সবচেয়ে বিপজ্জনক শিকার

(ধারাবাহিক রোমাঞ্চ গল্প)
মূলঃ রিচার্ড কনেল (১৯৩২)           অনুবাদঃ তিমুর
timursblog@yahoo.com

 

© লেখক


রিচার্ড কনেলের 'দ্য মোস্ট ডেঞ্জারাস গেম' কে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রোমাঞ্চ গল্পগুলোর একটা বলে ধরা হয় । সৈয়দ মুজতবা আলী থেকে কাজী আনোয়ার হোসেন অনেকই এর সুখপাঠ্য অণুবাদ করেছেন । নগন্য আমিও কেন এই মহাজনো পন্থায় গেলাম সে কৈফিয়ত না দিয়ে বলি গল্পটা আমার ভীষণ প্রিয় ।
গল্পের শুরুতে দেখি হুইটনি আর রেইন্সফোর্ড দুই বন্ধু ইয়টে করে ক্যারিবিয়ান সাগর ধরে ব্রাজিলের আমাজন জঙ্গলে জাগুয়ার শিকার করতে যাচ্ছে । হুইটনির সাথে রেইন্সফোর্ডের প্রাথমিক কথোপকথনে আমরা দেখি শিকার-শিকারী কিঞ্চিত খুচরা আলাপ করছে, আমরা আরো শুনি এখানে একটা অভিশ্প্ত দ্বীপ আছে আশপাশেই । সেটা পার হয়ে গেলেই নাবিকরা খুশি...বাকিটা আশা করি পাঠকরা জানতে পারবেন ।



'সামনে ডানদিকে একটা বড়সড় দ্বীপ আছে,' বলল হুইটনি । 'দ্বীপটা বেশ রহস্যময় ।'

'কী নাম দ্বীপটার?' রেইন্সফোর্ডের প্রশ্ন ।

'পুরনো জাহাজী চার্টগুলোতে একে 'শিপট্র্যাপ আইল্যান্ড' বলা হয়েছে,' হুইটনির উত্তর । 'বেশ লাগসই নাম তাই না ?'

'দেখতে পাচ্ছি না,' ইয়টটাকে চেপে বসা সামনের উষ্ণ, আদর অন্ধকার ভেদ করে সামনে দেখার চেষ্টা করে বলল রেইন্সফোর্ড ।

'তোমার চোখ ভাল,' হাসল হুইটনি । 'আমি চারশো গজ দূরে শরতের বনে মুজ হরিণ ফেলে দিতে দেখেছি । কিন্তু তুমিও চাঁদহীন ক্যারিবিয়ান সাগরের অন্ধকার ভেদ করে চার মাইলের মতন দূরে দেখতে পাও না ।'

'চার গজও না ,' স্বীকার করল রেইন্সফোর্ড । 'উফ, একেবারে ভেজা কালো মখমলের মতন অন্ধকার ।'

'রিওতে আলোর কোন অভাব হবে না,' আশ্বাস দিল হুইটনি । 'আমরা কয়েকদিনের মধ্যেই পৌঁছে যাবো । আশা করি পার্ডি কোম্পানি থেকে জাগুয়ার মারা বন্দুকগুলো পৌঁছে গেছে । আমাজন নদীর উজানে চমৎকার শিকার হবে আমাদের ।'

'পৃথিবীর সেরা বিনোদন,' একমত হল রেইন্সফোর্ড ।

'শিকারীর জন্য,' সংশোধন করল হুইটনি । 'শিকারের জন্য নয় ।'

'বাজে কথা বোলো না হুইটনি,' বলল রেইন্সফোর্ড । 'তুমি একজন বড় শিকারী । একটা জাগুয়ারের কী রকম লাগল করবে সেটা নিয়ে কে মাথা ঘামাবে ?'

'হয়তো জাগুয়ার বোধ করবে সেটা,' হুইটনির পর্যবেক্ষণ ।

'ফুহ! ওদের চিন্তাশক্তিই নেই !'

'তাহলেও আমার মনে হয় ওদের একটা বোধশক্তি আছে । মৃত্যু আর ব্যথা সব প্রাণীই বোঝে ।'

'ননসেন্স,' হেসে উঠল রেইন্সফোর্ড । 'আসলে এই গরম আবহাওয়ায় মিইয়ে গেছ তুমি । বাস্তববাদী হও, দুনিয়াটা দুটো শ্রেণীতে বিভক্ত । শিকার আর শিকারী, ভাগ্যক্রমে তুমি আর আমি দ্বিতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত । তোমার কী মনে হয় আমরা দ্বীপটা ছাড়িয়ে এসেছি ?'

'এই আঁধারে আমি সঠিক বলতে পারছি না । আশা করি তাই ।'

'কেন?' রেইন্সফোর্ডের জিজ্ঞাসা ।

'জায়গাটার একটা নাম আছে । বদনাম ।'

'নরখাদকদের আবাস আছে?' রেইন্সফোর্ডের প্রশ্ন ।

'মনে হয় না । এমন কী নরখাদকরাও এমন বাজপড়া জায়গায় থাকতে চাইবে না । কিন্তু যে করেই হোক এর নাম নাবিকদের গল্পকথায় ঢুকে গেছে । তুমি দেখো নি আজকে আমাদের ক্রুরা কেমন নার্ভাস আচরণ করছে ?'

