বৃষ্টি নীল জল
ধারাবাহিক উপন্যাস
(পর্ব ১-৫)
~~ নীল ~~
jodi_bolo@yahoo.com
© লেখক
১
রিমি কাজলদানীর দিকে তাকিয়ে আছে। কাজল চোখে দেবে? নাকি দেবে না? সে কোন একটা সহজ সিদ্ধান্ত সহজে নিতে পারে না। একটু দোনোমনো ভাব করে সে কাজলদানীটা তুলে নেয়। এটা তার নানীর। তারপর মা’র। তারপর রিমির। সে আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো কাঠের কারুকাজ করা কাজলদানীটার দিকে। তারপরে খুব যত্ন করে কাজল দিল দুচোখে। দুই ভ্রূর মাঝে ছোট কালো টিপ। দুই মিনিটের তাড়াহুড়োর মাঝে ব্যাগের টুকিটাকি সবকিছু গুছিয়ে নিল সে।
বাসা থেকে বের হয়ে দেখে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিপড়া শুরু হয়েছে। ছাতা আনা উচিত ছিল। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সে মেঘের গর্জন শুনেছিল। সে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মাঝেই রিক্সা নিল। হুড ফেলে এবার ঠান্ডা মাথায় ভাবতে থাকে। সে যে স্বাধীনতাটা নিয়েছে সেটা কি ঠিক? সে বিরক্তিতে কপালের ভ্রূ কুচকায়। তার চব্বিশ বছরের মাথায় কিছু ঢুকছে না। বিয়ে। জীবনের সহজ কোন সিদ্ধান্ত নয় যে সহজে নেবে। সাদা নাকি কালো জুতা পড়বে এই চিন্তায় তার যেখানে আধঘন্টা সময় যায় সেখানে সে এক রাত্রির মাঝে কি করে এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিল সে জানে না।
হৃদয় জি ই সি’র মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় আধঘন্টা। সে শান্ত ভঙ্গীতে সিগারেট টানছে। আর মাঝে মাঝে তার সাদা পাঞ্জাবীর ডান পাশের এক টুকরো ছেঁড়া অংশের দিকে উদাসভাবে তাকাচ্ছে। রিমি দেখলে খুব রাগ করবে। কিন্তু তার কি দোষ। রিক্সাতে উঠার সময়ে টান লেগে এই অবস্থা। কিন্তু রিমি সেটা বুঝবে না। এই দুনিয়াতে যদি মেয়ে জাতিটা না থাকতো তবে কতই না ভালো হতো। সে ভাবে। মানিব্যাগ বের করে ৫০০ টাকার সবেধন নীলমণি নোট টাকে এক নিজির দেখে নেয়। তার অফিস থেকে তিন মাসের বেতন এখনো দেয় নি। রিমি জানে না। জানলে অহেতুক চেচাঁমেচি করবে যেটা হৃদয়ের একটুও ভালো লাগে না। বোকা আর মাথাগরম মেয়েমানুষ। সে গুন গুন করে একটা গানের সুর গলায় আনতে চেষ্টা করে’আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান’। গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মাঝে তার হঠাত এই গান কেন মইনে আসলো সেটাই সে ভেবে পায় না। রিমিকে আজ সত্যিই সে বিয়ে করে ফেলবে? তার আরো কিছু সময় দরকার ছিল। এখনো সে নিজেই ঠিকমতো চলতে পারে না। রিমির বাবার উপরেই তার যত বিরক্তি গিয়ে পড়ে। মেয়ের বিয়ে কানাডার ছেলেটার সাথে এত তাড়াতাড়ি ঠিক করার দরকারই বা কি ছিল! সে আরো জোরে সিগারেটে টান দেয়। বৃষ্টি হঠাত আরো জোরে পড়তে শুরু করলো।
আজ স্বরূপের ক্লাস ৯.৩০ থেকে। সে শাটল্ ট্রেনের ভীড়ের মাঝে কোনভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এই সাতসকালেই ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা এত এনার্জি কোথা থেকে পায় সেটা সে কোনদিনই মাথায় আনতে পারে না। এই ট্রেন শহর থেকে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে যায় পঁচিশ কি.মি. দূরের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে ট্রেনের ভীড়ের মাঝে চোখ বুলায়। কিছু ছাত্র বই নয়ে মনোযোগ সহকারে পড়ছে। এদের মনে হয় পরীক্ষা।’বেচারা!’। মুখে একটা সহানুভূতির হাসি ফুটে ওঠে তার। এদের পাশেই গলা ফাটিয়ে গান গাইছে কিছু ছেলে। এরা মানুষ নাকি যন্ত্র সেটা সে মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। এই সকালবেলায়-ই গলায় এত জোর পায় কি করে! ইশ্বর এদের গলায় আরো শক্তি দিক! আজ সে ‘প্রথম ট্রেন’ মিস্ করেছে। এটা ‘দ্বিতীয় ট্রেন’ ভার্সিটি যাওয়ার। সকাল ৮.১০-এ ছাড়ে শহর থেকে। প্রথম ট্রেনে তার ক্লাসের বন্ধুরা সবাই একসাথে যায়। তাই এখন সে একা। ঘড়িতে এখন বাজে ৯.২০। সে ক্লাশে ঠিক সময় যেতে না পারলে স্যার ঢুকতে দিবে না।
