নব আলোকে বাংলা উত্তরাধিকার। অঙ্গীকার। দূরদৃষ্টি। Humaira Haroon , Suprateek Aroop Ghosh, Nauba Aloke Bangla সম্পাদক পাঠক পরিষদঃ চঞ্চল চৌধুরী, শুভলগ্না শোয়ারা
১১২ তম (১১ ই জৈষ্ঠ্য ১৩০৬ -১৪১৮ বঙ্গাব্দ) নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে এবারের প্রকাশনা
'সেই সুর সেই ডাক স্মরি'
সম্পাদকীয় ছন্দাবলী -২৭
অরুণকান্তি কে গো যোগী
তুমি
প্রাণের কবি
***
জাতীয় কবি নজরুল ও নজরুল সঙ্গীত শায়মা
কাজী নজরুল ইসলাম। এ নামটার মানেই যেন ঝাঁকড়া চুলে বাবরী দোলানো এক কিশোর, এক প্রেমিক হৃদয়। কিন্তু সবচেয়ে যে দৃশ্যটি চোখের তারায় ভেসে ওঠে সে এক বিদ্রোহী, আত্নপ্রত্যয়ী তরুণ যুবকের প্রতিকৃতি।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এক বিস্ময় ও অবাক করা মেধার নাম কাজী নজরুল। বিদ্রোহী এবং কবি পরিচয় ছাড়াও নজরুল ছিলেন একাধারে গল্পকার, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। তিনি নাটক রচনা করেছেন। তার প্রবন্ধের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। তার জীবনের একটি মূল্যবান সময় কেটেছে সাংবাদিকতায়। এছাড়াও তিনি একজন মহান পূর্নাঙ্গ সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব।
সঙ্গীতের প্রতি তাঁর অনুরাগ খুব ছোটবেলা থেকেই। বাংলা লোকগীতির বিভিন্ন দিক ছাড়াও তিনি মার্গ সঙ্গীতেও তালিম নিয়েছিলেন তিনি। মার্গ সঙ্গীতের বিভিন্ন রাগ রাগিনী সম্পর্কেও তাঁর ধারণা গড়ে উঠেছিলো। চন্চলমতী এই কবির পক্ষে একাধারে ওস্তাদের কাছে বসে থেকে সাধনা সম্ভব ছিলনা তবুও অসাধারণ প্রতিভাবলে অতি দ্রুত তিনি বিভিন্ন রাগ রাগিনী সম্পর্কে ধারণা করে নিতে পারতেন।
কবি নজরুল তার সঙ্গীতে যে অভাবনীয় দক্ষতায় নানা রাগ রাগিনীর মিশ্রণ ঘটিয়েছেন তা সত্যিই অচিন্তনীয়, মনোমুগ্ধকর। যেমন তাঁর একটি গান, চেয়ো না সুনয়না আর চেয়ো না এ নয়নপানে। এ বিখ্যাত গজলটির সুরে তিনি দুটি রাগের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। একটি বাগেশ্রী অন্যটি পিলু। আমার অসম্ভব প্রিয় দুটি রাগ আর এই গানটি আমার তাই এত প্রিয়। পিলু খামাজ ঠাটের রাগ আর বাগেশ্রী কাফি ঠাঁটের এ দুই সুর সাধারণত একসাথে ভালো লাগার কথা নয়। তবু এ গান শুনে মনে হয় কিভাবে সম্ভব এমন অপূর্ব এক সৃষ্টি! গানটির প্রথমাংশ বাগেশ্রী আর শেষাংশ পিলু। ফিরোজা বেগমের কন্ঠে গানের লিংক এইখানে।