'হু, ব্যাপারটা বেশ অবাক করেছে আমাকে । এমন কী ক্যাপ্টেন নিলসেনও--'

'হ্যাঁ, এমন কী সেই কাঠখোট্টা দুঃসাহসী সুইডিশ বুড়োটাও, যে কিনা খোদ শয়তানের কাছে গিয়ে পাইপ ধরানোর আগুন চাইতে পারে সেও ঘাবড়েছে খানিকটা । ওর মাছের মত ভাবলেশহীন নীল চোখ জোড়ায় এমন দৃষ্টি দেখিনি কখনো । জিগ্যেস করে যেটুকু জানতে পারলাম 'এ জায়গার খুব বদনাম আছে স্যার ।' বলে খুব গম্ভীরভাবে আমাকে জিগ্যেস করল, 'আপনি কিছু টের পাচ্ছেন না স্যার?' যেন বাতাসটাই বিষাক্ত হয়ে উঠেছে । আমার কথা শুনে হেসো না, আমার সত্যি একটা গা শিরশির করা অনুভূতি হয়েছিল । এক ফোঁটা বাতাস বইছিলো না কোনখানে, সাগর একেবারে আয়নার মত শান্ত, আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম দ্বীপটার দিকে । আমি হঠাৎ আতংকিত বোধ করলাম ।'

'স্রেফ কল্পনা,' রায় দিল রেইন্সফোর্ড । 'একজন কুসংস্কারগ্রস্ত নাবিক, পুরো জাহাজটাকে পচিয়ে দিতে পারে ।'

'হতে পারে । তাহলেও বলব, নাবিকদের সাধারণত বিপদে পড়ার আগেই টের পায় । আমার কখনো কখনো মনে হয় যে অশুভ একটা ধরাছোঁয়া যায় এমন জিনিস, মানে শব্দ বা আলোর মতই এর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য আছে । একটা অশুভ জায়গা নিজের অস্তিত্বের কথা রীতিমত ব্রডকাস্ট করে যদি সেভাবে বলতে পারি । এ জায়গা থেকে বেরিয়ে আসছি বলে আমি খুশি ।'

'আমর ঘুম পায়নি,' বলল রেইন্সফোর্ড । 'আফটারডেকে বসে আরেকটা পাইপ টানব আমি ।'

'তাহলে গুডনাইট রেইন্সফোর্ড । ব্রেকফাস্টে দেখা হবে আবার ।'

'ঠিক, গুডনাইট হুইটনি ।'

ইয়টের এঞ্জিনের ভোঁতা শব্দ আর প্রপেলারের পানি কেটে এগোনোর শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ রেইন্সফোর্ডের কানে আসছে না । স্টিমার চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে মনের আনন্দে পাইপ ফুঁকছে রেইন্সফোর্ড । তন্দ্রায় বুঁজে আসছে তার চোখ । 'রাতটা এত অন্ধকার যে আমি চোখের পাতা খোলা রেখেই ঘুমাতে পারি,' আপন মনে বিড়বিড় করে বলল ও ।

হঠাৎ একটা শব্দে চমকে জেগে উঠল ও । ডানদিক থেকে এসেছে আওয়াজটা, ওর কান এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ, এসব ব্যাপারে ভুল হয় না আন্দাজে । আবার হল শব্দটা, অন্ধকারে কেউ পর পর তিনবার গুলি করেছে ।

এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে রেলিংএর কাছে গিয়ে দাঁড়াল তাজ্জব রেইন্সফোর্ড । অন্ধকার ভেদ করে কিছু দেখার চেষ্টা করছে ও, কিন্তু সেটা কম্বলের মধ্যে দিয়ে দেখার মতই অসম্ভব কাজ । রেলিংএর উপর উঠে গেল ও আরো ভাল করে দেখার জন্য । ওর মুখের পাইপটা জাহাজের একটা দড়িতে বাড়ি খেয়ে ছিটকে পড়ল মুখ থেকে । ওটাকে ধরার জন্য হাত বাড়াল, যখন ও বুঝল ভারসাম্য হারিয়েছে ও অস্ফুট একট আর্তচিৎকার বেরোল ওর মুখ থেকে । ক্যারিবিয়ান সাগরের তপ্ত পানিতে ওর মাথাটা ডুবে যেতেই চিৎকারটা থেমে গেল ।