ভার্সিটি ট্রেন স্টেশন। এক পাশে পাহাড়। বৃষ্টিতে ভিজে আরো সবুজ হয়েছে সবুজ গাছগুলো। তার পাশে লাল রঙের বৃটিশ আমলের স্টেশন মাস্টারের ছোট একতলা বিল্ডিং। একটা অনেক লম্বা প্রায় দুই কি.মি. সোজা রাস্তা এসে মিশেছে রাঙামাটি রোড থেকে স্টেশন পর্যন্ত। সেই রাস্তার দুধারে সারিসারি কদম আর মেহগনির গাছ। এই বর্ষায় হলুদ কদমফুলে ছেয়ে গেছে গাছগুলো। কিছু চাপাফুলের গাছ। অনেক বিশাল। সোনালী চাপাফুলের সমারোহ। তার দুপাশে অবারিত সবুজ ধানক্ষেত অনেক দূরে দিগন্ত ছাড়িয়ে মিশে গেছে দূরের পাহাড় সারিতে। এই রাস্তার নাম দিয়েছে ছাত্ররা হাইওয়ে টু হেভেন।
সেই রাস্তার এক পাশে ইউনুইভার্সিটি স্টেশনের কাছে একটা ছোট দোকান। সেই দোকানের দোকানী রমিজ পাগলা। সবাই তাকে কেন পাগলা বলে সেটা সে কোনদিন ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেনি। এই সকালবেলা সে সাধারণত দম ফেলার সময় পায় না। ভার্সিটির ছেলেমেয়েদের ভীড় দোকানে লেগেই থাকে। চা , সিঙ্গাড়া, পুরি, কেক, কলা আর সিগারেট। আজ কেন জানি তার দোকানে ভীড় নেই। সে তার আধাপাকা দাড়িতে হাত বুলায় আর আকশের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে কথা বলতে থাকে। স্বরূপ ধীরে ধীরে রমিজ পাগলার দোকানের বেঞ্চিতে এসে বসে। সে খুব দ্রুত হাঁটতে পারে না। ছোটবেলার পলিও তার দুই পায়ের অনেকটুকু শক্তিই কেড়ে নিয়ে গেছে।
‘রমিজ ভাই, এক কাপ চা দাও। বাকীর পয়সা খুঁজো না। ফুটা পয়সা নাই। দুইটা সিঙ্গাড়া দিও। বাকীর খাতায় লিখে রাখো।’
রমিজ পাগলা গজগজ করতে করতে চা বানাতে শুরু করলো। ‘এমন করে কি ব্যবসা করা যাবে! রমিজের মা তুমি দেখলা না। বেঁচে থাকতে দেখলা না।’
স্বরূপ এইসব পাত্তা দেয় না। সে জানে এইসব রমিজ ভাইয়ের মনের কথা না। ‘সুমিকে দেখেছ রমিজ ভাই?’
রমিজ মাথা নাড়ে। ‘আফারে দেহি নাই’।
স্বরূপ সামনের রাস্তার দিকে তাকায়। আজ আর ক্লাস করতে ইচ্ছা করছে না। সে তার মানিব্যাগের ভাঁজ থেকে অনেক যত্ন করে রাখা, চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া সিগারেট টা বের করে। হাতের তালু দিয়ে গোল আঁকার চেষ্টা করে।
রমিজ পাগলার দোকানের টিনের চালার উপরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। স্বরূপের চোখের গ্লাসে বৃষ্টির ছাট এসে ঝাপসা করে দিল। তবু সে বৃষ্টির মাঝে দেখতে পেল একটা শ্যামলা মেয়ের অবয়ব। এই দিকেই আসছে। সে চশমা খুলে রুমাল দিয়ে পরিষ্কার করতে থাকে।আর ফিসফিস করে যেন শুনতে না পায় সেভাবে বলল,’কেমন আছো সুমি?’
২
উল্টানো ছাতাটাকে সোজা করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে পুজার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। রাস্তার মানুষজন সব তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। তার জামাকাপড় সব ভিজে এক। সে কোনমতে ছাতাটাকে সোজা করল। তাকে অনেক দূর হাঁটতে হবে। ফুটপাথে জমে থাকা জল সাবধানে এড়িয়ে সে দ্রুতপায়ে হাটতে লাগলো। তার বয়স ২০ বছর। শ্যামলা গায়ের রঙ। লম্বা চুল আর সুন্দর দুটি চোখ নিয়ে মোটামুটি সুন্দরী বলে চালিয়ে দেয়া যায়। সে কপাল আর ঘাড় থেকে ওড়না দিয়ে জল মুছে নেয়। এতো বৃষ্টি তার ভালো লাগে না। তাকে যেতে হবে তিন্নি খালার বাসায়। সেইখানে সে বিভিন্ন ধরণের খাবার বানাতে সাহায্য করে। সেই খাবারগুলো যায় কিছু বেকারীতে, কিছু বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। মাস শেষে কিছু টাকা সে পায়।
সে যখন তিন্নিখালার বাসায় পৌঁছাল তখন জলকাদায় সে মোটামুটি মাখামাখি। তিন্নি খালা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। দরজা খুলে দিয়ে এক ধমক লাগালো। ‘এইভাবে কাক ভেজা হয়ে আসবার কোন দরকার ছিল? না আসলেও পারতি আজকে।বাপরে বাপ। এমন বৃষ্টি বাপের জন্মেও দেখিনি। সবজায়গায় পানি উঠে গেছে, না? দাঁড়া, গামছা এনে দিই। মুছে ফেল। না হলে ঠান্ডা লেগে যাবে। ’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ঘরের ভিতর থেকে গামছা নিয়ে আসলেন।
পুজা চুল মুছতে মুছতে রান্নাঘরের দিকে হাঁটতে লাগলো। রান্নাঘরের পাশেই খালার মেয়ে জুঁই এর রুম। সে একটু উঁকি দিয়ে দেখে। জুঁই পড়ছে। সামনে পরীক্ষা। সে তাকিয়ে থাকে জুঁইয়ের দিকে। মেয়েটা এত সুন্দর কেন? সবে মাত্র মাধ্যমিক পরীক্ষা দিবে। তবু কি সুন্দর স্বাস্থ্য। গভীর টানা টানা চোখ।
“জুঁই, কিরে কি পড়িস?”
“পুজাদি, একটুও ডিস্টার্ব করবে না। বিজ্ঞান পড়ছি। খটমট খটখট্ কটকটি বিজ্ঞান।”
“তুই এত মটমটি কথা কোত্থেকে শিখেছিস রে?”
“সেটা তোমাকে বলা যাবে না। এখন যাওতো। সামনে পরীক্ষা । জানো না?”