আরেকটি গান রাগ ভীমপলশ্রীর সুরে কবি গড়ে তুলেছেন পাষাণের ঘুম ভাঙালে গানটি। গানটির মধ্যে এক কান্নার সুর যেন খেলা করে যায়। গানের লিংক https://www.youtube.com/watch?v=NiIVMklrWco খামাজে- কুহু কুহু কোয়েলিয়া, গানের লিংক https://www.youtube.com/watch?v=tP5sv6grxAE কবি নজরুল তার গানে অনেক আরবী ফার্সী শব্দ ব্যবহার করেছেন। এ যেন নজরুল সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য। যেমন, আলগা করো খোঁপার বাঁধন, দিল ওহি মেরা ফাস গায়ী। গানের লিংক https://www.youtube.com/watch?v=ujUcHhM7j58 মানবেন্দ্র মুখার্জীর কন্ঠে https://www.youtube.com/watch?v=9vZQ9RUUqpY বৃন্দাবনী সারং এ রচিত হয়েছে, একি মধু শ্যাম বিরহে। এ গানটিতে একদিন আমার মন মজেছিলো। কৌশিকি কানাড়ায়- শ্মশানে জাগিছে শ্যামা ও কেদারায়- আজো কাঁদে কাননে কোয়েলিয়া। অজয় চক্রবর্তীর কন্ঠে আজো কাঁদে কাননে গানের লিংক https://www.youtube.com/watch?v=roANnqAjVGw নজরুলের ক্বোরাস গানও কম বিস্ময় নয়। দুর্গম গিরি কান্তার মরু গানটির মধ্যে রয়েছে এক অপূর্ব মাধুর্য্য ও উন্মাদনা আর রয়েছে এক আত্নবিশ্বাসের বলিষ্ঠ স্বর। সব্যসাচীর কন্ঠে দুর্গম গিরি কান্তার মরু কবিতাটির আবৃত্তির লিংক https://www.youtube.com/watch?v=6vVGXgSK8ZA তার দেশপ্রেম ও সুরঝংকার গান মানেই - কারার ঐ লৌহ কপাট। একই সাথে- এই শিকল পরা ছল এবং তোরা সব জয়ধ্বনি কর। এসব গানও যুগে যুগে আমাদেরকে যুগিয়েছে অনুপ্রেরণার বাণী। কারার ঐ লৌহ কপাট গানের লিংক https://www.youtube.com/watch?v=4gOJVlb_9-A সৈনিক জীবন কবি নজরুলকে অনুপ্রাণিত করেছে গান রচনায় ও আমাদেরকে দিয়েছে কিছু অবিস্মরণীয় সঙ্গীত। যেমন তাঁর বিখ্যাত রণ সঙ্গীত, চল চল চল উর্ধ গগণে বাজে মাদল / নিম্নে উতলা ধরণীতল / অরুণ প্রাতে তরুণ দল/ চলরে চলরে চল গানের লিংক https://www.youtube.com/watch?v=TvKgjq-eW6w সঙ্গীত ভুবনে জাতীয় কবি নজরুলের অবদান চিরস্মরণীয়। তার সঙ্গীতের তুলনা একমাত্র তিনিই।
*** নজরুলের একটি কৃষ্ণবাদী গান ইমন জুবায়ের শিল্পী অনুপ জালোতার কন্ঠে গানের লিংক https://www.youtube.com/watch?v=2aW4oJoYLQ4 জীবদ্দশায়
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা সম্পন্ন
