নব আলোকে বাংলা

উত্তরাধিকার। অংগীকার। দূরদৃষ্টি।

Humaira Haroon, Suprateek Aroop Ghosh

সম্পাদক

সুপ্রতীক অরূপ ঘোষ

পাঠক পরিষদঃ শুভলগ্না শোয়ারা, চঞ্চল চৌধুরী

কৃতজ্ঞতাঃ  শিল্পী রুনা লায়লা, জেমস

Nuaba Aloke Bangla

বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস স্মরণে...

 

সম্পাদকীয়


সেই সময়! গন্ডগোলের সময়! মুক্তিযুদ্ধের সময়! গোলমালের সময়! আরও কি কি নামে ডাকা হয় তাঁকে! তবুও তাঁর সঠিক নামটি আজও কেউ চিনে নিলনা! খুব আশ্চর্য লাগে ৩৯ বছরের এই চিরসংগ্রামী যুবকের নাম নিয়ে এত বিভ্রাট কেন? এই যুবক হল ‘স্বাধীনতা’!


বাংলাদেশের স্বাধীনতার নাম স্বাধীনতা কেন নয়! কেন নির্দ্বিধায় মানুষ তাঁকে তাঁর পরিচয় দেয়না আজও! জানিনা। তবে সময় এসেছে। বর্তমান প্রজন্মকে জেনে নিতে হবে সঠিক কি ঘটেছিল ১৯৭১ এর সেই দুর্যোগময় দিনগুলিতে যা চলেছিল দীর্ঘ সাড়ে নয় মাস ধরে! কেমন করে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক জীবন কাটত! কেন গন্ডগোলের সময় বলে স্বাধীনতা প্রসংগ এড়িয়ে যায় সাধারণ মানুষ!


বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সেদিন সব কিছু ত্যাগ করে অত্যাচারের শাসনের বিলুপ্তি চেয়েছিল! কেমন ছিল সেই আন্দোলনের চেহারাটা, স্কুল পড়ুয়া ছাত্র, ছাত্র তৈরীর কারিগর মাষ্টারমশাই, রোগ নিরাময়ী ডাক্তার ও আরও কত সাধারণ মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া সেদিন ‘মুক্তিযোদ্ধা’ নামটিকে আপন করে নিয়ে, প্রাণ সংশয় সত্ত্বেও দেশমাতৃকার বুক থেকে রাজাকার আর পশ্চিম পাকিস্তানী অত্যাচারী সেনার আগ্রাসী থাবাকে নির্মূল করে দিতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলে!


আজকের মিশর, লিবিয়া, ইয়েমেন বা বাহরিনের সঙ্গে সেদিনের বাংলাদেশের পরিস্থিতির কি কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যায়! পন্ডিতেরা অনেক কথা বলবেন! সাধারণ মানুষ কি বলেন সেটাই জানার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আজ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে নব আলোকে বাংলার এই সংক্ষিপ্ত সম্পাদকীয় লিখতে বসে এই সব প্রশ্ন নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। আমার বাংলাদেশী ভাই-বোনেদের কাছে একটি অনুরোধ রেখে এই অসমাপ্ত লেখা এখানেই থামাব – স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসটিকে জানুন। আগামী প্রজন্মের কাছে তাঁর সঠিক ছবিটি তুলে ধরুন। লিখুন নব আলোকে বাংলার পাতায় – যদি মন চায়... নব আলোকে বাংলা সবারে এই মর্মে আহবান জানায়...


মুক্তিযুদ্ধের বীর সৈনিকদের উদ্দেশে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম ও সংগ্রামী সালাম জানিয়ে বলি সবাই ভাল থাকুন...
 

আপনাদের সুপ্রতীক

 

২৫ শে মার্চ ২০১১,   ১১ই চৈত্র ১৪১৭

 

 

এবারের প্রকাশনা
 

স্বাধীনতা
সকাল রয়


স্বাধীনতা মানে মাথা
উঁচু করে বলা ,আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি
স্বাধীনতা মানে কৃষাণের ফসলের রোদমাখা সোনালী হাসি।
স্বাধীনতা মানে সব শহীদের জয় বাংলা স্লোগান
স্বাধীনতা মানে নব যৌবনের উদাত্ত
আহবান

স্বাধীনতা মানে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া আমার বাংলাদেশে
স্বাধীনতা মানে মৃত্যুঞ্জয়ী
হওয়া বিজয়ের হাসি হেসে।
 

***

 

 

স্বাধীনতার সংজ্ঞা কি?

রাতিফ আহমেদ রিজভী


রাস্তার এক পাশে ছিলো এক ছোট্ট শিশু,
অন্যপাশে আমি ,
ছোট্ট হাতে ছিলো তার ফুলের ঝুড়ি,
রুগ্ন পায়ে বালি,
করুণ ছিলো তার চোখের ভাষা,
মিনতি ছিলো তার সবার তরে--
মিটিয়ে দাও আমার ক্ষুধার জ্বালা,
এই ফুলের ঝুড়ির দামটা দিয়ে।
ক্ষণিক পরে হঠাৎ দেখি,
সে ছোট্ট শিশু এগিয়ে আসে,
এগিয়ে এসে আমার কাছে,
বললো আমায় সজল চোখে--
মিটবে না আর ক্ষুধার জ্বালা,
তোমায় দিলাম ফুলের মালা,
বলে শিশুটা মুখ লুকালো,
দূরের পথে হারিয়ে গেলো,
আমি শুন্য চোখে তাকিয়েই ছিলাম,
শুন্য মনে ভেবেই গেলাম--
হায়! স্বাধীন দেশের মাটির উপর
স্বাধীন নয় এই ছোট্ট শিশু,
হিংস্র ক্ষুধা তার কোমল পায়ে,
যখন জীবন-রণের শিকল পরায়,
ভয়াল হৃদয়ে প্রশ্ন জাগে--
দেশ স্বাধীনের সংজ্ঞা কোথায়?
 

