নব আলোকে বাংলা
উত্তরাধিকার। অংগীকার। দূরদৃষ্টি।
Humaira Haroon, Suprateek Aroop Ghosh
সম্পাদক
পাঠক পরিষদঃ শুভলগ্না শোয়ারা, চঞ্চল চৌধুরী
কৃতজ্ঞতাঃ শিল্পী রুনা লায়লা, জেমস
Nuaba Aloke Bangla
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস স্মরণে...
সম্পাদকীয়
সেই সময়! গন্ডগোলের সময়! মুক্তিযুদ্ধের সময়! গোলমালের সময়! আরও কি কি নামে ডাকা হয়
তাঁকে! তবুও তাঁর সঠিক নামটি আজও কেউ চিনে নিলনা! খুব আশ্চর্য লাগে
৩৯ বছরের এই চিরসংগ্রামী যুবকের নাম নিয়ে এত বিভ্রাট কেন? এই যুবক হল ‘স্বাধীনতা’!
বাংলাদেশের স্বাধীনতার নাম স্বাধীনতা কেন নয়! কেন নির্দ্বিধায় মানুষ
তাঁকে তাঁর
পরিচয় দেয়না আজও! জানিনা। তবে সময় এসেছে। বর্তমান প্রজন্মকে
জেনে নিতে হবে সঠিক কি ঘটেছিল ১৯৭১ এর সেই দুর্যোগময় দিনগুলিতে যা চলেছিল দীর্ঘ
সাড়ে নয় মাস ধরে! কেমন করে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক জীবন কাটত! কেন
গন্ডগোলের সময় বলে স্বাধীনতা প্রসংগ এড়িয়ে যায় সাধারণ মানুষ!
বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সেদিন সব কিছু
ত্যাগ করে অত্যাচারের শাসনের বিলুপ্তি চেয়েছিল! কেমন ছিল সেই আন্দোলনের চেহারাটা,
স্কুল পড়ুয়া ছাত্র, ছাত্র তৈরীর কারিগর মাষ্টারমশাই, রোগ নিরাময়ী ডাক্তার ও আরও কত
সাধারণ মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া সেদিন ‘মুক্তিযোদ্ধা’ নামটিকে
আপন করে নিয়ে, প্রাণ সংশয়
সত্ত্বেও দেশমাতৃকার
বুক থেকে রাজাকার
আর পশ্চিম পাকিস্তানী অত্যাচারী সেনার আগ্রাসী থাবাকে
নির্মূল করে
দিতে
যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলে!
আজকের মিশর, লিবিয়া, ইয়েমেন বা
বাহরিনের সঙ্গে সেদিনের বাংলাদেশের পরিস্থিতির কি
কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যায়! পন্ডিতেরা অনেক কথা বলবেন! সাধারণ মানুষ কি বলেন সেটাই
জানার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আজ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে নব আলোকে বাংলার এই
সংক্ষিপ্ত সম্পাদকীয় লিখতে বসে এই সব প্রশ্ন নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। আমার বাংলাদেশী
ভাই-বোনেদের কাছে একটি অনুরোধ রেখে এই অসমাপ্ত লেখা এখানেই থামাব – স্বাধীনতা
আন্দোলনের ইতিহাসটিকে জানুন। আগামী প্রজন্মের কাছে তাঁর সঠিক ছবিটি তুলে ধরুন।
লিখুন নব আলোকে বাংলার পাতায় – যদি মন চায়... নব আলোকে বাংলা
সবারে এই মর্মে আহবান
জানায়...
মুক্তিযুদ্ধের বীর সৈনিকদের উদ্দেশে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম
ও সংগ্রামী সালাম জানিয়ে বলি সবাই ভাল থাকুন...
