝে বেশ অনেকগুলো চিঠি লিখেছি আপনাকে। কিন্তু আপনি নীরব! কেন জানিনা। সব ভালতো? জানিনা কারণ আপনার খবর জানার কোনও উপায় নেই। অধিকার আছে কি? জানিনা। আমি তাই আমার কথাই বলে যাই। একমুখী আলাপ। আলাপ বলতেই বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। আপনাকে দেওয়া কথা হয়তো আর রাখা গেলনা। তাই আলাপ কথাটা শুনলেই কেমন দমবন্ধ লাগে।


সুর তাল কথা ও লয়
হারিয়েছি এসবের সমন্বয়
জীবন হলোই বা বিষময়
সংগীত তবু সদা অক্ষয়।
 

কিছু বুঝলেন? আমার গান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমি চুপ! বিশ্বাস করি আজও বন থেকে পাখীকে তুলে খাঁচায় রেখে তাকে স্তব্ধ করে দেওয়া যেতে পারে কিন্তু পাখীর মন থেকে সবুজের ইন্ধনে আর নীলের জ্বালানীতে জন্ম নেওয়া সংগীত বন্ধ করে দেওয়া যায়না। মানুষকে গান শিখিয়েছিল তো পাখীরাই। তাই না? তাই আমি চুপ। আমার মন পাখীর গানকে নীরবে উপোভোগ করি আমি। আর ভাবি আবার একদিন আমি গান গাইব। আমি যে একজনকে কথা দিয়েছি। সে কথা যে আমায় রাখতেই হবে।    
সুবুদ্ধি একটু থেমে মুচকি হাসল। তার কথা বন্ধ আর অধরার গান বন্ধ। দুটো ঘটনা একই সময়! অন্ততঃ দেরীতে খোলা চিঠি পড়ে তাই মনে হচ্ছে! দুটো কি কাকতালীয়? দুটো একই ব্যাপার কি? কে জানে!


আমার বর্ণময় অন্তরালে থাকার বর্তমান চেহারাটা এইরকম। আমি এখন আর গান শিখতে যেতে পারিনা। নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক পন্ডিত পুরুষোত্তম কেলকারজী আমার গলা শুনে বিনা দক্ষিণায় আমাকে আবার আমার তানপুরা ধরায় ব্রতী করে তুলেছিলেন। আবার গান শেখা শুরু করতে আপনি যে সাহস জুগিয়েছিলেন তাতে গুরুজীর আশ্বাস আমাকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। বাদ সাধল আমার সংসার। আমার স্বামী বিক্রমের দৃঢ় বিশ্বাস যে আমি মেয়েকে অবহেলা করছি। অথচ এই মেয়ের জন্যেই আমি আজও এই সোনার খাঁচায় নির্বাক বন্দিনী হয়ে আছি। আমি শুধু শনিবার সকালটুকু গুরুজীর কাছে যেতাম। শনিবারের সকালের কয়েক ঘন্টা আর মাঝে সময়ের ফাঁকে ফোঁকরে একটু রেওয়াজ এই করেই গানের মোরামে ফিরে আসছিলাম আমি। আমার নাকি অনেক গুনমুগ্ধ তৈরী হচ্ছে! সেই কারণে বিক্রমের অক্ষম গোঙ্গানী এখন ক্রুদ্ধ আক্রমনে পরিণত হয় প্রায়ই। অথচ এই চল্লিশের বিষাদে ভরা মনের মাঝে প্রশস্তি বাক্য শোনার কোনও অভিপ্রায় নেই। যার কথা বুকে তুফান তুলতে পারত সে তো আমার জীবনে আসেইনি। আমি কি করে গুনমুগ্ধদের খেয়াল করব! গান শিখতে যেতে আসতে কিছু খরচ আছে। সেই খরচও বন্ধ হয়েছে। অনেকটা আমার সামাজিক পরিচয়ের জগত থেকে আমাকে দূরে রাখতেই এই প্রচেষ্টা। বিক্রম আজও একটা ইন্সিকিউরিটিতে ভোগে। ঘরে সুন্দরী বৌ থাকলে সব পুরুষেরই কি এই এক সমস্যা? নারীর সম্ভ্রম বোধের ওপর পুরুষের কি কোনও আস্থা নেই? না কি থাকতে নেই? জানিনা...