***

 

স্মৃতি সততই সুখের নয়
চঞ্চল জামান


‘বালক বয়স’ ক’বছর বয়স থেকে শুরু হয় যেন? ছ’ সাত বছর? আমার তখন ছ’ সাত বছরই বয়স। ১৯৭১ সালে শত্রুর বোমা বারুদে খুন হলো প্রায় ৩ মিলিয়ন অমূল্য প্রাণ এবং সেই সাথে আমার নিজস্ব এবং আরো অনেকের বালক বয়স। বয়সের মৃত্যু হলো; সময়ের সাথে আমাদের বালক বয়স বেড়ে কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ কিছুই আর হলোনা। যুদ্ধের ট্রমা বুকে যেসব বালক বেঁচে রইলো অনন্যোপায় Zombi র মতো – আমি তাদেরই একজন।

আমাদের স্মৃতি সততই হৃদয় বিদারক। মনে পড়ে গরুর গাড়িতে বাড়ি ফেরা খোনোর শবদেহ। মনে পরে গড়াই নদীর জলে ভেসে গেছে শবের বন্যা, এ বালকের জানা হয় নি কি ছিলো তাদের নাম, কোথা ছিলো গ্রাম। ধর্ষিতা মেয়েটির মুখ আজও অবিকল মনে পড়ে। মনে পড়ে ‘খেলায় নিতে হবে’ এই অপরাধে শত্রু ক্যাম্পে কাটানো আমার কয়েক ঘন্টা। মনে পড়ে পিতামহের হাত ধরে নদী-ঘাট, মাঠে মাঠে পালিয়ে ফেরা নিশীদিন। মনে পড়ে বিরতিবিহীন একটানা অনাহার।

কে যেন কান্নার ফাঁকে বলে গেলো আনো ডাক্তারের ভাই খোনো খুন হয়ে গেছে পূর্ণিমার রাতে। মড়া আমি দেখেছি আগেও। তবে নিহত এই প্রথম। একগ্রাম মানুষ, মাথার উপর পাখিরা, পাশে বয়ে যাওয়া নদী -সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে থাকলো। আমরা দল বেঁধে দেখলাম একটি শবদেহ। অনেক প্রশ্নে হৃদয় ভারি হলো। তবু ফুটলো না মুখে একটি কথাও। নিজেই বুঝেছি এ সময় নীরবতার। আমার হাত ধরা পিতামহের মুঠি শক্ত। মুখ তুলে তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার প্রথম সমুদ্র দর্শন হলো – তিনি শুধু অস্ফুট বললেন ‘মুক্তিযুদ্ধ’।

আমার জীবনে মুক্তিযুদ্ধ এভাবেই শুরু হলো। তারপর ২৬৬ টি দিবসের ২৬৬ টি রজনীর দীর্ঘ, দীর্ঘতম পথটি শেষ হয়ে এলো, এলো না স্বাধীনতা। একদিন ২৬৬ টি নিশীদিনের দীর্ঘতম পথটি শেষও হলো, স্বাধীনতা এলো না তবুও। স্বাধীনতার কথাটা থাক। বিবেক বালক যা বলছিলে তাই বলো – তোমার সেই স্মৃতির কথা।

সূয্যি মামা তেঁতে ছিলো, গুমোট ছিলো হাওয়া, তাইতো যাওয়া বাড়ির পাশে সেই নদীতটে। একা আমি, একাই বটে, হেঁটে এসে নদীর পাশে দাঁড়াতেই মাছেদের ক্রন্দন শুনে চকিতে চমকাই -কারা যায় ঐ জলে ভেসে? কোথা থেকে আসা ঐ বিদেশী নিষ্প্রাণ দেহমন্ডলী আমাদের এই নদী নাম্নী গাঁ –এ? শিশু মাছটি কি তার মাকে তাই শুধোলো? এইরকম একটি দৃশ্যই মনে পড়ে। স্রোতে ভাসা মানুষের শব, যেদিকে তাকাই চোখ জ্বালা করে ওঠে। আজো ওঠে। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ কথা ক’টি মিথ্যে শুনায়।

বিবেক বালক এবার তবে সেই মেয়েটির কথা বলো। সে কি আজো আছে? নিশ্চয়ই আছে, থেকেছে এতকাল, থাকবে নির্ঘাত যতকাল আমিও আছি। খুলে মেলেই বলছি তবেঃ পশুর দল হল্লা শেষে যেই ফিরেছে, কানে কানে ফিসফিসিয়ে উচ্চ এবং অনুচ্চ স্বরে সারা গাঁ-এ রাষ্ট্র হলো নারকীয় সেই ঘটনা। রটনা নয়, নিরুংকুশ এক সত্যি দেখতে ঘনীভূত হলো হালকা পাতলা গ্রাম খানি কুমারী বিভা রাণীর উঠোনে। আমিও ছিলাম সেই ভীড়ের ভিতর নীল হয়ে আসা এক চিলতে হৃতপিন্ড। আর কারো নয় আমার চোখেই কি তবে একবার শুধু চোখ রেখেছিল কুমারী বিভা রাণী?

এটাও তবে থাকুক অসমাপ্ত – বড় রকম ব্যথা করে ওঠে বুক। বিবেক বালক খেলার ছলে বলবে নাকি সেই খেলাটি?

তবে তাই হোক, সেই ভীষণ খেলাটি ভীষণ ভাবেই মনে পড়ে, সবুজের প্রতি আমার ছিলো খুব টান। কাউকে সঙ্গে নেব, তাও নয়, একাকী হিংসুটে, বনে জঙ্গলে বেড়াতে খুব ভালো লাগতো। বনের ভেতর সহসা দেখি মুক্তিবাহিনী। কেটে রাখা কলাগাছে লুংগি জামা পরাচ্ছে, সামনে কাঠের তৈরি রাইফেল।‘আমাকে খেলায় নিতে হবে’ বললেই সহজে নেবে না তা আমার জানা। তাই ওত পেতে থাকি সুযোগের।মুক্তি সেনারা সরে যেতেই লাফিয়ে পড়ি। লাথি মেরে সরিয়ে দিই ফাঁদের এক কলাগাছ সৈনিককে। বুকে চেপে ধরি জোরে কাঠের রাইফেল। অদূরে কোথাও গুলি ছুড়লো, মুক্তি সেনারা। একটি মুহূর্ত যেন। তারপর শত্রু সেনাদের কোটি কোটি গুলি এসে বিঁধলো আমার কলাগাছ সহযোদ্ধাদের বুকে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে আছি, চিতকার শুনে চোখ খুলে দেখি শত্রু সেনারা ঘিরে ফেলেছে আমাকে। একজন আমাকে প্রায় টেনে হেঁচড়ে ওদের ভ্যানে তুলে নিলো। মুক্তিবাহিনীর কেউ আর গুলি ছুড়লো না।ওরা আমাকে দেখেছে বলেই বদলে নিয়েছিল প্ল্যান। শত্রুসেনাদের ভ্যান ওদের ক্যাম্পে ফিরে এলো।উত্তেজনায় বুকের ভেতরটা খুব কাঁপছে। এক অজানা কারণে আমার গায়ে একটি নখের আঁচড়ও পড়লো না।