আপনাদের সুপ্রতীক
২৫ শে মার্চ ২০১১, ১১ই চৈত্র ১৪১৭
এবারের
প্রকাশনা
স্বাধীনতা
*** |
স্বাধীনতার সংজ্ঞা কি? রাতিফ আহমেদ রিজভী
*** |
স্মৃতি সততই সুখের
নয়
সন্ধ্যে বেলায় ওদের এক বড় কর্তা জানালো বিচিত্র বিকৃত এক বাংলা ভাষায় যার অর্থ হয় আমার চাচা আমাকে নিতে এসেছে। চাচাকে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলাম। দুজন মিলে যখন বেরিয়ে যাবো ক্যাম্প থেকে তখন সে আরো একবার ডাকলো। আমরা দাঁড়িয়ে আছি। বুকের ভেতর অনিশ্চয়তা। বৃহদাকার গরিলাটি বললো, তোমার চাচার চুল খুব লম্বা, তার চুল কেটে দিও। আমরা আর দেরি করি নি। বাড়ি ফিরে আমার মুক্তিযোদ্ধা চাচা অনেক বকুনি দেবার ইচ্ছে বুকে চেপে শেষমেষ কিছুই বললেন না।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে এলো, স্বাধীনতা এলো না।
|
ইন্দিরার স্বপ্ন – বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ খালিল হাসান এক চিলতে রোদ পর্দার আড়াল ভেদ করে কখন যে চোখ বিদ্ধ করেছে আমি জানি না। চোখ মেলে দেখি সুন্দর একটি সকাল। দিনটি আজ এত সুন্দর কেন? স্বাধীনতা দিবস বলেই হয়তো বা। এক অনাবিল শান্তি আর আনন্দ এসে ভর করে মনের মাঝে যখন মনে পড়ে যায় ৭১ এর ১৬ ই ডিসেম্বর বিজয়ের আনন্দ মিছিলে অংশ নেবার কথা। আজও স্মৃতিপটে অম্লান ৭ই মার্চের ভাষণ , ২৫ শে মার্চের কাল রাত্রির কথা। আজ ৪০ বছর পরও আমায় সেসব দিনের স্মৃতি অশ্রুসিক্ত করে তুলে। স্বাধীনতা দিবস এলেই স্মৃতি রোমন্থনে চলে যাই সেই পুরনো দিনগুলিতে। দেখেছি কত । সয়েছি শত। মনে রেখেছি প্রতিটি ঘটনা। এই তো সেদিন... অগাস্ট, ১৯৪৭ আমি তখন আর কতই বা, বিশ বছরের একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট। আমার মাতৃভূমি ভারত খন্ড বিখন্ড হল কত না ভাগে। সৃষ্টি হল ১৬০০ মাইল ব্যবধানে ওয়েস্ট পাকিস্তান আর ইস্ট বেঙ্গল, পরবর্তীতে ইস্ট পাকিস্তান। বিভাজন হল মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা বলে। না আছে সেখানে কোন ভাষার মিল, না আছে কোন সংস্কৃতির মিল। ক্ষমতার প্রতি লিপ্সা আর ধর্মের অজুহাত তৈরি করলো এ বিভক্তি। ক্ষমতা আর কর্তৃত্বের ভার ওয়েস্ট পাকিস্তানের । ইস্ট পাকিস্তান শুধুই বঞ্চনার স্বীকার। ২১ শে মার্চ, ১৯৪৮ একই ভাষাভাষীর অবস্থান ভারতের পশ্চিম বঙ্গ আর ইস্ট পাকিস্তানে। ভাষার মিলে প্রাণের মিল, যা ভাল লাগেনি ওয়েস্ট পাকিস্তানের। আর ১৯৪৭ এর পর ভারতের সাথে ওদের টানাপোড়নও অনেক। তাই মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষণা উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের অফিসিয়াল ভাষা। ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সকাল ১০ টা হবে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে হল থেকে বেরিয়ে সবাই জড়ো হলাম ঢাকা ইউনভার্সিটির চত্বরে। পুলিশের বেষ্টনী আর তার মাঝে আমাদের প্রতিবাদ – রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই। ছাত্রদের হস্টেলে গুলিবর্ষণ হলো। ছাত্রদের মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া জনমনে জন্ম দিল অসন্তোষ। শুরু হলো প্রতিবাদ, মিছিল। ১৯৫৬ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃত দেয়া হলো বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে। সেকশন ২১৪ অনুযায়ী ।। 