গুগল কথন -  

প্রযুক্তির প্রাণকেন্দ্রে বসবাস

রাগিব হাসান

ragibhasan@gmail.com                                                                                              http://www.ragibhasan.com

 

গুগলে তিন মাস টানা কাজ করে যখন ফিরছি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে, তখন মনে হলো, এই তিনটা মাস এক অসাধারণ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দ্রুত কেটে গেছে আসলেই, গুগল এক আজব দুনিয়া

১৯৯৮ সালে গুগলের প্রতিষ্ঠা, স্ট্যানফোর্ডের দুই ছাত্র - সের্গেই ব্রিন আর ল্যারি পেইজের হাতে এরা দুজনে ইন্টারনেটের ওয়েবসাইট গুলোকে কিভাবে র‌্যাংকিং, বা ক্রম নিরূপণ করা যায়, সেই গবেষণা করছিলেন তা করতে গিয়ে তাঁরা বের করেন পেইজর‌্যাংক নামের একটি অ্যালগরিদম আর সেই পেইজর‌্যাংকের চমৎকারিত্বেই গুগলের অনুসন্ধানের মান হয়ে উঠে এতোটা ভালো

সের্গেই আর ল্যারিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি দুই-তিন জনে শুরু হওয়া এই গুগল আজ হাজার দশেক প্রোগ্রামারের এক বিশাল প্রতিষ্ঠান আর গুগলে সার্চ করাটা এতই নিত্যনৈমিত্ত্বিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, অনেক অভিধানে "গুগল" নামের ক্রিয়াপদটিও যুক্ত হয়েছে, যার অর্থ ইন্টারনেটে কারো সম্পর্কে তথ্য বের করা

ক্যালিফোর্নিয়ার মধ্য-উত্তর ভাগে, সানফ্রান্সিস্কো আর সান হোসে শহরের মাঝে, সেই সুবিখ্যাত সিলিকন ভ্যালির কেন্দ্রস্থলের মাউন্টেইন ভিউ শহরে গুগলের সদরদপ্তর জায়গাটা চমৎকার, আবহাওয়াটা বাংলাদেশের হেমন্তকালের মতো থাকে সারা বছর জুড়েই দিনের বেলাতে তাপমাত্রা ২০-২৫ সেলসিয়াস, আর রাতে ১৫-১৬ ডিগ্রির মতো আর ভারি সুন্দর রৌদ্রকরোজ্জ্বল আকাশ সানফ্রান্সিস্কোতে অবশ্য ঠান্ডা পড়ে এই গরম কালেও, প্রশান্ত মহাসাগরের শীতল স্রোতের কল্যাণে কিন্তু উপকূল হতে ৪০ মাইল ভেতরের সিলিকন ভ্যালিতে আসতে আসতে ঠান্ডার প্রকোপ কমে আসে

আমি আর আমার স্ত্রী জারিয়া বাসা খুঁজে নিয়েছিলাম গুগলের প্রধান দপ্তরের মাইল দুয়েকের মধ্যেই আমাদের বাসা হতে মাইল দেড়েক আসলেই হাইওয়ে ১০১ পড়ে, আর তার ওপারেই গুগল হাইওয়ে ১০১ চলে গেছে সানফ্রান্সিস্কো হতে লস অ্যাঞ্জেলেস অবধি তবে ভীড়টা হয় সানফ্রান্সিস্কো হতে সান হোসের মধ্যকার অংশে, অর্থাৎ সিলিকন ভ্যালির এলাকাটাতে এখানেই লাগালাগি করে শহর গুলো গড়ে উঠেছে সান হোসের পশ্চিমে পর্যায়ক্রমে সান্তা ক্লারা, সানিভেইল, মাউন্টেইন ভিউ, পালো আল্টো (স্ট্যানফোর্ডের ক্যাম্পাস), আর তার পরে আরো কিছু শহর পেরিয়ে সবার পরে হলো সানফ্রান্সিস্কো এই এলাকার তাবৎ মানুষ তাই হাইওয়ে ১০১ দিয়েই চলাচল করে থাকে প্রতি পাশে ৪টি করে মোট ৮লেইনের এই হাইওয়ে সারাক্ষণ জমজমাট বলা হয়ে থাকে, হাইওয়ে ১০১এর ট্রাফিক জ্যাম দেখেই বোঝা যায়, সিলিকন ভ্যালির অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন আমি অবশ্য প্রচন্ড ভীড় দেখেছি, তাই বলতে পারি, এখন এখানকার কোম্পানিগুলোর রমরমা অবস্থা