সন্ধ্যে বেলায় ওদের এক বড় কর্তা জানালো বিচিত্র বিকৃত এক বাংলা ভাষায় যার অর্থ হয় আমার চাচা আমাকে নিতে এসেছে। চাচাকে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলাম। দুজন মিলে যখন বেরিয়ে যাবো ক্যাম্প থেকে তখন সে আরো একবার ডাকলো। আমরা দাঁড়িয়ে আছি। বুকের ভেতর অনিশ্চয়তা। বৃহদাকার গরিলাটি বললো, তোমার চাচার চুল খুব লম্বা, তার চুল কেটে দিও। আমরা আর দেরি করি নি। বাড়ি ফিরে আমার মুক্তিযোদ্ধা চাচা অনেক বকুনি দেবার ইচ্ছে বুকে চেপে শেষমেষ কিছুই বললেন না।

মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে এলো, স্বাধীনতা এলো না।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলো, স্বাধীনতা এলো না।


***

 

 

 

ইন্দিরার স্বপ্ন বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ

খালিল হাসান

এক চিলতে রোদ পর্দার আড়াল ভেদ করে কখন যে চোখ বিদ্ধ করেছে আমি জানি না। চোখ মেলে দেখি সুন্দর একটি সকাল। দিনটি আজ এত সুন্দর কেন? স্বাধীনতা দিবস বলেই হয়তো বা।

এক অনাবিল শান্তি আর আনন্দ এসে ভর করে মনের মাঝে যখন মনে পড়ে যায় ৭১ এর ১৬ ই ডিসেম্বর বিজয়ের আনন্দ মিছিলে অংশ নেবার কথা। আজও স্মৃতিপটে অম্লান ই মার্চের ভাষণ , ২৫ শে মার্চের কাল রাত্রির কথা। আজ ৪০ বছর পরও আমায় সেসব দিনের স্মৃতি অশ্রুসিক্ত করে তুলে। স্বাধীনতা দিবস এলেই স্মৃতি রোমন্থনে চলে যাই সেই পুরনো দিনগুলিতে। দেখেছি কত । সয়েছি শত। মনে রেখেছি প্রতিটি ঘটনা।

এই তো সেদিন...

অগাস্ট, ১৯৪৭

আমি তখন আর কতই বা, বিশ বছরের একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট। আমার মাতৃভূমি ভারত খন্ড বিখন্ড হল কত না ভাগে। সৃষ্টি হল ১৬০০ মাইল ব্যবধানে ওয়েস্ট পাকিস্তান আর ইস্ট বেঙ্গল, পরবর্তীতে ইস্ট পাকিস্তান। বিভাজন হল মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা বলে। না আছে সেখানে কোন ভাষার মিল, না আছে কোন সংস্কৃতির মিল। ক্ষমতার প্রতি লিপ্সা আর ধর্মের অজুহাত তৈরি করলো এ বিভক্তি। ক্ষমতা আর কর্তৃত্বের ভার ওয়েস্ট  পাকিস্তানের । ইস্ট পাকিস্তান শুধুই বঞ্চনার স্বীকার।  

২১ শে মার্চ, ১৯৪৮

একই ভাষাভাষীর অবস্থান ভারতের পশ্চিম বঙ্গ আর ইস্ট পাকিস্তানে। ভাষার মিলে প্রাণের মিল, যা ভাল লাগেনি ওয়েস্ট পাকিস্তানের। আর ১৯৪৭ এর পর ভারতের সাথে ওদের টানাপোড়নও অনেক। তাই মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষণা উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের অফিসিয়াল ভাষা।

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২

সকাল ১০ টা হবে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে হল থেকে বেরিয়ে সবাই জড়ো হলাম ঢাকা ইউনভার্সিটির চত্বরে।  পুলিশের বেষ্টনী আর তার মাঝে আমাদের প্রতিবাদ রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই। ছাত্রদের হস্টেলে গুলিবর্ষণ হলো। ছাত্রদের মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া জনমনে জন্ম দিল অসন্তোষ। শুরু হলো প্রতিবাদ, মিছিল।

১৯৫৬ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃত দেয়া হলো বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে। সেকশন ২১৪ অনুযায়ী

 ।।  214(1) The state language of Pakistan shall be Urdu and Bengali  ।।

১৯৭০

১৯৫৩ তে আমি ইস্ট পাকিস্তান আর্মিতে যোগদান করেছি চিকিতসক হিসেবে। মেডিসিনে স্পেশালাইজেশান শেষ করে পোস্টিং পেয়েছি ওয়েস্ট পাকিস্তানে। ১৯৫৩ থেকে ১৯৭০, এই ১৭ বছর চাকুরী জীবনে দেখেছি ইস্টের ওপর ওয়েস্টের ঘৃণা, তাচ্ছিল্য আর রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণ। সবচেয়ে অবাক হবার মতন স্মৃতি হলো  আওয়ামী লীগের সংখ্যা গরিষ্ঠ আসনে শেখ মুজিবের বিজয়কে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টোর প্রত্যাখান। পূর্ব পাকিস্তানের বিজয়ী প্রার্থীকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ঘটনাটি রূপ নিল প্রতিবাদে আন্দোলনে।

৩ রা মার্চ, ১৯৭১

প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ঢাকায় ভুট্টো আর  মুজিবের সাথে বৈঠক ব্যর্থতায় পর্যবাসিত হলো।

৭ই মার্চ, ১৯৭১

সোহরোয়ার্দী উদ্যানে বজ্রকন্ঠে উচ্চারিত হলো শেখ মুজিবের ভাষণ। ডাক দিলেন স্বাধীনতার। তাঁর কন্ঠের সেই আহবান আজও স্পষ্ট কানে ভাসে...

 ।। আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল ।।

।। রক্ত যখন দিতে শিখেছি, রক্ত আরো দিব এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ ।।

।। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ।।

 

২৫ শে মার্চর কাল রাত্রি, ১৯৭১

অপারেশান সার্চ লাইট নামে শুরু হলো বাঙ্গালী নিধন প্রক্রিয়া ২৫ শে মার্চ রাতে। ছাত্র হলগুলো ছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীদের টার্গেট। জ্বলেছে ঢাকা সারারাত, বিশেষ করে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলো। শেখ মুজিব অ্যারেস্ট হলেন, ঘোষণা দিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার।