একজন আলোকিত সুন্দর মানুষ, যে কারণে তাঁর পক্ষে মথুরা-বৃন্দাবনের
শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে কাওয়ালী ঢংয়ে গান কম্পোজ করা সম্ভব হয়েছে। সেই
আশ্চর্য গতিশীল গানটি আমরা অনেকেই শুনেছি ... ‘এল নন্দের নন্দন
নবঘন শ্যাম / এল যশোদা নয়নমনি নয়নাভিরাম / প্রেম রাধার মন নব বঙ্কিম
ঠাম / চির রাখাল গোকূলে এল ... কৃষ্ণজী কৃষ্ণজী কৃষ্ণজী কৃষ্ণজী ’
...এবং এই ‘ কৃষ্ণজী’, ‘ কৃষ্ণজী’-এই ক্বোরসটি অনেকটা কাওয়ালী
ঢংয়ের। ইসলামের নবীকে নিয়ে নজরুল যেমন কাওয়ালী ঢংয়ে গেয়েছেন, ‘সে
যে আমার কামলিওয়ালা, কামলিওয়ালা’ ... সেই রকমই কৃষ্ণকে নিয়ে
গেয়েছেন: ‘কৃষ্ণজী’, ‘কৃষ্ণজী’, এবং নজরুলের কৃষ্ণবাদী এ আবেগ
আরোপিত নয়, বরং স্বতঃস্ফূর্ত ও সত্য। কেননা নজরুলের স্পর্শকাতর
মানস বহু বর্ণিল ভারতীয় ঐতিহ্যে লালিত। হাজার বছর ধরে ভারতীয়
সংস্কৃতি মূলত বহুস্রোতে বহমান। জীবনভর তাঁর গানে, তাঁর কবিতায়
নজরুল এই বহুমাত্রিক বিচিত্র জীবনধারাকে মেলানোর সাধনা করেছেন ।
গানেও নজরুল সে প্রমাণই দিয়েছেন।
তিমির-বিদারী অলখ-বিহারী প্রথমেই কৃষ্ণর
সংজ্ঞা নির্ধারন করেছেন, যিনি অন্ধকার দূর করেন, অদৃশ্যে বিচরণ করেন। তবে
তাঁর হাতে একটি বাঁশী রয়েছে। নজরুলও বাঁশী বাজাতেন। যিনি অন্ধকার দূর করেন
এবং অদৃশ্যে বিচরণ করেন তার সঙ্গে সাধারন মানুষের দূরত্ব তৈরি হতে পারে;
তবে, তাঁর হাতে একটি বাঁশী নিয়ে তিনি যান মানুষের কাছাকাছি চলে আসেন।
কৃষ্ণকে নজরুল বলেছেন, কালো রাখাল, যিনি অন্ধকার দূর করেন, যিনি অদৃশ্যে
বিচরণ করেন-সেই ‘কৃষ্ণ-মুরারী’ আসছেন। তাতে, অর্গল টুটে যাবে। এ জন্যই
‘নিখিল’ বিশ্ব পাগল হয়ে অপেক্ষায় রয়েছে।
তিমির-বিদারী অলখ-বিহারী সর্বসহা আজি
সর্বজয়ী। যারা সহ্য করে তারা সর্বজয়ী হবে। কবি কৃষ্ণর জীবনের ভবিষ্যৎবানী
করছেন। কৃষ্ণ, বিষ্ণুর অষ্টম অবতাররূপে উত্তরভারতের মথুরা দেবকী-বসুদেবের
ঘরে জন্মাবেন। মথুরার রাজা কংস মূতিমার্ন স্বৈরাচারী। স্বীয় পিতা উগ্রসেনকে
কারাগারে আটক করে রেখেছেন। কংস সম্পর্কে কৃষ্ণর মাতুল। কংস জানতে পারে
‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।’ সুতরাং কংস মথুরা শিশুহত্যার
সিদ্ধান্ত নেন।শিশু কৃষ্ণকে তখন গোকুলে নন্দ-যশোদার ঘরে রেখে আসেন। ছোট্ট
