১
সকাল বেলা দরজা খুলতেই এক পশলা বাতাস আদর করে দিয়ে যায়। আগের রাতের শেভ করা গালে
নতুন ব্রণের মতো অযাচিত শিহরণ জাগায়। এক হাতে বড় ব্যাগ, কাঁধে ল্যাপটপের
পুলিন্দা, চোখে চশমা, কিংবা আলোঝলমলে দ্যুতি- একগুচ্ছ আনন্দ- সব মিলিয়ে খুব
সকালেই বাসা থেকে বের হন আমাদের এই দিনপঞ্জির মূল চরিত্র।
ছুটির দিনের মতোই সকাল। অন্যান্য সপ্তাহ হলে হয়তো বিছানার উষ্ণ সান্নিধ্য কিংবা
ঘুমের সাথে রতিক্রিয়া ছেড়ে উঠতে মন চাইতো না। কিন্তু সারা দেশের কাছে বিহ্বল হয়ে
থাকা ঢাকা শহর ক্রমেই প্রান্তিক হতে থাকা মানুষের কাছে শেকড়ের কাছে ফিরে যাওয়াটা
রতিক্রিয়ার চাইতেও মোহময়, স্খলনজনিতআনন্দময়। ফলে চা কিংবা নাস্তা না করেই
অফিসবরাদ্দকৃত গাড়িটি ছুটে চলে উত্তুরের দিকে, উত্তরের দিকে।
গৌতম নামের এক বালকের দিনযাপনের কাহিনীগুলো প্রায়ই একঘেঁয়ে। কখনও কখনও সেগুলো
প্রবল আত্মবিশ্বাস ও উদ্দীপনায় ভরা, কখনও নিশ্চুপ কোনো আউটসাইডারের এক
বিবমিষাজনিত আত্মঅহংকার কিংবা অভিমানে ভরা জীবনে বলক দিয়ে আসা ফেনাময়। অফিস থেকে
তাই যখন ঢাকার বাইরে কাজ করার কথা উঠে,তখন
সেখানে প্রাণপ্রাচুর্যের
দুর্বাঘাসগুলো লকলকিয়ে উঠে।
গাড়ির ভেতর এফএম রেডিও চলছে, পত্রিকা পড়ার মতো বিলাসিতাটা ত্যাগ করার চেষ্টা
থাকলেও একসময় প্রাত্যকর্মের মতোই তাগিদ অনুভব করে গৌতম। জীবনের দায় বুঝে ফেলার
মতো শিক্ষাটা মানুষ পেয়ে গেলে তখন থেকেই পরাধীনতার শুরু। জীবনের সাথে রাষ্ট্র
যুক্ত হলে এ দায় শিকল হয়ে ঝুলে পড়ে। তাই রাস্তার অ্যাক্সিডেন্টের খবরগুলো কিছুটা
হলেও চিন্তাযুক্ত করে গৌতমকে- একবার ভাবে, আজকে এরকম একটা অ্যাক্সিডেন্ট হলে কি
খুব খারাপ হবে?
ঠিক এসময় উত্তরবঙ্গ থেকেই একটা ফোন। একেবারেই অপরিচিত কিন্তু বহুল আন্তরিক ও
প্রাচুর্যময় কণ্ঠ- আপনি এখন কোথায়? গৌতম অনুভব করে-
রক্তে তার বান হেনেছে
ডাকছে ওই উত্তরের বাতাস, মানুষ নয়তো-
পুরো উত্তর ভর করেছে
ওই মানবীর কণ্ঠে হয়তো।
২.
জীবনকে পাশ কাটিয়ে চলার মতো অনেক উপাদানই আছে, হয়তো। আপনি চাইলেই জীবনের বহু
প্রাচুর্য কিংবা বহু পঙ্কিলতাকে অনায়াসেই পাশ কাটিয়ে যেতে পারবেন। কালিয়াকৈরের
বাইপাস রাস্তাটুকু পার হওয়ার সময় গৌতম হিসেব করতে বসে- এই জীবনে সে কতোজনের
বাইপাস হয়েছে? হঠাৎ একসময় ধন্দে পড়ে যায়- সে নিজেই কি মানুষকে বাইপাস করছে না?