আমি কেবল এখন বালিশে মুখ রেখে চোখের জল রোধ করি আর কল্পনায় আমার মায়ের গলার গানগুলো মনের তানপুরায় শুনি আর ভাবি। না কিছু ভাবিনা। ভাবা আমার অধিকারের মধ্যে পড়ে কি?


জীবন এখন অন্য খাতে বইছে। মেয়ে বড় হয়েছে। ক্লাস টেন পাশ করল খুব ভাল রেজাল্ট করেছে। ৯৪% পার্সেন্ট নিয়ে পাশ করেছে। ওর ইচ্ছে জার্নালিজম পড়বে। ভাল একটা জুনিয়র কলেজে ভর্তি হয়েছে। মেয়েকে গান শেখানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ভীষণ ভাল গলা ওর কিন্তু মস্ত ফাঁকিবাজ। কিছুতেই রেওয়াজ করবেনা। কেবল বলে মা তুমি গাও আমি তুলে নেব। ও বোঝেইনা ওর মায়ের গান ওর বাবার চক্ষুশুল। ও এখনও বোঝেইনা সংগীত হল সাধনার জিনিষ। শ্রুতিধর গায়ক হয়না যে তা নয় কিন্তু তারও চর্চার প্রয়োজন। আপনি খুব ভাল বোঝাতে পারেন। কাছে থাকলে হয়ত তিতলিকে একটু গাইড করতে পারতেন। ও আপনার কথা খুব বলে। আপনিতো বিক্রমকেও টেলিফোনে কনভিন্স করেছিলেন যাতে আমার আবার গানের চর্চা শুরু হয়। আপনি অসাধ্য সাধন করেছিলান। কিন্তু আপনি যে কোথায় হারিয়ে গেলেন! জানিনা।


বিক্রম ব্যাঙ্কের চাকরীটা ছেড়েছে। ঠিক কি হয়েছিল জানিনা। তবে হঠাতই সব ঘটে গেল। একদিন অফিস থেকে এসে বলল, 'কাল থেকে আর অফিস যাবনা। ভাবছি ফাইন্যান্সিয়াল কন্সাল্ট্যান্সি করব। অনেক ভাল হবে' একদমে কথা গুলো বলেই বিক্রম বুঝল আমি শীতলতার অতলে হারিয়ে গেছি কখন। এত অনিশ্চয়তা দেখেছি এই সতের বছরে যে আজ আর কোনও কিছুই ভয় দেখাতে পারেনা। তবু ওর তাতে কিছু যায় আসেনা। বলল, খুব ভাল করে কষা মাংস রান্না করতো আজ। সঙ্গে লাচ্ছা পরঠা আর স্যালাড। আমি জানি আমার হেঁসেলের স্বাস্থ্য কেমন! বললাম, জোগাড় এনে দাও। রাঁধুনী তো আছেই তৈরী। তখনই আরেক প্রস্থ অশ্রাব্য কথাবার্তা। আর ভাল লাগেনা। বাজারে এত ধার দেনা করে রেখেছে বিক্রম যে কলিং বেল বাজলে আমার হার্ট বিট বেড়ে যায়। কতকিছুই যে দেখলাম। একজন তার পাওনা শোধ করার জন্য বিক্রমকে বলেছিল তার থার্ড রেট হিন্দি ছবিতে উচ্ছলা এক নায়িকার কাজ করার জন্যে। তাতে নাকি অনেক লিবারাল সিন থাকবে তবে বিক্রমের আপত্তি করার কিছু নেই কারণ ওর দেনা অনেক। কিন্তু বেঁকে বসল আমার মেয়ে। তার জন্যে খুব মার খেয়েছিল বাপের হাতে। তিতলিই সেদিন আমাকে বাঁচিয়েছিল। মেয়ে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেওয়াতে বিক্রমের জেদ কমেছিল। শত হলেও বাবাতো, তাই। কিন্তু আমার মনের মধ্যে কি ঘৃণার জন্ম হয়েছে সেই দিন থেকে তা কি আমি কাউকে বলতে পারব? নাঃ পারবনা। আপনাকে বিরক্ত করছি জানি তবুও আপনিই তো আমার পরম আরাধ্য ও রক্ষাকর্তা। আপনার টেলিফোন কথাগুলো মনে মনে শুনে আর আপনার লেখা পড়ে আমি জোর পাই। মানসিক সেই জোর, সেই ভাবনাই আমার অবলম্বন। সে আপনি যাই ভাবুন।
 

