আমার শহর

 


 

 

 

১.


শহরটা চোখের সামনে বদলে যাচ্ছে। অথচ আমরা
কিছুই করতে পারছি না। রাস্তা-ঘাট, দালান-কোঠা, সবজি বাগান,
হলদে রৌদ্র, কি নির্মম ভাবে বদলে যাচ্ছে। অথচ আমরা...।
আমি তো এই শহরেই আছি, কোথাও যাই নি; কিম্বা
বার-চৌদ্দ বৎসর পর ফিরে আসা নই; তবুও
শহরের এই উন্নাসিক পরিবর্তন টের পাচ্ছি। শহরের মানুষগুলো,
আমার বন্ধুরাও ঠিক বদলে যাচ্ছে শহরের সাথে
পাল্লা দিয়ে। আমি শুধু পুরোনো বাতিঘরের মতোন, প্রাচীন দ্বার রক্ষীর
মতোন, দেবনাগরীয় ভাষার চিত্রকল্পের মতোন ক্ষয়িষ্ণুতায়
গা এলিয়ে পরিবর্তনহীন পড়ে আছি একা, নিঝুম!
 

 

 

২.
এ শহরে এখন রাত্রি ঘুমায় না। এ শহর এখন বারবনিতার ঘরে রাত কাটায় বিনিদ্র।
অনিদ্রায় ভুগছে এ শহর দীর্ঘ দিন। এ শহর জেগে উঠে সারা দুপুর ঘুমায়।
এ শহরের অলিতে-গলিতে বেড়েছে সফেদ পাঞ্জাবীর ঢল। পবিত্র কেতাবের
অলৌকিক ভাষায় এখন লেখা হয় দেওয়াল লিখন : ' পুরুষই নারীর জান মালের...'
এ শহরে রমনীরা অনিদ্রায় ভুগছে দীর্ঘদিন পুরুষেরই হেফাজতে!


৩.
আমাদের জন্যে এটি একটি দুর্ভাবনার শহর, শুধুই দুর্ঘটনার। সবকিছুই
অনিশ্চিত আমাদের জীবন যাত্রায়। তরল জ্যোৎস্না বাষ্প হয়ে উড়ে গ্যাছে
কবে। প্রবল প্লাবণের মতো এই ছিন্নভিন্ন শহর; প্রেমিকার শরীর থেকে
মুছে গ্যাছে কুয়াশার নিবিড় গন্ধ। মধ্যযুগে ফিরে যাওয়ার আয়োজনে
ব্যাস্ত কালো ধোঁয়ার উৎসমুখ এখন আমাদের শহর।
 

৪.
অশুভ প্রেতাত্মার মতোন অনটন ছড়িয়ে আছে এ শহরের প্রান্তে প্রান্তে
 

 

৫.
সব জ্ঞানই সত্য নয় জেনে অবিশ্বাসী হয় এ শহরের এক বিতৃষ্ণ যুবক
কয়েক মুঠো অন্ধকারের চিত্রকল্প দিয়ে চন্দ্রিমা মুছে দেওয়া যায় না
বাতিওয়ালা চলে গ্যাছেন কবে এই শহর ছেড়ে; শুধু বিতৃষ্ণ সেই যুবক
বসে আছে শহরের বিবর্ন জোছনায় এক খন্ড কবিতা হাতে নিয়ে।

 

১৭.০৬.০৮

 

 

 

 

 

 

 

 

 
     

নাগরিক শয্যা (সমুদ্র পর্ব)

 

সে কি মোর তরে পথ চাহে
সে কি বিরহ গীত গাহে...



অচেনা বন্দরে প্রেম কঙ্কাল হয়; আমরা সরে যাই পরস্পর থেকে। বিচ্ছিন্ন হওয়ার মতো আনন্দ আর নেই- বিষ্ময়ে যেনে যাই।

তাদের চোখের রেখায় দুরন্তপনাই ছিল বেশী। নাবিক তাই জ্যামিতিক হিসাবে বড় রকম ভূল করে ফেলে; জাহাজ পশ্চিম থেকে ক্রমশঃ ভীড়ছে উত্তরে- কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই।

রাতের রেস্তোরায় অভিনিবেশ ঘটে খুব। নদীর জলের শব্দে আহত হয় দেশী মদের বোতল। হাতের তালুতে নদীর ভিন্নরকম চিত্রকল্পের আভাস; নারীর শয্যায় তাদের স্বামীরা এতদিনকার বকেয়া গোনে।