 যুদ্ধ

পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে শুরু হলো গেরিলা ট্রেনিং। অস্ত্র, প্রশিক্ষণ আর সৈন্য সহযোগে শুরু হলো পাকিস্তান মিলিটারির মোকাবেলা। ভারতীয় সৈন্য, দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তৈরি করলো প্রচন্ড আক্রমণের পরিকল্পনা। এ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ৩ রা ডিসেম্বর দখলদার বাহিনী শুরু করলো অতর্কিতে বিমান হামলা, যার নাম ছিল অপারেশান ফোকাস। ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্ত বরাবর তাদের আক্রমণ সীমাবদ্ধ ছিলা না। পাক হানাদার সুপরিকল্পিত ভাবে বিমান হামলা চালালো পশ্চিমে ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স স্টেশানে আর পূর্বে মুক্তি বাহিনী ক্যাম্প লক্ষ্য করে পশ্চিমবঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর তাতক্ষণিক আদেশে ভারতীয় সৈন্য বাহিনী সমবেত হলো পুরোমাত্রায়, হানাদার বাহিনীকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে। প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে বললেন, India is at war with Pakistan. তাঁর এই কথাটি নিমেষে পৌঁছে গেল লক্ষ লক্ষ ভারতবাসীর কাছে। ভারত হতে সহস্রাধিক সৈন্য, টন টন গোলাবারুদ, অস্ত্রসামগ্রী স্থানান্তর সম্ভব হয়েছিল ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের হেলিকপ্টার যোগে। হঠাত চমকে দিয়েছিল পাকিস্তানিদেরকে তাদের বিরুদ্ধে এ আয়োজন ও আক্রমণ। ৬ দিনের মধ্যে ইন্ডিয়ান সৈন্যরা প্রবেশ করলো বাংলাদেশের একেবারে অভ্যন্তরে। দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণ আর মুক্তি বাহিনী ছিল সর্বক্ষণ তাদের পথনির্দেশক। তা না হলে এই নদী নালা, ঝোপ জংগল, জলাশয়ে ভরা বাংলার এতটা পথ মাত্র ৬ দিনে অতিক্রম করার অসাধ্য সাধন কি সম্ভব ছিল। সপ্তম দিনে রাওয়াল পিন্ডির হেডকোয়ার্টারে ছড়িয়ে পড়েছিল আতংক। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর যুদ্ধের ঘোষণার দিনই তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্ববৃহত যুদ্ধ জাহাজ INS Vikrant আন্দামান আর নিকোবোর দ্বীপপুঞ্জের উত্তর থেকে অগ্রসর হলো চট্টগ্রাম বন্দর অভিমুখে।

৪ঠা ডিসেম্বর, ১৯৭১

ভারতীয় ৮ টি Sea Hawk এর উড্ডয়ন। লক্ষ্যঃ কক্সেস বাজার। উদ্দেশ্যঃ হানাদার বাহিনীর অবস্থান ধ্বংস।    ইতিমধ্যে INS Vikrant আরো এগিয়ে এসেছে চটগ্রামের দিকে। এবার লক্ষ্যস্থল মংলা, খুলনা অঞ্চলে হানাদার বাহিনীর অবস্থান। জলে, স্থলে, আকাশ পথে প্রচন্ড বাধার সম্মুখীন হয়েছে হানাদার বাহিনী। স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ, যা পাকিস্তানে কমান্ডো ব্রিগেড নামে পরিচিত তারাও ইচ্ছেপূর্বক ক্ষতিসাধনের (স্যবটেজ) চতুরীতে এবার হেরে গেল মুক্তিবাহিনী আর মিত্র বাহিনীর ক্ষিপ্র মোকাবেলায়। পরাজয় মেনে নিল। ১৬ ই ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর হাতে চলে এলো ঢাকা। রমনা রেসকোর্স ময়দানে ভারতীয় সময় বিকেল ৪ টা ৩১ মিনিটে লে. জে. নিয়াজী আত্মসমর্পণ করলেন লে. জে. জাগজিৎ সিং অরোরার বাহিনীর কাছে। বাংলাদেশের বিজয় হলো।

১৪ ই ডিসেম্বর, ১৯৭১

বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ

বিশ্বাসঘাতকদের সুপরিকল্পিত হত্যার আরো একটি নমুনা রয়েই গেল। জামাত-ই-ইসলামী এবং এদের আধা সামরিক বাহিনী আল বদর, আল সামশ তৈরী করলো কবি, সাহিত্যিক, প্রকৌশলী, চিকিতসক, শিক্ষকদের তালিকা। বিজয়ের দুই দিন আগে নির্মম ভাবে হত্যা করলো সকল বুদ্ধিজীবীদের।

শে মার্চ, ২০১১

আজ স্বাধীনতার ৪০ বছর। জেমসের কন্ঠের সেই কয়েকটি লাইন বার বার মনে পড়ছেঃ (গানের লিংক এখানে)

'তুমি মিশ্রিত লগ্ন মাধুরীর জলে ভেজা কবিতায়
আছো সরোয়ার্দী, শেরেবাংলা, ভাসানীর শেষ ইচ্ছায়
তুমি বঙ্গবন্ধুর রক্তে আগুন জ্বলা জ্বালাময়ী সে ভাষণ

তুমি ধানের শীষে মিশে থাকা শহীদ জিয়ার স্বপন,
তুমি ছেলে হারা মা জাহানারা মামের একাত্তরের দিনগুলি
তুমি জসীম উদ্দিনের নকশী কাঁথার মাঠ, মুঠো মুঠো সোনার ধূলি,
তুমি তিরিশ কিংবা তার অধিক লাখো শহীদের প্রান
তুমি শহীদ মিনারে প্রভাত ফেরীর, ভাই হারা একুশের গান,

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি

জন্ম দিয়েছ তুমি মাগো, তাই তোমায় ভালবাসি।'


আমি আজ জীবন সায়াহ্নে উপনীত। দেখেছি আমার অখন্ড ভারতকে খন্ডিত হতে, দেখেছি ধর্মের কারণে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হতে। দেখেছি এই ধর্মের কারণটি ভুলে গিয়ে ভাষাগত আর সংস্কৃতিগত ব্যবধানের জন্য সৃষ্ট বৈষম্য, জাতিগত আক্রোশ, আক্রমন, ধ্বংস আর বীভতস হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে মানবতার অপমান হতে। বিনিময়ে দিয়েছি অনেক রক্ত। একসাগর রক্ত নাকি তারও বেশী? এই ত্যাগ, এই যন্ত্রণা, এই বেদনা আর স্বজন হারানোর কষ্ট আমি আজ মাপতে চাই না। শুধু জানতে চাই এর শেষ কোথায়?