“যাচ্ছিরে বাবা, যাচ্ছি। চা খাবি?”
“না। চা খেলে গায়ের রঙ কালো হয়ে যাবে। মা বলেছে।”
“তোর মাথা।”
পুজা রান্নাঘরে গিয়ে রান্নার সরঞ্জাম ঠিক করতে লাগলো। “খালা তুমি কোথায়? আসো তাড়াতাড়ি। আমাকে আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।” ভিতরের রুম থাকে উত্তর আসল “আসছি।”
শাহেদ কাঁথার নীচ দিয়ে হাত বের করে হাতড়ে হাতড়ে ঘড়িটা নিল। কাঁথার ভেতরে ঘড়িটা ঢুকিয়ে দেখতে চেষ্টা করলো কয়টা বাজে। ঘুম এখনো ভাঙেনি পুরোপুরি। যখন সে বিঝতে পারলো কাঁথার ভিতরে অন্ধকারেঘড়ি দেখা যাবে না, তখন সে মাথাটা বের করলো কাঁথার ভেতর থেকে। ঘড়িতে এখন দশটা বাজ়ে। সে হাই তুললো। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, বৃষ্টি পড়ছে।
“শালার বৃষ্টি!” মনে মনে একটা গালি দিয়ে সে আবার কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করে।
“নাহ্। আর ঘুমানো যাবে না।” ঘুমঘুম চোখে কন মতে উঠে বাথরুমে ঢুকে চোখ বন্ধ করেই দাঁত ব্রাশ করে শুরু করলো। ফ্রেশ হয়ে সে রান্নাঘরে উঁকি দেয়। পুজা আর আম্মা রান্না করছে। সে পা টিপে টিপে বাসা থেকে বের হয়ে আসলো। এদের কাছ থেকে কিছু চাইলে একঝাঁক বাণী শুনবে। এই সাত সকালে তার বানী শুনতে ইচ্ছে করছে না। বানী শুনার জন্য সকাল বেলা উত্তম সময় নয়।
“শালার বৃষ্টি!” সে মনে মনে আবারো গালি দেয়। সারা ঘরে ছাতি একটা। আর বৃষ্টি পড়লে সেটা খুঁজে পাওয়া যায় না। সে দৌড়ে মোড়ের রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ে।
চায়ের অর্ডার দিয়ে সে চেয়ারে বসে বৃষতির দিকে উদাসভাবে তাকিয়ে ভাবতে থাকে। আজ কোথায় যাওয়া যেতে পারে। পত্রিকা ঘাটবে বিজ্ঞাপনের জন্য? “নাহ্... শালার চাকরী। আমাকে দিয়ে আর হবেনা।” সে মনে মনে আরো কয়েকটা গালি দেয়।
চা শেষ করে শাহেদ বাইরে এসে বৃষ্টির মাঝেই হাটা শুরু করে।অনেকদিন রাত্রিকে দেখা হয় না। একবার তাকে দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে। সে যখন গার্লস কলেজের সামনে এসে দাঁড়ালো তখন তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভিজা। রাত্রি সাধারণত ১১টায় কলেজে আসে। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকে।
রাত্রির গাড়ি কলেজ গেটে এসে দাঁড়ালো। শাহেদ দেখে রাত্রি ছাতা খুলে নামছে। সে একটা সাদা জামা পড়েছে। কি সুন্দর লাগছে। শাহেদ এগিয়ে গেল।
“রাত্রি কেমন আছো?”
“আরে শাহেদ ভাই যে। এই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কি করেছেন?”
“আরে বলো না । খুব ব্যস্ত। দম্ ফেলার সময় পর্যন্ত নাই। কোন ট্যাক্সি পাচ্ছি না। কাজের সময় এইসব ভাল লাগে? তুমি বল। তাই রাগের চোটে বৃষ্টির মাঝেই দাঁড়িয়ে আছি।”
“ওমা সে কি!”
“তো তোমার পড়ালেখা ভাল চলছে?”
“আর বলবেন না শাহেদ ভাই। পড়ালেখা আর ভালো লাগে না। আচ্ছা আমি যাই। ক্লাশের দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
“আচ্ছা । আমারও দেরী হয়ে যাচ্ছে। সামনে এগিয়ে দেখি ট্যাক্সি পাওয়া যায় কি না।”
“বাই”
“বাই”
শাহেদ রাত্রি চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল তারপর আবার বাসার দিকে হাটা শুরু করলো। সে যখন বাসায় ফিরল তখন বৃষ্টি কমা শুরু হয়েছে। “শালার বৃষ্টি! সবখানেই পার্শিয়াল্টি !”
কলিং বেল টিপতেই পুজা দরজা খুলে দিল। তার হাতে তোয়ালে। শাহেদ জিজ্ঞেস করলো “কিরে তোর হাতে তোয়ালে কেন?”
“আমি তোয়ালে খাই তো, তাই। খুব ক্ষুধা লেগেছিল, তাই তোয়ালে নিয়ে বসেছিলাম খাব বলে। এখন তোমাকে দেখে ক্ষুধা মরে গেছে। তাই আর খেতে ইচ্ছে করছে না। বাকীটা তুমি খাও। ধরো।” শাহেদের হাতে তোয়ালে ধরিয়ে দিয়ে পুজা রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। শাহেদ মনে মনে একটা গালি দিল “শালার মেয়েমানুষ। মুখতো নয় যেন ছুরি। একটা কথার উত্ত্রে এত কথার কনো মানে হয়! ”
সে মাথা মুছে কাপড় পালটালো। কি করবে এখন সেটা ভাবার চেষ্টা করে। আরেকবার ঘুম দেয়া যাতা পারে। বেকার মানুষের ঘুমের দরকার আছে। এটা তার বর্তমান আবিষ্কার। সে মাঝে মাঝে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আবিষ্কার করে ফেলে। যেমন গতকাল খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস সে আবিষ্কার করেছে। সেটা হল আম্মা যখন তাকে প্রতিদিনের বাণী দেয়া শুরু করে তখন কোনভাবে যদি একবার পলটিক্স নিয়ে আসা যায় তখন বানীগুলো আর তার দিকে আসে না। সব চলে যায় রাজনৈতিক নেতাদের দিকে। সে মনে মনে একটা তৃপ্তির হাসি হাসে। বিছানায় শোয়ার পর জানালার দিকে চোখ পড়লো তার। এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। “শালার বৃষ্টি!”