ভুস করে পানির উপর ভেসে উঠে চিৎকার করতে চাইল রেইন্সফোর্ড । কিন্তু প্রোপেলার থেকে তোড়ে বেরিয়ে আসা পানি ওর মুখ বন্ধ করে দিল । নোনাপানিতে জ্বালা করছে গলা । দ্রুত ইয়টের অপসৃয়মান আলোর দিকে সাঁতরাতে শুরু করেছিল ও । কিন্তু পঞ্চাশ ফিট যাবার আগেই থেমে গেল ও । মাথা ঠান্ডা করে চিন্তা করছে, এমন নয় এই প্রথমবার একটা কঠিন, বিপদজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়েছে ও । হতে পারে ওর চিৎকার ইয়টের কেউ শুনছে, কিন্তু সে সম্ভাবনা খুবই কম । জামাকাপড় ছেড়ে শরীরের সমস্ত শক্তি জড় করে চিৎকার করল ও । কিন্তু ইয়টের আলো জোনাকির মত টিমটিমে হয়ে রাতের অন্ধকারে পুরো মিলিয়ে গেল ।

গুলির শব্দের কথা মনে পড়ল রেইন্সফোর্ডের । শব্দটা ডানদিক থেকে এসেছিল, ঘুরে সেদিকে সাঁতরাতে শুরু করল ও । ধীরে ধীরে, শক্তি বাঁচিয়ে বাহু বিক্ষেপ করছে ও । মনে হল, অনন্তকালের জন্য সাগরের বিরুদ্ধে যুঝছে ও । স্ট্রোক গুনতে শুরু করল ও অবশেষে, খুব বেশী হলে আর শ'খানেক বারের মত হাত নাড়তে পারবে ও, তারপর--

শব্দটা শুনতে পেল রেইন্সফোর্ড । অন্ধকার থেকে আসছে কোন তীব্র যন্ত্রণাদীর্ণ আতংকিত প্রাণীর তীক্ষ্ণ চিৎকার ।

জানোয়ার ঠিক কী রকম বুঝতে পারল না রেইন্সফোর্ড । সে চেষ্টাও করেনি ও অবশ্য, নতুন উদ্যমে সাঁতরাতে শুরু করেছ ও, তীর কাছেই আছে বোঝা যাচ্ছে । আবার শব্দটা হল, কিন্তু মাঝপথে কেটে গেল তা আরেকটা তীক্ষ্ণ, সংক্ষিপ্ত শব্দে ।

'পিস্তলের আওয়াজ,' সাঁতরাতে সাঁতরাতে বিড়বিড় করল রেইন্সফোর্ড ।
 

দশ মিনিট প্রাণপণে সাঁতরানোর পরে শব্দটা পেল রেইন্সফোর্ড--পাথুরে তীরে সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ার বহু প্রতীক্ষিত আওয়াজ । দেখার আগেই প্রায় তীরে পৌঁছে গেছে ও । সাগর আরেকটু অশান্ত হলে ঢেউএর ধাক্কায় একেবারে থেঁতলে যেত ওর দেহ । শেষ শক্তিটুকু খরচ করে হাঁচড়ে পাঁচড়ে সৈকতে নিজেকে টেনে তুলল ও । মাথার উপর অন্ধকারে পাথুরে শৈলশিরা দাঁড়িয়ে আছে । হামাগুঁড়ি দিয়ে একটা সমতল জায়গায় নিজেকে টেনে তুলল ও । শৈলশিরার একেবারে নীচের থেকেই ঘন জঙ্গল শুরু হয়েছে । সেখানে ঠিক কোন ধরনের বিপদ লুকিয়ে আছে সেটা নিয়ে রেইন্সফোর্ড মাথা ঘামালো না । আপাততঃ সাগরের ডুবে মরা থেকে রেহাই পেয়েছে ও । জঙ্গলের ধারে জীবনের সবচেয়ে গভীর ঘুমে ডুবে গেল ও ।

যখন ঘুম ভাঙ্গলো, তখন আকাশে সুর্যের অবস্থান থেকে বুঝল বিকেল গড়িয়ে গেছে । ঘুম দিয়ে তরতাজা বোধ করছে সে, পেটের ভিতর চনমনে খিদে ঠোকরাচ্ছে ।

'যেখানেই পিস্তলের গুলি সেখানেই মানুষ; আর যেখানেই মানুষ, সেখানেই খাবার,' ভাবল রেইন্সফোর্ড । কিন্তু ঠিক কোন ধরনের মানুষ এই বিরান দ্বীপে বাস করে? একদম নিশ্ছিদ্র জঙ্গলে ঢেকে আছে সমস্ত উপকুল । ঝোপঝাড়ের জটলার মধ্যে দিয়ে পথ চলার কোন রাস্তা খুঁজে পেল না ও । উপকুল ধরে পথ চলাই সবচেয়ে সুবিধাজনক । ও যেখানে প্রথম উঠছিল সেখানে গিয়ে থমকে গেল ।

কোন একট প্রাণী--আলামত দেখে বোঝা যায় বেশ বড় প্রাণী-- ঝোপের নীচে ধ্বস্তাধ্বস্তি করেছে । আগাছা, শ্যাওলা উঠে গেছে জায়গায় জায়গায়, খানিকটা জায়গা রক্তে লাল হয়ে গেছে । একটা ছোট্ট চকচকে জিনিস চোখে পড়াতে ও তুলের নিল ওটা । জিনিসটা একটা কার্তুজের খোসা ।