কালিয়াকৈরের গ্যাঞ্জামগুলো স্তিমিত হয়েছে, গৌতম হঠাৎই বুঝতে পারে- গ্যাঞ্জামের
কারণে বাইপাস করলে জীবনের প্রাচুর্য বা পঙ্কিলতা হয়তো স্পর্শই করে না; কিন্তু
সদর রাস্তা প্রাণহীন হয়ে পড়ে।
৩.
তবে কি পত্রিকার বাস্তব চিত্রগুলো ফুটে উঠছে রাস্তায় রাস্তায়। গৌতম জানালা
দিয়েই দুমড়েমুচড়ে যাওয়া বাস কিংবা ট্রাকগুলোর বডির চিৎকার যেন শুনতে পায়। এই
সময় আবার এফএম রেডিও জানায়- ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে এক সড়ক দুর্ঘটনায় দশ জনের মৃত্যু।
জীবন যেনো মেতেছে মৃত্যুর উৎসবে! এই উৎসবের মাঝেই চলে আহারক্রিয়ার মতো যাবতীয়
সম্ভোগের ইভেন্টগুলো। পাকুল্লার এক চা দোকানদার বহুদিন ধরেই বিক্রি করতেন গরুর
দুধের চা। বিশ্ব মন্দা তাঁকে আক্রান্ত করেছে কিনা জিজ্ঞেস করলে হয়তো ফ্যালফ্যাল
করে তাকিয়ে থাকবেন, কিন্তু এটা বুঝেন- মানুষ এখন ছয় টাকা দিয়ে দুধ-চা খেতে চাইবে
না। ফলে লেবুযুক্ত লাল চা মনে করিয়ে দেয় কোনো এক লাল পতাকার কথা যেখানে সমস্যা
নামক শব্দটি বিসর্জিত হলেও সমাধানের অনস্তিত্ব ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছিলো দিনে
দিনে। সব লাল একদিন মিশে গিয়েছিলো সূর্যাস্তের লালিমায়।
৪.
আমি, এই দিনপঞ্জির লেখক এবার উপর থেকে তাকাই গৌতমের দিকে। গাড়ির এসির বাতাসে
চুল উড়ছে না ঠিক, মুখের ওপর শীতল বাতাস শরীরের অনাবৃত অংশের রোমগুলোকে সটান করে
তুলছে। মুখের ওপর কিছু খেলা করছে কিনা দেখার জন্য তাকাতেই সামনে গাড়ির আয়না চোখে
পড়ে। পেছন থেকে আসা আরও অনেক বড় গাড়ি উত্তর দিয়ে যায়- শুধু একটি মুখ দেখার
জন্যই আয়না নয়; দেখ, সহস্র পদার্থ- হয়তো প্রতিপদার্থও- তোমাকে দেখছে তোমারই মুখ
দিয়ে তোমারই আয়নায়।
৫.
মাত্র চারশটা টাকা দিয়ে গৌতমের গাড়ি যমুনা নদীকে পদানত করেছে। নিচ দিয়ে কোটি
কোটি কিউসেক পানি সময়ের প্রবাহে গড়িয়ে চললেও উপরে পাষাণের হৃদয়বৃত্তির মতো জেগে
থাকা সেতু গৌতমের গাড়িটিকে সঙ্গী করেছে। নিচের পানি দুফোটা অশ্রু ফেলে- আমার
উপর গিয়ে গেলে, আমাকে ছুঁয়ে গেলে না?
গৌতম স্মিতমুখে হাসে- এ হলো আমার সূক্ষ্ম প্রতিশোধ।
যমুনা বুঝে না। তিরতির করে কয়েকটন পানি এগিয়ে দেন বঙ্গোপাসাগরের থলেতে। প্রতি
মুহূর্তে নিজের বক্ষের ধন উগরে দিয়ে দায়শোধ করছে যমুনা। বুকের পাষাণ নামে, নতুন
পাষাণের বসতি গড়ে। গৌতমের প্রতিশোধ শুনে বুক ভেদ করে জেড়ে ওঠা চরের কাশফুলগুলো
আন্দোলিত হয়। পরগাছাদের প্রতিশোধ ভয়ঙ্কর!
