বৃষ্টি নীল জ

ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব (৬-৯)

পর্ব (১-৫)

~~  নীল ~~

jodi_bolo@yahoo.com

 

© লেখক

 

 

 

দুইরাত হলো নিপা ঘুমায়নি। চোখ আর মাথা দুইটাই ভারী হয়ে আছে। তবু ঘুম আসছে না। এই দুইরাত লিলির পাশে জেগে থাকতে হয়েছে। এখন লিলি ঘুমাচ্ছে। নিপা অপলক দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা এত মায়াবী কেন? তার বুকে হঠাত কেন জানি কষ্ট হতে শুরু করলো।

সে অস্থিরভাবে জানালার দিকে তাকালো।শ্রাবণ আকাশের মেঘগুলো থমকে আছে।যেকোন মুহূর্তে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামতে পারে।সে কতদিন বৃষ্টিতে ভিজেনা।ইচ্ছেও হয়না এখন আর।কেন জানি না আজ অনেক বেশী লিলির বাবার কথা মনে পড়ছে।এই সাধাসিধা মানুষটা এত পালটে কেন গেল হঠাত করে সেটা সে এখনো বুঝতে পারেনা। সে হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা টেনে নিল।ব্যাগের ভিতর থেকে বের করলো যত্নে রাখা একটা ফোটোগ্রাফ। সজল। বিয়ের আগের ছবি।এই মানুষটা তাকে ছেড়ে চলে গেছে।কি কারণে সেটা সে এখনো জানে না। ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ নিপা কোনদিন করতে পারেনা। সজল কোনদিন জানবে না নিপা তাকে কি প্রচন্ড পরিমাণ ভালবাসতো।হয়তো এখনো বাসে।

বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি নামলো।নিপার মনের মাঝে এখনো থমকে আছে মেঘগুলো।সে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ধীরস্বরে বললো,

“আমার দুই চোখে দুই নদী

তুমি দুহাত ভরে পানি নিও

তৃষ্ণা লাগে যদি

আমার দুই চোখে দুই নদী”

মানুষের তৃষ্ণা লাগে। সকল মানুষ অনেক তৃষ্ণার্ত হয়ে কাকে যেন খুঁজে ফেরে মাঝে মাঝে। কোন মানুষের হাতে থাকে তার তৃষ্ণা নিবারণের পাত্র! সজলের তৃষ্ণা কি নিপা মিটাতে পেরেছিলো? হয়তো পারেনি।অথবা পেরেছিল। নিপা সেটা জানে না।মানুষ যেমন তৃষ্ণার্ত হয়ে ঘুরে ফিরে, ঠিক তেমনি আবার তার নিজ্র কাছেও থাকে এক অবারিত নদী।বুকের মাঝে নীরব ফল্গু হয়ে সে ন্দী বয়ে চলে। কেউ কেউ আসে, চুমুক দেয় সেই জলে। নিপার তৃষ্ণা কি সজল মিটাতে পেরেছিল?

মাঝে মাঝে অনেক জটিল অহেতুক চিন্তা নিপার মনের মাঝে ঘুরে ফিরে।সে নিজেকে বোঝাতে চায় অনেক অগোছালো ঘটনার গোছালো দিকটা। সে ভাবতে চেষ্টা করে নিজেকে একজন যোদ্ধা হিসেবে।এই সমাজে বেঁচে থাকার এক নীরব যুদ্ধে প্রতিনিয়ত নিজেকে তার ব্যস্ত রাখতে হয়।তবু মাঝে মাঝে তার অনেক ক্লান্তি লাগে।অনেক ইচ্ছে করে খুব নির্ভরতায় কারো পাশে মাথা রাখতে।অনেক ক্লান্তির পরে নিশ্চিন্ত এক ঘুমে তার নিজেকে ডুবিয়ে দিতে মাঝে মাঝে।

লিলি চোখ কুলে তাকালো।“মা মনি...”

“মা, তোমার এখন কেমন লাগছে?”

“ভালো।”

“কিছু খাবে? ক্ষুধা লেগেছে?”

“না, মামনি। মামনি, কাশফুল কি দেখতে অনেক সুন্দর?”

