মার্ক টোয়েন (Mark Twain)
অনুবাদ-তিমুর
� সংরক্ষিত
(পর্ব ১-১০)
পর্ব ১
মার্ক টোয়েনের জন্ম , ১৮৩৫ সালে হ্যালির ধুমকেতুর বছর , এবং তিনি প্রায়ই বলতেন তিনি হ্যালির ধুমকেতুর সাথে এসেছেন এবং হ্যালির ধুমকেতুর সাথেই যাবেন, কথাটা ফলে গিয়েছিল। কিন্তু পঁচাত্তর বছরের মার্ক টোয়েনের (১৮৩৫-১৯১০) জীবনটা খুঁটিয়ে দেখলে আমার দেখতে পাই এই সাহিত্যিকের জীবন আসলে দুটো প্রধান ভাগে বিভক্ত । ১৮৭১ এ রাফিং ইট বইটার মাধ্যমেই মার্ক টোয়েন সত্যিকার অর্থে নিজের স্বকীয়, শক্তিমান অবস্থানে নিজেকে আসীন করেন । কিন্তু লেখক টোয়েনকে বুঝতে হলে তাঁর প্রথম অর্ধেক জীবন সংগ্রামকেও বুঝতে হবে আমাদের ।
যদিও পৃথিবীর লোক তাঁকে মার্ক টোয়েন নামেই চেনে, তাঁর আসল নাম কিন্তু স্যামুয়েল ল্যাংহর্ন ক্লিমেন্স, জন্ম ১৮৩৪ সালে ৩০ এ নভেম্বর, শীতের এক বিষন্ন সন্ধ্যায় মিসৌরির প্রদেশের অন্তর্গত ছোট্ট শহর ফ্লোরিডাতে
। বাবা, ভার্জিনিয়ান বংশোদ্ভুত জন মার্শাল ক্লিমেন্স প্রথমে ছিলেন উকিল ও পরে স্থানীয় বিচারক-জাস্টিস অভ দ্য পিস । মার্ক টোয়েন পরে বড়াই করে বলেছেন তিনি জন্ম নিয়ে ফ্লোরিডা শহরের জনসংখ্যা শতকরা এক শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন (মানে শহরের জনসংখ্যা ছিল একশো!) । স্যামের বাবা জন মার্শাল ক্লিমেন্স, তাঁর ভায়রাভাই জন কোয়ারলেসের আমন্ত্রণে পার্টনারশিপে দোকান চালাতে এসেছিলেন ফ্লোরিডা শহরে ।সে সময় সীমান্ত এলাকাতে (মিসৌরি তখন সীমান্তেই অবস্থিত ছিলো ) দোকান চালাতে হলে দোকানদারকে তীক্ষ্ণ উপস্থিত বুদ্ধি আর হিউমারের দরকার ছিলো, খদ্দের কিছু একটা কিনলেই ফাও পাবার আশা করত, যেমন প্রাণ ভরে পাইপে তামাক ধ্বংস করার, বা পিপে থেকে দরাজ হাতে মদ ঢেলে নেবার অধিকার
। ব্যাপারটা বেরসিক জন ক্লিমেন্সের খুবই অনুচিত ও অন্যায় মনে হল (হাজার হোক একে ভার্জিনিয়ান তার উপর উকিল !) । তিনি তাঁর লজিক আর বিশুদ্ধ ভার্জিনিয়ান ভাষা নিয়ে ক্রেতাদের থেকে কিছুটা উঁচু স্তরেই রয়ে গেলেন । শিগগিরই লালবাতি জ্বলল দোকানে, কিন্তু দুই ভায়রাভাইয়ের বন্ধুত্বে মুহূর্তের জন্যও ভাটা পড়ল না তাতে ।স্যামির খালু জন কোয়ারলেস তাঁর দাসদাসী নিয়ে চাষবাষে লেগে পড়লেন আর ক্লিমেন্স ভাগ্য পরীক্ষার জন্য চলে এলেন ছোট্ট মিসিসিপি নদীর তীরে হ্যানিবাল শহরে। বাচ্চা স্যামির কাছে হ্যানিবাল শহরটা ভালোই লাগত, বাড়িতে ছিলো বড় বোন পামেলা আর ছোট ভাই হেনরি, বড় ভাই ওরাইওন সেইন্ট লুইতে ছাপাখানার কাজ শিখছিল । বাবা জন মার্শাল ক্লিমেন্স হানিবালের জাস্টিস অভ দ্য পিস হলেন । অ্যাডভেঞ্চার অভ টম সয়্যার বইটা পড়েছেন হ্যানিবাল শহরটা তাঁদের পরিচিত (বইতে কাল্পনিক সেইন্ট পিটার্সবুর্গ) । মার্ক টোয়েনের ছোটবেলাটা কেটেছে মিসিসিপি নদীর তীরে । এই মহানদী তাঁর রচনায় গভীর ছাপ রেখে গেছে । পাহাড়ের কোল ঘেঁষে মিসিসিপি নদীর বাঁকে অবস্থিত হ্যানিবাল শহর । নদীর উপরে চলে এসেছে পাহাড়ের দুটো চুড়ো, হলিডে হিল আর লাভার্স লিপ (টম সয়্যারের পুরোটা আর হাকলবেরি ফিন প্রথম অংশের পটভুমি ) ।
মিসিসিপির তীরে দাপিয়ে বেড়ান প্রায় সব বালকেরই স্বপ্ন ছিল স্টিমারের পাইলট হবার । সত্যি বলতে কি, হ্যানিবালের মতো ছোট্ট শহরে কোন স্টিমারের আসাটা ছিল একটা মস্ত ঘটনা । মুহূর্তে সরগরম হয়ে উঠত গোটা শহর, ছেলে বুড়ো সবাই ছুটতে আরম্ভ করত স্টিমার ঘাটের দিকে । 'চিমনি দিয়ে ঘন ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে উঠছে, এঞ্জিন রুমের খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ফারনেসের গনগনে আগুন, স্টেট রুমগুলোর ঝকঝকে স্ফটিকের ঝাড় বাতি, ঘন্টার শব্দ, খালাসিদের হাঁকডাক, হালে দাঁড়ানো সারেঙ এবং সবার উপর হারিকেন ডেকে দাড়িঁয়ে আছেন ধীরস্থির ক্যাপ্টেন, সব আমরা খেয়াল করতাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে' এভাবেই পরবর্তীকালে বর্ণনা করেছেন মার্ক টোয়েন আত্মজীবনীতে । বলা বাহুল্য স্যাম ক্লিমেন্স আর দলবল ও সেখানে গিয়ে হাজির । জাহাজের প্রতিটি খুঁটিনাটি ব্যাপার লক্ষ্য করত তারা গভীর মনোযোগ দিয়ে । অবাক হবার কোন কারন নেই যে এই ছেলেদের অনেকেই বড় হয়ে স্টিমারের পাইলট হবার স্বপ্ন দেখত । অতো বড় একটা জাহাজের হাল ধরে বসা, আহা ভাবতেও কেমন লাগে!