বিক্রমের শরীরও ভাল যাচ্ছেনা। কি একটা নার্ভের প্রব্লেম শুরু হয়েছে। পিঠে ব্যথা হয়। সেটা মাঝে অসহ্য যন্ত্রণায় পরিনত হয় ও কি রকম বেঁকে যায়। আর সেই সময় বা তারপর ওর আচার আচরণ সব কেমন পশুর মত হয়ে যায়। এইতো সেদিন রাতে মেয়েকে কি নির্দয় ভাবে মারল। আমি থামাতে গিয়েছিলাম। তার চিহ্ন এখনও জ্বলজ্বল করছে আমার গলায়। আমি যে কি নরকে আছি তা বাইরে থেকে কেউ বুঝবেনা। আপনাকেই বা আমি লিখছি কেন? হয়ত কিছুটা হালকা হবার জন্যে। আপনি এই পৃথিবীকে জানাবেন কি সুন্দর জীবন বর্ণময় অন্তরালে। আমার শীফন বা ঢাকাই শাড়ীর সাজের আড়ালে যে কি যন্ত্রণা আমি বয়ে নিয়ে চলি সে কথা কারও জানার কথা নয়। তবু আপনাকেই লিখি। এখন শুধু সংসার চালান নয় তার সাথে বিক্রমের চিকিতসাও চালাতে হয়। এক এক বার নিউরোলজিষ্টের কাছে যাওয়া মানে অনেক টাকার ধাক্কা। আমার নিজের গয়নাগাটি যা ছিল তা প্রায় সব গেছে। তবে তার বেশীর ভাগটাই গেছে বিক্রমের ধার শোধ করতে। এখন শুধু বিক্রমের অনিয়মিত রোজগার আর আমার কৃচ্ছসাধন করার অপরিসীম ক্ষমতা দুইয়ে মিলে চলেছে। ঠাকুরকে রোজ ডাকি, যে করেই হোক মেয়েটাকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দাও কিন্তু নিজের জন্যে কিছু চাইনা, চাইতে ভাল লাগেনা। ঈশ্বর তো সব দিয়েছিলেন কিন্তু আমি আজ সব হারিয়েছি... এমনকি আমার গানও! খুব চেষ্টা করি মনের মাঝে পুরোনো গানের সুর নিয়ে বেঁচে থাকতে কিন্তু পরিবেশ এমন যে আমার গলায় গুনগুন করা সুরও এখন বেরোতে ভয় পায়। বিক্রম ভাবে আমি গান গাইলেই অনেকে আমাকে চাইতে শুরু করবে, কি অবিশ্বাস্য রকমের পজেসিভ তাই না? এই তো সেদিন রান্না করতে করতে, চঞ্চল ময়ুরী এ রাত বঁধু যেতে দিওনা, কানায় কানায় ভরে থাকা রাত বঁধু যেতে দিওনা... গানটা গুনগুন করে ভাঁজছিলাম, হঠাত রান্না ঘরে ঢুকে কি সব অশ্রাব্য কথা বলতে শুরু করল বিক্রম। আমার মাথাটা খুব ঠান্ডা কিন্তু কি যে হল আমিও অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে আর পারলামনা। ব্যাস, কি থেকে কি হল কে জানে ড্রয়িং রুম থেকে কম্পিউটার টেবল থেকে ওয়েবক্যাম এর তারটা এনে আমার গলায় পেঁচিয়ে ধরে টান মারতে বাকি ছিল। ঠিক তক্ষুণি কলিং বেল বেজে উঠল। বিক্রমের এক পাওনাদার বন্ধু এসেছিল। আর সেই জন্যেই আমি বেঁচে আছি এখনও। সেই বন্ধুর খুব বিখ্যাত এক শাড়ীর দোকান আছে গড়িয়াহাটে। নিজের একটা ব্র্যান্ড ও আছে। সেই শাড়ীর বিজ্ঞাপনের জন্যে এসেছিল। যদি আমি কাজটা করে দিই তাহলে আমার ফীসটা বিক্রমের দেনার বোঝা কিছুটা কম করে দেয়। সেটা কত তা যদিও বলেনি। আমি কিছুই বলার মত অবস্থায় ছিলামনা। এখনও নেই। পরে জানাব বলে বিদায় করে দিয়েছিলাম সেই রাত্রে। সহধর্মিনী আমি তাই স্বামীর সব কাজে, দেনা শোধ করাতে আমারই সিংহ ভাগ। তবে মার খাবার পুরোটাই আমার আর আমার মেয়ের। কি অবাক লাগে আমার। আমার মা বাবা কোনও দিন আমাকে একটা চড়ও মারেননি আর আজ আমার অঙ্গেরব ভূষণ হল স্বামীর হাতে মার খাবার চিহ্নসমূহ। আমি কেন আছি এই নরকে? আমার মেয়েটার যেন কোনও ক্ষতি না হয়, তাই কি? মানুষ বাঁচে তো আশায়! আমি কোন আশায় বেঁচে আছি?
 