৩
ফরিদ সাহেবের ইদানিং অনেক কিছুই মনে থাকে না। বয়সের দোষ হয়তো। তিনি টেবিলের ওপর থেকে চশমাটা তুলে নিলেন। ফ্রেমের একটা স্ক্রু একটু ঢিলা হয়ে গেছে।ঙ্গাজ দোকানে নিয়ে গিয়ে ঠিক করে নিয়ে আসতে হবে। সকাল্বেলা পেপার না পড়লে তার আর কোন কাজে ঠিকমতো মন বসে না। এখনো পেপার দেয় নি। বৃষ্টির কারণে হয়তোবা। তিনি সিডি সেট এ গান ছাড়লেন। “এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরষায়” রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়া বৃষ্টির অর্থ তিনি অনুধাবন করতে পারেন না। তিনি যখন পি.এইচ.ডি. করছিলেন অক্সফোর্ডে তখন তিনি ছিলেন যুবক। পারুল বেগমকে সবেমাত্র বিয়ে করেছেন। নবপরিণীতার ছবিই শুধু সঙ্গী সেইখানে। শীতের দিনে বৃষ্টি এলো মেঘলা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি শহরে। তিনি তখন শুঞ্ছিলেন এই গান। ইংল্যান্ডের মানুষেরা শীতের দিনের বৃষ্টি একটুও পছন্দ করে না। তার ও খুব একটা ভালো লাগে না। তবু রবীন্দ্রনাথের গান শীতের মেঘলা ঠান্ডা বৃষ্টিকেও যেন উষ্ণতার আবরনে মুড়িয়ে দিত। তিনি তার নববধূকে অনুভব করতেন। বিরহের মাঝেও যে এক অদ্ভুত ভালোলাগা থাকতে পারে সে তিনি তখন বুঝতে পেরেছিলেন।
ঠিক ৯ টায় ইউনিভার্সিটির বাস আসবে। তার তৈরী হতে হবে। ভার্সিটি গিয়েও পেপার পড়া যায়। কিন্তু সেটা তার নীতিবিরুদ্ধ কাজ। তিনি ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করছেন আজ প্রায় ৩০ বছর ধরে। এর মাঝে একটা দিনও তিনি কাজে ফাঁকি দেননি। আমলাতন্ত্রের জটিলতা আর ঘুনেধরা রাজনীতির কারণে অনেক কিছু তিনি করতে পারেন নি তার শিক্ষক জীবনে যা তিনি করতে চেয়েছিলেন। তবু তার চেষ্টার কোন কমতি ছিল না।
তিনি পনের মিনিটের মাঝে তৈরী হয়ে নাস্তার টেবিলে আসেন । পারুল বেগম বাসায় নেই। তার দুই ছেলেই থাকে কানাডাতে। সেখানে বেড়াতে গেছেন আজ প্রায় বিশ দিন হলো। বাসাটা কেমন জানি খালি খালি লাগে ফরিদ সাহেবের। পঁয়ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবন। একটা মানুষ্কে এত কাছে থেকে দেখা। কমতো আর হলো না। তবু মানবজীবনে অনেক রহস্য অনন্মোচিত থেকে যায়। সবকিছু জানা হতে হতে কিছুটা যেন বাকী থেকে যায়। তাই হয়তো আকর্ষণ একে অপরের প্রতি। এটাও ঠিক তিনি পারুল বেগমের ওপর অনেকটুকুই নির্ভরশীল। এক সাথে থাকার কারণেই এই নির্ভরতা। তবু নির্ভরতাই কি ঘর শূন্য মনে হওয়ার একামত্র কারণ? নাকি কিছুটা অনন্মোছচিত রহস্যও মানুষের অবচেতন মনে বাস করে? বাস করে ইন্ধন জোগায়, আকর্ষণ জাগায়। তিনি এর উত্তর জানেন না। প্রকৃতি বড় রহস্যময়। কত কিছুর খেলাই না চলে এ পৃথিবীতে।
কাজের বুয়া নাস্তা দিয়ে গেল। তিনি পাইরুটির উপর জেলী মাখাতে মাখাতে ভাবতে লাগলেন। পারুলকে একটা ফোন করা উচিত। গত কয়েকদিন কোন যোগাযোগ হয় নি। তিনি সেলফোন তুলে নিয়ে ডায়াল করলেন। এখন কানাডাতে ঠিক কয়টা বাজে? তিনি মনে করার চেষ্টা করলেন। কানাডাতে ঠিক কয়টার টাইম জোন পড়ে? ৩ইন্টা নাকি দুইটা? হ্যালিফ্যাক্স কোন জোনে পড়েছে? পারুলকে জিজ্ঞেস করতে হবে। অপর প্রান্তে রিং হতে লাগলো।
পারুল বেগমই রিসিভার তুললেন। “হ্যালো।”
“হ্যালো পারুল, কেমন আছো?”
“ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? নাস্তা করেছো?”
“হ্যা, করছি। রুমন, বৌমা, তিশি কেমন আছে?”
“সবাই ভালো।”
“শোন তুমি কিন্তু শুধু শাড়ী পরে বের হয়ো না, কানাডার ওয়েদার তোমার ঠিক সহ্য হবে না। এই বুড়ো বয়সে নিউমোনইয়া বাঁধিয়ে বসো না দেখো আবার।”
“আচ্ছা। এই কথাটা এই নিয়ে তুমি আমাকে কয়বার বলেছ সেটা তুমি জানো?”
“হমম। এখানে বৃষ্টি পড়ছে। তোমার আশেপাশে কোন গান শোনার ব্যবস্থা আছে?”
“গান? কেন?”