টম সয়্যার আর হাকলবেরি ফিনের চরিত্রগুলো বেশিরভাগই বাস্তবথেকে নেয়া । জো হার্পারকে (টেরর অভ দ্য সীজ ) টোয়েন নিয়েছেন তাঁর বন্ধু জন ব্রিগস আর উইল বোয়েনকে মডেল করে । আর হাকলবেরি ফিনকে তিনি নিয়েছেন টম ব্ল্যান্কেনশিপকে মডেল করে। টমের বাবা উডসান ব্ল্যান্কেনশিপ ছিল শহরের অন্যতম প্রধান মাতাল ও ভবঘুরে । পরিত্যক্ত এক চামড়ার একপাল শুয়োরের সাথে দিব্যি পড়ে থাকত সে । নেশা না করলে, মাছধরে আর শিকার করে দিন কাটাত সে । উডসান ব্ল্যান্কেনশিপই যে হাক ফিনের বাবা চরিত্র তা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় কারোর (যদিও ছেলেকে টাকার জন্য অপহরন করেনি সে বাস্তবে, যেমন করেছিলো হাক ফিনের বাবা (!!!) ।
স্কুল স্যামির ভালো লাগতনা মোটেই, তবে স্কুলেই তার পরিচয় হয় উইল বোয়েন, টমি ব্রিগসদের সাথে । এদের নিয়ে স্যাম ক্লিমেন্স দল গড়ে তোলে, স্কুল পালিয়ে মাছ ধরতে যেত, জলদস্যু-জলদস্যু খেলত কিংবা সাঁতরে নদীর মাঝখানের জ্যাকসনের দ্বীপে চলে যেত । জ্যাকসন্স আইল্যান্ড কাল্পনিক নয়, আসলেই আছে ওটা মিসিসিপি নদীর মাঝখানে, দ্বীপের মাঝে আছে বাদুর ভর্তি গুহাটাও, যার ভেতরে টম সয়্যার আর বেকি থ্যাচার গল্প করতে করতে হারিয়ে গিয়েছিলো, সেটাও সম্পূর্ণ বাস্তব । আসলে টম সয়্যার আর হাকলবেরি ফিনে যে চরিত্রগুলো আছে তার প্রায় সবই বাস্তব থেকে নেয়া ।
টম ব্ল্যান্কেনশিপের বড় ভাই বেন ব্ল্যান্কেনশিপকেও ব্যাবহার করেছেন টোয়েন । বেন একবার এক পলাতক ক্রীতদাসকে আবিস্কার করেছিলো মিসিসিপি নদীর চরে । পঞ্চাশ ডলার পুরস্কারের লোভ সত্বেও বেন তাকে ধরিয়ে দেয়নি, বরং তাকে মাছ ধরার বড়ঁশি ও অন্যান্য জিনিস দিয়ে সাহায্য করেছিল সে । শেষ পর্যন্ত একদল কাঠুরের চোখে পড়ে যায় এই পলাতক ক্রীতদাস, তাড়া খেয়ে সাঁতরে মিসিসিপি নদী পার হতে গিয়ে ডুবে মরে সে । এই ঘটনাটাই হাকলবেরি ফিনের মধ্যে আছে, পলাতক ক্রীতদাস জিমকে ধরিয়ে দেবার ব্যাপারে হাকের মানসিক অন্তর্দন্দ্ব ।
বাবার অকাল মৃত্যুর পর স্কুল ছাড়তে হয় স্যামিকে । কিছুদিন এটা ওটা করবার পর শিক্ষানবিশ কম্পোজিটর মিসৌরি কুরিয়ার পত্রিকায় ঠাঁই হয় তার । মালিক ছিলেন পি. ই, আমেন্ট নামে এক বিরাট বপু ভদ্রলোক, মজুরি হিসেবে মালিকের ফেলে দেয়া জামাকাপড় আর যতসামান্য খাবারদাবার জুটত কপালে, কিন্তু নগদ একটা পয়সাও না ! এখানেই যা সাড়ে আট বছরের স্কুল জীবনে সম্ভব হয়নি, তা সম্ভব হল, স্যাম কষ্ট করে পড়তে শিখল । আব্রাহাম লিংকন যথার্থই বলেছেন 'ছাপাখানা হচ্ছে গরীবের কলেজ' আর একজন কম্পোজিটরের পক্ষে দিনের পর দিন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কম্পোজ করে সম্পূর্ণ নিরক্ষর থাকা অসম্ভব ব্যাপার ।
তবে প্রয়াত জন মার্শাল ক্লিমেন্সের অনেক স্বপ্নের মধ্যে পারিবারিকভাবে একটা পত্রিকা বের করার স্বপ্নও অন্যতম । স্যামের মা জেইন ল্যাম্পটন ক্লিমেন্স স্বপ্নটা মনে রেখেছিলেন । ক্লিমেন্সদের একেবারে নিজস্ব হ্যানিবাল জার্নাল পত্রিকা বের করার জন্য স্যামের বড়ভাই ওরাইওন ক্লিমেন্স তার সেইন্ট লুইয়ের চাকুরি ছেড়ে হ্যানিবলে চলে এলো দেখে মা ভারি খুশি হলেন । পত্রিকার অফিস হলো ক্লিমেন্সদের হিল স্ট্রিটের বাড়ির বৈঠকখানা । স্যামিকে ছাড়িয়ে আনা হলো "কুরিয়ার" থেকে পদোন্নতি সহকারে, অবৈতনিক কম্পোজিটর কাম সহকারি সম্পাদক হয়ে উঠলো সে নতুন কাগজের । তবে ওরাইওনের বেশি ভালোমানুষি আর ম্যাড়মেড়ে সম্পাদনার জন্য হ্যানিবাল জার্নাল খুব একটা উন্নতি করতে পারেনি প্রথম থেকেই ।
সেসময় (১৮৫০ এর দশকে) আমেরিকার পশ্চিমে পত্রিকা চালানো ছিলো যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার, মানষের হাতে টাকা ছিলো কম, অনেকসময় চাঁদা ব্যবদ অনেক সময় গ্রাহকের কাছ থেকে ডিম বা আলুও নিতে হত । ওরাইওন যদি স্যামের বুদ্ধি ধার নিতেন এব্যাপারে, তাহলে হয়তো আরেকটু বেশি পাঠক টানতে পারত জার্নাল । স্যামের পরামর্শ ছিল পাঠকের কৌতুহল আছে বা মনোযোগ আকর্ষিত হবে এমন সব জিনিস ছাপানো । কোন কারনে ওরাইওন শহরের বাইরে গেলে স্যাম সম্পাদক হয়ে বসত । তখনই কেবল নিজ নামে কিছু ছাপানোর সুযোগ ঘটত তার । অবশ্য ওরাইওন শহরে ফিরলে আগের পদে ফিরতে করতে হতো তাকে ।
স্যাম ক্লিমেন্সের একটা প্রতিদন্দ্বী পত্রিকার সম্পাদক প্রেমে ব্যর্থ হয়ে মিসিসিপি নদীতে আত্বহত্যা করতে গিয়েছিলেন । হ্যানিবাল জার্নালে খবরটা ফলাও করে ছাপা হলো (স্যাম সাময়িকভাবে সম্পাদকের চেয়ারে ) । হ্যান্ডবিল ছাপানোর যে বড় কাঠের ব্লক ছিল, তার একটাতে খোদাইকরে ছবি ছাপানো হলো, আত্বহননেচ্ছু সম্পাদক লাঠি হাতে (পানি মাপতে !) নদীতে নামছেন । সে সংখ্যা জার্নাল ছাপিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারা গেলনা । ক্ষিপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পাদক জার্নাল অফিসে এসে ক্লিমেন্সদের সবকটাকে পিটিয়ে যাবার হুমকি দিলেন । কিন্তু শেষ পর্যন্ত সকলের হাসির খোরাক হয়ে বেচারাকে শহর ছাড়তে হলো ।
পর্ব-২
কিন্তু ওরাইওন শহরে
ফিরে এলেই স্যামের সম্পাদনার স্বাধীকার শেষ হয়ে যেত । স্থানীয় গণ্যমান্য লোকদের মানের হানি ঘটলো কিনা সে চিন্তায় ওরাইওন ক্লিমেন্সের রাতের ঘুম ঠিক মতো হত না । এক রাতে একটা গরু ছাপাখানায় ঢুকে টাইপের ট্রে উলটে দেয়াতে জার্নালের মস্ত ক্ষতি হল । তারও কিছুকাল পরে এক রহস্যময় কারনে প্রেসে আগুন ধরে গেল । স্যামের বয়স তখন আঠারো বছর । বোন পামেলার বিয়ে হয়েছে সেইন্ট লুইতে, সেখানে বেড়াতে যেতে মনস্থ করলো স্যাম ।জেইন ক্লিমেন্স দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, স্যাম যে দীর্ঘ সময়ের জন্য চলে যাচ্ছে এব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই তাঁর মনে।একটা বাইবেল বের করলেন তিনি এবং অপর প্রান্ত ধরে শপথ নিতে বললেন তিনি, কখনো তাস বা মদ স্পর্শ করবে না স্যাম । সে প্রতিজ্ঞা রেখেছিলেন স্যাম ক্লিমেন্স ।
অল্প কিছুকাল সেইন্ট লুইতে ছিলেন মার্ক টোয়েন । এবং এ সময় সেইন্ট লুই ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় করেছেন তিনি । উদ্দেশ্য নিউ ইয়র্কে যে বিশ্বমেলা শুরু হবে তা দেখার মতো টাকা জমানো । রেলগাড়ি সবে পৌঁছেছে সেইন্ট লুইতে, তবে ১৮৫৩ সালের ট্রেন ছিল যথেষ্ট মন্থর গতির, সেইন্ট লুই থেকে নিউ ইয়র্ক পৌঁছতে কয়েকদিন লেগে যেতো। পামেলাকে লেখা একটা চিঠির ভগ্নাংশ পাওয়া গেছে যা মার্ক টোয়েন এই মেলা সম্বন্ধে লিখেছেন,
"দোতলার গ্যালারির দৃশ্য ভারি সুন্দর, পৃথিবীর সব দেশের নিশান উড়ছে, রোজ মেলায় প্রায় ছ'হাজার লোক আসছে, (হ্যানিবালের জনসংখ্যার প্রায় দ্বিগুন ), প্রবেশমুল্য পঞ্চাশ সেন্ট,প্রায় তিন হাজার ডলারের মতো রোজগার মেলার ।ল্যাটিং অবজারভেটরিতে গিয়েছিলাম আমি (২৮০ ফিট উঁচু),আশপাশের পুরো শহর দেখা যায় সেখান থেকে । ক্রোটন আকুয়াডাক্টও কাছেই । হারলেম নদীর বুক চিরে বসানো হয়েছে লোহার পাইপ । আটত্রিশ মাইল দুরের ওয়েস্টচেস্টারে একটা আস্ত নদীর গতিপথ ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে" । পরবর্তীকালে যে একজন বড় লেখক হবেন তার কিছুটা আভাস পাওয়া যায় এইসব চিঠি থেকে ।
কিন্তু স্যামির মাথায় যে পোকা ছিল ছোটবেলা থেকে, সেটা বের হবার নয় । তা হচ্ছে মিসিসিপি নদীর পাইলট হওয়া (এখনকার এরোপ্লেনের এর পাইলট হওয়ার মতো ব্যাপার ছিলো মিসিসিপি স্টিমবোটের হালধরার যোগ্যতা অর্জন করা ) । স্যামির দুই বন্ধু বোয়েনদের দুই ভাই মিসিসিপির পাইলট হয়েছিল । লেফটেনান্ট লুই হার্নডনের লেখা ব্রাজিল একটা রিপোর্ট পড়ে আঠারোশো সাতান্নো সালে মিসৌরির কিওকুক শহরে পৌঁছুলেন স্যাম ক্লিমেন্স, উদ্দেশ্য ব্রাজিলে যাবেন কোকোর ব্যবসা করতে ।
কিন্তু কিওকুকে এসে ধাক্কা খেতে হলো স্যামিকে , ব্রাজিলের শিগগির উদ্দেশ্যে ছাড়বে এমন কোন জাহাজ নেই, এমন আগামী কয়েক বছরে নাও পাওয়া যেতে পারে ! তখনই স্যামির মনে পড়ল ছোটবেলার স্বপ্নটা, ব্রাজিল না যেতে পারলে কি হয়েছে, মিসিসিপি নদীর সারেঙ হতে অসুবিধা কী?