214(1) The state language of Pakistan shall be Urdu and Bengali ।। ১৯৭০ ১৯৫৩ তে আমি ইস্ট পাকিস্তান আর্মিতে যোগদান করেছি চিকিতসক হিসেবে। মেডিসিনে স্পেশালাইজেশান শেষ করে পোস্টিং পেয়েছি ওয়েস্ট পাকিস্তানে। ১৯৫৩ থেকে ১৯৭০, এই ১৭ বছর চাকুরী জীবনে দেখেছি ইস্টের ওপর ওয়েস্টের ঘৃণা, তাচ্ছিল্য আর রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণ। সবচেয়ে অবাক হবার মতন স্মৃতি হলো আওয়ামী লীগের সংখ্যা গরিষ্ঠ আসনে শেখ মুজিবের বিজয়কে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টোর প্রত্যাখান। পূর্ব পাকিস্তানের বিজয়ী প্রার্থীকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ঘটনাটি রূপ নিল প্রতিবাদে আন্দোলনে। ৩ রা মার্চ, ১৯৭১ প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ঢাকায় ভুট্টো আর মুজিবের সাথে বৈঠক ব্যর্থতায় পর্যবাসিত হলো। ৭ই মার্চ, ১৯৭১ সোহরোয়ার্দী উদ্যানে বজ্রকন্ঠে উচ্চারিত হলো শেখ মুজিবের ভাষণ। ডাক দিলেন স্বাধীনতার। তাঁর কন্ঠের সেই আহবান আজও স্পষ্ট কানে ভাসে... ।। আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল ।। ।। রক্ত যখন দিতে শিখেছি, রক্ত আরো দিব –এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ ।। ।। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম – এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ।।
২৫ শে মার্চর কাল রাত্রি, ১৯৭১ অপারেশান সার্চ লাইট নামে শুরু হলো বাঙ্গালী নিধন প্রক্রিয়া ২৫ শে মার্চ রাতে। ছাত্র হলগুলো ছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীদের টার্গেট। জ্বলেছে ঢাকা সারারাত, বিশেষ করে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলো। শেখ মুজিব অ্যারেস্ট হলেন, ঘোষণা দিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার। যুদ্ধ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে শুরু হলো গেরিলা ট্রেনিং। অস্ত্র, প্রশিক্ষণ আর সৈন্য সহযোগে শুরু হলো পাকিস্তান মিলিটারির মোকাবেলা। ভারতীয় সৈন্য, দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তৈরি করলো প্রচন্ড আক্রমণের পরিকল্পনা। এ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ৩ রা ডিসেম্বর দখলদার বাহিনী শুরু করলো অতর্কিতে বিমান হামলা, যার নাম ছিল অপারেশান ফোকাস। ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্ত বরাবর তাদের আক্রমণ সীমাবদ্ধ ছিলা না। পাক হানাদার সুপরিকল্পিত ভাবে বিমান হামলা চালালো পশ্চিমে ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স স্টেশানে আর পূর্বে মুক্তি বাহিনী ক্যাম্প লক্ষ্য করে পশ্চিমবঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর তাতক্ষণিক আদেশে ভারতীয় সৈন্য বাহিনী সমবেত হলো পুরোমাত্রায়, হানাদার বাহিনীকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে। প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে বললেন, India is at war with Pakistan. তাঁর এই কথাটি নিমেষে পৌঁছে গেল লক্ষ লক্ষ ভারতবাসীর কাছে। ভারত হতে সহস্রাধিক সৈন্য, টন টন গোলাবারুদ, অস্ত্রসামগ্রী স্থানান্তর