“আহা। বলো না আছে কিনা।”
“নাই। টেলিফোন ডাইনিং রুমে।”
“শোন একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনবে আজকে। যদি কজুঁজে পাও। এমন্দিনে তারে বলা যায় , এমন ঘনঘোর বরষায়।”
পারুল বেগম হাসেন। “তোমার পাগলামী বুড়ো বয়সেও গেল না।”
“রাখি। আমার বাস চলে আসবে।”
“আচ্ছা শোন। তুমি সজলের কথা একবারও জিজ্ঞেস করলে না?”
“আচ্ছা বল।”
“সজল টরন্টো গেছে আজকে। কনফারেন্সে অর পেপার সাবমিট করার জন্য।”
“ভালো।”
“সজল তোমার ছেলে। তাই না? তোমার খুশী হওয়া দরকার।”
“আচ্ছা রাখি।”
“ছাতি নিতে ভুলো না বের হওয়ার সময়ে। দুপুরের খাবার ঠিক্মতো খেও। ওষুধ খেতে ভুলো না।”
“আচ্ছা। যত্ন নিও নিজের।”
“তুমিও।”
লাইন কাটার পর ফরিদ সাহেবের মনে পড়লো কানাডায় এখন কয়টা বাজে সেটা জিজ্ঞেস করা হয়নি। এত তুচ্ছ একটা ব্যাপার কেন তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে সেটা তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। তিনি গান পরিবর্তন করলেন। “ক্লান্তি আমায় ক্ষমা কর প্রভু।”
তিনি সজলের কথা ভাবতে চাচ্ছেন না। সজল তার ছোট ছেলে। তবুও তার মাথায় ঘুরে ফিরে সজলের মুখটা চলে আসছে। ফরিদ সাহেব খুব মন দিয়ে গান শুনতে চেষ্টা করতে লাগলেন। বাইরে বৃষ্টির তোড় যেন হঠাত বেড়ে গেল। তিনি জানালার কাছে বৃষ্টির ছাটের গড়িয়ে পড়া জল দেখতে লাগলেন। কি সুন্দর এই প্রকৃতি।
৪
লিলির ঘুম ভেঙ্গেছে অনেকক্ষণ হলো। সে শুয়ে থেকে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। আজ সকাল থেকেই আকাশের মন ভার হয়ে আছে। সারা আকাশ কাল মেঘে ঢেকে আছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে তার ঘুম ভাঙ্গার কিছুক্ষণ পর থেকেই। তার মন আকাশের সাথে সাথে রঙ পরিবর্তন করে।আকাশের রঙ নীল হলে তার মন অনেকটাই ভাল থাকে। সে অকারণেই সেদিন হাসে।যেদিন আকাশে সাদা সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায় সেদিন তার অনেক ইচ্ছে করে সবুজ কোন মাঠে হাঁটতে। সে শুনেছে ময়মনসিংহে নদীর পাড় জুড়ে অনেক সাদা কাশফুল ফুটে শরতকালে। তার খুব ইচ্ছে করে সেই নদীর পাড় ধরে হাঁটতে।
আজ আকাশ জুড়ে মেঘ। তার মনে হচ্ছে আকাশটা কাদঁছে। তারও কেন জানি কান্না পেয়ে যাচ্ছে। সে বিছানা থেকে উঠছে না, তার একটা কারণ আছে। সে অপেক্ষা করে আছে কখন তার আম্মু আসে। সে তার রুমের দরজা খোলার আওয়াজ পেলেই চোখ বন্ধ করে ফেলবে। তার আম্মু এসে তার মুখের উপর হাত বুলিয়ে আদর করবে। সে সেই আদরের জন্য অপেক্ষা করে আছে।
নিপা অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে তার সেলফোনে রিচার্জ করার জন্য। হয়তো নেটওয়ার্কের সমস্যা। কোনভাবেই রিচার্জ হচ্ছে না। বারবার ফেইলিউর ম্যাসেজ আসছে। সে হতাশ ভঙ্গীতে তাকিয়ে থাকে তার সেলফোনের দিকে। তার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কল করতে হবে। আজ তাদের বেতন দিবে কিনা সেটা জানা তার জন্য জরুরী। মেয়েটাকে আজকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। যদি বেতন আজকেও না দেয় তার জন্য কোনখান থেকে টাকা জোগাড় করতে হবে। সে আরো কিছুক্ষণ চেষ্টা করে সেলফোন রেখে উঠে দাঁড়ায়। মেয়েটাকে সেই সকাল থেকে এখনো দেখা হয়নি। সে লিলির রুমের দরজা খুললো।
সাদা ধবধবে চাদরের উপর লিলি শুয়ে আছে। এখনো ঘুম থেকে জাগেনি দেখে নিপা স্বস্তি পায়। মেয়েটা ঘুম থেকে জেগে তাকে না দেখলে অভিমানে মন ভার করে শুয়ে থাকবে। সে জানালার পর্দা টেনে দিতে গেল, যাতে বৃষ্টির ছাট ঘরে এসে না ঢুকে। পর্দা টেনে দিয়ে বিছানার দিকে ফিরতে তার বুক হঠাত ধক্ করে উঠলো। সাদা চাদরটা এখনই পাল্টাতে হবে। এটা যেন কাফনের কাপড়। তার মন অশুভ চিন্তায় ছেয়ে যায়। সে দৌড়ে গিয়ে মেয়ের ঘুমন্ত মুখ বুকে চেপে ধরে।
লিলি চোখ মেলে হাসে। “মামনি তোমার কি হয়েছে? ভয় পেয়েছ ?”
“হা মা। ভয় পেয়েছি। আমার সোনামণি যদি আমাকে ছেড়ে পরীদের দেশে চলে যায়!”
“মামনি, আমাকে আর সোনামণি বলে ডেকো না। আমি কত বড় হয়েছি সেটা তোমার খেয়াল আছে? ১৪ বছর।”
“তুমি আমার কাছে এখনো চৌদ্দ মাসের বাবু।”
লিলি হাসে। নিপা মেয়ের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হাসলে মেয়েটাকে কত সুন্দর লাগে। “আজ কেমন লাগছে?”