জেটিতে দাঁড়িয়ে থাকা পল জোন্স স্টিমারের ক্যাপ্টেন হোরেস বিক্সবিকে ধরে বসলেন স্যাম, শিক্ষানবিশ হিসেবে নিতে হবে তাঁকে। হোরেস বিক্সবি অনেকবার বোঝাবার চেষ্টা করলেন স্যামকে, মানুষের মাথা নষ্ট করার মতো যতো পেশা আছে নদীর সারেঙ হওয়া তার মধ্যে অন্যতম, আর তাছাড়া শিক্ষানবিশদের কমকরে হলেও পাঁচশো ডলার দিতে হয় ওস্তাদকে । স্যাম জানাল পাঁচশো ডলার দিতে সে খুশি মনেই রাজি আছে এর মধ্যে দুশো সে এখনই দেবে, আর তিনশো লাইসেন্স পাওয়ার পর মজুরি থেকে শোধ করব। বিক্সবি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তারপর রাজি হলেন ।
সেই মুহূর্তেই স্যামকে পল জোন্স জাহাজের হাল ধরতে দিলেন বিক্সবি , মাল তোলা শেষে ঘাট থেকে বেরিয়ে আসছিলো তখন স্টিমারটা। আপেলের খোসা ছাড়ানোর মতো করে পাশের জাহাজটার গা ঘেঁষে চলাতে বললেন বিক্সবি, ব্যাপারটা অহেতুক বিপদজনক মনে হল স্যামের কাছে, তাই বেশ দুর দিয়ে চালাতে লাগলেন ।
রাগে ফেটে পড়লেন বিক্সবি, নিজেই গিয়ে দাঁড়ালেন গিয়ে হুইলে। পরে বুঝেছেন টোয়েন আসলে বিক্সবি গোয়াঁর্তুমি করেননি, আড়াই লক্ষ ডলার দামের জাহাজখানা এমনভাবে চালাতে হবে যেন বরফের উপর দিয়ে দাগ আঁকা পথে স্কেটিং করা হচ্ছে , এরকম চুলচেরা হিসাবের অভ্যাসের ফলেই বিপদের সময় জাহাজকে রক্ষা করা যায় ।
আসলে মিসিসিপি নদীর পাইলট পারবর্তীকালের লেখক মার্ক টোয়েন তৈরি করেছে, মার্ক টোয়েন ছদ্মনামটাও জাহাজী জীবন থেকে নেয়া । মার্ক টোয়েন কথাটার অর্থ হচ্ছে দুই ফ্যাদম বা বারো ফুট পানি, নদীর পানি মাপতে মাপতে জাহাজীরা বলে মার্ক ওয়ান...নাইন, নাইন,...মার্ক টোয়েন...মার্ক টোয়েন... মার্ক টোয়েন কথাটা জাহাজীদের কানে মধু বর্ষন করে, কারন এতোটুকু গভীরতা স্টিমারচলার জন্য নুন্যতম প্রয়োজন ।
জাহাজের জীবন মার্ক টোয়েনকে কে পরিপক্ক করেছে, পরে তিনি বলেছেন, জীবনে এমন কোন চরিত্র দেখেননি তিনি, জুয়ারি, ভাগ্যাম্বেষী, লটবহর আর দাসদাসী সহ দক্ষিনের প্ল্যান্টেশন মালিক, ধর্ম প্রচারক, খনিজীবি, চাষী, ছোট ব্যাবসায়ী, যাদের সাথে স্টিমারের ডেকে আগেই দেখা হয়নি তাঁর, । চলার পথে মানুষের মিছিল দেখেছেন এই শিক্ষার্থী পাইলট, যিনি উত্তরকালে হবেন বিখ্যাত লেখক ।
আঠারোশো উনষাট সালে পাইলটের সনদ পান স্যাম ক্লিমেন্স । সময়টা ছিলো তাঁর জন্য খুবই রোমাঞ্চকর কোন সন্দেহ নেই, দক্ষিনে নিউ অর্লিয়ান্স আর উত্তরে শিকাগো পর্যন্ত ছিল স্টিমারের গতিপথ । তাঁর সবচেয়ে আনন্দকর সময় ছিলো, মা জেইন ক্লিমেন্সকে সেইন্ট লুইতে স্টিমারে বড়বোন পামেলার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া । পামেলার স্বামী উইল মোফেট, সেইন্ট লুই শহরে কমিশন মার্চেন্ট হিসেবে বেশ নাম করেছিলেন । নদীর জীবনের অভিজ্ঞতাই ফুটে উঠেছে লাইফ অন দ্য মিসিসিপি বইতে । এডভেঞ্চার অভ হাকলবেরি ফিন এও পটভুমি হিসেবে বড় অংশ জুড়ে আছে মিসিসিপি নদী ।
পর্ব-৩
নদীর উপর রোদ যেভাবে হঠাত কুয়াশায় ঢাকা পড়ে, এই চমতকার জীবনটাও সেভাবেই শেষ হয়ে গেলো
। আব্রাহাম লিংকন শপথ নিতে যাচ্ছেন, ক্রীতদাস প্রথা উচ্ছেদ করবেন তিনি, প্রয়োজনে বল-প্রয়োগ করবেন, আর দক্ষিণের নেতা জেফারসন ডেভিস প্রয়োজনে দক্ষিণের অংগরাজ্যগুলো নিয়ে পৃথক রাষ্ট্র "কনফেডারেশন অভ স্টেটস" করবার পাঁয়তারা করছেন । যেহেতু মিসিসিপি নদীটা দেশের ঠিক মাঝখান দিয়ে উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত ।এখন প্রত্যেক পাইলটকেই ঠিক করতে হবে তিনি উত্তরে ইউনিয়ন পক্ষে থাকবেন নাকি দক্ষিণে কনফেডারেসির পক্ষে নাম লেখাবেন।একটা কথা ঠিক, যুদ্ধ যদি সত্যিই বেঁধে যায়, যাত্রী আর মালবাহী স্টিমার চলাচলের দিন আপাতত শেষ । সেইন্ট লুই পার হওয়ার সম শহরের দক্ষিনের বিদ্রোহী জেফার্সন ব্যারাকের গোলন্দাজেরা স্যামের জাহাজের ওপর দু বার গোলাবর্ষন করলো । শেষবারের গোলায় পাইলট-হাউজের কাঁচ গুঁড়িয়ে গিয়েছিলো ।
চাকুরী থেকে ছাঁটাই হয়ে হ্যানিবালে ফিরে এলেন স্যাম, যুদ্ধের ডামাডোল সারা শহর জুড়ে । মিসৌরির গভনর্র "ক্লেইব" জ্যাকসন মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে তুলে প্রদেশের লোকদের আবেদন জানিয়েছেন, ওয়াশিংটন থেকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে এরকম মিলিশিয়া বাহিনী গড়ার অর্থ রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং কেন্দ্র কঠোর ব্যবস্থা নেবে সেরকম কিছু করলে ।
স্যামের বড় ভাই ওরাইওন, আব্রাহাম লিংকনের গোঁড়া ভক্ত হয়ে উঠছিলেন । এটা ঠিক স্যাম পরিবার বা স্কুল বা গীর্জা থেকে দাস প্রথার কখনো নিন্দাবাদ শোনেননি, যদিও ওই জাতটার প্রতিছিল তাঁর অন্য মমত্ব, ছোটবেলায় দুবার তাঁকে পানিতে ডুবে মরা থেকে বাঁচিয়েছে নিগ্রোরা । যদিও তাঁর বিচারক বাবা জন মার্শাল ক্লিমেন্স দু'দুবার দাসপ্রথা বিরোধীকে জেলে ঢুকিয়েছিলেন, কিন্তু জন ক্লিমেন্স তাঁর সব ছেলেময়েদের সমস্ত যুদ্ধ- বিগ্রহ ও সন্ত্রাসকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছিলেন । স্যাম বুঝতে পারছিলেন না তিনি কোনদিকে যাবেন ।