এক শিশুর কত বিড়ম্বনা! যে কারণে নজরুল লিখেছেন: ‘ সর্বসহা আজি সর্বজয়ী।’ বহিছে উজান
অশ্রু-যমুনায় ‘বহিছে উজান
অশ্রু-যমুনায়’ অসম্ভব সুন্দর একটি রূপকাশ্রয়ী চরণ। কিন্তু ‘ অশ্রু-যমুনায়’
কেন? শ্রীকৃষ্ণের জন্ম যমুনাপাড়ের মথুরায়। তারই জন্মসংবাদে যমুনায় উজানে
আনন্দের অশ্রু বইছে। এবং-হৃদি-বৃন্দাবনে আনন্দ ডাকে, ‘আয়,’.কৃষ্ণর
পালক-মাতা যশোদা। যশোদা শব্দের আগে ‘বসুধা’ শব্দটির প্রয়োগ
লক্ষণীয়। বসুধা
মানে পৃথিবী। কবি কি যশোদাকে পৃথিবী বলছেন? মাতৃস্নেহে কৃষ্ণকে লালন
করেছিলেন বলে? তাহলে কৃষ্ণ =মানবতা বা মানবকূল। সেই মা-পৃথিবী গোপাল (বালক
কৃষ্ণ) কে লালন করেছেন। সেই চরণটি স্মরণ করি: ‘সর্বসহা আজি সর্বজয়ী।’
সর্বসহা মা-পৃথিবী যশোদা বালক কৃষ্ণ কে লালন করে সর্বজয়ী হয়েছেন। কিংবা
আমাদের প্রতি এটি নজরুলের উপদেশ। যারা সহ্য করে তারা সর্বজয়ী হবে।
যমুনাপাড়ের গোকূলে
বালক কৃষ্ণ গোপাল গরু নিয়ে মাঠে যেত। দিনভর নেচে গেয়ে খেলে বেড়াত। সেই
অভূতপূর্ব দৃশ্যের বর্ণনায় নজরুল লিখেছেন একটি মনোরম চরণ:
কাল-রাখাল নাচে থৈ-তা-থৈ। কাল-রাখাল=কালো রাখাল। কৃষ্ণকে কালো রাখাল বলা
একমাত্র নজরুলের পক্ষেই সম্ভব। কালো রাখাল বলায় কৃষ্ণ আরও প্রাণের কাছাকাছি
চলে এল এরপর নজরুল বলছেন: বিশ্ব ভরি’
ওঠে স্তব নমো নমঃ এমন বিরাটের
আগমনে বিশ্ব ভরে উঠছে স্তবে, বন্দনায়। অরির পুরী-মাঝে এলো অরিন্দম। অর্থাৎ
অন্ধকার রাজ্যে সুন্দর আলোকিত মানুষ এসেছেন। স্বৈরাচারী মথুরারাজ কংসের
কারাগারে কৃষ্ণের মাতা-পিতা দেবকী-বসুদেবকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। সে
প্রসঙ্গে নজরুল লিখেছেন: ঘিরিয়া
দ্বার বৃথা জাগে প্রহরী জন কৃষ্ণ আসলে মুক্তির প্রতীক। মানবতার প্রতীক। এবং মানবতার মুক্তি অনিবার্য। নজরুলের এই কৃষ্ণবাদী গান সে কথাই যেন ফুটে উঠেছে। মানবতার সেই অনিবার্য মুক্তি অর্জনের পথে নজরুল একটি যাদুবাক্য আমাদের মনে রাখতে হবেঃ ‘সর্বসহা আজি সর্বজয়ী ... ***
............ খোঁপায় তারার ফুল ............ শায়মা খায়রুল আনামের কন্ঠে লিংক https://www.youtube.com/watch?v=T0U7BhEr3BU মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী , দেবো খোঁপায় তারার ফুল কর্ণে দুলাবো তৃতীয়া তিথির চৈতী চাঁদের দুল......