৬.
অসংখ্য বাঁক পেরিয়ে গৌতমের গাড়ি এগিয়ে যেতে থাকে। প্রতিটা বাঁকের কোণায় গৌতমের
মনে পড়ে আরও কিছু বাঁকের কথা, যেগুলোর কিছুটা সে দেখেছিলো, অনেকগুলোই দেখে নি।
ওই বাঁকগুলো পেরুতে পারলে কি জীবনটা থিতু হতো?
বগুড়া পার হওয়ার সময় ঝাঁকুনি না পেয়ে বিস্মিতই হয় গৌতম। এই মাত্র বছরখানেক আগেও
এদিক দিয়ে ঘুরে গেছে সে। তখন কতো চড়াই-উৎরাই ছিলো এই রাস্তার! বন্ধুর পথ পাড়ি
দিতে গিয়ে কতো মানুষ মারা গেছে! মাত্র একটা বছরেই কি চড়াই-উৎরাইয়ের জীবন মসৃণ
হতে পারে! একটা পিচঢালা কালো মিশমিশে পথ সঙ্গীসাথীমানুষদের জীবনটাকে পিচ্ছিল করে
তুলতে পারে?
অসংখ্য প্রশ্ন। উত্তর অনির্দিষ্ট। গাইবান্ধার পথ পেরুতে পেরুতে অনেক প্রশ্নের
উত্তর মেলে, অধিকাংশ প্রশ্ন নিজেই নিজের কাছে আড়াল তুলে রাখে।
৭.
ছটফটে সন্ধ্যেটায় আবার বগুড়া শহরে ফিরে আসে গৌতম। সাতমাথার মোড়ে বগুড়ার বিখ্যাত
দই খেতে খেতে ভাবে- ব্র্যান্ড জিনিসটা কতোই না শক্তিশালী! একবার শুধু শোয়া থেকে
উঠতে পারলেই হলো, কয়েক প্রজন্মের মানুষকে চিবড়ে খেতে পারবে! এই দই কি ঢাকাতে
নেই?
আছে হয়তো। কিন্তু সকালবেলা যে বগুড়া ডাক দিয়েছিলো গৌতমকে তাঁর যে কোনো খোঁজ নেই!
হারিয়ে গেলো? নাকি যত্ন করে ভুলেই গেলো?
পকেটফোনটা বের করে সুমিষ্ঠ কণ্ঠের 'আপনি ভুল নম্বরে ডায়াল করেছেন' কিংবা 'আপনার
ডায়ালকৃত নম্বরটি এই মুহূর্তে ব্যস্ত আছে' শুনবে বলে কানে লাগায়। কিন্তু
পরিবর্তে দীর্ঘায়িত টুট শব্দগুলো বুঝিয়ে দেয়- পৃথিবী আসলেই অধরা।
একটু রাতে বগুড়া আবার ডাকে গৌতমকে। উপলব্ধিজাত কথাগুলোয় গৌতম বুঝে- অপর পৃথিবী
আসলে এই পৃথিবীর মতোই মায়াময়, কিন্তু কষ্টসঞ্জাতরসে তার বসবাস।
রাত বাড়ে, গভীর হয়। আবারও এসি রুমে এসি ছেড়ে ল্যাপটপে গৌতম দিনপঞ্জি লিখতে বসে।
বিধাতা অলক্ষ্যে হাসেন- যে ঢাকাকে ছেড়ে গৌতম বেরিয়েছে তৃপ্তির উদ্দেশ্যে, সেই
ঢাকা আসলে বাস করে গৌতমের মাথায়।
বিধাতা হাসেন কি?
আজ রাতে বগুড়াতে গৌতমের ঘুম হবে না। শরীর জানান দিচ্ছে, কারো এক বিহ্বলতা তাকে
জাগিয়ে রেখে নিজে ঘুমুচ্ছে পুরো সত্ত্বার ভেতর।
পরের পাতা... |
|