এইখানে এসে সুবুদ্ধির নিজের প্রতিবাদী সত্ত্বাকে অপমানিত বলে মনে হয়। চুপ করে বসেছিল লেখা বন্ধ করে। শ্রী এসে বলল, সুভা আর আমি বসে আছি। চল খাবে চল। নীরবে অধরার চিঠিটা শ্রীর হাতে তুলে দিয়ে চুপ করে বসে রইল সুবুদ্ধি। শ্রীই নীরবতা ভংগ করল। ন্যাশনাল উইমেন্স রাইটস কমিশনের কাছে ব্যাপারটা তোলা দরকার। বলেই তাকাল সুবুদ্ধির চোখে। সেই চাউনির মধ্যে এক নিস্ফল প্রচেষ্টার দীর্ঘশ্বাস এর শব্দ শুনতে পেল সুবুদ্ধি। যার বাকশক্তি একদিন কত পাহাড় টলিয়েছে আজ তারই জ্ঞানাধীন এক মারাত্মক সামাজিক অপরাধ হয়ে চলেছে কিন্তু সে আজ বাকরুদ্ধ! কি অসহায় অবস্থার মধ্যে সুবুদ্ধি আছে সেটা শ্রী বেশ ভাল বোঝে। তাই আলতো করে ওর কাঁধে হাতের চাপ রেখে বলল, তুমি আবার কথা বলবে, আমি জানি...  

 

 

 

পর্ব-৮

 

 

 

 

 

বরষা এসেছে। আকাশ কালই থাকে বেশির ভাগ সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। মনের আকাশ? সুবুদ্ধি কেমন আনমনা হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে আর নিজের আবৃত্তির সিডি গুলো নেড়ে চেড়ে দেখে। শ্রী এসে বলে, চালিয়ে দিই একটা এখন? সুবুদ্ধি নীরবে মানা করে। কন্ঠস্বর নিস্তব্ধ হয়ে গেলে মনের সব আনাচে কানাচে কত কি উঁকি দেয়। এটা এত ভাল করে আগে কখনও সে বোঝেনি।