তা অবশ্য গুগল, ইয়াহূ!, সান, আর মাইক্রোসফটের বিশাল অফিস গুলো দেখলেই বোঝা যায় এদের মধ্যে গুগল সবচেয়ে নবীন তার পরেও প্রায় মাইল এলাকা জুড়ে এদের মোট ১৬টা অফিস ভবন রয়েছে এর পরেও জায়গা হচ্ছেনা দেখে আশে পাশে আরো অনেক ভবন ভাড়া নেবার পাঁয়তারা চলছে

তথ্য প্রযুক্তির এই প্রাণকেন্দ্রে কাজ করার সুযোগ পাওয়াটা সহজ না প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে পুরো আমেরিকার সব নামজাদা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা এখানে ইন্টার্নশীপ, বা তিন মাসের শিক্ষানবিশী কাজের জন্য আবেদন করে থাকে (গুগল অবশ্য এই তিন মাস ওদের স্থায়ী প্রকৌশলীদের হারেই বেতন দেয়) গত কয়েক বছর গ্রীষ্মকালে কাজ করেছি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারকম্পিউটার সেন্টার এনসিএসএ-তে তাই এবছরের শুরুতেই ঠিক করি, এবার আর এখানে না, বরং গবেষণা প্রোগ্রামিং এর হাতে কলমে কাজ হয়, এমন কোথাও ইন্টার্নশীপ করবো অফার অবশ্য পেয়েছিলাম বেশ কয়েক জায়গা থেকে কিন্তু মাইক্রোসফট, এইচপি, কিংবা ইয়াহুর থেকেও গুগলে কাজ করার ইচ্ছাটা অনেক বেশি ছিলো কারণ, গুগলের সম্পর্কে এতো গল্প চালু, ওদের কাজের পরিবেশের এতো সুনাম, আর এতো প্রচন্ড ইন্টারেস্টিং সব প্রজেক্ট ওদের এখানে চলছে, তাই ভেবেচিন্তে গুগলের ইন্টার্নশীপটাই বেছে নিই

গুগলে এসে এই তিন মাসে যা দেখেছি, তাতে বুঝেছি, সিদ্ধান্তটা ঠিকই নিয়েছিলাম প্রথম দিনটি থেকেই শুরু করে শেষ দিন পর্যন্ত চমৎকৃত হয়েছি প্রতিদিনই, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের অসাধারণ প্রয়োগের বিভিন্ন নিদর্শন দেখে দেখে



 

ছবি - গুগলে আমার অফিস ভবনের সামনে আমি

ছবি- গুগলের মূল ভবন বিল্ডিং ৪০- পাশে আমি জারিয়া

 

গুগল কথন -

 ডাইনোসরের ছায়ায় স্পেসশীপ

গুগলে কাজ শুরু করি ১৫ই মে আগের পুরো সপ্তাহ গাড়ি চালিয়ে আমেরিকা মহাদেশের এপার থেকে ওপারে গিয়েছি, প্রায় ২৫০০ মাইলের পথ পাড়ি দিয়ে প্রথম দিনে ওরিয়েন্টেশন, নির্দেশ ছিলো সকাল নয়টার সময় গুগলের বিল্ডিং ৪৩-এর লবিতে হাজির থাকার