“ভালো।”
“উঠে হাত মুখ ধুয়ে আস। আমি নাস্তা বানাচ্ছি।”
নিপা নাস্তা বানানোর জন্য রান্না ঘরে গেল। লিলি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে গেল,পর্দা নামানো। সে খুব ধীরে ধীরে উঠলো। বুকের মাঝের ব্যথাটা আজ নেই। বিছানা থেকে নেমে পর্দা তুলে দিল। আকাশ আর বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে বললো “আকাশ, ও আকাশ, আমাকে নদীর পাড়ে নিয়ে যাবে? কাশফুল দেখতে ইচ্ছে করছে এখন কি কাশফুল ফুটে? বৃষ্টি, তুমি আমার মন খারাপ করিয়ে দাও কেন ? আমাকে নিয়ে যাবে নদীর পাড়ে? মামণি কত কষ্ট করে আমার জন্যে। আমার আব্বু নেই তো। আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। কেন গেছে জানো? মামণি সুন্দর নাতো সেইজন্যে। আমিও সুন্দর না। শুধু মামণির কাছে আমি সুন্দর। আমার নদীর পাড়ে যেতে ইচ্ছে করে। তুমি নিয়ে যাবে?”
নিপা রান্নাঘর থেকে এসে দেখল লিলি জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। সে ধীরে ধীরে লিলির কাছে এসে দাঁড়ায়। “ মা , এখনো হাতমুখ ধোও নি?”
লিলি চমকে উঠে। সে বলে, “যাচ্ছ মামণি।” সে বাথরুমে ঢুকলো।
জানালার বাইরে তাকিয়ে হঠাত নিপার মন খারাপ হয়ে গেল। সে মনকে শক্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো। তার অবস্থানে থেকে কারো মন খারাপ করতে নেই। যে যুদ্ধ সে করে যাচ্ছে সেটা তার শক্ত মন নিয়েই করতে হবে। সে লিলির বিছানার চাদর পাল্টাতে লাগলো। বালিশের নীচে দেখল ডায়েরী। লিলির নাম লেখা। লিলি ডায়েরী লেখে এটা সে জানতো না। সে ডায়েরীটা না খুলেই আবার রেখে দেয় বালিশের নীচে। সবারই ব্যক্তিগত কিছু একটা থাকে বলে সে বিশ্বাস করে। অনেক কিছুই সবাইকে বলা যায় না। তাই অন্তত ডায়েরীর কাছে বলে হালকা হওয়া যায় মাঝে মাঝে। লিলি অনেক একা থাকে। সে যখন অফিসে যায় তখন একেবারেই একা। যদিও অফিস থেকে সে ফোন করে খবর নেয়। মেয়েটাকে নিয়ে একবার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলে কেমন হয়? সে ভাবে। কোথায় যাওয়া যায়? এই বর্ষায় গ্রামের বাড়ির কথা সে ভাবতেই পারে না। পাছেপাছে কাদা তার কখনই ভালো লাগে না। কক্স’স বাজার দুই কারণে বাদ। দুইজন মেয়েমানুষের একা যাওয়া ঠিক হবে না। আর তার হাতে অত পরিমাণ টাকাও নাই। সে হতাশ ভঙ্গীতে হাত নাড়ে আনমনে।
“মামণি।” লিলির ডাকে সে ফিরে তাকায়।
“ কি হয়েছে ?”
“বর্ষাকালে কি কাশফুল ফোটে?”
নিপা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। “মনে হয় না। কাশফুল দেখতে ইচ্ছে করছে?”
“না মামণি। এমনি জিজ্ঞেস করছি।”
লিলি তার চুল আচঁড়াতে শুরু করল। আয়নাতে সে এক কিশোরীকে দেখতে পায়। শ্যামলা গায়ের রঙ। ঢেউখেলান নরম চুল। সাদামাটা এক মুখে উজ্জ্বল দুটি চোখ। মেয়েটা চুল আঁচড়াচ্ছে । সে মনে মনে বলে “লিলি, বর্ষাকালে কাশফুল ফুটে না। বুঝেছ?” সে হাসে। মেয়েটাও হাসে।
হঠাত আয়নার মেয়েটা ঝাপসা হতে শুরু করল। লিলির বুকের মাঝে ব্যথা হচ্ছে। তার মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হয়-“মামণি...”