“হ্যা, অনেক সুন্দর। তুমি সুস্থ হয়ে নাও। আমরা কাশফুল দেখতে যাব।”

লিলির মাথাটা কেমন যেন ভারী হয়ে আছে।চোখ বন্ধ করলে চোখের সামনে শুধু সে একটা নদী দেখতে পায়।নদীর দুই তীর জুড়ে সাদা  কাশফুল।সেই কাশফুলের মাঝে কে যেন একটা নীল রঙের শাড়ী পরে দাঁড়িয়ে আছে।ছোট একটা মেয়ে। সে চিনতে পারেনা। সেই মেয়ের দুইপাশে কারা যেন হাসছে।তাদের একজনকে সে চিনতে পারে।মামনি। আরেকজনকে সে ঠিক চিনতে পারেনা।তবু মাঝে মাঝে তার মনে হয় এটা যেন তার বাবা।
লিলি তার ছোট বুকে কেন জানি ব্যথা অনুভব করে।এই ব্যথাটা কি তাকে ছাড়বে না কোনদিনও? সে কি সত্যি সত্যি একদিন তার মামনিকে ছেড়ে পরীদের দেশে চল যাবে? সেইখানে কি তার অনেক একা লাগবে? নাকি পরীদের দেশে সে একটা কাশফুলের তীর ঘেরা নদী পাবে?  তার মামনি, তার বাবা আর সে।

 

 

লিলির হঠাত অনেক ঘুম পেয়ে গেল।সে যখন ঘুমিয়ে পড়লো তখন বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।সেই বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে নিপার হঠাত অনেক কান্না পেয়ে গেল।নিজেকে এতটা একা তার অনেকদিন মনে হয়নি। তার মনে কেন জানি শুধু ঘুরে ফিরে আসছে কিছু লাইন...আমার দুই চোখে দুই নদী...

 

 

স্বরূপ সিগারেটে শেষ টান দিয়ে খুব উদাস ভঙ্গীতে সামনের রাস্তার দিকে তাকালো।বৃষ্টির পানিতে ভেজা কালো পিচের উপর কদম ফুল পড়ে রয়েছে।সে আজও ক্লাসে যাইনি।এই বছর তার রেজাল্ট কি হবে সে না ভেবেই বলতে পারে।অবস্থা অনেক ভয়াবহ।সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।সে ঘড়ির দিকে তাকায়।বারোটা বাজতে এখন ঠিক পনের মিনিট বাকী।কিছুক্ষণ পরেই ক্লাস শেষ হবে।সুমি কি আসবে একবার এইখানে?

সুমি যখন ক্লাস থেকে বের হলো তার শ্যামলা অবয়ব জুড়ে ক্লান্তির ছাপ।সেই সকাল থেকে টানা ক্লাস।সে এককাপ চায়ের জন্য রমিজ ভাইয়ের দোকানে যাচ্ছে।আর খুব সম্ভবত ওইখানে স্বরূপ আছে।এই চশমা চোখের সাধাসিধা ছেলেটাকে সে কেন জানি না অনেক পছন্দ করে।সে রমিজ ভাইয়ের দোকানের সামনে গিয়ে দোকানে উঁকি দিল।নাহ্‌।স্বরূপ সেখানে নেই।তার কেন জানিনা মন খারাপ হয়ে গেল।সে তার উনিশ বছরের তরুণী মনে কিসের যেন কষ্টের পরিষ্কার ছাপ অনুভব করে।মানুষ একেই বুঝি ভালবাসা বলে।সে ঠিক বুঝেনা।সে এক কোণে বসে চায়ের অর্ডার দিল।দূরের আকাশটা অনেক কালো হয়ে আছে।কদম ফুলের গাছ ছাড়িয়ে দূরের পাহাড়ে তার দৃষ্টি গেল।কি সুন্দর সবুজ!তার খুব ইচ্ছে করে ওইরকম এক সবুজ পাহাড়ে সে খুব প্রিয় কারো হাত ধরে হাঁটবে। সে চায়ের কাপে চুমুক দিল।

আর পাঁচ মিনিট পরেই পরের ক্লাস শুরু হবে।স্বরূপ কি ক্লাসে?নাকি আজ আসেনি? সে ভাবে।সে তার মনের মাঝে হঠাত কেমন যেন এক অভিমানের ছোঁয়া অনুভব করে।সে দুই হাতের মাঝে মুখ রেখে দূরের পাহাড়ের দিকে চেয়ে থাকে।ক্লাসের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। যাক। আজ আর তার ক্লাস করতে ইচ্ছে করছেনা।সে কিছুক্ষণ পরে দেখতে পায় অর্পণ আসছে।

অর্পণ দোকানে ঢুকেই একটা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে তোর খবর কি? স্বরূপ কোথায়?”