চিকিতসার জন্য ভিয়েনা যাবার একটা বেশ ভাল প্রস্তাব এসেছিল শ্রীর অফিসের সরকারী চত্বর থেকে। ন্যায়সঙ্গত পথেই। শ্রী কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপদে আসীন কিন্তু সুবুদ্ধি কোনও আলোচনা করার অবকাশ রাখেনি। একটা চিরকুট লিখে শ্রীকে শুধু প্রশ্ন করেছিল, এদেশ থেকে ডাক্তার গিয়ে আমেরিকার বা বিভিন্ন দেশের চিকিতসা ব্যবস্থা চালু রেখেছে আর তুমি চাও যে আমি আমার দেশের ডাক্তারদের অপমান করি...? যা হবার এদেশেই হবে। এদেশ যদি তাকে জীবনের বিভিন্ন সোপান পার করে এনে এই পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে থাকে তবে এদেশেই তার সুস্থ হবার ব্যবস্থা আছে – এই বিশ্বাসই সুবুদ্ধি রাখে। কথা বন্ধ হলে কি হবে, শ্রী জানে সুবু যা করে ভেবেচিন্তেই করে। মাথাটা খুব পরিস্কার। আশঙ্কার মধ্যে আছে শ্রী তবুও আর কথা বাড়ায়নি। শ্রী'র আরেক চিন্তার কারণ হল এই মানুষটার চুপ করে থাকা মানে অনেক মানুষের মুস্কিল আসানের জীবন, ঘটী ডোবেনা তাল পুকুর হয়ে যাওয়া আর সেটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা। সুবুদ্ধির এই অসহায় অবস্থাটা যে কি তা শ্রী জানে তাই খুব চেষ্টা চালাচ্ছে যদি কোনও ভাবে ওঁকে আবার কথা বলানো যায়।


অধরাকে নিয়ে লেখার কাজ শেষ করতে চায় সুবুদ্ধি। আজ আবার অধরাকে নিয়ে লিখতে বসেছে। একটা চিঠি খুলে পড়ল। খামের মধ্যে রাখল। আবার খুলে পড়ল। কি এক অস্থিরতা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। অধরা কবিতা লিখেছে আবার, সুন্দর...


দিশা


কে গো তুমি
আমায় আবার জাগালে
জাগ্রত সত্ত্বা আমার
খুঁজে ফেরে তোমায় বারবার
কাছে এসেও ফিরে ফিরে যাও
আসতে পারনা কি চিরতরে
এই প্রাণের নাগালে
আমি যে আমি
ভুলেই ছিলাম প্রায়
কত যন্ত্রণা সয়েছি
বিষাক্ত ক্ষত সারা গায়ে
তুমি দেখালে নতুন দিশা
জাগালে নতুন আশা
বলেছ মনকে জ্জীবিত কর
ফেলে দাও এই হতাশা
বেশ তো আবার হোক নব সূর্যোদয়
আর কোনও দ্বিধা দ্বন্দ্ব নয়
নব নব রূপে যা কিছু সৃষ্টি
আমার মন ভেজানো বৃষ্টি
সে তো আমার নয়
সে তোমারই জয়।
 


এই কবিতা পড়ে সুবুদ্ধি কি কিছু ইঙ্গিত পাচ্ছে? কার কথা বলেছে সে? কে সে? সুবুদ্ধি নিজে জানে সে কিছুই করে উঠতে পারেনি অধরার জন্য। তবুও তার এত বিশ্বাস! এই মহিলার কপালে কত দুঃখ আছে আর? চারিদিকে অধরার হতাশার প্রয়াগ সন্মেলন আর সে কিনা টেলিফোনে আর বিরল চ্যাটে কিছু কথা তাই নিয়ে জীবন যুদ্ধে নতুন করে ব্রতী হয়েছে! এই কি জীবন? এই কি ভালবাসা? সুবুদ্ধি চুপ! কিন্তু ভাবনাহীন নয়।


ধীরে ধীরে সে অধরার আরেকটি কবিতা পড়ে।

 

স্বগোতোক্তি

একা একা পথ চলা
নিজের সাথে কথা বলা
তুমি আমি আছি সুখে তাই কি হয়
এ’ কি খরগোশের মত ভান করা নয়?
মৃত প্রাণে বাঁচার খেলা
বাঁচার আশা হেলা ফেলা
একা দ্বীপে বাস করি
ও’হে বলে যাও
একটু হাতটা বাড়াও
কোথায় আমার ইচ্ছে তরী
পাড়ি দেবো ঐ সাগরে
দামাল ঝড়ে সেই গভীরে
নিয়ে যাবে মোরে ঐ সূদূরে
দোহাই তোমার বন্দী রেখোনা আর পিঞ্জরে
পরিত্রাণ কর মোরে হে ঈশ্বর
নশ্বর দেহের মাঝে আত্মা অবিনশ্বর।