এমন সময় শুনলেন শহরের কিছু তরুন মিলে একটা স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী মিলিশিয়া বাহিনী তৈরি করছে, বন্ধুদের ডাকে সাড়া দিয়ে এ দলে ভীড়ে গেলেন স্যাম ।
স্যাম ভাবলেন ছোট বেলায় রবিনহুড বা জলদস্যু খেলার মতোই মজা হবে বেশ, তাছাড়া স্থানীয় আনুগত্যের ব্যাপারও আছে একটা । এক রাতে শহরের কাছে বিয়ার ক্রিক নামের এক জায়গায় তাঁরা প্রায় পনেরো জন জড় হলেন । টম লিয়ন নামে একজনকে কমান্ডার নির্বাচিত করা হলো, স্যাম হলেন সেকেন্ড লেফট্যান্ট, এরকম অনেক অফিসার নির্বাচিত করার পর দেখা গেল সাধারন সৈন্য হবার মতো তেমন কেউ অবশিষ্ট নেই, যা হোক বাহিনীর একটা জমকালো নাম থাকা দরকার, নাম দেয়া হোল 'দ্য ম্যারিওন রেঞ্জার্স' ।
ঠিক হলো, পরদিন পনেরো মাইল দুরের একটা গ্রামে অপারেশনে যাবে ম্যারিওন রেঞ্জার্স । পরদিন সবাই রওনা দিলো পিকনিকে যাওয়ার মতো করে, গান গাইতে গাইতে । সোজা পাকা রাস্তা দিয়ে গেলে ঘন্টা তিনেকের বেশি সময় লাগার কথা নয়, কিন্তু তাতে তো যুদ্ধের যথাযোগ্য থ্রিল মেলে না । ক্যাপ্টেন লিয়ন তাঁর বাহিনীকে পরিচালনা করলেন খানা-খন্দক আর মাঠঘাট মধ্যে দিয়ে।
প্রথম ঘন্টা মহা ফুর্তিতে গান গাইতে গাইতে চলে গেল, কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঘন্টায় গানের পরিমান কমে গিয়ে বিরক্তির পরিমান বেড়ে গেলো । উস্কোখুস্কো চুল, ফোস্কা পড়া পায়ে, শেষমেষ তারা রাল্স কাউন্টিতে কর্নেল রাল্স নামে এক ভদ্রলোকের খামারবাড়িতে এসে থামলো।
কর্নেল রাল্স ছিলেন মেক্সিকো যুদ্ধফেরত অবসর প্রাপ্ত অফিসার ( পুরো রাল্সকাউন্টি জেলাটাই তাঁর নামে করা হয়েছিলো), এই ভলান্টিয়ারদের দেখে আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। লাঞ্চের দাওয়াত দিলেন তিনি, সানন্দে গ্রহন করা হল সে নিমন্ত্রন । খানাপিনার বিপুল আয়োজন দেখে স্যামির বিশ্বাস জন্মাল, যুদ্ধ-বিগ্রহ কখনো কখনোও বেশ মজাদার ব্যাপার বটে !
শেষ ঝলসানো মোরগটা খতম করার পর কর্নেল তাঁদের নিয়ে গেলেন কাছের এক গোলা বাড়িতে । ভুরিভোজের ফলে নেতিয়ে পড়া এই শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে এক আগুন ঝরানো বক্তৃতা দিলেন তিনি । (আঞ্চলিক) দেশপ্রেমের বন্যা ছুটলো তাতে । তিনি জানালেন তাঁরা মানে ম্যারিওন রেঞ্জার্স এক মহান গুরু দায়িত্ব কাঁধে তুলেছে, "প্রয়োজনে দেশের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে" ....দেশ মানে কনফেডারেসি, আরও পরিষ্কার ভাবে মিসৌরি স্টেট । শুধু কথায় চিঁড়ে ভিজবে না ভেবে একটা বাইবেল ছুঁইয়ে শপথ করালেন কর্নেল রাল্স ' মিসৌরি স্টেটের প্রতি আজীবন অনুগত থাকবো' । তারপর রালস, স্যামের বেল্টে ঝুলিয়ে দিলেন মেক্সিকো যুদ্ধে ব্যবহৃত একটা তলোয়ার ।
পর্ব-8
শিগগিরই একটা পরিত্যক্ত আখের গুদামে তাঁদের একটা ঘাঁটি করার অনুমতি দিলেন স্থানীয় মুরুব্বিরা চলাফেরা করার জন্য কিছু বুড়ো, বেতো ঘোড়াও মিললো দয়ালু চাষীদের কাছ থেকে
। স্যামের কপালে জুটল একটা ছোট্ট হলদেটে বদমেজাজী বুড়ো খচ্চর, পিঠে চড়লেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়তো মাটিতে আর চালাতে চাইলে আরোহীকে ছুঁড়ে ফেলতো শূন্যে ।তবু কয়েকদিন কসরত করার পর চলাফেরা করার মত ঘোড়া চালানো শিখে ফেললেন স্যাম ক্লিমেন্স
। তাতে আর কিছু না হোক স্থানীয় চাষী মেয়েদের সাথে ভাব করার মতো ঘোরাফেরা করা যেতো । তবে শিগগিরই পরিস্থিতি পাল্টে গেল । খবর পাওয়া গেলো জনৈক কর্নেল ইউলিসিস এস. গ্র্যান্টের (পরবর্তীকালে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে ইউনিয়ন পক্ষের পুরো এক রেজিমেন্ট সৈন্য আসছে এদিককার দখল নিতে। যুদ্ধটা যে পিকনিক নয় সেটা স্যাম ক্লিমেন্স বুঝতে পারলেন । তাঁরা পিছু হটতে লাগলেন, পিছু হটতে হটতে পালাতে লাগলেন । এক রাতে স্যাম সহ ছয়জন রেঞ্জার এক নির্জন বনের মধ্যে পথের ধারে লুকিয়া আছেন, এমন সময় ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পেলেন তাঁরা । তারার আলোয় তাঁরা দেখলেন, একজন নিঃসংগ ঘোড়সওয়ার চলছে বনের পথ দিয়ে, নি:সন্দেহে শত্রুর গুপ্তচর! যেই ভাবা সেই কাজ, স্যাম শুদ্ধ ছয়জন একসাথে লোকটাকে গুলি করে বসলেন । এমন সময় মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ বেড়িয়ে এলো, তাঁরা দেখলেন লোকটা চিত হয়ে পড়ে আছে মাটিতে, তার শার্টটা ভিজে গেছে রক্তে, বিড়বিড় কি সব বলছে সে তার পারিবার পরিজন সম্বন্ধে । স্যামের হঠাত মনে হলো তিনি একজন খুনি ! এই অপরিচিত লোকটাকে হত্যা করতে তিনিও সাহায্য করেছেন !লোকটাতো তাঁর কোন ক্ষতি করেনি, সেও তো আর সবার মতো তার জীবনটাকে ভালোবাসে ! সেই মুহূর্তে স্যাম ও তাঁর বন্ধুরা ভুলে গেলেন যুদ্ধের কথা, তাঁরা ঘিরে রাখলো অচেনা লোকটিকে, লোকটিকে জীবন ফিরিয়ে দিতে সে মুহূর্তে তাঁরা পৃথিবীর যে কোনো কিছু করতেই রাজি ছিলেন । এঁদের অনেকেই পরবর্তীকালে যুদ্ধে নাম করবেন, তবে স্যাম ক্লিমেন্স আর এ ভাতৃঘাতী যুদ্ধে থাকছেন না । অপরিচিত এই লোকটির মৃত্যু নিয়ে পরে বহু বছর মার্ক টোয়েন দুঃখ বোধ করেছেন, তা বোধ হয় না করলেও চলতো, কারন আর যাই হোক বন্দুকের গুলিতে লক্ষ্যভেদের ব্যাপারে কেউ মার্ক টোয়েনকে কৃতিত্ব দিতে পারবে না !