“খবর ভালো আমি কি স্বরূপের সেক্রেটারী?স্বরূপ কোঠায় সেটা আমি কি করে বলবো?”

“সেটাও ঠিক। যাই হোক এই আস্ত সকালে তোর সাথে ঝগড়া করতে আমার ইচ্ছে করছে না। তার চেয়ে একটা গান শোনা।”

“ভালো লাগছে না। তারচেয়ে বরং তুই তোর কবিতা শোনা একটা।”

“নাহ্‌।কবিতা লেখা হয়নি একটাও। আমি দৌড়ের উপর আছি।”

“হাহ্‌! তোর আবার দৌড়ের উপর থাকা! হাসালি।”

অর্পণ হাসে।“আচ্ছা বাদ দে।শোন।প্রিয়াদিকে চিনিস? ওই যে খাটো চুল। সুন্দর চোখ।”

“হ্যা, চিনি।”

“দেখেছিস আজকে?”

“নিজের খবর রেখেই কুল পাইনা, আবার কোথাকার কে প্রয়াদি তার খবর রাখবো!”

অর্পণ বিরক্ত হয়ে হাত নাড়ে।“দূর...তোর সাথে কথা বলতে যাওয়াই বৃথা।স্বরূপ যে কি করে তোকে টলারেট করে সেটাই আমি বুঝিনা।”

বলে সে উঠে দাঁড়ালো।ফ্যাকাল্টির দিকে হাঁটা শুরু করলো।

সুমির কেন জানি কিছু ভালো লাগছেনা। তার কারণ সে জানে।কিন্তু যে মানুষটা আসলে তার ভালো লাগবে তারই কোন দেখা নেই।

 

স্বরূপ তার অনেক পুরোনো গিটার নিয়ে চারুকলা ডিপার্টমেন্টের এক কোণে বসে আছে।তার মন এই মেঘে ঢাকা কালো আকাশটার মতোই কালো হয়ে আছে। মনের আকাশে অনেক মেঘ জমে আছে। শুধু কাঁদার অপেক্ষায়।তার চারপাশে অনেক সমস্যার জাল ধীরে ধীরে তৈরী হয়েছে।সে এখনো উনিশ বছরের একটা ছেলে। এত সমস্যা সে কি করে সামাল দেবে সে জানে না। গতকাল তার বাবার চাকরী চলে গেছে। অফিসের রাজনীতির মারপ্যাচে পড়ে এই অবস্থা তার বাবার। এখন তার পরিবার কি করে চলবে সে জানে না।সে যে মেয়েটাকে পড়ায় সেই মেয়ে অনেকদিন ধরে অসুস্থ।গত দুইদিন ধরে সেই মেয়ে আনেক বেশী অসুস্থ।ফুলের নামে মেয়েটির নাম। লিলি। এতো মায়াবী একটা মেয়ে।সেই মেয়ে কেন এত জটিল দুরারোগ্য অসুখে ভুগবে সেটাও সে জানে না।সুমি কিছুদিন ধরে তাকে এড়িয়ে চলছে অনেকটাই।কি কারণ সেটাও তার জানা নেই।সে আকাশের দিকে তাকায়। কালো আকাশ। তার মনে হচ্ছে ঐ আকাশ শুধু কাঁদার জন্যে অপেক্ষায় আছে।ঠিক তার মতো।শুধু একজন বন্ধুর হাতের স্পর্শের অপেক্ষায়। স্পর্শের আদরে আকাশ অঝোরে ভেঙ্গে পড়বে।তাই আজ সে সুমির সামনে যাইনি। যদি সুমি একবার তাকে সহানুভূতির স্বরে বলে ...কেমন আছো স্বরূপ? সে নিজেকে আর সামলাতে পারবে না।একজন মেয়ের সামনে আর যাই হোক সে চোখের জল দেখাতে চায় না।