কি ভাবছে অধরা? কি ভেবে এই লেখা? কিছুই জানার উপায় নেই। আবার কলম ধরেছে সুবুদ্ধি নিজের ইচ্ছায়, কাউকে জিঞ্জাসা করে তো নয়। অধরা কেন চিঠি লিখছে সেটা সে’ কিছুটা বোঝে। একটা জানালা খোলা রেখে তার মধ্যে দিয়ে সে তার মনের কষ্ট লাঘব করতে চায়। করুক না। সুবুদ্ধি মনে মনে অধরার বন্ধু।
 
বন্ধু মানে মেঘলা দুপুর শিশির মাখা ভোর।
বন্ধু মানে মনের মাঝে কোথাও একটু জোর।
বন্ধু মানে স্বল্প কথা একটু অভিমান।
বন্ধু মানে মনের মাঝে কোথায় একটু টান।
 

সুবুদ্ধি জানে বন্ধুত্ব কি রকমের পাগল করা রোমান্টিসিজম! তার প্রাণের বন্ধু সন্টুকে ওরা যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনের কোলাপ্সিবল গেটের মাঝে চেপে ধরে মাথাটা থেঁতো করে মেরে ফেলেছিল আর সে কিছুই করতে পারেনি। সেই শোকের থেকে আজও বেরোতে পারেনি। সন্টুকে বাঁচাতে পারেনি। সন্টুর সাথে কথা হয় একান্তে আজও। সন্টু প্রশ্ন করে,'কেমন আছিস ফাইটার?' সুবুদ্ধির ডাকনাম। সন্টুর শেষ কৃত্যও হয়নি। মাসীমার সামনে যাওয়ার সাহস হয়নি গত পঁয়ত্রিশ বছরে। মাসীমা কি বেঁচে আছেন? তাও জানেনা সে। সপ্রতীভ সুবুদ্ধির আরও কিছু অন্ধকার দিক আছে। সন্টুকে বাঁচাতে এগিয়ে গেলে সেদিন দুটো প্রাণ যেত। তখন এক একটি প্রাণের প্রয়োজন ছিল ভীষ। আর সুবুদ্ধিদের নিঃশেষ করতে আর সেই নতুন প্লাবনকে রুখতে ওরা নেমেছিল সদলবলে সশস্ত্র সঙ্গে ছিল পুলিশ – নৈতিক ভাবে ওরা হেরে গিয়েছিল অনেক আগেই, পারেনি সেই প্লাবন রুখতে তাই হত্যালীলা শুরু করে দিয়েছিল। সেই হত্যা লীলার শিকার যারা হয়েছে তাদেরকে ওরা হালাল করা মুর্গির থেকে বেশি কিছু মনে করেনি সেদিন। তাই আজও ধিকিধিকি ছোট বড় স্ফুলিংগ জ্বলছে সারা দেশ জুড়ে। যদিও আন্দোলনের চরিত্র বদলে গেছে। যাবেই কারণ লক্ষ্য এখন অপরিষ্কার। নতুন প্রজন্ম জানেনা সেই আন্দোলনের ইতিহাস।

বিনা টিকিটের ট্রেন যাত্রি হয়ে কবে যে কখন মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত প্রান্তরে কিম্বা পুরুলিয়া বাঁকুড়ার গহীন জঙ্গলে দিন কাটানোর অভ্যাস করে ফেলেছিল সুবুদ্ধি সে নিজেও জানেনা। দাঁড়াশ সাপের পোড়া মাংস আর আধসেদ্ধ মাইলোর কাত্থ খেয়ে প্রাণটুকু ধরে রাখা আর খবরের আশায় এদিক ওদিক চেয়ে থাকা। পুকুরের জল খেয়ে বেঁচেছিল। মাঝে একদিন মহুয়া খেয়ে আদিবাসীদের সঙ্গে নাচা, প্রয়োজন তখন বাঁচা।