'পয়েন্ট টু টু, গুলি,' আপন মনে বলল রেইন্সফোর্ড । 'ব্যাপারটা অদ্ভুত, দেখে শুনে মনে হচ্ছে জানোয়ারটা বেশ বড়ই ছিল । এত ছোট বোরের অস্ত্র দিয়ে সে এটাকে মোকাবিলা করেছে, শিকারীর নার্ভ আছে বলতে হবে । জানোয়ারটা যে লড়াই করেছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে, আমার মনে হব প্রথম যে তিনটা গুলির শব্দ শুনেছিলাম তা আসলে শিকারীর প্রথম গুলিবর্ষণ, তারপরে সে জন্তুটাকে তাড়িয়ে এখানে এনে শেষ গুলিতে খতম করেছে ।'

ভাল করে মাটি পরীক্ষা করে যা খুঁজছিল পেয়ে গেল সে--একজোড়া হান্টিং বুটের ছাপ । শৈলশিরার প্রান্ত ধরে সে যেদিকে যাচ্ছে, বুটের ছাপও সেদিকে গেছে । আগ্রহের সাথে এগিয়ে চলল রেইন্সফোর্ড, মাঝে পচা গাছের গুঁড়িতে বা আলগা পাথরে হড়কে যাচ্ছে পা, কিন্তু চলার বিরাম নেই ।

সাগর আর অরন্যের উপর আঁধারের চাঁদোয়া যখন নেমে আসছে খন রেইন্সফোর্ড আলো দেখতে পেল । সৈকতের একটা বাঁক ঘুরতেই এতগুলো আলো চোখে পড়ল যে, তার মনে হল যেন একটা গ্রামে এসেছে । কিন্তু সামনে আগে বাড়তেই অবাক বিস্ময়ে সে দেখল সমস্ত আলোই একট প্রকান্ড দালান থেকে আসছে--একটা বিশাল প্রাসাদোপম বাড়ি, মাথায় বসানো টাওয়ারগুলো অন্ধকার আকাশ ছুঁতে চাইছে । অন্ধকারে চোখে পড়ল দালানটার আবছায়া রেখা, একটা শৈলশিরার মাথায় বসানো প্রাসাদটা, তিনদিক থেকে খাড়া পাহাড় নেমে গেছে সাগর পর্যন্ত যেখানে ক্ষুধার্ত ঢেউগুলো ক্লিফের গোড়া লেহন করছে ।

'মরিচীকা,' ভাবল রেইন্সফোর্ড । কিন্তু যখন লোহার তীক্ষ্ণ শলা বসানো গেটটা খুলল, দেখল ব্যাপারটা কোন দৃষ্টি বিভ্রম নয় । পাথরে বাঁধানো সিঁড়িটা আসলেই বাস্তব, প্রকান্ড সিংহ দরজায় বসানো একটা দাঁত বের করা ড্রাগনের মাথা আকৃতির নকারটা আসলেই আছে । কিন্তু গোটা জায়গাটার মধ্যেই একটা অলীক কুহকের ছায়া খেলা করছে ।

নকারটা তুলতেই কিঁচকিঁচ করে শব্দ হলো, যেন এটা কোনদিন ব্যবহার করেনি কেউ । নকারটা ছেড়ে দিতেই এর বিকট শব্দে নিজেই চমকে উঠল রেইন্সফোর্ড । মনে হল ভিতরে পায়ের আওয়াজ শোনা গেল, কিন্তু দরজাটা বন্ধ রইল । আবার নকারটা তুলে আওয়াজ করল রেইন্সফোর্ড । দরজাটা এবার এত দ্রুত খুলে গেল যেন পাল্লাটা স্প্রিং লাগানো--ঘরের উজ্জল সোনালী আলোয়ে চোখ ধাঁধিয়ে গেল রেইন্সফোর্ডের । প্রথম রেইন্সফোর্ড জিনিসটা সে দেখল সেটা হচ্ছে তার দেখা সবচেয়ে বিশালদেহী মানুষ--দৈত্যের মতন লোকটার দাড়ি প্রায় কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে । ওর হাতে একটা লম্বা নলওয়ালা রিভলভার, সেটা সে সরাসরি রেইন্সফোর্ডের হৃৎপিন্ড বরাবর তাক করে রেখেছে ।

চুলদাড়ির জঙ্গল থেকে দুটো কুঁতকুঁতে ক্ষুদে চোখ রেইন্সফোর্ডকে দেখছে ।

'ঘাবড়ে যেও না,' মোলায়েম হাসি মুখে টেনে বলল রেইন্সফোর্ড । 'আমি কোন ডাকাত নই । আমি ইয়ট থেকে পানিতে পড়ে গেছি । আমি নিউ ইয়র্কের স্যাংগার রেইন্সফোর্ড ।'