গুগলের ক্যাম্পাসে ঢুকতেই সামনে পড়লো প্রকান্ড এক ডাইনোসর তাও আবার ডাইনোসরদের রাজা টিরানোসরাস রেক্স! বিশাল হা করে বিদঘুটে, ধারালো, তেকোণা দাঁতগুলো মেলে আছে, যেন এই ধরতে আসলো গুগলের মূল ক্যাম্পাসের চারটি ভবন - বিল্ডিং ৪০, ৪১, ৪২, ৪৩ এর মাঝের মাঠে রাখা, ঠিক যেনো ঢুকে পড়া অনাহুত সবার পিলে চমকে দেয়ার জন্য স্থাপিত



এই ডাইনোসরটির নাম স্ট্যান ৬৫ মিলিয়ন বছরের পুরনো এই ডাইনোসরটি পাওয়া গিয়েছিলো সাউথ ডাকোটা স্টেইটের এক পাহাড়ে গুগলে অবশ্য আসল ডাইনোসরের হাড়গোড় নেই, বরং আসলটার ব্রোঞ্জে তৈরী প্রতিমূর্তি রাখা আছে কেনো গুগলে ঢোকার মুখে এটা রাখা, ওরিয়েন্টেশনে করা এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাইনি, তবে মনে হয় ঠাট্টার ছলে এটা রাখা গুগলের এই অফিসগুলো আগে ছিলো সিলিকন ভ্যালিরই এক নামজাদা কোম্পানি, সিলিকন গ্রাফিক্সের এক কালে চুটিয়ে ব্যবসা করা সিলিকন গ্রাফিক্স ডাইনোসরদের মতোই হঠাৎ বিলীন হয়ে যায়, ব্যবসায় লালবাতি জ্বেলে জনশ্রুতি অনুসারে, রসিকতা করে সিলিকন গ্রাফিক্সের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই ডাইনোসর এখানে স্থাপিত গুগলের ইঞ্জিনিয়ারদের রসবোধের আরো প্রমাণ পেলাম, ডাইনোসরের গলায় গুগলের আইডিকার্ড ঝুলতে দেখে



ডাইনোসর ডিঙিয়ে লবিতে গিয়ে এবছরে আসা ইন্টার্নদের সাথে পরিচয় হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও কানাডা, ইউরোপ, এমন কি অস্ট্রেলিয়া থেকেও অনেকে এসেছে প্রায় ঘন্টা দুয়েকের কঠিন এক ফোন ইন্টারভিউ পেরুতে হয়েছে সবাইকে

ওরিয়েন্টেশনের প্রাথমিক কথাবার্তা শেষে আমাদের নেয়া হলো গুগল ভবনের এক ট্যুরে মূল ভবন বিল্ডিং ৪৩এর লবির পাশের দরজা পেরুতেই আবারো চমকে গেলাম, প্রমাণ আকারের একটা স্পেস শীপ ঝুলছে তলা ভবনের ছাদ থেকে গাইড হিসাবে যিনি দেখাচ্ছিলেন, তিনি জানালেন, এটা স্পেসশীপ ওয়ান - দুনিয়ার প্রথম বেসরকারী মহাকাশযানের পূর্ণ সংস্করণ বার্ট রুটানের নকশায় প্রণীত এই স্পেসশীপটি বছর দুয়েক আগে মহাকাশের দোরগোড়ায় পৌছানোর সুবাদে এক্স প্রাইজ জিতে নিয়েছিলো গুগলের প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেইজ এক্স প্রাইজ ফাউন্ডেশনের বোর্ড মেম্বার হওয়াতে স্পেসশীপ ওয়ানের এই পূর্ণ আকারের সংস্করণটি এখানে রাখা