স্বরূপ উঠে দাঁড়ালো।টুইশনি খুঁজতে হবে, সে একমাত্র ছেলে তাদের পরিবারে। আর তার ছোটবোন।এখন তাকে কিছু একটা করতে হবে। কোথায় যাবে সে ভাবতে চেষ্টা করে। অনেক ভেবে একজনের কথা মনে পড়লো।শাহেদ ভাই।উনার কাছে গেলে নিশ্চয়ই টুইশনির একটা ব্যাবস্থা হয়ে যাবে। স্বরূপ গিটার কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটা শুরু করলো।

প্রিয়া অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছে একটা ছেলে গিটার নিয়ে বসে আছে। খুব উদাস মন খারাপ ভঙ্গীতে বসে আছে। সে তার এক বান্ধবীর সাথে দেখা করার জন্যে চারুকলা ডিপার্টমেন্টে বসে আছে অনেকক্ষণ ধরে। এখনো তার বান্ধবীর দেখা নেই।ছেলেটা তার সামনে দিয়ে হেঁটে গেল।সে খুব আগ্রহের দৃষ্টি নিয়ে গীটার টার দিকে তাকিয়ে আছে। সে গীটার খুব পছন্দ করে। তার দৃষ্টিপথে হথাত অন্য একটা ছেলের ছায়া এসে দাঁড়ালো। অর্পণ।

প্রিয়া জিজ্ঞেস করলো “কেমন আছো, অর্পণ?”

“ভালো, প্রয়াদি, আপনার গীটার কি অনেক পছন্দের?”

“হ্যা। কিন্তু কেন?”

“না, এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম।”

“প্রিয়াদি, আপনার পাশে বসতে পারি?”

“হ্যা, বস।” 

অর্পণ বসে একটু হাসলো।“প্রিয়াদি, আপনাকে আমি একটা চিঠি লিখেছি। পড়বেন?”

প্রিয়া একটু আশ্চর্য হয়ে বললো, “নিশ্চয়ই। দাও।”

অর্পণ আবার একটু হাসলো।দিউ হাত নেড়ে বললো “নাই। ছিঁড়ে আকাশের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছি।”

প্রিয়া এওকটু আওবাক হলো। এই ছেলে বলে কি! “ভাল করেছো।”

“প্রিয়াদি, আমি এখনো ভাল ছাত্র। এটা কি আপনি জানেন?”

“না। আমি তোমার সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না।”

“আমি কিন্তু আপনার চেয়েও ভাল পড়ালেখায়।”

“খুব ভাল।”

“হম্‌ম্‌।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমি কোন পড়ালেখা করতে পারছি না।আর এটার কারণ কি আপনি জানেন?”

“না জানি না।”

“না জানাই ভাল। আমি যাই।”

প্রিয়া অনেক অবাক হয়ে অর্পনের চলে যাওয়া দেখতে লাগলো। ছেলেটা এত অদ্ভুত কেন?

 

অর্পণ তার ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে ক্যাপ মাথায় দিল। সে চাচ্ছে এখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামুক।বৃষ্টিতে যেন পৃথিবীর সব কিছু মুছে যাক।শুধু যেন তার চোখের সামনে জেগে থাকে একটা মুখ।এক জোড়া সুন্দর চোখ। সে দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে মাথা নীচু করে হাঁটতেই থাকে।তার উনিশ বছরের মনে এক নিদারুণ তোলপাড় চলছে। সে মনে মনে জপে চলছে, “তোমার জন্যে প্রিয়াদি, তোমার জন্যে...আমার এখন ঘুম হয় না। অনেক অস্থির লাগে।ঘুম হয় না, রাত জাগি।রাতের শেষে ট্রেইন স্টেশন, ইউনিভার্সিটি।তোমার প্রতীক্ষায় কাটে সারাবেলা।তোমার জন্যে প্রিয়াদি, তোমার জন্যে। আমি এত যে ভাল একজন ছাত্র...আমার কিচ্ছু পড়া হয়না।আমার খেতে ইচ্ছা করে না।আমার কিচ্ছু করতে ইচ্ছা করেনা।তোমার জন্যে প্রিয়াদি, তোমার জন্যে।আমার এখন কিছুই ভাল লাগেনা।কিছুই না।”

 