প্রাণ বাঁচানোর জন্যে তখন কি না করতে হয়েছে! সুবুদ্ধির এখনও মনে হয় সেই আদিবাসীরা ওকে ভালবেসে ফেলেছিল। ওকে আড়াল করে রাখত ওরা। তাই যেদিন প্রাণ বাঁচাতে রাতারাতি ডেঁরা ও অঞ্চল বদল করতে হয়েছিল সেদিন ওদের সকলের চোখে এক কাতর আকুলতা দেখেছিল সুবুদ্ধি। সে যেন না চলে যায় ওদের ডেঁরা থেকে কিন্তু তাকে যেতে হয়েছিল। তাকে যেতে হয়েছিল, পালাতে হয়েছিল। দিনে এক জায়গায় আবার রাতের আরেক জায়গায়, সে এক অনিশ্চিত জীবন! সেই হত্যালীলার কষাইদের হাত থেকে বাঁচতে প্রায় বুকে হেঁটে, সাইকেল করে রাতারাতি মধুপুর, গিরিডী আরও কত জায়গা ঘুরেছে সে। অনেক দিন পরে পরে নেতাদের সাথে যোগাযোগ হত আর শুনত কতজন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এই ক'মাসে। নিজেকে কিরকম অকিঞ্চিতকর লাগত। কেন এই বেঁচে থাকা? কেন এই পালিয়ে বেড়ানো? এর থেকে ওদের কয়েকটা কে শেষ করে নিজের প্রাণ আহুতি দেওয়া ভাল কিন্তু নেতৃসঙ্কুলের আদেশ। আন্ডার গ্রাউন্ড হয়ে যাও।


শেষমেষ যখন যখন নিজের শহর কলকাতায় ফিরতে পারল সুবুদ্ধি তখন অনেক বড় বড় মস্তিষ্ক নিলাম হয়ে গেছে। আর যারা নিলাম হতে চায়নি তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হত্যালীলা স্তিমিত কিন্তু স্তব্ধ নয়। প্রথমদিন ইউনিভার্সিটিতে এসে নিজেকে হেড ডিপ এর কাছে পরিচয় দিতে হয়েছিল তাকে। এঞ্জিনিয়ারিং পড়াটা তখন আর ভালবেসে পড়া নয়। এক বছর পেছিয়ে পড়েছে বলে নয়, পড়ার প্রতি ভালাবাসা ছিলনা অনেক কারণে, বন্ধুহীনতা, সন্টুর কলেজ ক্যাম্পাসে খুন হওয়া, কারোর কোনও তাপ উত্তাপ ছিলনা তাই নিয়ে। কেমন যেন নিজভূমে পরবাসী সুবুদ্ধি কোনক্রমে কলেজে আসত এক লজ্জিত হেরে যাওয়া মানুষ হিসেবে। আজও সেই যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খায়।


সে জানে এখন বন্ধু কি! সে জানে পঁয়ত্রিশ বছরের পুরোন বন্ধু সুমনকে ব্যাঙ্গালোর শহরে খুঁজে পাওয়ার আনন্দ কি! সুমন অনেক বদলে গেছে কিন্তু সে সুবুদ্ধির অভিন্নাত্মা বন্ধু। ঐ যে বন্ধু শব্দটার দুর্দাম প্রচন্ডতা। এক দুর্দমনীয় রোমান্টিসিজম তাকে বন্ধুত্বের প্রেমে পাগল করে রেখেছে। এই নীরব সময়ে সেই সব স্মৃতির আসা যাওয়ার পথের ধারে সুবুদ্ধির বসে থাকা। তার মন বলতে চায়, আসা যাওয়ার পথের ধারে আমার বাড়ি; কেউবা আসে ওপার হতে, পাড়ের ঘাটে কেউ খেয়া দেয় পাড়ি, আসা যাওয়ার পথের ধারে আমার বাড়ি। কিন্তু কন্ঠ তাহার স্তব্ধ আজিকে বাঁশী সংগীতহারা, অমাবস্যার কারা। সুবুদ্ধির হঠাত মনে হল সে নিজেকে নিয়ে একটু বেশীই ভাবছে। আবার সে অধরার মনে কলম রাখে...
 

    * পর্ব ৯ - শেষ পর্ব *