নজরুলের যে গানটি শুনলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে জ্যোস্নাস্নাত মায়াবী নীলাকাশ। যার জমিনে হাজারো রুপোলী তারার ঝিকিমিকি। নিঝুম রাত। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একজোড়া প্রেমিক প্রেমিকা। প্রেমিকটি প্রেমিকাকে সাজিয়ে চলেছে অসম্ভব দুর্লভ কিছু মনোমোহিনী রুপকথাময় সাজ সজ্জায়। যে সাজ ও সজ্জা ইহজগতে সহজ লভ্য নয়। সে শুধু রুপকথার রাজকুমারীদেরই প্রাপ্য। এমন সব দুর্লভ সাজেই যেন সাজিয়ে চলেছে সেই প্রেমিক প্রবর তার ভালোবাসার দেবীকে। কাজী নজরুল ইসলাম রচিত এই গানটি লেখার আদি উৎস রূপ বেশ চমকপ্রদ। আব্বাসউদ্দীন 'আমার শিল্পী জীবনের কথা' বইটিতে লিখেছেন, একদিন কবি ও আরো কয়েকজন শিল্পী গ্রামোফোন কম্পানিতে বসে গল্প করছিলেন। এমন সময় কথাচ্ছলে প্রশ্ন উঠলো যদি কেউ একলাখ টাকা লটারিতে পেয়ে যায় তবে কে কার প্রিয়াকে কেমন ভাবে সাজাবেন। কেউ কমলালয় স্টোর্সে যেতে চাইলেন, কেউ আবার সুইৎজারল্যান্ড। কিন্তু কবি খাতা কলম নিয়ে বসে গেলেন তার প্রিয়াকে সাজাতে। মুগ্ধ হলাম এতদিন পরেও কবিমনের এ পরিচয় পেয়ে। সত্যিই এ সাজ কি লক্ষ কোটি টাকাতেও হয়? হয়না । এ সাজের জন্য চাই একটি রূপকথা মন। মনে পড়ে আমার মায়ের কথা। আমি যখন খুব ছোট তখন মাকে প্রায়ই হারমোনিয়াম বাজিয়ে বিকেল বেলা গান গাইতে দেখতাম ও শুনতাম। এর মাঝে দুটি গান আমার কখনও ভোলা হলোনা।
এক আমারও ঘরের মলিন দ্বীপালোকে জল দেখেছি প্রিয় তোমারি চোখে।
খুব ছোট ছিলাম আমি কিন্তু গানটির বাণী আমার চোখে জল টলমল সরবোর বানিয়ে দিতো। আর একটি গান ছিলো-
আসে বসন্ত ফুলবনে সাজে বনভূমি সুন্দরী। চরণে পায়েলা রুমুঝুমু মধুপ উঠিছে গুন্জরী।
গানটি শুনে মনে নিশ্চয় এমনি একটি দৃশ্যই ফুটে ওঠে যে, ফুলমন্জরী বিভূষিত বনভূমিতে নূপুর পায়ে রুমঝুম নেচে চলেছে কোনো রূপসী অথবা কোনো ছায়া ছায়া রহস্যে ঘেরা অপরূপা বনদেবী, যাকে দেখা যায়না চর্মচক্ষুতে, ছোঁয়াও যায়না, শুধু মনের চোখেই অনুভব করা যায়।
ফিরোজা বেগমের কন্ঠে গানের লিংক https://www.youtube.com/watch?v=mC42coix49Y
আশ্চর্য্যের বিষয় হলো এ গানটির আদি ইতিহাসও ঠিক এমনটাই। ১৯৩৩ সালে অগ্রহায়নের এক সন্ধ্যায় মিশরীয় নর্তকী মিস ফরিদা আলফ্রেড রঙ্গমন্চে নাচ দেখাতে আসেন। উর্দূ গজল 'কিস কি খায়রো ম্যায় নাজনে, কবরো মে দিল হিলা দিয়া' গানটির সাথে নাচটি নজরুলের মনে যে ভাবের সঞ্চার হয়েছিল তারই প্রতিফলন 'আসে বসন্ত ফুলবনে' গানটি। আসলেই তো, চোখের সামনে গানের মধ্য দিয়ে নেচে যায় রঙ্গমন্চের সেই মনমোহিনী নর্তকী। মন্চ তার পুরো ফুলভূমি সজ্জিত বনতল। বিমোহিত করে তার রূপ ও নৃত্যের ছন্দে আমাকেও চুপিচুপি।