অর্পণ হেঁটে চলেছে।তার দুই পাশে মেহগনি গাছের সারি। তার  দুইপাশে ধানক্ষেত।তার পরে পাহাড়।সব সবুজ যেন এক কালোয় মিশেছে।শ্রাবণ মেঘের অদ্ভুত অন্ধকারে।পৃথিবীর উপরে যে আকাশ সেই আকাশ কিছু তরুণ তরুণীকে ছায়া দিয়ে চলেছে।সবাই আনমনে চাইছে বৃষ্টি নামুক। বৃষ্টি তাদের হয়ে কাঁদবে। কারো অস্থিরতা নীরব ঝাউয়ের মতো উদাসীন বাতাসে দোলে, কারো অস্থিরতা নীরব মেঘের মতো থমকে থাকে।তবু সবাই মনে মনে চাইছে বৃষ্টি নামুক।শ্রাব দিনের নির্জন আলোছায়া অন্ধকারে।

 


ঘুমঘুম সকাল। শাহেদের সাধারণত এই সময় ঘুম ভাঙ্গার কথা নয়।আজ ব্যাতিক্রম ঘটেছে।শাহেদ কাঁথার ফাঁক দিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছে এই সাত সকালে তার ঘুম কেন ভাঙ্গলো।অনেকক্ষণ ভেবেও কিছু বের করতে না পেরে সে বিছানা ছাড়লো।অদ্ভুত ব্যাপার হলেও সত্যি যে সে একটা চাকরী পেয়ে গেছে। কিন্তু কেন জানি তার সেটা এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। হয়তো সে এখনো ঘুমাচ্ছে। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে যে সে চাকরী পেয়ে গেছে।ঘুম ভাঙলে দেখতে পাবে আবার সেই ম্যান্দামারা দিন।সে বালিশের নীচ থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা বের করে।কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার রেখে দেয়।
তার অনেক মন ভালো থাকার কথা। অনেক খুশীতে লাফালাফি করার কথা। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি তার মন কেন জানি খারাপ।কারণটা সে কোনভাবেই বের করতে পারছে না।জানালার দিকে তাকিয়ে সে বাইরের বৃষ্টি দেখতে পায়। আজ কেন জানি তার বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে। সে মনে মনে একটা গালি দেয়… শালার বৃষ্টি।
সে এখনো কাউকে জানায়নি তার চাকরী পাওয়ার ঘটনাটা। কাকে প্রথম জানাবে সেটা ভাবতে তার মনে অনেকদিন পরে একটা মেয়ের ছবি ভেসে উঠলো।রিমি।সে মনে মনে ভাবে রিমি এখন কোথায় আছে। সে জানে না।আর তার জানার কোন দরকারও নাই।সে জীবনের কোন জটিল জিনিস নিয়ে কখনো ভাবে নাই।আর কোনদিনও ভাবতে চায়না।জীবন তাকে যেখানে নিয়ে যাবে সে সেখানেই যেতে চায়।
তবুও পৃথিবীর কোথায় যেন অমোঘ ঘড়ি চলে। কিসের টানে মানুষ কোথায় ছুটে চলে সেটা সে নিজেও জানে না অনেক সময়। শাহেদ তৈরী হয়ে নিজের অজান্তেই শহরের এমন একটা জায়গায় যেতে লাগলো যেখানে সে অনেকদিন ধরেই যায় না।সে কখনো বিষন্নতায় বিশ্বাসী না। কনো ধরণের কোন কিছুই তাকে স্পর্শ করেনা।তার নিজের পরিবারে সে কখনোই কোন সময় দেয়নি। সেখানে তার জীবনে কেন একটা গভীর ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে সেটাও সে ভাবে না।এই ক্ষতের কথা সে কখনো মনে করেনা।তবু মাঝে মাঝে রাতবিরেতে কেন জানি তার মন খারাপ হয়।কোনকিছুতেই তার তখন কিছুই ভালো লাগেনা।
সে একসময় নিজেকে আবিষ্কার করলো সুগন্ধা আবাসিক এলাকায়।সে চুপচাপ ধীর পায়ে একটা বিল্ডিং-এর সামনে এসে দাঁড়ালো।এইখানে এইসময় রিমিরা থাকতো। এখনো কি থাকে?সে জানে না। পাশেই এক দোকানে ফুল বিক্রি হচ্ছে। সে একটা গোলাপ আর কিছু চকোলেট কিনল। কলিং বেল টিপে সে নিজেকে বুঝতে চেষ্টা করলো।না। তার তেমন কোন তীব্র অনুভূতি হচ্ছে না।দরজা খুলে দিল কাজের বুয়া। জিজ্ঞেস করল, “কারে চান?” শাহেদ বললো, “রিমি আছে? আমি তার একজন বন্ধু।”
“ভিতরে আসেন।”
ড্রইংরুমে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরে শাহেদ রিমিকে দেখতে পেল।
***
দুইদিন হলো সজল আর পারুল বেগম কানাডা থেকে ফিরেছে।হঠাত করেই আসা।পারুল বেগম খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছেন ফরিদ সাহেবকে নিয়ে।তাই সজলকেও জোর করে নিয়ে এসেছেন সাথে করে।বেশ কয়েক বছর পরে দেশে এসে সজলের কেমন যেন একটা মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে।
সজল আসার পরে ফরিদ সাহেব কিছু সৌজন্যমূলক কথাবার্তা ছাড়া আর কোন কথা বলেননি তার সাথে।সজল বুঝে কেন তার বাবার এত রাগ তার উপর।কিন্তু বাবা কোনদিনও তাকে বুঝতে চেষ্টা করেন নি।তার সাথে বিয়ে দিয়েছেন এমন একটা মেয়ের যাকে সে কখনো বুঝে উঠতে পারে নাই।
বাসা থেকে বের হয়ে সে ঠিক বুঝতে পারছে না কোথায় যাবে। তার তেমন কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধব নেই যে ওখানে যাওয়া যাবে।সে একটা রিক্সা নিল।নিউমার্কেট এলাকার দিকে। কিছুদূর যাওয়ার পরে সিগন্যাল ক্রসিং-এ রিক্সা থামলো।একটা ছোট মেয়ে দৌড়ে আসলো ফুল নিয়ে। “স্যার ফুল কিনবেন?” সজল মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু থমকে গেল।অনেকদিনের পুরনো একটা মায়া তার মনে উঁকি ঝুঁকি দেয়া শুরু করলো।
 