প্রকারন্তরে আব্রাহাম লিংকনই স্যামকে যুদ্ধ থেকে বিরত করবেন
। স্যামের বড়ভাই ওরাইওন নেভাডা প্রদেশের অস্থায়ী সেক্রেটারি পদে যোগ দেবার নিয়োগ পত্র পেলেন রিপাবলিকান দলের কাছ থেকে । ওরাইওনের হাত তো চির কালই খালি, অতএব স্যামকে তিনি প্রস্তাব করলেন বিনা বেতনে সেক্রেটারির সেক্রেটারির' পদটা নিতে । আহার খরচটা স্যামই দেবেন দু'জনের হয়ে । স্টিমারের পাইলট থাকা কালে স্যাম এ টাকা জমিয়ে ছিলেন । আসলে স্যামের যুদ্ধ থেকে বেরোনোর পরে যে কোনো কিছু করতে রাজি ছিলেন, নেভাডা, ক্যালিফোর্নিয়া সোজা কথায় দূর পশ্চিম, সোনা-রূপার দেশ ( ১৮৪৯ সালের বিখ্যাত ক্যালিফোর্নিয়া গোল্ডরাশ তখনকার সময় থেকে মাত্র বারো বছর আগের কথা) ।একটা সোনার নিদেন পক্ষে একটা রূপার খনির মালিক হিসেবে কোটিপতি হবার দিবাস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন রোমান্টিক স্যাম ক্লিমেন্স
।পর্ব-৫
সেইন্ট লুইতে গিয়ে সবার সাথে বিদায় নিয়ে স্টিমারে উঠলেন দু ভাই, গন্তব্য মিসৌরির সেইন্ট জোসেফ
। সেখান থেকে একেক জনের দেড়শো ডলার দিয়ে ওভারল্যান্ড স্টেজরুটের টিকেট কিনলেন । ১৮৬১ সালের জুলাইয়ের শেষদিকে স্যাম আর ওরাইওন চড়ে বসলেন ষোলো ঘোড়া টানায় স্টেজ কোচে, পশ্চিমের পথে । খাওয়া আর ঘোড়া বদলানো সময়টুকু বাদ দিলে দিনরাতই কেবল বিরতিহীন যাত্রা । যাঁরা মার্ক টোয়েনের 'রাফিং ইট' বইটা পড়েছেন তাঁরা এ যাত্রার খুঁটিনাটি সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল আছেন ।"It thrills me through and through to think of the life, the gladness, and the wild sense of freedom that used to make the blood dance in my face on those fine overland mornings."
(Roughing It, Mark Twain)
নেভাডার অস্থায়ী রাজধানী ধুলো ধুসরিত কার্সন সিটিতে এসে থামল স্টেজকোচ
। ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ছড়ানো কয়েকশো কুটির, হাজার দুয়েক লোকের বাস এ শহরে । নেভাডা তখনও স্টেট হয়নি, মিসেস ও'ফ্ল্যানিগানের বোর্ডিং হাউজে ঠাঁই হলো দু ভাইয়ের । সেখানেই একটা ফাঁকা মতো জায়গায় অফিস বসালেন ওরাইওন । কিন্তু স্যামকে পনেরো মিনিটের বেশি টেবিলে আটকে রাখা সম্ভব হতোনা ওরাইওনের পক্ষে ।এই প্রথম স্যামুয়েল ল্যাংহর্ন ক্লিমেন্স তাঁর আচরনে একটা ক্ষীণ বিদ্রোহের সুর প্রকাশ করলেন । বিদ্রোহের প্রথম প্রকাশ পাওয়া গেলো বেশভুষায় । চিবুকে কিছু কোঁকড়ানো লাল দাড়ি রাখতে শুরু করলেন, খনি মজুরদের মতো পুরু কিন্তু আরামদায়ক পোশাক পরতে আরম্ভ করলেন, সাথে মানানসই চামড়ার জ্যাকেট আর স্লাউচ হ্যাট । দিনকতক উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘোরাফেরা করলেন কার্সন সিটির রাস্তায় রাস্তায় । পথচলতি লোকের চেহারার দিকে চেয়ে থাকতেন একদৃষ্টে, শিগগিরই কয়েকজনের সাথে পরিচয় হয়ে গেল । তাদেরকে স্যাম তাঁর দক্ষিন দেশের আঞ্চলিক ঢঙে গল্প শোনাতেন । শ্রোতারা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতো গল্পের শেষের বিলম্বিত বিষ্ফোরনের জন্য, সাসপেন্স আর হিউমার কিভাবে লেখার মধ্যে তৈরি করতে হয়, তা কথক টোয়েন শানিয়ে নিয়েছেন এভাবেই ।
পনেরো দিনের মধ্যেই স্যাম কার্সন সিটির সবচেয়ে পরিচিত মানুষে পরিচিত হয়ে উঠলেন । স্যামের আরেকটা বিদ্রোহসুচক কাজ হল, তিনি ওহাইওতে থেকে আসা এক বন্ধু জন কিনির সাথে লেক বিগলারে (এখনকার লেক টাহো ) চলে গেলেন । সেখানে একটা খোলা নৌকায় দিনকয়েক একটানা ঘুরে বেড়ান, বিগলার হ্রদের পানি এতো স্বচ্ছ ছিল যে আশি ফুট নীচের হ্রদের তলার খুঁটিনাটি দেখা যেত পরিস্কার । যেসব চিঠি তিনি লিখেছেন বাড়িতে মা আর পামেলার কাছে, স্যামুয়েল ল্যাংহর্ন ক্লিমেন্স যে কালে একজন বড় লেখক হয়ে উঠবেন, তা চিঠিগুলো পড়ে বেশ বোঝা যায় । লেকের ধারে একটা ছোট্ট কাঠের কুঁড়েঘরও বানিয়েছিলেন স্যাম আর জন । দিনকতক পর স্যামি ভাবলেন ঘোরাঘুরি যথেষ্ট হয়েছে, এখন পরিবারের জন্য যে ধনরত্ন কুড়াবেন ভেবেছিলেন সেকাজে হাত দেয়া যায় ।
শরত পেরিয়ে শীত এসে পড়লো আর প্রথম বারের মতো স্যাম ক্লিমেন্স 'মাইনিং ফিভারে' আক্রান্ত হোলেন
। নতুন আবিস্কৃত হামবোল্ট খনি এলাকা থেকে গুজব আসতে লাগল । ওখানকার পাহাড়গুলো নাকি একদম রুপা দিয়ে ঠাঁসা । ভার্জিনিয়া সিটির কাগজ টেরিটোরিয়াল এন্টারপ্রাইজের স্থানীয় প্রতিনিধি ওখানকার খনির জৌলুসের কথাপ্রকাশ করার মতো ভাষাই খুঁজে পাচ্ছিলেন না, এই এন্টারপ্রাইজ পত্রিকায় স্যাম মাঝে মাঝে শখের বশে লেখা পাঠাতেন ।পর্ব-৬
ডিসেম্বরের এক হিমঝরা বিকেলে কারসন সিটি ছেড়ে পর্বতের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন তাঁরা, ঝিরঝির করে তুষার পড়ছিলো তখন