সম্ভব হয়েছিল ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের হেলিকপ্টার যোগে। হঠাত চমকে দিয়েছিল পাকিস্তানিদেরকে তাদের বিরুদ্ধে এ আয়োজন ও আক্রমণ। ৬ দিনের মধ্যে ইন্ডিয়ান সৈন্যরা প্রবেশ করলো বাংলাদেশের একেবারে অভ্যন্তরে। দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণ আর মুক্তি বাহিনী ছিল সর্বক্ষণ তাদের পথনির্দেশক। তা না হলে এই নদী নালা, ঝোপ জংগল, জলাশয়ে ভরা বাংলার এতটা পথ মাত্র ৬ দিনে অতিক্রম করার অসাধ্য সাধন কি সম্ভব ছিল। সপ্তম দিনে রাওয়াল পিন্ডির হেডকোয়ার্টারে ছড়িয়ে পড়েছিল আতংক। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর যুদ্ধের ঘোষণার দিনই তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্ববৃহত যুদ্ধ জাহাজ INS Vikrant আন্দামান আর নিকোবোর দ্বীপপুঞ্জের উত্তর থেকে অগ্রসর হলো চট্টগ্রাম বন্দর অভিমুখে। ৪ঠা ডিসেম্বর, ১৯৭১ ভারতীয় ৮ টি Sea Hawk এর উড্ডয়ন। লক্ষ্যঃ কক্সেস বাজার। উদ্দেশ্যঃ হানাদার বাহিনীর অবস্থান ধ্বংস। ইতিমধ্যে INS Vikrant আরো এগিয়ে এসেছে চটগ্রামের দিকে। এবার লক্ষ্যস্থল মংলা, খুলনা অঞ্চলে হানাদার বাহিনীর অবস্থান। জলে, স্থলে, আকাশ পথে প্রচন্ড বাধার সম্মুখীন হয়েছে হানাদার বাহিনী। স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ, যা পাকিস্তানে কমান্ডো ব্রিগেড নামে পরিচিত তারাও ইচ্ছেপূর্বক ক্ষতিসাধনের (স্যবটেজ) চতুরীতে এবার হেরে গেল মুক্তিবাহিনী আর মিত্র বাহিনীর ক্ষিপ্র মোকাবেলায়। পরাজয় মেনে নিল। ১৬ ই ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর হাতে চলে এলো ঢাকা। রমনা রেসকোর্স ময়দানে ভারতীয় সময় বিকেল ৪ টা ৩১ মিনিটে লে. জে. নিয়াজী আত্মসমর্পণ করলেন লে. জে. জাগজিৎ সিং অরোরার বাহিনীর কাছে। বাংলাদেশের বিজয় হলো। ১৪ ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ বিশ্বাসঘাতকদের সুপরিকল্পিত হত্যার আরো একটি নমুনা রয়েই গেল। জামাত-ই-ইসলামী এবং এদের আধা সামরিক বাহিনী আল বদর, আল সামশ তৈরী করলো কবি, সাহিত্যিক, প্রকৌশলী, চিকিতসক, শিক্ষকদের তালিকা। বিজয়ের দুই দিন আগে নির্মম ভাবে হত্যা করলো সকল বুদ্ধিজীবীদের। ২৬ শে মার্চ, ২০১১ আজ স্বাধীনতার ৪০ বছর। জেমসের কন্ঠের সেই কয়েকটি লাইন বার বার মনে পড়ছেঃ (গানের লিংক এখানে)
'তুমি
মিশ্রিত লগ্ন মাধুরীর জলে ভেজা কবিতায়
তুমি ধানের শীষে মিশে থাকা
শহীদ জিয়ার স্বপন, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি জন্ম দিয়েছ তুমি মাগো, তাই তোমায় ভালবাসি।'
*** |
১৯৭১ এর মার্চ মাস
১৯৭১ সালের এই উচ্ছ্বাসের
মাসে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক গাঁও গেরামের ছেলে, আমি একা চলছি শিক্ষায়
উচ্চ ডিগ্রি নিতে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে। কেবল পা রেখেছি রাজশাহী
বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজার প্রথম সিঁড়িতে। ভাবতে গেলে একেবারে কম কথা নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চাত্রীদের মন তখন নতুন আম্রমুকুল
থেকে বিচ্ছুরিত মিষ্টি শিশিরের রসে পরিতৃপ্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র