অচেনা বন্দর চেনা হয়ে যায়; সুতরাং অচেনার উদ্দেশ্যে আবার যাত্রা শুরু; সন্তরনপটু জাহাজ নাবিকের ইশারা বোঝে ঠিক ঠিক। দুরত্ব কেবলি বাড়ে।

বন্দরের মেঝেতে থেকে যায় শুধু ক্লান্ত নাবিকের হৃদয়ের খন্ড দলিল।

 

০৯.১০.০৮

 

 

 

 

 

নাগরিক শয্যা (একজন অপ্রকৃতস্থ কবি)

 

টেবিলে কবির নিজস্ব সম্রাজ্য নথিভুক্ত হয়। এই নাট্যাভিনয়ে দর্শক: একটি অ্যাশট্রে, একটি মধ্যরাতের মগ আর একটি লাল পিপড়ার সারিবদ্ধতা--;

যে কবিতাটি লেখা হচ্ছে সেটি না লিখলে বিশেষ ক্ষতি হতো না আমাদের; অর্থাৎ পৃথিবীর। তবু অশেষ মেধাশ্রমে কবি এইমাত্র যে জ্যামিতি সৃষ্টি করলেন তার জন্য তিনি ঘনিষ্ঠ নারীর সঙ্গে অবলীলায় বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন কোনরকম অপরাধবোধ ছাড়াই; সমস্ত মানবিকতার মুখে থকথকে থুথু দিয়ে চলে যেতে পারেন নিশ্চিন্ত পানাহারে। কবি তার সমস্ত জীবন মধুর আলস্যে কাটাতে পারতেন যদি তা কবিতা জন্মের সহায়ক হতো!

কবিতাকে নারীর সমমর্যাদা দিতে পৃথিবীর তাবৎ কবি নারীকে নিজ শয্যায় নিয়ে গিয়ে প্রকারান্তরে আত্মহত্যায় অনুপ্রাণিত করেন? নারী তখন কবির চোখে থরোথরো প্রেম রেখে কামহীন অন্ধকারে দ্রবীভূত হয়ে যায়। কবি শরীরে কামের গন্ধ নিয়ে ঘাম আর বীর্যস্খলনোৎসবের মধ্যদিয়ে নতুন রাজ্যপাটে অভিষিক্ত হন।

পৃথিবীর সমস্ত কবিতাই আসলে নারীর চোখের জলের মতোই টলটলে- কবি ভাবেন।

২০.১০.০৮

 

 

নাগরিক শয্যা (প্রেমিক পর্ব)

 

 

শেষ দরজায় কড়া নাড়া হয়ে গ্যাছে-
দ্রোহী, তুমি প্রেমিক হও
প্রেমিকেরা আজ ক্লীববৎ

চিরস্থায়ি নৈঃসর্গ ভেবে নিয়ে আলোহীন তাবৎ প্রেমিক
মুষ্ঠিবদ্ধ হাত থেকে দূরে নিষাদের সহমর্মী হয়;
রমনক্লান্ত এই সভ্যতা বাণিজ্যিক নিয়মে
নিজের ভিতরে ক্লৈবত্য বেড়ে ওঠা দ্যাখে নির্বিকার।
পিঠ চাপড়ানো আশ্বাসে জুয়ার টেবিলে উজ্জ্বল হয় নীল ঘুঁটি
আমাদের নীল রঙের ঘুঁটি- ব্রীজের পাতায় ব্যাথায় নীল হয় রাশান গোলাম
শেষ চাল আর বাকী- এখনও গ্লাস ধোঁয়ায় পূর্ণ হয় নি।
তবু সঙ্গম-প্রিয় প্রেমিকেরা শয্যার প্রতি অনাস্থা আনে
কক্ষ জুড়ে নামে শীতনিদ্রার ধুম- দ্রোহী,

প্রনয়ের মোহন খিলান খুলে ক্লীবদের রক্ষা দাও তুমি।

 

২৬.১০.০৮

 

   
  কবির মুখ

কবির মুখ সবুজ কার্পেট
স্বচ্ছ হ্রদের কাছে বিকেলের শিশির ঘাঁস
নরোম পদাঙ্ক তার বক্ষ জুড়ে
জেগে থাকে সারা রাত- চায়ের আলস্য
তার সুঘ্রান ছড়ায় অবিরাম প্রভাতময়