***

 

১৯৭১ এর মার্চ মাস
মোঃ আবদুল খালেক


ফেব্রুয়ারি – মার্চ মাস হচ্ছে বাঙ্গালীর আন্দোলনের মাস। এ সময়ে উত্তরী বায়ুর যবনিকা টেনে চলে আসে হু হু করে দখিনা বাতাস। গাছে গাছে নতুন পাতার নাচন। কৃষ্ণচূড়ার রক্তে রাঙানো অভিষিক্ত ফাগুন এবং সুর কোকিলের মধুর ডাক জানিয়ে দেয় বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। প্রকৃতির এ প্রভাব পৌনঃপুনিক ভাবে প্রভাবিত করে বাঙ্গালীদের মনপ্রাণ । উচ্ছ্বাস নিয়ে আসে তাদের চলনে, বলনে, ভংগীতে। প্রকৃতিই টেনে আনে বাঙ্গালীদের ঘরের বাইরে। ফেব্রুয়ারি–মার্চ মনে করিয়ে দেয় রক্তঝরার মাস, মায়ের ভাষায় কথা বলার মাস, জনসমুদ্রের মাস ও স্বধীনতার আনন্দে উপচে পড়া বন্যার মাস।

 

১৯৭১ সালের এই উচ্ছ্বাসের মাসে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক গাঁও গেরামের ছেলে, আমি একা চলছি শিক্ষায় উচ্চ ডিগ্রি নিতে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে। কেবল পা রেখেছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজার প্রথম সিঁড়িতে। ভাবতে গেলে একেবারে কম কথা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চাত্রীদের মন তখন নতুন আম্রমুকুল থেকে বিচ্ছুরিত মিষ্টি শিশিরের রসে পরিতৃপ্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের হাওয়ায় যুক্ত হয়েছে। বিভিন্ন আবাসিক হল সমূহের ছাত্র সংসদ নির্বাচনী তরংগের উপর আরেকটি উপ-তরংগ। অন্যদিকে চলছে ১৯৭১ এর পাকিস্তানের ইসলামাবাদ সরকারের বিরুদ্ধে বাঙ্গালী জনগণের ১১ দফা ও ৬ দফা দাবী আদায়ের রাজনৈতিক যুদ্ধ। দেশের আপামর জনসাধারণের সাথে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তরুণ ছাত্র ছাত্রীরাও অগ্রণী ভূমিকায় অংশীদার হয়ে, আন্দোলনের ধারাকে নিয়ে যাচ্ছিল সাফল্যের চূড়ায়। ১৯৭১ এর ফেব্রুয়ারি – মার্চ ছিল গণ আন্দোলনের ফুলে ফেঁপে উঠা বিস্ফোরণের একটি পূর্ব মুহূর্ত।
১৯৭১ এর মার্চে ততকালীন সরকারের বিরুদ্ধে গণজোয়ার এবং আন্দোলনের পূর্ব প্রস্তুতির জের ধরে সেবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল প্রকার ছাত্র সংসদ নির্বাচন স্থগিত হয়েছিল।


২রা মার্চ ১৯৭১ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্র ছাত্রীরা স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা ও মিছিলে যোগদান করে। সিদ্ধান্ত হয়েছিল ৩ রা মার্চ ১৯৭১ শহর অভিমুখী মিছিলে সবাই যোগদান করবে। ৩রা মার্চ সকাল ১০ টায় রাজশাহী শহরে যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবাদ মিছিল বের হলো তখন মিছিলের উপর পাক সেনা বাহিনীর গুলিবর্ষণে ১ জনের মৃত্যু সহ ৫/৬ জন আহত হয়েছিল। ফলে মিছিল ছত্রভংগ হয়ে যায়। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ফিরে আসি। তখন মিছিলের ডাক দেয়া হয়। বলা হয় আগামীকাল ৪ঠা মার্চ থেকে আন্দোলনের ধারাকে আরো জোরদার করে দাবী আদায়ের লক্ষ্যে সর্বোপরি ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া।

 

৩ রা মার্চ ১৯৭১, রাত সাড়ে দশটায় ছাত্র ক্যান্টিনে বসে কলিকাতা বেতারের সংবাদ পরিক্রমা শুনছিলাম, যা ছিল পূর্ব বাংলার সকলের কাছে অতি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। তখনকার দিনের পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ এবং তার মন্তব্যসহ প্রচারিত হতো এই অনুষ্ঠান। তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বাঙ্গালীদের কার্যক্রমের সংবাদ কলিকাতা বেতার থেকেই সঠিক ভাবে পাওয়া যেত। পরিক্রমা অনুষ্ঠানটি যখন শোনা শেষ তখন হলের বাইরে থেকে চিতকার ভেসে এলো – মিলিটারি আসছে, মিলিটারি, মিলিটারি। আমরা ভয়ে যে যার রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। আমি দৌড়ে তিনতলায় একটি রুমে ঢুকলাম। জানালা দিয়ে দেখলাম একটু দূরের রাস্তা দিয়ে কয়েকটা জীপ বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সামসুজ্জোহা হলের দিকে এগুচ্ছে। ঠিক ঐ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেশন অতিক্রম করছিল সাড়ে দশটার ট্রেন, যার শব্দটা এত অশ্রুতপূর্ব, ভয়ংকর হয়ে আমার কানে ও হৃদয়ে বিধঁছিল, মনে হচ্ছিল ট্রেন ভর্তি মিলিটারি, ছাত্র হলগুলির দিকে আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসছে। তাদের আক্রমণের লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্র ছাত্রী।


মিলিটারি গাড়ি বহর শহীদ সামসুজ্জোহা হলে গেটের কাছে কয়েকটা রুমের দরজা ভেঙ্গে অস্ত্র হাতে উর্দু ভাষায় চেঁচিয়ে ছাত্রদেরকে ভয় দেখিয়ে চলে গেল। তাদের বার্তার সারমর্ম ছিল, ‘যদি আগামী কালের ভিতর হল ত্যাগ না করা হয়–তবে সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে।’

৫ ই মার্চ হল ত্যাগ করে নিজ গন্তব্যে যাবার জন্য প্রস্তুত হলাম। বাড়ি পৌঁছালাম। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ যা সেদিন সম্প্রচার করা হয়নি তা রেডিওতে বাজিয়ে শোনানো হল পরের দিন ৮ই মার্চ সকাল আটটায়। ভাষণ শুনে আবেগে আপ্লুত হয়েছিলাম। মনোযোগ দিয়ে ও প্রাণ ভরে শুনলাম,  'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম – এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'  তাহলে আমরা কোথায় কোন বিস্ময়ের দিকে আগাচ্ছি?