সংসদ নির্বাচনের হাওয়ায় যুক্ত হয়েছে। বিভিন্ন আবাসিক হল সমূহের ছাত্র সংসদ
নির্বাচনী তরংগের উপর আরেকটি উপ-তরংগ। অন্যদিকে চলছে ১৯৭১ এর পাকিস্তানের
ইসলামাবাদ সরকারের বিরুদ্ধে বাঙ্গালী জনগণের ১১ দফা ও ৬ দফা দাবী আদায়ের
রাজনৈতিক যুদ্ধ। দেশের আপামর জনসাধারণের সাথে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তরুণ
ছাত্র ছাত্রীরাও অগ্রণী ভূমিকায় অংশীদার হয়ে, আন্দোলনের ধারাকে নিয়ে যাচ্ছিল
সাফল্যের চূড়ায়। ১৯৭১ এর ফেব্রুয়ারি – মার্চ ছিল গণ আন্দোলনের ফুলে ফেঁপে উঠা
বিস্ফোরণের একটি পূর্ব মুহূর্ত।
৩ রা মার্চ ১৯৭১, রাত সাড়ে দশটায় ছাত্র ক্যান্টিনে বসে কলিকাতা বেতারের সংবাদ পরিক্রমা শুনছিলাম, যা ছিল পূর্ব বাংলার সকলের কাছে অতি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। তখনকার দিনের পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ এবং তার মন্তব্যসহ প্রচারিত হতো এই অনুষ্ঠান। তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বাঙ্গালীদের কার্যক্রমের সংবাদ কলিকাতা বেতার থেকেই সঠিক ভাবে পাওয়া যেত। পরিক্রমা অনুষ্ঠানটি যখন শোনা শেষ তখন হলের বাইরে থেকে চিতকার ভেসে এলো – মিলিটারি আসছে, মিলিটারি, মিলিটারি। আমরা ভয়ে যে যার রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। আমি দৌড়ে তিনতলায় একটি রুমে ঢুকলাম। জানালা দিয়ে দেখলাম একটু দূরের রাস্তা দিয়ে কয়েকটা জীপ বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সামসুজ্জোহা হলের দিকে এগুচ্ছে। ঠিক ঐ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেশন অতিক্রম করছিল সাড়ে দশটার ট্রেন, যার শব্দটা এত অশ্রুতপূর্ব, ভয়ংকর হয়ে আমার কানে ও হৃদয়ে বিধঁছিল, মনে হচ্ছিল ট্রেন ভর্তি মিলিটারি, ছাত্র হলগুলির দিকে আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসছে। তাদের আক্রমণের লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্র ছাত্রী।
হঠাত
কলিকাতা বেতার স্বাভাবিক অনুষ্ঠান বন্ধ করে অতি শান্ত কন্ঠে প্রচার করলো,
‘পূর্ব বাংলায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ঢাকায় রাস্তায় রাস্তায় সামরিক জান্তার সাথে
ছাত্র, জনতা, পুলিশ ও ইপিআর বাহনীর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছে। পূর্ব বাংলার
অন্যান্য শহরেও সামরিক জান্তার সাথে জনগণের চলছে প্রতিরোধ যুদ্ধ।’ এ ঘোষণার
পরপরই বেতার থেকে বেজে উঠলো , ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি, চিরদিন
তোমার আকাশ , তোমার বাতাস আমায় প্রাণে
বাজায় বাঁশী’, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের
বিখ্যাত হৃদয়স্পর্শী এ গানটি। আমার চোখ দিয়ে ঝর ঝর পানি ঝরছিল। কিছুক্ষণ পর পর
এই একই ঘোষণা এবং একই গান । আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে করুণাময়ের কাছে এ যুদ্ধে
সাফল্যের জন্য প্রার্থনা জানালাম। সেদিনের
বার বার ঝরে পড়া চোখের পানিকে বন্ধক
রেখেছিলাম স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিদান হিসেবে। ***
|
হাজার বছরের বাঙালির শ্রেষ্ঠ কবি সৈয়দ আফসার