পথিকেরা নীল ঘুড়ির নাটাই মগডালে
ঝুলে থাকা দেখে- কালো সর্প
সেই ঘুড়ি কিনে নেয় জলের দরে
তারপর একদিন নীল ভাসে
আকাশে আর পৃথিবীর জলে

কবি তার মুখ দেখে জলের আয়নায়
বুক জুড়ে হিমাঙ্কের বিকেল নামে
বিকেলের বিষন্ন রোদ পড়ে জলে
সেই জল ফিরে যায় হ্রদের স্বচ্ছ কার্পেট ছুঁয়ে

নরোম পদাঙ্ক তার রাতভর গুঞ্জন করে;



(...ঈর্ষায় সবুজ হয়ে উঠছি।, এরকম একটি বাক্যাংশ মনে রেখে)

০৫.১১.০৮

 

 
(একটি পুরোনো কবিতা; হঠাৎ মনে পড়ে গ্যালো)

বিষাদোত্তীর্ণ কিছু অক্ষর

আমি স্তিমিত হই বিষয় ও বিন্যাশে

গত শতকের অপরিশোধিত ঋণের কথা জানাজানি হলে পর
তীব্র শীত নেমে আসে সন্তর্পণে;
স্নায়বিক জগৎ আমার-
ভীষন 'না' এর মতো রাত্রি এক; তার পাশে
স্খলিত জলপাই হামাগুড়ি দ্যায় প্রবল রোদে।
তুমিও রোদ পোহাতে এসো এমন
আমার অগোচরে;

আমার জড়ানো কন্ঠ-
আমার মৃতবৎ জেগে থাকা-
কিছুই দেখে না। কিছুই জানে না।
বোঝানোর কিছু নেই জেনে
কিছুই বোঝে না ঋণ সংক্রান্ত এই বিষাদোত্তীর্ণ অক্ষরের।

 

০২.১২.০৮

   
     
     

 

নিজেক যখন এক

 
নিজেকে যখন একা, খুব একা মনে হয়-
ভাঙ্গা জানলার মতো বিষন্নতা নেমে আসে মনে
ভাবনার গহ্বরে অস্তমান সূর্যের মতো দেখি তোরই
বিজন উপস্থিতি; বন্ধু,
নির্জন সুহৃদ আমার,
প্রথম কবে দেখা আমাদের
অথবা প্রথম পরিচয়ের হিরন্ময় ভোর
(
স্মৃতিধূসর আমি, গিয়েছি ভুলে)
স্মরণে কি আছে তোর?
মনে পড়ে, আমার কবিতা লেখার প্রথম প্রহরে
প্রনয়াক্রান্ত অমল কিশোরের মতো
আনত লজ্জা নিয়ে গিয়েছি ছুটে তোরই নিকট
সদ্য ভূমিষ্ঠ কবিতা নিয়ে হাতে দারুণ উৎসুক;
চশমার ভারী কাঁচের ওদিক থেকে
আমার কবিতায় তোর নিবন্ধিত দৃষ্টিকে
মনে হতো, সময়ের ওপাড় থেকে
কোন মুগ্ধ নয়না তাকিয়ে রয়েছে যেন আমারই দিকে-
বুকে তার শতাব্দি কাঁপানো প্রেম থরো থরো

মনে আছে তোর প্রথম মিছিল আমার?
আমার প্রথম আর্তনাদের
কী কাতরই না হয়েছিলি তুই। তোর শীতল পদাবলীতে
উঠেছিল কেঁপে অচেনা ঘাতকের বিরুদ্ধে ক্ষোভজাগ্রত পরোয়ানা মৃত্যুর।
একসাথে জ্যোৎস্নার আমন্ত্রণে
দারুণ ক্ষুধার্ত চোখে কত মধ্যরাত্রি করেছি সাবাড়
তুই আর আমি

মনে কি আছে আজো সেই বিবর্ণ গোধূলীর লজ্জা?
বান্ধবহীন- তুই আর আমি- আমরা
অসহায় সন্ধ্যা নিয়ে বুকে অভিমানে জ্বলে উঠেছিলাম
বিধ্বস্ত ছাপাখানার অন্ধকার গুহায়
কবিতা নাম্নী অশ্বের আস্তাবলের খোঁজে; অথবা
ফেব্রুয়ারির সেই হিম রাত্রি? কবিতা তখন পলাতক-
নিঃসঙ্গ এক সিসিফাস কড়া নেড়েছিল
দাঁতল নেকড়ের খাঁচায়- রক্তাক্ত প্রগতি
সভ্যতার জনাকীর্ণ উঠোনে...