৫
গতকাল সারারাত ঘুমায়নি প্রিয়া। সে অনেক চেষ্টা করছে ঘুমানোর জন্য। সে দেখেছে সে যখন ঘুমানোর জন্য চেষ্টা করে তখন কিছুতেই ঘুমাতে পারে না। আর যখন তার জেগে থাকার অনেক ইচ্ছা করে রাতের বেলা তখন ঘুমের জন্যে সে চোখ খোলা রাখতে পারে না। কিছুদিন আগে তার এক বান্ধবীর বিয়েতে সে অনেক প্ল্যান করেছিল। বিয়ের রাতে সারারাত জেগে অনেক আনন্দ করবে সবাই মিলে। আর ঠিক সে রাতে দশটার মাঝে সে এক কোণে ঘুমে কাদা। সে বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানি দিয়ে আসে। চোখ জ্বালা করছে। তার ইউনিভার্সিটি যেতে হবে। সারাদিন মাথাব্যথা থাকবে। রাত জাগার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে সে বুঝতে পারে।
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। নিশ্চয়ই সামনের রাস্তায় পানি উঠে গেছে এতক্ষণে। সে জানালা দিয়ে উঁকি দেয়। না এখনো উঠে নাই। পানি উঠার আগেই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়া উচিত। সে রেডি হয়ে তার বড় ভাইয়ের রুমের দরজায় টোকা দেয়। সে তার বড় ভাইকে অসম্ভব ভয় পায়। তার বড় ভাই উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। নাম হাসান মাহমুদ। বয়স ৪৪ বছর। রাশভারী গম্ভীর। প্রিয়ার সাথে প্রতিদিন দেখা হয় না। দরকার পড়লে দুজনের মাঝে দেখা হয়।
কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলল হাসান। “তোমার কি খবর?” প্রিয়াকে জিজ্ঞেস করলো হাসান।
“ভালো। আমার টাকা লাগবে কিছু। ৫০০।”
“দাঁড়াও দিচ্ছি । একটু হিসেব করে খরচ করা শেখো ।”
প্রিয়া চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। হাসানের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সে বাসা থেকে বের হলো। বৃষ্টির তোড় তখন একটু কমেছে।
প্রিয়া যখন ইউনিভার্সিটি পৌঁছাল তখন মুষল ধারে বৃষ্টি হচ্ছে। সে ছাতা মেলে কোনমতে ক্যাফেটেরিয়াতে ঢুকলো। এখন ক্লাসের সময়। তাই ক্যাফেটেরিয়া মোটামুটি খালি। সে এক কাপ চা নিয়ে এক কোণের এক টেবলে বসলো। তার সামনের টেবিলে কিছু ছেলে বসে আছে। দেখে যতদূর বুঝা যাচ্ছে এরা প্রথম বর্ষের ছাত্র। এদের মধ্যে একটা লম্বা করে ছেলে তার দিকে একবার তাকিয়ে তারপর বন্ধুদের নীচু গলায় কি জানি বললো। সবাই সাথে সাথে হাসিতে ফেটে পড়লো। একজন তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী হিসেবে সে নিজেকে অনেকটুকুই সিনিয়র ভাবে। তার খুব রাগ হতে লাগলো। কিন্তু এখন তার কোন বন্ধু বান্ধবী সাথে নেই। তাই কিছু করার নেই। সে অন্যদিকে মন দিতে চেষ্টা করলো।
ছেলেটা হঠাত উঠে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। সে মাথা তুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। ছেলেটা লম্বা, চিকন। চোখদুটি মায়াবী। সে জিজ্ঞাসা করলো, “কি চাই?” ছেলেটা উত্তর দিল, “আপা, আপনার কপালটা মুছে ফেলুন। কালো কালো কি জানি লেগে আছে।”
প্রিয়া বিব্রত হয়ে তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে কপাল মুছে দেখল সত্যি সত্যি কালো কালো কি জানি লেগে আছে। সে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললো “ থ্যাঙ্কস্।” বলে সে বেসিনের দিকে হাঁটা দিল মুখ ধুবে বলে। পিছনে শুনতে লাগলো ছেলেগুলির হাসির শব্দ। তার খুব লজ্জা লাগছে, সাথে রাগও।
সে মুখ ধুয়ে আবার আগের জায়গায় বসলো। দেখল সামনের টেবিলে ছেলেটা বসে আছে। বাকী ছেলেগুলো নেই। কিছুক্ষণ পরে ছেলেটা একটু ইতস্ততঃ ভঙ্গীতে সামনে এসে দাঁড়ালো।
“আপা , বসতে পারি?”
“বস।”
চেয়ার টেনে বসে সে বলল, “আমার আম অর্পণ। আমি আসলে মনে হয় আপনার সাথে খারাপ আচরণ করেছি। সরি।”
“ঠিক আছে। তুমি এত নার্ভাস হচ্ছো কেন?”
অর্পণ হাসলো। “জানি না। আমি একটু এইরকম। চা খাবেন?”
“আমার সামনেই চায়ের কাপ। আবার জিজ্ঞেস করছো চা খাবেন কিনা। ঘটনা কি?”
অর্পণ আবার হাসলো। “সরি, ভুল হয়ে গেছে।”
“তুমি বরং এক কাপ চা খাও।” প্রিয়া চায়ের অর্ডার দিল ।
“থ্যাঙ্কস্।”
“এত সরি আর থ্যাঙ্কস্ কেন?”
“ওহ্ সরি... ওহ্ ভুল হয়ে গেছে... আর বলবো না।”
“ শোন অর্পণ, আসলে আমার কথায় কিছু মনে করো না। আমিও একটু এরকমই।”
“তাই নাকি?”
“হ্যা।”
“আপনাকে আমি প্রায় সকাল বেলাই ট্রেন স্টেশনে দেখি। গতকাল দেখেছি । আপনাকে খুব সুন্দর লাগছিল।”
“হমম্।”
“আপনি অনেক সুন্দর।”
“আচ্ছা তাই নাকি? জানতাম না তো।” প্রিয়া চায়ের কাপে চুমুক দিল। ছেলেটা এত প্যানপ্যান করছে কেন সেটা সে মনে মনে ভাবছে। অবশ্য ‘প্যান প্যান’ করছে বলে তার সময়টা কেটে যাচ্ছে। বন্ধুরা না আসা পর্যন্ত মন্দ কি।
“প্রিয়াদি, আমি উঠি। এখন ক্লাশ আছে। আমি আপনার ডিপার্টমেন্টের প্রথম বর্ষের ছাত্র। দেখা হবে।”
প্রিয়া একটু অবাক হয়ে ছেলেটার চলে যাওয়া দেখল। ছেলেটাকে সে তার নাম বলে নি। জানল কি করে!