আরেকটি গান, স্নিগ্ধ শ্যাম বেণী বর্ণা , এসো মালবিকা। গানটি বাজলে আমার চোখে ঘোর ঘনায়। আমি এক নিমিষে ফিরে যাই সেই ছোট্ট বেলার নৃত্য মন্চে। ধূপ জ্বালা ধোয়া ধোয়া সেই আলোছায়া। চোখ জ্বলে যাচ্ছিলো তবুও এক অপার্থিব ঘোরের মাঝেই নেচে চলেছিলাম সেদিন। নকল চুল জোড়া দিয়ে বড় বেণী । কানে গুঁজে দেওয়া একগোছা গন্ধরাজ ফুল আর নীল মেঘরঙ শাড়ী। মা সাজিয়ে দিয়েছিলেন সব। আমি মনে হয় মেঘের দেশেই চলে গিয়েছিলাম সেদিন হতে । আজও ফিরিনি ।
এই গানটার আদি ইতিহাসটা মাঝে মাঝে আমার আরেক প্রিয় বৃষ্টিপ্রেমী বন্ধুর ভাবাবেগের সাথে মিলে মিশে যায়। মানে তার বৃষ্টি প্রেম আর সেই নিয়ে কাব্য রচনার গল্প শুনে শুনে। সে যাই হোক, ইতিহাসটা বলি, একদিন জৈষ্ঠ্যের এক শেষ বিকেলে আকাশ কালো করে মেঘ জমে উঠলো। গ্রামোফোন রুমের হৈহুল্লোড়ের মধ্যে এক মুহূর্তে কবি গম্ভীর হয়ে গেলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই লিখে ফেললেন এই অপূর্ব গানটি । আসন্ন বর্ষার আহ্বান গীতি। সঙ্গে সঙ্গে সুরোযোজিত হলো। ১৩৪০ সালের পৌষ সংখ্যায় গানটি প্রকাশিত হয় ও পরে 'গানের মালা' গ্রন্থে সংকলিত হয়।
কুমিল্লার দৌলতপুর নিবাসী আলী আকবার খানের ভাগ্নী নার্গিস খানমের সাথে নজরুলের বিয়ে হয়েছিলো ১৩২৮ সালের ৩ আষাঢ়। এ বিয়ে সফল হয়নি। বিয়ের দিন রাতেই কবি পায়ে হেঁটে চলে আসেন সে বাড়ি হতে। এরপর তার সাথে কবির আর দেখা হয়নি তবে ষোলো বছর পরে নার্গিস কবিকে একখানি চিঠি লিখেন। ১০৬ আপার চিৎপুর রোডে গ্রামোফোন কম্পানির রিহার্সেল রুমে বসে বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়কে কবি চিঠিখানি পড়তে দেন। বন্ধুর অনুরোধে কবি চিঠিখানির উত্তর লিখতে গিয়ে লিখে ফেলেন এই গানটি-
যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই কেনো মনে রাখো তারে? ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে....
মানবেন্দ্র মুখার্জীর কন্ঠে গানের লিংক https://www.youtube.com/watch?v=5UJ2PIerOhE
আরেকটি গান
দারুণ পিপাসায় মায়া মরীচিকায়.... চাহিতে এলি জল বনের হরিণী দগ্ধ মরুতল, কে তোরে দেবে জল, ঝরিবে আঁখি নীর তোরই নিশিদিনই।
শান্তিপদ সিংহের সাথে একদিন বিকেলে মনোমোহন থিয়েটারে যাবার সময় ইন্টালী মার্কেটের কাছে এক অপরূপা রূপসী ভিখারিনীকে দেখে কবি অবাক হন। শান্তিপদ জানান এক বড় পুলিশ অফিসারের ছেলের প্রেমে পড়ে মেয়েটি ঘরছাড়া। মেয়েটির ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া আর এখন কিছুই করার নেই। কবির মন ব্যথায় মুচড়ে ওঠে । সেদিন রাতে ঘরে ফিরেই তিনি রচনা করেন এই গানটি। কেন তুই বনফুল, বিলাস কাননে করিয়া পথভুল এলি অকারণে... সন্ধ্যা গোধূলীর রাঙা রূপে ভুলি আসিলি এ কোথায় তমসার কূলে...