লোকটার চোখের রক্ত পানি করা চাহনি বিন্দুমাত্র পাল্টাল না । রিভলভার ধরা হাতটা যেন পাথর কুঁদে বের করা মূর্তির হাত । রেইন্সফোর্ডের কথা যে বুঝেছে এমন কোন আলামতও পাওয়া গেল না । আস্ত্রাখান উলের বর্ডার দেয়া কালো রঙের ইউনিফর্ম পড়ে আছে দৈত্যটা ।

'আমি নিউ ইয়র্ক শহরের স্যাংগার রেইন্সফোর্ড, আমি ইয়ট থেকে পড়ে গেছি,' আবার শুরু করলো রেইন্সফোর্ড । 'আমি খুব ক্ষুধার্ত ।'

উত্তরে রিভালভারের হ্যামারটা তুলে দিল লোকটা । রেইন্সফোর্ড দেখল লোকটার অন্য হাতটা স্যালুটের ভঙ্গিতে কপালে উঠে গেল । তারপরের মেঝেতে বুট ঠুকে এটেনশন হয়ে দাঁড়ালো ও । চওড়া মার্বেলের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে সান্ধ্য পোশাক পরনে, ঋজু, মেদহীন একজন মানুষ । রেইন্সফোর্ডের দিকে এগিয়ে হাত বাড়িয়ে ধরলেন তিনি ।

নিঁখুত, মার্জিত এক্সেন্টে ইংরেজিতে বললেন তিনি, 'বিখ্যাত শিকারী মি. স্যাংগার রেইন্সফোর্ডকে আমার বাড়িতে স্বাগত জানাতে সন্মানিত বোধ করছি আমি ।'

স্বয়ংচালিতের মত লোকটার সাথে হ্যান্ডশেক করল রেইন্সফোর্ড ।

'তিব্বতে আপনার তুষার চিতা শিকারের বইটা পড়েছি আমি,' ব্যাখ্যা করলেন লোকটা । 'আমি জেনারেল জারফ ।'

রেইন্সফোর্ডের প্রথম চিন্তাটা হল লোকটা অত্যন্ত সুপুরুষ । দ্বিতীয় চিন্তাটা হল, কোথায় যেন একটা অস্বাভাবিকতা আছে লোকটার চেহারার মধ্যে । লোকটা মধ্যবয়স ছাড়িয়ে গেছে, ওঁর চুল রাতের ধবধবে শাদা, কিন্তু ভুঁরু আর চোখা মিলিটারি গোঁফ রাতের অন্ধকারের মতই মিশকালো । উঁচু গালের হাড়, ধারাল নাক আর কাটা কাটা মুখায়ব দেখে বোঝা যায় এ লোক হুকুম দিতে অভ্যস্ত, এ চেহারা কোন নীল রক্তের মানুষের । উর্দি পরা দৈত্যকে একটা ইঙ্গিত করতেই যে তার পিস্তলটা সরিয়ে, স্যালুট ঠুকে চলে গেল ।

'ইভান সাংঘাতিক শক্তিশালী মানুষ,' মন্তব্য করলেন জেনারেল । 'কিন্তু দুঃখের বিষয়ে ও কানেও শোনে না, কথাও বলতে পারে না । একজন সহজ সরল মানুষ, কিন্তু আমি দুঃখিত ওর জাতের বেশিরভাগের মতই একটু বুনো টাইপের ।'

'ও কী রাশিয়ান?' রেইন্সফোর্ডের প্রশ্ন ।

'তা বলা যায়, ও কসাক,' লাল ঠোঁট আর চোখা দাঁত বের করে হাসলেন জেনারেল । 'আমিও তাই ।'

'কিন্তু আমরা এখানে কথা বলে সময় নষ্ট করব না,' বললেন জারফ । 'আপনার খাবার, কাপড় আর বিশ্রাম প্রয়োজন । সে সব পাবেন আপনি এখানে । এটা খুব শান্তিপূর্ণ জায়গা ।'

ইভান আবার এল । জেনারেল কিছু বললেন তাকে, মুখ নড়ল কিন্তু শব্দ বের হল না ।

'ওর পিছু পিছু যান মি. রেইন্সফোর্ড । 'আমি ডিনার করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আপনার জন্য অপেক্ষা করব । আশা করি আমার কাপড় আপনার গায়ে ফিট হবে ।'

নিঃশব্দ দৈত্যটার পিছু পিছু রেইন্সফোর্ড একটা মস্ত, উঁচু ছাতওয়ালা, বেডরুমে পৌঁছালো । সেখানকার চাঁদোয়া লাগানো প্রকান্ড পালংকটাতে অনায়াসে ছয়জন লোক আরাম করে ঘুমাতে পারে । ইভান একটা ইভনিং স্যুট বিছিয়ে রাখল । রেইন্সফোর্ড খেয়াল করল কাপড়টা লন্ডনের যে দর্জি বানিয়েছে তারা সাধারনত ডিউক পদমর্যাদার নীচে কারো কাপড় কাটে না ।