৯ই মার্চ থেকে ২৪ শে মার্চ পর্যন্ত আমি রেডিওর খবর পুংখানুপুংখ রূপে শুনতাম। বিদেশীদের ঢাকা শহর ত্যাগ, পূর্ব বাংলার সমস্ত শহরে আন্দোলনের লেলিহান শিখার বিস্তার, জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিজয়ী আওয়ামী লীগের বৈঠক, বাংলাদেশ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট, সরকারি, বেসরকারি বাঙ্গালী কর্মচারীদের বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান, সর্বত্র জনগণের লাঠি ও মশাল মিছিল সমেত পূর্ব বাংলা ছিল বিস্ফোরণ মুখী একটি আনবিক বোমা। ভাবছিলাম এই প্রথম আওয়ামীলীগ পাকিস্তান জাতীয় সংসদে যাবে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবে একজন বাঙ্গালী, সকল দাবীদাওয়া পূরণ ইত্যাদি। রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ তখনও আমি পুরোপুরি বুঝে উঠিনি। ইয়াহিয়া বা জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঢাকা আগমন, শেখ মুজিবর রহমানের সাথে বৈঠক এবং পরিস্থিতির রাজনৈতিক সমাধানের দিকেই বেশী মনোযোগী ছিলাম। মনে হচ্ছিল হয়তো অচিরেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে এবং আবার আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে ফিরে যাব।
এ সময় আমি কল্পলোকে বিচরণ করে মার্চের বাসন্তী পূর্ণিমা রাতের সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়ে জীবনের প্রথম কবিতা লিখলাম। যেখানে একটি লাইন ছিল, ‘আধো শীত আধো গ্রীষ্ম এ পূর্ণিমা রাতে।’ তাই এখনও বসন্ত পূর্ণীমার রাত আমার স্মৃতিকে গভীরভাবে উষ্ণ করে তোলে।


২৬ শে মার্চ ১৯৭১


প্রতিদিনের মত সকালে রেডিও অন করেই শুনি ঢাকা বেতার থেকে একটি দেশাত্মবোধক গান, ‘পলাশ ডাকা, কোকিল ডাকা, আমার এ দেশ ভাইরে...’। শেষ হওয়ার পরও পুনঃ পুনঃ একই গান বাজছিল। দেশাত্মবোধক এ গানটিই বার বার শুনতে যদিও ভাল লাগছিল, তবুও দেশে কিছু একটা অঘটন ঘটছে বলে মনে হচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর কোনরকম ঘোষণা ছাড়া বেতার কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেল। গত দুই সপ্তাহ যাবত ঢাকা বেতার পূর্ব বাংলার আন্দোলনের সমস্ত ঘটনা প্রবাহ সবিস্তারে সম্প্রচার করছিল। আন্দোলনের যাবতীয় খবর আমরা ঢাকা বেতার থেকেই শুনছিলাম। গতকাল রাত্রের খবর ছিল চট্টগ্রামে মিছিল এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্র বোঝাই জাহাজ পৌছেছে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে। জাহাজ থেকে অস্ত্র খালি করার ঘটনা নিয়ে চট্টগ্রামে বিরাজ করছে অস্থিতিকর পরিস্থিতি। সকাল সাড়ে আটটার দিকে বেতারে উর্দুতে এক ঘোষণা এলো। ঘোষণার অর্থ যা বুঝলাম তা ছিল, ঢাকাতে কারফিউ, সামরিক শাসন জারি এবং কিছুক্ষণের ভিতরে জেনারেল টিক্কা খানের ভাষণ প্রচারিত হবে। কিছুক্ষণ পর জেনারেল টিক্কা খানের সংক্ষিপ্ত ভাষণের পর আবার ঢাকা বেতার কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেল। কোথাও থেকে আর কোন খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। আমি শুধু রেডিও টিউনিং করছিলাম কোথাও থেকে ঢাকার কোন সংবাদ পাওয়া যায় কিনা এ আশায় । কলিকাতা বেতারে সকালের স্বাভাবিক অনুষ্ঠান প্রচারের পর বন্ধ হয়ে গেল। বেলা সাড়ে বারোটায় কলিকাতা বেতার থেকে স্বাভাবিক অনুষ্ঠান পরিচালনা শুরু হতো আবার। ঢাকা বেতার তখনও বন্ধ। আমি একা একা ভাবছিলাম ঢাকাতে এখন না জানি কি হচ্ছে?

 

হঠাত কলিকাতা বেতার স্বাভাবিক অনুষ্ঠান বন্ধ করে অতি শান্ত কন্ঠে প্রচার করলো, ‘পূর্ব বাংলায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ঢাকায় রাস্তায় রাস্তায় সামরিক জান্তার সাথে ছাত্র, জনতা, পুলিশ ও ইপিআর বাহনীর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছে। পূর্ব বাংলার অন্যান্য শহরেও সামরিক জান্তার সাথে জনগণের চলছে প্রতিরোধ যুদ্ধ।’ এ ঘোষণার পরপরই বেতার থেকে বেজে উঠলো , ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি, চিরদিন তোমার আকাশ , তোমার বাতাস আমায় প্রাণে বাজায় বাঁশী’, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত হৃদয়স্পর্শী এ গানটি। আমার চোখ দিয়ে ঝর ঝর পানি ঝরছিল। কিছুক্ষণ পর পর এই একই ঘোষণা এবং একই গান । আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে করুণাময়ের কাছে এ যুদ্ধে সাফল্যের জন্য প্রার্থনা জানালাম। সেদিনের বার বার ঝরে পড়া চোখের পানিকে বন্ধক রেখেছিলাম স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিদান হিসেবে।

আমি উদ্গ্রীব হয়ে গেলাম এই সংবাদটি সবার কাছে পৌঁছানোর জন্য। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আকাশ। চারপাশের গ্রাম বাংলার সবুজ দৃশ্যকে মনে হচ্ছিল-এক নতুন সোনার বাংলা। মনের অজান্তেই এক মুঠো মাটি হাতে তুলে নিয়ে বললাম, হে আমার স্বাধীন দেশের মাটি, আমি তোমাকে বড় ভালবাসি। এ ভাবেই আনন্দ অশ্রু আর স্বাধীনতার জীবন মরণ শপথের মাধ্যমে কেটেছিল আমার প্রথম স্বধীনতা দিবস।
 

***

 

 

 

হাজার বছরের বাঙালির শ্রেষ্ঠ কবি

সৈয়দ আফসার

 

গোপনকথা, দাহকথা, প্রেম-প্রকৃতি-কথা কেউ লিখেন কবিতায়, কেউ গানে গানে বলে যা মনের হাজারো অস্ফূটকথায়।  আর যে জন জনতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন খেটে খাওয়া মানুষের কবিতা, কাজ থেকে ছাঁটাই করা মানুষের কবিতা, আত্নবোধের কবিতা, বাঙালি জাতির ভেদাভেদের কবিতা, বাঙালি জাতির মুক্তির কবিতা, সুষমা-সমতার কবিতা…

 

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’

 