। দলে ছিলেন স্যাম ক্লিমেন্স, দুই তরুন উকিল ক্ল্যাগেট আর ওলিভার (একজন পরবর্তী কালে মন্টানা থেকে কংগ্রেসম্যান, আরেকজন ফেডারেল জাজ হয়েছিলেন) আর খনির কাজে দলের একমাত্র অভিজ্ঞ লোক প্রায় ষাট বছর বয়স্ক অবসরপ্রাপ্ত কামার মিঃ টিলু , (রাফিং ইট বইতে মিঃ টিলুকে মিঃ বালু নাম দিয়েছেন টোয়েন ) । এই আনাড়িদের মধ্যে টিলুই কেবল আসল সোনা-রুপা চিনতে পারতেন ।আঠরোশো পাউন্ড রসদ সহ দুটো বুড়ো ঘোড়া নড়বড়ে গাড়িটা আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথের চড়াই ধরে টেনে নিয়ে চললো, অভিযাত্রীরা সব হেঁটে চললেন
। খুব শিগগিরই তাঁদের রুপার পাহাড়গুলো জ্বলজ্বল করতে দেখবেন এই আশায় তাঁরা চললেন, না হলে এই শহুরে বাবুদের শরীরে এতো কষ্ট সইতো না । দিন পনেরো চলার পর প্রায় দুশো মাইল পাড়ি দিলেন তাঁরা । আরো তাড়াতাড়ি হত যদি আলসে ঘোড়া গুলোকে দিয়ে গাড়ি না টানিয়ে নিজেরাই টানতেন (মার্ক টোয়েনের চুটকি !) । সে যা হোক, ষোলোদিন পর হামবোল্ট পর্বতমালার কাছে ইউনিয়নভিল গ্রামে পৌঁছুলেন তাঁরা ।সোনার খনি খুঁড়তে গেলেও প্রথমে একটা মাথা গোঁজার ঠাই দরকার
। একটা ক্যানভাসের ছাউনি দেয়া কুঁড়েঘর তুললেন চেষ্টা চরিত্র করে, ছাদে একটা ফুটো রেখে দিলেন ধোঁয়া বেরোতে পারবে (সে ফুটো দিয়ে বৃষ্টির পানি থেকে কাঠবিড়ালি অনেক কিছুই ঢুকতো ঘরে !) । স্যামের তর সইছিলোনা কখন তিনি তাঁর নিজের খনিটা আবিস্কার করবেন । রাতের খাবার সেরে তিনি বেরিয়ে পরলেন একা, চকচকে রুপার তাল পড়ে থাকতে দেখবেন আশা করছিলেন তিনি এবং কি আশ্চর্য ওরকম রুপালী ধাতুর টুকরো অনেক পড়ে আছে পথের ধারে! পকেট ভর্তি করে ওসব কুড়িয়ে ছাউনিতে ফিরে এলেন তিনি, সংগীদের চমকে দিতে তর সইছেনা তাঁর । তবে সাথে সাথে ফাঁস করলেন না তিনি পথের ধারে কী গুপ্তধন পেয়েছেন । যখন সবাই চেপে ধরলো নিতান্ত অবহেলার সাথে ছুঁড়ে মারলেন তিনি "রুপার" টুকরাগুলো, সংগীদের উত্তেজনা দেখে কে ! কিন্তু মিঃ টিলু অভিজ্ঞ লোক, জানালেন "ওগুলো মাইকা মানে অভ্র, এক হন্দর অভ্রের দাম দশ সেন্ট !!কয়েক সপ্তাহ খন্তা কোদাল দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করার পর স্যাম ক্লিমেন্স বুঝলেন আর যাই হোক গ্রানাইট পাথর ভেঙে সোনা বা রুপা বের করা তাঁর কাজ নয়
। প্রচন্ড জ্বর আর মাথাব্যথা নিয়ে ঝড় বৃষ্টির মধ্যে কার্সন সিটিতে ফিরে এলেন স্যাম । যখন তিনি তীব্র অবসাদ আর হতাশায় ডুবে আছেন, এমন সময় একটা চিঠি এলো তাঁর নামে । ভার্জিনিয়া সিটির থেকে প্রকাশিত টেরিটোরিয়াল এন্টারপ্রাইজ পত্রিকার মালিক/সম্পাদক জোসেফ টি গুডম্যান দেখেছেন স্যামের লেখা একজন অ্যামেচারের তুলনায় যথেষ্ট উন্নত মানের (১৮৬২ সালে নেভাডার কোন খনিশহরে পেশাদার সাংবাদিক ব্যাপারটার তেমন কদর ছিল না বোধহয় )। সপ্তাহে পঁচিশ ডলার বেতনে সহকারী সম্পাদকের পদ খালি আছে এন্টারপ্রাইজে , মিঃ স্যামুয়েল ল্যাংহর্ন ক্লিমেন্স কি এ চাকুরি করতে আগ্রহী ? আগ্রহী মানে ? ঝাড়া একশো তিরিশ মাইল পায়ে হেঁটে অগাস্টের এক বিকেলে ভার্জিনিয়া সিটিতে হাজির হলেন স্যাম ক্লিমেন্স ।এন্টারপ্রাইজ অফিসের রাস্তার উল্টো দিকে অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতে হল তাকে, এতো গাড়ি ঘোড়া চলছে রাস্তা দিয়ে, শহর বটে এক খানা! প্রাদেশিক রাজধানী কার্সন সিটি থেকে ঢের জমকালো
। পোশাক পরিচ্ছেদ খুবই মলিন যদিও । গায়ে নীল রংচটা একটা ফ্ল্যানেলের শার্ট, মাথায় একটা তোবড়ানো স্লাউচ হ্যাট , চুল দাড়ি সব এলো মেলো আর জট পাকানো । তবে আর কয়েকদিনের মধ্যেই আর সব সাংবাদিকের মতো ফিটফাট হয়ে গেলেন তিনি । কেবল একটা ব্যাপার বাদে, তখনকার দিনে কোমরে পিস্তল ঝোলানো ফ্যাশনের অপরিহার্য অংশ ছিলো, শান্তিবাদী টোয়েন কাউকে হত্যা করেননি, করার প্রবৃত্তিও ছিলো না, তাই তিনি নিরস্ত্রই রয়ে গেলেন ।
পর্ব-৭
স্যামের কাজ ছিলো সারাদিন শহরের আনাচে কানাচে, স্যালুনে, স্টেজস্টেশনে ঘুরে গরম খবর যোগার করা
। ব্যাপারটা তেমন কঠিন ছিল না একদিক থেকে, রোজই খবর আসত নতুন কমস্টোক, ওফির এলাকা থেকে নতুন সোনা বা রুপার রিজার্ভ আবিস্কার হয়েছে, মানে গতকালের কোন ভবঘুরে আজকের কোটিপতি, আর মাতলামি আর মারামারির কোন অভাব ছিল না শহরে । আর পাহাড়ের ধারে নতুন গোরস্তানটার প্রথম ছাবি্বশটা কবরই গোলাগুলিতে নিহত ব্যক্তিদের ! তবে খবরের অভাব থাকলে আজগুবি খবর বানানোর পুরনো দুষ্ট বুদ্ধি (হ্যানিবালের পারিবারিক কাগজটা চালানোর মতো) মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো স্যামির মধ্যে ।হঠাত একদিন টেরোটোরিয়াল এন্টারপ্রাইজের পাঠকরা পড়লো, নেভাডার মরুভুমিতে এক প্রাগৈতিহাসিক মানুষের ফসিল হয়ে যাওয়া দেহাবশেষ পাওয়া গেছে , এবং হামবোল্ট থেকে একশো মাইল হেঁটে করোনার এসেছেন এর ময়না তদন্ত করতে । ব্যাপারটা একশোভাগ স্যামের পেট বানানো, কিন্তু টোপসহ বঁড়শি গিলে ফেললো অনেক কাগজ, সানফ্রানসিস্কো কুরিয়ার শুধু খবরটাই ছাপেনি, বেশি চালাকি করে তারা প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ননা হিসেবে তাদের পত্রিকার প্রথম পাতায় গুহামানবের একটা স্কেচও জুড়ে দিয়েছিলো !