হে বান্ধব, হে ব্যর্থতার সহপাঠী,
হে অনুজ্জ্বল শোভাসঙ্গী আমার,
আজও শহরের পরিচিত
সড়কে, দালানে, বিপন্ন বৃক্ষে, বিলবোর্ডে
খুঁজে চলি তোকে আর অভিমান ঋদ্ধ পংক্তিমালা তোর;
সুদূর জনারণ্যের অপ্রসন্ন অবসরে যদি
আমার স্মরণে তোর কন্দরে না ওঠে ঝড়
যদি না ঝরে বৃষ্টি তোর
ব্যক্তিগত আষাঢ়ে- ক্ষতি নেই; আমি
তবু শহুরে রাত্রির নিয়ন আলোর বৃষ্টিতে ভিজে অনুবাদ করে যাবো
ক্ষমাহীন ব্যর্থ পদাবলী তোর আর আমার
একা একা...

 

 

(বন্ধুবর কবি হাবীব ইমনের ২৫তম জন্মদিনে লেখা)

 ১২.০৩.০৮

 

 

আপনি যেভাবে ব্যর্থ হয়েছেন

 (হুমায়ুন আজাদ স্মরণে)

আপনার কবর নুয়ে চুমু খাবেনা নক্ষত্রেরা; আপনার
কবরে ভালোবেসে গজাবেনা তৃনদল। আপনি জানতেন
এইসব অর্থহীন ভাবালুতা মাত্র। কবরে আপনা আপনিই
জমে আবর্জনা অথবা ফোঁটে ঘাঁসফুল। জীবনের প্রতিটি
নিঃশ্বাসে রচনার প্রতিটি পংক্তিতে আপনি
অস্বীকার করেছেন যে সকল মিথ্যাকে, আপনার মৃত্যুর পর
আপনারই সন্ততিরা সেই মিথ্যার জন্য অথর্ব রাষ্ট্রের নিকট
চাইলো রাষ্ট্রীয় ভিক্ষা। জীবন প্রণালীতে অথবা রচনাতে
যে সত্যের নির্মম আরাধনায় আপনি মৃত্যুপণ নিয়োজিত ছিলেন
মুত্যুর পর আপনার অসহায় অর্থহীন মৃতদেহের
সামনে দাঁড়িয়ে আপনারই প্রাজ্ঞ উত্তরাধিকার আপনাকে,
আপনার কর্ম সমূহকে সম্পুর্ণ ব্যর্থ করে দিয়ে
মহান মিথ্যার কাছে মৃত্যু-পরবর্তি শান্তি করল কামনা
জনসভার মতোন মানুষের বিশাল অরণ্যে। আর ঠিক
সেই মুহূর্তে তাৎপর্যহীন কবরে শায়িত হওয়ার কিছু পূর্বে
শহরের সবচেয়ে স্বচ্চতম আলোক গুচ্ছটিকে অবাক করে দিয়ে
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিয় উম্মুক্ত প্রাঙ্গনে পরাজিত

সম্রাটের মতোন শোচনীয় ভাবে ব্যর্থ হলেন আপনি।

 

০৫.০৬.০৮

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মিছিল

আর কোথাও মানুষ দেখিনা-
কোথাও কোন মানুষ নেই-
-কেউ কি ছিল-
মিছিল দেখি- কোন স্বপ্ন নেই- শুধুই
মিছিল দেখি- মিছিলে তোমাদের মুখ-
অচেনা ভাষায় চিৎকার শুনি- কোন
অর্থবহ শ্লোগাণ শুনিনা- কোন স্বপ্নের
ধ্বনি নেই- অগ্রসরমান কোন প্রত্যয় নেই-
মিছিলে- তোমাদের মুখের রেখা নেই- ভাঁজ করা
মুখে ড্রাগনের মুখ দেখি- মানুষ- শ্লোগাণ-
কিছুই দেখিনা। তোমাদের মিছিলে কোন
স্বপ্ন নেই- কোন সৌন্দর্য নেই- বোধের উন্মেষ
নেই- শিশুর হাসির মতো শব্দ নেই- মানুষের
বিপরীতে- এক পাল শাদা মানুষ- তোমরা- অন্ধকারের
দিকে- সভ্যতাহীনতার দিকে- তোমাদের মিছিল।

তোমরা,
কতটা নিঃসর্গের দামে মিছিল নামক এই উন্মত্ততা থামাবে, বলো?

১৪.১২.০৮