সুবেশ প্রতিদিনের সহজ পরিচিতের স্বরে বলে

 

প্রায়শই ভোরে দরজার কাছে খট্ খট্ শব্দ শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায়;
ভাবি, পত্রিকার ছেলেটা বুঝি- এত সকালে তো
তার আসবার কথা নয়; অস্বস্তিতে দরজা খুলে দেখি, ইন্সুরেন্স কোম্পানীর
সুবেশ প্রতিনিধির মতো একজন বেশ গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে
:
কী ব্যাপার, এত সকালে আপনি?


মনে ভাবি, কোন ইন্সুরেন্স তো আমি করিনি; অবশ্য
অনেক বছর আগে, তরুন বয়সে, প্রিয় বন্ধুর উৎসাহ এবঙ উদ্যোগে
একটা বীমা করেছিলাম; কিন্তু, আমারই উৎসাহহীনতায়
সেটি বহুবছর পূর্বেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। সেটির ব্যাপরে কি এসেছে
এই সুবেশ? যুগপৎ আশা এবঙ শঙ্কায় পুনর্বার জিগ্গেস করি,
:
আপনি কি ইন্সুরেন্সের পক্ষ থেকে এসেছেন?
:
না;
:
তবে কোন নতুন পন্যের বিজ্ঞাপন?
:
না;
:
তবে কি কোন প্রকাশনা সংস্থা থেকে?
:
না;
:
কোন বার, হোটেল, পলিটিক্যল পার্টি, নাইট ক্লাব,
কিম্বা কোন টক-শো? কোন গোল টেবিল?
:
না;

গম্ভীর মৌনতা ত্যাগ করে অবশেষে সুবেশ প্রতিদিনের সহজ পরিচিতের স্বরে বলে-
না, আমি দুঃসংবাদ;
আপনার এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম
ভাবলাম, দেখটা করেই যাই;

 

২৬.০৪.০৮


 

 

 

 

-বিচ্ছিন্ন পংক্তিমালা

 

আমি কি ছিলাম কবে হ্যামেলিনের বংশি বাদক?
পশ্চাতে অনুসৃত হয় কেবল
আমারই বিব্রত বিষন্ন শৈশব মুষিক;
*
অপেক্ষার আগে এরকম দুঃসহ হয়ে আসেনি
যে রকম আগে তুমি ভালোবেসে কাছে আসোনি
*
তোমার ওষ্ঠে আর কেউ চুমু খাবে
একি আমি মেনে নিতে পারি?
*
আমাকে নিয়েই ভাববে তুমি;
আমি তোমার দিন রাত্রি
সকাল অথবা দুপুর
আমিই তোমার প্রস্তাবিত পুরুষ
*
সর্বনাশ আসে কাছের মানুষের হাত ধরেই
*
তুমি সহসা তাকালে বলে
আমি বিনির্মান করেছি কবিতা
*
তোমার নাভীমুল আমার কবিতার কাছে বেশ ঋনী
তুমি দ্যাখোনি,
পূর্বে কতটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিলো ঐশী গুহা?
*
প্রলম্বিত হোক আমাদের এই নৈঃশব্দ্যিক প্রহর
শব্দহীন শুধু ছুঁয়ে যাও, শুধু ছুঁয়ে যাবো
*
বীটোফেন কখনও শোনেন নি প্রেয়সীর কামার্ত শীৎকার?
কন্ঠলগ্ন রমনীই আমাকে শুনিয়েছে শ্রেষ্ঠতর সিম্ফনী;
*
আবার আসন্ন বিষাদ
ভুলে যেতে চাই
ভুল করে তাই
পুনরায় ফিরে আসি অভিন্ন উপত্যকায়;
*
যদি ভুলে যাও কখনও আমার বাড়ির পথ
তাই বসতি গড়েছি তোমার অস্তিত্বে;
আঘাত দিও না নিজেরে বধু
তোমার দুঃখ জেনো আমারই দুঃখ
***
প্রাচীন পান্ডুলিপির মতো ম্লান হয়ে আসছে জীবনের তাবৎ সৌন্দর্য;
সুরা পাত্র মুখে নিয়ে বসে আছি, অবগুন্ঠন খোল এবার
নন্দিত হও কামাতুর নৃত্যে; ভাঁজে ভাঁজে দৃশ্যমান হোক যৌগিক
শুদ্ধতার সোনালী আগুন। রাত্রির পর্দায় ঋদ্ধ হবে বিলিয়মান বেহিসেবী যৌবন।