***


রিমি একটু অবাক হয়ে দেখলো সোফায় বসা মানুষটাকে। শাহেদ ভাই। বোকার মতো বসে আছে।এই মানুষটা কি কখনো পালটাবে না? সে ভাবে। কেমন অদ্ভুত ভঙ্গীতে একটা ফুলের তোড়া আর চকোলেটের বাক্স নিয়ে বসে আছে।সে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছো, শাহেদ ভাই?”
“ভালো আছি। তোর কি খবর?”
“আমি ভালো আছি। তো এতদিন পরে হঠাত কি মনে করে?”
“কিছুনা। এমনিতেই। এইগুলো তোর জন্যে।” ফুল আর চকলেটগুলো শাহেদ রিমির দিকে বাড়িয়ে দেয়। রিমি সেগুলো নিয়ে একটু দেখলো।তারপর জিজ্ঞেস করলো, “এখন কি করছো শাহেদ ভাই?”
“কিছু করছি না রিমি।”
“এখন তাহলে আগের মতোই আছো। ভালোই তো। তুমি সুখী মানুষ।”
“বুঝলি রিমি, এই পৃথিবীর আসলে সবাই সুখী। কেউ সেটা বুঝতে পারে আর কেউ পারে না…এটাই শুধু পার্থক্য।আর কিছু না।”
“হুম্‌…চা খাবে নাকি অন্য কিছু?”
শাহেদ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।সে মনে মনে ভাবে মানুষ এত অভিনয় করতে পারে কি করে?তারা দুইজনই এমন ভাব করছে যেন তাদের মাঝে কোনকিছুই হয় নি। যেন এই কিছুদিন আগেই তাদের মাঝে দেখা হয়েছিল। অথচ তাদের মাঝে জীবন জানে কত প্রহর কত কিছু যা কিছুটা অবর্ণনীয়, যার কিছুটা অব্যক্ত।
শাহেদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সে বলে, “উঠি রিমি। ভালো থাকিস।”
“আচ্ছা। তুমিও ভালো থেকো।”
শাহেদ বাইরের আকাশে বেরিয়ে আসে।তার উপরের আকাশে অনেক মেঘ জমে আছে।সে উদাস চোখে আকাশের মেঘ দেখে।আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামবে। যে কথাগুলো কখনই তার বলা হয়ে উঠেনা ওই আকাশ কি জানে তার কতটুকু কষ্ট সেই না বলা কথার? হয়তোবা জানে।হয়তোবা না। সে মাটির দিকে তাকিয়ে হেঁটে যেতে থাকে। পৃথিবীর অনেক কিছুই তাকে স্পর্শ করেনা।সে শুধু জানে তাকে বাঁচতে হবে। শুধু বাঁচার তাড়নায় অনেকটা আদিম পশুর মতো সে পৃথিবীর পথে হেঁটে চলে। তাকে বাঁচতে হবে। আর কিছুই তাকে স্পর্শ করেনা। এমনকি শ্রাবণ দিনের অনেক মেঘ করে আসা বাদল বৃষ্টিগুলোও না।
 