তিনিইতো হাজার বছরের বাঙালির শ্রেষ্ঠ কবি, যার আহবানে সাড়া দিয়ে পুরো বাঙালি জাতি তাঁর ধর্ম-বর্ণ-বৈষম্য ভুলে এক কাতারে দাঁড়িয়ে ছিল! কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য মরণপণ লড়াই করেছিল, শহীদ হয়েছিল, যে মা-বোনেরা সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন তারাতো সেই কবিতাটিরই অংশ। সে সব ভাবলেই মনভরে উঠে।

ফিরতে চাই গর্বে তিনক্রোশ হেঁটে দূর পাহাড়ের চূড়ায়, তুলে রাখি বিজয়ের সুখ, মুঠো ভরে তুলে আনি ধূলো; নাক বরাবর রেখে অনুভব করি প্রতিটি কণা যেন ডাকছে... বলছে গায়ে মেখে দেখ কি অনুভূতি জাগে তোর প্রতিটি শিরায়। জানিস আমি উড়তে পারি, আমি পায়ে পায়ে হেঁটে যেতে পারি; ‘আমি রোদে পুড়ি বৃষ্টিতে ভিজি’ যখন তোদের স্পর্শ আমার গায় ছুঁয়ে যায়; আমার ভালো লাগে খুব যেন ‘ফুরফুরে থাকে মেজাজ শরীফ’ আমার শরীরে বাঁধা সব প্রাণীর সহজ জীবন। আমার শরীর ছিঁড়ে-খুঁড়ে উৎপাদন হয় তোদের বেঁচে থাকার সকল আয়োজন।

***

 


 

 

 

 

মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিঃ

আমাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন আমার মা
ফকির ইলিয়া

ঐতিহ্যবাহী সুরমা নদীর শাখা নদী 'বাসিয়া'। সিলেটের দক্ষিণ সুরমা এলাকা স্পর্শ করে বিশ্বনাথের দিকে বয়ে গেছে এই বাসিয়া নদী। সিলেট-লক্ষ্মীবাসা এলাকার লোকাল বোর্ডের সড়কটি গিয়ে শেষ হয়েছে এ নদীটির তীরেই। এ নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত এলাকার নাম কামাল বাজার। সিলেট শহর থেকে মাত্র সাড়ে তিন মাইল পশ্চিমে।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ এলাকার মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ, বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ আজও অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে আছে আমার মানসপটে।
মার্চের শুরুতেই একটি অনিবার্য মুক্তিযুদ্ধের জন্য তৈরি হয়ে থাকেন এ এলাকার মানুষ। পঁচিশে মার্চের কালরাতে পাক হায়েনারা যখন বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন মিছিলমুখর হয়ে উঠেন এ অঞ্চলের মানুষ। মনে পড়ছে হাজারো জনতার একটি বিশাল মিছিল বাসিয়া নদীর পারে সমবেত হয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় সিলেট শহর অভিমুখে।
কারও হাতে বাঁশের লাঠি, কারও হাতে রামদা। না তাদের হাতে মারাত্মক কোন অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। তবুও মনের বলে তারা ছিলেন বলীয়ান। হাজার হাজার মানুষের সেই মিছিলটি 'মকনের দোকান' পর্যন্ত যেতে পেরেছিল। এরপরই পাক বাহিনীর গুলি চালানোর সম্ভাবনা বিবেচনা করে ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিলেন জনতা।
এ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের শাণিত চেতনার নেতৃত্ব যারা দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম শহীদ সোলেমান হোসেন। এ বীর তরুণ লাউড স্পিকার দিয়ে গ্রামে গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন। সাইকেল চালিয়ে তিনি ঘুরেছিলেন সর্বত্র। মহান বিজয়ের মাত্র ক'দিন আগে অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে শহীদ হন সোলেমান হোসেন। তিনি যুদ্ধের প্রাক্কালেই বলছিলেন, প্রাণের বিনিময়ে হলেও এ দেশ স্বাধীন করব। কথা রেখেছিলেন প্রাণ দিয়ে।
একাত্তরের জুলাই মাস। দেশজুড়ে তুমুল যুদ্ধ চলছে। সুরমা নদী দিয়ে ভেসে আসছে প্রতিদিন অগণিত লাশ। হঠাৎ একদিন শুনলাম, সুরমার সংযোগ নদী, বাসিয়া নদী দিয়েও লাশ ভেসে আসতে শুরু করেছে। আমাদের বাড়ির সামনেই নদীর চরে 'তারা' গাছের শেকড়ে আটকা পড়েছে এক জোড়া লাশ। সেদিন বিকেলে বড় ভাইর সঙ্গে দেখতে গেলাম চুপি চুপি। দু'জন তরুণ-তরুণী। স্বামী-স্ত্রী অথবা প্রেমিক-প্রেমিকা হবে বলেই মনে হলো। দু'জনের হাত এক সঙ্গে বাঁধা। উবু হয়ে পড়ে আছে লাশ দুটি। পেছন থেকে বুলেটগুলো ঝাঁঝরা করে দিয়েছে দেহ। শুধু একবার কাছ থেকে দেখলাম। আর স্থির থাকতে পারলাম না। ছুটে এলাম বাড়িতে। বেশ ক'রাত ভয়ে ঘুমাতে পারিনি।
একাত্তরের অগাস্ট মাসে হঠাৎ একদিন পাক হানাদার বাহিনী আক্রমণ করল আমাদের এলাকা। কে একজন দৌড়ে বলে যেতে থাকল-'পাঞ্জাবি আসছে, পাঞ্জাবি আসছে'। গ্রামের মানুষ হানাদার জল্লাদদের 'পাঞ্জাবি' বলেই সম্বোধন করতেন। আমাদের এ এলাকায় বেশকিছু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাস। কোন দালাল নাকি তথ্য দিয়েছিল, এসব হিন্দু সম্প্রদায় তথাকথিত 'পাকিস্তান'র বিরুদ্ধে কাজ করছেন। তাই এ আক্রমণ।
মনে পড়ছে, বাসিয়া নদীর তীরে এসে পাক সেনাদের জিপ, ট্রাকগুলো থামল। সেখান থেকে তারা সামরিক কায়দায় দৌড়ে এসে ঢুকে পড়ল গ্রামের অভ্যন্তরে। বাড়ি বাড়ি ঢুকে তল্লাশি শুরু করল।
'ইধর কোই হিন্দু হ্যায়'?- কথাগুলো এখনও কানে বাজে আমার। গ্রামের মানুষ উর্দু জানেন না। উর্দু জানেন না, আমার মা - ও। প্রাণের ভয়ে অনেকেই তখন চৌকির নিচে, ঝোপঝাড়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
যাদের ওরা সামনে পেয়েছে, দাঁড় করিয়েছে বাড়ির উঠোনে। 'হিন্দু' শব্দটি শুনেই সবাই ভয়ে মাথা নাড়ছেন। না, আমরা 'হিন্দু' নই!