১৬.০৪.০৮

 

 

নয়টি পর্ব; দুইটি রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক

 

বোধ আর বিশ্বাসের মাঝখানে কোন শুণ্যতা থাকতে নেই; দুয়ের মধ্যে ভয়ানক শত্রুর মতো নিয়তই বেড়ে উঠতে হবে বিরুদ্ধতা নিরেট দেওয়াল। তবেই পৃথিবী প্রগতির দিকে আবর্তিত হতে পারে; রাস্তার নেড়ি কুকুরের কথা সত্যি হবে; কেননা সে জানে সেও প্রজননক্ষম;

ইঁদুরের হাত ধরে প্রথম কবিতা লেখা মানুষের; মানুষ এখনও ভুলেনি
পূর্বজর ঋণ এখনো শোধ করে চলে; এখনও গভীরেই যেতে চায়- ঠিক যত গভীরে ইঁদুরের নিবাস;

আমি আসলে বেড়াল গোত্রীয়; অথচ কী করে যে কবিতার মতো কিছু লিখে ফেলি; তবে কি গোত্রচ্যুত হয়ে গেছি একদিন-; কেউ জানে নি, কেউ বোঝেনি; শুধু এক কাদা-থকথকে বিকেল বেলা এক শব্দকর এসে বলেছিল: তুইতো বংশের মুখে চুনকালি দিবিরে হারামজাদি!

আজ সমস্ত দৈব অদৈব প্রজ্ঞা অতিক্রম করে আমি যে তালগাছটির নিচে এসে দাঁড়িয়েছি, সম্ভবত এরকম একটা তালগাছ দেখে রবীন্দ্রনাথ একদিন উৎফুল্ল হয়েছিলেন; অথচ আমি খুব বিষন্ন বোধ করছি; তবে কি রবীন্দ্রনাথ কিছুই বুঝতেন না; অথবা আমি ইতোমধ্যেই পরিত্যক্ত হয়ে পরেছি;- শরীরতো আর শতায়ু নয়;

অথবা তিনি খুব অন্যমনস্ক ভাবে ভিক্টোরিয়ার বুকে হাত রেখে আবৃত্তি করছিলেন: শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি...

সড়কের ঠিক কাছে আমার বাড়িটা; বাড়িতে যে থাকে তাকে আমি প্রতিদিন বলে আসি আমাকে যেন ঘুম থেকে না জাগায়; কিন্তু কোনদিনই সে এই অনুরোধটা রাখতো না; রাখতো না বলছি এই কারণে যে, সে এখন আর জীবিত নয়; গতরাতে আত্মহত্যার অনুপ্রেরণা দেওয়ার ঠিক পনের মিনিটের মাথায় আমি তাকে নক্ষত্রের সাথে ঝুলতে দেখেছি।

মানুষেরতো কখনওই ফেরা হয় না; ফিরে আসে কেবল স্মৃতি আরেক
মানুষের নিকট; মানুষতো বিলীন হয় শুধু মৃত্তিকায় সমস্ত প্রাজ্ঞতা সমেত।
চোখ কান খোলা রেখে হয়তো কিছু সান্ধ্যিক আঁধার এড়ানো যায়;
কিন্তু অন্ধকার? আলোহীন গভীর নৈঃশব্দ্যতা...