 

অর্পণ অনেকঅক্ষণ ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে কিভাবে একটা নতুন কবিতা লেখা যায়। কিন্তু কিছুই মাথায় আসছে না।সে বিরিক্তভাবে কলম রেখে রমিজ পাগলাকে বলল, “রমিজ ভাই এক কাপ চা আর একটা সিগারেট দেন।”

রমিজ পাগলা গজগজ করতে করতে চা বানাতে লাগলো।আজ তার মন একটু ভাল।কারণ কি সেটা সে নিজেও জানে না।আজ বৃষ্টি হচ্ছে না।হয়তো এটাই কারণ।সে চা এগিয়ে দেয় অর্পণের দিকে।জিজ্ঞেস করে, “কি লেখ এসব আবোল তাবোল? ভাল কিছু লিখতে পারোনা?”

অর্পণ ভ্রূ কুঁচকে তাকায়। বলে “ভাল কিছুটা কি?”

“ভাল কিছু হইল ভাল কিছু।সেটাও কি আমাকে বলে দিতে হবে?” এই বলে রমিজ নিজের কাজে মন দিল।আপন  মনেই বলতে থেকে সে “হায়রে রমিজের মা, বেঁচে থাকতে এই দুনিয়া তুমি দেখলা না। কি যে লেখে পোলাপাইন আজকাল। কিছুই বুঝা যায় না।”

 অর্পণ ব্যাগ থেকে কিছু প্র্যাকটিকাল শীট বের করলো। সে হতাশ ভাবে তাকিয়ে থাকে এইসব সাদা কাগজের দিকে।কিছুই লেখা হয়নি, কিছুই আঁকা হয়নি।আজ কি নিয়ে সে প্র্যাকটিকাল ক্লাসে যাবে!সে হতাশ হয়ে আবার ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে দেত শীটগুলো। সে কলম তুলে আঁকি বুকি কাটতে থেকে খাতার মাঝে।ধীরে ধীরে সে লিখতে থাকে…

ধীরপায়ে তুমি যদি এসে দাঁড়াও একবার

আমার মনের আঙিনায়

আমি কিছুই চাইব না আর

ওই আকাশ আর নদী যেই আমাকে কিছু দিতে চায়

সব ফিরিয়ে দিব

আমি শুধু তোমার পায়ের শব্দ শুনবো

আমার আঙিনা জুড়ে

তুমি যদি একবার আস

আমার মনের আঙিনায়

অর্পণ কিছুক্ষণ লেখাটার দিকে তাকিয়ে থাকলো।তারপর ধীরে ধীরে ছিঁড়লো পাতাটা।বেঞ্চে ছেঁড়া টুকরোগুলো রেখে উঠে দাঁড়ালো।সে ক্লাসের দিকে রওনা দিল।

রমিজ পাগলা ছেঁড়া টুকরোগুলো দেখে গজগজ করতে করতে উঠে দাঁড়ালো।“এইটা কোন কথা হইল? এরা কি করে কেন করে কিছুইতো বুঝিনা রমিজের মা।তুমি দেখলা না বেঁচে থাকতে এই দুনিয়া…হায়রে রমিজের মা।” সে কাগজের টুকরাগুলো পরিষ্কার করার জন্যে হাত বাড়াতেই শুনতে পেল একটা মেয়ের গলা।সে পিছনে তাকিয়ে দেখে প্রিয়া।