আমি তখন স্কুলছাত্র। পালাব কোথায়? কিছুই ভাবতে না পেরে দৌড়ে গিয়ে মায়ের কাছে আশ্রয় নিলাম। আমার মা আমাকে বুকে চেপে ধরলেন। বাবা তখন প্রবাসে। নিজেদের পৃথিবীর অসহায়তম মানুষ বলেই মনে হলো। পাকিস্তানী ঘাতক বাহিনী আমাদের বাড়ি পর্যন্ত এসে পৌঁছার আগেই মা আমার মাথায় একটি সাদা গোল টুপি পরিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে একথা প্রমাণিত হয়, আমি হিন্দু নই-আমি মুসলমান। তারপরও পাকিস্তানী সেনার মুখোমুখি দাঁড়াতে হলো আমার মাকে, আমাকে নিয়ে। ব্যাজ ও স্টার দেখে বুঝলাম, সে একজন অফিসার। আমার মাকে বেশ দাম্ভিকভাবে জিজ্ঞাসা করল 'এই বুড্ডি, ইয়ে লাড়কা তোমারা হ্যায়? ইয়ে হিন্দু তো নেহি?' আমার মা মাথা নেড়ে না সূচক জবাব দিলেন। অথচ এ প্রশ্নটি না শোনার জন্যই আমার মা আমাকে টুপি পরিয়েছিলেন। দুঃখ হয়, আমার মাথার টুপিটিও সেদিন আমার প্রকৃত ধর্মীয় পরিচয় তুলে ধরতে পারেনি পাক হানাদারদের কাছে।
 

মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমাদের গোটা এলাকা যেন নিথর হয়ে পড়ল। আমাদের বাড়ির পশ্চিমে দু'টি এবং উত্তরে একটি বাড়ি ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। সেসব বাড়ির নারী-পুরুষ-শিশু সবাই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন পশ্চিমের গ্রামগুলোতে। পাক সেনারা ওসব বাড়িতে ঢুকেই পেট্রোল ঢেলে অগ্নিসংযোগ করল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকল আগুনের লেলিহান শিখা। আমাদের বাড়ির পশ্চিমের বাড়িটি বসন্ত কাকাদের। বসন্ত কুমার দেব। ছোটকাল থেকেই তার স্নেহ পেয়ে বেড়ে উঠেছি আমরা। অকৃতদার,এই মানুষটি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ডাক কর্মচারী। পোস্টমাস্টারের কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছিলেন। বাড়ির সবাই দৌড়ে পালাতে পারলেও, তিনি পালাতে পারেননি। ফলে ঘাতকরা তাকে বাড়িতেই পেয়ে যায়। তারা পেছন থেকে তার হাত বেঁধে ফেলে। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েই পথ। তিনটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে উল্লাস-নৃত্য করতে করতে ফিরে যাওয়ার সময় বসন্ত কাকাকে সঙ্গে করেই নিয়ে যাচ্ছিল খুনিচক্র।
এ সময় তিনি হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। তার গগনবিদারী চিৎকারে আঁতকে উঠেছিলাম আমরা, প্রতিবেশীরা। 'আমাকে নিয়ে যাচ্ছে কেন? আমি তো কোন অপরাধ করিনি। আমাকে ছেড়ে দাও না'... প্রবীণ এ মানুষটির আকুতি ছিল হৃদয়বিদারক। পাক সেনাদের গাড়িতে তোলা পর্যন্ত অনেকেই দেখেছিলেন তাকে। এরপর আর তাকে দেখা যায়নি। কোনদিনই গ্রামের পথ ধরে ফিরে আসেননি আমাদের বসন্ত কাকা।
 

যেসব শহীদের রক্তের স্মৃতি বহন করে চলেছে আমার মাতৃভূমি কামাল বাজার এলাকা, তারা হচ্ছেন- শহীদ সোলেমান হোসেন, শহীদ এনামুল হক, শহীদ বসন্ত কুমার দেব, শহীদ নরেশ চন্দ্র দেব ও শহীদ বারিক আলী। শহীদ এনামুল হক, যিনি একজন স্কুলছাত্র হিসেবেই অংশ নেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে শহীদ হন তিনিও। এ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ শতাধিক। তারা সিংহভাগই এখন বেঁচে আছেন বড় দীনতা নিয়ে।


এসব কথা যখন মনে পড়ে তখন কেবলই ভাবি কী চেয়েছিলেন তারা? তারা কী কোটিপতি হওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন? গোটা বাংলাদেশের সিংহভাগ মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্ন ছিল একটাই, আর তা ছিল-একটি স্বাধীন জন্মভূমি। একটি মানচিত্র।
বাঙালি সেই পতাকা পেয়েছিল ঠিকই ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি মহান চেতনার সূর্যছবি। কারণ, কতিপয় চিহ্নিত রাজাকার বাদে বাকি সবাই সেদিন একটি রাষ্ট্রের জন্য ছিলেন উদগ্রীব।
মনে পড়ছে, নভেম্বরের এক গভীর রাতে আমাদের এলাকার বেশক'জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন আমার বড়ভাই। আগেই সংবাদ জানানো হয়েছিল। তাই আমার বড় বোন, মা, চাচিরা সবাই রান্না করে অপেক্ষায় ছিলেন গভীর রাত পর্যন্ত। মুক্তিসেনারা মাত্র দুই ঘণ্টার জন্য বাড়িতে এসেই আবার হারিয়ে গিয়েছিলেন রণাঙ্গনের উদ্দেশে।
আমার আজও খুব মনে পড়ে সেই সরদার মাঝির কথা। যে গভীর রাতে বাসিয়া নদীর খেয়া পার করেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের। আর সরদার মাঝি আমার বড় চাচাকে বলেছিল, 'চাচা আমি তো যুদ্ধে গেলাম না। বড়ভাইদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) খেয়া পার করে দিয়েছি, এটাই আমার সান্ত্বনা।'

 

***

 

যথারীতি প্রকাশনা

ধারাবাহিক গল্প

 

পৃথিবীলোক

একাধিক একা

সুখের লাগিয়া

প্রবন্ধ

যাদের রক্তে মুক্ত এ দেশ

আর্কাইভ

 

Best view with Microsoft Internet Explorer
font download link
http://omicronlab.com/download/fonts/SolaimanLipi_20-04-07.ttf