এখানে থাকতেই ১৮৬৩ সালে স্যামের লেখক জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনাটা ঘটলো, তিনি মার্ক টোয়েন ছদ্মনাম নিলেন । আসলে সেযুগে সাংবাদিকদের কিংবা রম্য লেখকদের ছদ্মনাম নেয়াটা একটা রেওয়াজ ছিলো । আর স্যাম দেখলেন তাঁর লেখাগুলো যত্রতত্র নকল হচ্ছে । অতএব আর্টিকলগুলো "সাইন" করার সিদ্বান্ত নিলেন তিনি 'মার্ক টোয়েন' নামে । আসলে এই ছদ্মনামটার দুটো ব্যাঞ্জনা আছে, একটা হচ্ছে অন্ধকার রাতে নদীর স্টিমারের সামনের গলুইতে পানি মাপতে থাকা খালাসির মার্ক টোয়েন ..মার্কটোয়েন... (দু ফ্যাদম বা বারো ফুট পানি ) এ ডাক হুইলে দাঁড়ানো পাইলটের কানে মধুবর্ষন করে, মার্ক টোয়েন মানে জাহাজ নিরাপদে চলতে পারে এখানে, একথা যাঁরা এই লেখক সম্বন্ধে একটু পড়েছেন তাঁরাই জানেন । কিন্তু আরো একটা ব্যাপারটা হচ্ছে যেটা অনেকেই জানেননা সেটা হচ্ছে মার্ক টোয়েন ছদ্মনামটা কিন্তু মৌলিক নয় ! নিউ অর্লিয়ান্সের বাসিন্দা মিসিসিপি স্টিমার রুটের ক্যাপ্টেন ইসাইয়া সেলার্স শখের লেখক হিসেবে মার্ক টোয়েন ছদ্মনামটা ব্যবহার করেছেন ১৮৪০-১৮৫০ পর্যন্ত । সে যাহোক, স্যামুয়েল ল্যাংহর্ন ক্লিমেন্স নিজেও তো পাইলট ছিলেন মিসিসিপিতেই, অতএব এ জাহাজী বুলি ছদ্মনাম হিসেবে ব্যবহার করার অধিকার স্যামের খানিকটা আছে ।
তবু কেউ কেউ মনে করেন পাইরেসি ঠেকাতে গিয়ে নিজেই পাইরেসির অবতারণা করেছেন স্যাম ক্লিমেন্স । ১৮৬৩ সালের ফেব্রুয়ারির ২ তারিখে প্রথম মার্ক টোয়েন নামটা ব্যবহার করলেন স্যাম ক্লিমেন্স, এরপর আমৃত্যু এ নামটাই ব্যাবহার করেছেন তাঁর সমস্ত লেখায়, পৃথিবীর অধিকাংশ লোক এখনও তাঁকে এই রোমান্টিক মার্ক টোয়েন ছদ্মনামটা তাঁর আসল নাম স্যামুয়েল ল্যাংহর্ন ক্লিমেন্স থেকে বেশি চেনে ।
আগেই বলেছি স্যাম ক্লিমেন্স শান্তিপ্রিয় লোক ছিলেন, নিরস্ত্র অবস্থায় খনিশহর ভার্জিনিয়া সিটির রাস্তায় ঘোরাফেরা করতেন । কিন্তু কিভাবে তিনি ডুয়েল লড়ার মতো ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়লেন ভাবতে অবাক লাগে ।
১৮৬৪ সালের এপ্রিলের শেষের দিকে সপ্তাহ খানেকের জন্য টেরিটোরিয়াল এন্টারপ্রাইজের মালিক/সম্পাদক জোসেফ গুডম্যান সান ফ্রানসিস্কোতে ছূটি কাটাতে গেলেন স্যামকে সম্পাদনার অর্থাৎ সম্পাদকীয় লেখার ভার দিয়ে । ২৩ শে এপ্রিল ১৮৬৪ তারিখে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের তিনশোতম জন্মবার্ষিকী, হাতের কাছের একটা এনসাইক্লোপেডিয়া থেকে শেক্সপিয়ার সম্বন্ধে বেশ কয়েক প্যারা টুকে দিয়ে দিলেন । কিন্তু শেক্সপিয়ারের জন্মদিন তো রোজ আসে না, এক অলস দুপুরে লেখার কিছু না পেয়ে ভাবলেন, হ্যানিবালের থাকার সময় প্রতিদ্বন্দী পত্রিকাকে আক্রমন করার পদ্ধতিটা কাজে লাগালে কেমন হয় ? তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী ভার্জিনিয়া ইউনিয়ন পত্রিকার প্রকাশক লেয়ার্ডকে (ইউনিয়ন পত্রিকার সম্পাদক টম ফিচ ও তখন ছুটিতে ছিলেন, প্রকাশককে চেয়ারে বসিয়ে) আক্রমন করে একটা প্রবন্ধ লিখে ফেললেন । লেয়ার্ড প্রথমে পাত্তাই দিলেন না, তারপর এমন একটা পাল্টা প্রবন্ধ লিখলেন স্যাম ক্লিমেন্সের চরিত্র সম্বন্ধে, যে মনে হোল রিভলভারের একটা গুলি বুঝি শোঁ করে কানের পাশ দিয়ে চলে গেল ।
পর্ব-৮
আস্তে আস্তে দুই পত্রিকার বা বলা ভাল, সম্পাদক/প্রকাশকের কাজিয়া জমে উঠল, অবশ্য ব্যাপারটা শুরুতে কলমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, স্যাম আর লেয়াডের্র অতি-উৎসাহী বন্ধুরা এই আগুনে ঘি ঢালতেন
। সেকালের রেওয়াজ ছিলো এরকম ব্যাপারে একপক্ষ বেশি বাড়াবাড়ি করলে অন্য পক্ষ ডুয়েলের আহ্বান করতেন ।লেয়ার্ড শিষ্টাচারের সীমা ছাড়িয়ে গেলে (খুব সম্ভব মার্ক টোয়েনকে ঘোড়াচোরের ছেলে বা ঐ জাতীয় কোন বাড়াবাড়ি সম্বোধন করেছিলেন লেয়ার্ড !!), স্যামের বন্ধু স্টিভ গিলিস স্যামের হয়ে ডুয়েলের চ্যালেঞ্জ জানালেন (স্যাম কে না জানিয়ে !)
। প্রথম বার লেয়ার্ড উত্তর দিলেননা, দ্বিতীয়বারও না, এন্টারপ্রাইজ কর্মীরা বেশি বাড়াবাড়ি করলে লেয়ার্ড দিনক্ষন ঠিক করে দিয়ে চ্যালেঞ্জ গ্রহন করলেন ।স্যামের বন্ধুরা এসে জানালেন তাঁরা কি করে ফেলেছেন ! রাজি না হলে, স্যাম ভেবে দেখলেন এই শহর ছাড়তে হবে (ইজ্জত কা সওয়াল!)
। আর রাজি হলে জান নিয়ে টানাটানি ।মার্ক টোয়েন ঘটনাটা এতো কেলেংকারিজনক মনে করতেন যে বহুকাল এব্যাপারে তিনি কাউকে কিছু বলেননি বা লেখেননি
। তেতাল্লিশ বছর পর ১৯০৬ সালে নিরবতা ভেঙে মাই অটোবায়োগ্রাফি তে লিখলেন ।আমার বন্ধুরা এতো খুশি হলেন যে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়, তাঁরা আমাকে নিয়ে গিয়ে উইল করালেন, এতে আমার দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে গেলো, ভোর পাঁচটা এই ট্র্যাজেডির জন্য নির্ধারন করা হয়েছে, কিন্তু আমাকে যেতে হবে ভোর চারটায়, কারন রিভলভারটা কিভাবে ধরতে হয়ে তা জানা নেই আমার (!?!)
।শহর থেকে মাইল দুই দুরে একটা খামারবাড়ির পাশে একটা পাহাড়ী খাদে চাঁদমারি বানালাম আমরা
। খামারবাড়ির বাইরের ঘরের একটা দরজা আর বেড়ার একটা খুঁটি তুলে নিয়ে এলাম টার্গেট প্র্যাকটিসের জন্য , খামারের মালিক তখন সেখানে ছিলেননা তাই না বলেই নিয়ে নিলাম। পাহাড়ের ঢালে দরজাটা রেখে তার উপর খুঁটিটা রাখা হোল ।গুলিভর্তি একটা রিভলভার আমার হাতে দিয়ে বলা হোল খুঁটিটায় লাগাতে, চেম্বার খালি করে করে ফেললাম কিন্তু একটা গুলিও খূঁটি তো দুরের কথা দরজাতেও লাগলো না
। আবার চেষ্টা করলাম ফলাল তথৈবচ, যে দুয়েকটা গুলি যে দরজায় লাগলো তাই ভাগ্য মনে হোল ।ওদিকে পাশের একটা খাদ থেকেও গুলির আওয়াজ ভেসে আসছিলো, লেয়ার্ড গুলি ছোঁড়ায় খুবই পটু, কিন্তু তবু শানিয়ে নিচ্ছিলেন
। আমি দমে গেলাম, মনে হোল আমার জীবনের বোধহয় এটাই শেষ সুর্যোদয়, কেমন করে এতে জড়িয়ে পড়লাম ভেবে আশ্চর্য হয়ে গেলাম ।আমার আনাড়িপনায় বন্ধু স্টিভ গিলিসের ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো, আমার হাত থেকে পিস্তলটা কেড়ে নিয়ে প্রায় তিরিশ গজ দুরে ঝোপের ওপর বসা একটা ছোট্ট চড়ুই পাখির মাথা উড়িয়ে দিলো, সেই মুহূর্তে লেয়ার্ড আসছিলেন এদিকে আমি কেমন মকশো করছি দেখতে
।'
কে মারল পাখিটা?'আমি কিছু বলবার আগেই স্টিভ বললো
'ক্লিমেন্স মেরেছেন''
'আচ্ছা চমতকার টিপ, আচ্ছা সবসময়ই কি তিনি এরকম পিস্তল চালান?'