প্রিয়া হেসে বলে, “রমিজ ভাই, এককাপ চা দাও খুব তাড়াতাড়ি। আর তুমি রমিজের মা বল কেন? রমিজ তো তোমার নাম।”

রমিজ পাগলা বলে, “প্রিয়া আপা, এইটা হলো ভাবের কথা। তোমরা আজকালকার পোলামাইয়া এইসব ভাবের কথা বুঝবা না।”

প্রিয়া বলে “ভাবটা একটু বুঝায় বল। বুঝতে চেষ্টা করি।”

রমিজ পাগলা একটু উদাস ভঙ্গীতে বলল, “এই দুনিয়াতে সবচেয়ে আপন কে? আপন হইল মা। তাই আমার মায়েরে জিজ্ঞাসা করি প্রইত্যেক কথা। আফসোস লাগে এই দুনিয়ার কত কিছু মা দেখতে পেলনা।”

এই বলে সে চা বানাতে গেল। 

প্রিয়া কাগজের ছেঁড়া টুকরোগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো।সে সব টুকরো জড়ো করে হাতের মাঝে নিল।অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরে সে আর ডায়েরীর ভাঁজ-এর মাঝে টুকরোগুলো রাখলো।

চা খেয়ে সে চারুকলা ডিপার্টমেন্টের নির্জন কোণে পাহাড়ের পাশে এসে বসলো। ডায়েরী খুলে ছেঁড়া টুকরোগুলো জোড়া লাগানোর চেষ্টা করতে লাগলো। অনেকক্ষণ পরে সে পড়তে পারলো কবিতাটা।তার মনে শুধু একটাই প্রশ্ন আসে।ছেলেটা এত অদ্ভুত কেন?

প্রিয়ার সাধারণত মন খারাপ হয়না।তার শুধু মাঝে মাঝে অনেক উদাস লাগে।কেন লাগে সেটা সে জানে।কিন্তু কারো সাথে সেটা শেয়ার করতে ইচ্ছা করেনা।আজ তার উদাস লাগছে না।তার কেন জানি মন খারাপ হচ্ছে।মানুষ এত অদ্ভুত হয় কেন?কেন মানুষের মন আরেকজনের জন্য পুড়ে।কি আছে দুনিয়ায়? এত মায়া কোথা থেকে আসে মানুষের মনে? সে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানে না।উত্তর সে চায়ও না।সে শুধু জানে পৃথিবীর অমোঘ নিয়মে সবাইকে বেঁচে থাকতে হয়। সবাই এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্যই আসে।এইসব আবেগের মূল্য কতটুকু এই বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতায়? 

প্রিয়ার বাবা মা কেউ বেঁচে নেই।ভাই আছে। ওরা কি তার আপন মানুষ? সে জানে ওরা কেউ তার আপন নয়।সম্পর্ক রক্তের।তাই হয়তো এখনো টিকে আছে? প্রিয়ার মন মাঝে মাঝে উদাস হয় তার বাবা মার জন্য।মাঝে মাঝে সে অনেক বেশী মিস্‌ করে বাবা মাকে।মনে হয় কেউ যদি থাকতো যে খুব গম্ভীরভাবে বলতো না যে এইটা করো না ওটা করো না, যে খুব গভীর মমতায় তাকে কাছে টেনে নিত, তবে তার জীবনটা অনেক সুন্দর হতো।মাকে তাই তার অনেক বেশী মনে পড়ে মাঝে মাঝে।এইসব কারণ ছাড়া তাই তার অন্য কোন কারণে মন খারাপ হয় না সাধারণত। কিন্তু আজ কেন তার একটা ছেলের কথা এত বেশী মনে পড়ছে? সে কবিতার পাতাটার দিকে তাকিয়ে থাকে।কাগজটার মাঝে ধীরে ধীরে সে দেখতে পায় একজোড়া মায়াবী চোখ।সে হাসে। জিজ্ঞেস করে, “এই ছেলে, তুমি এত অদ্ভুত কেন? আমার মন খারাপ করে দাও কেন?”

 

 

চলবে...

পর্ব (১-৫)