যে ডাইনিং রুমটাতে ইভান ওকে নিয়ে এল সেটা অনেকভাবেই চমকপ্রদ । একধরনের মধ্যযুগীয় জৌলুস আছে তাতে; এর উঁচু ছাত, ওককাঠের প্যানেল, রিফেক্টরি টেবিল যাতে দু'কুড়ি মানুষ অনায়াসে খেতে পারে, সামন্ত যুগের অহমিকা প্রকাশ পাচ্ছে । দেয়ালে অসংখ্য শিকার করা প্রাণীর চামড়া আর মাথা ঝোলানো--সিংহ, বাঘ, হাতি, মুজ হরিণ, ভালুক । এতো বড় বড় বা এর থেকে এত চমৎকার সব ট্রফি রেইন্সফোর্ড আগে কখনো দেখেনি । প্রকান্ড টেবিলটার একপ্রান্তে জেনারেল একা বসে আছেন ।

'একটা ককটেল নিন আপনি,' বললেন জেনারেল । ককটেলটা ছিল চমৎকার, আর টেবিলের সাজসজ্জাও--লিনেন, ক্রিস্টাল, চিনামাটি আর রুপার বাসনকোসন; একেবারে নিঁখুত।

ওরা বর্শ নামের লাল, সুস্বাদু স্যুপ খাচ্ছে যা রুশদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় । কিছুটা ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে জেনারেল বললেন, 'আমরা সভ্যতার সব সুযোগ সুবিধা রক্ষা করার চেষ্টা করি । যদি কোন ত্রুটি হয়ে থাকে তবে নিজগুনে ক্ষমা করবেন । আপনার কী মনে হয় শ্যাম্পেনটা তার দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রায় তার স্বাদ হারিয়েছে?'

'একেবারেই না,' জোরগলায় বলল রেইন্সফোর্ড । জেনারেলকে চমৎকার বিবেচনাশীল গৃহকর্তা হিসেবে দেখছে ও, জেনারেলের রুচিও আন্তর্জাতিক মানের । কিন্তু জেনারেলের একটা ছোট্ট ব্যাপারে খটকা লাগছে তার মনে । যতবারই সে প্লেট থেকে চোখ তুলে চাইছে ততবারই দেখছে, জেনারেল চোখ সরু করে রেইন্সফোর্ডকে মাপছেন ।

'আপনি বোধহয় আবাক হয়েছেন যে আমি আপনার নাম জানি,' মুখ খুললেন জেনারেল । 'আসলে আমি রাশিয়ান, ইংরেজি আর ফরাসীতে ছাপা সমস্ত শিকারের বই পড়ি । আমার জীবনে মাত্র একটাই শখ আছে মি. রেইন্সফোর্ড, আর সেটা হচ্ছে শিকার ।'

'দেয়ালে চমৎকার কিছু মাথা দেখতে পাচ্ছি আমি ,' একটা সুস্বাদু ফিলো মিনিও চাখতে চাখতে বলল রেইন্সফোর্ড । 'ওরকম বিশাল কেপ বাফেলো আমি কখনো দেখিনি ।'

'ওহ ওটা, একটা রীতিমত দৈত্য ।'

'মোষটা কী আপনার দিকে তেড়ে এসেছিল?'

'একটা গাছের উপর আছড়ে ফেলেছিল আমাকে,' বললেন জেনারেল । 'আমার খুলি ফেটে গেছিল ধাক্কায়, কিন্তু শেষমেষ জানোয়ারটাকে আমি ঘায়েল করতে পেরেছি ।

'আমি সবসময়েই ভেবেছি,' বলল রেইনস্ফোর্ড । 'শিকার করার জন্য কেপ বাফেলো হচ্ছে সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রাণী ।'

একমুহূর্ত কোন উত্তর দিলেন না জেনারেল । সেই লাল-ঠোঁট হাসিটা হাসছেন তিনি । তারপর ধীরে ধীরে বললেন তিনি, 'না স্যার । কেপ বাফেলো সবচেয়ে বিপজ্জনক শিকার নয় ।' ওয়াইনে চুমুক দিলেন তিনি, 'এখানে, মানে আমার এই দ্বীপে আমি আরো বিপজ্জনক প্রাণী শিকার করে থাকি ।'

অবাক হল রেইন্সফোর্ড । 'এখানে বড় কোন শিকারের প্রাণী আছে না কি?'

মাথা নাড়লেন জেনারেল । 'সবচেয়ে বড় ।'

'সত্যি?'

'আসলে সত্যি বলতে কী প্রাণীটা এখানকার নয় । এটা আমাকে বাইরে থেকে আমদানী করতে হয় ।'

'কী জানোয়ার আপনি আমদানী করেন জেনারেল? বাঘ?'