ক্যাফে থেকে বের হয়ে অর্পণ ক্লাশের দিকে দৌড় দিল। তার সবুজ ভাল লাগে। বৃষ্টির সবুজ তার মনে অনেক আনন্দ নিয়ে আসে। মাঝে মাঝে অবশ্য মন খারাপ হয়। তবু সে বৃষ্টিভাল বাসে। সে ফ্যাকাল্টি বিল্ডিং এ ঢুকে কিছুক্ষণ দাঁড়ালো। ঘড়ি দেখল। এখনো দশ মিনিট দেরী আছে ক্লাশশুরু হতে। সে ধীরে ধীরে তার ডিপার্টমেণ্টের দিকে হাঁটা শুরু করল। চারাপশে কত ছেলে মেয়ে। হাসছে। কথা বলছে। সে সবার মুখ দেখতে দেখতে হাঁটতে থাকে। একেই বুঝি কবির ভাষায় বলে “জীবনের কোলাহল!” সে ভাবে।
ক্লাশে ঢুকে সে জানালার পাশে একটা সিটে বসলো। ক্লাশের বলতে গেলে কারো সাথেই এখনো তেমন একটা ঘনিষ্ঠতা হয়নি। সে জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে থাকে। পাহাড়, বৃষ্টি, সবুজ প্রকৃতি। চারকোণা চারকোণা জানালাগুলোতে যেন এক একটা ছবি। অসীম ক্ষমতাধর এক শিল্পীর আঁকা।
স্যারের ডাকে সে নিজের মাঝে ফিরল।
“এই যে আপনাকে বলছি। আপনি।” স্যার মনে হয় কাউকে কিছু বলছে। অর্পণ আশে পাশে তাকাতে লাগলো। স্যার আবারো বলল, “আপনাকে বলছি । হ্যা, হ্যা... জানালা প্রেমিক আপনাকেই ।”
অর্পণ বলল “আমাকে বলছেন স্যার?”
“জ্বী, আপনাকেই বলছি। আপনি দয়া করে ক্লাশের বাইরে চলে যান। আপনার মনযোগ এখন বর্হিবিশ্বে। তাই আমি অধম কোন শক্তিতে আপনাকে ভিতরে কারারুদ্ধ করে রাখবো? যান আপনাকে মুক্তি দেয়া হলো।”
ক্লাসের সবাই হাসতে লাগলো। অর্পণ বলল, “সরি স্যার। আর থাকবো না।”
স্যার বললেন, “ঠিক আছে । পড়ায় মনযোগ দাও।”
অর্পণ এইবার লেকচারে মনযোগ দিতে চেষ্টা করে। তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। সে পাশের ছেলেটার দিকে তাকায়। ছেলেটা পুরো পৃষ্ঠা ভরিয়ে ফেলেছে লিখে লিখে। অর্পণ কলম দিয়ে লেখার চেষ্টা করলো কিছু কিছু। শেষে কিছুতেই মনযোগ দিতে না পেরে সে প্রিয়াদির মুখটা মনে করার চেষ্টা করতে লাগলো। কাঁধ পর্যন্ত কাটা চুল প্রিয়াদির। চোখদুটি সুন্দর। ফর্সা গায়ের রঙ। কত সুন্দর লাগে প্রিয়াদিকে । সে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা শুরু করলো।
“কেমন আছো, প্রিয়াদি? তুমি নিশ্চয়ই আজ খুব অবাক হয়েছ, তাই না? আমি তোমার নাম জানি। তুমি কোথায় পড় সেটাও জানি। অবাক হয়েছ? আমি জানি তুমি অবাক হলেও বেশীক্ষণ অবাক থাকবে না। কারণ তুমি বুঝে ফেলবে যে ডিপার্টমেণ্টের কারো কাছ থেকে আমি তোমার সম্পর্কে জেনেছি।
প্রিয়াদি, তোমাকে আমি প্রথম দেখি এক অদ্ভুত সুন্দর সকাল বেলায়। তুমি কি জানো আমি খুব ভোরে উঠতে পারি না? তবু দেখ আমার নিয়তি আমাকে এমন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে এনে ফেলেছে যেখানে যেতে হলে খুব ভোরে উঠতে হয়। সেই কত ভোরে উঠে ঘুম ঘুম চোখে স্টেশনে আসলাম। চোখে রাজ্যের ঘুম আর মনে বিরক্তি। সকালের রোদটাকে মনে হচ্ছিল অসহ্য। এমন সময় তোমাকে দেখলাম।তোমার পরনে লাল জামা। সকালের সোনার রোদে তোমাকে মনে হচ্ছিল অসহ্যরকমের সুন্দর। এক নিমিষেই অসুন্দর ভোরটা আমার কাছে সুন্দর সকাল হয়ে গেল।
আমাকে কে কি পাগল মনে হচ্ছে? হয়তো আমি তাই। মাঝে মাঝে পাগলামি করতে আমার ভালোই লাগে। তোমার লাগে না? তোমাকে আমি দেখি বৃষ্টি আসলে ভিজ। আর এমন ভাবে কর যেন তোমার খুব জরুরী কাজ আছে বলে বৃষ্টিতে ভিজেই যেতে হচ্ছে। এটাও তোমার একটা পাগলামী। আসলে আমাদের সবার মাঝে একটা পাগল বাস করে। সে শিকল দিয়ে বাঁধা থাকে। মাঝে মাঝে কোন কারণে সেই শিকলে টান লাগে। শিকল ভেঙ্গে যায়। আমাদের মাঝে থেকে সেই পাগলটা বের হয়ে আসে। এই কথাগুলোও কি তোমার কাছে পাগলামি লাগছে ? লাগলেও ক্ষতি নেই। তোমার কাছে আমি সব কিছু হতে রাজী আছি...”
হঠাত স্যারের ডাকে অর্পণের সম্বিত ফিরলো। স্যার তার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে সে কি লিখছে। “বাহ্ বাহ্। খুব সুন্দর। ক্লাশ থেকে এখুন বের হও।”
অর্পণ কোন কথা না বলে ব্যাগ নিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে আসলো। তার কেন জানি খুব আনন্দ হচ্ছে। সে আজ আর কোন ক্লাসই করবেনা। সে কিছুই করবে না। সে আজ এলোমেলো পায়ে এলোমেলো জায়গায় ঘুরাফেরা করবে। রমিজ ভাইয়ের চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে থাকবে। পাহাড় দেখবে । বৃষ্টিভেজা মায়াবী পাহাড়। আর ভাববে কেন একজন মানুষ তার মনে এত মায়া নিয়ে আসে। বৃষ্টভেজা পাহাড়ের চেয়েও গহীন যে মায়া । সে ব্যাগটাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো যাতে ভিজে না যায়। অনেক বৃষ্টি পড়ছে। সে বৃষ্টির মাঝে হাঁটতে শুরু করলো।