পাশেই প্রজেক্টরের মাধ্যমে দেয়ালে দেখানো হচ্ছে, দুনিয়ার বিভিন্ন স্থান হতে আসা গুগল সার্চের একটু অংশ দ্রুত স্ক্রোল করে যাচ্ছে, ইংরেজি ছাড়াও চীনা, জাপানি, আরবি এরকম সব ভাষাতে কে কী সার্চ করছে এই মুহুর্তে, তা লাইভ দেখানো হচ্ছে অবশ্য সবটা না, খুব অল্প অংশ তার পাশেই একটা স্ক্রীনে দেখানো হচ্ছে একটা গ্লোব ঘুরতে থাকা গ্লোবটাতে বিভিন্ন মহাদেশ হতে নানা বর্নের আলোকরশ্মি বেরিয়ে এসেছে, একেক ভাষার জন্য একেক রঙ আর রশ্মি গুলো নির্দেশ করছে কোথা থেকে সার্চ আসছে স্বভাবতই দুনিয়ার যেখানে যেখানে দিন, সেখান থেকে অনেক আলো বেরুচ্ছে বাংলাদেশের এলাকা থেকে অল্প কিছু আলো বেরুতে দেখলাম, ইংরেজি ভাষার সার্চ নির্দেশ করা অবশ্য তখন বাংলাদেশে গভীর রাত আফ্রিকার পুরোটাই ঘন অন্ধকার

গ্লোব আর প্রজেক্টরের এই দেয়ালের পাশেই রয়েছে মেং এর অ্যালবাম মেং গুগলের একজন সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার বড়বড় দাঁতে বিশাল এক হাসি দিয়ে বিখ্যাত লোকদের সাথে ছবি তোলাই তার শখ গুগলে প্রায় প্রতিদিনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের নামজাদা সব লেখক, রাজনীতিবিদ, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী - এরা আসেন আর বিখ্যাত কেউ আসছে শুনলেই, ব্যস, মেং ছুটে যায় ক্যামেরা নিয়ে ক্লিন্টন, কার্টার থেকে শুরু করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, এদের ছবি তো আছেই, রয়েছে অন্য অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের ছবি রয়েছে হিলারি ক্লিন্টন, থেকে শুরু করে মুহাম্মদ আলীর ছবি, নানা লেখক আর চিত্রতারকাদের ছবি, নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী আর শান্তিকর্মীদের ছবি

এতো সব ছবি যখন এক এক করে সবাই দেখে চলেছে, তখন আমি তাকিয়ে রয়েছি বিপুল গর্ব নিয়ে মেং এর অ্যালবামের এক প্রান্তে, যেখানে মেং এর সাথে শোভা পেয়েছে আমাদের ডঃ ইউনুসের ছবি



ছবিতে রয়েছে বিল্ডিং ৪৩ এর সামনের বাগানে স্ট্যান টি রেক্সের সাথে আমি আমার স্ত্রী জারিয়া ভবনের ভেতরের ছবি তোলা মানা বলে স্পেসশীপ ওয়ানের ছবি তোলা হয়নি


গুগল কথন -

 গুগলপ্লেক্সের ভিতরে বাইরে

ইন্টার্নশীপের প্রথম দিনেই হাজির হলাম গুগলের সদর দপ্তরে এতো বিখ্যাত কোম্পানি, কিন্তু নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি নেই প্রথম দিনে লবিতে আমার ইন্টার্নশীপের কাগজপত্র আর আইডি দেখানোর পরে ছবি সহ গুগল ব্যাজ দেয়া হলো ব্যাস, এই ব্যাজ থাকলে গুগলের সর্বত্র অবাধে আসা যাওয়া করা সম্ভব