হাসলেন জেনারেল । 'না, বাঘ শিকার আমার কাছে, তার আকর্ষণ হারিয়েছে কয়েক বছর আগেই । বাঘ শিকারের সব সম্ভাবনা আমি শেষ করে ফেলেছি । আমার কাছে বাঘ শিকারে আর কোন থ্রিল নেই । কোন সত্যিকারের বিপদ নেই । আমি, মি. রেইন্সফোর্ড; আমি কেবল বিপদের স্বাদ নেয়ার জন্যই বেঁচে আছি ।

পকেট থেকে একটা সোনার সিগারেট কেস বের করে তা থেকে একটা রুপালী প্রান্ত লাগানো কালো সিগারেট বারিয়ে ধরলেন জেনারেল । ধূপের মত একটা সুগন্ধী সে সিগারেটে ।

'চমৎকার জমবে আমাদের শিকার,' বললেন জেনারেল । 'আপনার সঙ্গ পেলে আমার খুবই ভাল লাগবে ।'

'কিন্তু শিকারটা কী ?'-- শুরু করেছিল রেইন্সফোর্ড ।

'আমি বলব আপনাকে,' বললেন জেনারেল । 'আপনি চমৎকৃত হবেন তাতে কোন কোন সন্দেহ নেই । যথাসম্ভব বিনয়ের সাথেই বলছি, আমি একট একেবার নতুন জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেছি । আরেক গ্লাস পোর্ট ঢালতে পারি আপনার জন্য ?'

'থ্যাংক ইউ জেনারেল ।'

দুটো গ্লাসই ভরলেন জেনারেল । 'ঈশ্বর কিছু মানুষকে কবি, কিছু মানুষকে রাজা, কিছূ মানুষকে ভিখারি করে বানিয়েছেন, আর আমাকে তিনি বানিয়েছেন শিকারী করে । আমার বাবা বলতেন, আমার হাত একেবারে ট্রিগারের জন্য তৈরি করা । উনি খুব ধনী এবং খুব শিকার পাগল লোক ছিলেন, ক্রিমিয়াতে প্রায় আড়াই লাখ একর জমি ছিল তাঁর ।

আমার যখন মাত্র পাঁচ বছর বয়স, তখন চড়ুই পাখি শিকারের জন্য মস্কো থেকে আমার উপযোগী ছোট্ট একটা বন্দুক বানিয়ে আনেন তিনি । বন্দুকটা দিয়ে যখন আমি বাবার কিছু প্রাইজ পাওয়া তিতিরকে গুলি করে মেরে ফেলি তখন একটুও রাগ না করে বাবা আমার নিশানার প্রশংসা করেন । দশ বছর বয়সে আমি ককেশাসে আমার প্রথম ভালুকটা মারি । আমার গোটা জীবনটাই একটা মস্ত বড় শিকার অভিযান বলতে পারেন ।

সেনাবাহিনীতে যোগ দেই, কারন অভিজাত ঘরের ছেলে হিসেবে সেরকম কোন ক্যারিয়ার প্রত্যাশা করা হত আমার কাছে । ওখানে একটা কসাক ঘোসওয়ার ডিভিশনের কমান্ড এসে পড়ে । কিন্তু সবসময়ে আমার আসল আগ্রহ ছিল শিকারে। আমি সমস্ত ধরনের জানোয়ার পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে শিকার করেছি । আমি জীবনে কত প্রাণী মেরেছি তার হিসাব দেয়া অস্ম্ভব ব্যাপার ।'

সিগারেটে টান দিলেন জেনারেল ।

'রাশিয়াতে বিপর্যয় ঘটার পরে আমি দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেই, জারের একজন অফিসার হিসেবে দেশে থাকাটা একেবারেই নির্বুদ্ধিতার কাজ হত । বেশিরভাগ অভিজাত রাশিয়ান সর্বস্বান্ত হয়েছিল । কিন্তু আমি সৌভাগ্যবশত আমেরিকার কোম্পানির শেয়ার কিনে রেখে ছিলাম । অতএব আমাকে মন্টি কার্লোতে কোন চায়ের দোকান বা প্যারিসে ট্যাক্সি চালাতে হয় নি ।

স্বাভাবিকভাবেই আমি শিকার চালিয়ে যাই--আপনাদে দেশে গ্রিজলি ভালুক, গঙ্গা নদীতে কুমীর, পূর্ব আফ্রিকাতে গন্ডার । আফ্রিকাতে থাকার সময়েই কেপ বাফেলোর গুঁতো খেয়ে ছ'মাস বিছানায় পড়ে থাকতে হয় । সুস্থ হয়ে উঠে আমাজন অববাহিকায় জাগুয়ার শিকার করতে শুরু করি, আমি শুনেছিলাম যে ওরা নাকি খুব ধূর্ত হয়, দুঃখের বিষয়ে যে ব্যাপার তা নয়,' দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কসাক । আসলে ওরা শক্তিশালী রাইফেলধারী বুদ্ধিমান কোন শিকারীর সাথে টিকতেই পারবে না ।