কাজী নজরুল ইসলাম একজন প্রেমিক কবি আর তাই তাঁর প্রায় সকল বিরহ মিশ্রিত প্রেমের কবিতায় যন্ত্রণা কাতর প্রেমিক হৃদয়ের আকুতিই বার বার ফুটে ওঠে। ***
‘চারিদিকে মোর উড়িছে কেবল শুকানো পাতার মলিন ফুলদল।’ নজরুলের একটি গান ইমন জুবায়ের অনুরাধা পাডোয়ালের কন্ঠে গানের লিংক https://www.youtube.com/watch?v=OSakFM7FvM8 কাজী নজরুল ইসলাম। কবির শেষ জীবনের ছবি। এত বয়সেও চোখের কৌতুহলজ্যোতি নিভে নাই। জীবনের কোনও অবস্থাতেও চোখের কৌতুহলের জ্যোতি যেন ম্লান না হয়ে আসে আমাদের প্রতি কবির এই অনিবার্য নির্দেশ। এখন তো বাঙালির অনভিপ্রেত দুর্যোগের কাল চলছে। হিরণময় জ্যোতির্ময় কাজী নজরুল ইসলাম এইক্ষণে আমাদের সহায় হোন-ভরসাস্থল হোন। এই প্রার্থনা।
হারানো হিয়ার
নিকুঞ্জপথে কুড়াই ঝরা ফুল একলা আমি। বিরহের গান। কিন্তু, প্রথম লাইনেই হোঁটচ হেতে হয়। ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে’-এই কথাটাই কেমন রহস্যময়। নিকুঞ্জপথে মানে বাগানের পথ। সেখানে কেউ ফুল কুড়াচ্ছে। কিন্তু, হারানো হিয়ার কেন? রহস্য এখানেই। তাই বলছিলাম:‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে’-এই কথাটাই কেমন রহস্যময়। ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে’-এই কথার ইংরেজি কী হবে? Garden path of lost heart? লস্ট হার্ট? ছবিটা ঝাপসা এখানেই। যেন, বাস্তবে ঘটছে না কিছুই। সবই বিবর্ণ স্বপ্ন দৃশ্য। এই গানটি নজরুল কত সালে লিখেছিলেন? সঠিক বলতে পারি না। কিন্তু, সাহিত্য অলোচনায় ‘সুরিয়ালিজম’ নামক একটি শব্দ ততদিনে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে বলাতে সবটাই পরাবাস্তব বলে ভ্রম হয়। গানটির দৃশ্যকল্পও কেমন স্বপ্নময়। তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন,
হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে কুড়াই ঝরা ফুল
একলা আমি।
সুখের সরগ (স্বর্গ) বলাতে রহস্য ঘনিভূত
হয়েছে। মনে হয় কেউ শূন্য হতে মর্ত্যলোকে নেমে এসেছে। যে এলো তাকে অবেলার
পথিক বেভুল বলে সম্বোধন করা হয়েছে।
কী দিয়ে বরণ করি ও চরণ নিভিছে জীবন
জীবনস্বামী।
হারানো প্রেমিককে বরণ করতে চাচ্ছে;
পারছে না। কেননা, জীবন নিভে যাচেছ।
কথাও হচ্ছে। তারপরও সবই কেমন আবছা,
ম্লান। এই সুরিয়ালিস্ট নজরুলের আপন বৈশিষ্ট্য। তাই বলছিলাম, রবীন্দ্রবলয়ে
বেঁচে থেকেও বাংলা গানকে নিজস্ব শৈলী ও আঙ্গিকে এক লোকোত্তর স্তরে পৌঁছে
দিয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম। যে গানের তাৎপর্য এই একুশ শতকেও ম্লান তো নয়ই
বরং নজরুলের গানের দিকে নতুন ভাবে আজও তাকানো যায়। ফেরদৌস আরার কন্ঠে গানটির লিঙ্ক https://www.youtube.com/watch?v=m6MB7ueMeBQ ***
যথারীতি প্রকাশনা ধারাবাহিক গল্প
পৃথিবীলোক একাধিক একা সুখের লাগিয়া প্রবন্ধ * * * * * * * * * * |
Best view
with Microsoft Internet Explorer
font download link
http://omicronlab.com/download/fonts/SolaimanLipi_20-04-07.ttf