গুগলের প্রধান অফিসকে বলা হয় গুগলপ্লেক্স প্রযু্ক্তির প্রাণকেন্দ্র সিলিকন ভ্যালির একেবারে কেন্দ্রস্থল মাউন্টেইন ভিউ শহরে এর অবস্থান আসলে সান ফ্রান্সিস্কো হতে সান হোসে পর্য্ত প্রায় ৪০ মাইল লম্বা যেই উপদ্বীপ আকারের এলাকা, তার পুরোটাই আধুনিক প্রযুক্তি ভিত্তিক ব্যবসার কেন্দ্র মাউন্টেইন ভিউ এর পাশেই স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, পালো আল্টো নামের শহরে প্রযুক্তিগত বিভিন্ন বিষয়ে এখানে অভাবনীয় সব গবেষণা হয়ে চলেছে খানেক বছর ধরেই, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের দিক থেকেও এটা দুনিয়ার প্রথম কাতারে নামজাদা সব মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, বিশেষত ইদানিংকার অধিকাংশ সফটওয়ার কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা অনেকেই এখানকার ছাত্র ছিলেন গুগলের সের্গেই ব্রিন আর ল্যারি পেইজ তো বটেই, ইয়াহু! প্রতিষ্ঠাতা ফিলো এবং ইয়াং, সানের প্রতিষ্ঠাতা ম্যাকনিলি, বিনোদ খোসলা - এরা সবাই স্ট্যানফোর্ডে পড়ার সময়ে বা পাস করেই নিজেদের কোম্পানিগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আর সেই কারণেই পালো আল্টো বা মাউন্টেইন ভিউতে এই সব কোম্পানির সদর দপ্তর গড়ে উঠেছে

ফিরে আসি গুগলপ্লেক্সের কথায় গুগলের শুরুটা হয়েছিলো ব্রিন পেইজের এক বন্ধুর গ্যারেজে, মাত্র কয়েকটি কম্পিউটার নিয়ে মেনলো পার্কের গ্যারেজে পরে গুগল চলে আসে পালো আল্টো শহরে কিন্তু গুগলের অভাবনীয় সাফল্যের কারণে জায়গার দরকার বাড়তে থাকে অচিরেই তাই ২০০৩ সাল এক কালের নামকরা কোম্পানি সিলিকন গ্রাফিক্সের ১৬০০ অ্যাম্ফিথিয়েটার পার্কওয়েতে অবস্থিত বিশাল হেড কোয়ার্টারটি গুগল ভাড়া নেয় এখানে রয়েছে চারটি ভবন - বিল্ডিং ৪০, ৪১, ৪২, এবং ৪৩ আগেই বলেছিলাম, এই চারটি ভবনের মাঝখানের চত্ত্বরের বিশাল ডাইনোসরটির কথা এছাড়াও মাঝখানের চত্ত্বরে রয়েছে একটি ভলিবল কোর্ট সারাদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে কেউ না কেউ খেলে বেড়াচ্ছে ... দেখলে মনে হবে অফিস নয়, বরং একটা হোটেলের খেলার কোর্ট অনেকের কাছে শুনেছি, বিকেলের দিকে সের্গেই ব্রিন বা পেইজও নাকি যোগ দেয় খেলাতে আমার অফিসটা অবশ্য একটু অন্যপাশে থাকায় সেই দৃশ্য দেখিনি

এর পাশেই ক্যাফের চত্ত্বর গুগলের সুবিখ্যাত খাওয়া দাওয়া নিয়ে পরে লিখবো কিন্তু এটুকু বলতে পারি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেরা সেরা সব রেস্তোঁরার খাওয়াকেই গুগলের ক্যাফেগুলো হার মানায় মোট ক্যাফের সংখ্যা এখানে ১৫টি একেক ক্যাফে একেক রকমের - প্রধান ক্যাফেটা গুগলপ্লেক্সের বিল্ডিং ৪০এর চার্লিজ ক্যাফে ওখানে এক সাথে প্রায় কয়েক হাজার লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় প্রতিদিন

আমাদের ওরিয়েন্টেশন হয়েছিলো বিল্ডিং ৪৩ আর ৪২ এর বিশাল অডিটোরিয়ামে প্রথম দিনের সব কাজ কর্ম শেষে পুরো গুগলপ্লেক্স ঘুরে দেখানো হলো প্রতিটি তলাতেই একটু পর পর মাইক্রো কিচেন আছে, যাতে থরে থরে সাজানো আছে নানা রকম ফলের রস, চিপ্স, আইসক্রিম, ডাবের পানি, চকলেট, স্যান্ডউইচ থেকে শুরু করে কতো কি!! এই ব্যাপারে নাকি সের্গেই ব্রিনের একটা নীতি আছে, "কোনো মানুষকেই খাবার দাবারের থেকে দেড়শো ফুটের বেশি দূরে রাখা ঠিক না" কাজ করতে করতে একটু খিদে পেলেই দূরে যাবার দরকার নেই, অফিস থেকে দুই পা হাঁটলেই একটা মাইক্রোকিচেন, আর সেখানে এরকম জিভে জল আনা সব খাবার