প্রচন্ড মাথাব্যথা নিয়ে একদিন শুয়ে আছি আমার তাঁবুতে, এমন সময় একটা ভয়ংকর চিন্তা এল । শিকার ব্যাপারটা পানসে হয়ে যাচ্ছে আমার কাছে ! আর শিকার মনে আছে আপনার, আমার জীবনের ধ্যানজ্ঞান । আমি শুনেছি অনেক আমেরিকান ব্যবসায়ী, ব্যবসা ছেড়ে দেয়ার পর পাগল হয়ে গেছে ।'

'হ্যাঁ, ব্যাপারটা অনেকটাই তাই,' সায় দিল রেইন্সফোর্ড ।

হাসলেন জেনারেল । 'পাগল হওয়ার কোন শখ ছিল না আমার,' বললেন তিনি । 'আমাকে একটা কিছু করতে হবে । এখ মি. রেইন্সফোর্ড, আমার মনটা সবসময়েই বিশ্লেষধর্মী, সন্দেহ নেই সেজন্যই আমি শিকারকে এত উপভোগ করেছি ।

'তাতে সন্দেহ নেই, জেনারেল জারফ ।'

'তো,' বলে চললেন জেনারেল । 'আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম কেন শিকারে আর উৎসাহ পাচ্ছি না আমি । আপনি আমার থেকে বয়সে ছোট মি. রেইন্সফোর্ড, এবং এত শিকার করেননি । কিন্তু উত্তরটা আশা করি আন্দাজ করতে পারছেন ।'

'কারনটা কী ?'

'কারন, খুব সহজভাবে বলতে গেলে শিকার ব্যাপারটাই আর আমার কাছে স্পোর্টিং নেই । খুব সহজ হয়ে গেছে ব্যাপারটা । আমি সবসময়েই শিকারকে ঘায়েল করতে পারছি । এবং কোন কিছুতে শতকরা একশো ভাগ নিখুত হওয়ার থেকে বেশি বিরক্তিকর ব্যাপার আর নেই ।'

আরেকটা সিগারেট ধরালেন জেনারেল ।

'আসলে কোন জানোয়ার আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে না । কোন বড়াই করছি না আমি, এটা একটা গাণিতিক নিশ্চয়তা । একটা জানোয়ার হচ্ছে চারটে পা আর তার অন্ধ প্রবৃত্তি । প্রবৃত্তি, বুদ্ধির সাথে কখনো পেরে উঠতে পারে না । যে মুহূর্তে এই সত্যটা যখন বুঝলাম সেটা অত্যন্ত ট্র্যাজিক মুহূর্ত ছিল আমার জন্য ।'

সামনে টেবিলের উপর ঝুঁকলো রেইন্সফোর্ড, তন্ময় হয়ে শুনছে সে জেনারেলের কথা ।

'আমার মাথায় তখন চিন্তাটা এল যে আমাকে ঠিক কী করতে হবে,' বলে চললেন জেনারেল ।

'আর সেটা কী ?'

জেনারেল হাসলেন, একজন মানুষ যে কি না সাফল্যের সাথে কোন বাধা পেরিয়েছে তার শান্ত হাসি । 'আমাকে একটা নতুন প্রাণী আবিষ্কার করতে হল ।

'একটা নতুন প্রাণী ? আপনি ঠাট্টা করছেন ?'

'একেবারেই না । আমি শিকারের ব্যাপারে কখনো ঠাট্টা করি না । আমার একটা নতুন প্রাণীর দরকার ছিল । আমি সেটা পেয়েছি । তাই আমি এ দ্বীপটা কিনে এই বাড়িটা বানিয়েছি । আর এখানেই আমি শিকার করে থাকি । এই দ্বীট এই উদ্দেশ্যের জন্য একদম নিঁখুত । অসংখ্য বুনোপথে ভরা জঙ্গল আছে এখানে, আরো আছে পাহাড়, জলাভূমি--'

'কিন্তু প্রাণীটা জেনারেল?'

'প্রাণীটা আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে রোমাঞ্চকর শিকারের অনুভূতি দেয় । এর সাথে দুনিয়ার আর কোন শিকারের তুলনাই হয় না । রোজই আমি শিকার করি । কোন একঘেয়েমি ধরে না, কারন এখন আমি এমন শিকার পেয়েছি যে আমার সাথে বুদ্ধিতে পাল্লা দিতে পারে ।'

রেইন্সফোর্ডের বিস্ময় তার মুখেই ফুটে উঠেছিল ।

'শিকারের জন্য আমার আদর্শ প্রাণী চাই,' ব্যাখ্যা করলেন জেনারেল । 'আদর্শ শিকারের বৈশিষ্ট্য কী ? প্রাণীটার অবশ্যই সাহস, ধূর্ততা থাকতে হবে এবং সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এটা আমার সাথে চিন্তায় পাল্লা দিতে পারবে ।'

'কোন জানোয়ারের চিন্তা করার ক্ষমতা নেই,' বাধা দিল রেইন্সফোর্ড ।

'প্রিয় বন্ধু,' বললেন জেনারেল । 'একটা প্রাণী আছে যেটা চিন্তা করে ।'

পরের পাতা...