'তা পাঁচটা গুলি করলে চারটাই এরকম লেগে যায়'
লেয়ার্ডকে খুব চিন্তিত মনে হোল, দ্রুত কেটে পড়লেন সংগীদের সাথে নিয়ে তিনি
। শিগগিরই নিজের হাতে লেখা চিঠি এলো লেয়ার্ড লড়তে রাজি নন । ভুল বোঝাবুঝিটা একান্তই লেখালেখি সংক্রান্ত, সেভাবেই মিটিয়ে ফেলতে পারলে তিনি খুশি হবেন ।'
পর্ব-৯
বন্ধু স্টিভই যত নষ্টের গোড়া কিন্তু স্টিভের চালাকির জোরেই স্যামের জান ও মান দুই ই বেঁচে গেলো, কিন্তু তিনি বা তাঁর বন্ধুরা জানতেননা নেভাডায় একটা নতুন আইন হয়েছে তাতে কাউকে ডুয়েল লড়া বা ডুয়েলের চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য দু'বছর জেল হতে পারে
। হঠাত স্যাম আর স্টিভের মনে হলো নেভাডা বড় নিরস জায়গা, এমন জায়গায় মানুষ থাকতে পারে? সিয়েরা পর্বতের ওধারেইতো (ক্যালিফোর্নিয়ায়) বাস করার জন্য অনেক ভালো ভালো জায়গা আছে ।যেই ভাবা সেই কাজ, চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই তিনি আর স্টিভ স্টেজকোচে চড়ে বসলেন
।প্রশান্ত মহাসাগরের তীরের এই সুন্দর শহরটির প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গেলেন ।যদিও রাফিং ইটে বইতে একটু মৃদু খোঁচা দিয়েছেন তিনি, দোষের মধ্যে এখানকার পুলিশ খুব বদ আর মাঝে মাঝে ভূমিকম্প হয় ! সেইসময় ১৮৬৪ সালে সান ফ্রানসিস্কোর সবচেয়ে বড় সাহিত্যিক আকর্ষন ছিলো চার্লস হেনরি ওয়েবের 'দ্য ক্যালিফোর্নিয়ান' পত্রিকাটা
।এই পত্রিকাটা ঘিরে জমে উঠেছিলো ব্রেট হার্ট, প্রেন্টিস মালফোর্ড, চার্লস ওয়ারেন স্টোডার্ড, জোয়াকুইন মিলার, আর্টেমাস ওয়ার্ড আর অবশ্যই মার্ক টোয়েনের আড্ডা
। টোয়েন এতোকাল বাইরে থেকে লেখা পাঠাতেন, এবারে সরাসরি শরিক হলেন ।এদের মধ্যে একমাত্র মার্ক টোয়েনেই সবচেয়ে বিশ্ববিখ্যাত হবেন, কিন্তু কাছাকাছি আসবেন ফ্রান্সিস ব্রেট হার্ট, 'ক্যালিফোর্নিয়ানের' সম্পাদক
। আরো একটা পত্রিকা ছিলো নাম করার মতো সেখানে, গোল্ডেন এরা আর কর্নেল ম্যাককম্বের 'আল্টা ক্যালিফোর্নিয়া ' । এ দুটো কাগজেও লেখা দিয়েছেন টোয়েন ।হার্ট সম্পাদক হবার পর মার্ক টোয়েনকে প্রতি প্রবন্ধ পিছু বারো ডলার সন্মানীতে 'ক্যালিফোর্নিয়ানের ' নিয়মিত প্রদায়ক হিসেবে নিয়োগ করলেন
। তখনকার দিনে বারো ডলার সন্মানীর কথা কেউ শোনেইনি, তার ওপর তিনি পুরনো কাগজ টেরিটোরিয়াল এন্টারপ্রাইজের সান ফ্রানসিস্কো প্রতিনিধি হয়ে গেলেন । সপ্তাহে তিরিশ ডলার পেতেন 'লেটার ফ্রম সানফ্রানসিসকো ' লেখার জন্য ।কিন্তু সমস্যা দানা পাকিয়ে উঠলো সান ফ্রানসিস্কোতেও
। এখানকার পুলিশবিভাগের দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারের কথা তিনি এতো অকপটে লিখতেন, যে এন্টারপ্রাইজের কপি সিয়েরাপর্বত পেরিয়ে এদিকে আসলেই টাউনহলে হাউকাউ শুরু হয়ে যেতো ।সান ফ্রানসিস্কোর পুলিশ কমিশনার যে মানহানির মামলা দায়ের করে ছিলেন এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে সেটা ক্যালিফোর্নিয়ায় এন্টারপ্রাইজের কাটতি বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছিলো
। কিন্তু মাঝখানে এমন একটা ঘটনা ঘটলো যে স্যামের ওপর সরাসরি বিপদ নেমে এলো ।
পর্ব-১০
স্টিভ গিলিস সর্বদাই দুর্বলের বন্ধু, একদিন পথ চলতে গিয়ে দেখলেন রাস্তায় এক তরুনের উপর চড়াও হয়েছে তিন মাস্তান, আস্তিন গুটিয়ে নেমে পড়লেন লড়াইতে
। স্টিভ এমনিতে রোগাপটকা মানুষ, ওজন মাত্র পঁচানব্বই পাউন্ড , কিন্তু ক্ষেপে গেলে ভয়ংকর হয়ে উঠতেন ।হাতাহাতি শেষ হবার পর দেখা গেলো এক মাস্তান হাসপাতালে যাবার জন্য তৈরি হয়ে সটান রাস্তার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে, বাকি দুটো অবস্থা সুবিধের নয় ভেবে লম্বা দিয়েছে
। বীরের সন্মান পাওয়া উচিৎ ছিলো স্টিভ গিলিসের, কিন্তু জুটলো হাতকড়া আর হাজতবাস, জানা গেল মাস্তান তিনটে ছিলো সান ফ্রানসিস্কো পুলিশের "সোর্স", বড়কর্তাদের পেয়ারের লোক ।মার্ক টোয়েন নিজে গিয়ে জামিন দিয়ে ছাড়িয়ে আনলেন স্টিভকে, বললেন স্টিভকে দিন কয় যদ্দিন না এদিকতা ঠান্ডা হচ্ছে ততোদিন নেভাডায় গিয়ে থাকতে, তারপর সান ফ্রানসিস্কো পুলিশের উর্ধতন চতুর্দশ পুরুষ উদ্ধার করে একটা আর্টিকল লিখে দিলেন এন্টারপ্রাইজে,
।এ মামলা যে কোর্টে উঠবেনা এব্যপারে তিনি নিশ্চিত ছিলেন
। এবং সাথে সাথেই পুলিশ শমন জারি করলো টোয়েনের বিরুদ্ধে, যে জামিনপ্রাপ্ত আসামীকে স্টেটলাইন (প্রাদেশিক সীমা )পার হতে সাহায্য করেছেন, পুলিশের শমনে এও ছিলো অভিযুক্ত ব্যাক্তির সমস্ত ব্যাক্তিগত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে, । গ্রেফতার হয়ে যেতেন তিনি এবং ওরাইওনের উপহার দেয়া সাধের সোনার পকেটঘড়িটা যে মার যেতো তাতে কোন সন্দেহ নেই ।যদি না স্টিভের ভাই জিমি গিলিসের সাথে রাস্তায় দেখা না হয়ে যেতো, জিমি সোজা মার্ক টোয়েনকে টুলাম পাহাড়ের ধারে অয়্যাঞ্জেল'স ক্যাম্প এলাকায় তাঁর লগকেবিনে নিয়ে গেলেন
।জ্যাকাস হিলের উপর জিমির কেবিনে ব্রেট হার্ট সহ অনেক সাহিত্যিক আতিথ্য গ্রহন করেছেন, সত্য বলতে কি এখানেই হার্ট তাঁর পৃথিবীবিখ্যাত ছোটগল্প লাক অভ দ্য রোরিং ক্যাম্প লেখেন
। জিমি এখানকার পরিত্যাক্ত খনি গুলোতে সোনা-রুপা খুঁজে বেড়াতেন, তাঁর নিজেরও একটা ছোট্ট খনি বা পকেট ক্লেইম ছিলো ।সান ফ্রানসিস্কো থেকে চিঠি এলো পুলিশ বিভাগ ব্যাপারটা ভুলে যেতে প্রস্তুত
। টোয়েন ফিরে গল্প লেখায় হাত দিলেন, টুলাম পাহাড়ে থাকার সময় ইলিনয় থেকে আসা এক অবসর প্রাপ্ত মিসিসিপি নদীর পাইলট বেন কুনের সাথে হয় মার্ক টোয়েনের ।কুন একটা ব্যাঙের গল্প বলেছিলেন টোয়েন কে, যেটা মার্ক টোয়েন তাঁর নিজস্ব ভাষায় পরে গল্পে রুপান্তরিত করেন, ব্যাপারটা বিশ্ব সাহিত্যে গুরুত্বপুর্ণ, কারন এই গল্পের সাথে সাথে সাংবাদিক মার্ক টোয়েন, সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন হবার পথে প্রথম ধাপ অগ্রসর হলেন
। ১৮৬৫ সালের ১৮ ই নভেম্বর ছাপা হোল 'দ্য সেলিব্রেটেড জাম্পিং ফ্রগ অভ ক্যালাভেরাস কাউন্টি', সে যুগের আমেরিকার সবচেয়ে বিদগ্ধ সমালোচক, বোস্টনের জেমস রাসেল লোয়েল পড়ে বললেন এ গল্প এ সময়ের সেরা রম্য রচনা ।