গুগলপ্লেক্সের চারটি ভবন ছাড়াও এই এলাকাতেই কেবল গুগলের অফিস রয়েছে মোট ১৬টি এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত প্রায় মাইল দূরত্ব আমার অফিসটি পড়েছিলো পশ্চিম পাশে অবশ্য এক অফিস থেকে আরেক অফিসে যাবার জন্য অনেক ব্যবস্থা আছে পুরো ক্যাম্পাসের প্রতিটি ভবনের সামনেই রয়েছে গুগলের মনোগ্রাম লাগানো বাই সাইকেল বা জি-বাইক যে কেউ যে কোনো জি-বাইক নিয়ে অন্য অফিসের সামনে গিয়ে পার্ক করে রাখে, পরে আবার সেটা অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারে তালা মারার ব্যাপার নেই এটা ছাড়াও রয়েছে ইলেকট্রিক স্কুটার, শাটল বাস, এবং দুই চাকার অদ্ভুত যান সেগওয়ে কিন্তু সবকিছুকে হার মানায় মাকড়শার মতো আকৃতির কনফারেন্স বাইক প্রথম যেদিন দেখলাম, অবাক হয়ে গিয়েছিলাম মাকড়শার অনেক গুলো পায়ের মতো এই বাইকের সাতটি বসার জায়গা বৃত্তাকারে বসানো, কেন্দ্রের একটি বিন্দুতে যুক্ত বসার সময় কেন্দ্রের দিকে মুখ করে সবাই বসে প্রতিটি সিটের নীচে প্যাডেল রয়েছে সবাই প্যাডেল চালালে এক অদ্ভুত উপায়ে সেটা এক সাথে যুক্ত করে বাইকটিকে চালায় আটজনের মধ্যে একজনের হাতে স্টিয়ারিং থাকে, সে এটা কোনদিকে যাবে তা ঠিক করে আর এই বাইকের নাম কেনো কনফারেন্স বাইক হলো? আসলে গুগলের প্রকৌশলীরা কনফারেন্স রুমে মিটিং না করে অনেক সময় এই বাইকে মজা করে চালাতে চালাতে মিটিং করে থাকে, এমনকি ল্যাপটপে করে ইন্টারনেটে যোগাযোগ, সবই করা সম্ভব এটাতে


গুগলপ্লেক্সে মোট কাজ করে হাজার ছয়েক মানুষ এদের অজস্র গাড়ি পার্ক করার জন্য যে পার্কিং লট রয়েছে, গুগল সেটাকেও অন্যভাবে কাজে লাগিয়েছে গুগলপ্লেক্সের স্যাটেলাইট ছবিতেই দেখবেন, পুরো গুগলপ্লেক্সের উপরের ছাদ, এমন কি পার্কিং লটের অনেক অংশের ছাউনির উপরে সোলার প্যানেল বসানো এই সোলার প্যানেলগুলো থেকে প্রতিদিন যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যুত উৎপাদন করা হয় - দিনে গড়ে মেগাওয়াটেরও বেশি আর গুগলের নিজস্ব আরেকটা প্রজেক্ট হলো প্লাগ-ইন হাইব্রিডের গবেষণা, অর্থাৎ এমন গাড়ি বানানো, যা বাসার ইলেক্ট্রিক সকেটে প্লাগ ঢুকিয়ে চার্জ করে নেয়া যাবে

                   

ছবিগুলো গুগলপ্লেক্স, আমার অফিসের বাইরের অংশ, গুগলপ্লেক্সের মধ্যকার ভলিবল কোর্ট - এই সব এলাকার।

 

পরের পাতা.....