দুপুরে মানুষ এক সময় আকাশের দিকে তাকাতো না, রাতে দেবতারা প্রকট হতেন- এই ভেবে রাতভর জেগে জেগে আকাশ দেখতো: আর এখন মানুষকে তাকাতেই হয়না; বরং দেবতাগণ দিনে দুপুরে চোখের সামনেই কিলবিল করেন দানবের হাতে হাত রেখে;- আর মন্ত্রের মতোন উচ্চারণ করেন সর্বদা- একদিন এইসব অমরাবতী হবে, এইতো সময়; মানুষ প্রার্থণায় মগ্ন হয়;

কিছু নচ্ছার দেবগৃহকে ভুল করে পতিতালয় ভেবে গালি দিয়ে ওঠে; আমরা করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থণা করে চলি; হাঁটুমুড়ে বলি: ক্ষমা করো, ক্ষমা করো

 

 

 

 

২৬.০৩.০৮

 

 

 

 

অস্বস্তি

 

এর চেয়ে ভালো প্রগতির অজুহাতে অন্ধকারে মুখ বুজে থাকা:
আলোতে ছুঁয়েছি হৃদয়
সাদা কালো পৃথিবীর
রঙ পেন্সিল হাতে
বিরাট ক্যানভাসে
একটি বিন্দু শুধু

সব গাঢ় আকাঙ্খা মৃত্তিকায় বিলীন হয়
মানুষের সত্য মানুষেরই অস্বস্তি;

পণ আর প্রথার কাছে প্রকৃতি অমোঘ
এক অস্ত্রের মতো; প্রমাণিত ইতিহাস
কখনও পায় নি কেউ? শুধু অনুমান
শুধু ভুল? কেবল সত্য ঐশী বাণী-
বিষাক্ত বিশ্বাস।

 

০৯.০৩.০৮

সবাই একদিন বিপন্ন সময় অতিক্রম করবে

 

বিপন্ন হরিণেরা কখনো খুঁজেনা প্রেম, খুঁজে আশ্রয়
একটি মাত্র; হরিণের খয়েরী চোখ, নাক, কান
নীল হয়ে আসে; খোঁজে আশ্রয়। থরোথরো শরীরের ভেতরে
অলিন্দের জোয়ারের টানে একদিন প্রথম প্রেম এসেছিলো
জন্মেছিল নবজাতকের আকাঙ্খা। শিখরে শিকড়ের প্রতিচ্ছবি
ভুলে অবস্থাপন্ন সময়ের কাছে চলে যায় বিষাদ। মানুষও কখনো
খোঁজেনি প্রতিপক্ষ সমুদ্রের শব্দে অথবা কোন বিজন-সন্ধ্যা-কালে।
রাত্রির মতো অনিবার্য হয়ে আসে অথচ; অবস্থাপন্ন সময়কে
স্বাগত জানায় সবাই। সবাই একদিন বিপন্ন সময় অতিক্রম করবে
যেমন ছায়াপথ অতিক্রম করে সূর্য। সূর্যের ছায়ায়
নিশ্চিন্ত হরিণেরা বিপন্ন হয়; একদিন অবস্থাপন্ন সময়ের আশ্রয়ে
বিপন্ন হবে বিষাদ। সময়কে নবজন্ম দিতে বহু রক্তে বান আসে
নবজাতকের আকাঙ্খায়। সব্বারই একদিন মিশে যেতে হবে
এই স্রোতে; এখানেই শুধু জীবন তার হলুদ গোলাপটি ফোঁটায়।

 

১৩.০৬.০৮

 

 

 

সরাইখানার রোদ্দুর

 

সরাইখানা থেকে বের হয়ে
আবার গিয়ে ঢুকতে হলো হাসপাতালে
(
ততক্ষণে আমি বেড়িয়ে গেছি)
দুটো শুয়োর নাকি আমাকে গরু খোঁজা করছিল

অবাধ্য চুলগুলিকে কেটে ফেলে আবার বেরুলাম
কতক নপুংশকের ছায়ায় শীতল হয়ে
অতঃপর দরদামে মনোযোগী হলাম;

আমাকে তোমার ওষ্ঠ ঘুমুতে দিলনা
চাঁদ আমাকে দারুণ ভাবে কামার্ত করে ফেললো
তুমি ক্রমশ আমার অনাত্মীয়া-;
তোমার শরীরের মাচিত্রে আজও আমি উদ্বাস্তু
ভোরের কুচকাওয়াজের লজ্জাস্কর ধ্বনি এড়াতে
গত রাতেই 'সিডাকসিন' খেয়ে বেঘোরে ঘুম
তারপর দ্রিম দ্রিম দ্রামাকা দ্রামাকা শব্দ দুষণ
অর্থাৎ স্বাধীনতা উদযাপন-;