গোপনকথা, দাহকথা, প্রেম-প্রকৃতি-কথা কেউ লিখেন কবিতায়, কেউ গানে গানে বলে যান মনের হাজারো অস্ফূটকথায়। আর যে জন জনতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন খেটে খাওয়া মানুষের কবিতা, কাজ থেকে ছাঁটাই করা মানুষের কবিতা, আত্নবোধের কবিতা, বাঙালি জাতির ভেদাভেদের কবিতা, বাঙালি জাতির মুক্তির কবিতা, সুষমা-সমতার কবিতা…
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’
তিনিইতো
হাজার বছরের বাঙালির শ্রেষ্ঠ কবি, যার আহবানে সাড়া দিয়ে পুরো বাঙালি জাতি তাঁর
ধর্ম-বর্ণ-বৈষম্য ভুলে এক কাতারে দাঁড়িয়ে ছিল! কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর
মোকাবিলা করার জন্য মরণপণ লড়াই করেছিল, শহীদ হয়েছিল, যে মা-বোনেরা সম্ভ্রম
হারিয়েছিলেন তারাতো সেই কবিতাটিরই অংশ। সে সব ভাবলেই মনভরে উঠে। ***
|
মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিঃ আমাকে
আঁকড়ে ধরেছিলেন আমার মা
ঐতিহ্যবাহী সুরমা নদীর শাখা
নদী 'বাসিয়া'। সিলেটের দক্ষিণ সুরমা এলাকা স্পর্শ করে বিশ্বনাথের দিকে বয়ে গেছে
এই বাসিয়া নদী। সিলেট-লক্ষ্মীবাসা এলাকার লোকাল বোর্ডের সড়কটি গিয়ে শেষ হয়েছে এ
নদীটির তীরেই। এ নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত এলাকার নাম কামাল বাজার। সিলেট শহর
থেকে মাত্র সাড়ে তিন মাইল পশ্চিমে।
মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমাদের গোটা এলাকা যেন নিথর হয়ে পড়ল। আমাদের বাড়ির
পশ্চিমে দু'টি এবং উত্তরে একটি বাড়ি ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। সেসব বাড়ির
নারী-পুরুষ-শিশু সবাই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন পশ্চিমের গ্রামগুলোতে। পাক সেনারা
ওসব বাড়িতে ঢুকেই পেট্রোল ঢেলে অগ্নিসংযোগ করল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দাউ দাউ করে
জ্বলতে থাকল আগুনের লেলিহান শিখা।
আমাদের বাড়ির পশ্চিমের বাড়িটি বসন্ত কাকাদের। বসন্ত কুমার দেব। ছোটকাল থেকেই
তার স্নেহ পেয়ে বেড়ে উঠেছি আমরা। অকৃতদার,এই মানুষটি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ডাক
কর্মচারী। পোস্টমাস্টারের কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছিলেন।
বাড়ির সবাই দৌড়ে পালাতে পারলেও, তিনি পালাতে পারেননি। ফলে ঘাতকরা তাকে বাড়িতেই
পেয়ে যায়। তারা পেছন থেকে তার হাত বেঁধে ফেলে। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েই পথ। তিনটি
বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে উল্লাস-নৃত্য করতে করতে ফিরে যাওয়ার সময় বসন্ত কাকাকে
সঙ্গে করেই নিয়ে যাচ্ছিল খুনিচক্র। যেসব শহীদের রক্তের স্মৃতি বহন করে চলেছে আমার মাতৃভূমি কামাল বাজার এলাকা, তারা হচ্ছেন- শহীদ সোলেমান হোসেন, শহীদ এনামুল হক, শহীদ বসন্ত কুমার দেব, শহীদ নরেশ চন্দ্র দেব ও শহীদ বারিক আলী। শহীদ এনামুল হক, যিনি একজন স্কুলছাত্র হিসেবেই অংশ নেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে শহীদ হন তিনিও। এ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ শতাধিক। তারা সিংহভাগই এখন বেঁচে আছেন বড় দীনতা নিয়ে।
*** |
যথারীতি প্রকাশনা
ধারাবাহিক গল্প
প্রবন্ধ
Best view
with Microsoft Internet Explorer
font download link
http://omicronlab.com/download/fonts/SolaimanLipi_20-04-07.ttf