আলস্যে গা এলাতে পারিনি ৩৬ বছর পরও
আমার অপরাধগুলো- হাসপাতালে ভর্তি-
ভরদুপুরে ভর করে; প্রেমিকা নিহত হয়
বেশ্যার শরীরের ব্যবহৃত গন্ধের মতো
রাত নামে; শতশত বছরব্যপী
বিশ্বাস আর যুক্তির দ্বন্দ্বের মতো তুমি মুখোমুখি-;
তোমার প্লাবিত জ্যোৎস্নায় পুড়ে মরে অজস্র ব্রুণো

আমার অবাধ্য চুলগুলি ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে
সরাইখানা থেকে হয়তো
ঢুকতে হবে হাসপাতালে আবার

 

২৬.০৩.০৮


 

 

 


 


 

 

নিরুদ্দেশ যাত্রা

 

ইদানিং এমন হয়:
হয়তো চা খাচ্ছি, হয়তো কোন গুরুত্বপূর্ণ ক্লাশ করছি
হয়তো আড্ডা দিচ্ছি- হঠাৎ একটি পঙক্তি এসে
ভীড় করে মস্তিস্কে; যন্ত্রণার মতো বাজতে থাকে
তখন মনে হয় এই পঙক্তিটি দিয়ে আস্ত একটি কবিতা লেখা যাবে
মনে মনে চিত্রকল্পও বুনতে থাকি।

কিন্তু, যখনই টেবিলে বসি, পঙক্তিটি আর মনেই আসে না
একদম উধাও হয়ে যায়; যেন কোন দিন কোন পঙক্তিই
মস্তিস্কে এসে ভীড় করেনি। স্মৃতির সঙগে যুদ্ধ করে বড়জোর
এক-আধটি শব্দ উদ্ধার করা যায়; কিন্তু, পঙক্তিটি বেমালুম গায়েব!

এই যেমন গতকাল হাঁটছিলাম- হঠাৎ একটি পঙক্তি এলো মনে
খুব ছোট্ট পঙক্তি -চার শব্দের- বাসায় এসে যেই না লিখতে বসেছি,
স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেল। আর মনেই করতে পারিনি
অনেক কষ্টে শুধু মাত্র শেষ শব্দটি মনে করতে পেরেছিলাম- নিরুদ্দেশ।
বাকি তিনটি শব্দ কোনভাবেই মনে করতে পারিনি; যেন শেষ শব্দটি
চার শব্দের এই পঙক্তিটিকে নিয়ে যাত্রা করেছে নিরুদ্দেশে- আর ফিরবে না

 

২০.০৩.০৮

 

জোছনা শিকারী

 

নাগরিক ধোঁয়া পেছনে ফেলে কবি এসে দাঁড়ালেন
সন্ধ্যা-নিবিড় ধান ক্ষেতের সামনে; শিশিরে দৃষ্টি ধুয়ে
কবি দেখেন মাঠের কোলাহলময় একাকিত্ব। দূরে, ক্ষেতের আলে
পরম সোহাগে স্তন-গুচ্ছ বিছিয়ে জোছনা পোহায় যুবতী শেয়াল।
নারীও শরীরের ফাঁকে ফাঁকে জোছনা ধরে রাখে। সেই জোছনার
খোঁজে হিংস্র থাবা ম্যালে জোছনা শিকারী। যুবক শেয়াল ফিরে যায়
যুবতীর শরীরের কাছে চিবুকে প্রেমের অর্ঘ্য মেখে। চারিদিক ভরে
ওঠে আশ্চর্য সুন্দর কামের সুঘ্রানে। শুন্য থেকে মুহূর্তেই
খসে পড়ে যন্ত্রণাকাতর চাঁদ---

নাগরিক যন্ত্রণাকে পাশ কাটিয়ে কবির মগজে জমা হয় আরেকটি
জোছনাময় পংক্তি। কবি ফিরে যান ধূসর নগরে আবার---
সেখানে কঙক্রিটের ফাঁকে ফাঁকে অসংখ্য জোছনা জমে আছে!

 

৮.০১.০৮